তোমাতে রহিব বিলীন পর্ব অন্তিম

#তোমাতেই_রহিব_বিলীন
#পর্ব_২১ (অন্তিম পর্ব)
#নিশাত_জাহান_নিশি

“অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত এই তিন কালচক্র ধরেই শুভ ভাই আপুকে পূর্বের ন্যায় উন্মাদের মতো ভালোবেসে আসছে, আসছেন এবং ভবিষ্যতে ও আসবেন! এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই!”

আব্বু কিঞ্চিৎ মুহূর্ত ভাবশূন্য ভঙ্গিতে মৌন রইলেন। অতঃপর কিছু একটা ভেবে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“আমাকে স্বার্থপর প্রমান করতে চাইছ? শুভর চোখে আমাকে ছোট করতে চাইছ?”

“আশ্চর্য আব্বু। কেনো নেগেটিভ দিকটাই তুমি ভাবছ? আই হোপ সো আব্বু। শুভ ভাই কখনো তোমার সম্পর্কে এসব কু-ধারনা পোষন করেন নি, না কখনো করতে পারবেন!”

“স্যরি প্রভা। আমি কাউকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারব না। শুভ হয়তো কখনো মুখ ফুটে কিছু বলবে না, তবে মনে মনে এই কু-ধারনা গুলো পোষন করতেই পারে। আমার পাশাপাশি আমার বড় মেয়ে এবং আমার গোটা পরিবারকেই নিচ এবং স্বার্থপর ভাবতে পারে!”

আমি অধৈর্য্য কন্ঠে বললাম,,

“তুমি ভুল বুঝছ আব্বু। শুভ ভাই কখনো আমাদের নিচ বা স্বার্থপর ভাবতে পারেন না। তুমি অযথাই বেশি ভাবছে।”

কিঞ্চিৎ মুহূর্ত থেকে আমি পুনরায় বললাম,,

“ওকে ফাইন আব্বু। তোমার যদি এই বিষয়ে কোনো ডাউট থেকেই থাকে। তবে তুমি চাইলে এই বিষয়টা নিয়ে শুভ ভাইয়ার সাথে বিস্তারিত কথা বলতে পারো।”

প্রতিত্তুরে আব্বু কিছু বলার পূর্বেই আম্মু কান্নাজড়িত কন্ঠে আব্বুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“কেনো এতো জেদ করছ সোলেমান? মেনে নাও না প্রভার কথা! সবসময় নিজে যা ভাববে তাই কেনো তোমার করতে হবে? পরিবারে আমার বা আমার মেয়েদের সিদ্ধান্তের কোনো গুরুত্ব নেই? আমরা কখনো তোমার সিদ্ধান্তের উপর নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারি না? আমাদের মতামতের কি কোনো প্রাধান্যই নেই? আমি জানি শুভ কেমন! শুভর মতো নম্র, ভদ্র, ভালো একটা ছেলে এই পৃথিবীতে দুটো নেই। আমি হলফ করে বলতে পারি, এবার অন্তত আমার বড় মেয়েটা একটু সুখেই থাকবে। একবার তো কথা বলে দেখো শুভর সাথে!”

দাঁতে দাঁত চেঁপে আব্বু আম্মুর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“তোমার মেয়ে প্রেগনেন্ট। আরিফের সন্তান ওর গর্ভে। মানলাম শুভ জেনে শুনে তোমার মেয়েকে বিয়ে করল। সন্তানটাকে ও মেনে নিলো। কিন্তু বিয়ের পর? বিয়ের পর যে শুভ তোমার মেয়েকে তার অতীত সম্পর্কে খোঁটা দিবে না, কটু কথা শুনাবে না তার কোনো গ্যারান্টি আছে? দিতে পারবে তুমি আমায় সেই গ্যারান্টি?”

আম্মু প্রতিত্তুর করার পূর্বেই আমি আম্মুর মুখের কথা টেনে দৃঢ় কন্ঠে আব্বুকে বললাম,,

“আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি আব্বু! শুভ ভাই কখনো আপুর অতীত সম্পর্কে খোঁটা দিবেন না, না কখনো আপুকে কটু কথা শোনাবেন!”

আব্বু অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“এতো কনফিডেন্স শুভর প্রতি? শুভ তোমার চোখে এতোটাই ভালো? এতোটাই মহান?”

“হ্যাঁ মহান। শুভ ভাই আমার চোখে মহান। আর শুভ ভাইকে আমি ভালো ভাবে চিনি বলেই এতো কনফিডেন্স শুভ ভাইয়ার প্রতি!”

আব্বু হঠাৎ খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে বেসিনের দিকে পা বাড়িয়ে পেছন থেকে শান্ত কন্ঠে আমায় উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“শুভ দেশে ফিরলেই কথা হবে এই বিষয়ে। শুভ যদি সত্যিই আমার মেয়েকে ভালোবেসে থাকে, যদি আমি এর সামান্যতম প্রমান ও পাই না? তবে অন্তত এবার আমি না করব না, গতবারের মতো এবার আর শুভকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিবো না!”

আমি এবং আম্মু দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে মৃদ্যু হাসলাম। মনে হলো যেনো এক যুগ পর আম্মুর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে প্রফুল্ল হাসি দেখেছি। এই হাসির মূল্য পৃথিবীর কোনো দুর্লভ জিনিসে ও হয় না।

,
,

কেটে গেলো মাঝখানে দীর্ঘ ১ বছর! আপু এবং শুভ ভাইয়ার বিয়ের ২ মাস চলছে! শুভ ভাইয়া এবার ঠিক পেরেছিলেন আব্বুর মন জয় করে ভালোবাসার হাজারটা প্রমান দিয়ে আব্বুর বরাদ্দ করা গন্ডি থেকে আপুকে বের করে আনতে। সারা জীবনের জন্য আপুকে নিজের সাথে একাত্ন করে নিতে। আপুর মেয়েকে নিজের মেয়ে হিসেবে ভালোবাসতে, আপন করে নিতে। “ফাইজা” (আপুর মেয়ে) তিন মাস ১৫ দিন চলছে বাবুটার! শুভ ভাইয়া সারাক্ষন ফাইজাকে চোখে চোখে হারাচ্ছেন। বেলায়, অবেলায় মেয়েকে নিয়ে মেতে থাকছেন, এক দন্ড মেয়েকে চোখের আড়াল করতে চাইছেন না। আপুর চেয়ে ও শুভ ভাইয়া অধিক কেয়ারিং ফাইজার প্রতি। বিন্দুমাএ অবহেলা করছেন না ফাইজাকে। আপু সংসার জীবনে এখন বেশ সুখি! শুভ ভাইয়াকে পেয়ে আপু অতীতের ক্ষত একটু একটু করে ভুলতে আরম্ভ করেছেন। আরিফ নামের অধ্যায়টাকে ও ভুলতে বসেছেন প্রায়। শুভ ভাইয়ার প্রেমপূর্ণ পাগলামীতে আপু এখন ভালোই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন!

জিজুর সাথে তিন মাস হলো আপুর ডিভোর্সের! দুমাস আগে জেল থেকে হঠাৎ এক রাতে খবর এলো জিজু হার্ট এ্যাটাকে মারা গেছেন! হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার সময়টা ও পর্যন্ত পাওয়া যায় নি! জিজুর মৃত্যুর এক মাস পূর্বেই আপু এবং জিজুর ডিভোর্স টা হয়। জিজু অনেক কাকুতি, মিনতি করে ও ডিভোর্সটা ঠেকাতে পারেন নি। ইয়ানাত আঙ্কেল ও আব্বুকে দু,তিন বার রিকুয়েস্ট করেছিলেন। তবে আব্বু প্রতিবারই ইয়ানাত আঙ্কেলের রিকুয়েস্টকে নাকোচ করেছিলেন। পরবর্তীতে আঙ্কেল আর জোরাজুরি করেন নি। স্বাভাবিকভাবেই ডিভোর্সটাকে মেনে নিয়েছিলেন। ধারনা করা যাচ্ছে, ডিভোর্সের শোকটা জিজু মানতে পারেন নি! নয়তো আল্লাহ্ র তরফ থেকে নিজের কু-কর্মের ফল জিজু ইহকালেই পেয়েছিলেন। ধারনা করছি মাএ! বাকিটা উপর ওয়ালাই ভালো জানেন!

জিজুর মৃত্যুর পর আহনাফ এবং আঙ্কেল সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন। টানা এক মাস সময় লেগেছিলো জিজুর আকস্মিক মৃত্যুটা রিকভার করতে। জিজুর মৃত্যুর জের ধরেই আঙ্কেল এবং আহনাফের সাথে আমার টুকটাক বাক-বিতন্ডা হয়েছিলো। সাময়িকভাবে তারা দুজনই আমাদের দায়ী করছিলেন জিজুর আকস্মিক মৃত্যুতে৷ আমি এবং আমার পরিবার শান্ত থেকেই পরিস্থিতিটা সামলে নিয়েছিলাম। কারন আমরা জানতাম, আঙ্কেল এবং আহনাফ গভীর শোকে তলিয়ে ছিলেন বলেই আমাদের দিকে আঙ্গুল তুলতে পেরেছিলেন। সুস্থ, স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলে তারা কখনো আমাদের দিকে আঙ্গুল তুলতেন না! বিধির বিধান বলেই জিজুর মৃত্যুটা মেনে নিতেন।

আহনাফের সাথে বিয়ের ৪ মাস চলছে আমার! আপুর ডিভোর্সের এক মাস পূর্বে আব্বু এবং আম্মুকে অনেক বুঝিয়ে, শুনিয়ে আহনাফ আমায় বিয়ে করেছিলেন! আহনাফের পাগলামী দেখে আব্বু ও আমাদের বিয়েতে রাজি হতে বাধ্য হয়েছিলেন। সাদা-মাটা ভাবেই আমাদের বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছিলো। তিন কবুল এবং রেজিস্ট্রির মাধ্যমেই কাজীর সামনে আমাদের বিয়েটা হয়েছিলো। সব কিছু ঠিকঠাক ভাবেই চলছিলো। জিজুর সাথে আপুর ডিভোর্সটা ও আহনাফ স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিয়েছিলেন। তবে জিজুর আকস্মিক মৃত্যুতে আহনাফ শতভাগ আমাকেই দোষারোপ করেছিলেন। এই নিয়ে আহনাফের সাথে তুখার ঝগড়া হয়েছিলো আমার। যার জের ধরে দীর্ঘ ১ মাস আমি আহনাফের সাথে রাগ করে বাপের বাড়ি চলে আসি৷ আহনাফ ও এই এক মাসে অন্তত একবারের জন্য আসে নি আমার রাগ ভাঙ্গাতে। আমাকে ফিরিয়ে নিতে। জিজুর মৃত্যুর শোক কাটিয়ে আঙ্কেল সহ আহনাফ হঠাৎ একদিন উঠেছিলেন আমাদের বাড়িতে। পরিশেষে আমি বাধ্য হয়ে আহনাফের সাথে আহনাফের বাড়ি ফিরে আসি।

আজ নেহাল ভাই এবং তনিমা আপুর বিয়ে! এই এক বছরে তাদের মধ্যে প্রখর এক ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরী হয়েছিলো। সেই ভালোবাসার পরিনতি আজ স্বার্থকতা পাবে। দুজনই আজ পবিএ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন। নেহাল ভাইয়ার পরিবারের তরফ থেকে আমার বাপের বাড়িতে ও বিয়ের দাওয়াত পৌঁছানো হয়। পল্লবী আপু এবং শুভ ভাইয়ার কাছে ও বিয়ের ইনভিটিশান পৌঁছে যায়। প্ল্যান মাফিক সবাই এক জোট হয়েই নেহাল ভাই এবং তনিমা আপুর বিয়েতে যাওয়ার সিদ্ধান্তে নেই।

আহনাফ এবং শ্বশুড় আব্বু এখনো বিষন্ন হয়ে থাকেন জিজুর অকাল মৃত্যুতে। বিষাদে জর্জরিত ছিলেন বলেই আহনাফ আগ্রহ প্রকাশ করেন নি নেহাল ভাইয়ার হলুদের অনুষ্ঠানে যাওয়ার। সমস্ত প্ল্যানিং ভেস্তে দিয়েছিলেন এই লোকটা। অফিস থেকে রাতে বাড়ি ফিরেই উনি না খেয়ে, না দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। অনেক জোরাজুরি করে ও উনাকে খাওয়াতে পারি নি কিছু। শেষ পর্যন্ত আমি ও না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম উনার সাথে।

নেহাল ভাইয়ার বিয়ে আজ! অলরেডি সকাল ৮ঃ৩০ মিনিট বাজছে ঘড়িতে। ঘুম ভেঙ্গে উঠে আমি তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছেড়ে নামতেই মনে হলো কেউ আমার শাড়ির আঁচল ধরে টানছেন। পিটপিটে চোখে আমি পিছু ফিরে তাকাতেই দেখলাম আহনাফ ক্রুর হেসে আমার শাড়ির আঁচলটা ধরে আছেন। কপাল কুঁচকে আমি ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললাম,,

“কি হলো?”

মুহূর্তের মধ্যেই আহনাফ আমার শাড়ির আঁচলে হেচকা টান দিয়ে আমাকে বিছানার উপর শুইয়ে দিলেন। তড়িৎ বেগে আমার গাঁয়ের উপর উঠে উনি আমার চোখে, মুখে অজস্র চুমো খাওয়া অবস্থায় স্লো ভয়েজে বললেন,,

“কিছু হয় নি এখনো। তবে এখন হবে!”

আমি বিস্ময়ভরা কন্ঠে বললাম,,

“হবে মানে?”

আহনাফ উন্মাদের মতো আমার ঘাঁড়ে মুখ ডুবিয়ে ছোট ছোট বাইটে আমার ঘাঁড়ের দিকটা ভরিয়ে দিচ্ছেন। অতঃপর এক টানে আমার গাঁ থেকে শাড়ির আঁচলটা খুলে ঘোর লাগা স্বরে বললেন,,

“রাতের আদরটা এখনই পুষিয়ে নিবো!”

প্রতিত্তুর করার সুযোগ না দিয়ে আহনাফ আমার ঠোঁট জোড়া আঁকড়ে ধরতেই আমি অস্পষ্ট কন্ঠে উনার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,

“নেহাল ভাইয়ার বিয়েতে যাবো না? এমনিতেই আজ অনেকটা লেইট হয়ে গেলো ঘুম থেকে উঠতে!”

“নেহালের বিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে না। যাওয়ার অনেক সময় পড়ে আছে। আমাকে জাস্ট ওয়ান আওয়ার সময় দিলেই হবে!”

মৃদ্যু হেসে আমি ও আহনাফের ভালোবাসায় সায় জানালাম! তাছাড়া আমি ও খুব দ্রুত বেবি কনসিভ করতে চাইছি। বিয়ের চার মাস তো চলছেই অলরেডি। এবার অন্তত একটা বেবির খুব দরকার!

নেহাল ভাই এবং তনিমা আপুর বিয়ে সম্পন্ন হতেই আমরা বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরে এলাম। ফেরার সময় আহনাফ ফাইজাকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। ফাইজার প্রতি এক অদ্ভুত টান আহনাফ এবং শ্বশুড় আব্বুর। কারন ফাইজা দেখতে অনেকটাই জিজুর মতো হয়েছে! জিজু নেই, তবে জিজুর স্মৃতি এখনো অবশিষ্ট আছে। যদি ও আহনাফ এবং শ্বশুড় আব্বু চেয়েছিলেন ফাইজার সমস্ত ভরন-পোষনের দায়িত্ব বহন করতে। তবে শুভ ভাই নাকোচ করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ফাইজার সমস্ত দায় দায়িত্ব শুভ ভাইয়ার কাঁধেই বর্তাবে! জিজুর মৃত্যুতে যে আপু কষ্ট পায় নি, এমনটা ও কিন্তু না। মাঝে মাঝেই আপু জিজুর জন্য মন খারাপ করেন। কখনো অজান্তেই কেঁদে উঠেন। মানুষটা হাজার খারাপ হলে ও এক সময় তো মানুষটা আপুর হাজবেন্ড ছিলেন। মানুষটাকে আপু ভালোবাসতেন, অঢেল বিশ্বাস ও করতেন। মানুষটার আকস্মিক মৃত্যুতে আপুর কষ্ট পাওয়াটা নিতান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার। শুভ ভাই ও অবশ্য বিষয়টা মানিয়ে নিয়েছিলেন। যখনই আপুর মন ব্যথিত হতো, তখনই শুভ ভাই আপুকে সন্তপর্নে মানিয়ে নিতেন।

__________________________________________

দীর্ঘ ৪ বছর পর,,

আমার আড়াই বছরের ছোট্ট মেয়েটা মুখ থেকে লালা নিঃসৃত করে তার বাবার অফিসের শো জোড়া তার গাঁয়ের জামা দিয়েই পরিষ্কার করতে প্রয়াত প্রায়! এদিক সেদিক ফিরে একটু তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। জুতো পলিশের কাজে এতোটাই ব্যস্ত সে। আমি এবং আহনাফ দূর থেকে অবাক চোখে মেয়ের কান্ড দেখছি। ওদিকে তো আহনাফের চোখের কোনে খুশির জল ছলছল করছিলো। ইদানিং মেয়ের পাকামোতে আহনাফের চোখে হুটহাট জল চলে আসে। খুব দুর্বল হয়ে পড়ে মেয়ের প্রতি। মেয়ে পাগলী পুরো আমার বরটা। মেয়েকে সারাক্ষন চোখে চোখে হারায়।

আহনাফের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আমি গলা খাঁকিয়ে আমার মেয়ে “আনহাকে” ডেকে আহ্লাদী স্বরে বললাম,,

“কি করছ মামনী?”

আনহা চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকালো। অতঃপর টোল পড়া গালে খিলখিলিয়ে হেসে আধো আধো বুলিতে বলল,,

“মা মা।”

আনহা তাড়াহুড়ো করে বসা থেকে উঠে আহনাফের একটা শো হাতে নিয়ে আলু থালু ভাবে হেঁটে আহনাফের দিকে এগিয়ে এলো। ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে আনহা আহনাফের দিকে শো টা এগিয়ে দিয়ে বলল,,

“বা বা।”

আনহা হাত দিয়ে ইশারা করে বলছে শো টা পায়ে পড়তে। আহনাফ চোখের জল ছেড়ে তড়িৎ বেগে মেয়েকে কোলে তুলে নিলেন৷ মেয়ের চোখে, মুখে অজস্র চুমো খেয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল,,

“আমার মা টা। বাবাকে কেউ এভাবে কাঁদায়? এভাবে কেউ বাবার যত্ন রাখে? এতোটা ও ভালোবাসে বাবাকে?”

আনহা হাঁসফাঁস করে খিলখিলিয়ে হাসছিলো। আহনাফের চোখে, মুখে চুমো খাচ্ছিলো। পাশ থেকে আমি চোখে জল নিয়ে আহনাফ এবং মেয়ের দিকে চেয়ে আছি। কি সুন্দর এই দৃশ্য! মনে হচ্ছে যেনো পৃথিবীর সব’চে আবেগঘন এই দৃশ্যটা! বাবা, মেয়ের ভালোবাসার এ যেনো এক স্বর্গীয় প্রতিচ্ছবি। আহনাফ আচমকা হাসি মুখে আমার দিকে চেয়ে আমাকে ও উনার বুকের এক পাশে জড়িয়ে ধরলেন। ঐ দিকে মেয়ে তার বাবার চোখ থেকে চশমাটা খুলে চশমা নিয়ে খেলা ধূলা করতে ব্যস্ত। এই নিয়ে প্রায় ৬ টা চশমা ভেঙ্গেছে আনহা আহনাফের। মেয়েকে কোলে নিলেই আহনাফের চশমা গেলো বলে! এরপরে ও আহনাফ একই ভুল বার বার রিপিট করবেন। চশমা চোখে দিয়েই মেয়েকে কোলে নিবেন। ইতোমধ্যেই আহনাফ আমার কপালে দীর্ঘ এক চুমো খেয়ে বললেন,,

“তোমার জন্যই সবকিছু সম্ভব হলো প্রভা। আমার জন্য এক রাশ ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করেছিলে বলেই আজ আমি একটা সুখি সংসার পেয়েছি। তোমাকে পেয়েছি, আমার মেয়েকে পেয়েছি। উপর ওয়ালার কাছে আমি যতোটা ঋণী, তোমার কাছে ও ঠিক ততোটাই ঋণী। ভালোবাসি প্রভা। তোমাকে এবং মেয়েকে ভীষন ভালোবাসি।”

নিরুত্তর থেকে আমি মৃদ্যু হেসে আহনাফের বুকের একপাশে মিশে আছি। লোকটাকে যে আমি কতোটা ভালোবাসি তা কখনো ভাষায় ব্যক্ত করতে পারব না। ধন্য আমি উনাকে পেয়ে। উনার মতো একজন উত্তম জীবন সঙ্গি পেয়ে। যদি ও মাঝে মাঝে লোকটা অকারনে রেগে যান। তবে কিছু সময় পর নিজেই আবার ভালোবাসার টানে আমার কাছে ফিরে আসেন। জিজুর মৃত্যুর শোক সবাই পুরোপুরিভাবে কাটিয়ে উঠতে পারলে ও শ্বশুড় আব্বু এখনো পারেন নি। বড় ছেলের জন্য এখনো উনি নীরবে কাঁদেন। প্রতিদিন ছেলের জন্য মসজিদে মিলাদের ব্যবস্থা রাখেন। প্রতি মাসে বাড়িতে ও মিলাদের অনুষ্ঠান রাখেন। আহনাফ ও মাঝে মাঝে কাঁদেন জিজুর জন্য। জিজুর শেষ স্মৃতি ফাইজাকে তখন দুজনই বুকে টেনে নেন।

আপু আবার বেবি কন্সিভ করেছেন ৫ মাস হলো। শুভ ভাই এবং আপুর পাশাপাশি আমাদের দু পরিবারের সবাই বেশ খুশি আপুর বেবি কনসিভ করার বিষয়টাতে। ফাইজাকে নিয়ে প্রতি শুক্রবার শুভ ভাই নিয়ম করে ঘুড়তে বের হোন। মাঝে মাঝে আমি এবং আনহা ও শুভ ভাইয়ার সাথে ঘুড়তে বের হই। আপু বাড়ি থেকে বের হওয়া তেমন পছন্দ করেন না। তাই শুভ ভাইয়া তেমন জোর ও করতে চান না।

নেহাল ভাই তনিমা আপুর ছয় মাসের একটা ফুটফুটে ছেলে বাবু আছে। কিছুক্ষন দিন আগে তার নামকরণ করা হয়েছে। সেই নামকরন অনুষ্ঠানে আমরা ও এটেন্ড ছিলাম। অনুষ্ঠানের পরের দিন আবার বাড়ি ফিরে আসি। তারা দুজন ও বিবাহিত জীবনে বেশ খুশি। তবে ঝগড়া, ঝাঁটি নিত্যদিন লেগেই থাকে। ঠিক আহনাফ এবং আমার মতো!

বেশ হাসি, খুশি, সুখে, দুঃখেই কেটে যাচ্ছে আমাদের দিন, মাস, বছর। বিবাহিত জীবনে সবাই বেশ সুখি। আহনাফ এবং এক মেয়েকে নিয়ে আমার খুশির যেনো অন্ত নেই। সারাদিন মেয়ের হুটোপুটির জ্বালা সহ্য করে যখন রাতে একটু ঘুমোতে যাবো তখনই শুরু হবে মেয়ের বাবার যন্ত্রনা। সারা রাত আমাকে জ্বালিয়ে মারবে, একদম ঘুমুতেই দিবে না। প্রতি রাতে আমার ঐ চাশমিশ লোকটার রোমান্টিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়৷ আজ ও তার অন্যথায় নয়! রাতের খাবার সেরে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে যখন নিশ্চিন্তে একটু চোখ বুজতে যাবো ঠিক তখনই আহনাফ ঝড়ের গতিতে আমার গাঁয়ের উপর হামলা দিলেন। খোলা জানালা দিয়ে আসা অর্ধ চাঁদের পূর্নিমায় আহনাফের ক্রুর হাসি আমার দৃষ্টিহরন করছে। চশমাটা চোখ থেকে খুলে আহনাফ আমার চোখে চোখ রেখে আমায় প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“প্রভা অর্থ জানো?”

আমি ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ উঁচিয়ে বললাম,,

“জানব না কেনো?”

“তাহলে বলো কি?”

“আলো!”

আহনাফ উনার দুচোখে আঙ্গুল তাক করে মৃদ্যু হেসে বললেন,,

“আমার এই দু চোখে তুমি আলোর পরশ হয়েই এসেছ প্রভা! তোমার নামের মাঝেই আমাদের ভালোবাসার স্বার্থকতা খুঁজে পাই। প্রথম যেদিন তোমায় দেখি না? তখনই খুব ইচ্ছে জাগে চোখ থেকে এই পাওয়ার ফুল চশমাটা খুলে তোমার আলোয় দু চোখে সম্পূর্ণ জ্যোতি ফিরে পেতে। চোখ দুটো চকচক করছিলো আমার। পরিশেষে চোখ থেকে চশমাটা খুলতেই হলো। খালি চোখেই তোমায় দেখার সৌভাগ্য হলো।”

অট্ট হেসে আমি আহনাফের কপালের অংশে লেপ্টে থাকা চুল গুলো বাম হাত দিয়ে এলোমেলো করে বললাম,,

“পাগল। আপনি সত্যিই একটা পাগল।”

আহনাফ আচমকা আমার গলায় মুখ ডুবিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে বললেন,,

“তোমার প্রেমেই তো পাগল!”

মুচকি হেসে আমি পরম আবেশে চোখ জোড়া বুজে বললাম,,

“তবে শুনে রাখুন মিঃ চাশমিশ আহনাফ! এই প্রভা ও আপনার প্রেমে পাগল!”

#সমাপ্ত

(গল্পটা এতো জলদি শেষ করার ইচ্ছে ছিলো না আমার। তবে একদিন আগে অপ্রত্যাশিত ভাবেই আমার ইনকোর্স এবং টেস্ট এক্সামের রুটিন পাবলিশ হয়। ২৪ তারিখ থেকে এই মাসের শেষার্ধ জুড়েই আমার এক্সাম চলবে। আপাতত পড়ালেখাটাকে প্রাধান্য দিতে চাইছি। দীর্ঘ দেড় বছরের অধিক সময় ধরে পড়ালেখা কি প্রায় ভুলতে বসেছি। তাই অনেকটা সময় নিয়ে পরীক্ষার প্রিপারেশান নিতে হবে। বাধ্য হয়েই আজকের পর্বে গল্পের ইতি টানতে হলো। জানি, সমাপ্তি ভালো হয় নি। অনেক অগোছালো ছিলো। যাই হোক, ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। যারা এতোটা দিন ধরে গল্পটার পাশে ছিলেন তাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং ভালোবাসা। ভালো থাকবেন সবাই। আসসালামু আলাইকুম।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here