তোমাতেই পরিপূর্ণ পর্ব -১৯+২০

#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
১৯.
~
আতাউর সাহেব মিথিকে নিয়ে তার কলেজে এলেন। আজ তার প্রেকটিকেল পরীক্ষা। কলেজ গেটের সামনেই নেহা দাঁড়িয়ে আছে। মিথি রিক্সা থেকে আস্তে আস্তে নেমে নেহার কাছে গেল। তারপর দুজন এক সঙ্গে কলেজের ভেতর প্রবেশ করলো। আতাউর সাহেবও রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে তাদের পেছন পেছন এলেন। মিথি আর নেহা তাদের প্রেকটিকেল ক্লাসে ঢুকে পড়ল। মিথির বাবা তখন সেই ক্লাসের দায়িত্বে পড়া দুজন টিচারের সঙ্গে কথা বললেন। উনারা তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, দুশ্চিন্তা না করতে, মিথি শরীরের কন্ডিশনের কথা উনারা মাথায় রাখবেন। মিথির বাবা কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হলেন। তিনি ওয়েটিং রুমে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

এক ঘন্টা পর মিথি আর নেহা বের হলো। বাবাকে নিয়ে মিথি কলেজের গেটের সামনে গেল। রাস্তার ওপারের ফুচকার স্টলটাতে চোখে পড়তেই মিথির মনটা লাফিয়ে উঠল। কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই মুখ কালো হয়ে গেল তার। ঠোঁট উল্টে কেবল ঐদিকে তাকিয়েই থাকল। ইশ, খালি দেখতেই পারবে খেতে তো আর পারবে না। এই মুহুর্তে তার মনে একটা গানই বাজছে,

‘তোমাকে ছোঁয়ার নেই তো আমার সাধ্য
দেখতে পাওয়া সেই তো বড়োই ভাগ্য..’

নেহা তার পাশে ছিল। সে মিথির কাঁধে হাত রেখে বললো,

‘কি রে দোস্ত? মুখে খেতে পারছিস না বলে কি চোখ দিয়েই ফুচকাগুলো গিলে খাবি?’

মিথি অসহায় ভাবে মাথা নাড়াল। নেহা ফিক করে হেসে দিয়ে বললো,

‘আহারে বেচারা। থাক বাবু কষ্ট পাস না। সত্যি সত্যি খেতে না পারলেও মনে মনে তো খেতে পারবি। আর মনের খাওয়াই আসল খাওয়া বাকি সব তো কেবল বিলাসিতা।’

মিথি রাগ দেখিয়ে বললো,

‘হয়েছে চুপ করতো।’

মিথির বাবা গিয়েছিলেন রিক্সা ঠিক করতে। তার মাঝেই সেখানে নৈরিথ এল। যাকে দেখা মাত্রই মিথির সেদিনের কথাগুলো মনে পড়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় লাল হয়ে উঠল তার গালগুলো। নৈরিথ গাড়ি থেকে নেমে তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। মিথির দিকে তাকিয়ে প্রসন্ন হেসে বললো,

‘কেমন আছো?’

মিথি হালকা হেসে বললো,

‘ভালো।’

‘একা এসেছো, নাকি আংকেল সাথে এসেছেন?’

‘না বাবা এসেছেন সাথে। ঐ যে উনি রিক্সা ঠিক করছেন।’

নৈরিথ মিথির বাবার কাছে গেল। সালাম দিয়ে বললো,

‘আংকেল রিক্সা ঠিক করার প্রয়োজন নেই। আমি অফিস থেকে গাড়ি নিয়ে এসেছি। চলুন আপনাদের নামিয়ে দেই।’

‘না না বাবা। তুমি নেহাকে নিয়ে বাড়ি যাও। আমাদের জন্য তোমাকে আবার উল্টা রাস্তায় যেতে হবে।’

‘সমস্যা নেই তো আংকেল। আমি অনুরোধ করছি, প্লীজ চলুন।’

নৈরিথের জোরাজুরিতে আতাউর সাহেব রাজি হলেন। গাড়িতে গিয়ে বসলো সবাই। মিথিদের বাড়িতে যেতে লাগে পনেরো মিনিট। সেই পনেরো মিনিটের রাস্তা ফুরানোর আগেই মিথি চেঁচিয়ে উঠল,

‘গাড়ি থামান, গাড়ি থামান।’

মিথির চিৎকারে ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষলেন। সামনের সিট থেকে নৈরিথ পেছনে ঘুরে তাকিয়ে বললো,

‘কি হয়েছে মিথি?’

মিথি ততক্ষণে অস্থির। সে তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল,

‘বাবা, আমি সিফাতকে দেখেছি। ও এক্ষুণি আমার পাশ দিয়ে বাইক নিয়ে গিয়েছি। আমি স্পষ্ট ওকে দেখেছি।’

নেহা আর নৈরিথ দুজনেই অবাক। তাদের মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে নিউরনে এখন শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরছে, ‘কে এই সিফাত?’

মিথি অস্থির হয়ে গাড়ি থেকে নামতে নিলেই তার বাবা তাকে আটকে দেয়। তিনি মিথির দুবাহু ধরে বলেন,

‘ওটা সিফাত না। তুই সিফাতকে দেখিসনি অন্য কাউকে হয়তো দেখেছিস মা।’

মিথি অসহায় কন্ঠে বললো,

‘বাবা ওটা সিফাত ছিল। আমি আমার সিফাতকে চিনি বাবা। ঐ সিফাত। আমি দেখেছি ওকে। এক্ষুণি আমার সামনে দিয়ে গেল।’

‘আমার সিফাত’ কথাটা শোনা মাত্রই নৈরিথের মুখটা চুপসে গেল। মনটা অস্থির হয়ে উঠল তার। মিথির মুখে এর আগে কোনোদিনই এই নামটা শোনেনি। কে সে? আর মিথিই বা কেন এই মানুষটার জন্য এত অস্থির হয়ে উঠেছে? তার সাথে মিথির কি সম্পর্ক? নৈরিথের মন বিচলিত হয়ে উঠে। ইচ্ছে করছে এক্ষুণি মিথিকে এই প্রশ্নগুলো করতে। কিন্তু মিথির অবস্থা দেখে সে নিজেকে সামলে নিল। একটা ছোট্ট নিশ্বাস নিয়ে নৈরিথ বললো,

‘গাড়ি স্টার্ট করতে বলবো আংকেল?’

মিথির বাবা মিথিকে শান্ত করলেন। তারপর নৈরিথকে সম্মতি দিতেই গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। মিথি বাবার বুকে মাথা রেখে ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়ছে। তার মন বলছে বাইকের ঐ ছেলেটাই সিফাত। সে তার মুখটা দেখেছিল। কিন্তু এটা তার বাবাকে সে কিভাবে বিশ্বাস করাবে?

গাড়ি তার গন্তব্যে এসে থেমে যায়। মিথি গাড়ি থেকে নেমে সোজা বাসায় চলে যায়। আতাউর সাহেব নৈরিথ আর নেহাকে বিদায় দিয়ে বাসায় প্রবেশ করেন।

‘এই সিফাতটা কে রে নেহা?’

‘আমিও তো জানি না ভাই। মিথি তো আমাকে এই নামের কারো সমন্ধে কিছু বলেনি।’

নৈরিথের মনের অস্থিরতাটা আরও বেশি বেড়ে যায়। মিথির এমন কোনো কথা নেই যেটা নেহা জানে না। অথচ এই সিফাত সম্পর্কে সেও কিছু বলতে পারছে না। আশ্চর্য! চিন্তা হবারই কথা। তার সাথে ভয়ও হচ্ছে। ঠকে যাওয়ার ভয়। কিছু হারিয়ে ফেলার ভয়। নৈরিথ শক্ত হয়ে সিটে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে। মনে মনে সে বলে,

‘খুব কষ্টে নিজের মনকে বুঝিয়েছি মিথি। আমার বিশ্বাস ভেঙ্গো না।’
.
.
সারাদিন যায় মিথির মন খারাপ। যেদিনই সিফাতের কথা তার মনে মাথা চারা দিয়ে উঠে সেদিনই তার মন খারাপ থাকে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। বিছানায় বসে এক ধ্যানে ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে আছে সে। যেন এই ফ্যানের মাঝেই সে কোনো গোপন রহস্য খুঁজে পেয়েছে। তার মাথায় চলছে যতসব আজগুবি চিন্তা ভাবনা। আচ্ছা, এই ফ্যানটা তো এত ঘোরে তার কি মাথা ঘুরায় না? আচ্ছা, তার কি বমি বমি পায় না? শরীর ক্লান্ত হয়না?

একসময় নিজের মনের প্রশ্নে নিজেই বিরক্ত হয়ে উঠে সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

‘আই মিস ইউ সিফাত।’

কান্না পাচ্ছিল খুব। কিন্তু সে কাঁদল না। কাঁদলেই তো আর সিফাত চলে আসবে না। সুতরাং কেঁদে কেটে অযথা চোখের পানি অপচয় করে কোনো লাভ নেই। এগুলো জমিয়ে রাখতে হবে। বিয়ের দিন কবুল বলার সময় কেঁদে কেটে ভাসাতে হবে। মিথি নাক টানল। বিয়ের কথা মনে হতেই তার নৈরিথের কথা মনে পড়ল। ছেলেটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে তাকে নিয়ে অনেক কিছু ভেবে ফেলেছে? আচ্ছা, সিফাতের কথা তো নেহাও জানেনা। মেয়েটাও নিশ্চয়ই চিন্তায় পড়ে গেছে। পড়ুক, মাঝে মধ্যে এমন একটু আধটু চিন্তায় পড়া লাগে তাহলে শরীর মন ভালো থাকে।

ঐদিকের মানুষটা সত্যি সত্যিই চিন্তা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। আর না পেরে এবার ডিরেক্ট সে কল দিয়ে বসলো। কলটা রিসিভ হতেই নৈরিথ ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠল,

‘সিফাত কে?’

মিথি বুঝে গেল বেচারার মস্তিষ্ক এই এক চিন্তায় এতক্ষণে ঘোলাটে হয়ে উঠেছে যে ‘কে এই সিফাত?’ মিথির ভালো লাগল। এই চিন্তাটাকে দুশ্চিন্তায় পরিণত করার এক জম্পেশ বুদ্ধি আঁটল সে। গলা ঝেড়ে বললো,
#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
২০.
~
মিথি গলা ঝেড়ে বললো,

‘আসলে সিফাত আমার বয়ফ্রেন্ড ছিল। দুবছর আগে কোনো এক কারণে আমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হয় তাই ও তখন রাগ করে দেশের বাইরে চলে যায়। তারপর আর ওর সাথে আমার কোনোপ্রকার যোগাযোগ হয়নি। ইনফেক্ট এখনও কোনো যোগাযোগ নেই। কিন্ত আমি ওকে মিস করি। ভীষণ মিস করি। আমার মনে হয় ও আমার আশে পাশে আছে। হয়তো লুকিয়ে আছে। আমার উপর এখনও রেগে আছে হয়তো তাই সামনে আসছে না। কিন্তু আজকে সত্যিই আমি ওকে দেখেছিলাম। আমার এখনও মনে হচ্ছে ঐ ছেলেটাই সিফাত। আর আমি..’

বাকি কথা বলার আর সুযোগ পেল না মিথি তার আগেই নৈরিথ কল কেটে দিল। ব্রু কুঁচকে মিথি আবার নৈরিথের নাম্বারে কল দিতেই সেটা বন্ধ বললো। মিথি খুশিতে নেচে উঠল, ফাইনালি আগুন লেগে গেছে। এবার জ্বলো, জ্বলতে জ্বলতে ছাই হয়ে যাও। ভালোবাসার দহনে না পুড়লে এর মর্ম কি বুঝবে প্রিয়?

রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাল মিথি। কিন্তু নৈরিথ পুরো রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারল না। রাগে, ক্ষোভে ফেটে পড়ছিল সে। সে ঠকেছে, মিথি ঠকিয়েছে তাকে। মিথি তাকে কখনো ভালোই বাসেনি। শুধুমাত্র ঐ সিফাতকে পাচ্ছিল না বলে তার সাথে টাইম পাস করতে চেয়েছিল। নিজের মনকে বুঝিয়ে ভুল করেছে সে। অনেক বড় ভুল। নৈরিথ তার ভুলের যন্ত্রণায় পুরোটা রাত কাতরে গেছে। অস্থির মনকে কোনোভাবেই বুঝাতে পারছে না যে মিথি তার সাথে অন্যায় করেছে।

পরদিন সকালে আর অফিসে যায়নি নৈরিথ। সোজা গিয়েছে একটা কফি শপে। কফি শপের ভেতরে গিয়ে দেখল একটা টেবিলে আতাউর সাহেব বসা। নৈরিথ সৌজন্যমূলক হেসে আতাউর সাহেবের সামনে গিয়ে তাকে সালাম দিল। সালামের জবাব দিয়ে আতাউর সাহেব বললেন,

‘কি হয়েছে বাবা? হঠাৎ এত জরুরি তলপে আমাকে ডাকলে যে, কোনো সমস্যা?’

নৈরিথ মৃদু সুরে বললো,

‘জ্বি আংকেল সমস্যাই। সব বলছি আপনাকে তার আগে কি খাবেন বলুন?’

‘সকালের নাস্তা করে বেরিয়েছি। পেটে এক ফোটাও জায়গা নেই বাবা।’

‘আচ্ছা তাহলে দুটো কফি অর্ডার দেই?’

‘ঠিক আছে, এটা দিতে পারো।’

নৈরিথ একজন ওয়েটারকে ডেকে দুটো কফি অর্ডার দিল। তারপর সে সোজা হয়ে চেয়ারটাতে বসলো। একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললো,

‘আচ্ছা আংকেল, সিফাত নামের ছেলেটার সাথে মিথির কি সম্পর্ক?’

আতাউর সাহেব হালকা হেসে বললেন,

‘ওরা তো ভালো বন্ধু।’

নৈরিথ কপাল কুঁচকে বললো,

‘কিন্তু মিথি তো আমাকে অন্য কিছু বলেছে।’

‘কি বলেছে ও?’

নৈরিথ ইতস্তত কন্ঠে বললো,

‘মিথি বলেছে সিফাত নাকি ওর বয়ফ্রেন্ড। ওদের নাকি আগে সম্পর্ক ছিল?’

আতাউর সাহেব হাসলেন। বললেন,

‘আহারে, এই পাজি মেয়েটার কথা তুমি বিশ্বাস করতে গেলে কেন? ও নিশ্চয়ই তোমার সাথে মজা করেছে। সিফাত আর ও খুব ভালো বন্ধু। বন্ধুত্ব ছাড়া ওদের মাঝে আর কোনো সম্পর্ক নেই। সেই গ্যারান্টি আমি তোমাকে দিতে পারবো।’

নৈরিথ অস্থির হয়ে বললো,

‘তাহলে ও মিথ্যে বললো কেন?’

‘হয়তো তোমাকে জেলাস ফিল করানোর জন্য। আমি চিনি আমার মেয়েকে। তার জীবনে আমার পর সেই দ্বিতীয় পুরুষটাই তুমি যাকে সে এত ভালোবেসেছে। ওর ভালোবাসায় কোনো খাত নেই নৈরিথ। সিফাতকেও ও ভালোবাসে তবে বন্ধু হিসেবে। ওদের মাঝে ঝামেলা হওয়ায় সিফাত ওর সাথে রাগ করে দেশের বাইরে চলে গিয়েছে। কিন্তু মেয়েটা আমার এখনও তাকে খুঁজে বেড়ায়। দেখলে না কাল কি করলো। এর আগেও দু একদিন এমন করেছে। সিফাতকে সে নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবাসে। তাই ওর প্রতি এত টান। তুমি এই নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না।’

মনটা কিছুটা হলেও হালকা হলো নৈরিথের। তবে এত সহজে সে মিথিকে ছেড়ে দিবে না। ওর মিথ্যে বলার শাস্তি তো ওকে পেতেই হবে। খুব শখ না জেলাস ফিল করানোর, এবার তার পালা। জ্বালাতে জ্বালাতে যদি সে মিথিকে বার বি কিউ না বানিয়েছে তবে তার নামও নৈরিথ হাসনাত না।

কফির কাপে চুমুক দিয়ে নৈরিথ সরব হলো। কিছুটা সময় নিয়ে সে নিজেকে তৈরি করলো কিছু একটা বলার জন্য। তবে ভীষণ নার্ভাস লাগছে। বুক কাঁপছে তার। চোখ বন্ধ করে জোরে একটা শ্বাস টানল নৈরিথ। তারপর সরস কন্ঠে বললো,

‘আংকেল, আমি মিথিকে বিয়ে করতে চাই।’

চমকে গেলেন আতাউর সাহেব। কিন্তু পরক্ষণেই মুখে হাসি ফুটে উঠল তার। কন্ঠে নেমে এল একরাশ উল্লাস। তিনি বললেন,

‘আমি তো আগে থেকেই রাজি বাবা। তোমার মা বাবাকে নিয়ে চলে এসো। আমাদের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি নেই।’

নৈরিথ মাথা নিচু করে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

‘আমার মা বাবা..?’

আতাউর সাহেবও চুপ হয়ে গেলেন। তিনি জানেন নৈরিথ আর তার মা বাবার মধ্যকার তিক্ত সম্পর্কের কথা। তাই তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

‘বিয়ে করতে গেলে তো গার্জিয়ানের প্রয়োজন হয় বাবা।’

নৈরিথ স্মিত হেসে বললো,

‘ঠিক আছে আংকেল আমি উনাদের সাথে কথা বলবো। কিন্তু আপনার কাছে আমার আরেকটা আবদার, আমাদের যে আজকে দেখা হয়েছে কথা হয়েছে সেসব যেন মিথি না জানে। প্লীজ আংকেল, আমার এই আবদারটা রাখবেন!’

আতাউর সাহেব হেসে বললেন,

‘ঠিক আছে। চিন্তা করো না মিথি কিছু জানবে না।’
.
.
ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে কেবলই রুমে এল মিথি। দেখল তার ফোনটা বাজছে। কাছে গিয়ে দেখল নৈরিথের নাম্বার। তাড়াহুড়ো করে কলটা রিসিভ করলো। ওপাশের পরিবেশ নিরব। মিথি ক্ষীণ সুরে বললো,

‘হ্যালো!’

‘হুম মিথি। একটা জরুরি কাজে কল দিয়েছিলাম।’

মিথি কিছুটা অবাক হয়ে বললো,

‘কি কাজ?’

‘সিফাতের একটা ছবি পাঠাও তো।’

মিথি ব্রু উঁচিয়ে বলে,

‘সিফাতের ছবি দিয়ে আপনি কি করবেন?’

‘ওকে খুঁজব।’

‘মানে?’

‘মানেটা খুব সিম্পল। আমি সিফাতকে খুঁজে বের করে তোমার সাথে বিয়ে দিব। কাল রাতে তোমার কথা শুনে আমি বুঝতে পেরেছি যে তুমি সিফাতকে কতটা ভালোবাসো। আমি তোমাদের ভালোবাসাকে সম্মান করি। আর আমি চাই তোমরা যেন এক হতে পারো। আর সেই জন্যই সিফাতকে খুঁজতে আমি তোমাকে সাহায্য করবো। এখন তাড়াতাড়ি ওর একটা ছবি পাঠিয়ে দাও।’

মিথি টাস্কিত, চমকিত, অবাকিত। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা বোধ হয় এটাকেই বলে। চারদিকে এখন শুধু ছলছল নয়নে হাসিমাখা বদনে গান চলছে। মানে সিরিয়াসলি? এই লোকটাকে সে ভালোবেসেছে? এখন তো তার বিশ্বাসই হচ্ছে না। এই মানুষটার মধ্যে কোনো ফিলিংস নেই? এত নিরামিষ কেউ কেমনে হয় রে ভাই? মিথির কান্না পাচ্ছে। মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদতে মন চাচ্ছে তার। কেন এই কথাগুলো সে নৈরিথকে বললো? কেন কেন? এই ছেলেটা যে এত উদার মনের সেটা তো সে জানতো না। এখন তো মনে হচ্ছে বিয়ের পরও যদি কেউ এসে একে বলে, ‘ভাই আমার না একটাও বউ নেই, আপনার বউটাকে কিছুদিনের জন্য আমাকে একটু দিবেন?’ তাহলে এ তখনও নাচতে নাচতে নিজের বউকে ঐ লোকের হাতে তুলে দিবে। এখন যেমন সিফাতের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। মিথি ফোন কেটে দিয়ে সেন্টি মাখা মুখে বসে রইল। বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। নিজের জালে নিজেই ফেঁসেছে সে। এবার এই জাল কিভাবে কাটবে সে?

কিছুক্ষণ পর আবারও কল এল।

‘কি হলো ছবিটা এখনও পাঠাচ্ছো না যে?’

খুব জঘন্য ভাষায় এই লোকটাকে কিছু গালি দিতে ইচ্ছে করছে মিথির। খুব কষ্টে সে নিজের জিভকে সামলে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

‘প্রয়োজন নেই। জীবনে আপনি আমার অনেক উপকার করেছেন। আর লাগবে না। দয়া করে আপনি আমাকে শান্তিতে থাকতে দিন। সিফাতকে আপনার খুঁজতে হবে না। ও পৃথিবীর যে কোণায় আছে সেই কোণাতেই থাকুক। আপনাকে কষ্ট করে তাকে খুঁজে বের করতে হবে না।’

নৈরিথ কন্ঠে মেকি অসহায়ত্বের ভাব ফুটিয়ে তুলে বললো,

‘তাহলে তোমার কি হবে মিথি? সিফাতকে ছাড়া তুমি কি করে বাঁচবে? তুমি না ওকে ভালোবাসো?’

মিথি রাগে তেতিয়ে উঠে বলে,

‘আপনি না আসলেই একটা উদ্ভট প্রাণী। জীবনেও কিছু বুঝবেন না। আমারই ভুল হয়েছে আপনাকে এত কিছু বলে। আর ফোন দিবেন না আমাকে। আপনার সাথে কথা বলতেও আমার ইচ্ছে করছে না।’

মিথি কলটা কেটে দিল। রাগে চেহারাটা বাংলার পাঁচ হয়ে আছে তার। ঐদিকে নৈরিথের মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি। বেচারি এসেছিল নৈরিথকে বোকা বানাতে এখন যে সে নিজেই বোকা বনে গেল তার কোনো খবর নেই।
.
.
আজ শুক্রবার। সাদা পাঞ্জাবীতে মারাত্মক লাগছে নৈরিথকে। সে আজ মিথিদের বাসায় এসেছে তার বাবার সাথে কথা বলার জন্য। যখনই মিথি নৈরিথকে দেখেছে তখনই তার বক্ষপিঞ্জরের ভেতরকার মাংসপিন্ডের কম্পন বেড়ে গেছে। মিথির দৃষ্টি ফেরানো মুশকিল। অথচ নৈরিথ তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। ড্রয়িং রুমে বসে অনেকক্ষণ বাবার সাথে কথা বললো। কি কথা বললো কে জানে? মা সেই রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল বলে সে একটু উঁকি ঝুঁকিও মারতে পারেনি। না একটু শান্তিতে নৈরিথকে দেখতে পেরেছে। বরাবরের মতোই মিথিকে ইগনোর করে নৈরিথ বেরিয়ে গেল। মিথির বুকটা কষ্টে ফেটে চৌচির। হু, কি ঢং! একটু সুন্দর হওয়াতে যেন অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না। সেও কম সুন্দর না। একদিন তাকে দেখেও নৈরিথের হৃদকম্পন বেড়ে যাবে। সেও বিস্ময় চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। থাকিয়েই থাকবে। এইভাবেই থাকিয়ে থাকতে থাকতেই পার হয়ে যাবে অজস্র যুগ। কিন্তু তাও তার চোখের তৃষ্ণা মিটবে না। সে কেবল দেখেই যাবে, দেখেই যাবে, আর দেখেই যাবে..

চলবে..
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here