তোমাতেই ইতি,পর্ব-৮+৯

#তোমাতেই_ইতি
#আয়েশা
পর্ব-০৮

ঘুম ঘুম চোখ মেলে তাকাতেই নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে হুমড়ি খেয়ে উঠতেই নিলুর কপালের সাথে বাড়ি খেল ইচ্ছে।
“উফফ” করে আওয়াজ করে কপাল ঘষে তাকাতেই দেখলো,
স্বর্নাপু,নিলু,মিতু সবাই তার মুখের সামনে সন্দেহ পাতিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

ইচ্ছে আমতা আমতা করে বলল,
-এভাবে তাকাচ্ছো কেন সবাই?

কারও মুখে কথা নেই।শুধু চোখ বড় বড় করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে।
ইচ্ছে টুপ করে খাট থেকে নেমে দাড়ালো।খানিকটা দূরে সরে বলল,

-এমন বিহেভ করছো কেন সবাই?যেন আমাকে এই প্রথম দেখছো কিংবা খুব বড় কোনও অপরাধ করে ফেলেছি বোধ হয় যা তোমাদের হজম হচ্ছে না!

নিলু বোকা বোকা গলায় বলল,
ছাদ থেকে কিভাবে নামলি সেটা জিজ্ঞেস করবিনা?

ইচ্ছের মাথার টনক নড়ল।হুম সেটাইতো ইচ্ছে তো সেটাই ভাবছিল।কাল রাতে তো পূরণ ভাইয়ের সাথে ছাদেই ছিল।পুরোটা রাত পূরণ ভাই তার কোলে ঘুমিয়েছে।সত্যি কথা বলতে এই নির্জন রাতে কাল ইচ্ছের একটুও ভয় করেনি!ইচ্ছের ও কখন জানি চোখ লেগে এল।

অথচ অন্যদিন হলে সেদিকে পা ই বাড়াতো না।হয়তো পূরণ ভাই ছিল বলে।ভাবতেই মুখে আপনা আপনি হাসি চলে এল।
ওদের দিকে তাকাতেই দেখল চেহারায় সেই একি রকম রিয়্যাকশন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ইচ্ছে গলা ঝেড়ে বলল,
-আমি নিচে কিভাবে নামলাম?

স্বর্নাপু হুট করে সামনে এগিয়ে ইচ্ছেকে কোলে তুলতে চাইলো।
ইচ্ছে ভয় পেয়ে সরে দাড়ালো।
আশ্চর্য এমন করছো কেন?

আশ্চর্য জনক কাজটাই যে ঘটেছে রে ইচ্ছে!আমরা কি আর কম আশ্চর্য হয়েছি?
পূরণ ভাই তোকে কোলে নিয়ে বিছানায় সুইয়ে দিয়ে গেছে।শুধু তাই নয় কি সুন্দর গায়ে কাথাও দিয়ে গেছে।কপালের চুলগুলোও সরিয়ে দিয়ে গেছে!

নিলুর এমন অবাক হওয়া আর বোকা বোকা কথায় ইচ্ছের চরম লজ্জা পেল আর কিছু শুনার সাহস হলো না নইলে লজ্জায় বোধহয় মরেই যাবে।দ্রুত পাশ কেটে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।
আর এরা হেসে লুটে পুটে খুন।তার মানে দুটোর মধ্যে কিছু চলছে অথচ কেউ প্রকাশ করছে না!

ইচ্ছে ওয়াশরুমে গিয়ে বেসিনের পানি ছেড়ে বসে আছে,পানি পড়ছে তো পড়ছেই,ব্রাশ করছে তো করছেই সাথে মিটিমিটি হাসিটা মুখে লেগেই আছে।।এমন লাগছে কেন তার,কেমন উদ্ভুদ উদ্ভুদ বিহেভ ও করছে।
কাউকে ভালবাসলে বুঝি এমনও হয়?আচ্ছা পূরণ ভাইও কি এমন করছে?
খুব দেখতে ইচ্ছে করছে একবার।

নাস্তার টেবিলে বসে স্বর্নাপুরা যা ইচ্ছে তাই বলে ইচ্ছেকে পচাচ্ছে।আর ইচ্ছে লজ্জাবতী গাছের মত বারবার নুইয়ে যাচ্ছে।
ওদিকে ইচ্ছেরা খেয়ে উঠতেই ইচ্ছের বাবা আসলো।ইচ্ছের মায়ের মনে এখনও কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছে।শুনেছে বিয়ে উপযুক্ত হলে খারাপ কিছু ঘটার আগে মেয়ে বিয়ে দেয়া দরকার।মেয়েটাও হয়তো তাই চাইছে।কিন্তু ওর বাবা যে শুনতেও পারেনা বিয়ের কথা!

বলতে গেলেই ধূর ধূর করে তাড়াবে।একবার বলবে বলবে করে কথাটা মুখে নিয়ে এসে মুহুর্তেই আবার গিলে ফেলছে।
স্বর্নাপুরা দোতলায় যাচ্ছে।ফুফু তাদের জন্য চিকেন নুডুলস করেছে যেটা ইচ্ছের ফেবারিট।
ইচ্ছে পানি খেতে মাত্র ডাইনিং এ আসলো অমনিই স্বর্নাপু ডেকে উঠলো,

-ইচ্ছে আমরা সেকেন্ড ফ্লোরে যাচ্ছি।ফুফু তোকেও ডেকেছে।তাড়াতাড়ি এসে পড়।

ইচ্ছে পানিটা খেয়ে গ্লাস টা হাতে নিয়ে নাড়া চাড়া করে যাচ্ছে।যেতে তো ইচ্ছে করছে কিন্তু পূরণ ভাইয়ের সামনে কিভাবে পড়বে?
এত লজ্জা লাগছে যে আর কি বলবে।অথচ দেখতেও ইচ্ছে করছে।

ইচ্ছেকে এমন করত্ব দেখে ইচ্ছের মা ইশারায় ইচ্ছের বাবাকে দেখালো।
ইচ্ছের বাবা প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি কি বলতে চাইছে।পরে ইচ্ছের দিকে তাকাতেই দেখল ইচ্ছে নিজে নিজেই লজ্জা পাচ্ছে আবার হাসছেও।

তিনি কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

-ইচ্ছে কিছু হয়েছে,এমন হাসছিস যে?

ইচ্ছে কিছুনা বলে জিভ কেটে দৌড়ে বেরিয়ে গেল।

ইচ্ছের বাবা!তুমি কি কিছু বুঝতে পারছো?
-কি বুঝবো?
-এই যে ইচ্ছের মুখের হাসি,বারবার লজ্জা পাওয়া কেমন অদ্ভুদ না!

তুমি কি বলবে আমি সেটা বুঝে গেছি।শুনো তোমার বান্ধবীর ছেলে না কি তাকে একদম বারণ করে দাও।আমার মেয়েটা ছোট,এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবোনা আমি মেয়েকে।তাছাড়া একটা মাত্র মেয়ে আমার আট দশ টা নেই যে বাকি গুলোর কি হবে ভেবে আমি আর্লি বিয়ে দিয়ে দেব।

ছোট নেই আর তোমার মেয়ে,কলেজে পড়ে।তুমি জানো কাল কি বলছিলো,

-কি?

-ওর শাড়ি পরতে ইচ্ছে করছে।আরও কি বলে জানো?

-তুমিও কি শুরু করেছো বলেতো!টিভি সিরিয়ালের মত না বললে কিভাবে জানবো?

-রেগে যাচ্ছো কেন?আমি এমনি এমনি বলছি না এসব।বলে তোমার মেয়েকে শাড়ি পরা শেখাচ্ছি না কেন,পরে তো শ্বশুর বাড়ির লোকেরা আমাদের খোটা দেবে কিচ্ছু শেখায় নাই বলে।

ইচ্ছের বাবা দ্বিধায় পড়লেন।তিনি চান না এত তাড়াতাড়ি মেয়ে বিয়ে দিতে।কিন্তু ব্যাপারটা একবার ভেবে দেখতে হবে।কথায় আছে,আকাশে চাঁদ উঠলে যেমন সবাই দেখতে পায়।
তেমনি উঠতি বয়সে একটা মেয়েকে সবার চোখে পড়াটাও স্বাভাবিক।
হয়তো কেউ ইচ্ছের মায়ের মাথায় এসব ঢালছে।ইচ্ছে যখন ক্লাস নাইনে উঠে তখন থেকে বিয়ের প্রস্তাব ই এসে যাচ্ছে।অনেক যত্নে বড় করেছে মেয়েটাকে এভাব্ব হুট করে বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারেন না।

পূরণের সাথে একবার ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করা দরকার।

পূরণ এখনও নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে।সবাই যখন কিচেনে খেতে ব্যস্ত ইচ্ছে পূরণের রুমে উঁকি ঝুকি দিতে ব্যস্ত।কয়েকবার চাইলো রুমে যেতে কিন্তু দ্বিধাবোধ নিয়ে আবার ফিরে এল।কেমন আজব আজব ফিলিং।যা ইচ্ছের সাথে আগে কখনোই হয়নি।হবেই বা কি করে ইচ্ছে তো আর আগে কাউকে ভালবাসে নি!

তোমাতেই আমার ভালবাসার শুরু পূরণ ভাই!আর দেখ তোমাতেই ইতি ঘটাবো।

ইচ্ছে সাহস করে এবার ভিতরে গেল।পূরণ ভাই উলটো হয়ে ঘুমোচ্ছে।ইচ্ছের লজ্জা করছে ভীষণ,ভেতরে আসতেই আবার হার্টবিট আপনা আপনিই বেড়ে গেল।বুকের বা পাশে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ চেপে ধরলো কিন্তু না থামছেই না।খাটের পাশে গিয়ে বসতেই গলাটা ও শুকিয়ে আসছে।

ইচ্ছের মনে আজগুবি ভাবনা রা উঁকি দিচ্ছে।একদিন এই খাটের একপাশে ইচ্ছে নিজেও ঘুমোবে।খুব যত্ন করে গুছিয়ে রাখবে এই রুমের একেকটা জিনিস।ইচ্ছে উঠে গিয়ে পূরণের মাথার কাছে থাকা পর্দাটা সরিয়ে জানালার একটা গ্লাস খুলে দিল।
এখনও ভাবনারা উঁকি ঝুকি দিয়ে যাচ্ছে আপন মনে।এই যে এখন সে জানালাটা খুলছে একদিন পূরণ ভাই এসে ফিল্মি স্টাইলে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরবে হয়তো সাথে আরও দুষ্টমিষ্টি খুনসুটি তো থাকবেই।

ইচ্ছের হাসি পেল খুব প্রেমে পড়লে বুঝি সব ফিল্মি ফিল্মি লাগে?
কি জানি,হয়তো!
পূরণ ভাই খানিকটা নড়েচড়ে বালিশ টাকে মাথা থেকে বুকে নিয়ে সোজা হয়ে ফিরলো এবার।ইচ্ছে কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল তারপর আবার পাশে গিয়ে বসল।খুব ইচ্ছে করছে চুলগুলো ছুঁয়ে দিক।বিয়ের পর সে এভাবেই প্রতিদিন পূরণ ভাইয়ের চুলে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াবে আর ঘুম থেকে জাগাবে।

চুলে হাত ছোয়াতেই পূরণ ভাই কেমন বাচ্চাদের মত গুটিসুটি মেরে চুপটি করে ঘুমিয়ে যায়।ইচ্ছের তখন খুব আদর আদর পায়,যেমনটা এখন পাচ্ছে।
ইচ্ছে চুলে হাত দিয়ে আলতো করে গালে আরেক হাত রেখে যেই কপালে ঠোঁট ছোয়াতে যাবে তখনি এক ঝটকায় নিচে মেঝেতে গিয়ে পড়ল।

ইচ্ছে হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো।গাল বেয়ে কখন যে টুপটাপ করে অশ্রুরা গড়াচ্ছে বুঝতেই পারলো না।শুধু বুঝতে পারছে বুকের ভেতর সব ধুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।কেউ যেন খুব করে কলিজাটা টেনে বের করে নিয়ে আসতে চাইছে।
ইচ্ছে এখনও ঠায় নিচে বসে রইলো।উঠার কোনও চেষ্টাই করছে না।যেন গায়ে কোনও শক্তিই পাচ্ছে না!

-লজ্জা শরমের মাথা যে অনেক আগেই খেয়েছিস সেটা তো জানতাম।কিন্তু এতটা নিচে নেমে যাবি সেটা জানতাম না ইচ্ছে!

কি শুনছে ইচ্ছে!সত্যি তো এসব?এখন যেটা ঘটছে সেটা সত্যি! নাকি গতকাল রাতের সেই ভালবাসাময় মুহুর্ত?

তবে কি সব ইচ্ছের মন গড়া স্বপ্ন ছিল!

ইচ্ছে দুহাতে চোখের পানি মুছার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু মুছতে না মুছতেই আবার ঝুম বৃষ্টির মত ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।

-শুন ইচ্ছে তোকে আমি নেহাৎ মজার ছলে ছেলে বলেছিলাম কিন্তু তাই বলে এটা নয় যে নিজেকে মেয়ে প্রমাণ করতে নিজেকে পরিদর্শন করার মত আমার সামনে উপস্থাপন করবি।একটা মেয়ে হিসেবে সেল্প রেস্পেক্ট টুকু অন্তত রাখিস।

-কে কি বললো তাই বলে নিজের সব খুইয়ে দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে তুই একটা মেয়ে!
কেন আমার চোখে কি ছাই পড়েছে?তোর শরীরের গঢন কি আমি দেখতে পাচ্ছি না?তোর শরীর কেমন আর আমার শরীর কেমন আমি সেটা বুঝি না নাকি!তোর বুক……..

বাকি কথাটা শুনার আগেই ইচ্ছে এক দৌড়ে নিচে নেমে গেল।কিচেন থেকে স্বর্নাপুরা হা হয়ে তাকিয়ে আছে।ফুফু ডেকেই যাচ্ছে পেছন থেকে কিন্তু ইচ্ছের কানে যে এসবের কিছুই ডুকছে না শুধু গরম ধোঁয়া বেরোচ্ছে আর চোখ দিয়ে অঝোর শ্রাবণ।কিভাবে নিচে নামলো ইচ্ছে বুঝতেও পারলো না।ওয়াশরুমে ঢুকেই ঝর্না টা ছেড়ে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়ল।

#তোমাতেই_ইতি
#আয়েশা
পর্ব-০৯

গত দুদিন ধরে জ্বরে ভুগছে ইচ্ছে,খাওয়া দাওয়া তো দূর পানি অবদি মুখে দিচ্ছে না।কিছু পেটে পড়লেই গড়গড় করে সব আবার বেরিয়ে আসছে।বিছানা থেকে নড়তেও পারছে না।
সব সময়কার মত ফুফু এসে খাইয়ে দিয়ে গেলেও এবার আর তিনিও খাওয়াতে সক্ষম হলেন না।

কিভাবে হবে!
মন মরে গেলে শরীর কি আর বাঁচে?

ওদিকে স্বর্নাপু,নিলু,মিতু সবার মন খারাপ।হুট করেই মেয়েটা জ্বর বাধিয়ে বসলো।সেদিন ওয়াশরুম থেকে বেরোনোর পরই সবার কিছু সন্দেহ হয়েছিল।চোখ মুখ সব লাল হয়েছিল।বারবার খালি নাক টানছিল।গলাটাও ছিল ভাঙা ভাঙা।তার মানে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিলো যে ইচ্ছে কেঁদেছিল।খুব কেঁদেছিল।
অথচ এখন অবদি তারা কারণটা ও খুঁজে পায়নি।

সেদিন রাতেই তো ছাদে পুরো রাত কাটিয়েছিল দুজন।নিলু আর মিতু না দেখলেও স্বর্নাপু তায়েফ ভাই সহ উঁকি মেরে দেখেছিল।আর হুট করেই কি এমন হল,সেদিন ওই ভাবে ছুটে নামলোই বা কেন?তবে কি পূরণ ভাই কিছু বলেছিল?
খুব দ্রুত পা ফেলে স্বর্নাপু সেকেন্ড ফ্লোরে গেল।পূরণ ভাই কি সব কাগজ পত্র দেখছিল।কেমন স্বাভাবিক দেখতে লাগলেও ভেতর থেকে যে কতটা ভেঙে পড়েছে চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে।

পূরণ ভাই!একটা কথা ছিল?

হুম বল।

তোমার আর ইচ্ছের কি ঝগড়া হয়েছে?

দেখ স্বর্না,তোর কি মনে ওটুকু একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে আমার ঝগড়া করার বয়স?
তোরাও না পারিস বটে!
বলেই বিরক্তিকর একটা ভাব আনলো কপালে।

মুহুর্তেই স্বর্নাপুর পূরণ ভাইয়ের প্রতি মায়াটা কেটে গিয়ে খারাপ লাগা কাজ করল।এমন ভাব দেখাচ্ছে কেন পূরণ ভাই?
মনে হচ্ছে যেন ইচ্ছে অসুখ বাধাতে তার কোনও হাত ই নেই, আর তার কিচ্ছু যায় আসেও না!

বুঝে না বাপু এদের।সেতো শুধু তায়েফ ভাইকে বুঝে,তায়েফ ভাই কিছু না বললেও সে যেন সব বুঝে নিতে পারে।সেটা চোখ দিয়ে হোক আর মন দিয়ে।
কোনও উত্তর না পেয়ে স্বর্নাপু পূরণ ভাইকে আর বেশি ঘাটতে গেল না।তবে চলে আসার আগে বলে গেল,
-আমাকে নাইবা বললে,তবে যদি পার একবার এসে দেখে যেও।চেহারার কি হাল করেছে মেয়েটা।খাওয়া তো নেই বললেই চলে।ঔষুধ টুকুও ওই খালি পেটেই খাওয়াতে হচ্ছে।
একেবারে বিছানার সাথে পেট লেগে আছে।

পূরণ বড় করে একটা ঢোক গিল্ব নিল শুধু আর কিচ্ছু বলল না।কই মা তো একবারের জন্য ও বলেনি যে ইচ্ছে কিছু খায়নি।সে তো জানে মা গেলেই ইচ্ছে খেয়ে নিবে।তাহলে বলল না কেন?

রাতের বেলা খাওয়াতে এসেও ইচ্ছের মা অক্ষম হল।কিছুক্ষন বকাঝকা করে বেরিয়ে গেল, খাওয়ারটা টেবিলে পড়ে রইল।স্বর্নাপু তায়েফ ভাইয়ের সাথে ছাদে।মিলু আর নিতুকে ইচ্ছে বারবার করে বলছে টিভি দেখতে যেতে কিন্তু ওরা নড়ছেই না।মিতু তো প্রায় কান্না করে দেবে দেবে ভাব আর দুটো দিন মাত্র ইচ্ছেপুর জন্মদিনের, এরপরেই তারা গ্রামের বাড়ি চলে যাবে।কিসের জন্মদিন হবে! ইচ্ছেপু তো বিছানা থেকে উঠতেই পারছেনা।খুব কষ্ট হচ্ছে তার।

আর থাকতে ভালো লাগছে না।ইচ্ছে করছে এখনই বাড়িতে চলে যাক।
ইচ্ছে খাটে হেলান দিয়ে আধ শোয়া হয়ে বসে আছে।কোনও হেলদোল নেই শরীরে।শুধু চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে,যদিও সবাই ভেবে নিচ্ছে জ্বরের সাথে হয়তো তার চোখেরও অসুখ করেছে।কিন্তু তার যে মনের অসুখ সেটা কি ঔষুধে সারাবে?পারলে কেউ সেই ঔষুধ টা এনে দিক না, ইচ্ছের আর কিচ্ছু লাগবে না কিচ্ছু না।

হুট করে পূরণ ভাই রুমে এসে ঢুকতেই নিলু আর মিতু ঘাবড়ে গিয়ে উঠে দাড়ালো।পূরণ ভাই ইশারায় বলে দিল বাইরে বেরিয়ে যেতে।দুজন কিছুক্ষণ দুজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে তারপর বেরিয়ে গেল।
দরজা টা হালকা টেনে দিল পূরণ ভাই ইচ্ছে এখনও একই ভঙ্গিতে বসে আছে শুধু চেহারায় কিছুটা শক্ত ভাব আর চোখের পানিটা আপনা আপনিই বাড়তে লাগল।

পূরণ ভাই কিছু না বলেই প্লেট টা হাতে নিয়ে ভাতের লোকমা ইচ্ছের মুখের সামনে ধরতেই ইচ্ছে এক ঝটকায় ফেলে দিল।
পূরণ ভাই কিছুটা অবাক হয়ে তাকালো।

-কেমন পাগলামি এসব?যার সাথে রাগ হয়েছে রাগ গিয়ে তাকে দেখা।খাওয়ার প্রতি রাগ দেখানোর তো কোনও মানে হয়না।

মনে মনে খুব করে বকে যাচ্ছে ইচ্ছে।ভেতর থেকে শুধু চিৎকার আসছে।বলছে,

এক্ষুনি বেরিয়ে যান আমার সামনে থেকে।এক্ষুনি তো এক্ষুনি।কে বলেছে ঢং দেখাতে আসতে?বলেছি আমি?এই দুদিন কই ছিলেন?এই কড়া কড়া কথা শুনায় তো এই ভালবাসা দেখাতে আসে।আমি যে আপনাকে বুঝতেই পারিনা পূরণ ভাই!

কি চান আপনি?

আশ্চর্য!অথচ মুখ দিয়ে একটা শব্দ ও বেরোচ্ছে না ইচ্ছের।শুধু কান্নার পরিমাণ বাড়ছে, কান্নার সাথে পুরো শরীর টা অবদি কাঁপছে।কতটা গভীর থেকে কান্না আসলে এমনটা হয় বলার প্রয়োজন রাখেনা।

হুট করেই পূরণ ভাই ঝাপটে জড়িয়ে ধরল।একদম টাইটলি। ইচ্ছের ইচ্ছে করছে এক্ষুনি ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিক,যেমনটা তাকে ফেলে দিয়েছিল।সেও বুঝুক ইচ্ছের কতটা কষ্ট হয়েছিল।
কিন্তু পারছে না।কেন পারছে না?কে হয় সে?কেন তাকে খারাপ কিছু বলার জন্য মুখ দিয়ে কথাও বেরোয় না!

ইচ্ছে নিজেও কখন দুহাতে খামছে জড়িয়ে ধরল মনেই পড়ছে না।তবে মনে হচ্ছে এটা তার খুব দরকার ছিল।সব বিষন্নতা মুহুর্তেই উবে গেল।যেন বুক থেকে বড় একটা পাথর সরে গেল।এতদিন মনে হয়েছে যেন তার বুকে বড় একটা পাথর বসেছিল।
পূরণ ভাই ছাড়াতে চাইল কিন্তু ইচ্ছে আরও টাইটলি ধরে রইল।

ছাড় না!এবার তো অন্তত খেয়ে নে!
ইচ্ছের যেন এবার অভিমান বাড়ল।মুখ ফুলিয়ে বলল,
-নাহ খাব না!

মানে কি?কেন খাবি না।যা চেয়েছিস সেটাতো পেয়েছিস তবে আবার কি?

ইচ্ছে মুখ ফুলিয়ে কপাল টা বাড়িয়ে দিল।অভিমানি গলায় বলল,
আমার আদর চাই!

পূরণের খুব হাসি পেল।এই বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে কি করবে সে?

এই যে এখন এমন ঢং ঢং করে বাচ্চা বাচ্চা গলায় কথা বলছে তার যে সব ভেঙে আসছে।কি করে নিজেকে শক্ত করতে পারবে সে?
মনে মনে বলল,
এমন করিস না পাগলী মেয়ে,নিজেকে সামলানো যে বড্ড দায় হয়ে যায় রে!

পূরণ কপালে ঠোঁট ছোয়াতেই বুঝল তাপমাত্রা ঠিক কতটা গায়ের!
নাহ বড্ড অন্যায় করে ফেলেছে সে।
দুহাতে মুখ ধরে অনেকক্ষন তাকিয়ে ছিল সে।
আর ইচ্ছে লজ্জা পাচ্ছে,হেসে খুন হচ্ছে।
কে বলবে এই মেয়েটাই কিছুক্ষণ আগে ভেঙে পড়ে নুইয়ে ছিল অথচ হঠাৎ কারও স্পর্শ পেয়ে কেমন সজীব হয়ে উঠল।

যেমনটা শুকনো খরার মাঝে এক পশলা বৃষ্টি এসে ফসলে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়ে যায়।

আমাদের প্রত্যেকের জীবনের এমন একটা মানুষ থাকে, যে নিজের অজান্তেই কখন আমাদের বেঁচে থাকার উৎস আর প্রাণ হয়ে যায় আমরা টেরই পাই না।তার স্পর্শ কিংবা উপস্থিতিতে আমরা জীবিত থাকি বেঁচে থাকার বলয় খুজে পাই।
আর তার অনুপস্থিতিতে মৃত প্রায়!

ইচ্ছে ছোট একটা বাচ্চা মেয়ের মত বাধ্য হয়ে খেয়ে নিল।যদিও মুখে তেতো তেতো লাগছিল সব তবুও ইচ্ছের মন হল, এভাবে যদি পূরণ ভাই তাকে বিষ ও এনে খাইয়ে দেয় আর বলেও দেয় যে ইচ্ছে এটা বিষ তবুও ইচ্ছে হাসি মুখে খেয়ে নিবে।

পূরণ ভাই বেরিয়ে যাবে ঠিক তখন ইচ্ছে টেনে হাতটা ধরে রইলো।মন বলছে প্লিজ যাবেন না!আপনি থাকুন না,আপনি থাকলে আমার সব অসুখ আপনা আপনি সেরে যাবে।ঔষুধের ও প্রয়োজন হবে না।কিন্তু কেন জানি মুখ দিয়ে বেরোলো না।

পূরণ ভাই পেছন ঘুরে বলল,
-কিছু বলবি?

ইচ্ছে মাথা নাড়ালো অথচ মন খারাপিতে সমস্ত শরীর যেন ছেয়ে যাচ্ছে তার।

পূরণ ভাই ওই হাত ধরা অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে অনেকক্ষন তাকিয়ে রইলো ইচ্ছের মুখপানে।চেহারার কি হাল করে রেখেছে।কি বুঝে ড্রেসিং টেবিলের কাছ থেকে চিরুনী টা হাতে নিল।

ইচ্ছের আনন্দে চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে পড়লো।পূরণ ভাই যেন তার মনের কথা বুঝে ফেলল।কিন্তু কিভাবে?সে যে পূরণ ভাইয়ের আরও সঙ্গ চাইছে!

আলতো হাতে ইচ্ছের এলোমেলো চুলে হাত বুলালো কিছুক্ষন,তারপর আলগোছে খুব যত্নে মাথায় চিরুনি বুলিয়ে আচড়ে দিল।হাসির বিষয় হলো পূরণ ভাই আচড়ালো তো ঠিক কিন্তু বাধতে পারছেনা।
ইচ্ছের মনে খানিকটা দুষ্টোমি ভর করল।

-আমি জানি না বাপু চুল তো আপনাকে বাধতেই হবে।

পূরণ ভাই ঢের বুঝতে পারল ইচ্ছের মজা নেয়াটা।কোনও রকম পেচিয়ে বেধে দিয়ে বলল।
শোন,
আমার বউয়ের এইভাবে পেচানো খোপা থাকলেও আমার কোনও আপত্তি নেই বুঝলি।আমার দিব্যি চলবে।প্রয়োজনে আমিই রোজ চুল বেধে দেব আর এরকম এলোমেলো হাতেই।চাইনা তার কোনও আধুনিকতা।সে আমার বোকা সোকা বাচ্চা বউ হয়েই থাকবে।

ইচ্ছের খুব লজ্জা পাচ্ছে।মনে মনে বলছে সে এই খোপাটা আর খুলবে না।পূরণ ভাই চলে যাওয়ার পর আরও কয়েকটা ব্যান্ড দিয়ে টাইটলি বেধে রাখলো খোপাটা যেন আর না খুলে।সত্যি কি পাগল সে?এমনও কেউ করে!কারও কথা কেন জানতে হবে!সে তো করবেই।

কিছুক্ষণ পর স্বর্নাপুরা এসে অবাক হল।এ কাকে দেখছে তারা?
মুহুর্তেই সব চেঞ্জ!কোনও ম্যাজিক ছিল বুঝি?
নিলু আর মিতু লজ্জা দিতে দিতে বলল,
হুম গো স্বর্নাপু ম্যাজিক ই তো ছিল।পূরণ ম্যাজিক!

সবাই উচ্চস্বরে হাসতে লাগল।আলগোছে দরজার পাশ থেকে কেউ একজন বিক্ষুব্ধ মন নিয়ে সরে গেল,কেউ টেরও পেলো না।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here