তুমি বললে আজ ২ পর্ব -৪২ ও শেষ

#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৪২.

.
একটা রাতের ব্যাবধানেই ব্যাপক পরিবর্তন উপলব্ধি করলাম নিজের মধ্যে। বারংবার মনের কোণে উঁকি দিতো তাসফি ভাইয়ের কেয়ার, ভালোবাসা সবটাই শুধুমাত্র বাচ্চার জন্য, আমার জন্য জাস্ট দেখানো, সবকিছু সাজানো। ওনার হঠাৎ জড়িয়ে ধরায়, ওনার আদুরে মাখা কথাগুলোই রাতে ঠিকই শান্ত হয়েছিলাম। কিছু সকাল হওয়ার পর থেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছি না নিজেকে। ওনাকে কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না। মাথায় শুধু একটা কথায় গেঁথে গেছে যেন, চলে যেতে হবে আমাকে। ওনার থেকে নিজেকে মুক্তি করে বহু দূর চলে যেতে হবে। ওনার এই ভালোবাসা বিহীন দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি করে নিতে চাই নিজেকে।

শরীরে র*ক্ত না থাকায় প্রোপার বের্ড রেস্টে দিয়েছে ডাক্তার। আর এই বের্ড রেস্টে নিজেকে বন্দী দশায় মনে হচ্ছে। খাওয়া দাওয়ার সবটার পরিচালনায় করছে আম্মু, ফুপি ও বড়মা মিলে। ভার্সিটি থেকে কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়ে তাসফি ভাইও পুরোটা সময় আমাকে দিচ্ছেন। যদিও এখন আর ওনার এই কেয়ার করাটা আমার কিছু যায় আসে না। সবটাই কেমন জানি ধোঁয়াশায় ঘেরা বলে মনে হয়।

রুমে কাউকে না পেয়ে উঠে বসলাম বিছানা ছেড়ে। ফ্লোরে পা ফেলে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই সামনে এসে কেউ দাঁড়ালো। পা থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত দেখেই বুঝতে পারলাম মানুষটা ঠিক কে হতে পারে। বিরক্ত হলাম কিছুটা। উঠে দাঁড়াতেই আমার হাত ধরে ফেললেন তাসফি ভাই। বললেন,

“কোথায় যাবি? উঠছিস কেন?”

ওনার কথায় বিরক্তির মাত্রা কিছুটা বৃদ্ধি পেল। জবাব না দিয়ে সরে যারার চেষ্টা করলাম। এবার দু’হাতে ধরে ফেললেন আমায়। বললেন,

“কি হলো? বলতে পারছিস না, কোথায় যাবি?”

“আপনাকে কেন বলতে হবে? দেখি ছাড়েন, আমি….”

“ঠিক আছে, বলতে হবে না।”

বলেই হুট করে কোলে তুলে নিলেন। চেঁচিয়ে উঠলাম কিছুটা, ছটফটিয়ে নামার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। ধমকে উঠলেন উনি। বললেন,

“অসুস্থ শরীর নিয়ে এমন পেঙ্গুইনের মতো লাফালাফি করছিস কেন? বেয়াদব! বলতে পারছিস না কোথায় যাবি?”

মিইয়ে গেলাম ওনার ধমকে। বজ্জাত লোক একটা। এই বিখ্যাত ধমক ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না যেন। তাকালাম ওনার দিকে। মিনমিনে গলায় আস্তে করে বললাম,

“ও..ওয়াশরুমে যাবো।”

“আগে বললে কি হতো? ঢং করতে ভালো লাগে, তাই না?”

কিছু বলার আগেই উনি এগিয়ে যেতে লাগলেন ওয়াশরুমের দিকে। ভেতরে ঢুকে নামিয়ে দিয়ে বললেন,
“আমি এখানেই আছি, দরজা আটকাতে হবে না।”

“আপনি কিন্তু….”

আমাকে বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে গেলেন। হতাশার নিশ্বাস ছাড়লাম আমি। এই মানুষটা কখনোই ভালো হবার নয়। আস্ত একটা বজ্জাত লোক।

কিছুটা সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম ওনাকে। এগিয়ে যেতে চাইলে উনি আবারও হুট করে কোলে তুলে নিলেন। ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম ওনাকে। বললাম,

“আরে… আবার কোলে নিতে হবে কেন? এতটুকুও কি যেতে পারবো না আমি?”

“গায়ে এতটুকুও শক্তি নাই। আর বলে কি না, ‘এতটুকুও কি যেতে পারবো না আমি’। হু!”

“এই…. এই, আপনি কি আমায় ভেঙ্গেচ্ছেন?”

“আরে না, ভেঙ্গাবো কেন? পাগল! আমি তো আমার বউটাকে আদর করতে চাচ্ছি।”

বলেই টুপ করে ওনার ঠোঁটের স্পর্শ ছুঁয়ে দিলেন আমার ঠোঁটে। মুহুর্তেই চোখ দুটো বড় বড় আকৃতির ধারণ করলো যেন। ওনার থেকে এমনটা কিছুতেই আসা করি নি আমি। অসভ্য লোক একটা। যখন যেটা ইচ্ছে হবে, তখন কি সেটাই করে যাবে আমার সাথে? কিছুটা চেঁচিয়ে উঠে বললাম,

“অসভ্য, বজ্জাত লোক একটা, নামান বলছি আমাকে।”

বিছানায় নামাতে গিয়েও নামালেন না আমার। শক্ত করে জড়িয়ে পিছিয়ে এলেন কিছুটা। বিরক্ত হলাম আমি। চোখে মুখে বিরক্তির রেশ ফুটিয়ে এনে বললাম,

“কি হলো? নামাতে বললাম না? দেখি, ছাড়েন আমায়।”

“ছাড়তে তো ইচ্ছে হচ্ছে না বউ, তোমাকে কোলে নিয়ে শুধুই আদর আদর পাচ্ছে।”

স্থির দৃষ্টিতে তাকালাম ওনার দিকে। আস্তে করে বললাম,
“এতোদিন? এতদিন তো আমাকে সহ্যই করতে পারেন নি, তাহলে আজকে হঠাৎ আমাকে দেখে এত আদর আদর পাচ্ছে কেন?”

চমকে উঠলেন তাসফি ভাই। আবাক চোখে তাকালেন আমার দিকে। হয়তো আমার থেকে এমন কথা প্রত্যাশা করেন নি। হালকা হাসলাম আমি। আবারও বললাম,

“ওও সরি! আমি তো ভুলেই গেছিলাম, আপনার এই আদর, এই ভালোবাসা সবটাই তো আমাদের সন্তানের জন্য, আমার জন্য তো এর বিন্দু পরিমাণও নেই।”

“রুপু…. কি বলছিস এগুলো? আমি তোকে….”

“ঠিক কথায় তো বলছি। আমার প্রতি আপনার সবটায় তো দেখানো, দ্বায়িত্ব মাত্র। ভালোবাসা তো নয়।”

“কেন মনে হয় এমনটা তোর?”

“আপনার করা অবহেলা গুলো ঠিকই বুঝিয়ে দেয় আমাকে। একটুকুও ভালোবাসেন না আপনি আমায়। থাকবো না আমি, চলে যাবো এখান থেকে।”

সহসায় কিছু বললেন না উনি। আলগোছে শুইয়ে দিলেন বিছানায়। উনিও ঝুঁকে এলেন আমার দিকে। আস্তে করে বললেন,
“চলে যাবা? আচ্ছা ঠিক আছে, কেন চলে যেতে চাও?”

ওনার বলা কথায় কান্না পেল আমার। নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিলাম। বলে উঠলাম,

“আপনার অবহেলা ঠিক সহ্য হয় না আমার, নিতে পারি না আমি। আপনার ভালোবাসা নামক দায়বদ্ধতায় জড়িয়ে রাখতে চাই না নিজেকে। আপনার দ্বায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্তি করে নিতে, চলে যাবো আমি, অনেক দূর চলে যাবো।”

আঁটকে রাখা কান্নাটা দলা পাকিয়ে আসলো। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। দু-হাত গালে রেখে আলতো করে চোখের পানিগুলো মুছিয়ে দিলেন। বেশ কিছুটা সময় তাকিয়ে থাকলেন এক দৃষ্টিতে। চোখ সরিয়ে নিলাম ওনার থেকে। ওনাকে ছাড়িয়ে ওঠার চেষ্টা করতেই হুট করেই জড়িয়ে ধরলেন আমায়। গলার ভাঁজে মুখ গুঁজে দিলেন। কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলাম, স্থির হয়ে গেলাম মুহুর্তেই। বেশ কিছু সময় সেভাবেই থাকার পর মৃদুস্বরে বলে উঠলেন,

“ভালোবাসি! ভালোবাসি! ভালোবাসি! আমার রুপুসোনা কে ভীষণ ভালোবাসি। আমার এই ভালোবাসা থেকে কিছুতেই আপনার মুক্তি নেই ম্যাডাম।”

অনুভব করলাম হঠাৎ কাঁপুনির মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। অজান্তেই এক হাত চলে গেল ওনার ঘারে। খামচে ধরলাম ওনার টি-শার্ট। অস্পষ্ট সুরে আস্তে করে বললাম,

“আপনার অবহেলায় বেঁচে থাকা সম্ভব, ভালো থাকা সম্ভব নয় তাসফি।”

আগের চেয়েও অধিক ভাবে জড়িয়ে নিলেন নিজের সাথে। একটু ছাড় পেলেই মনে হয় হারিয়ে যাবো ওনার থেকে। কিছু একটা বললেন, কিন্তু কোন কথায় যেন আমার কান পর্যন্ত পৌঁছালো না।

.
বয়সের তুলনায় দিন দিন নিজেকে ছোট বলে মনে হচ্ছে। বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে নিজেই যেন একটা বাচ্চাতে পরিণত হয়ে উঠেছি। আম্মু ও ফুপির সারাদিনের এত এত যত্ন আর ভালোবাসায় ঠিক বাচ্চা বলেই মনে হচ্ছে নিজেকে। প্রায় তিন মাস সময় কেটে গেছে তাদের আদর যত্ন খেতে খেতে। তাসফি ভাইও কেয়ার, যত্ন নামক ব্যাপক অত্যাচার চালু করেছেন আমার প্রতি। ফিরে এসেছেন তার পুরোনো সত্তায়। ওনার লাগাম ছাড়া কথা বার্তায় জ্বালিয়ে ফেলেছেন আমায়। লাগাতার ওনাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেও কেন কাজ হয় নি। ওনার থেকে দূরে চলে যাবার প্রয়াশ চালিয়ে গেলেও তাতেও কোন লাভ হয় নি। ঠিকই আমাকে বেঁধে ফেলেছেন উনি।

আম্মু চলে গেলেও আবারও এসেছে। আমার এই অসুস্থতায় নাকি কিছুতেই ওখানে মন টিকে না। ডেলিভারি পর্যন্ত আমার সাথেই থাকতে চায়। বাসার কেউ আর বারণ করে নি আম্মু কে। নয় মাসে পড়লেও ডেলিভারির সময়টা এখনো অনেক। এতদিনে আমার উন্নতিটাও হয়েছে কিছুটা। শরীরে র”ক্তের পরিমাণটাও কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ডেলিভারির সময় এটাও নাকি পর্যন্ত পরিমাণ নয়। এতটুকুই বা হবেই না কেন? মি. বজ্জাত তাসফি যে নিজে আমার প্রতিটি দ্বায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ডাক্তার তবুও সাবধানে চলাফেরা করতে বলেছেন, প্রোপার রেস্টে থাকতে বলেছেন।

খাবার ভর্তি প্লেটে আম্মু ও ফুপি সামনে এসে বসতেই বিরক্তিতে চোখ মুখ ছেয়ে গেল। খাবার গুলো দেখেই গা গুলিয়ে দুপুরের খাবার গুলো বেরিয়ে আসতে চাইলো। মাঝখানে অনেকটা সুস্থবোধ করলেও ইদানীং আবারও খাবারে গা গুলিয়ে বমি বমি ভাব শুরু হয়েছে। সবাই আবারও বেশ চিন্তায় পড়বে বলে বুঝতে দেই নি কাউকে। কিন্তু আজকে হঠাৎ খাবারগুলো দেখে আর সামলাতে পারবো না হয়তো নিজেকে। চোখে মুখে হাজারো বিরক্তি এনে বললাম,

“খাবো না আমি, নিয়ে যাও এগুলো।”

“খাবি না মানে? দুপুরেও তো ঠিক ভাবে খাস নি, অল্প করে খেয়ে নে।”

“খাবো না। তোমাদের কি আর কোন কাজ নেই? সারাক্ষণ শুধু আমার খাওয়ার পিছনে পড়ে থাকো? নিয়ে যাও তো এগুলো।”

আম্মু কপাল কুঁচকে তাকালো আমার দিকে। ফুপি বলে উঠলো,
“কেন মা? আবার কি হলো তোর? কয়েকদিন থেকেই দেখছি, আবারও খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিছিস।”

“আমার বউকে তোমাদের খাওয়ানোর সাধ্য নেই আম্মু। সে তো বাচ্চা, বাচ্চাদের মতোই আদর দিয়ে খাওয়াতে হবে। সেটা অবশ্যই তার একমাত্র বরের আদর হতে হবে।”

ফুপির কথার প্রতিত্তোরে হঠাৎ রুমে ঢুকে বলে উঠলেন তাসফি ভাই। কটমট চোখে তাকালাম ওনার দিকে। একদল রাগ এসে ভীর জমালো। অসভ্য লোক একটা, সবসময় নির্লজ্জ মার্কা চলতে থাকে তার মুখে। আমি রাগে মুখ ফুলিয়ে ফেললেও আম্মুও ফুপি স্বাভাবিক ভাবেই নিলো কথাটা। উনি আবারও বললেন,

“মামী, আম্মু তোমরা যাও। ওকে আমি খাওয়াচ্ছি।”

“খাওয়াতো বাবা। দিন দিন যা অবস্থা হচ্ছে শরীরের। আমার তো খুব চিন্তা হয়, কি যে হবে…”

বলেই উঠে দাঁড়ালো আম্মু। ফুপিও একই সুরে তাল মিলিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আমাকে খাওয়ানোর কথা বলে দুজনেই বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে। এবার রীতিমতো কান্না পেল আমার। নিজেকে স্কুলের বাচ্চা উপাধি দিতে ইচ্ছে হলো। আমার ভাবনার মাঝেই প্লেটটা হাতে নিয়ে নিয়ে এগিয়ে এলেন মি. বজ্জাত লোকটা। খাওয়াতে চাইলে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। খেতে চাইলাম না কিছুতেই। ধমকে উঠলেন উনি। বারণ করলেও শুনলেন না। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও খেতে হলো। বার কয়েক মুখে দিলেও পরবর্তীতে আর পারলাম না। মুখ ফুলিয়ে আস্তে করে বলে উঠলাম,

“আর খাবো না, প্লিজ!”

“হা কর, আর একটু….”

“প্লিজ! আর একটু খেলে বমি হয়ে যতটুকু খেয়েছি সেটাও বেরিয়ে আসবে। পরে খেয়ে নিবো।”

আমার কথায় মায়া হলো হয়তো ওনার। রেখে দিলেন খাবারের প্লেট, কড়া গলায় বললেন পড়ে কিন্তু খেতে হবে। আমিও মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলাম। বোঝালাম, অবশ্যই খাবো। কপাল কুঁচকে একবার তাকিয়ে চলে গেলেন সবকিছু নিয়ে।

.
প্রতিদিনের মতো আজকেও ঠিক মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেল। প্রতিরাতে সাধারণ ভাবে ঘুম ভেঙে গেলেও আজকে আচমকাই একটা বাজে স্বপ্নে ঘুমটা ভাঙলো। জাগার পর কিছুতেই মনে করতে পারলাম না স্বপ্নটা ঠিক কি ছিলো।কিন্তু খুব বাজে একটা স্বপ্ন ছিলো সেটা উপলব্ধি করতে পারলাম। প্রতিদিনের মতোই নিজেকে ওনার বুকে আবিষ্কার করলাম। হঠাৎ দেখা বাজে স্বপ্নে দুরুদুরু বুক মৃদু কাঁপতে লাগলো পুরো শরীর। জড়িয়ে থাকা তাসফি ভাইকে আরও জড়িয়ে ধরলাম। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে শান্ত করালাম নিজেকে। হালকা মাথা তুলে তাকালাম ওনার দিকে। গভীর ঘুম ঘুমিয়ে আছেন। প্রতিদিন ঘুম ভাঙার পর নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই ঘুম ভেঙে যায় ওনার। আমার উঠতে না দিয়ে আরও শক্ত করে জড়িয়ে নেন নিজের সাথে। হাজারো বিরক্ত করে নানান কথা বললেও তার কোন কথায় কানে নেন না উনি। সেদিন হঠাৎ অসুস্থ হবার পর গত কয়েক মাসে আগেই তাসফি কে ফিরে পেয়েছি, সাথে ওনার সেই পাগলামিতে ভরপুর ভালোবাসা। হ্যাঁ! এই মানুষটার সবকিছুই শুধু আমার জন্য, নিজের থেকেও বেশি আমাকে ভালোবাসেন। গত তিন মাসে আমাকে আবারও নতুন ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

রুমের আবছায়া আলোয় তাকালাম ওনার দিকে। বাচ্চাদের মতো শান্ত হয়ে গভীর ঘুমে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে কপালে, গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। এমতাবস্থায় ওনাকে দেখে অবাধ্য অনুভূতি গুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। হাত বাড়িয়ে আলগোছে ছুঁয়ে দিলাম ওনার গালে। এলোমেলো চুলেও হাত বুলিয়ে দিলাম। একটু নড়েচড়ে উঠলেন উনি। সাবধানতায় দু’হাতে আগলে নিলেন। হালকা হাসলাম আমি। ঘুমের ঘোরেও ঠিক কতটা আগলে রাখে আমাকে। মাথা উঁচিয়ে আলতো করে ঠোঁটের স্পর্শ দিলাম ওনার গালে। সরে এসে আলগোছে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। সারাটাদিন ভার্সিটি ও আমাকে সামলে এতটাই ক্লান্ত যে জাগা পেলেন না কিছুতেই।
আস্তে আস্তে নেমে যেতে লাগলাম বিছানা ছেড়ে। মাথাটা হঠাৎ চক্কর দেবার সাথে সাথে গা গুলিয়ে উঠলো। বিছানা ছেড়ে আস্তে করে নেমে এগিয়ে গেলাম টেবিলে দিকে। গ্লাসে পানি ঢেলে হাতে নিতেই শরীরে হালকা কম্পন সৃষ্টি হলো, গ্লাসের অর্ধেক পানি পারে গেল ফ্লোরে। হতাশার নিশ্বাস ছাড়লাম। বাকি পানিটা খেয়ে রেখে দিলাম গ্লাসটা। কিছুটা রিলাক্স ফিল করলেও পুরোপুরি পারলাম না। রুমের আবছা আলোয় গুটিগুটি পায়ে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে বেরিয়ে এলাম। এবার কিছুটা স্বস্তি পেলাম যেন। বিছানার দিকে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ তরল কিছুর সাথে পা লেগে গেল। দু’হাত বাড়িয়ে কিছু ধরার চেষ্টা করেও পেলাম না। ভারসাম্য রাখতে পারলাম না নিজের, স্লিপ কেটে পা পিছলে গেল সহসায়। এক হাত পেটে রেখে আত্মদান করে ডেকে উঠলাম ওনাকে।

“আহ্! তাসফিইই….”

ফ্লোরে পড়তেই নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেললাম মুহুর্তেই। অসহ্য ব্যাথা আর যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলাম সমানে। হালকা ভাবে কানে ভেসে আসলে নিজের নাম, জ্বলে উঠলো রুমের আলো। দু’হাতে আগলে ধরলো কেউ। কানে স্পষ্ট ভাবে ধরা দিলো কিছু কথা।

“রুপু! এই রুপু, কি হয়েছে তোর? এত ব্লাড কেন? তাকা আমার দিকে, এ্যাই মেয়ে….”

ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও চোখ খুলে তাকাতে পারলাম না ওনার দিকে, আর না জবাব দিতে পারলাম ওনার কথার। র*ক্ত কিসের সেটাও দেখার সুযোগ মিললো না। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলাম শুধু। এই মুহুর্তে শুধু একটা কথায় মাথায় আসতে লাগলো, আমার বাচ্চাটা ঠিক আছে তো? ওর কিছু হয় নি তো? বাচ্চার কথা ভেবে শক্ত করলাম নিজেকে। দু’হাতে ওনাকে খামচে ধরে চোখ খোলার চেষ্টা করলাম। অস্পষ্ট সুরে বলার চেষ্টা করলাম,

“আ..আমার বাচ্চাকে বাঁচিয়ে দিন তাসফি। ওর কিছু হতে দিয়েন না।”

এতক্ষণে কিছুটা হুস হলো ওনার। চিৎকার করে ফুপি ফুপা ও আম্মুকে ডাকতে লাগলেন। উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে দিয়ে ছুটে এলেন আমার কাছে। আলগোছে কোলে তুলে নিয়ে বলে উঠলেন,

“রুপু চোখ দুটো খোলা রাখ, একদম বন্ধ করবি না। তাকিয়ে থাক আমার দিকে।”

ওনার কথা মতো মিটমিট করে তাকানোর চেষ্টা করলাম। উনি চিৎকার করে আবারও ডেকে উঠলেন সবাইকে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই সবাই বেরিয়ে এলো। কিছু একটা বললেও তার কোন কথায় আমার কানে গেল না। তাসফি ভাই বলে উঠলেন,

“জানি না আমি, ওকে হাসপাতালে নিতে হবে। এখুনি সাদিকে ফোন করো।”

বলেই আমার দিকে তাকালেন। উত্তেজিত কণ্ঠে আমাকে বললেন,
“চোখ খোলা রাখ রুপু, একদম চোখ বন্ধ করবি না।”

যন্ত্রণায় ছটফট করলেও ওনার কথায় চোখ খুলে রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম, তাকিয়ে দেখতে লাগলাম ওনাকে। এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে এখানেই আমার জীবনের সমাপ্তি। কিন্তু আমার বাচ্চা? ও ঠিক আছে তো, পৃথিবীতে সুস্থ ভাবে আসতে পারবে তো? অস্পষ্ট সুরে ডেকে উঠলাম ওনাকে। বলার চেষ্টা করলাম,

“আম্…আমাদের বাচ্চাকে বাঁচিয়ে নেও তাসফি, ওর কিছু হতে দিও না। আমার দ্বায়িত্ব আর নিতে হবে না তোমাকে, ভালোবাসতে হবে না আমাকে। সবটা দিয়ে আমাদের সন্তানকে আগলে রেখো। আমাকে করা অবহেলা ওকে করবে না, আমার মতো ওকেও দূরে ঠেলে দিও না।”

“রুপু! এ্যাই রুপু, কিছু হবে না তোমার। তাকাও আমার দিকে। চোখ খোলা রাখো….”

“ওকে বাঁচিয়ে নেও তাসফি। আমাদের সন্তানের কিছু হতে দিও না। আমি ওর ক্ষতি চাই নি, ইচ্ছে করে এমনটা করতে চাই নি। আমি ওকে অনেক ভালোবাসি, অনেক….”

“একদম উল্টা পাল্টা কথা বলবি না….”

ধমকে চুপ করে দিলেন। পাত্তা দিলাম না আমি। নিজ মনে আবারও বলে উঠলাম,
“আমার দ্বায়িত্ব আর আপনাকে নিতে হবে না তাসফি। চলে যাবো, অনেক দূরে চলে যাবো….”

“এসব কথা একদম বলবি না। ঠিক কতটা ভালোবাসলে আমার থেকে দূরে যেতে চাইবে না রুপু, ঠিক ততটাই ভালোবাসবো তোমাকে। তার চেয়ে অনেক বেশিই ভালোবাসবো, তবুও আমাকে ছেড়ে যাবার কথা বলবে না।”

নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বলে উঠলেন। ওনার মাঝে আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় তীব্র ভাবে প্রতিফলিত হয়ে উঠলো। দু’হাতে ওনাকে খামচে ধরে অস্পষ্ট সুরে বলে উঠলাম,

“ভালোবাসি! আপনাকে অনেক বেশিই ভালোবাসি তাসফি।”

.
ধীরে ধীরে তীব্র যন্ত্রণার সাথে সাথে ছটফটানির মাত্রাটাও বেড়ে গেল। হাসপাতালে আনার পর অবস্থার গতিবেগ দেখে দ্রুত অপারেশন করতে চাইলো। অপারেশন থিয়েটারে যতই এগিয়ে নিতে যেতে চাইলো ততই তাসফি ভাই আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে রাখলেন। বলতে লাগলেন,

“অনেক ভালোবাসবো রুপু, তোমার কল্পনার থেকেও বেশি ভালোবাসবো তোমাকে, তবুও আমাকে ছেড়ে যাবার কথা ভাববে না তুমি….”

আরও কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারলেন না। হাত ছেড়ে নিলো ওনার থেকে, আমাকে নিয়ে চলে এলো।
অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে খুব জলদিই সবকিছু গুছিয়ে নিলো। বেশ কয়েকটা ইনজেকশন শরীরে পুস করে চোখ খোলা রাখার চেষ্টা করতে বললো সাদিক ভাইয়া। চোখ দু’টো বন্ধ হয়ে আসলেও অতি কষ্টে খোলা রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। ঠিক কতটা সময় পেরিয়ে গেল জানা নেই আমার। কানে ভেসে আসলো কারোর কথা।

“আর সম্ভব নয়। এমনিতেই শরীরে ব্লাড ছিলো না, তার মধ্যে এত ব্লাড লস, মা বাচ্চা দুজনের লাইফ রিক্সে, সম্ভবত একজন কে বাঁচানো যাবে।”

চমকে উঠলাম আমি। মুহুর্তেই শ্বাস প্রশ্বাসের আনাগোনা বেড়ে গেল। হাত বাড়িয়ে টেনে ধরলাম সাদিক ভাইয়ার হাত। তাকালেন আমার দিকে। এগিয়ে এসে দাঁড়াতেই মৃদু গলায় অস্পষ্ট সুরে বলে উঠলাম,

“আমাদের সন্তানকে বাঁচিয়ে নিন ভাইয়া, ওর কিছু হতে দিয়েন না। ত্…তাসফি ওকে অনেক ভালোবাসে, ওর কিছু হতে দিয়েন না ভাইয়া।”

.
.#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
অন্তিম পর্ব.

.
সময়ের গতিবেগে হারিয়ে যায় জীবনের একাংশ, রেখে যায় শুধু স্মৃতি গুলো। নতুন করে প্রাপ্তির তালিকায় যুক্ত হয় জীবনের নতুন সূচনা। যেটা আঁকড়ে ধরে মানুষ বাঁচে, শুরু করে জীবনের নতুন উদ্যোগে পথচলা। কিন্তু আমি? আমি কি এর একাংশও পেয়েছি? হ্যাঁ! অতীতের সবকিছুকে পিছনে ফেলে এগিয়ে এসেছি, তাসফি নামক মানুষটার হাত ধরে পারি দিয়েছি জীবনের অর্ধেক পথ। যে মানুষটা নিজের সবকিছু উজার করে দিয়েছে, পাগলের মতো ভালোবেসে গেছে আমাকে। কিন্তু তাকেই আমি ভুল বুঝেছি, বারংবার দূরে ঠেলে দিয়েছি সেই মানুষটাকে।

হঠাৎ পিছন থেকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরায় ভাবনার ছেদ কাটলো। কিন্তু চমকালাম না, অবাকও হলাম না বিন্দু পরিমাণ। শুধু হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটের কোণে, বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস।

“এতো ভাবুক হয়ে বউটা কি আমার কথায় ভাবে?”

ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম না ওনাকে। একই ভাবে সোনালি চাঁদের আলোয় পরিপূর্ণ হওয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বলে উঠলাম,

“উহুঁ! আপনার কথা ভাবতে যাবো কেন? আমি তো আমার বজ্জাত তাসফি’র কথা ভাবছি।”

“তা বজ্জাত তাসফি’র কথা কি ভাবছিলেন?”

“আপনাকে কেন বলবো? ঘরের কথা বাইরের মানুষকে বলতে নেই।”

“ওও আচ্ছা! তাই তো। আমিও এখন আমার বউকে আদর করবো, আপনি একদম বাঁধা দিতে পারবেন না।”

বলেই হাতের বাঁধনটা শক্ত হলো ওনার। বেনি করা চুলটা সরিয়ে গলার ভাঁজে মুখ গুঁজে দিলেন। ওনার স্পর্শের মাত্রা বৃদ্ধি পেতেই ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলাম। বলে উঠলাম,

“ইস্! সবসময় এমন করেন কেন? ছাড়েন তো, কেউ চলে আসবে।”

“আপনার কথা তো শুনবো না ম্যাডাম, আমি তো আমার বউ কে আদর করছি।”

“উফ্! সবসময় এত আদর করার মুডে কেমনে থাকেন?”

“কারণ আমার আস্ত একটা আদর করার জিনিস, তাই।”

চুপ হয়ে গেলাম আমি। ওনার কথার প্রতিত্তোরে কিছু বলতে পারলাম না। মিনিট দুয়েক অতিক্রম হবার পর যখন আমার কোন সারা পেলেন না, তখন উনিও থেমে গেলেন। আলগা করে ছেড়ে ঘুরিয়ে নিলেন নিজের দিকে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বোঝা র চেষ্টা করলেন। বললেন,

“কি হয়েছে?”

“আমাকে এতটা ভালোবাসেন কেন তাসফি?”

ওনার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললাম। সহসায় কিছু না বলে একই ভাবে তাকিয়ে রইলেন। এক হাতে কোমড় জড়িয়ে কাছে টেনে নিলেন, ঘুচিয়ে দিলেন মাঝের দূরত্ব। আস্তে করে বলে উঠলেন,

“কারণ, যতটা ভালোবাসলে আমার থেকে দূরে যাবার কথা কল্পনা করতে পারবে না, ঠিক তার থেকেও বেশি ভালোবাসবো।”

“আপনার এত ভালোবাসার সত্যিই কি প্রাপ্য আমি? বিরক্ত লাগে না আমাকে?

চেপে ধরলেন নিজের সাথে। আলতো করে ঠোঁটের স্পর্শ ছুঁয়ে দিলেন আমার কাপালে। বললেন,

“তোমাকে সারাজীবন, সারাটাক্ষন, সারাটা সময় ভালোবেসেও এই জনমে আমার সাধ মিটবে না রুপু। পরকালেও শুধু তোমাকেই ভালোবাসে চাই।”

সহসায় একদল নোনাজল এসে ভীর জমালো চোখের কোণে। ভারী হয়ে উঠলো গলা। ছলছল করে উঠলো চোখ দু’টো, টপ করে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। ভেজা গলায় বলে উঠলাম,

“আপনার ভালোবাসা আপনাকে দিতে পারলাম না তাসফি। আপনার ভালোবাসার জিনিসটা দিতে পারলাম না আপনাকে, আমাদের সন্তানকে….”

“তুমিই তো আমার ভালোবাসা রুপু, তোমাকে পাবার পর আর কোন ভালোবাসায় আমার প্রয়োজন নেই।”

ওনার কথাটা কানে আসলেও মস্তিষ্কে ধারণ করলাম না। শুধু বিচরণ করতে লাগলো ওনার বলা আগের কিছু কথা। ‘তোর জন্য আমার বাচ্চার কোন ক্ষতি হোক, সেটা আমি মেনে নিবো না।’ ‘তোর জন্য আমার বাচ্চার যেন কিছু না হয়।’ পারলাম না…. পারলাম না আমি ওনার এই কথা গুলোর ধারণা ভুল প্রমানিত করতে, পারলাম না আমি আমাদের সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে। কথাগুলো ভাবতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। বললাম,

“আমার জন্য আমাদের সন্তানের ক্ষতি হলো তাসফি, আমার জন্য ও পৃথিবীর আলো দেখাতে পারলো না। বিশ্বাস করো তাসফি, এমনটা আমি চাই নি, ইচ্ছে করে ওর কোন ক্ষতি চাই নি। বারবার…. বারবার করে সাদিক ভাইয়া কে বলেছিলাম ওকে বাঁচাতে, কিন্তু ভাইয়া আমার কোন কথায় শোনে নি, আমার জন্য আমাদের সন্তানকে….”

“রুপু, রুপু….শান্ত হও! কেন দোষারোপ করছো নিজেকে? সেদিন তোমার কোন হাত ছিলো না৷ অতিরিক্ত ব্লাড লসের কারণে ওকে বাঁচানো যায় নি, এতে তোমার কোন দোষ নেই।”

“আমার জন্য…. শুধুমাত্র আমার জন্যই ওকে বাঁচাতে পারে নি তাসফি।”

“ডাক্তাররা তো আর কম চেষ্টা করে নি, কিন্তু ওকে পাওয়ার ভাগ্যটা হয়তো আমাদের ছিলো না। তোমার কোন দোষ নেই রুপু।”

“আমি মা হয়ে ওকে সামলাতে পারলাম না তাসফি, আপনার সন্তানকে আপনার কাছে দিতে পারলাম না…..”

“একদম চুপ, আর একটাও কথা নয়। অনেক হয়েছে…..”

কিছু বলতে চাইলে আবারও চুপ করিয়ে দিলেন। জড়িয়ে ধরলেন নিজের সাথে, শান্ত করার প্রয়াস চালিয়ে গেলেন আমাকে। শরীরের পুরোটা ভর ছেড়ে দিলাম ওনার উপর, জোরে জোরে শ্বাস টেনে আপন মনে কেঁদে গেলাম। আলগোছে কোলে তুলে নিলেন, আবছায়া অন্ধকারাচ্ছন্নে ঘেরা বারান্দা থেকে রুমে নিয়ে আসলেন।

এগুলো নতুন কিছু নয়। বিগত ছয় থেকে সাত মাস এগুলোই হয়ে আসছে। হ্যাঁ! আমাদের সন্তানকে হারানোর প্রায় সাত মাস কেটে গেছে। পরিবারের সবাই ভুলে গেলেও আমি ভুলে যেতে পারি নি, মুছে দিতে পারি নি সেই দিনটার কথা। ভুলে থাকার চেষ্টা করলেও ওনার বলা কথাগুলো কানে বাজতে থাকে। ‘তোর জন্য আমার বাচ্চার কোন ক্ষতি হোক, সেটা আমি মেনে নিবো না।’
কথাটা মন ও মস্তিষ্কে এসে জমা হলে জেগে উঠে এক অপরাধী সত্তা। মা হয়ে আমি আগলে রাখতে পারলাম না আমাদের সন্তানকে। এই মানুষটাকে ছাড়া তো আমি নিজেকেই সামলাতে পারি না, সেখানে আমাদের সন্তানের এত বড় দ্বায়িত্বটা কিভাবে নিতে গেলাম আমি?

.
সেদিন অপারেশন থিয়েটারে সাদিক ভাইয়াকে কথাটা বলার পর সহসায় কোন জবাব দেয় না ভাইয়া। দূর্বল হাতে ভাইয়ার হাত ধরে আবারও বলতেই ভাইয়া বলে উঠে,

“নিজেকে শান্ত করো রূপা। আমরা তো চেষ্টা করছি। প্রচুর ব্লাড লস হয়েছে, তোমাকে ইমারজেন্সি ব্লাড দিতে পারলেও বেবির ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয়, হয়তো ইতিমধ্যে বেবিটা আর….. তবুও আমরা চেষ্টা করছি।”

বলেই একটু থামলো। জোরে নিশ্বাস টেনে সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বলে উঠলো,

“নিজের কথাটা না ভাবলেও তাসফি’র কথাটা একবার ভাবো। ছেলেটা কি পরিমাণ পাগলামি শুরু করেছে, যা বলার বাহিরে। তোমার কিছু হলে ও কিছুতেই ঠিক থাকবে না। নিজেকে শক্ত করো, তোমার মনের জোর আমাদের জন্য অনেক কিছু।”

মাথায় হাত বুলিয়ে সরে গেল ভাইয়া। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না, গলা দিয়ে কোন কথায় যেন বেরুলো না। চোখ দিয়ে সমামে গড়িয়ে পড়তে লাগলো অশ্রু। কিছুটা সময় পর শুধু একটা কথায় কানে আসলো, ‘ ইট’স্ নট সাকসেস।’ ঠিক তখনই চোখের সামনে আঁধার নেমে আসলো।

.
চোখ খুলে নিজেকে হসপিটালের বেডে’ই আবিষ্কার করেছিলাম। এক হাতে স্যালাইন চললেও অপর হাতটা তাসফি ভাইয়ের হাতের শক্ত বাঁধনে বেঁধে ছিলো। একটু নড়েচড়ে উঠতেই ব্যাপক উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন উনি। স্পষ্ট দেখেছিলাম ওনার চোখে কিছু হারানোর ভয়। অস্পষ্ট সুরে বাচ্চার কথা জানতে চাইলেও সহসায় কোন উত্তর দিতে পারেন নি উনি। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে আমাকে বুঝিয়ে গিয়েছিলেন কিছু একটা। আমি আস্তে করে বলে উঠি,

“আমার জন্য…. আমার জন্য আমাদের বেবিটা পৃথিবীর আলো দেখাতে পারলো না তাসফি। আপনি আমায় ক্ষমা করবেন না, একদম না….”

চোখের কোণ বেয়ে পড়তে থাকা পানির ফোঁটাগুলো মুছে দেন। আলতো করে কপালে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বলেন,

“আমার শুধু তোমাকে চাই, আর কাউকে না, কিচ্ছু না। তোমাকে ভালো রাখতে বাচ্চার কথায় তোমাকে মানাতাম। আমার সবটা জুড়ে শুধু তুমি, চাই না আর কিছু। তুমি বললে আজ থেকে অনেক ভালোবাসবো, অনেক বেশিই, তবুও আমার থেকে দূরে যাবার কথা ভাববে না, কষ্ট দিয়ে দূরে ঠেলে দিবে না আমাকে।”

ওনার বলা কথাগুলো শোনার পর আর কোন কথায় বলি নি আমি, সাহসটাও করে উঠি নি। কি-ই বা বলতাম? যে মানুষটা আমাকে এতটা ভালোবাসে তাকে তো বাবা হওয়ার সুখ টাই দিতে পারলাম না। আর না পেরেছিলাম নিজের সন্তানকে দেখতে। শুধু জেনেছিলাম ফুটফুটে এক ছেলে হয়েছিলো আমাদের। যে ছেলে কে ছুয়ে দেখার ভাগে আমার ছিলো না।

সেদিনের পরও ওনার সামনে এই বিষয় নিয়ে কোন কথা উঠায় নি। কিন্তু সময় যতই চলে যেতে লাগলো, ঠিক ততই যেন ভেতর ভেতর ভেঙে যেতে লাগলাম। নাম না জানা এক অপরাধী সত্তা জাগ্রত হতে লাগলো। বারংবার ভেঙে পড়লেও আমাকে সামলে গেছেন বরাবরের মতো, আগলে রেখেছেন নিজের সাথে।

.
“এ্যাই রুপু….”

বেড়িয়ে এলাম নিজের করা ভাবনা থেকে। গত সাত মাসে এগুলো শুধুই স্মৃতি, তবুও যেন সেই স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারি নি।

বিছানায় বসে আলতো ভাবে জড়িয়ে রাখলেও বেশ শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছি ওনাকে। ফ্রেশ হবার জন্য যেতে চাইলেও ওনার কোন কথায় যেন আমি কানে নিলাম না। উনি আবারও ডেকে উঠলেন। বললেন,

“রুপু, এখন তো ছাড়। আমি….. ”

“আমার বেবি চাই তাসফি। আমি আবারও মা হতে চাই, আপনাকে বাবা হবার আনন্দ দিতে চাই।”

হতাশার নিশ্বাস ছাড়লেন উনি। আমাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দু’ গালে হাত রাখলেন। বললেন,

“প্রতিদিন-ই তো এই কথাটা বলো, আর আমার উত্তরটাও তো সেই একই হয়। তাহলে বলো কেন?”

“প্লিজ! তাসফি, আর বাঁধা দিবেন না। সাত মাস তো কম নয়, অনেক বেশিই সময়। তাহলে সমস্যা কোথায়?”

“সমস্যাটা তুমি। তুমি এখনো বাচ্চা নেবার জন্য রেড়ি নও। তোমাকে নিয়ে আর কোন রিক্স নিতে পারবো না রুপু।”

“আমি একদম ঠিক আছি, সুস্থ আছি। প্লিজ! তাসফি, আমার কথাটা একটু শোনো। এবার সব কথা মেনে চলবো তোমার, একদম অবাধ্য হবো না।”

“রুপু তুই কিন্তু….”

“প্লিজ! তাসফি প্লিজ! আমি আর তোমার অবাধ্য হবো না।”

জোরে করে নিশ্বাস ছাড়লেন উনি। এতদিন পর আমার করা জেদের কাছে হাল ছেড়ে দিলেন। বলে উঠলেন,

“আচ্ছা ঠিক আছে, এখন তো ছাড়।”

ওনার সম্মতি পেয়ে মুহুর্তেই খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। অজান্তেই জড়িয়ে ধরলাম ওনাকে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলাম,

“থ্যাঙ্কিউ! থ্যাঙ্কিউ, তুমি বললে আজ থেকেই আমরা….”

“রুপু!”

কথার মাঝেই ডেকে উঠলেন উনি, থামিয়ে দিলেন আমাকে। বলে উঠলেন,

“আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তুই খাবার রেডি কর, জলদি।”

বলেই ছাড়িয়ে নিলেন আমাকে। কিছু বলার জন্য উদ্যোগ হতেই আবারও থামিয়ে দিলেন। আমিও আর বাঁধা দিলাম না ওনাকে। ওনার কথা অনুযায়ী ছেড়ে দিলাম, খাবার রেডি করতে নিচে নেমে গেলাম।

এই কয়েক মাসে এভাবেই আমাদের দু’জনের ছোট সংসার চলছে। আমি কিছুটা সুস্থ হবার পরেই সবাই চলে গিয়েছে, তাসফি একা হাতে সামলে গিয়েছে আমাকে। কয়েকবার বগুড়া থেকে ঘুরে আসলেও কখনোই থাকতে দেন নি, দূরে থাকতে দেন নি আমাকে। আমাকে নিজের সাথেই নিয়ে ফিরে এসেছেন। পড়াশোনার জন্য নিজেকে ব্যস্ত রেখে বাচ্চার কথা ভুলে থাকবো ভেবে এখানকার কলেজে ট্রান্সফার করে নিয়ে এসেছে। তবুও নিজের থেকে দূরে রাখেন নি। এতদিন এত শত বলে কয়েও ওনাকে রাজি করাতে পারি নি বাচ্চা নেওনার জন্য। বারংবার আমাকে বুঝিয়ে গেছেন আমি প্রস্তুত নয় বাচ্চা নেবার জন্য, আমাকে নিয়ে নতুন ভাবে রিক্স নিতে রাজি নয়। আজকে হঠাৎ এভাবে আমাকে চমকে দিয়ে রাজি হয়ে যাবেন, সেটা ভেবেই ব্যাপক খুশি লাগছে। এবার হয়তো ছেলেকে হারানোর কষ্টটা একটু হলেও ভুলে থাকতে পারবো।

.
প্রায় তিন মাস ধরে চেষ্টা করার পরও যখন কনসিভ করতে পারছিলাম না, তখন মা হওয়ার আসা টাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভেঙে পড়েছিলাম আবারও নতুন ভাবে। কিন্তু তাসফি…. তাসফি হারে নি, ভেঙে পড়ে নি মোটেও। প্রতিনিয়ত আশ্বাস দিয়ে গেছেন আমাকে।
গত মাসে আবারও পিরিয়ড মিস হওয়ায় ও শরীর দূর্বলতার কারণে গতকাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান আমাকে। সন্দেহর তালিকায় প্রেগন্যান্সির টেস্ট করায় ডক্টর। ডক্টর সন্দেহ করলেও কেন জানি মনে হচ্ছে এবারও হেরে যাবো আমি, মা ডাক থেকে চিরতরে বঞ্চিত হবো।

হঠাৎ পিছন থেকে জড়িয়ে ধারায় চমকে উঠলাম আমি। প্রতিবার ওনার হুটহাট জড়িয়ে ধরায় চমকে না উঠলেও আজকে ব্যাপকভাবে চমকে উঠলাম। কারণটা টেস্টের রিপোর্ট। টেস্টের রিপোর্ট আনতেই গিয়েছিলেন উনি, প্রতিবারের মতো এবার আমি যেতে চাইলে বারণ করে দেন উনি, একা গিয়েই আনবেন সেটাও জানিয়ে দেন। জানি না কি আছে রিপোর্টে, হঠাৎই বুকের টিপটিপ শব্দের প্রতিধ্বনি দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। রাগের কারণ না থাকলেও রাগ দেখালাম ওনাকে। বললাম,

“কতদিন বলছি বাসায় আসলে কলিং বেল দিবেন, এভাবে চোরের মতো লুকিয়ে বাসায় ঢুকেন কেন? আসেন ভালো কথা, এভাবে ভয় দেখান কেন?”

“কারণ এভাবে হুটহাট আপনাকে চমকে দিয়ে আমার ভীষণ ভালো লাগে।”

“আর আমার? আমার ভয় লাগে না বুঝি?”

“তা আজকে হঠাৎ ভয় পেলি কেন?”

“কারণটা কি আপনার অজানা?”

সহসায় কিছু বললেন না উনি। ঘুরিয়ে নিলেন আমাকে নিজের দিকে। চোখে মুখে গম্ভীরতা ফুটিয়ে আনলেন। বললেন,

“উহুঁ! তবুও জানতে চাই।”

“রিপোর্টে এবারও নেগেটিভ আসছে, তাই না?”

বলতেই একদল নোনাজল এসে ভীর জমালো চোখে। চোখের কার্ণিশ বেড়ে অশ্রুগুলো গড়িয়ে পড়ার আগেই জড়িয়ে ধরলেন, শক্ত করে আঁটকে নিলেন নিজের সাথে। আমি বুঝে গেলাম, এবার হয় নি। শক্ত করলাম নিজেকে, কিছু বলার আগেই উনি আস্তে করে বলে উঠলেন,

“উই আর গোয়িং টু বি প্যারেন্টস্ রুপু।”

চমকে উঠলাম আমি। কেঁপে উঠলো পুরো শরীর। আমি কি ঠিক শুনলাম? না-কি সারাক্ষণ একটা কথা ভাবতে ভাবতে ভুল শুনলাম। কাঁপা কাঁপা গলায় আস্তে করে বলে উঠলাম,

“মাম্…মানে? আপনি কি….. ”

“আমরা আবারও মা বাবা হতে চলেছি রুপু, তোমার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। তুমি কনসিভ করেছো।”

শরীরের কাঁপুনির মাত্রাটা বৃদ্ধি পেল হঠাৎই, মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলাম না ওনাকে। ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। সবকিছুই যেন মুহুর্তেই স্বপ্ন বলে মনে হতে লাগলো। উনি সময় দিলেন আমাকে। বেশ কিছু সময় অতিক্রম হবার পর ছেড়ে দিলেন। চোখের পানিগুলো মুছিয়ে দিলেন। বলে উঠলেন,

“অনেক হয়েছে, আর নয়। আজকে থেকে আর একদম কান্না নয়।”

মাথা ঝাঁকালাম আমি, বোঝালাম একদম কাঁদবো না। কিন্তু চোখের অশ্রু গুলো যেন বাঁধা মানলো না। উনি আবারও মুছিয়ে দিলেন। বললেন,

“আবার কাঁদছো কেন? একদম অনিয়ম করলে চলবে না, এখন থেকে সবসময় আমার কথা শুনে চলবে।”

“হুম!”

মাথা ঝাঁকিয়ে সেভাবেই ফুপিয়ে কেঁদে গেলাম। উনি হয়তো এবার বিরক্ত হলেন কিছুটা। গলায় গম্ভীরতা ফুটিয়ে এনে আবারও বললেন,

“রুপু, কান্না থামাতে বললাম না? আমি কিন্তু এবার রেগে যাবো।”

আবারও একইভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে গেলাম। কাঁদো কাঁদো গলায় কিছু বলার উদ্যোগ হতেই উনি নিজের ঠোঁটের স্পর্শে মিলিয়ে দিলেন আমার ঠোঁট। সহসায় কান্না থেমে গেল, দু’হাতে খা’মচে ধরলাম ওনাকে।

.
মা হবার অনুভূতিটা যে ঠিক কি, সেটা গত সাত দিন আগে টের পেয়েছি এক ফুটফুটে মেয়ের মা হয়ে। ছোট ছোট হাত পা নিয়ে ছোট পরী টাকে যখন প্রথমবার কোলে নিয়েছি তখন উপলব্ধি করেছি মা হওয়া ঠিক কতটা সুখের। সাময়িক সেই কষ্ট গুলো নিমিষেই বিলীন হয়ে গিয়েছিলো যেন।
আগের চেয়েও ব্যাপক সাবধানে রেখেছে সবাই, এক মুহুর্তের জন্যও কিছু করতে দেয় নি আমাকে। আর এসবের পিছনে তাসফি ভাইয়ের হাতটায় বেশি ছিলো। সারাসময় ফুপি সামলে রাখলেও ভার্সিটি থেকে বাসায় আসার পর প্রায় প্রতিটা মিনিট আমাকে সময় দিয়েছেন উনি।

আজ সাত দিন পর মেয়েকে কোলে নিয়ে তাসফির হাত ধরে বাসায় আসি। অদ্ভুত এক অনুভূতির সাথে পরিচিত হই। পরিবারের সবাই ভীষণ খুশি, তাদের নাতনিকে পেয়ে। রিমি আপু ও রিফা আপুর ছেলে হবার পর এটাই তাদের প্রথম নাতনি, তাই হয়তো আনন্দটা একটু বেশিই। আকিকা না করলেও তাসফির নামের সাথে মিল রেখে তামায়া নাম রেখেছি আমি। সবাই এই নামেই ডাকে ওকে। মেয়ের আগমনে বাসায় এক উৎসব মুখর পরিবেশর সৃষ্টি হয়েছে। ফুপিরা সহ রিমি আপু, রিফাপু, সাহিল ভাইয়া, সাগর ভাইয়া সহ রাহাতরাও এসেছে।
সারাটা সন্ধ্যা থেকে কিছুটা রাত পর পর্যন্ত সবার সাথে সময় কাটিয়ে চলে শরীর আর সায় দিলো না বসে থাকার। সোফার সাথে শরীর মিলেছে দেওয়ায় সবার আড্ডার আসর ভঙ্গ করে আমাকে বললো রুমে যেতে, গিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে। এতক্ষণে তাসফিও হয়তো পুরোপুরি ভাবে লক্ষ লরলো আমাকে। একই ভাবে বললো রুমে যাবার জন্য। মেয়েকে নিতে চাইলেই আম্মু বললো, উপরে যেতে, একটু পর দিয়ে আসছে। আমি আর বারণ করলাম না। আড্ডার আসর ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম, চলে আসলাম রুমে।

কিছুটা সময় পর আম্মুর সাথে তাসফি ভাইও রুমে আসলেন। মেয়েকে কোলে নিয়ে আম্মু বললো ওকে খাওয়াতে। ওকে কোলে নিয়ে খাওয়াতে লাগলাম। আম্মু জিজ্ঞেস করলো রাতে আমার সাথে থাকতে হবে কি, একা বাবুকে সামলাতে পারবো কিনা? মাথা তুলে তাকালাম তাসফির দিকে। ওনার করুন মুখের চাহনিতে ব্যাপক হাসি পেল। তবুও দমিয়ে রাখলাম নিজেকে। আম্মুকে বললাম, পারবো ওকে সামলাতে , থাকতে হবে না। কোন সমস্যা হলে ডেকে নিবো। কথা বারালো না আম্মু, সাবধানে থাকতে বলে বেড়িয়ে গেল রুম ছেড়ে।

মেয়েকে খাওয়ানোর মাঝেই ঘুমিয়ে গেল। ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমারও তন্দ্রাচ্ছন্ন হলে এলো। হঠাৎ জড়িয়ে ধরায় কেটে গেল মাত্র ভারী হওয়া ঘুমটা। ব্যাপক বিরক্ত হলে বললাম,

“কি করছেন? ছাড়েন তো, ওপাশে যান। ঘুমাবো আমি।”

প্রতিত্তোরে কিছু বললেন না উনি। আগের চেয়েও অধিক ভাবে জড়িয়ে নিলেন। আবারও বললাম,

“উফ্! কি হলো? ছাড়েন তো….”

“কতদিন পর আমার রুপুসোনা কে একটু কাছে পেলাম, ছেড়ে দিবো কিভাবে?”

“কতদিন পর মানে? এই কদিন তো হসপিটালেই আমার সাথে রোগী হলে ছিলেন, আপনার জন্য কি আমায় কম লজ্জায় পড়তে হয়েছে? নার্সরা কি কি ভাবতো?”

“তাদের ভাবনা দিয়ে তো আর আমার কাজ নাই, আমার কাজ আমার বউকে দিয়ে।”

ওনার কথায় হালকা হাসলাম আমি। এই মানুষটা আসলেই একটা বজ্জাত, খচ্চর। সবসময় নিজের মর্জিতে চলে। গলায় গম্ভীরতা এনে ছেড়ে দিতে বললাম ওনাকে। ছাড়লেন না উনি, আগের ন্যায় অধিক জড়িয়ে ধরার প্রয়াস চালিয়ে গেলেন, গলার ভাঁজে মুখ গুঁজে দিলেন। হাসিটা চওড়া হলো আমার। ওনাকে ছেড়ে দেবার কথা বললেও তো চাই না ছেড়ে দিক, এভাবেই বেঁধে রাখুক নিজের সাথে, ভালোবাসায় ভরিয়ে দিক।

“রুপু!”

আস্তে করে ডেকে উঠলেন। আমিও ওনার ডাকে সারা দিলাম। ছোট করে ‘হু!’ বলতেই উনি বললেন,

“তুমি বললে আজ থেকে আমাদের ছোট সংসার শুরু হোক রুপু। তুমি, আমি আর আমাদের ছোট তামায়া কে নিয়ে।”

জবাব দিলাম না। মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম তাসফির দিকে। ওনার বুকে মুখ গুঁজে শক্ত করে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলাম। বুঝিয়ে দিলাম মুখ ফুটে না বলা কথাগুলো। কিছুটা সময় নিয়ে উনি আবারও ডেকে উঠলেন।

“রুপুসোনা!”

“হু!”

“গোধূলি মেঘ জমেছে নামা সাঝের মায়ায়,
আধার নামা রাতে।
চাঁদ মাখা আলোয়ে জমেছে,
শিশির পাতায় পাতায়।
তুমি বললে আজ নামাবো তারায় সুখ,
তুমি বললে আজ নামবে তৃপ্তসুখ।”

.
.
সমাপ্ত……!

গল্পটায় নানান ভাবে আশাহত হলেও শেষটা একদম মনের মতো সাজিয়ে গুছিয়ে লিখতে পেরেছি, আলহামদুলিল্লাহ! সত্যি বলতে এই গল্পটা শুধু পাঠকের নয়, আমার নিজেরই মন মতো হয় নি। মাঝে শেষ করে দিতে চাইলেও সবার কথা ফেলতে পারি নি। যারা সিজন ১ পড়েছেন তাড়া বুঝতে পারবেন, এই সিজনে কতগুলো চরিত্র হাইড করে গেছি। প্রথমটা যেভাবে শুরু করেছি মাঝে এসে ততটাই এলোমেলো করে ফেলেছি। এই গল্প নিয়ে আপনাদের সকল অভিযোগ আমি মাথা পেতে নিবো, কারণ ভুলটা আমার।

এই গল্পের আর কোন সিজন আসবে না, তবে গল্পের নতুন নামে, নতুন রুপে তাসফি রূপা আবারও আসবে এবং খুব তারাতাড়ি আসবে। ততদিন আমার নতুন গল্প পড়বেন সবাই। খুব তারাতাড়ি নতুন গল্প শুরু করবো, ইনশাআল্লাহ। তাসফি রূপা কে এত এত ভালোবাসা দেবার জন্য অনেক অনেক ভালোবাসা।🖤
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ভালোবাসা অবিরাম।🖤
চলবে…..

শেষ পর্ব আগামী সোমবারে পাবেন। রি-চেক দেওয়া হয় নি। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here