তোমাতে করিবো বাস পর্ব -১৪+১৫

তোমাতে করিবো বাস💗
#পর্ব_১৪
লেখনীতে-আফনান লারা
.
আসিফ বাপ্পির বরাবর সামনে বসেছে।এর আগে তাদের একসাথে বসা হয়নি।বিয়ের আগে যতবার বাপ্পির সাথে ওর দেখা হতো কেমন আছো,কি খবর ছাড়া তেমন কথা হতোনা।
বিয়ের দিন অবশ্য আসিফই বকবক করছে তটিনিকে নিয়ে।বাপ্পি বেশি বলেনি।সেদিন আর কথাও তাদের হয়নি।এখন সেই আগের দু লাইন বলার ইচ্ছাবোধ তাদের দুজনেরই ছিল না।সুতরাং নতুন কথা বলতে হবে।তবে কে আগে বলবে তাই ভাবছিল দুজন।
শেষে আসিফই বলে উঠে,’তটিনি কেমন জ্বালায়?’

‘ঠিক জানিনা ‘

‘ঠিক জানো না?জ্বালালো কিনা জানো না?’

‘তাও জানিনা।আসলে তটিনির সবই আমার ভাল লাগে তাই কোনটা জ্বালানো সেইটা বুঝতে পারিনা।’

আসিফ মুচকি হাসে।এরপর টেবিলের উপরের পানির গ্লাসটা বাপ্পির দিকে এগিয়ে ধরে বলে,’আমি জানি তটিনি তোমায় বিরক্ত করেছে।তবে সে তোমার পরিবেশে খুব জলদি মানিয়ে নিতে পারবে।ও দারুণ একটা মেয়ে’

বাপ্পি পানি খেলোনা।গ্লাসটা অনেকক্ষণ ধরে দেখে বললো,’আচ্ছা একটা কথা জানতে পারি?’

‘কি?’

‘তুমি বিবাহিত, এ কথাটা তটিনিকে আগে কেন বললেনা?’

আসিফ মুচকি হাসে আবারও।এরপর বলে,’সেই বিরাট কাহিনী।সময় সুযোগ জায়গা দেখে একদিন বলবো নাহয়!তবে তটিনি আমায় যেরকমটা ভাবছে এখন,,, আমি কিন্তু সেরকমটা নই।পরিস্থিতির কাছে সবাইকেই হেরে যেতে হয়।আমিও হেরে গিয়েছিলাম।এখনও সেই হেরোটাই রয়ে গেলাম।
তটিনিকে যে পায়নি,সে জানে তাকে হারানো কতটা দুঃখের!!

‘তুমি রিনিকে ভালবাসো না?এটলিস্ট সে তোমার ওয়াইফ হয়!’

আসিফ কিছু না বলেই উঠে চলে যায়।কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলেও তা দেয়া যায়না।গলা দিয়ে সেই উত্তর আসতে আসতেই থমকে যায়।সব জবাব সব সময়ের জন্য হয়না!
রিনির সাথে বিয়েটা পারিবারিক ভাবে হলেও তাদের বেশ করে কথা হয় আজকাল ধরেই।এর আগে তাদের কখনও নিবিড়ে,ঘনিষ্ঠ ভাবে কথা হয়নি।এক রুমে থাকা হয়নি,বসা হয়নি।যে বয়সে তাদের বিয়ে হয় সে বয়সে আসিফ জানতোনা বউ কাকে বলে!
চোখের সামনে চঞ্চল যে মেয়েটিকে গলা ফাটিয়ে ভাইয়া বলতে দেখতো সারা বছর,,,,সেই মেয়েটির প্রেমেই আসিফ প্রথমবার পড়েছিল।
মেয়েটিকে সে বুঝতে দেয়নি,কারণ সে জানে তার ভালবাসার অংশীদার হিসেবে অন্য একটা মানুষ গ্রামে বেড়ে উঠছে,দিন গুনছে।
তার পরেও সে এই মেয়েটির প্রেমে ডুবে গিয়েছিল।মেয়েটিকে তার বাবা মারতে আসলে সে প্রতিবার দেয়াল হয়ে দাঁড়াতো।কেয়ার করতো!দূর থেকে প্রাণভরে দেখতো।অথচ কাছে আসলেই সে এমন ভাব করতো যেন সে ওকে নিয়ে কিছুই ভাবেনা।তটিনি তাই কখনওই এটা মাথায় আনেনি যে আসিফ ভাইয়াও ওকে ওরই মতন করে ভালবাসে!!
যখন বোঝার বয়স হলো তখন আসিফ তটিনিকে নিয়ে সে ভাবনা রাবার দিয়ে মন থেকে মুছতে শুরু করলো।ভীষণ কষ্ট হতো তার এই ভেবে যে,সে যে মেয়েটাকে চাইছে তাকে সে কখনও পাবেনা!!পায় ও নি!
তার অনেক আগেই পাওয়া হয়ে গেছে অন্য কাউকে!যাকে সে কখনও চোখে চোখ রেখে দেখেনি। যার হাত ধরে কখনও সে দেখেনি,যার জন্য কখনও সে একটা ফুল আনেনি!যার নাম ধরে ডেকে ডেকে বাড়ি মাথায় করেনি সেই মেয়েটি আজ দিব্যি তার পাশের জায়গাটি দখল করে আছে।রীতিমতন তাকেও হয়ত আপন করে নিতে হবে!কিন্তু মনকে কে বোঝাবে?এতগুলো বছর ধরেও যাকে মন থেকে মোছা গেলোনা তাকে কি করে মন থেকে ভোলাবে!তটিনি যে ভোলার মতন মেয়ে না!
—-
আসিফ রান্নাঘরে যাবার আগে যে করিডোরটা পড়ে তাতে একটা জানালা আছে বাড়ির পেছনের দিকটার জানালা।সেটাতে মাথা ঠেকিয়ে চোখের পানি ফেলছিল সে।
ঠিক সেসময়ে তটিনি লাইটার নিয়ে রান্নাঘর থেকে যাচ্ছিল,আসিফকে কাঁদতে দেখে সে থেমে যায়।আসিফের কান্নার কারণ সে ছাড়া আর কেউ নয় এটা সে বেশ বুঝতে পারছে।কিন্তু আসিফের প্রতি অগাধ ক্ষোভ তাকে আর এখানে থামিয়ে রাখতে পারেনি।সে চলে আসলো তার রুমে।
এখন কেঁদে লাভ কি?চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে!
ভালবাসার মানুষ হারালে হুশ আসে যে ঠিক কি হারাইছে।

তটিনি কবিতার পাতায় আগুন ধরাতেই যাচ্ছিল,ঐ সময়ে বাপ্পি এসে ওকে আটকিয়ে বলে,’ছোট বয়সী মেয়েদের মতন কাজ করবেনা।ওতোটাও ছোট না তুমি!’

‘যান আমার রুম ঠেকে।আমার ইচ্ছা আমি কি করবো না করবো!’

‘বইখাতাগুলো না পুড়িয়ে কেজি দরে বিক্রি করলে টাকা পাবে।সে টাকা দিয়ে চানাচুর ও খেতে পারবে’

তটিনি লাইটার ফেলে নিচে বসে গেছে এবার।বাপ্পি ভাবলো তটিনিকে হাসাবে কিন্তু ওকে এমন ভেঙ্গে পড়তে দেখে সে নিজেই দূর্বল হয়ে পড়েছে।
———-
রিনি জামা বদলে রুম থেকে বের হতেই আসিফকে দেখে করিডোরে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে।নিশ্চয় কেঁদেছিল,এটা সে বেশ বুঝতে পারছে।আর কান্নাটা যে তটিনির জন্য এটাও সে জানে।কিছু বলবে নাকি বলবেনা,বললেও কেমন রিয়েক্ট করবে তা ভেবে রিনি আর আগায়নি।কিন্তু লোকটা সম্পর্কে তার স্বামীই হয়।দরদ লাগছে বলে টিস্যুর বক্সটা এনে পাশে ধরলো সে।আসিফ মুখ ফুলিয়ে চলে গেছে কোনো কথা না বলে।যেন সে রিনিকে দেখেইনি।রিনি ও পিছু পিছু আসতেই,,ওর মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো আসিফ।মানে সে একা থাকতে চায়।
রিনি আর কি করবে সোজা তটিনির কাছের দিকে গেলো।
তটিনির রুমের কাছে এসে দেখে দরজা খোলা।সে ওমনি মাঝে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো বাপ্পি তটিনির দিকে করুণ চোখে চেয়ে আছে আর তটিনি বাচ্চাদের মতন কাঁদছে নিচে বসে বসে।

রিনি মনে মনে বললো,’দুই হাগলে অজ্ঞার লাই অজ্ঞা কান্দে,হাঁকে দি আঁই আর এই বেডা ফাঁইসা গেছি’🐸
[দুই পাগলে একজনে আরেকজনের জন্য কাঁদে।ফাঁকে দিয়ে আমি আর এই লোকটা ফেঁসে গেছি’]

রিনি মুখ বাঁকিয়ে দরজাটা টেনে দিয়ে চলে গেলো।ওকে তটিনি আর বাপ্পি কেউওই দেখেনি।
রিনি এবার তটিনিদের বাসার পেছনে এসে আসিফের রুমের জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।আসিফ নিচে বসে বসে চোখ মুছছে ঠিক তেমন করে যেমনটা তটিনি করছিল।রিনি এক দৃষ্টিতে বেশ অনেকক্ষণ ধরে ওকে দেখে বললো,”কাঁদাকাডি শেষ অইলে কইয়েন,বাপ্পি ভাই আর তটিনি বইনের লাই নাস্তা বানাইছি,আন্নে সহ খাইয়েন’

আসিফ ভূত দেখার মতন চমকে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে জানালার গ্রিল ধরে রিনি দাঁড়িয়ে আছে।আসিফ বিরক্ত হয়ে কাছে এসে জানালা আটকে দিলো এবার।রিনি জানালার ওপার থেকে বললো,’আন্নেরে কাঁদাকাডি করতে তো আঁই দেই হালাইছি।অন আর জানালা বন্ধ করি লাভ আছেনি?’

আসিফ আরও রেগে গেছে কিন্তু কিছু বলতে পারছেনা।রাগটা ভেতরে ভেতরে পুষে রেখে চুপ করে থাকলো।
———
তটিনির কান্না থেমেছে।জিনিসপত্র গুলো যেভাবে আছে সেভাবে রেখেই সে উঠে পড়ে।বাপ্পি তখনও চুপ করে ছিল।সে কিছু করলে তটিনি না জানি ক্ষেপে যায় সে ভয়ে সে কিছুই করছেনা,তটিনি রোবটের মতন এক জায়গায় দাঁড়িয়েই ছিল,সেসময় বাপ্পির ফোনে ওর বড় বোন বকুলের কল আসে।তাই সে রিসিভ করে বাহিরে চলে আসলো।

‘কিরে বাপি??আর কতক্ষণ লাগবে তোদের?বাড়িতে সবাই নতুন বউকে দেখার জন্য ড্রয়িং রুম ভর্তি মানুষ এসে বসে আছে অথচ তোরা সামান্য জামাকাপড় নিতে গিয়ে এখনও আসছিস না।আসতেও তো দু ঘন্টার মতন লেগে যাবে,সেটা জানিস?’

‘হ্যাঁ আমরা সিএনজির অপেক্ষা করছি আপু।এখনই রওনা হবো’

বাপ্পি জলদি ফোন রেখে পেছনে ফিরতেই দেখে তটিনি তার হাতে জামাকাপড়ের ব্যাগ নিয়ে সোজা হাঁটা ধরেছে।বাপ্পিকে আর কিছু বলতে হয়নি।যাবার আগে তারা রিনিকে বলে চলে এসেছে।তটিনি কোনো কথাই বলেনি,শুধু বাপ্পি বলেছে তারা যাচ্ছে।
——
আসিফ কারোর কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছেনা বলে মুখ ধুয়ে এসে রুমের দরজা খোলে।খুলতেই দেখলো ওপারে রিনি হাতে কমলার প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,যেন এতক্ষণ দরজা খোলার অপেক্ষাতে ছিল।আসিফ কিছু না বলে ওর পাশ কাটিয়ে করিডোর দিয়ে সামনের দিকে গেলো।রিনি ওর পিছু পিছু আসতে আসতে বললো,’কমলা খাইবেন্নি?এইন্না মিডা!!!
[কমলা খাবেন?এত মিষ্টি!’

‘তুই খা’

‘আই তিনগা খাইছি।আন্নে অজ্ঞা খান।এতাগো কমলা মিডা’
[আমি তিনটা খেয়েছি।আপনি একটা খান।এনাদের কমলা মিষ্টি’

আসিফ তটিনির রুম খালি দেখে জানতে চাইলো ওরা কোথায়।
রিনি জানালো ওরা চলে গেছে।আসিফ স্বস্তির দম ফেললো তখন।সে চায়নি আর তটিনির মুখোমুখি হতে।ভালই হয়েছে ওরা না বলে চলে গেছে।নাহলে কষ্টটা আরও গাঢ় হতো।

আসিফ মুখে হাসি ফুটিয়ে পেছনে ফিরতেই রিনি কমলার প্লেট উপরে তুলে বললো,’কমলা খাইলে মাতা ঠাণ্ডা অয়।ইক্কিনি খান’
[কমলা খেলে মাথা ঠাণ্ডা হয়।একটুখানি খান]
চলবে♥তোমাতে করিবো বাস💗
#পর্ব_১৫
লেখনীতে-আফনান লারা
.
বাপ্পি আর তটিনি মিলে চুপচাপ গাড়ীতে করে বাড়ি ফিরছে।বাপ্পি ভেবেছিল তটিনি আগামী কয়েকদিনেও কোনো কথা বলবেনা,বোবা হয়ে থাকবে।কিন্তু তার ধারণা ভুল করে দিয়ে তটিনি বলে উঠলো,’আমি বিসকুট চুবিয়ে চা খাবো,দুধ চা।টাটকা গরম দুধ চা,ধোয়াঁ ওঠা একেবারে।আর বিসকুটটা হতে হবে মেরি বেসকুট’

বাপ্পি গাড়ী থামিয়ে ফেলে ড্রাইভারকে বলে। মা বলেছিল কিছু মানুষ নাকি রাগ হলে খাবার বেশি করে খায়।তটিনিও হয়ত সেই লেভেলের।
তাই ওর কথামতন বাপ্পি কাছের একটা দোকানে গিয়ে চায়ের খোঁজ করলো।মুশকিল হলো দুধ চা নেই,আছে রঙ চা।

‘শোনো!রঙ চা খাবে?দুধ চা নেই তো’

‘আমার সর্দি লাগছে?কেন খাব রঙ চা?’

‘সর্দি লাগলেই খায় নাকি রঙ চা?আমি তো মন চাইলেই খাই’

‘আমি আর আপনি কি এক হলাম?আর কোনোদিন আমাকে রঙ চা সাধবেন না।বিরক্তিকর! ”

বাপ্পি ফের এসে গাড়ীতে বসে ড্রাইভারকে বললো সামনে কোনো দোকান দেখলে আবার থামাতে।
————
আসিফ রান্নাঘরের তাকে উঠে বসে বসে পা দুলাচ্ছে আর কমলা খাচ্ছে,রিনির কথামতন।
রিনি বাপ্পি আর তটিনির জন্য বানানো নাস্তা সাবাড় করছে বসে বসে।
কমলার খোসা ফেলে আসিফ বললো,’তোকে কাল সকালে বাড়িতে দিয়ে আসবো।কোনো কথা বলবিনা’

‘আঁই হরেরদিন চলি আইয়াম আবার😎'[আমি পরেরদিন চলে আসবো আবার’

‘থাপ্রাবো!বেয়াদবের মতন কথা বলবিনা।আমি তোর স্বামী হই।আমার আদেশ মানা তোর কর্তব্য ‘

‘স্বামী?কিচ্চেন?আঁর জামাই হই আন্নে আঁর লাই কিচ্চেন যে আন্নে জামাইর অধিকার চান অন??’
[স্বামী?কি করছেন?আমার জামাই হয়ে আপনি আমার জন্য কি করছেন যে আপনি জামাইর অধিকার চান এখন? ‘

‘ওমা গো!আবার কিছু করাও লাগবে?আমি কি চাকরি করি যে তোর জন্য কিছু করবো?শর্ত তো এটাই ছিল যে চাকরি পেলেই তোকে নিয়ে আসবো, তবে তুই আগে ভাগে এসে ঘ্যানঘ্যান করছিস কেন?’

‘কারণ আঁর আর হত্তে হত্তে ভাল্লাগেনা আন্নেরে ছাড়া,
আঁই থাইকলে আন্নের লগেই থাইক্কাম ‘
[কারণ আমার আর একা একা ভাল লাগেনা আপনাকে ছাড়া। আমি থাকলে আপনার সাথেই থাকবো’]
———
সামনে কোথাও চায়ের দোকান পায়নি বাপ্পি।তটিনি মাথা ধরে এক পাশে মাথা হেলান দিয়ে চুপ করে আছে,কোনো কথা বলছেনা।বাপ্পি আর ওকে বিরক্ত করতে চায়নি,চুপ করে ছিল।দু ঘন্টার পথটা তাই খুব দপরি করে শেষ হয়েছে।তাও তারা কোনো কথা না বলেই বাড়ি পৌঁছে গেছে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ।বাড়ির গেইট অবধি আসতেই মানুষের গমগম শোনা গেলো।তটিনি ভয় পেয়ে থমকে গেছে।বকুল আপু বাগানেই ছিলেন ওদের অপেক্ষায়।তটিনিকে দেখে ছুটে এসে ওর মাথার ঘোমটার কথা জানতে চাইলেন।তটিনি বললো সে ওটা রুমেই ফেলে গেছে।তাই জলদি গিয়ে রুম থেকে ঘোমটা নিয়ে আসলেন উনি।ওটা তটিনিকে পরিয়ে এরপর বাড়িতে ঢোকালেন।ড্রয়িং রুমের এমন কোনো জায়গা বাকি নেই যেখানে মানুষ বসা নেই।সোফার হাতলেও কতজন বসে আছে।সবার চোখ তটিনির দিকে।তটিনি আসিফকে নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত ছিল যার কারণে সে রোবটের মতন তাই তাই করছিল যা যা বকুল আপু করতে বলছিল।সবার মাঝে দাঁড়িয়ে সে সালাম দেয় আগে।এরপর বাপ্পির একটা কাজিন উঠে গিয়ে তটিনিকে সোফায় বসতে জায়গা করে দিলো।তটিনিকে ওখানে বসানো হলো।বাপ্পি তটিনিকে একা রেখে যেতে চায়নি বলে এক কোণায় দাঁড়িয়ে দেখছিল ওকে।
খালা,ফুফু,মামি,সবাই ঘিরে ধরে তটিনির ঘোমটা সরিয়ে কথা শুরু করেছে।তটিনি মাথার ব্যাথায় গালটা ফুলিয়ে সবার মুখের দিকে তাকিয়েছিল।সেইসময় বাপ্পির ফুফু ওর মামিকে বলছিল মেয়ে ওমন গাল ফুলিয়ে রেখেছে কেন।তখন বাপ্পির মামি বলে মেয়ে নাকি বিয়েতে রাজি ছিল না।এটা নিয়ে ফিসফিস শুরু হয়ে গেলো।তখন বাপ্পি ওদের বুয়াকে ডেকে চা নিয়ে আসতে বলে,কারণ সে জানে তটিনির এই মূহুর্তে কি প্রয়োজন।তটিনি ওনাদের ফিসফিস সব শুনে আবার জোর করে হাসির চেষ্টা করছে।সবাই যে যার উপহার ওর হাতে ধরিয়ে আবার অন্য টপিক নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠেছে।বকুল তখন আপু তটিনির কাছে গিয়ে বললেন সে এখন রুমে যেতে পারে।ওমনি তটিনি উঠে চলে গেলো রুমে।

রুমে এসেই ঘোমটা টা খুলে আবারও ছুঁড়ে মারলো সে।এবারও সেটা বাপ্পির মুখেই পড়েছে।

‘আমি জানি তোমার মন খারাপ।কি করতে পারি বলো?’

‘চুপ করে বসে থাকেন’

এটা বলে তটিনি বিছানায় উঠে বললো,’লাইট বন্ধ করেন তো!আলো দেখলেই মেজাজ খারাপ লাগে’

বাপ্পি লাইট বন্ধ করে ধীরে ধীরে ডিভানে গিয়ে বসে।তারপরেই বকুল আপু বাপ্পির আর তটিনির জন্য বিকালের নাস্তার ট্রেটা নিয়ে এসে রুম অন্ধকার দেখে
ভাবলেন রুমে কেউ নেই,কিন্ত তার বেশ মনে আছে ওদের দুজনকে তিনি একসাথে রুমে ঢুকতে দেখেছিলেন।তবে গেলো কই?ট্রেটা এক হাতে রেখে অন্য হাতে অনেক কষ্টে রুমের আলো জ্বালালেন আপু।ওমা!!আলো জ্বালাতেই বাপ্পি তটিনি দুজনকেই রুমে দেখে আপু অবাক হয়ে বললেন,’একি রে!!তোরা দুজন এখানে আর আলো নেভানো কেন?এটা কোন ধরনের কারবার?’

‘আপু আমার না অন্ধকারে বসে থাকতে ইচ্ছে করছিল’

‘তোর এমন উদ্ভট ইচ্ছা হয়না সেটা জানা আছে আমার।বাড়িতে যে নতুন এসেছে তার মাথা থেকেই এমন উদ্ভত ইচ্ছা বের হতে পারে।যাই হোক!নতুন বউয়ের মুড সুয়িং হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার।আমার ও বিয়ের পরেরদিন মেজাজ গরম ছিল।তার কারণ ছিল তোদের দুলাভাই আমায় চায়ের সাথে বিসকিট দেয়নি।আমি তো ভাই বিসকিট ছাড়া চা খেতেই পারিনা,সেই নিয়ে মেজাজ গরম ছিল।নতুন বরের উপর জোর খাটাতে কিছু মেয়ের আরাম লাগে তার মধ্যে আমি একজন ছিলাম।তটিনিও তাদের একজন।কিন্তু তটিনি তোমায় আবারও বলছি! আমার ভাইকে সিধা পেয়ে এত জোর খাটাইওনা।বাপ্পির একটা বাজে অভ্যাসের কথা জেনে রাখো।সে অতি সহজে রাগ করেনা এটা যেমন চরম সত্য তেমনই সে অতিরিক্ত কিছু হয়ে গেলে প্রচণ্ড রকমের রাগ করে।তার সেই রাগ গায়ের চামড়া উঠে হাতে চলে আসলেও যায়না।তাই বাপ্পিকে সীমার অধিক বিরক্ত করবেনা,হেনস্তা করবেনা।’

এই বলে বকুল আপু ট্রে রেখে চলে গেছে।তটিনি বাপ্পির দিকে তাকিয়ে বললো,’আমি ভয় পাই আপনাকে?আপনি যদি রেগেও যান তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসেনা।’

‘জানি আমি’

‘হুম।আর সবাই আমায় এত জ্ঞান কেন দিচ্ছে?আমার ইচ্ছা আমি কিভাবে বাকি জীবন চলবো।আমাকে কেন নিয়মের মধ্যে আটকে থাকতে হবে?’

‘থাকতে হবেনা।আমি তোমায় সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিব’

‘তা তো দেখছিই কেমন স্বাধীনতা দিবেন’
———-
আসিফ রিনির ব্যাগ গুছিয়ে ওকেও রেডি হতে বললো।কাল না গিয়ে আজই সে যাবে বলে ঠিক করেছে।রিনি শুরুতে না না করছে বলে আসিফ নিজেই সব করে নিয়েছে।বাসের টিকেট কেটে তটিনির মাকে ফোন করে বলে সে রিনিকে নিয়ে জোর করে বেরিয়ে গেছে বাসা থেকে।
রিনি বেশ অনেকক্ষণ যাবার জন্য জেদ করে যখন দেখে আসিফ মানছেনা তখন সে চুপ হয়ে যায়।একেবারে চুপ।
চঞ্চল,বাচাল মেয়েটি একেবারে চুপ হয়ে গেলো।কোনো কথা নেই তার মুখে।আসিফ তাকে নিরব দেখেও কোনো রিয়েকশান দেখায়নি,সে তার সিদ্ধান্তে অটল।
—–
‘আপা ঝালমুড়ি খাইবেন?’

বাসে ওঠা ঝালমুড়িওয়ালার কথা শুনে রিনি গাল ফুলিয়ে জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে বললো,’এগিন আঁর লগের বেডা ইগার গাত ঢালি দেন উত করি🙂’
[এগুলা আমার সাথের লোকটার গায়ে উপুড় করে ঢেলে দেন’]

লোকটা হা করে তাকিয়ে আছে।আগাগোড়া কিছুই বুঝলোনা সে কিন্তু আসিফ ঠিকই বুঝেছে।সে দশ টাকার ঝালমুড়ি নিয়ে একা একা খাওয়া শুরু করলো রিনিকে দেখিয়ে দেখিয়ে।

আসিফ মরিচ বেছে বেছে ফেলছিল নিচে কারণ সে ঝাল খেতে পারেনা।হাত দিয়ে মরিচ ধরে সে হাত দিয়েই আবার ভুলে নিজের চোখ কচলে ফেললো।ওমনি জ্বালা পোড়া শুরু।
চোখে হাত দিয়ে আসিফ ছটফট করছিল।
রিনি ওর দিকে চেয়ে অবস্থা দেখেই বুঝে গেছে কি হয়েছে তাই সে নিজের ওড়নায় ফু দিয়ে আসিফের চোখে চেপে ধরলো চুপ করে।
এমন কয়েকবার করার পর আসিফের চোখের জ্বালা কমলো।দম ফেলে সে আবারও আগের মতন গাল ফুলিয়ে বসে থাকলো
রিনিও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।লোকটার কাছে কৃতজ্ঞতা বলে কিছুই নেই।
———
তটিনি বাপ্পির রুমের জানালা খুলে মাথা ঠেকিয়ে নিচে বাগান দেখছিল।সেই বারান্দা দিয়ে আহামরি কিছু দেখা যায়না,দেখা যায় শুধু সবুজ ঘাস।তটিনি মনযোগ দিয়ে সেটাই দেখছিল।বাপ্পি কয়েবার ওর পাশে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখে গেছিল আসলে সে এতক্ষণ ধরে কি দেখছে।কিন্তু সে নিজেও সবুজ ঘাস ছাড়া আর কিছু দেখতে না পেয়ে চলে গেছে।ঘাসকে কেউ এমন মনযোগ দিয়ে দেখতে পারে তা ওর এই প্রথম জানা।অনেকক্ষণ যাবত ঘাস দেখতে দেখতে তটিনির নজরে আসলো সিগারেটের খালি প্যাকেট ঘাসের মাঝে পড়ে আছে।সে পেছনে তাকিয়ে বললো,’আপনি সিগারেট খান?’

‘নাহ’

‘মিথ্যে কেন বলছেন?আপনি ছাড়া আর জোয়ান কে আছে বাসায়?’

‘দুলাভাই খায়।হয়ত আজ যখন এসেছিল তখন খেয়েছে।কেন কি হয়েছে আবার?’

‘মদ খান?’

‘আমি যদি এগুলা খাইও,তোমার কি তাতে কিছু যায় আসে?তাছাড়া আরেকটা কথা হলো, আমি যদি কোনো মেয়ের সাথে চ্যাট ও করি তোমার কি তাতে কিছু যায় আসে?’

‘যায় আসে নাকি না আসে তাতে আপনার কি যায় আসে?আমার ইচ্ছা আমি প্রশ্ন করবো।ঠিকঠাক জবাব দেবেন নাহয় প্রশ্নটা আপনার মাকে গিয়ে করবো।বুঝতে পারছেন? ‘
চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here