তোমাতে করিবো বাস💗
#সূচনা_পর্ব
লেখনীতে-আফনান লারা
হইহুল্লড়ে ঘেরা বিয়ের আসর স্তব্ধ করা কথাটি ছিল “”””আমার পক্ষে এ বিয়ে করা সম্ভব নাহ।””””
এই কথাটি বলেছে কনে নিজেই।
গলার স্বর ভারী করে জনসম্মুখে সকলের হাসিমাখা মুখের ওপর ফ্যাকাসে ভাব নামিয়ে দিয়েছে তটিনি।আজ তার বিয়ে হচ্ছে বাপ্পির সাথে।এক মাস ধরেই তাদের বিয়ের কথা চলছিল।এমন নয় যে বিয়ে না করার কথা তটিনি এই প্রথমই বলেছে।এক মাসে ১০০বার বলা হয়ে গেছে তাও কেন যে কেউ শুনলোনা।
সেই বিয়ের আগেই যখন কবুল বলার বিষয়টা স্থির হয় তখনই সে চিৎকার করে বলে ওঠে সে এ বিয়ে করতে পারবেনা।সে জানে এখনই তাকে বিয়েতে না করতে হবে।শুনলে শুনবে নাহয় অন্য পথ বাছবে।জেনেশুনে কেন সে তাকেই বিয়ে করবে যাকে সে চায়না।
তার এ কথায় শুরুতে ঠিক কে কথা বলে উঠবেন সেটা নিয়েই সকলে অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেছে,গুরুজন অনেকেই ছিলেন,কিন্তু বিষয়টা হলো সকলের আদরের মেয়ে তটিনি,হুট করেই থাপ্পড় মারা যায়না।শেষে তটিনির মামা খাইরুল এগিয়ে এসে ধমকের সুরে বললেন “””এসময়ে এ কেমন মশকরা!”””
তটিনি যেন ওনার কথা শোনেইনি।শাড়ীর কুচি মুঠো করে ধরে বিছানা থেকে নেমে দৌড় দিলো সে।দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথেই একটা মানুষের সাথে তার ধাক্কা লেগে যায়।
মানুষটা হলেন আসিফ ভাই।হাতে ফাঁকা ট্রে নিয়ে ওখান দিয়ে যাচ্ছিল রান্নাঘরে।কে যেন বলেছিল কনের শাশুড়ির জন্য শরবত আনতে হবে বেশি চিনি দিয়ে,সুগার লো হয়ে গেছে তার।সেটা অবশ্য সে দিয়েও এসেছে তাই তো হাতে ফাঁকা ট্রে।
তটিনির সাথে ধাক্কা লাগায় সে থামে। কপাল কুঁচকে ওর মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মুখে হাসি ফুটিয়ে ওর থুঁতনি টেনে বলে, ‘কিরে?কবুল বলেছিস?’
‘ভাইয়া আমি তোমার জন্য কবুল বলবো,আর কারোর জন্য না’
আসিফ আশ্চর্য হয়ে ট্রেটা এবার হাত থেকেই সরিয়ে টেবিলের ওপর রেখে দেয়।এদিক সেদিক চেয়ে দেখে সকলে ওদের দিকেই চেয়ে আছে।
আসিফ এবার লজ্জিত কন্ঠে তটিনির হাত মুঠো করে ধরে পুনরায় হুজুরের সামনে এনে বলে,’নে,কবুল বল।দেরি হয়ে যাচ্ছে’
তটিনি এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলে,’আমি আসিফ ভাইকে বিয়ে করতে রাজি,কবুল বলিলাম’
ওমনি তটিনির বাবার হাত থেকে চড় খেয়ে তটিনি বেসামাল হয়ে মেঝেতে ছিটকে পড়ে।আসিফের বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে।তটিনিকে নিচে পড়ে যেতে দেখে সে পিছিয়ে গেলো,তটিনির বাবাকে সে প্রচণ্ড ভয় করে।তটিনির বাবা রুমে যারা যারা আছেন তাদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’এই কথা যেন বাইরে না যায়।খবরদার!!ঐশি যা তো আমার রুমে খাটের তলায় যে বেত টা আছে নিয়ে আয়’
ঐশি তটিনিকে টেনে তুলার চেষ্টা চালাচ্ছিল,বাবার আদেশ পেয়ে ঢোক গিলে তটিনির হাত ছেড়ে ভয়ে ভয়ে রুমের দিকে গেলো।
তটিনি মাথা থেকে ঘোমটার সেফটি পিন খুলে নিচে বসে থেকে বললো,’বাবা চাইলে মেরে ফেলো।,তাও আমি স্টেজে বসে থাকা ঐ লোকটাকে বিয়ে করবোনা।করলে আসিফ ভাইয়াকেই বিয়ে করবো’
বাবা রাগে কটমট করতে করতে ঐশীর আগেই গিয়ে বেতটা নিয়ে আসলেন।সকলে ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে,এরই মাঝে তটিনির মামা এসে ওর বাবার হাত আটকে ধরে বললেন,’দুলাভাই রাখেন।আজ ওর বিয়ে।বাদ দেন এইসব।রাজি হবে ছেলেমানুষি করতেছে।এই তো আমরা বুঝিয়ে নিব’
‘রাখ তোমাদের বুঝানো!কদিনে কি বুঝাইলা?বিয়ের দিনে এসব নাটক করতেছে!’
বাবা মামাকে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে তটিনির গায়ে আঘাত করলেন বেত দিয়ে।তটিনী ডান হাত ধরে দাঁত কেলিয়ে বলে,’মারো। তাও বিয়ে করবোনা’
বাবা ২য় বার আঘাত করলেন এবার আঘাতটা আসিফের হাতে লেগেছে।কারণ সে হাত দিয়ে ধরেছে বেতকে।বাবার চোখ আরও রক্তবর্ণ হয়ে গেলো এবার।আসিফ বেতটা ওনার হাত থেকে টান দিয়ে ছুটিয়ে বলে,’আমি ওরে বুঝাই আনতেছি।’
এই বলে আসিফ তটিনির হাত ধরে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।বাইরে মানুষ আর মানুষ।একটা রুম খুঁজে পাওয়া মশুকিল যেখানে মেহমান নেই।শেষে ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে যে করিডোর পড়ে সেটাতেই নিয়ে আসলো আসিফ ওকে।
নিয়ে এসে আসিফ কিছু বলতে যাবার আগেই তটিনি ওর বুকে মুখ গুজিয়ে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,’ভাইয়া আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই,আমাকে ফিরিয়ে দিও না ভাইয়া”
‘তটিনি বাচ্চামো বন্ধ করবি নাকি হাতের চড় খাবি?আজ তোর বিয়ে।খোয়ালিপনা বাদ দিয়ে এখন এই মূহুূতে তুই চোখ মুখ মুছে কবুল বলতে বসবি।আমি আর কিছু শুনতে চাইনা’
‘আমি কবুল বললে তোমার জন্যে বলবো’
‘আমি তোকে ভালবাসিনা তটি!ভুল ধারনা নিয়ে বিয়ে বাড়িতে ঝামেলা করতেছিস!আর কতবার বলবো আমি তোরে ভালবাসিনা’
‘তুমি বাসো।নাহলে ছোটবেলা থেকে আমার গায়ে পড়া বেতের ২য় বাড়িটা সবসময় তুমি খেতেনা ভাইয়া’
আসিফ চোখ বন্ধ করে করিডোরের গ্রিলে হাত রেখে দম ফেললো এরপর দূরে বরের স্টেজের দিকে চেয়ে থেকে বলে,’আর সময় নেই,জলদি চল।তোকে কবুল বলতেই হবে।আমি আর ঝামেলা চাইনা।’
এই বলে আসিফ তটিনির হাত ধরে টেনে নিয়ে আসলো হুজুরের সামনে।হাসি মুখে বললো,’ও মানছে।বলবে কবুল’
তটিনির বাবা গম্ভীর চাহনিতে চেয়ে আছেন তটিনির দিকে।তটিনি ঘোমটা বিছানা থেকে তুলে মাথায় দিয়ে বিছানায় বসে আসিফের দিকে একবার তাকালো তারপর হুজুরের দিকে চেয়ে বললো,’আবার পড়ুন দোয়া।ছেলের নাম এবার বাপ্পি হবেনা না,আসিফ হবে’
ইতোমধ্যে বাপ্পির কানে কথা পৌঁছে গেছে,তটিনি কবুল বলছেনা ঝামেলা করছে।তবে কি ঝামেলা করছে সেটা জানা হয়নি।
বাপ্পি স্টেজ থেকে উঠে এদিকেই চলে আসে।রুমের দরজার বাইরে অবধি পৌঁছোতেই ভেতরের রুমটাতে বিছানার উপর কনে সাজে তটিনিকে দেখে সে।মেয়েটিকে সর্বপ্রথম ঘটকের আনা একুশটা ছবির মাঝে সাত নম্বর ছবিতে দেখেছিল সে।দুই বছর ধরে কনে দেখার ইতি টেনেছিল সেদিন।মুখ ফুটে বলেছিল সে এই মেয়েটিকেই বিয়ে করবে।সে কি আয়োজন!সে কি ঝাঁকজমক।অথচ! দেখতে আসার দিনই তটিনি আর তাকে যখন আলাদা কথা বলতে দেয়া হলো তখন সে ১ম লাইনের কথাতেই বলে দিয়েছিল সে আসিফ ভাইকে ভালোবাসে।
আসিফ সম্পর্কে তটিনির দূর সম্পর্কের খালাতো ভাই হয়।আসিফের বাবার সাথে তটিনির বাবার সম্পর্ক ওতো টাও ভাল নয়।আসিফ এই বাড়িতেই থাকে সেই হাই স্কুলের গন্ডী থেকেই।আসিফের বাবা-মা গ্রামেই থাকেন।পড়াশুনার জন্যই শহরে আসা তার।অনার্স পাড়ি দিতে আর কটা মাস বাকি ওর।শেষ বর্ষে পড়ছে সে।তটিনি যে তাকে পাগলের মতন ভালবাসে এইটা সে সেইদিন থেকেই জানে যেইদিন থেকে সে এই বাড়িতে আছে।সেইদিন থেকেই তটিনির চোখে সে এক আলাদা ভাললাগা ঝলঝল করতে দেখতো যতক্ষণ সে ওর সামনে থাকতো ততক্ষণ।সেই ভাললাগার কথাই তটিনি পরিষ্কার করো জানিয়ে দিয়েছিল বাপ্পিকে।কিন্তু বাপ্পি যে নিজেই তটিনিকে অনেক বেশি পছন্দ করে ফেলেছিল,সে তার মাকে বলতে পারেনি তটিনিকে সে বিয়ে করবেনা।সে চুপ করে ছিল।সকলে তার চুপ করে থাকাকে হ্যাঁ সূচক ধরে বিয়ের আয়োজনে মেতে উঠেছে তাই।
তটিনি মুখ ফুলিয়ে বিছানায় বসে পা দোলাচ্ছিল।ওপাশে বাবা জানালায় মাথা ঠেকিয়ে ছিলেন আর হুজুর কাগজে কলম ধরে রেখে একটা কিছু জানার অপেক্ষায় আছেন।কার সাথে বিয়ে পড়াবেন, বাপ্পি নাকি আসিফ সেটা শুনার অপেক্ষায় আছেন তিনি।
বাপ্পি ঘটনাটা বুঝে এইবারও তার স্বার্থপরতার পরিচয় দিলো।ভেতরে এসে বলে দিলো তটিনি যেন জলদি কবুল বলে।কথাটা শুনে তটিনির রাগ হলো ভীষণ।
তটিনি জানতো ছেলেরা ভালবাসার মানুষের অন্য মনের মানুষ আছে জানলে বুকে পাথর বিধে হলেও দূরে সরে যায়।আর এই ছেলেটাকে দেখো!!দীর্ঘ এক মাস ধরে সে আসিফের গুনগান করতে করতে ছেলেটার কান পঁচিয়ে ফেলেছে তাও সে এখনও ওকেই বিয়ে করবে!
ডান পাশে চেশে তটিনি আসিফকে ফিসফিস করে বলে,”আমাকে বিয়ে করতে ভয় লাগে?’
‘চুপ করে থাক।আমি বিষয়টা দেখছি!’
‘কবুল বলে দাও ভাইয়া।এত দেখাদেখির কিছু নাই’
আসিফ অনেক ভেবে বুদ্ধি বের করলো।সে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।তবে কথাটা তটিনিকে জানাবেনা।পানি খাওয়ার নাম করে বের হয়ে সোজা বাস ধরবে।দারুণ আইডিয়া।দারুণ কাজ দেবে!!
————–
সায়দাবাদে নোয়াখালীর থেকে আসা একটা বাস থেমেছে মিনিট দশেক আগে,ঢাকা এক্সপ্রেস।এতক্ষণ বাস থামার কথানা,বাসের থামার কথা আরেকটু সামনে গিয়ে।কিন্তু এই জায়গায় থেমে এত সময় কেন খোয়াচ্ছে?।থেমে আছে কারণ একজন যাত্রীর চার নং ব্যাগ বাসের ভেতর হারিয়ে গেছে।ড্রাইভার,কন্ডাকটর আর অন্যান্য যাত্রীর সহায়তায় অবশেষে পাওয়া গেলো ছোট্ট একটা পুটলি।তাতে বাতাসা মুড়ি আর বার্মিজ আচারের বড়সড় একটা প্যাকেট।
ড্রাইভার পুটলির সাইজ দেখে বিরক্ত হয়ে ঠাসঠুস করতে করতে নিজের সিটে গিয়ে বসে গেছে।
যাত্রী তার পুটলি বুকে ধরে বাস থেকে নিচে নামলো।আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা ঘুরিয়ে সামনের বড় বড় অট্টালিকা গুলো দেখে তার চোখ পড়ে দোকানে বসে থাকা কিছু মধ্যবয়স্ক লোকদের দিকে।তাদের পাশে আবার কমবয়সী যুবক ও বসা।
ভাই বলছিল ঢাকা শহরে মধ্যবয়স্ক পুরুষদের থেকে অধিক নিরাপদ হয় কম বয়সী যুবক।
মুখে হাসি ফুটিয়ে মেয়েটি ঐ যুবকদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।একটা যুবক চায়ে পাউরুটি চুবিয়ে খাচ্ছিল আরেকজন শুকনো পাউরুটি খাচ্ছে ওর পাশে বসে।মেয়েটিকে ওমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ছেলে দুটি খাওয়া বন্ধ করে ফেললো।তিনজনেই চুপ এখন।
শেষমেশ পাউরুটি চুবিয়ে খাওয়া ছেলেটি বলে, ‘কে আপনি?খুধা লাগছে?খাইবেন কিছু?’
ভাই কইছিল অচেনা কারোর দেয়া কিছু না খেতে।সে যুবক হোক কিংবা বুড়া বেটা।
মেয়েটি খাওয়ার কথা ঘুরিয়ে বলে,’উহু!এই জাগা কি ঢাকা?’
‘জাগা কি আবার?’
শুকনো পাউরুটি খাওয়া ছেলেটা ঐ ছেলের কানে ফিসফিস করে বললো,’জাগা মানে মনে হয় জায়গা।এইটা নোয়াখালীর ভাষা, আমি শুনেছি’
‘ওহ হো!!হ্যাঁ এটা ঢাকা।আপনি কোথায় যাবেন?’
‘আঁই ঢাকা যাইয়াম😎’
ছেলে দুইজন একজন আরেকজনের দিকে তাকালো।এই মেয়ে কয় কি!ঢাকায় এসে বলে ঢাকায় যাবে!আগে পরে কিছু নাই?ঢাকার কোন জায়গায় যাবে সে!
চলবে♥