তোমাতে করিবো বাস পর্ব -৪৮+৪৯ ও শেষ

তোমাতে করিবো বাস💗
#পর্ব_৪৮
লেখনীতে-আফনান লারা
.
আসিফকে ছাড়া তটিনি থেকেছিল প্রায় সাতদিনের মতন।তার কি যে অবস্থা হয়েছিল।সারাদিন বাসার ল্যান্ড লাইন নয়ত বাবার ফোনের দিকে চেয়ে বসে থাকতো।ইশ কখন আসিফ একবার ফোন দিবে,আর বলবে সে কয়দিন পর ফিরবে।
আসিফ ঈদের ছুটিতে সাতদিনের জন্য যেতো।তখন তটিনির খুব খারাপ যেতো দিনগুলো।আসিফের অপেক্ষায় তার নাওয়া খাওয়া ঠিক মত হতোইনা।
কে জানতো একদিন এমন একটা মানুষ আসবে যার অনুপস্থিতিতে নাওয়া খাওয়াই উঠে যাবে!
নিয়তি কত অদ্ভুত তাই না!আমরা কাউকে ভালবেসে ভাবি এটাই আমাদের আসল ভালবাসার মানুষ!
এরপর মানুষটা ছেড়ে চলে গিয়ে যখন ২য়জন এসে হাত ধরে তখন বুঝতে পারি আসলে প্রথম মানুষটা পুরোটাই ভ্রম ছিল।
যা থাকার তা ২য়তেই!!
দেখোইনা!আসিফকে ছেড়ে সাতদিন থাকতে পারতো তটিনি!আর আজ বাপ্পিকে ছেড়ে কয়েকটা ঘন্টা তার কাঁটা গিলবার মতন অবস্থা করে ছেড়েছে।

বকুল আপু রান্নাঘরে তটিনির জন্য বেলের শরবত তৈরি করছিলেন।সেইসময় তার ফোনে একটা কল আসে।কলটা বাপ্পির। আপু ফোন হাতে নিয়ে ওর নাম দেখে মুচকি হাসি দিয়ে রেখে দিলেন।ফোনটা বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে গেলো।কয়েক মিনিট পর আপু যখন শরবতের গ্লাসটা ট্রে তে নিয়ে তার পাশে বাদামের বাটি নিলেন সেই আবারও কল আসলো।
এবার আপু ট্রেটা রেখে কল ধরলেন।

‘আপু ভাল আছো?’

‘খুব ভাল,তোর কি খবর?’

‘এই তো ভাল’

‘আর কিছু বলবি?’

‘দুলাভাই কই?’

‘সে তো ফিল্ডে গেছে।আর কিছু?’

‘না ঐ!তটিনি কই?’

‘সে কাঁদছে।খুব কাঁদছে।কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ সব ফুলিয়ে ফেলেছে।মেয়েটাকে এত কষ্ট দিচ্ছিস?’

‘আমি কি করলাম বলো বুবু? সব তো মায়ের ইচ্ছাতেই হচ্ছে।তুমি ওরে একটু বুঝাও।আমি মাকে ঠিক করে ওকে তাড়াতাড়ি নিয়ে আসবো’

‘এক মিনিট,তোর কি ইচ্ছে করেনা তটিনির থেকে সেই ভালবাসাটা পেতে যেটা তুই ওকে বাসোস?’

নিরব হয়ে বাপ্পি বললো,’করে’

‘তাহলে এত তাড়া কিসের?সময় দে,সময় নে।এইসব ঠিক করতে একটু কষ্ট করা লাগে।তটিনি যেদিন তোকে নিজ থেকে মেনে নিতে পারবে সেদিন আমার আর আম্মুর চাইতে কেউ বেশি খুশি হবেনা।আমরাও চাই তোরা দুজন হ্যাপি কাপল হও’

‘আমি তো তাও পারছি নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে।কিন্তু তটিনি এভাবে ভেঙ্গে পড়লে কি করে হবে?’

‘হাহাহা!ওটা মজা করলাম।তটিনি মোটেও এমন বুক ফাটিয়ে কাঁদছেনা।সে জানালার গ্রিল ধরে ম্যানিকুইনের মতন থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে।বোঝাই যাচ্ছে ভেতরটা তার পুড়ছে কিন্তু ব্লাস্ট হচ্ছেনা’
——-
রিনি আর আসিফ পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিরছে।তারা যে পথটা ধরে আসছিল সেটি ছিল সরু একটা পথ।দুপাশে বহুতল ভবন।তার সাথে মোটা মোটা কারেন্টের তার আর পিলারের পর পিলার।
রিনি মনে মনে ভাবছে বাসায় ফিরলে ঐ আন্টি আর তার মেয়ে আবার কি জেরা করে।
আর আসিফ ভাবছে রিনির ঐ হাতটা ধরার যে হাতে সোনার বালা ঝুলছে।তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ সে হাতটা ধরেই ফেললো।
রিনি তখন একটা দালানের তলা গুনছিল।আসিফের হাতের স্পর্শ পেয়ে সে মুখটা ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকায়।
আসিফ অন্যদিকে তাকিয়ে হাঁটছে।
রিনি মুচকি হাসি দিয়ে হাতটা নাড়াতে নাড়াতে বললো,’
যাক!ঘি সোজা আঙ্গুলেই উঠছে’

আসিফ লজ্জায় লাল হয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে।রিনি ও ওর সাথে পাল্লা দিয়ে আসতে আসতে বললো,’আম্মা মরি গেছে বলেই কি আঁই এত ভালবাসা হাইতেছি?
[মা মরে গেছে বলেই কি আজ আমি এত ভালবাসা পাচ্ছি?’]

আসিফের পা থেমে গেলো।সে রিনির হাতটা তখনও ছাড়েনি।তবে রিনির বলা কথাটা তার মনটাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিলো।কি যেন ভেবে পকেট হাতিয়ে একটা রুমাল বের করে সে রিনির দিকে ধরে।
তারিখ আজ থেকে বারো দিন আগের।সেখানে লেখা আসিফ রিনির কাছে ঋনী।,স্বামী হিসেবে ঋনী।এই ঋণ প্রেম দিয়ে শোধ করা হবে একদিন’
এই লেখা কোনো একটা নারীর হাতের লেখায় সিক্ত ঐ রুমালে।গ্রামগতর খুঁজে সেই নারীর হাতে বুনে এনেছে আসিফ এই রুমাল।রিনি জানেনা।
তার মা থাকতেই আসিফ নিজের মনে তাকে জায়গা দিয়ে দিয়েছিল,বলতে গেলে এখন সেই আনুষ্ঠানিকতা হলো।
রিনির চোখে অশ্রু ঠাঁইয়ের জায়গার অভাব পড়ছে আজ।আসিফ রুমালটা দিয়ে ওর চোখ মুছে দিয়ে পুনরায় টানা ধরলো হাতটাকে।
——–
তটিনি বেলের শরবত খেতে খেতে বকুল আপুর ফোনটা দেখছিল।বকুল আপু কাজের ফাঁকে সে দৃশ্য খেয়াল করে বললেন,’আমার ফোনের মডেলটা তোমার পছন্দ হয়েছে বুঝি?বাপ্পিকে বলবো এমন একটা তোমায় কিনে দিতে’

‘নাহ,মানে হ্যাঁ।সুন্দর’

‘ধরেও দেখতে পারো,আমি কিচ্ছু মনে করবোনা’

তটিনি বিড়বিড় করে বললো,’ধরে দেখা হয়ে গেছে, কি নামে সেভ করা কে জানে!”

‘উজবুক!’

‘এ্যাঁ?’

‘মানে আমি বাপ্পিকে উজবুক মনে করি,তুমি কি মনে করো?’

‘ঐ একই।আমার কাছেও ওনাকে উজবুক মনে হয়’
——
বাপ্পি তার মায়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।মা তখন ওর জন্য মুরগীর মাংস দিয়ে নুডুলস বানাচ্ছিলেন।তিনি বেশ বুঝতে পারছেন তার ছেলে কিছু একটা বলতে চায় কিন্তু ভয়ে বলতে পারছেনা যার কারণে এক জায়গায় স্থির না থেকে শুধু ঘুরঘুর করছে।

‘কিছু বলবি?’

‘হ্যাঁ, আসলে….’

‘তটিনির কথা বাদ’

‘মা সে কষ্ট পাচ্ছে’

‘পাক!এ খবর কে দিলো?’

‘বকুল আপু’

‘তার মানে কথা সত্য।ভাল,আমি তো এটাই চেয়েছিলাম।’

‘মা তুমি কি খুশি হলে?’

‘মোটেও না,তবে শান্তি পেলাম।আমি এটাই চেয়েছি।সে বুঝুক,সে কষ্ট পাক।সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করুক তুই ওর খুব কাছের,খুব আপন’
———
রাতে বাপ্পি বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছিল,তটিনিকে ছাড়া কিরকম যে তার লাগছে সে যদি একবার মাকে বুঝাতে পারতো তাহলে মা তটিনিকে শাস্তি না দিয়ে টের পেতেন আসলে শাস্তিটা বাপ্পি নিজে পাচ্ছে।
সেইসময় দরজা খটখটানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল অনেকক্ষণ যাবত।রাত ১:৩৪বাজে এই সময়ে বাপ্পিকে ডিস্টার্ব করার মতন কেউ নেই এই বাসায়।তাহলে কে এমন উন্মাদের মতন দরজায় নক করে যাচ্ছে?
এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বাপ্পি উঠে গিয়ে দরজা খোলে।
খুলতেই ওপাশ থেকে সুবাসিত দেহের এক নারী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে ওকে।বাপ্পি অপরিচিত বলে চেঁচিয়ে উঠে নি।কারণ গন্ধটটা তার খুব চেনা।
এটা তো তটিনি!
তবে এত রাতে,এই খানে সে কিভাবে আসলো?সে কি স্বপ্ন দেখছে?

‘তটিনি?’

‘হুম’

‘তুমি?কি করে আসলে?কার সাথে আসলে?’

‘ক্যাব বুক করে এসেছি।আবার চলে যাবো, এই রাতটা পার হোক।ভোর হলেই চলে যাবো।বুশরা দরজা খুলে দিয়েছে’

‘একা একা আসার কোনো মানে আছে?এরকম পাগলামি কেন করলে?’

তটিনি দরজা লাগিয়ে বিছানায় উপর বসে বেলো,’অত্যাচার!পুরো বংশ মিলে আমায় অত্যাচার করছে।বকুল আপু আজ সেইসব রান্না করেছে যা আমার বাপের জন্মে আমাকে কেউ খাওয়াইতে পারে নাই’

‘কি রেঁধেছে?’

‘পাঙ্গাস মাছের চচ্চড়ি, মাসকলাই ডাল,করলা ভাজি দিয়ে হাঁসের ডিম ভাজি,কাকরোলের ভর্তা’

‘বাহ!আপু এগুলা খুব ভাল বানায়।আমি খেয়েছি’

‘কিন্তু আমি খাইনি বাপ্পি সোনা।এখন গিয়ে তোমাদের ফ্রিজ থেকে আমার জন্য খাবার নিয়ে এসো।আমি না খেয়ে আছি সোনা’

‘এভাবে সোনা সোনা বলে কি আদর করে ডাকতেছো নাকি টিটকারি মারছো?’

‘দুটোই’

‘আমাদের বাসায় রাতে ফ্রিজে ভাত তরকারি থাকেনা’

‘তাহলে অর্ডার দিয়ে আনুন।আমি কি না খেয়ে থাকবো?’

বাপ্পি মাথা চুলকে ফোন খুঁজে একটা রেস্টুরেন্টের পেজে ঢুকে অর্ডার করতে গিয়ে শোনে তারা এত রাতে অর্ডার নেয়না।অনেক খুঁজে তারপর অবশেষে একটা পেলো যারা কিনা মাঝ রাতেও ফুড ডেলিভারি করে।

খাবার আসতে সময় লেগেছে বিশ মিনিট।ওরা কল দিতেই বাপ্পি পা টিপে টিপে রুম থেকে বেরিয়ে গেট থেকে পার্সেল নিয়ে এসে বাসায় ঢুকতেই মায়ের সামনে পড়লো বরাবর।মা দুহাত ভাঁজ করে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলেন।তারপর বললেন,’আজ দারোয়ান খাবার নেয়নি।ফ্রিজে মাংস,ডাল,সালাদ সব ছিল।ওগুলা খাওয়া ওরে।বাহিরের খাবার খাইতে হবেনা’

বাপ্পি ভয় পেয়ে চুপসে গেছে। কি থেকে কি বলবে।পরে মা ফ্রিজ থেকে খাবার বের করতে করতে বললেন,’এরকম পাগলামি ভাল!আমার কথার অবাধ্য হয়ে সে এখানে চলে আসুক,এটা ঘটুক সেটাই চেয়েছিলাম।মেয়েটা সব কিছুতে পাশ করতেছে।আর যাইতে হবেনা।কয়েক ঘন্টাতেই তার আক্কল এসে গেছে দেখলাম। আমি আর শাস্তি দিব না।’

চলবে♥তোমাতে করিবো বাস💗
#পর্ব_৪৯(শেষ পর্ব)
লেখনীতে-আফনান লারা
.
একটা মানুষকে আপনি প্রচণ্ড রকমের মিস করেন,তাকে চোখের দেখা অনেকক্ষণ না দেখলে আপনার বুকের ভেতরটা হাঁশপাশ করে।তাকে সামনে পেলেই যেন মনের ভেতর শান্তি বিরাজ করে।সেই মানুষটা ছাড়া আর এক সারি মানুষের ভীড়ে আপনার ভাললাগা নেই।
কেবল ঐ মানুষটি এলেই আপনার যত খুশি।বলতে গেলে ঐ মানুষটার মাঝেই আপনার বসবাস।
সেরকমই বাপ্পিকে এইসবকিছুর অংশীদার করতে পেরেও তটিনি মুখ ফুটে আজও বলতে পারেনি সে ওকে আসিফের চেয়েও বেশি ভালবেসে ফেলেছে।সে পারেনা বলতে।
বাপ্পির মা,বড় বোন কেউই চেষ্টা করেও বিষয়টা প্রকাশের আওতায় আনতে পারেনি।

অন্যদিকে আসিফ রিনির ক্ষেত্রে শুরুতে কিছুটা এরকম হলেও সম্পর্কের একটা সময়ে গিয়ে আসিফ মুখ ফুটে বলেই দিয়েছে সে রিনিকে ভালবেসে ফেলেছে।
তবে তটিনির জন্য যে ভাললাগা তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল সেটি তখনও বিদ্যমান কিন্তু রিনির প্রতি সম্মান,শ্রদ্ধা এবং স্বামী হিসেবে তার যে দায়িত্ববোধ আছে তা থেকেই ওর ভালবাসার শুরু।
দুটোই ভিন্ন! তটিনি মোহ আর রিনি হলো বাস্তবতা।
সে অবশ্য সাহস করে রিনিকে কোনো এক শীতল রাতে চাদর মুড়িয়ে কানের কাছে ফিসফিসে বলেই দিয়েছিল সে রিনিকে চায়,রিনিকে সে ভালবাসে।
——
আজ তটিনি বাপ্পির বিয়ের দুই বছর পূর্ণতা পেয়েছে।
তটিনি এখন পাকা সংসারী। কিন্তু সংসার বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে এই সমস্ত বাড়ির দায়িত্ব সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।দাদুর চাইতেও ভাল রান্না করে সে এখন।অথচ যার জন্য এ সংসার তাকে আজ অবধি গলা জড়িয়ে বলেনি’বাপ্পি আমি তোমায় ভালবেসে ফেলেছি’

না বললেও সে যে ভালবাসে তা কাজেকর্মে বুঝিয়েই ছেড়েছে।কিন্তু ঐ যে মুখে বলার আরেক শান্তি যে শান্তি বুঝিয়ে দেয়াতে নেই।
বাপ্পি অফিসের কাজে জাপান চলে যাবে শীঘ্রই ।হয়ত ফেরা হবে হয়তবা হবেনা।
সেটার সিউরিটি সে জানলেও বাড়ির লোক এবং বিশেষত তটিনিকে সে জানিয়েছে সে ফিরবেনা।ওখানেই থেকে যাবে।ফিরলেও কয়েক বছর লাগিয়ে দিবে।
এটা ইচ্ছে করেই লুকিয়েছে।তটিনির মুখ থেকে কথা সে বের করবেই!সিনেমার মতন এয়ারপোর্টে গিয়ে বুক ধড়ফড় করতে করতে বলবে,’প্লিজ যেও না বাপ্পি।আই লাভ ইউ’

এইসব ভেবে মুখে হাসি ফুটিয়ে বাপ্পি কাল থেকে ব্যাগ গুছাচ্ছিল।তার মনে দারুণ আমোদ।আগামীকাল এয়ারপোর্টে তার এক বছরের সাধনার রুপ ফলিত হবে।
হাসতে হাসতে রুমের শেষ কোণায় চেয়ে বাপ্পি হতভম্ব হয়ে গেলো।তটিনি সেখানে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হাসতে হাসতে ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে।
তার মানে কি ওর কিছুই যায় আসেনা! নাকি ভং ধরছে।
বাপ্পি মুখটা গোমড়া করে আবারও ব্যাগ গুছাতে মন দেয়।কিন্তু তটিনির যেন হাসি শেষ হবার নামই নিচ্ছেনা।
মেয়েটা কি আদৌ সিরিয়াস?সিরিয়াস হলে কি এমন হাসে?
‘তার কি ধারণা আছে আমি যে আর ফিরবোনা!’

বাপ্পি ব্যাগ রাখতে গিয়ে আয়নার উপর চোখ রাখে।তটিনি ততক্ষণে ফোন রেখে এদিকেই আসছিল,কি কারণে এত হাসছিল হয়ত তাই বলতেই আসছে।
বাপ্পি ও মুখটা গুরুগম্ভীর করে রেখে নিজের কাজে ব্যস্ত।

‘জানেন!আয়ান নাকি প্রথম বুলি পুপু বলেছে’

‘তোহ?’

‘তোহ মানে!পুপু মানে ফুফু!আমি তো ওর ফুফু হই।ভাবতে পারেন!সে আমাকে ডেকেছে,মিস করে’

‘হ্যাঁ,তুমিও মিস করবে আমায়।চলে যাচ্ছি তো!অবশ্য করবে কিনা তাও জানিনা।যে হারে হাসাহাসি চলছে এ বাড়িতে!’

তটিনি হাসি একটা দিয়ে চলে গেলো।বাপ্পি তো অবাকের শেষ সীমানায় চলে এসেছে।এই মেয়েটার হলো কি!
কাল এ সময়ে দেখা গেলো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদবে।আমার কি!কাঁদার হলে কাঁদবে!কাছে থাকতে পাত্তা দিচ্ছেনা যখন তখন দূরে গেলেই দিক!একা একা পাত্তা দিক!
—–
বাপ্পি ভেবেছিল তটিনি আজকের পুরা সন্ধ্যা,রাতটা ওর নামে করে দিবে।ওর সাথে কাটাবে।যেভাবেই হোক সময়টাকে মধুর করবে।কিন্তু তার সব ধারণায় পানি ঢেলে তটিনি গায়েব।
রাত আটটা অবধি ওর অপেক্ষায় থেকে আর সহ্য করতে না পেরে তাকে একটা ফোন করে বাপ্পি।

‘হ্যালো!তুমি কোথায়?’

‘আমি তো একটু মার্কেটে এসেছি,কেন বলুন তো?’

‘আশ্চর্য! আমি যে কাল জাপান চলে যাব সেটা কি তুমি ভুলে গেছো?’

‘না তো ভুলবো কেন!বেশ মনে আছে।এই তো মার্কেটের যতগুলা জামাকাপড় ধরছিই বারবার মাথায় আসছে কাল চলে যাবেন’

‘আমার জন্য নিচ্ছো?’

‘আপনার জন্য কেন নিব?আমি আমার আয়ানের জন্য নিচ্ছি।বাড়ি ফিরবার পথে একবার আসিফ ভাইয়ার বাসায় নামবো।রিনির আর আয়ানের সাথে দেখা করে ফিরতে আমার দেরি হবে।খেয়ে নিয়েন’

এই বলে তটিনি লাইনটা কেটে দেয়।বাপ্পির মাথা তো রেগে চড়ক গাছ!মেয়েটার সমস্যা কি!
—–
আসিফ রিনিকে নিয়ে কাল হাসপাতাল যাবে।তাদের আয়ানের বয়স এক বছর।এরই মাঝে রিনি ভুলবশত পুনরায় প্রেগন্যান্ট। সেটার চেক আপ করতেই হাসপাতালে যাবে।এই খবর তখনও তটিনি জানেনা।সে ধীরে ধীরে ওদের ফ্ল্যাটের বাহিরে দাঁড়িয়ে কলিংবেলে চাপ দেয়।

কিছু সময় পর এসে দরজা খোলে রিনির ছোট ভাই কারিম।সে কালই এসেছিল বেড়াতে।তটিনিকে দেখে সে হেসে বলে রিনি ভেতরের রুমে আয়ানের সাথে খেলছে।আসিফ বাসায় নাই।
তটিনি ধীরে ধীরে ঢুকে ওদের রুমের কাছে গিয়ে আয়ানের জন্য আনা খেলনা গাড়ী সামনে ধরে বলে,’সারপ্রাইজ!! ‘

আয়ান মাথা ঘুরিয়ে গাড়ী দেখে খুব খুশি হয়ে যায়।তটিনি ওর কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে বলে,’আবার বলো পুপু!তোমায় ফুফু বলতে হবেনা।পুপুই বলবে।আমার কোনো সমস্যা নেই’

রিনি মিটমিট কররে হাসছিল।তটিনি আয়ানকে এক টানে কোলে নিয়ে তার জন্য আনা গাড়ী ওকে দেখাচ্ছে এবার।
তটিনি এত দ্রুত আসিফের পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য কখনওই হতোনা।রিনি,আসিফ সুযোগ করে দিছে বলেই এমনটা হলো।তাছাড়া ওর তো বেবি নাই,তাই যত টান!
আয়ানের সাথে গল্প করতে করতে তটিনির বেশ দেরি হয়ে গেছে।বাপ্পি তার উপর রেগে থাকতে থাকতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে কাল যাবার পথেও তটিনির সাথে কথা বলবেনা।এটা ওর শাস্তি।
তটিনি যখন বাসায় ফেরে তখন রাত সাড়ে বারোটা।বাপ্পি রাগে ক্ষোভে ঘুমিয়ে পড়ে।যে ছেলেটা রাত ২/৩টা ছাড়া ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমায় না,সেই ছেলে কিনা এখন ১২টায় ঘুমাচ্ছে!
তটিনি শুরুতে বিশ্বাস করে নাই।চুড়ির ঝুনঝুন আওয়াজ,আর নিজের বড় বড় পায়ের কদমের আওয়াজেও যখন তাকে নাড়াতে পারলোনা তখন সিওর হয়ে নিলো সত্যিই সে ঘুমায়।
তাই দেরি না করে সেও ঘুমিয়ে পড়ে।

সকাল হতেই বাপ্পির চলে যাওয়ার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে যায়।সকলে বেশ ব্যস্ত এই নিয়ে।
বাপ্পির মন খারাপ।সে চেয়েছিল তার যাওয়া নিয়ে তটিনিকে আয়ত্তে নিয়ে আসবে,কিন্তু এইবার দেখা গেলো তটিনির হাতের বাহিরেই চলে গেছে।

বাপ্পির মন খারাপ আরও বেড়ে গেলো যখন সবার সাথে গাড়ীতে তটিনি আসলোনা।সে নাকি তার বাবা মায়ের সাথে অন্য গাড়ীতে আসবে।
এয়ারপোর্টে এসে তটিনির অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ফ্লাইটের সময় হয়ে যাওয়ায় সে চলে যেতে বাধ্য হয়।
তটিনিদের গাড়ী নাকি জ্যামে!
বাপ্পি এতটাই কষ্ট পেয়েছে সে প্লেনের সিটে বসে চোখ মুছছিল বাচ্চাদের মতন।কান্না আর আটকাতে পারেনি।এতগুলো দিনের জন্য চলে যাচ্ছে সে।তটিনি তাকে একবার জড়িয়ে ধরলোনা,হাতটাও ধরলোনা! এর চাইতে কষ্টের আর কি হতে পারে!দুইটা বছর যার এই সামান্য ভালবাসার খাতিরে এত কিছু করা হলো,যার মনে বসবাস করা হলো!সেই মানুষটার মনের দলিলটুকু নিজের নামে করা হলোনা!

হাত দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে হাত ভিজে গেছে বলে হাতটা সে এবার নিজের শার্টে মুছে আবারও চোখ মুছে নেবে তখনই তার পাশে বসা কালো টপস আর কালো জিন্সের মেয়ে ওরপে তটিনি টিস্যু এগিয়ে ধরলো।
বাপ্পি কাঁদতে কাঁদতে টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে নিলো এবার।

‘আহারে!বউ মরছে?’

‘মরার চাইতেও বেশি!’

এই বলে বাপ্পির কথা আটকে গেলো।মাথা তুলে পাশে তাকায় সে।
এতক্ষণ তার পাশে কালো সানগ্লাস,কালো স্কার্ফের মেয়েটি তবে তটিনি!!
তটিনি দাঁত কেলিয়ে তখনও তাকিয়ে আছে।বাপ্পি শক খেয়েছে বলে সে চশমাটা খুলে পকেটে পুরে বললো,’আপনাকে ছাড়া বকুল আপুর বাসায় এক ঘন্টা থাকতে দম বন্ধ হয়ে গেছিলো।সেই আমি কি করে মাসের পর মাস থাকবো ভাবতে পারেন?এই দুইটা বছর আমি আপনার সাথে কিভাবে থেকেছি সব ভুলে গেছেন?মাথায় আসে কি করে যে তটিনি দেশে থাকবে,আর বাপ্পি বিদেশে!’

‘তুমি এখানে কি করে?’

‘সে লম্বা কাহিনী!যেতে যেতে বলবো।এখন শুনেন’

‘কি?’

‘যেটার জন্য দুই বছর প্রতি সকালে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন,প্রতি ভাললাগার সময়ে মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাসে সমাপ্তি ঘটাতেন! সেই কথাটি’

‘বলো!’

‘দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ-মাস
আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন
তোমাতে করিব বাস’

সমাপ্তি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here