তুমি আসবে বলে পর্ব -৪৩+৪৪

#তুমি_আসবে_বলে
#হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৪৩

ফুল দিয়ে সাজানো স্টেজ টাতে পালককে নিয়ে বসালো রুচিতা আর আরশি। প্রথমে গায়ে হালকা কিছু গয়না থাকলেও সেগুলো খুলে চৌধুরী বাড়ি থেকে আসা গয়না গুলো পরিয়ে দিয়েছে তার মা। বিয়েতে শ্বশুড়বাড়ি থেকে আসা তত্ত্ব পরাটাই নাকি নিয়ম। এতো ভারি গহনা সাথে শাড়ি, একেবারেই অভ্যাস না থাকায় বেশ হিমসিম খেতে হচ্ছে পালককে। মিষ্টি বসেছে পালকের কোলে।
বেশ বড় উঠান টা ভর্তি লোকজন। রঙিন মরিচবাতি, ফুলের ঝালরে সাজানো বাড়ির আনাচে কানাচে ভরা লোকজন। এতসব লোকজনের ভীড়েও পালকের মনটা শূন্যতায় খাঁ খাঁ করছে। ভাইয়ের প্রতি ভীষন অভিমান হচ্ছে, এতোই পড়াশোনা যে বোনের বিয়েতে দুদিনের জন্যেও আসতে পারলো নাহ। দুবছর পার হয়েছে ভাইকে দেখে নাহ,জীবনের এমন একটা দিনে ভাই নামক মানুষটাকে ভীষণ মিস করছে পালক।

এর মাঝেই একে একে সবাই এসে উপস্থিত হলো। বাবা মা,মামা মামি, আরশি তার বাবা মা,শিমু,আর বন্ধুদের সাথে ও বাড়ির লোক। সবার এমন উচ্ছ্বসিত হাসি মুখ দেখে পালকও আর বেশিক্ষণ মন খারাপ করে থাকতে পারলো নাহ।
সবার আগে ডাকা হলো পালকের বাবা আর মা কে, দুজন পালকের দুপাশে বসে হলুদ ছুঁয়ে দিলেন মেয়ের গালে। হাসি মুখে পালকের মুখটা ধরে আদর করে দিলেন তারেক হাসান। রুমানা বেগম হাসি মুখে থাকলেও চোখ ভর্তি জলে। মায়ের চোখে জল দেখে পালকের ও চোখ ভরে এলো। পালকের হাতে একটা উপহার দিয়ে কপালে চুমু দিয়ে উঠে গেলেন দুজন৷ একে একে মামা মামি, আরশির বাবা মা, বড়রা সকলে হলুদ ছুঁয়ে দেওয়ার পর, এবার আমার হুরহুর দলের সবগুলো এসে বসলো আমার পাশে।

একে একে সকলে হলুদ ছুঁয়ে দিলো। তিয়াস ভাইয়া এসে আমার পাশে বসে হলুদ ছুঁয়ে বললো

-শালাবাবু কিন্তু অপেক্ষায় আছে কখন তার বউ নিয়ে যাবে, একটা ছবি তো দেওয়াই যায় তাই না।

বলেই ফোন বের করতে নিলে আরশি ছো মেরে ফোন কেড়ে নিয়ে বললো

-একদম নাহ, বিয়ের আগ অব্দি বর কে কনের একটা ছবিও দেখানো যাবে নাহ

-বললেও হলো দেখানো যাবে নাহ,কখন থেকে তোর ঢং দেখতাছি,নিবিড়ের ফোন কাইরা নিয়েছিস,এখন আবারও কোনো তালবাহানা করলে ছুই’ড়া মা’রুম পুকুরে।

পেছন থেকে আরশির মাথার চা’পড় মে’রে বললো আদ্রিশ। ফোনটা নিয়ে তিয়াস ভাইয়ের হাতে দিয়ে আবারও বললো

-একটা মাত্র বান্ধবীর বিয়ে, ছবি না তুললে থাকবে কি গাঁধা।

-ও হ্যাঁ তাই তো, আসলে এটার কথা মনে ছিলো নাহ।

-তা থাকবে কেনো মাথার ভেতর গোবর ভরা,এই তোরে এইখানে কেডা ডাকছে যা তো যাহ থালাবাটি মাজ গা।

রাফাতের কথায় তেঁতে উঠে আরশি বললো

-বরপক্ষের লোক হয়ে, কনের বাড়ি এসে কনেপক্ষের লোকটে অপমান করার সাহস হয় কি করে।

আরশির কথায় রাফাত বেশ ব্যাঙ্গ করে বলে

-এহ আইছে কনেপক্ষ। না তুই কনেপক্ষ না বরপক্ষ, তুই তো বাসন কোসন মাজা পক্ষ। যা সেখানে যাহ ফট

রাফাতের দিকে আরশি তেড়ে আসতে নিলেই আরাব ওদের থামিয়ে বলে

-ওয়েট ওয়েট, কারো ফোনেই ছবি তুলতে হবে নাহ, ক্যামেরাতে তুলি? তাইলেই তো মেঘ ও দেখলো না,আবার ছবিও তোলা থাকলো

-এইতোহ, এতক্ষণে একটা ঝাক্কাস কথা বলেছেন ভাই, ইউ আর বেস্ট ডুড

বলেই আরাবের সাথে হাত মেলালো নিবিড়। একে একে সবাই বসে পালকের সাথে ছবি তুললো। ধ্রুব পালককে হলুদ লাগাতে এসে কানে কানে কিছু একটা বলেই উঠে গেলো, সবাই এতটা খেয়াল না করলেও, সারা এসে বললো

-আপু,ধ্রুব ভাইয়া তোমায় কানে কানে কি বলে গেলো।

সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত থাকায় সারার কথা টা খুব একটা খেয়াল করেনি, ওদের দিকে তাকিয়ে সারাকে চুপ করিয়ে বললাম

-ও কিছুনা, এমনেই মামনীর কথা বললো।

সারাও আর ঘাটেনি ব্যপার টাহ,ওউ সবার সাথে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
খানিক বাদেই রুচি আপু সবাইকে তাড়া দিয়ে বললো

-সবাই জলদি শেষ কর, ফিরতে হবে তো,ওদিকেও তো হলুদ পর্ব বাকি, রাত তো হয়েই গেলো।আর আফুকেও তো মেহেদী পরাতে হবে,রাত হয়ে গেলে ক্লান্ত হয়ে যাবে সবাই

রুচি আপুর কথার পর, রাফাত নিবিড় আদ্রিশ আরও কিছুক্ষণ আমার সাথে কথা বলে গেলো।
আরাব ভাই, তিয়াস ভাই ও বিদায় জানিয়ে গেলো। ধ্রুব ভাই যাওয়ার আগ দিয়ে ইশারা করে আমায় কিছুক্ষণ আগে বলা কথা টা মনে করিয়ে দিয়ে হাঁটা ধরলো। এবার শুধু রুচিতা আপু,আরশি, শিমু, সারা আমি আর আশেপাশের মেয়ে মানুষের ভীড়। হুট করেই আরশি হলুদের বাটিটা নিয়ে বললো

-রাতে মেহেদী কিন্তু আমরা সবাই পরবো।

-হ্যাঁ অবশ্যই,আমিতো দু’হাতে ভরে মেহেদী সাজাবো

আরশির কথায় সারাও উৎফুল্লতা নিয়ে বললো।
আরশি মুচকি হেসে আবারও বললো

-তাইলে মেহেদী তো সবাই পরবো। হলুদ কেনো আফু একা মাখবে,

-এটা কিন্তু একদম ঠিক বলেছিস আরু।

বলেই আরশির হাত থেকে হলুদের বাটিটা কেড়ে নিলো রুচি আপু, আঙুলের মাঝে হলুদ তুলে শিমু, সারা আর আরশির গালে মেখে দিয়ে বললো

-বিয়ের হলুদ ছুঁয়ে দিলাম তোদের ও তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাবে,

বলেই সবাই মিলে হলুদ মাখামাখি শুরু করলো। পাড়ার মেয়েরাও যোগ দিয়ে হাসা হাসি করে খেলা শুরু করলো। ভীড়ে মাঝে হঠাৎ কোমরে আঙুলের স্পর্শে কেঁপে উঠলো পালক। আশেপাশে চেয়ে দেখে কোনো পুরুষ মানুষের উপস্থিতি নেই, কিন্তু পালকের উপস্থিত বুদ্ধি স্পষ্ট বুঝতে পারছে ওটা কোনো পুরুষ মানুষের স্পর্শ। এই স্পর্শ টা তার ভীষণ চেনা,কিন্তু এখানে কিভাবে? কোমর থেকে শাড়ির আঁচল টা সামান্য সরিয়ে দেখতেই ভেতর টা ধক করে উঠলো। স্পষ্ট তিন আঙুলের হলুদের ছোঁয়া লেগে আছে, তার মানে এটা তার ভুল নাহ। হুট করেই মনটা কেমন উঠলো। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ কার হতে পারে। তবে কি?
পালকের ভাবনার মাঝেই সবাই ওকে নিয়ে কলপাড়ে নিয়ে মাথায় পানি ঢেলে গোসল করিয়ে দিলো। ঘরে গিয়ে শাড়ি পালটে, চুলগুলো মুছে বসতেই পেছন থেকে ডাক আসলো

-আসতে পারি?

পেছনে ফিরে সামান্য হেসে উত্তর দিলাম

-আসুন ধ্রুব ভাই।

ধ্রুব ভাই এসে ফোনটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো
-বেশিক্ষণ নিও নাহ কিন্তু, ওরা টের পেলে হুলস্থুল করবে।আমি বাইরেই দাঁড়িয়ে আছি

স্মিত হেসে সম্মতি দিয়ে, ফোনটা কানে ধরেই উঠে দাঁড়ালাম জানালার পাশে।

দুপাশে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কাটলো।সুনসান নিরবতা ভেঙে আমি মৃদু কণ্ঠে শুরু করলাম

-হ্যালো

ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল

-দুটো সপ্তাহ তোমায় দেখিনা, গত তিনদিন ধরে তো ফোনটাও ধরো নাহ, আমার উপর দিয়ে কি যাচ্ছে বুঝো মেয়ে?

চোখ দু’টো পরম আবেশে বন্ধ করে নিলাম। শান্তি, অদ্ভুত শান্তি লাগছে এ কণ্ঠস্বর, যেনো তিনদিন নাহ তিনটা যুগ পরে শুনছি। লোকটার এ ব্যকুল কণ্ঠস্বর আমায় ভীষণ পীড়া দেয়,আর তো মাত্র একটা রাত তবুও কেনো এতো অধৈর্য লাগছে, যেনো জনম জনম দেখা হয়না

-চাঁদ মুখ খানায় অশ্রু কেনো? এই অধম টাকে মনে পরছে?

উনার কথা শুনে এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরালাম

-এইতো, এদিকে বা পাশটার রাস্তার পাশে।

দৌড়ে গিয়ে জানালার পারে দাড়াতেই দেখলাম খানিকটা দূরেই বাড়ি সাথ ঘেঁষে চলা রাস্তাটার পাশেই গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেঘালয় ।এতটুকু দূরত্বে উনার অবস্থান থেকে আমার প্রতিটা পদক্ষেপ স্পষ্ট দেখা যাবে।
ফট করে ঘুরে দাঁড়ালাম,চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে গেলো। হার্টবিট প্রচন্ড ফাস্ট হলো যেনো মিস হয়ে যাবে কয়েকটা। শ্বাস আটকে নিজেকে শান্ত করলাম। লোকটার পাগলামি গুলো আমার ভেতরটা অস্থির করে তোলে।

-এইতো শাড়ির ভাজে বাঁক ধরানো কোমর টা স্পষ্ট। এসেছিলাম তো মুখ খানা দেখতে, কোমর দেখতেও মন্দ লাগছে নাহ

ছিটকে সরে গেলাম জানালার পাশ থেকে
ভরাট কণ্ঠস্বরে আবারও বললো
-আমায় তোমার সাথে কথা বলা থেকে দূরে রাখলো,অথচ সবার মাঝে এসে হলুদ মাখিয়ে গেলাম কেও টের পেলো নাহ

-তার মানে ভীড়ের মধ্যে আপনি..

-মেঘালয় চৌধুরী ছাড়া আর কার সাহস আছে যে নূরের কোমর ছুঁয়ে দেবে।

লজ্জায় কান গরম হয়ে আসছে, খটমট করে বললাম
-আপনি এতোটা বেহায়া কেনো
-তুমি লজ্জাবতী বলে
-অসভ্য
-তোমার অসম্ভব রূপ তো আমায় সভ্য থাকতে দেয়না
-নির্লজ্জ
-তোমার জন্য
-পাগল
-তোমার প্রেমে
-ধ্যাতত!..
বলেই খট করে ফোনটা কেটে দিলাম, উনার প্রতিটি কথায় আমার ভেতরের অন্তস্তল পর্যন্ত নাড়িয়ে দেয়। ওই মোহগ্রস্ত আবিষ্ট কণ্ঠস্বর আমায় মাতাল করে দেয়। সর্ব’নাশ। এই লোকের মাঝেই আমার সর্ব’নাশ দেখতে পাই আমি।

গালে,মুখের হলুদ গুলো ধুয়ে শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে শিমু পালকের ঘরের সামনে আসতেই কেও হাত ধরে এক টানে পাশের বারান্দা টায় নিয়ে গেলো। অস্পষ্ট আলোতেও চেহারা টা চিনতে এতটুকুও অসুবিধা হলো না শিমুর। আমতাআমতা করে বললো

-আ আপনি?
-হ্যাঁ আমি,কেনো অন্য কারো আসার কথা ছিলো?
-না তা নাহ
-তাহলে কি?
-মানে,এভাবে টেনে কেনো আনলেন
-তুমি তো স্বেচ্ছায় আসবে না,তাই টেনেই আনতে হলো।
-কেও দেখলে ব্যপার টা খুব খারাপ ভাবে নেবে, আমাকে যেতে দিন

বলেই পা বাড়াতে নিলেই ধ্রুপ খপ করে শিমুর এক হাত টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে দাঁড় করালো। ধ্রুবের এতোটা কাছে দাঁড়ানোয় শিমুর সারা শরীরে কাঁপুনি ধরেছে, অদ্ভুত এক পুরুষালি গন্ধের মাদকতায় মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ধ্রুব মুখটা কানের কাছে এনে ফিসফিসিয়ে বললো

-মিস করেছি তোমায়।
-হু
শিমু অস্ফুটস্বরে উত্তর দিলো।
-তোমায় ছাড়া থাকতে ভাল্লাগে না একটুও।
-হু
আবারও একইভাবে শিমু উত্তর দিলো। সমস্ত শব্দ এসে কণ্ঠনালিতে আটকে গেছে শিমুর, একটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে নাহ। মেঘপালক আর আরশি আরাবের সাথে এতদিনে তাদের সম্পর্ক টাও সহবত,আর সামাজিকতা থেকে অনেক্ষানি এগিয়েছে। ধ্রুব কথায় কাজে তার অনুভূতি ব্যক্ত করলেও শিমু কোনোরূপ উত্তর করেনি। কি করে করবে,লোকটার সামনে আসলেই তো তার সারা শরীর জমে যায়।

-শুধু কি হু হু ই করবে, এতদিন পরে দেখা হলো,তোমার কি কিছুই বলার নাই

শিমু তবুও নিশ্চুপ হয়ে থাকলো। ধ্রুব কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে, শিমুকে ছেড়ে চলে যেতে নিলেই শিমু পেছন থেকে হাত চেপে ধরে। পা থামিয়ে দাঁড়ালেও ফিরে তাকালো না ধ্রুব। মেয়েটা কেনো সবসময় চুপ থাকে, ধ্রুবের ও তো ইচ্ছে হয় শিমু নিজ মুখে স্বীকার করুক,অনুভূতি গুলোকে ব্যক্ত করুক।
ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ধ্রুবের পিঠ ঘেঁষে দাঁড়ালো শিমু, পেছন থেকে ধ্রুবের সফেদ পাঞ্জাবি টা দু’হাতে খামচে ধরে ধিমি কন্ঠে বললো

-আমিও আপনাকে মিস করেছি।

শিমুর কথায় ধ্রুবের ভেতরে অদ্ভুত প্রশান্তি ছেয়ে গেলো। পুরুষালি মনটার ভেতরে অস্থিরতার দোলাচালে স্তব্ধ হলো। তড়াৎ পেছন ঘুরে দাঁড়াতেই শিমুকে তার ভীষণ কাছে পেলো,একদম বুকটার কাছাকাছি। কাঁপা কাঁপা হাত এগিয়ে শিমুকে এরেকটু কাছে টেনে নিলো। দূরত্ব টা একেবারেই নগন্য। ধ্রুবকে অবাক করে দিয়ে শিমু নিজেই আরও কাছে সরে এলো। এই সুযোগ টাকে একদম হারাতে চাইনি ধ্রুব দু’হাতে আরও কাছে টেনে জড়িয়ে ধরলো শিমুকে

-এই যে মিস, আমার ফোনটা কি ফেরতযোগ্য নয়?

পেছন থেকে কারো ডাকে ফিরে তাকালো সারা। লম্বা করে চশমা পরা ছেলেটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই অন্যদিকে হাঁটা দিলো।
নিবিড় হা করে চেয়ে আছে কি হলো! সে তো তার ফোনটাই ফেরত চেয়েছিলো। নিবিড়ের ভাবনার মাঝেই সারা ফিরে এলো। ফোনটা নিবিড়ের সামনে ধরে বললো

-সারা, আমার নাম সারা

বলেই আবারও গটগট হেটে চলে গেলো।
বয়স কম হলেও বেশ ঝাঝ মেয়েটার, নিবিড় মুখ বাকিয়ে সামান্য হেসে সারার যাওয়ার পানেই তাকিয়ে আছে
আদ্রিশ নিবিড়কে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো

-সারা কো দেখকে দিল মে যারা যারা কুছ হো গায়া কিয়া?

-যারা নাহি বহত কুছ হুয়া

বলেই আদ্রিশের দিকে তাকালেই আদ্রিশ হাহা করে হেসে ওঠে, নিবিড় ও মাথা চুলকে গেইটের দিকে হাটা ধরে।

~

ভোর বেলা থেকেই ভীষণ ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। আব্বু, তৈয়ব আংকেল মামা সবাই মিলে বাইরের ডেকোরেশন, চেয়ার টেবিল সাজানো, খাবার রান্নার দিকটা তদারকি করছেন। আর আম্মু, পারুল আন্টি মামিসহ আরও মহিলারা মেহমানদারি আর খাবার দেওয়া সহ বাড়ির সকল কাজে ছুটাছুটি করছে। সকাল থেকে একদন্ড বসার সুযোগ হয়নি কারো। আমি বার কয়েক সাহায্য করতে গেলে আমায় ফিরিয়ে দিয়েছে আন্টিরা। নতুন বউয়ের নাকি কোনো কাজ করতে নেই।
আরশি আর সারা মিলে ড্রেস সিলেক্ট করছে, শিমু ও বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য পাঠানো লেহেঙ্গা গয়না সহ অন্যসব জিনিস গুছিয়ে রাখছে। দেখতে দেখতে বেলা গাড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলো, বরপক্ষ আসার সময় হয়ে গেছে অথচ আমি এখনো গা থেকে সাধারণ সালোয়ার টা পর্যন্ত ছাড়িনি। শিমু আর আরশির ঠেলাঠেলিতে গোসল করে এসে বসে আছি।
যহরের আজান দেওয়ার খানিক পরেই সকলে তাড়া দেওয়া শুরু করলো সাজানো শুরু করা নিয়ে। ভীষণ ভারি গাঢ় খয়েরী রঙের লেহেঙ্গা টার উপর সোনার জরির কাজ করা। আমার শাশুড়ীর ছেলে নাকি নিজে অর্ডার দিয়ে স্পেশাল ভাবে বানিয়েছেন লেহেঙ্গা টা। অসম্ভব সুন্দর লেহেঙ্গাটার ভারে যেনো নুইয়ে যাচ্ছি। আমায় বেশ সময় নিয়ে সাজালো তিনজন মিলে, পার্লারের সাজ আমার ভালো লাগে নাহ, মনে হয় মুখের উপর তিন ইঞ্চির প্রলেপ লাগানো। সাজানো শেষ করে লেহেঙ্গা দোপাট্টা দিয়ে আমায় খাটের একদম মাঝখানে বসিয়ে রাখলো। একে একে পাড়ার সব লোকজন আসতে লাগলো, আত্মীয় সজনেরা এসে দেখে যাচ্ছে।

অনেকক্ষণ সময় পার হওয়ার পর, ভীড়ের মাঝ থেকেই একজন বলে উঠলো বর এসেছে। যেনো বুকের ভেতর বিকট শব্দে ধক করে উঠলো। বর এসেছে, কথাটা একজন থেকে মুখে মুখে ছড়িয়ে গেলো। মানুষে ভরা ঘরটা নিমেষেই ফাঁকা হয়ে গেলো৷ সবাই ছুটে গেলো বাইরে বর দেখতে। ঘরের মধ্যে আমি আর শিমু বসে আছি, আস্তে ধীরে লেহেঙ্গা টা ধরে বিছানা থেকে নেমে গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম জানালার ধারে, ভীষণ অস্থিরতা জেঁকে বসেছে ভেতরে। কিছুতেই শান্ত হয়ে থাকতে পারছিনা

ওই সুদর্শন চেহারার লোকটাকে বরের বেশে কেমন লাগবে? এই দুপুরের রোদে নীলাভ চোখ জোড়ার মণি দুটো কি জ্বলজ্বল করবে নাহ? আজও কি তার সারা মুখে অস্থিরতা, অধৈর্যের কড়া প্রলেপ থাকবে না,নাকি প্রাপ্তির আনন্দে তা চেপে যাবে? বউ সাজে আমায় দেখে কি উনি বরাবরের মতোই বেহায়া নজরে চেয়ে থাকবেন? নাকি সবার সামনে মুখ খুলে বলেই ফেলবেন

“মে’রে ফেলবে নূর, তোমার এ রূপের বৈরাগ্যে আমায় ডু’বিয়ে মার’বে”

লজ্জায় গাল,মুখ,কান লাল হয়ে আসলো, যেনো বিয়ের লেহেঙ্গা টার রঙের সাথে মিলে লাজে রাঙা মুখটায় আমায় সত্যিই লাল টুকটুকে বউ লাগছে!
.
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

Humu_♥#তুমি_আসবে_বলে
#হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৪৪

সদর দরজার বাহিরে সারি সারি কয়েকটা গাড়ি রাখা, সামনের কালো মার্সিডিজ থেকে প্রথমেই সুট পরিহিত ভদ্রলোক নামলো,কোলে একটা বাচ্চা নিয়ে, তিয়াস। পেছনের গাড়ি থেকে ধ্রুব,আরাব রাফাতসহ বাকিরা নামলো,সব শেষে রুচিতা। মিষ্টি তিয়াসের কোল থেকে নেমেই দৌড় দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে এলো। পালকের ঘরের সামনে এসে চেঁচিয়ে বললো

-মাম্মাম!! তোমার বর এনেছি
বলেই খিলখিলিয়ে হেসে পালকের সামনে আসলো। ছোট্ট পরীর মতো লাগছে মিষ্টিকে। ফর্সা টকটকে গায়ে মিষ্টি রঙের একটা ফ্রক। মিষ্টিকে মিষ্টি রঙে একেবারে এঞ্জেল লাগছে। হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিলাম। ভারি লেহেঙ্গা সামলে দাঁড়াতে হিমসিম লাগলেও এমন একটা চিনির দলাকে কোলে না নিয়ে থাকতে পারলাম নাহ। কোলে উঠে আমার গলা জড়িয়ে ধরে আবারও বললো

-মাম্মাম,তোমার বর এনেছি

আবারও হেসে দিলাম ওর কথায়,,বেশ লজ্জা লাগছে মিষ্টির কথায়,এসব ও ওকে নিশ্চয়ই বেহায়া লোকটা শিখিয়েছে

♠️

অবশেষে নির্বিঘ্নে শেষ হলো মেঘপালকের বিয়ে,
এক জীবনের জন্য তারা একে অপরের হয়ে গেলো,কাবিননামা নামক দলিলে সাক্ষর করে মেঘ তার নূরকে আজীবনের জন্য নিজের নামে করে নিয়েছে,আর কোনো দূরত্ব থাকবে নাহ,না কোনো বাঁধা।
বিদায়ের বেলায় বাবা মাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদেছে পালক, সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবারও বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো বাকিসব ভুলে কেদেই যাচ্ছিলো। মেঘের আর সহ্য হলো নাহ পালকের কান্না। এগিয়ে গিয়ে এক হাতে জড়িয়ে নিলো পালককে। আরেক হাতে তারেক হাসানের হাত টা ধরে বললো

“আপনার আদরের দুলালিকে আজ নিজের নামে করে অনেক বড় ঋনপত্রে নিজের নাম লিখিয়েছি বাবা, আমার জন্য দোয়া করবেন যাতে এ ঋণের দায়ে নিজের সারাটা জীবন ওকে ভালোবেসেই উৎসর্গ করতে পারি, আপনার মেয়ের জন্যেও দোয়া করবেন যাতে এ কান্নায় ওর জীবনের শেষ কান্না হয়”

চুপ হয়ে গেছে চারপাশ। স্তব্ধ হয়ে মেঘালয়কে দেখছে,তারেক হাসান কান্না থামিয়ে মুগ্ধ চোখে মেঘালয় কে দেখলো। দুহাত তুলে মেঘালয়ের মাথায় রেখে দোয়া করে দিলেন।সকলের থেকে বিদায় নিয়ে পালককে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বেরিয়ে এলো মেঘালয়।

গাড়িতে উঠার পরেও কেঁদে চলেছে পালক। জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। মেঘ কয়েকবার ওর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়েছে, ওকে ধরতে গেলেই সরে জানালা ঘেঁষে বসে আছে পালক। হঠাৎ করে নিজের হাতের উপর ছোট্ট একটা হাতের স্পর্শ পেলো পালক

-মাম্মাম? তুমি কাঁদছো কেনো মাম্মাম?

পাশে ফিরে দেখে মেঘ আর পালকের মাঝেই মিষ্টি বসে আছে, মিষ্টি ওর ছোট দুটো হাত উচু করে পালকের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে আবারও বললো

-তোমাকে কে বকেছে মাম্মাম? কেও কি তোমার চকলেট কেড়ে নিয়েছে?

পালক কান্না মিশ্রিত মুখের ঘাড় দু’দিকে নাড়িয়ে না বুঝালো

-তাইলে কেনো কাঁদছো? তোমার আব্বু আম্মু আদর করেনি বলে?

চোখ প্রসারিত করে তাকালো এবার পালক। মিষ্টিকে মাঝখান থেকে তুলে কোলে নিয়ে মেঘালয় বললো

-হ্যাঁ মিষ্টি, তোমার মাম্মাম আদর নেওয়ার জন্যেই কাদঁছে।

-তাহলে তুমি মাম্মাম কে আদর করে দাও মেঘ

মিষ্টির কথায় গাল বাকিয়ে হেসে মেঘ পালকের দিয়ে তাকালো। এক মুহূর্তের মধ্যে পালকের কান্না থেমে গেলো। এই লোক দিয়ে এতটুকু বিশ্বাস নেই। ফট করে একদম জানালা ঘেঁষে সরে গেলো পালক।
মেঘালয় একবার গাড়ির সামনের আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলো, গাড়িতে ওঠার সময়ই আয়নাটা ঘুরিয়ে রেখেছিলো, মিষ্টিকে পাশে বসিয়ে একটা চকলেট হাতে ধরিয়ে দিলো। চকলেট পেতেই মিষ্টি বাকিসব ভুকে ওটা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পরলো।
মেঘালয় পালকের কাছে সরে এসে এক হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে আরেক হাতে চোখের পানি মুছে দিয়ে সারা গাল ভরে বেশ সময় নিয়ে চুমু দিয়ে বললো

-হুসস,আর একটুও কাদে নাহ তুমি জানো নাহ তোমার চোখে পানি দেখলে আমার কতটা লাগে? আবারও কাঁদলে এবার কিন্তু কোলে তুলে নেবো

এসবের মাঝেও মেঘের এমন কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলো পালক। মেঘালয় ও হেসে এক হাতে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। শান্তি লাগছে,, ভীষণ শান্তি। এই সময়টার জন্য কতই না অপেক্ষা করেছে সে। পারছে না পালককে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে।

~~

ঘন্টা দুয়েক পারি দিয়ে গাড়িটা এসে থামলো। মেঘ আগে বেরিয়ে পালকের হাত ধরে নামালো। গাড়ি থেকে নেমেই মাথা উচিয়ে তাকালো পালক।
‘চৌধুরী ভিলা’ এই বাড়িটাতে অসংখ্য বার এসেছে সে,থেকেছে। তবে আজকের আসা টা ভিন্ন, আজ সে বউ হয়ে এসেছে। এখন আর এটা তার ভাড়ায় থাকা বন্ধুর বাসা নেই। আজ থেকে এটাই তার আবাস,ঠিকানা তার শ্বশুড়বাড়ি।
মেঘালয় পালকের হাতটা শক্ত করে ধরে হাঁটা ধরলো ভেতরের দিকে। অন্যদের গাড়িটা আগেই এসেছে। সবাই আগেই গিয়ে ভেতরে অপেক্ষা করছে। সকলে মিলে হৈ-হুল্লোড় করে বরণ করলো মেঘপালককে। বরণ শেষে বসার ঘরে বেশ কিছুক্ষণ সবার সাথে বসিয়ে রেখেছিলো পালককে। রাফাত নিবিড় আদ্রিশ রুচি,ধ্রুব আরশি শিমু আরাব সবাই মিলে ঘন্টা খানেক ধরে আড্ডা দিয়েছে।

-অনেক হয়েছে, এবার আফুকে একা ছাড়ো তো, সারাদিন অনেক ধকল গেছে ওর উপর দিয়ে, একটু কিছু খেতে হবে এখন।

বলেই খাবারের থাল নিয়ে পালকের পাশে বসলো নিলাশা চৌধুরী, ভাত মাখাতে মাখাতে বললো

-শোনো মেয়ে ও বাড়ি থেকে আসার সময় ভীষণ কান্নাকাটি করেছো নাকি, এবার থেকে যদি তোমার চোখে এক ফোটা ও পানি দেখি তাহলে একটা মা”র ও মাটিতে পরবে নাহ, তোমার বরের কানে কথা টা ভালো করে ঢুকিয়ে দিও”

বলেই খাবারের লোকমা মুখে পুরে দিলো পালকের। নিলাশা চৌধুরীর কথায় সবাই মুখ টিপে হাসছে, মেঘ চোখ ছোট ছোট করে মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকেই উঠে দাঁড়িয়ে বললো

-হ্যাঁ এখন তো আমাকে চিনবেই নাহ,আমি কে

মেঘের কথায় সবাই হাহা করে হেসে দিয়ে বললো
-এই না হলে রাফাতের ভাই

মেঘ ওদের কথায় কান না দিয়ে ফোনটা কানে নিয়েই গটগট করে হাঁটা ধরলো। খাওয়া শেষ করেই সবাই পালককে নিয়ে ঘরের দিকে গেলো।
মিষ্টিও লাফাতে লাফাতে আসলো সবার সাথে।
ঘরে এনেই রুচিতা পালক কে খাটে বসিয়ে দিয়ে বললো

-এই নে আফু, আজ থেকে এই ঘর আর ঘরের মালিক দুটোই সামলানোর দ্বায়িত্ব তোর। রাগী, গম্ভীর তোর সিরিয়াস চৌধুরীকে গুছিয়ে নেওয়ার দায়ভার আজ থেকে শুধুই তোর

রুচিতার কথায় পালক ঘাড় আরও নামিয়ে নিলো। চেনা পরিচিত মানুষের মুখ থেকে এমন অচেনা শব্দ গুলো ভীষণ লজ্জা দিচ্ছে।
এর মাঝেই বাইরে থেকে চিল্লাচিল্লির শব্দ শোনা গেলো।
রাফাত নিবিড় আদ্রিশ আরশি শিমু সবাই দরজায় দাঁড়িয়ে আছে মেঘকে টাকা বাদে ঢুকতে দেবে নাহ

-হাউ স্ট্রেঞ্জ আমার ঘরে আমিই কি না টাকা দিয়ে ঢুকবো

-রং, এখন এটা শুধু আপনার নাহ,আফুর ও ঘর তাই ঢুকতে হলে টাকা দিতে হবে

-তো আফুর ও ঘর যখন টাকা টা ওর থেকেই নাও

-এইই একদম না ভাইয়া, আফু তো তোমারই বউ৷ তার ওর টাকাও তোমাকে দিতে হবে। আর চাওয়া লাগবে ক্যান, আমরা তোমার একমাত্র পাঁচটি শা’লা শা’লি,আমাদের তো তোমার সেধে সেধে টাকা দেওয়া উচিত

রাফাতের কথায় ওকে থামিয়ে আরশি বললো

-এই এক মিনিট এক মিনিট! তুই না মেঘ ভাইয়ের ছোট ভাই,তুই ক্যামরে শা’লা হইলি রে। এতক্ষণ তো বরপক্ষ ছিলি

-আব্বে চুপ মা’র, আমিতো আফুর ও বন্ধু তাই আমি শালা ও, আর এখন আমি বউপক্ষ। বেশি প্যানপ্যান না করে আমার সাথে তাল মেলা যদি টাকা চাস তো

-ওহহ,ওকে! হ্যাঁ তাই তো ভাইয়া। আজ আমরা কোনো কথা শুনবো নাহ, বেশি নাহ পঞ্চাশ হাজার দিলেই দরজা ছেড়ে দেবো।

-হোয়াট,নিজের ঘরে ঢোকার জন্য এখন আমায় পে করতে হবে!

-এমন কিপটামি করছিস ক্যান মেঘ। টাকার তো অভাব হয়নি দিয়ে দে নাহ। আর সাথে আমাদের টাও অ্যাড করে দিস

মেঘ বেশ হতবাক হয়ে বললো

-ওদের টা না হয় মানলাম। বাচ্চামি করছে, তুই আর আরাব ও সাথে যোগ দিয়েছিস।

ধ্রুব বোকা বোকা হেসে বললো

-আসলে আমরা প্রথমে যোগ দিতে চাইনি। তারপর ভাবলাম প্ল্যান টা খারাপ নাহ, তাই আরকি

ধ্রুবের সাথে তাল মিলিয়ে আরাব ও বললো

-আর বয়সে তো আমরা তোমার ছোটই ব্রো। তাই হামারা ভি হাক বানতা হে

আরাবের সাথে সবাই তাল মিলিয়ে জেদ ধরলো। ওদের জেদের কাছে হার মেনে বাধ্য হয়ে মেঘ টাকা দিলো। টাকা নিতেই সবগুলো ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো

-আরে! এইটা কি হলো? আমিতো টাকা দিলাম না কি?

-বেশি নাহ মাত্র পাঁচ মিনিট ওয়েট করুন ভাইয়া আমরা আধা ঘণ্টার মধ্যে খুলছি

ভেতর থেকে আর কোনো কথা শোনা গেলো নাহ,সব গুলো মিলে কিসব ফুসুরফাসুর করছে খোদা জানে

-কোন পাগল গুলোর পাল্লায় পরলাম গড,,এরা তো আমায় নিজের বউয়ের কাছেই যেতে দিচ্ছে না,ধ্যাতত

বলেই গটগট করে আবারও হাঁটা ধরলো মেঘ। গজগজ করে বসার ঘরে গিয়ে সোফার উপর মুখ ফুলিয়ে বসলো

-কি ব্যাপার শা’লাবাবু, চাঁদ মুখ খানায় আমাবস্যা নামলো কেনো, আর তুমি বউ ছেড়ে এখানে কি করছো বলোতো

তিয়াস এসে মেঘের পাশে বসে বললো

-বউ কে ধরলাম কখন যে ছাড়বো। ঘরেই তো ঢুকতে দিচ্ছে নাহ

-আহারে, কি বলো এখনো ঢুকতে দিলো নাহ

তিয়াসের কথার পৃষ্ঠে মেঘ মুখ ফুলিয়ে বসে থাকলো। ভীষণ রাগ হচ্ছে তার,এতকিছুর পর কই ভাবলো বউটাকে ধরে ঠা’স ঠা’স করে কইটা চুমু খাবে,কোলে বসিয়ে রাখবে। তা না সবগুলো জেঁকে বসেছে ঘরে,আর তার নূর ও কি! একটা বার তার কথা মনেও করছে নাহ।
মেঘের মুখের করুন রিয়েকশন দেখে তিয়াস আবারও বললো

-এটা কিন্তু একদম ঠিক হচ্ছে না শা’লাবাবু, আরে দশটা না বিশটা না একটা মাত্র বউ তোমার,একটা বারই তো ফুলসয্যা হবে। আর তুমি কি না মাঝরাত হয়ে গেলো তাও ঘরেই যেতে পারলে নাহ। বিয়ের পর বউকে ছেড়ে এতক্ষণ থাকা মোটেও ঠিক নাহ

-তাই?

-অবশ্যই তাই, পারলে তো রাতের মেয়াদ আরও বাড়িয়ে নেওয়া উচিত। বাসর বলে কথা,,,না নিজে ঘুমানো যাবে না বউকে ঘুমাতে দেওয়া যাবে।

তিয়াসের কথায় বেশ কিছুক্ষণ গম্ভীর মুখ করে ভাবলো মেঘ, তারপর বললো

-ইউ আর রাইট, একটুও ছাড় দেওয়া চলবে নাহ। পইপই করে হিসাব রাখছি৷ আমায় যতক্ষণ অপেক্ষা করছে তা সু’দ সহ উসুল করবো আমি

তিয়াস মেঘের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললো

-দ্যাটস দ্যা স্পিরিট, এই না হলে আমার শা’লাবাবু। এখন চলো তোহ৷ এতক্ষণ ওরা সবগুলো মিলে কি করছে দেখি।

বলে মেঘ আর তিয়াস হাঁটা ধরলো উপরের দিকে। ঘরের সামনে যেতেই দেখলো রুচিতা মিটমিট করে হেসে বেরিয়ে আসছে ঘর থেকে।

-একি তুমি এখানে?

তিয়াস কে দেখে হাসা থামিয়ে রুচিতা বললো

-হ্যাঁ, ওই আফুর সাথে ছিলাম আরকি

-হ্যাঁ তো তুমি কেনো আফুর সাথে থাকবে, বরের চেয়ে ননদের দরদ বেশি নাকি। বোন হয়ে ভাইয়ের বাসরে বসে থাকতে লজ্জা করে না তোমার।

-ওমাহ,লজ্জা কেনো লাগবে আফু একা ছিলো তাই

-বরকে ঢুকতে না দিলে একাই তো থাকবে৷ তুমি নিজে বরের থেকে দূরে দূরে থাকো বলে কি অন্যের বর কেও তার বউয়ের কাছে যেতে দিবে নাহ।

তিয়াসের এমন লাগাম ছাড়া কথায় রুচিতা বেশ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে দেখলো। মেঘের দিকে তাকিয়েই দম ফাটা হাসি পাচ্ছে তার, আহারে তার বেচারা ভাইয়া বউয়ের কাছে না যেতে পেরে মুখ টা কেমন বাংলার পাঁচ করে রেখেছে।
মেঘের দিকে চেয়ে বললো

-থাক আর মন খারাপ করিস নাহ, তোর বউকে আর আমরা জ্বা’লাচ্ছি নাহ,যা তুই

রুচিতার দিকে বাকা চোখে চেয়েই পাশ কাটিয়ে গটগট করে ঘরের ভেতর ঢুকে গেলো। মেঘের যাওয়ার পর রুচিতা আর তিয়াস একসাথে হাহা করে হেসে উঠলো।

ধপ করে দরজা লাগানোর শব্দে কেঁপে উঠলো পালক। মেঘ ঘরের ভেতর ঢুকেই ধপ করে দরজা লাগিয়ে দিলো। হাতের ঘড়িটা খুলে টেবিলের উপর রেখে দিলো।

-বিয়ে করেও শান্তি নেই৷ আমাকে বউয়ের কাছে আসতেই দেয়না। এই তোমার বন্ধু গুলোকে আগামী সাত দিন এদিক ফিরতে নিষেধ করবা। সারাদিন তো চিপকে থাকেই বাসরেও একা ছাড়ে না আমার বউকে

একা একাই বকবক করছে মেঘ,পালক চুপচাপ মাথা নিচু করে জড়সড় হয়ে বসে আছে, মেঘ এসে ধপ করে বিছানাই কাত হয়ে কনুইয়ে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে, পালকের দিকে অপলক চেয়ে থাকা অবস্থায় ই পালক মেঘের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে কিছু একটা ইশারা করে,মেঘ ভ্রুকুটি করে চেয়ে শয়’তানি হেসে বলে

-এমা ছিছি, ঘরে আসতে না আসতেই তুমি ইশারা শুরু করে দিয়েছো, সো ফাস্ট!

মেঘের কথায় পালক লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে,তবুও নিজেকে সামলে আবারও কিছু একটা ইশারা করতেই মেঘ আবারও বললো

-উফ এভাবে ইশারা করলে তো লজ্জা লাগে, এভাবে একলা ঘরে হ্যান্ডসাম ইনোসেন্ট একটা ছেলে পেয়ে নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারছো নাহ তাই তো?

নিজের মাথার চুল নিজেরই টেনে ছিড়তে ইচ্ছে করছে, এই লোকটার বেহায়াপনায় আমার জা’ন যাবে। চোখ গরম করে তাকাতেই বললো

-এহ,রেগে যাচ্ছো কেনো,আদর চাই তো? আচ্ছা দিচ্ছি

বলেই ঝড়ের বেগে এসে ঠা’স করে চুমু দিয়ে দিলো গালে৷ আমি এক গালে হাত দিয়ে হা করে তাকিয়ে আছি৷ মেঘ আরেক গালের দিকে আসতে নিলেই বারান্দার পাশ থেকে ফিসফিস শব্দ কানে আসলো। উনি থেমে গিছে কিছুক্ষণ মনযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে আমার দিকে তাকালেন। এক নজর তাকিয়েই উঠে গিয়ে বারান্দার পর্দা সরাতেই আরশি আর আদ্রিশ লাফিয়ে উঠলো

-আ ম মানে গুড ইভিনিং

আরশি আমতাআমতা করে বলেই আদ্রিশকে কনুই দিয়ে এক গুতা বসিয়ে দিলো। আদ্রিশ ছিটকে গিয়ে সরে বললো

-আ আরে মেঘ ভাই আ আপনি এখন?এখানে?

আদ্রিশের বোকা বোকা কথায় আরশি মাথা চুলকে শুকনো ঢক গিললো।
মেঘ স্থির দাঁড়িয়ে আছে ওদের দিকে চেয়ে। বেশ হয়েছে, ধরা পরেছে তো! নিষেধ করেছিলাম আমি এই লোকের নজর থেকে বাচা এতো সহজ নাহ। মেঘ ওদের ছেড়ে আশপাশ ঘুরে আলমারির দরজা টা খুলতেই রাফাত হুরমুরিয়ে বেরিয়ে আসলো। মুখ থুববে পরতে নিলেই মেঘ দু’হাতে ধরে ফেললো। রাফাত নিজেকে সামলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একবার আমার দিকে একবার মেঘের দিকে তাকাচ্ছে, বোকা বোকা হেসে অপ্রস্তুত হয়ে বললো

-আব.. হাই!

মেঘ দুহাত বুকে গুজে, গম্ভীর মুখ করে উত্তর দিলো

-হ্যালো

রাফাতের থেকে চোখ ফিরিয়ে খাটের দিকে এসে দাঁড়িয়ে গমগমে গলায় বললো

-তোমাদের কি আলাদা ইনভাইটেশন পাঠাতে হবে? নাকি আমি আসবো।।

মেঘের কথা শেষ হবার সাথে সাথে নিবিড় আর শিমু খাটের নিচ থেকে হুরমুরিয়ে বেরিয়ে আসলো। শিমুর সারা মুখে ময়লা আর এলোমেলো চুলে জুবুথুবু হয়ে আছে। নিবিড় আতংকিত চেহারায় একবার ডানে,তো একবার বামে তাকাচ্ছে।

-হ্যাঁ তো তোমরা এখানে কি করছো?

মেঘ এক ভ্রু উচিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো

-ম মানে ভাই,আসলে তোমাদের কিছু লাগবে কি না তাই জানতে এসেছিলাম

-ওহ আচ্ছা, তা পর্দার আড়ালে,খাটের নিচে আলমারির ভেতরে ঢুকে কোন জরুরি মিটিং চলছিলো

নিবিড় ঢক গিলে ভাঙা ভাঙা গলায় বললো

-না মানে আসলে মশা, হ্যাঁ মশা তো অনেক ঘরে তাই খাটের নিচিটাই দেখছিলাম, ইদানীং যেই হারে ডেঙ্গু বাড়ছে তো

নিবিড়ের কথায় আরশিও তাল মিলিয়ে বললো
-হ্যাঁ হ্যাঁ। তাই তো। ডেঙ্গু বাড়ছে খুব,তাই তো আমরা দেখছিলাম মশা টশা আছে নাকি।

-আচ্ছা, তাই। তবে মশার সাথে কিছু অপ্রয়োজনীয় ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাসের মতো প্রাণী ও বেড়েছে জানো। যারা সময় অসময়ে যেখান সেখানে হাজির হয়ে যায়। তাদের কি করা উচিত বলো তো

সবাই একসাথে গলা মিলিয়ে বললো
-কি??

-হ্যাঁ সেটাই দেখাবো।

বলে বেড সাইড থেকে একটা হকি স্টিক তুলে নিলো হাতে।

-নিবিড় বাচতে চাইলে পালা!!..

বলেই এক ছুটে দরজা খুলে দৌড় দিলো রাফাত আর ওর পিছনে নিবিড় শিমু, আরশি আদ্রিশ। মেঘ ধরার আগেই সবগুলো পগার পার।
হৈ হৈ করে সবগুলো দৌড়ে পালিয়েছে। ওদের সবগো এক্সপ্রেসন আর অবস্থা দেখে হাসিতে আমার পেট ফেটে যাচ্ছিলো। এতক্ষণ আটকে রাখলেও এদের এভাবে পালানো দেখে হাহা করে হেসে উঠলাম,
মেঘ পিছু ফিরে আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হাতের স্টিক টা ফেলে দিয়ে দরজা লাগালো, লাইট টা ঠা’স করে বন্ধ করে দিয়ে, ডিম লাইট জ্বেলে দিলো।
ডিল লাইটের মৃদু সবুজ আলোতেও উনার মুখের রহস্যময়ী হাসি টা স্পষ্ট, পালক হুট করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। মেঘ একটু থেকে বাকা হেসে এগোতে লাগলো,নিচের দিকে তাকিয়েও স্পষ্ট বুঝতে পারছে মেঘের আগানো। মেঘ আস্তে আস্তে এগোচ্ছে আর পালক পিছিয়ে যাচ্ছে। পিছাতে পিছাতে একদম দেওয়ালের কাছে এসে থেমে গেলো। মেঘ পালকের দুপাশে হাত রেখে ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে অপলক চেয়ে আছে পালকের দিকে। বুকের দ্রিমদ্রিম শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছে পালক। এতক্ষণ মজা করলেও মেঘের এখনকার চাহনিতে যে কত বড় সর্বনা’শ অপেক্ষা করছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারছে পালক। মেঘের মুখটা ঝুকিয়ে আরও নামিয়ে আনলো। একেবারে পালকের মুখক বরাবর, নরম কণ্ঠে বললো

-খুব হাসি পাচ্ছে নাহ?

পালক ঘন ঘন দুপাশে মাথা নাড়ালো। যা অর্থ নাহ। পালকের এমন ভড়কে যাওয়া চেহারা দেখে মৃদু হাসলো মেঘ। যার শব্দ স্পষ্ট কানে বাজলো পালকের। কণ্ঠের খাদ আরও নামিয়ে মেঘ বললো

-আজকে এতো সেজেছো কেনো?

পালক শুধু ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়ছে, কি বলবে সে? কেনো সেজেছে? কি বলবে যে আজ তার বিয়ে বলে সেজেছে, নাকি বাসর বলে সেজেছে?
মিনমিন করে বললো।

-খুব বেশি হয়ে গেছে?

মেঘ কিছুক্ষণ স্থির চেয়ে থেকে সোজা ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো।

-কতখানি বেশি তা জানি নাহ, তবে আমার অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে
ভ্রু কুচকে তাকালো পালক। মেঘ পালকের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললো

-আজকে কি বলো তোহ!

মেঘের কণ্ঠস্বরের উষ্ণতা যেনো সুচের মতো বিঁধে গেলো পালকের শরীরে। বেশ বুঝতে পারছে সে মেঘের গতিবিধি। দুহাতে মেঘের বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দৌড়ে যেতে নিলে পেছন থেকে আঁচল টেনে ধরে মেঘ, এক টানে এনে ফেলে বুকের মাঝে। শাড়ি ভেদ করে পেটের উপর হাত গলিয়ে দেয়। আস্তে আস্তে পেটের উপর ঠান্ডা হাতের স্পর্শ গুলো ভীষণ অবাধ্য হয়ে উঠতে লাগে,পালক এক হাতে খামচে ধরলো মেঘের হাত। পেছন থেকে আরেক হাতে পালকের ঘাড় থেকে চুল গুলো সরিয়ে থুতনিতে ভর দিয়ে রাখলো মেঘ, আগের ন্যায় আবারও ফিসফিসিয়ে বললো

-শুনতে চাও কি কি ক্ষতি হয়েছে?
.
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

Humu_♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here