#তুমি_আসবে_বলে
#হুমাইরা_হাসান
পর্বঃ ১১-১২
চারিদিকে নিঃস্তব্ধতা। পানির ট্যাপের টুপটাপ ফোঁটার শব্দ কানে বাজছে। আনমনে কোনো প্রতিক্রিয়া হীনা তাকিয়ে আছে আয়নার দিকে। বুকের বা পাশের শার্টের কুচকে যাওয়া অংশ টাতে হাত রাখলো। এখানেই খামচে ধরেছিলো মেয়েটা, ওই নরম আঙ্গুলের ছোয়া পেয়ে শক্ত প্রসস্থ বুকটা যে বেহায়া পানা শুরু করেছে, তার যন্ত্রণায় সারা শরীর যেনো হিম হয়ে আছে। কেনো যানি খুব টানছে,মেয়েটির কথা,হাসি,চোখ মুখ সবকিছু। ছোট্ট চেহারাটা বারবার দেখার উৎকণ্ঠা জাগছে।
মেঘ ভুল করেছে, ভীষণ ভুল। কি করে পেরেছিলো এমন একটা মেয়েকে না বুঝে সবার সামনে থা’প্পড় দিতে। মেয়েটার মানসিকতা চিন্তাভাবনা এতোটা সুন্দর স্পষ্ট সেটা তখন তার কথা শুনেই বুঝেছে। চেহারা টায় কেমন অদ্ভুত মায়া আর নিষ্পাপ জুড়ানো।
এসে থেকে বাথরুমের আয়না টার সামনে দাড়িয়ে হাজারো চিন্তাভাবনায় বুদ হয়ে আছে মেঘালয়, ইদানীং কেমন খাপছাড়া লাগে নিজেকে। নাহ এসব ভাবলে চলবে নাহ। ঘাড় দু পাশে ঘুরিয়ে ট্যাপ ছেড়ে চোখে মুখে পানির ছিটা দিতেই গলার পেছনে দিকটায় কেমন জ্বলন ধরে উঠলো,হাত দিয়ে স্পর্শ করতে বুঝতে পারলো জ্বলন টা। আয়নাতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতেই নজরে আসলো স্পষ্ট তিনটা নখের আচর, পালক কে গাড়ি থেকে নামানোর সময় ই মেয়েটা খামচে ধরেছিলো। আজ কাল যেনো সবকিছুতেই মেয়েটাকেই পাচ্ছে মেঘ।
বারকয়েক পানির ঝাপটা দিয়ে মুখ ধুয়ে,একবারে শাওয়ার নিয়ে বেরোলো মেঘ। এই দুইদিনে অনেক গুলো প্রজেক্ট পেন্ডিং পরে আছে,এখন সব কমপ্লিট
করতে হবে, মাথা মুছে ল্যাপটপ নিয়ে বসে পরলো।
____________________
-পালক কি খেতে চাস চট করে বলে ফেল তো আমি আর তোর আন্টি রান্না করবো
আমাদের দুজনের ফাঁকা ঘরটা আজ লোক সমাগমে ভরপুর। রাফাত,নিবি,আদ্রি, আরশি শিমু,রুচি আপু সবাই তো আছেই সাথে মামনী আর আঞ্জু আন্টিও, রুচি আপুর বাবা আর রমজান আংকেল ও এসেছিলেন,কিছুক্ষণ আগেই তারা বাহিরে গেলেন। অসুস্থ হয়ে এভাবে সকলের আদর পেতে মন্দ লাগছে নাহ, এই মুহুর্তে আব্বু আম্মুর কথাও ভীষণ মনে পরছে, তাদের সাথে কথা ঠিকি হয়েছে তবে অ্যাক্সিডেন্টের কথা জানায় নি,আমি চাইনা উনারা টেনসন করে অসুস্থ হোক।
মামনীর কথায় বললাম
-তুমি এতো ব্যস্ত হয়ো না তো,তোমরা যা খাবে আমিও তাই খাবো
পাশ থেকে রাফাত বলে উঠলো
-কিন্ত আমিতো নুডলস খাবো আফু,তুই রান্না করে দে না
লেও ঠেলা,এই ছেলে কোনোদিন ও সুধরাবে নাহ,রাফাতের কথা শুনে রান্নাঘর থেকে আন্টি খুন্তি হাতে বেরিয়ে বললেন
-এই যে হাতের এইটা দেখতে পাচ্ছো তো? এইটার বা’রি খাবা তুমি যদি ওকে বিরক্ত করেছো
আন্টির কথায় রাফাতের চুপসে যাওয়া মুখ দেখে সবাই হাহা করে হেসে উঠলাম। নিবিড় বললো
-রাফফ বেবি খাবা না নুডুউউলস
নিবিড়ের ব্যঙ্গ করায় রাফাত রেগে টিভির রিমোট ছুড়ে মারে, নিবিড় সরে গেলে ওটা গিয়ে লাগে আরশির মুখে।
-ও মা গোওও,রাফাইততা রে আমার নাক ফাডাই দিছে রে। এবার আমারে হ্যান্ডু আরাব কেমনে বিয়া করবো রে
বলেই উঠে এসে ধপ করে রাফাতের পিঠের উপর কিল বসায়
-তোরা মারামারি থামা প্লিজ, রাফাতের হয়ে আমি সরি বলছি আরশি,প্লিজ গ্যাঞ্জাম করিস নাহ
শিমুর কথায় আরশি বলে
-এহ আইছে মাতাজি এর হয়ে ওর হয়ে সরি বলতে। কিসের গ্যাঞ্জাম হ্যাঁ? আমাদের কথা তোর গ্যাঞ্জাম মনে হয়?
নিবিড় পাশ থেকে বলে
-আমাদের কথা মনে হয়না,কিন্তু তোর কথায় মনে হয়,তুই এমন বিশ্রি ভাবে কথা ক্যামনে কস রে আরু। তোর বাপ মায় কি তোরে কথাটাও শিখায় নি? সব তো আমরাই মানুষ করলাম,আমি না থাকলে তো তোরে মানবসমাজ থেকে বহিষ্কার করতো
-তোর সাথে থাকার জন্য কোনদিন আমারে বহিষ্কার করবে
-হইছে থাম তোরা,সবসময় এতো ঝগড়া কিভাবে করিস বল তোহ
শিমুর এসব বাণী শুনতে মন চাই ওরে ছুড়ে ফেলে দেয়, বা হাতটা তুলে ঠাস করে বসাইলাম মাথার উপর
-ক্যান রে,তোর সমস্যা কি তোরে তো কেও জ্ঞান দেওয়ার জন্য ডাকেনি।
শিমু কিছু বলতে নিলেই ওর ফোন বেজে ওঠে, ফোনটা হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে যায়।
এর মাঝে আন্টি সবার জন্য কফি আর নাশতা নিয়ে এলো। সবাই একসাথে বসে গল্প করছি আর খাচ্ছি। মিষ্টি আমার কোলে এসে বসেছে। ওর আম্মু অনেক জোর করলো কিন্তু ও আমার কাছ থেকে যাবেই নাহ আর আমিও দেইনি। বাচ্চাটাকে রাখতে আমার বেশ লাগে।
ওর হাত থেকে একটা চিপস নিয়ে রাফাত মুখে দিতেই ওরে ঠাস করে একটা থা’প্পড় লাগিয়ে দেই মিষ্টি।
-তাফাত একটা চুর
মিষ্টির তোতলানো আর রাফাতকে চোর বলা দেখে সবাই হেসে উঠলাম।
রাফাত গালে হাত দিয়ে বললো
-মিষ্টি তোরে না বলছি আমায় তাফাত বলবি নাহ,তুই তাফাত
-তুমি তাফাত। তাফাত চুর তাফাত
বলেই হিহি করে হেসে উঠলো, সাথে আমরাও,
এসবের মাঝে খেয়াল করলাম অনেক্ক্ষণ হলো শিমু আসেনি। এদিক ওদিক তাকাতে দেখি মুখটা কালো করে আসছে
শিমু কে দেখেই রুচি আপু বলে
-শিমু কই ছিলি এতোক্ষণ, আই আই বস
শিমু কোনো শব্দ না করে চুপচাপ বসলো।ওর কালো মুখ দেখে আপু জিগায়
-কি হয়েছে শিমু,তোকে চিন্তিত লাগছে কেনো।কে ফোন করেছিলো?
আপুর কথায় শিমু মন খারাপ করে বলে
-আসলে আম্মু ফোন করেছিলো। শরীর নাকি খুব খারাপ করেছে আমাকে দুদিনের জন্যে হলেও যেতে বললো।
ওর কথা শুনে বললাম
-তোর কালই যাওয়া উচিত শিমু,আন্টিকে অবস্থায় একা রাখা মোটেও উচিত হবে না
আমার কথা শুনে অন্যেরাও একই কথা বললো।
শিমু মুখ টা ছোট করে বললো
-হ্যাঁ তা তো যাওয়া উচিত কিন্ত,তুই অবস্থায় একা কি করে থাকবি। ডাক্তার তো তোকে মিনিমাম দুদিন বেড রেস্টেই থাকতে বলেছে
-সেকি শিমু,আমাদের কি চোখে পরে না তোমার,তুমি এ নিয়ে চিন্তা করছো,আমরা এতো গুলো লোক কি জন্যে আছি
আঞ্জু আন্টির কথা শুনে রাফাত ও বললো
-ঠিকি তো,তোর সব জাগায় বলদামি।আমাগো কি তোর মনে ধরে নাহ নাকি। আমরা সবাই তো আছি,আফুকে আমরাই দেখে রাখবো
-কে কি দেখে রাখবে পরের ব্যাপার,শিমু তোমার তাড়াতাড়িই কুমিল্লা ফেরা উচিত। আর আফুর কথা যদি বলো,তাহলে এ ব্যাপারে আমি কারো কথাই শুনবো নাহ,ও এই দুইদিন আমার সাথে আমার বাড়িতেই থাকবে
মামনীর কথা শুনে নিবিড় বললো
-তাহলে তো কোনো চিন্তায় নাই,রোজ আফুকে দেখতে এসে আন্টির হাতের মজার মজার রান্না খাওয়া যাবেই
আদ্রিশের কথা সবাই মজাচ্ছলে নিলেও আমি কিছুটা ইতস্তত করে বললাম
-তুমি কেনো শুধু শুধু কষ্ট করবে মামনী, আমি সামলে নেবো
-তুমি একদম চুপ থাকো মেয়ে, সামলে নেবে। দুদিন যদি বিছানা থেকে একা একা পা টাও নিচে নামাও তো একটা মাইর ও মাটিতে পরবে নাহ। মামনীর কাছে থাকতে কি অসুবিধা হ্যাঁ, আমায় কি আপন লাগে না?
-এমা কি বলছো। তুমি তো আমার ফেভারিট মামনী। আমিতো বলছিলাম তোমার অনেক কষ্ট হয়ে যাবে তাই
-সেসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে বলেছি? খালি পাকা পাকা কথা। সারাদিন একাই তো থাকি,তুই থাকলে আমার কতো ভালো লাগবে, একই তো বাড়ি শুধু কয়েক সিড়ি উপরে থাকবি। তোর ও একা থাকতে হবে নাহ আমারও ভালো লাগবে খুব
মামনীর কথা শুনে আরশি বললো
-তাহলে তো হয়েই গেলো৷ শিমু তুই ফটাফট কাল কেটে পর, আফুকে তো আন্টিই রাখবে এ সুযোগে আমরাও এসে আন্টির ইয়াম্মি রান্না খেয়ে যাবো।
আরও কিছুক্ষণ নানান কথা বার্তা বলে, বেশ রাত করেই নিবিড় আরশি আদ্রিশ ফিরে গেলো। রুচি আপু আজ আমাদের সাথেই থাকবে। আন্টিরা চলে যেতে আমরাও শুয়ে পড়লাম। কড়া ডোজের ওষুধ খাওয়ার ফলে খুন তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে গেলাম
___________________
পরদিন সকালে শিমুর ডাকে ঘুম ভাঙলো, উঠে দেখি ৯ টা বেজে গেছে, অথচ একটু টের ও পাইনি, সবই ওই হাফ ইঞ্চি ওষুধ এর ফল।
উঠে আমায় ফ্রেশ করিয়ে নাস্তা দিয়ে রেডি হলো শিমু। ১০ টা নাগাদ ওর বাস। রেডি হয়ে বেরোনোর সময় মুখ টা এইটুকু করে রেখেছে। ওর মন খারাপের কারণ টা আমি জানি। প্রায় ৬ বছরের বন্ধুত্ব আমাদের। দুজন খুব বেশি সময় আলাদা থাকিনি। তার পর এলো বাকি চারজন এদের সাথেও বন্ধুত্বের প্রায় চার বছর। আমাদের চার বছরের বন্ধুত্ব চার যুগ সমান। একে অপরের পরিপূরক হয়ে থাকি,আজ অব্দি কখনও কারো প্রয়োজনে একা ছাড়িনি।
আমাকে বিদায় দিয়ে মন খারাপ নিয়েই বেরিয়ে গেলো শিমু। রাফাত সকালে এসে দেখা করে গেছে,আজকে কেও ভার্সিটি যেতে চাইনি কিন্ত তাদের উপর যে দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তার দরুন যাওয়া বাধ্যতামূলক। তার উপর আমি অসুস্থ, গ্রুপের একজন সদস্য কম থাকলে কাজের চাপ একটু বেশিই। আর মাহফুজ স্যার তো আছেন ই। উনার ক্লাসের নোটস গুলো পরীক্ষায় অনেক বেশিই কাজে লাগে। তাই আমার জন্য এতো গুলো কাজ আটকে যাক আমি চাইনি। জোর করে পাঠিয়েছি।
সকাল বাজে ১০ টা, আমার জামা কাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে আপু নিয়ে গেছে উপরে। এরপর আন্টি আর রুচি আপু এসে আমাকেও ধরে নিয়ে গেলেন।
পাচতালা বিশিষ্ট ফ্লাট হলেও মামনী দের বাড়ির ভেতরটা দুতালা মতো। মানে ভেতরে ডুপ্লেক্স সিস্টেম। বিভিন্ন বিলাশবহুল দামি আর সৌখিন জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো পুরো বাড়িটা,আর তেমনি গুছানো। মামনী সব জিনিস গুছিয়ে রাখতে ভীষণ পছন্দ করে। আমায় নিয়ে বসালো ডাইনিং এ সোফার উপর। এতো বড়ো বাড়িটাতে কি না মামনী সারাদিন একা থাকেন। আংকেল ব্যবসায়ীক কাজে প্রায় ই বাইরে থাকেন। আর উনার ছেলে তো ফিরেছেন ই ছয় বছর পর। এসেও তো বসেছেন অফিস নিয়ে। চৌধুরী গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রির সিইও বলে কথা,হাজারো কাজ উনার। শুনলাম মহাশয় নাকি ৯ টার মধ্যেই অফিসে উপস্তিত হন। আংকেল অবশ্য একটু দেরি করেই যায়।
আমায় নিয়ে বসাতে কিছুক্ষণের মধ্যেই সিড়ি বেয়ে নেমে আসলো একটা হাস্যজ্বল চেহারা। বেশ লম্বা চওড়া গড়নের সুসাস্থের অধিকারি। হালকা গোলাপি রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা প্যান্ট পরিহিত। নিচে এসেই আমার পাশে বসে মাথায় হাত দিয়ে বললেন
-কেমন আছো মা?
-ভালো আছি আংকেল, এখন তো আপনাকে দেখে আরও ভালো হয়ে গেছি।
চওড়া হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,আরও ভালো হতে হবে,শিগগির সুস্থ হতে হবে তো।
আমার সাথে টুকটাক কথা বলে উনিও বেরোলেন অফিসের জন্য।
সারাদিন মামনীর সাথে এটা ওটা নিয়ে গল্প করেই কাটলো,রুচি আপু এসে কিছুক্ষণ থেকে গেছে।রাফাত ফোন করেছিলো একবার। কলে ওরা চারজন ই ছিলো। ওদের ভাষ্যমতে কাজ করে করে নাকি ওদের টিউবলাইট ফেটে যাচ্ছে। আর আরশির লাড্ডু ফুটছে আরাব ভাই কে দেখে। নিবিড় তো হায়হুতাশ করে মরছে ওর কতো গুলা ম্যাচ মিস হয়ে যাচ্ছে এসব কাজের চক্করে। আমায় বললো “আফু তুই শিগগিরই সুস্থ হ,আমার কাজ তোর ঘাড়ে চাপিয়ে আমি খেলতে যাবো”
আরও নানান কথা বলে ঘন্টা পার করেছি
এখন সময়টা বিকেল, আমি আর আন্টি বসার ঘরে বসে টিভি দেখছি আর পাকোড়া খাচ্ছি। এসে থেকে আমায় একটার পরে একটা খাইয়েই যাচ্ছে,কোনো বারণ ই শুনছে নাহ।
এসময় কলিং বেল বেজে উঠলো।মামনী গিয়ে খুলতেই গটগট করে প্রবেশ করলো সিরিয়াস চৌধুরী ওরফে মেঘালয় চৌধুরী। আমি বুঝিনা লোকটা সবসময়ই মুখটা এমন সিরিয়াস করে রাখেন কেনো।
কালো ব্লেজার টা খুলে হাতে ঝুলিয়েছে গায়ের সাদা রঙের শার্ট টার উপরের দুটো বোতাম খোলা, কালো বাদামি মিশ্রনের চুলগুলো এলোমেলো ছড়িয়ে আছে, গটগট পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে, এদিকে যে একটা জলজ্যান্ত আস্ত মানুষ বসে আছে কোনো খেয়াল ই নেই। পেছন থেকে মামনীর ডাকে পা থামিয়ে দাড়ালো। পেছনে ঘুরতেই আমায় এবার নজরে পরলো। উনার দিকেই তাকিয়ে থাকার কারণে আবারও চোখাচোখি হলো নীলাভ চোখ দুটির সাথে।
আমায় দেখে কিছুটা অবাক হয়েছেন হয়তো কিন্ত গোমড়া মুখের অভিব্যক্তি এখনো প্রতিক্রিয়া হীন।
-মেঘ, আমি পালক কে এনেছি আজ। শিমুর মা অসুস্থ বলে ও কুমিল্লায় ফিরেছে দুদিন ও আমার কাছেই থাকবে
-ওহ,আচ্ছা।ঠিকাছে
বলেই আবারও হনহন করে হাটা ধরলো। আচ্ছা গোমড়ামুখো লোক তো। মানুষের বাড়ি কেও আসলে ভালো মন্দ তো জিগাসা করবে,তা নাহ ঠিকাছে বলে হাটা ধরলো। মনে মনে মামনী কে হাজার বার প্রশ্ন করলাম ‘এইডারে কি খেয়ে পেটে রেখেছিলে গো’
এভাবে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত ও হলো। সন্ধ্যার পর রাফাত এসেছিলো কিছুক্ষণ গল্প করেই চলে গেছে কম্পিউটার গেইম খেলবে বলে,আমি পরে রইলাম একা। ঘড়ির কাটা ঠিক ১২ টার ঘরে, মামনী কিছুক্ষণ আগেই আমায় দিয়ে গেলো। দোতালার বাপাশের ঘরটা, দোতালায় তিনটা ঘর। একদম ডান পশের ঘরটাই মেঘালয় চৌধুরীর মাঝের ঘরটাও উনারই। শুনেছি সেখানে তার নানান শখের জিনিস আর বই সাজানো, যে ঘরটাতে সে ব্যাতিত কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ, আর তার পরের ঘরটাতেই আমাকে থাকতে দেওয়া হয়েছে।
এই ঘরটা বেশ বড়ো বড়ো খাট,খাটের সামনেই বড়ো আয়নাটা, ডান পাশে একটা আলমারি বুকসেল্ফ। বুকসেল্ফে হরেক রকমের বই সাজানো। সাইন্স ফিকশন,থ্রীলার,হরর লাভ স্টোরি মিলিয়ে বেশ বিশটা বই তো আছেই।
এতোক্ষন বসে বসে বোর হচ্ছি খুব। ফোনটাতেও চার্জ নেই। এ ঘরের সাথে এট্যাচড বারান্দা। বারান্দা টা দেখতে বেশ বড়োই মনে হচ্ছে, কিন্ত তাতে আমার কি,আমিতো আর উঠে জোৎস্না বিলাস করতে পারবো নাহ। ল্যা’ঙড়া হয়ে পরে আছি তো।
ধুর ভাল্লাগছে নাহ, চোখটা বারবার ডানদিকের বুকসেল্ফ টার দিকেই যাচ্ছে। বই পড়া নিয়ে আমার বরাবরই একটু বেশিই আগ্রহ। তার উপর এতো গুলো বই দেখে আমার ভেতরে ভীষণ অস্থিরতা শুরু হয়েছে,হাতে না নেওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি নাহ। একটা ইংরেজি উপন্যাসের বই দেখা যাচ্ছে,রঙিন মলাটে ঘেরা বইটার নামটা ভালো ভাবে বোঝা যাচ্ছে না,আরেক বইয়ের চাপে ঢাকা পরে আছে,শুধু একপাশে ‘ফিফটি’ শব্দটি দেখা যাচ্ছে। এর আগেও আমি ” beloved,through the looking glass,jane eyre.” নামক বেশ কয়েকটি ইংরেজি উপন্যাস পড়েছি। বেশ ভালোই লাগে আমার। এটার অর্ধেক নাম দেখে পড়ার আগ্রহ টা একটু বেড়েই গেলো।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে ভাবলাম। পায়ের ব্যাথাটা দুদিন ব্যবধানে আগের চেয়ে কম। আর বইগুলোও বেশি দূরে নাহ। এখন তো কেও নেই ও। চুপিচুপি এক পায়ে ভর দিয়ে গেলে কেও টের পাবে নাহ,সকাল হওয়ার আগেই আবার রেখে আসবো।
ব্যাস যা ভাবা তাই কাজ। আস্তে ধীরে বিছানা থেকে বাম পা টা নামালাম, হাতে ভর দিয়ে উঠে ব্যান্ডেজ করা ডান পা টা নামাতেই মুখ থুবড়ে পরে যায়।
এমন আচানক পরার দরুন বেশ জোরেই ধপ করে শব্দ হলো। পা টাতে খুব জোরেই লেগেছে। ব্যাথার চোটে নড়তে পারছি নাহ। মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে আর্তনাদ বেরিয়ে এলো
তখনি ধপ করে দরজা টা খুলে গেলো। চোখ তুলেই দেখি গাঢ় খয়েরি রঙের গেঞ্জি আর ধুসর বর্ণের একটা ট্রাউজার পরিহিত লোকটি দাড়িয়ে। আমায় পরে থাকতে দেখেই ছুটে এলো।
-একি পরে গেলে কি করে, একা উঠতে গেলে কেনো,তোমাকে তো পায়ে ভর দিতে নিষেধ করেছে। এখন তো পায়ের অবস্থা আরও বিগড়ে যাবে, কিছু লাগলে আমায় অথবা আম্মুকে ডাকতে
বলতে বলতে আমায় দুহাতে কোলে তুলে খাটের উপর বসিয়ে দিলো। বাহুডোরের বন্ধন আলগা করে আমায় আবারও জিগাসা করলেন।
-কেনো উঠতে গিয়েছিলে,কিছু লাগবে? ওয়াশরুমে যাবে?
এখন কি বলবো,আমি যদি বলি বই নেওয়ার জন্য উঠেছি তাহলে যদি আবার থা’প্পড় বসিয়ে দেয়,আর উনি দিক বা না দিক মামনী জানলে খুব বকবে
-নাহ আমি কোথাও যাবো নাহ আর কিছু লাগবেও নাহ
-তাহলে উঠতে গিয়েছিলে কেনো
-কি যেনো করতে চেয়েছিলাম,মনে নেই ভুলে গেছি।
-এটাতো নতুন কিছু নয়। জিনিস ভুলে যাওয়া আর ধুপধাপ পরে যাওয়া তো তোমার পুরাতন ব্যামো। মাথার কয়েকটি তারের কানেকশন প্রবলেম আছে।
শেষের কথা টা বিড়বিড়িয়ে বললেও আমি স্পষ্ট শুনেছি।
-আপনাকে বলেছে? আমার মাথার তারের কানেকশন প্রবলেম তা আপনাকে কে বলেছে,বেশি বুঝেন
-আপাতত আমার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে তো তাই দেখছি।
– একটু বেশিই ভুল দেখাচ্ছে আপনার চোখ তাহলে। চোখের ডাক্তার দেখান। নাহলে আপনার গার্লফ্রেন্ড অকালে ছেড়ে যাবে
-আমার গার্লফ্রেন্ড নিয়ে চিন্তা করতে হবে নাহ।সবাই তোমার মতো নাহ
-আমার মতো না মানে কি আমি কাকে ছেড়েছি।
-উফ, এবার বুঝলাম রাফাত এতো ঝগড়া করা শেখে কোত্থেকে। তুমিতো ঝগড়ায় ওর চেয়েও এক কাঠি উপরে।
-কিহ আমি ঝগড়ুটে? আপনি কাল ও একই কথা বলেছেন আমি কিসের ঝগড়া করলাম
-এই যে পাকনামো করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পরলে,আমি না আসলে তো অভাবেই সারারাত পরে থাকা লাগতো,আমি যে হেল্প করলাম আমায় থ্যাংকস না দিয়ে উল্টো ঝগড়া করছো
-হ্যাঁ আমায় উঠিয়ে উদ্ধার করে দিয়েছেন,আমি কি ডেকেছি আপনাকে? যেয়ে চেয়ে সাহায্য করতে কে বলেছিলো। সাহায্য করে খোটা দেওয়া লোক কে কখনও থ্যাংকস বলবো নাহ
-ঝগড়া করা না শিখে একটু দৌড়াদৌড়ি করলেও পারো, পরপর তিনবার ষাট কেজি তুলতে গিয়ে আমার হাত দু’টো ব্যাথা হয়ে গেছে।
-এই আপনাকে কে বললো আমার ওজন ষাট কেজি, আমাকে কি আপনার ভুটকি মনে হয়? আর আমিকি একবার ও বলেছি কোলে নিতে। নিজেই নিয়েছেন আবার আমার ওজন নিয়ে কথা বলছেন । আমার ওজন পঞ্চাশ ও পার হয়নি
-হবে কি করে, এইটুখানি মানুষ, এর চেয়ে বেশি ওজন হওয়া সম্ভব ও নাহ
-আপনি এইটুখানি কাকে বলছেন,আমি মোটেও এইটুখানি নাহ। নিজে তালগাছ ছাড়িয়ে গেছেন বলে কি সবাই তাই হবে। আর তালগাছ ছাড়ালে কি হবে মাত্র পঞ্চাশ কেজি তুলতে পারেন নাহ আবার বড়ো বড়ো কথা
আমার কথা শুনে উনি পকেটে গুজে রাখা হাত দু’টো বের করলেন।ঝুকে এসে আমার দু পাশে দু হাত রেখে বললেন
-আমি কি পারি আর না পারি সেটা না জানায় তোমার সাস্থের জন্য ভালো।
এভাবে হুট করে উনার কাছে আসায় আর এভাবে ধীরে কথা বলায় যেনো সারা শরীরে ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেলো, কোনো রকম থমকে থমকে বললাম
-ক কেন,জানলে কি হবে
-যা তুমি সইতে পারবে নাহ
উনার কথায় কেমন ভয় ভয় করছে, এভাবে কাছে এসে ধীরে মোহনীয় কণ্ঠে আগে কখনো কথা বলিনি।কাপা কাপা হাতে ভর দিয়ে একটু পিছিয়ে যেতে নিলেই উনি আরেকটু ঝুকে এলেন।আরও ধীর কণ্ঠে বললেন
-পিছিয়ে কতোদূর পালাতে পারবে? হুম?
সারা শরীরে বরফ জমে যাচ্ছে আমার,উনি এভাবে কেনো বলছেন,সত্যিই তো এই ল্যা’ঙড়া পা নিয়ে তো দাড়াতেই পারছি নাহ।
-ক কেনো,পালাবো কেনো, কি করবেন
-অনেক কিছুই করতে পারি
ধীরে ধীরে বলা কণ্ঠে বুকে ধুকপুকানির মাত্রা ব্যাপক হারে বেড়ে গেলো। অনেক খানি কাছে থাকার দরুন কথার তালে উনার উষ্ণ শ্বাস আমার মুখে ছড়িয়ে পরছে, উনার শরীর থেকে ভীষণ সম্মোহনী একটা ঘ্রাণ নাকে এসে ঠেকছে। উনিশ বছর বয়সী যুবতীর মনের আন্দোলন গুলো বড্ড খাপছাড়া আর জটিল, না পারা যায় সইতে না পারা যায় পালাতে।
কোনো রকম অস্ফুটে বললাম
-কি করবেন?
-এই যে মাঝরাত। এদিকটাই কেও নেই, মা বাবা নিচের ঘরর ঘুমিয়ে, তোমায় যদি এখন
সারা শরীরে কম্পন ধরেছে আমার,বুকের ভেতর ভাঙচুর শুরু হয়েছে, ধীর কণ্ঠে বলা বাক্য গুলোও বজ্রপাতের মতো বাজছে কানে,আরও অস্ফুটে স্বরে বললাম
-এখন?
উনি কানের কাছে মুখ এনে বললেন
-আমার সাথে ঝগড়া করার শাস্তি স্বরূপ যদি এখন তোমার ঠ্যা’ঙ দুটো ভে’ঙে বস্তায় ভরে ফে’লে দিয়ে আসি কাক পক্ষিও টের পাবে নাহ
উনার কথা শুনে চোখ দু’টো বড়ো হয়ে গেলো যেনো গর্ত থেকে বেড়িয়ে আসবে,তাই তো? এতোক্ষণ তো ভাবিনি,যেই লোক ভরা রাস্তায় থা’প্পড় দিতে পারে, সে এমন নির্জন সুনসান সময়ে খু’ন ও করে ফেলবে আনায়সে। ইয়া খোদা আমি এখনি মরতে চাইনা আমারতো এখনো বিয়েও হয়নি। কাপা কাপা চোখে তাকিয়ে আছি উনার দিকে।
সোজা হয়ে দাড়ালেন। দু হাত আবারও পকেটে গুজে বেশ গম্ভীর মুখ করে বললেন।
-এইটুখানি মাথা। এতো চাপ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। মনের ভেতরের ভুলভাল রেসিপি সকালে বানিও,এখম চুপচাপ ঘুমাও। নাহ তো
সাথে সাথে বললাম
-নাহ তো কি?
-নাহ তো বস্তা পাশের ঘরেই আছে
উনার কথা শুনে ধপ করে চাদর টা গায়ে টেনে শুয়ে পরলাম, চোখ টিপে বুজে আছি আর মনে মনে দু’আ করছি। কোনো ভাবে আজ বেচে যায় কাল কিছুতেই থাকবো নাহ।
আস্তে করে মাথাটা বের করে দেখি এখনো দাঁড়িয়ে শকুন চোখ দু’টো এদিকেই তাকিয়ে আছে,ধপ করে চাদরটা আবারও টেনে নিলাম, লাইট বন্ধ করার শব্দ কানে আসলো, যা খুশি হোক আমি কিছুতেই তাকাবো নাহ,কিছুতেই নাহহ।
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
হীডিংঃ অনেক তো হলো থা’প্পড় ঝগড়া, এবার একটু কেমিস্ট্রি আনা যাক পালক আর মেঘের,কি বলেন? মতামত চাই সকলের,দ্রুত!