#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ০৭.
.
ভালোবাসার মানুষের সামান্যতম আবদার অনায়াসেই রাখা যায়। তাদের কথাগুলো না চাইলেও মান্য করা যায়। তেমনি আমার ভালোবাসার একজন মানুষ হলো ফুপি। কেন জানি সবার চাইতে ফুপিকে একটু বেশিই ভালোবাসি, তার কথাগুলো সর্বত্র মান্য করার চেষ্টা করি।
ছাঁদে তখন তাসফি ভাইকে নিজের কাছে দেখে চলে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারি নি ওনার শক্তপোক্ত হাতের বাঁধনে আঁটকে পরে। মাথা ঘুড়িয়ে সবার উদ্দেশ্যে তাকালেও তখন কারোর দেখা মিলে নি। তখনই বুঝে গিয়েছিলাম সবাই প্ল্যান করেই আমাদের একটা রেখে চলে গেছে। তাসফি ভাইয়াকে তার রুপুর অভিমান গুলো ভাঙানোর সুযোগ করে দিয়ে গেছে। কিন্তু কেউ তো আর জানে না, ওই মানুষটাকে সকালে দেখার পরেই আমার রাগটা হারিয়ে গেছে, দুপুরে ওনার একটুখানি ভালোবাসার ছোঁয়া পেতেই আমার এতদিনের জমিয়ে রাখা পাহাড় সমান অভিমান গুলো নিঃশেষ হয়ে গেছে। কিন্তু…. কিন্তু কিছু পুরনো স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠলেই আমার এই শান্ত মনে অশান্তের ঝড় উঠে যায়, এলোমেলো হয়ে যায় যেন সমস্তকিছু। ওনার করা অবহেলার থেকেও বারংবার মনে হতে থাকে, আমার একান্ত মানুষটার মনে অন্য নারীর বসবাস, শরীর জুড়ে অন্য নারীর বিচরণ। কিভাবে মেনে নিবো আমি?
তাসফি ভাইয়ার শক্তির সাথে না পেরে উঠে এক প্রকার বাধ্য হয়েই ছাঁদে থাকতে হয়েছিলো আমাকে। গা ছমছমে রাতের আঁধারে আমার ভীতি কাজ করে, সেই সুযোগটাও কাজে লাগিয়ে ছিলেন ব/জ্জা/ত মানুষটা। সবাই চলে আসার পরও ওনার সাথে প্রায় আধা ঘন্টার মতো সময় কাটাতে হয়েছে। তার সবটাই ছিলো আমার অভিমানগুলো ভাঙানোর সামান্যতম চেষ্টা।
ছাঁদ থেকে নিচে দেখি সবার খাওয়া দাওয়া শেষে যে যার রুমে চলে গেছে। তাসফি ভাই এবং আমার জন্যই অপেক্ষা করে চলেছেন আম্মু আর ফুপি। আমরা আসতেই আম্মু টেবিলে তাসফি ভাইয়ের জন্য খাবার বাড়তে বাড়তে আমাকেও বসতে বলে খাওয়ার জন্য। খাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তাসফি ভাইয়ার সাথে এবং হাতের কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্তটা পাল্টে নিলাম। কিন্তু তাতে বাঁধ সাধলো ফুপি। এতবার বলার পর যখন নিজ হাতে খাইয়ে দিতে চাইলো, তখন আর না করতে পারলাম না। এই মানুষটাকে যে আমার কোন কাজে বারণ করতে ইচ্ছে হয় না। ফুপি আমাকে খাইয়ে দিতে শুরু করলেই তাসফি ভাইয়া অভিমানী সুরে বলে উঠলেন,
“বাহ্! তোমাদের এই বড় হওয়া বাচ্চা মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছো? আর আমি যে এতদিন পর বাসায় আসলাম, আমাকে কি চোখে পড়ছে না আম্মু?”
“না পড়ছে না। দেখছিস না, ওর হাতের কি অবস্থা?”
“আমার হাতেও ব্যাথা হচ্ছে, আমাকেও খাইয়ে দাও।”
বলেই খেতে খেতে প্লেট থেকে হাত উঠিয়ে নিলেন। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম ওনার দিকে। ফুপিকে কড়া গলায় বলতে ইচ্ছে হলো, ‘একদম তোমার এই ব/জ্জা/ত ছেলেকে খাওয়াবে না ফুপি, আমার আদরের ভাগ একদম ওনাকে দিবা না।’ কিন্তু কিছু না বলে কটমট চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলাম।
“আহ্ তাসফি, তুই দেখি আরও বাচ্চা হয়ে গেছিস। দেখছিস তো ও খেতে পারছে না।”
“আচ্ছা… আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আবার ভালো মানুষ, তাই কিছু মনে করলাম না।”
“নে, আর নাটক করতে হবে না। হা কর।”
তাসফি ভাই নিজের প্লেট থেকে খেতে শুরু করতেই ফুপি এক কোলমা নিয়ে এগিয়ে দিলো ওনার দিকে। হেঁসে আমার দিকে তাকিয়েই খেয়ে নিলো। তারপর বলে উঠলো,
“তুমি বললে তাই নিলাম কিন্তু আম্মু। আমি আবার বাচ্চা কাচ্চাদের আদরে ভাগ বসায় না, কিন্তু প্রয়োজনে আদরে আদরে অতিষ্ঠ করে দিতে পারি।”
সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিলাম আমি। ব/জ্জা/ত লোক একটা, কাকে আদর করবি কর না, আমার দিকে তাকিয়ে বলতে হবে কেন? কিয়ানা তো আছেই, প্রয়োজনে সারাদিন কোলে নিয়ে থাক, অ*সভ্য লোক কোথাকার। মনে মনে কঠিন ভাষায় একটা গালি দিলাম ওনাকে। ফুপি বলে উঠলো,
“চুপচাপ খাবারটা শেষ কর তো, বাজে কথা না বলে।”
তাসফি ভাইয়া কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে এক কোলমা মুখে দিলেন, তারপর অকপটে বলে উঠলেন,
“তোমার ছেলের বউকে একবার শুধু বাসায় আনতে দাও। তারপর দেখে তোমার আদরের প্রয়োজন হবে না, তোমার বাচ্চা বউমা আমাকে আদরে আদরে ভরিয়ে রাখবে।”
কয়েক সেকেন্ডর মতো চুপ থেকে আবারও বলে উঠলেন,
“আম্মু…. তাড়াতাড়ি আমার বউকে বাসায় আনার ব্যাবস্থা করো, একা একা ঘুমাতে আমার ভয় লাগে। না জানি কখন এই ছোট হার্টটা ঠাস করে ফেটে যায়।”
মনে মনে খুব বাজে ভাবে একটা গালি দিলাম ওনার কথাগুলো শুনে। অ*সভ্য ব/জ্জা/ত লোক একটা। কতটা খারাপ হলে মায়ের সামনে এসব কথাগুলো বলতে পারে? টেবিল থেকে গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেলাম, তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে ফুপির দিকে তাকিয়ে বললাম,
“তোমার এই ব/জ্জা/ত ছেলেকে সামলাও ফুপি, আমি আর খাবো না।”
বলেই তাসফি ভাইয়ার দিকে তাকাতেই দেখি উনি বাঁকা হেঁসে তাকিয়ে আছেন। আর দাঁড়ালাম না, সোজা হেঁটে নিজের রুমে চলে আসলাম। দরজাটা ভালোভাবে লক করে দিলাম, যেন ব/জ্জা/ত লোকটা পরবর্তীতে রুমে আসতে না পারে।
.
বিছানায় শুয়ে আধা ঘন্টার মতো এপাশ ওপাশ করেও চোখে ঘুম ধরা দিলো না। হঠাৎ মোবাইলের কথা মনে হতেই, মোবাইলটা হাতে নিলাম। ব/জ্জা/ত মানুষটার সাথে দেখা হবার পর থেকেই ফোনের কথাটা ভুলেই গেছি আমি। ফোনে সময় দেখি বারোটা পেরিয়ে গেছে। আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে কখন যে বারোটা পেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারি নি। কিন্তু একটা মনে করে অনলাইনে একটু টু দিলাম। নিউজ ফিডের প্রথম পোস্টেই তাসফি ভাইয়ার ছবি দেখে চমকে উঠলাম কিছুটা। আরে, এটা তো ওনার ফ্লোরিডা তে থাকাকালীন সময়ের ছবি, তাইলে আমার ফিডে কেমনে আসলো? আইডির নাম দেখে আরেক দফা অবাক হবার পালা আমার ইংরেজি গোটাগোটা অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে ‘তাশরিফ রওনাফ তাসফি’ নামটি। আমি তো ওনাকে অনেক আগেই ব্লক করে রেখেছিলাম, সমস্ত সোশাল মিডিয়া থেকে। তাহলে এটা কিভাবে সম্ভব? ওনার নামে ক্লিক করে আইডি তে ঢুকতেই আবারো অবাক হবার পালা আমার। ওনার সাথে ফ্রেন্ড হলাম কখন? সবকিছু যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে আমার। আমি তো করি নি, আজ সারাদিন তো মোবাইলও হাতে নেই নি। সকালে তো ফোনটা বসার রুমে….. তাহলে কি তাসফি ভাই? উফ্! এই মানুষটা এমন কেন? ফোনে লক না দেওয়ার ফল আজকে পেলাম।
রাগ করে আবারও ব্লক দিতে গিয়েও হঠাৎ থেমে গেলাম, ওনার ডিপির পিছনের কভার ছবি দেখে। হাজারো বিষ্ময় নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম ছবিটার দিকে। আমার এই ছবিটা ওনার কাছে কি করে? লম্বা চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া, সামনের কাটা চুলের একগুচ্ছ চোখের উপরে এসে বিছিয়ে গেছে, চোখ দুটো ঠিক ভাবে দেখা না গেলেও ঠোঁটে লেগে থাকা হাসিটা ঠিকই দেখা যাচ্ছে। সহসায় কেউ বুঝতেই পারবে না এটা আমার ছবি। ছবিটা প্রায় ছয় সাত মাস আগের তোলা। কিন্তু ওনার কাছে এলো কেমনে সেটাই বুঝতে পারছি না। ছবির ক্যাপশনে লেখা,
‘হাওয়ায় ভেসেছে মন,
মগ্ন মেঘে দিয়েছে সারা।
তোমার এক টুকরো হাসিতে,
আমি হয়েছি মাতোয়ারা…!’
প্রচন্ড অবাক হয়ে বসে আছি আমি। তাসফি ভাই এগুলো কেন করছেন? ভালোবাসেন? তবে, কিয়ানা? কিয়ানা আপুর সাথে তাহলে ওনার কিসের সম্পর্ক? অনেক কৌতুহল নিয়ে অল ফটোস্ এ ঢুকলাম। পুরোনো কিছু ছবি দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। ইস্ এই ছবিগুলো কত খুঁজেছি কাজিন মহলের সবার আইডি তে গিয়ে, কিন্তু পাই নি। কিন্তু তাসফি ভাইয়া প্রতিটি ছবিই যেন অনেক যত্নের সাথে রেখে দিয়েছেন। তাসফি ভাইয়ার সাথে আমার কিছু ছবি নজরে পড়তেই ঠোঁটের হাসিটা আরও প্রসস্থ হয়ে গেল। আগে ওনার সাথে ছবি তোলার জন্য কতই না পাগলামি করতাম, উনি কতই না জোর করে ছবি তুলতেন আমার সাথে।
.
সকালে স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছি। এর মাঝেই কলিং বেলের শব্দ ভেসে আসতেই প্রচন্ড বিরক্ত হলাম। বড়মা বাসায় নাই, কয়েকদিনের জন্য বাবার বাসায় গেছে। রিফাপু কোচিংয়ে আর রিমি আপু পড়াশোনার জন্য শহরের বাহিরে। আম্মুও মাত্র ছাদে গেছে কালকের ভেজা কাপড় নিয়ে। এই মুহুর্তে বাসায় দাদী আর আমি ছাড়া তৃতীয় কোন ব্যক্তি নেই। দাদীর বয়স হওয়ায় তার তো দরজা খোলার প্রশ্নই আসে না। আবার বেজে উঠলো কলিং বেলের শব্দ। প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে চুলগুলো বেনি করতে করতেই রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। দাদীও দেখি গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। দাদীকে বসতে বলে এগিয়ে গেলাম দরজা খুলতে। এতক্ষণ যতটা বিরক্তি এসে ভর করেছিলো চোখে মুখে ঠিক তার থেকেও দ্বিগুণ উৎসাহিত হয়ে উঠলো দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা তাসফি ভাইয়াকে দেখে। আমাকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধমকে উঠলেন,
“হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বেয়াদব! সর সামনে থেকে।”
ওনার ধমক খেয়েছে দু’পা পিছিয়ে ওনাকে যাবার জায়গা করে দিলাম। তাসফি ভাইয়া সোজা দাদীর কাছে চলে গেলেন। দাদীকে দেখে বলে উঠলেন,
“কি গার্লফ্রেন্ড, কি অবস্থা তোমার?”
আমি দরজাটা আঁটকে আসতেই দাদী বলে উঠলো,
“ভালো আছিস ভাই? কত দিন পরে দেখলাম তোকে। এত শুকে গেছিস ক্যা?”
“কি করবো গার্লফ্রেন্ড বলো? আমার তো আর তোমার মতো সুন্দরী বউ নাই, যে একটু যত্নআত্তি করবে। তাড়াতাড়ি আমার বিয়েটা দিয়ে দিলেও তো পারো।”
“তোর না হওয়া বউটা যে এখনো অনেক ছোট, আর একটু বড় হতে তো দে।”
“আহা! গার্লফ্রেন্ড তুমি বুঝলে না। বাচ্চা বউ থাকাটা যে কত মজা, সারাক্ষণ কোলে নিয়ে ঘোরা যায়। বেশি বেশি আদর করা যায়।”
“তুই যে বউ পাইয়ে আমারে ভুলে যাবি, সেটা কিন্তু বুঝবার পারছি। তাই এখন বিয়ের চিন্তা বাদ দে।”
আমি গোলগোল চোখ করে তাসফি ভাইয়া আর দাদীর কথাগুলো শুনে যাচ্ছি। তাসফি ভাইয়া আমার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। বললেন,
“তোমাকে ভুলে যাওয়া কি এতই সহজ গার্লফ্রেন্ড? তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা বলে কথা।”
“হু হু! সব বুঝি আমি। তুই যে এখন থেকেই রু….”
“তোর না স্কুল আছে? স*ঙ্গের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা রেডি হয়ে নে।”
দাদীর কথাটা শেষ না হতেই আমাকে ধমকে উঠলেন তাসফি ভাইয়া। আমও আবার কি করলাম যে এভাবে ধমকাতে হবে? ব/জ্জা/ত বদ*মাইশ একটা লোক, হু! সেখানে না দাঁড়িয়ে বিরবির করতে করতে রুমে চলে আসলাম। এবারের লম্বা ছুটিতে এসেছেন তাসফি ভাইয়া, ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে। ওনার আসাতে খুশি হলেও খুব একটা খুশি হতে পারলাম না। কারণ আর সপ্তাহ দুয়েক পরেই আমার এইটের বোর্ড পরীক্ষা। পড়াশোনা নওয়ে অনেকটা চা*পের মুখেই বলা যায়।
চট জলদি বাকিটা রেডি হয়ে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। বসার রুমে এসেই দেখি আম্মু ইতিমধ্যে চলে এসেছে। আম্মু আর দাদীকে বলে বেরিয়ে আসতেই আমাকে আঁটকে দিলেন তাসফি ভাইয়া। আম্মুকে বলে উঠলেন,
“মামী আমি বরং ওকে স্কুলে দিয়ে আসি, বাসায় একা একা থেকে কি করবো।”
“আচ্ছা যা, দুপুরের আগেই ফিরিস কিন্তু।”
“আমি একেবারে রূপাকে নিয়ে আসবো নি, চিন্তা করো না।”
বলেই আমাকে এগোতে বললেন। আমার খুশি আর দেখে কে? তাসফি ভাইয়া আমার স্কুলে যাবার পর যখন ক্লাস ফ্রেন্ড সহ নাইন টেনের বড় আপুরা বলে ‘এটা তোমার কে হয়?’ তখন যেন নিজেকে সেলিব্রিটি সেলিব্রিটি মনে হয়। ইস্! আজকে কতদিন পর তাসফি ভাই আমাকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন। খুশিতে আটখানা হয়ে এগোতে লাগলাম, তাসফি ভাইয়া দাদীকে ‘আসছি গার্লফ্রেন্ড’ বলেই আসতে লাগলেন আমার পিছন পিছন।
.
.
চলবে…..
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।🖤