তুমি এলে তাই পর্ব ৩০

#তুমি এলে তাই ❤
#লেখিকা- অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩০
.
স্পন্দনের নিজের ও খুব কষ্ট লাগছে গুঞ্জনকে কথা শুনিয়ে। কিন্তু ও কী করবে? ও তো চাইলেই গুঞ্জনের ব্যবহারগুলো ভুলে যেতে পারছেনা। স্পেশিয়ালি সেদিনের কথাগুলো। ওর ভালোবাসাকে ফিজিক্যাল ইনটেমেন্সির দিকে অবধি নিয়ে গেছে। চাইলেও মাথা থেকে ঝারতে পারছেনা। এতো সহজে গুঞ্জনকে ক্ষমা করতে পারবেনা ও। গুঞ্জন কাঁদোকাঁদো কন্ঠে একটু এগিয়ে গিয়ে বলল

— ” মিস্টার চৌধুরী আমি জানি আম..”

স্পন্দন ধমকের সুরে বলল,

— ” আই সেইড গেট লস্ট।”

গুঞ্জন এবার রেগে গিয়ে বলল,

— ” আরে আমার কথাটাতো শোনো প্লিজ।”

স্পন্দন এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে দুকদম এগোতেই গুঞ্জন দুকদম পিছিয়ে গেলো। স্পন্দন এবার জোরে চেচিয়ে বলল,

— ” কী বলবে? এখন কেনো বলবে? বারবার জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি যে ‘গুঞ্জন প্লিজ বলো কী হয়েছে?’ এমনকি এটাও বলেছিলাম যে তোমার কোনো প্রবলেম থাকলে তুমি সময় নাও। তোমার যতো ইচ্ছে সময় নাও কিন্তু তুমি? তুমি কী করলে? আমাকে রিজেক্ট করেছো এই অবধি ঠিক ছিলো। কিন্তু তোমার সাথে যোগাযোগ টাই শেষ করে দিতে বললে? এতটাই তুচ্ছ ছিলো তোমার কাছে আমাদের সম্পর্কটা? আমাদের বন্ধুত্বটা? আমার ভালোবাসাকে তুমি ফিজিক্যাল ইন্টিমেন্সিতে নিয়ে গেলে? বারবার তোমার কাছে কারণটা জানতে চেয়েছি। অথচ তুমি তখন ওভাবে অপমান করে এখন আমাকে বলতে এসছো? মানে আমি তোমার কাছে একটা পাপেট? যখন তুমি কাছে আসতে বলবে আমি আসবো, যখন তুমি দূরে সরে যেতে বলবে আমি দূরে সরে যাবো? তোমার যখন বলতে ইচ্ছে হবেনা আমি শুনবোনা আবার যখন তোমার বলতে ইচ্ছে হবে তখন আমি গিয়ে শুনবো? লাইক সিরিয়াসলি?”

গুঞ্জন মাথা নিচু করে কাঁদছে। স্পন্দনে প্রতিটা কথাই সত্যি। ভুলটা তো ওর নিজেরই।স্পন্দনের ভালোলাগছে না এই কান্না। কিন্তু ও নিজেও তো কেঁদেছে হ্যাঁ ওর চোখ হয়তো খুব একটা ভেজেনি কিন্তু ওর ভেতরটা যে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে গুঞ্জন তার কী হবে? ওর দোষটা কোথায় ছিলো? ওর ভুলটাই বা কোথায় ছিলো যার শাস্তি গুঞ্জন ওকে দিয়েছে? গুঞ্জন কাঁদতে কাঁদতে বলল,

— ” মিস্টার চৌধুরী আমি মানছি সব ভুল আমার ছিলো। আপনাকে অকারণেই আঘাত করেছ। কিন্তু.. ”

স্পন্দন তাচ্ছিল্যের এক হাসি দিয়ে বলল?

— ” বলেছিলাম, যে এমন কিছু করোনা যাতে ভবিষ্যতে তোমাকে পস্তাতে হয়।”

গুঞ্জন ফোপানো কন্ঠে বলল,

— ” মিস্টার চৌধুরী..”

স্পন্দন আর গুঞ্জনকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে গুঞ্জনের হাত ধরে বলল,

— ” আপনাকে এখান থেকে বের করার জন্যেই হাতটা ধরছি ভাববেন না এডভানটেজ নিচ্ছি।”

বলে গুঞ্জনের হাত ধরে টেনে কেবিনের দরজা খুলে প্রায় ধাক্কা দিয়ে বের করে দরজা বন্ধ করে দিলো। গুঞ্জন আটকাতে গিয়েও পারলোনা। আসলে কথা বলার সময় গুঞ্জন প্রচুর কাঁদছিলো। আর স্পন্দন সেই কান্না সহ্য করতে পারছিলোনা, আবার গুঞ্জনকে ক্ষমাও করতে পারছিলো না। রেহান আর মেঘলা একটু দূরে দাড়িয়ে ছিলো। গুঞ্জনকে বেড়িয়ে যেতে দেখে রেহান আর মেঘলা দুজনেই এগিয়ে এলো। মেঘলা বলল,

— ” কীরে কী হয়েছে এভাবে বেড়িয়ে এলি কেনো?”

গুঞ্জন ওদের দিকে তাকালো। গুঞ্জনের চোখ দেখেই বুঝে গেলো যে ভেতরে কী হয়েছে। গুঞ্জন নিরবে কাঁদছে। গুঞ্জনের মাথায় হাত বুলিয়ে রেহান বলল,

— ” আরে বাবু এটুকুতে এতোটা ভেঙ্গে পরলে চলবে? দেখো স্পন্দনকে আমি যতোটুকু চিনি, আর তুমি ওকে যা যা বলেছো শুনলাম তাতে ওর এরকম রিয়াক্ট করাটাই স্বাভাবিক। বাট তোমাকেও একটু শক্ত হতে হবে নাহলে ওকে মানাতে পারবেন না। তাই প্লিজ কান্নাকাটি করোনা। ”

গুঞ্জন এবার শব্দ করেই কেঁদে ফেলল। ও স্পন্দনের ব্যবহারে একটুও কষ্ট হচ্ছে না এখন কারণ এটা ওর প্রাপ্য ছিলো। ও কাঁদছে এইজন্যই যে আজ স্পন্দনের বলা কথাগুলোতে ও আরো ভালো করেই বুঝতে পেরেছে যে কতোটা কষ্ট দিয়েছে ও স্পন্দনকে। গুঞ্জনকে এভাবে কাঁদতে দেখে মেঘলা অবাক হয়ে বলল,

— ” গুটি তুই কবে থেকে এমন কান্নাকুমারী হলি বলতো? কোথায় এখন ওনার একটু শক্ত থাকার কথা তা না করে উনি এখন কান্না জুড়ে দিয়েছে।”

রেহান মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” আচ্ছা ওকে বোকছো কেনো বলোতো? গুঞ্জন তুমি এখন বাড়ি যাও বাকিটা আবার পরে দেখা যাবে।”

গুঞ্জন চোখ মুছে চলে গেলো ওখান থেকে । রেহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” স্পন্দনকে আমাদেরই বলা উচিত গুঞ্জন কেনো এমন করেছে।”

মেঘলা কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বলল,

— ” হ্যাঁ কিন্তু এখন না স্যারের মাথা এইমুহ‍র্তে গরম হয়ে আছে ভীষণ। এখন কিছু বললেও শুনবে না ।”

রেহানও সম্মতি দিয়ে বলল,

— ” ঠিকই বলেছো। ওর মাথাটা ঠান্ডা হোক এরপর ধীরে সুস্থে সবটা বলতে হবে।”

এরপর দুজনেই নিজের নিজের কাজে গেলো। আর এদিকে স্পন্দন নিজের কেবিনের সবকিছু এলোমেলো করে ফেলেছে। বারবার গুঞ্জনের সেই কান্নাজরিত মুখটা সামনে ভেসে উঠছে, আবার গুঞ্জনের দেওয়া আঘাতগুলোও মনে পরছে। ওকে কাছে নিতে পারছে না আবার দূরে সরাতেও মন সায় দিচ্ছে না। সবকিছু মিলিয়ে অতিষ্ট হয়ে গেছে ও।

____________________

রাতে স্পন্দন আর রেহান মিলে ল্যাপটপে অফিসিয়াল কিছু কাজ করছে। কাজ করতে করতে রেহান আড়চোখে একবার স্পন্দনের দিকে তাকালো। স্পন্দন একমনে কাজ করছে চোখ মুখ ভীষণ শক্ত করে রাখা। রেহান স্পন্দনের তিন বছরের বড় হলেও স্পন্দনের রাগকে বেশ ভয় পায়। ও একটু গলা ঝাড়তেই স্পন্দন ভ্রু কুচকে ল্যাপটপে চোখ রেখেই বলল,

— ” কী হয়েছে ? কীছু বলতে চাইছিস মে বি?”

রেহান নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

— ” বলছিলাম গুঞ্জন তো এসছিলো তোর কাছে। নিশ্চয়ই ক্ষমা চেয়েছে? তো তুই ওকে ক্ষমা তো করে দিতেই পারিস তাইনা?”

স্পন্দন ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে রেহানের দিকে তাকাতেই রেহান থতমত খেয়ে বলল,

— ” অবব এক্চুয়ালি দেখ। ক্ষমাতো মহৎ গুন তাইনা। সমাজ দ্বারা স্বীকৃত, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্ধ দ্বারা প্রমাণিত। তাই আমাদের উচিত না? সবারই ভুল দোষগুলোকে ক্ষমা করে..”

স্পন্দনের ফেস এক্সপ্রেশন দেখে রেহান একটা ঢোক গিলে ইতস্তত করে বলল,

— ” এভাবে তাকাস না ভাই জানিস তো আমার হার্ট দুর্বল। ইয়ে একটুখানি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা উচিত না?”

স্পন্দন এবার ল্যাপটপটা রেখে রেহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” আচ্ছা ভাইয়া ধর, মেঘলাকে তুই প্রপোজ করার পর ও তোকে ঝুলিয়ে রেখে বলল একটু সময় চায়। তুই সেটা দিলি। এরপর বন্ধুর মতো তোরা দুই/তিন মাস মেলামেশা করলি। ঐ কয়মাসে তুই মেঘলার মধ্যে তোকে ও ভালোবাসে তার বিভিন্নরকম ইঙ্গিতও পেলি। আর মনে মনে ওকে নিয়ে স্বপ্ন আরো গভীরভাবে দেখলি। এরপর হঠাৎ একদিন ও এসে তোকে বলল যে ও তোকে কোনোদিনই ভালোবাসতে পারবেনা এবং তোর সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবে না। তোর কেমন লাগবে? এটুকু অবধিও মেনে নেওয়া গেলেও এরপর যদি সামান্য একটু টাচ করাতে তোর গালে চড় মেরে বলে তোর লজ্জা নেই, তুই ওর সাথে টাইমপাস করার জন্যে পেছনে ঘুরছিস, ওর কাছে ফিজিক্যাল ইন্টিমেন্সি চাস তাহলে? পারবিতো এরপর ও একবার এসে তোর কাছে ক্ষমা চাইলেই ওকে ক্ষমা করে দিতে? বল পারবি?”

রেহান চুপ হয়ে গেলো। সত্যিই তো ও কী পারতো এতো তাড়াতাড়ি ক্ষমা করতে? কেউ কী পারতো? নাহ স্পন্দন আরেকটু সময় দেওয়া উচিত। এটাই ঠিক হবে। এসব ভেবে ও আর কথা বাড়ালোনা। স্পন্দনও নিজের কাজে মন দিলো।

সেদিন সারারাত গুঞ্জন কেঁদেছে। ওর বারবার শুধু স্পন্দকে দেওয়া কষ্ট আর আজকে স্পন্দনের বলা কথাগুলো মনে পরছে। আবির আর মেঘলা প্রায় সারারাত জেগেই ওকে সামলানোর চেষ্টা করেছে। ওরা তো অবাক যেই মেয়ের কান্না দেখা ধুমকেতু দেখার মতো সৌভাগ্যের ছিলো সেই মেয়ে এভাবে কাঁদছে। তবে স্পন্দনেরও এখানে কোনো দোষ নেই ও ওর জায়গায় ঠিক আছে।

___________________

স্পন্দন নিজের কেবিনে নিজের চেয়ারে বসে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে সামনে বসে থাকা রেহান আর মেঘলার দিকে। প্রায় অনেক্ষণ ধরেই বসে আছে দুজন স্পন্দনকে কিছু বলবে বলে কিন্তু কেউ সেই সাহস পাচ্ছেনা। স্পন্দন বিরক্ত হয়ে বলল,

— ” কিছু বলবি তোরা? এক ঘন্টা যাবত বসে আছিস?”

রেহান একটু মেখি হেসে দিয়ে বলল,

— ” হ্যাঁ হ্যাঁ বলছি বলছি। আরেকটু সময় দে?”

স্পন্দন একটা শ্বাস ফেলে বলল,

— ” ওকেহ। টেক ইউর টাইম।”

বলে কাছে মন দিলো। রেহান মেঘলার হাতে একটা চিমটি কাটতেই মেঘলা বলল,

— ” স্যার একটা কথা ছিলো!”

স্পন্দন ল্যাপটপে কাজ করতে করতে ভাবলেশহীনভাবে বলল,

— ” আধাঘন্টা যাবত এটাই বলছো। নেক্সট লাইন বলো।”

মেঘলা অসহায়ভাবে রেহানের দিকে তাকালো।রেহান ইশারা করতেই মেঘলা বলল,

— ” গুঞ্জন কেনো আপনার সাথে এরকম করেছে সেই কারণটাই বলার ছিলো।”

স্পন্দন এবার ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” এটা কাজের জায়গা আড্ডা দেওয়ার জায়গা নয়।”

মেঘলা একটু অনুরোধের কন্ঠে বলল,

— ” স্যার প্লিজ। আপনার এটা জানা দরকার। গুঞ্জনের পাস্টও আপনার জানা উচিত। তাহলেই আপনি আপনার উত্তর পেয়ে যাবেন।”

এবার স্পন্দন কাজ করা থামিয়ে দিলো। যতোই হোক গুঞ্জন ওর ভালোবাসা। আর নিজের ভালোবাসার মানুষের কোনো অতীত আছে সেটা শোনার আগ্রহ তো থাকবেই তাই গম্ভীর কন্ঠে বলল,

— ” কী বলবে বলো। কিন্তু তাড়াতাড়ি বলো।”

মেঘলা এবার লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলল,

— ” গুঞ্জন আপনাকে নিজের থেকে দূরে সরাতে চেয়েছিলো কারণ ও ভেবেছিলো যে আপনাকে আমি ভালোবাসি আর সেইজন্যেই এরকমটা করেছে যাতে আপনি ওর লাইফ থেকেই সরে যান।”

এবার স্পন্দনের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেলো। এমনিতেই রেগে ছিলো গুঞ্জনের ওপর এই কথাটা জেনো সেই রাগে ঘি এর মতো কাজ করলো।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here