#তোমাতেই_রহিব_বিলীন
#পর্ব_১১
#নিশাত_জাহান_নিশি
মুহূর্তের মধ্যে আহনাফকে ছেড়ে আমি এক দৌঁড়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আহনাফের গাড়িতে উঠে বসলাম। ভেতরটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আমার। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে। শুধু ভালো লাগা থেকেই কি উনার জন্য এতোটা অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে আমার? নাকি এই কয়েকদিনে উনার প্রতি সত্যিই কোনো ভালোবাসা জন্ম নিয়েছিলো আমার?
সেই অজানা প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে খুঁজতে দীর্ঘ দেড় বছর কেটে গেলো মাঝখানে! অনার্স ৪র্থ বর্ষে পা দিয়েছি সবেমাএ৷ বিয়েটা ঐ দিন ভেঙ্গে গেলে ও বিয়ে ভাঙ্গার সম্পূর্ণ দায়ভারটা এখনো আমার উপরেই বর্তাচ্ছে! ঐদিন আহনাফ সব বিচ্ছিন্ন করে, প্রতিটা সম্পর্ককে ছেড়ে ছুড়ে চলে গিয়েছিলেন ঠিকই তবে উনার এই ছেড়ে যাওয়ার পিছনে সব’চে কঠিন আঘাতটা পেয়েছিলাম আমি! দুনিয়ার সমস্ত রকমারী আয়োজন ফিকে লাগছিলো তখন। মনে হচ্ছিলো যেনো হাজার হাজার বছরের জন্য পৃথিবীটা থমকে গিয়েছিলো শুধুমাএ আমার জন্য। মনের কোণে জমে উঠা সুপ্ত অনুভূতিরা ও তখন নিজেদের প্রকাশ করতে না পারার তীব্র যন্ত্রণায় নির্বিকার, নির্লিপ্ত, নির্জীব হয়ে পড়েছিলো। নিজেকে হারিয়ে বসতে বসতে এখন একাকিত্বে নিজেকে বড্ড প্রিয় লাগছে। নিকষ কালো অন্ধকারটা এখন শ্বাস নেওয়ার উপযুক্ত মাধ্যম বলে মনে হচ্ছে। আলো, রোশনাই এসব আমার এখন একদমই সয় না! কেমন যেনো দম বন্ধ লাগে! শ্বাস নিতে দারুন কষ্টে ভুগতে হয়। তাই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম সবকিছু থেকে। ভালো থাকার জন্য অন্ধকার জগতটাকেই বেছে নিয়েছিলাম। পরিবার, পরিজন, সমাজ, আত্নীয়-স্বজন সবার থেকে অনেকটা দূরেই এখন আমার বসবাস!
ঐদিন আহনাফকে এক তরফা দোষারোপ করতে পারি নি আমি! কেনো জানি না হয়ে উঠে নি আমার দ্বারা৷ বিবেকে বাঁধছিলো, দম ফাঁটা আতর্নাদ আসছিলো, অনুভূতিরা আত্নাহুতি দিচ্ছিলো, ভিতরটা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে আসার পূর্বেই আমি দুই পরিবারের সবার সামনে দাঁড়িয়ে বুকে অজস্র দম নিয়ে বলেছিলাম,,
“বিয়েটাতে আমি প্রথম থেকেই রাজি ছিলাম না, আহনাফকে আমার কোনো দিক থেকেই পছন্দ নয়। উনার স্বভাব, চরিএ, ব্যবহার, আচরন ও আমার অতোটা পছন্দ নয়। গোটা একটা জীবন উনার মতো একজন বদরাগী ছেলের সঙ্গে কাটানো আমার পক্ষে আদৌ সম্ভবপর নয়। আর যখন আহনাফ কোনো ভাবে এই বিষয় গুলো জানতে পারেন তখনই উনি ডিসিশান নেন দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার। মূলত আমার সুখের জন্যই উনি বাধ্য হয়েছিলেন দেশ ছাড়তে। আসলে উনি আমার মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আমায় বিয়েটা করতে চান নি। বিয়েটা তো সারা জীবনের প্রশ্ন তাই! এই প্রথম উনি ভালো মন মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। আমার ফ্রিডমনেস আমায় ষোল আনায় বুঝিয়ে দিয়ে ভালো একজন মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়েছেন! আমাকে মুক্ত করে গেছেন। সারাজীবনের জন্য মুক্ত হয়ে গেছি আমি। উনার এই চলে যাওয়াতে আমি ভীষণ খুশি। ভীষন ভীষন ভীষন খুশি।”
বুকে পাথর চাঁপা দিয়ে যদি ও অর্ণগল কথা গুলো বলেছিলাম, তবে ভেতরের প্রতিটা অঙ্গ প্রতঙ্গ জানে ঠিক কতোটা ক্ষতি হয়েছিলো ভেতরে। নিংড়ে আসছিলো সম্পূর্ণ ভেতরটা। ব্যাথায় ছটফট করছিলাম, তবে কেউ ভেতরটা দেখে নি আমার। না কেউ বুঝতে পেরেছিলো কতোটা বেদনায় আমি কাতরাচ্ছিলাম। আমার প্রতিটা কথার বিপরীতে আপুর হাতে পাঁচ পাঁচটে চড় খেয়েছিলাম ঐদিন। নেহাল ভাই অনেক বার চেষ্টা করেছিলেন সত্যিটা বলতে। তবে প্রতিবারই আমি উনাকে থামিয়ে দিয়েছিলাম। যদি ও নেহাল ভাই আপুকে একবার বলেছিলেন, “আহনাফ নিজ থেকেই কানাডায় ব্যাক করার ডিসিশান নিয়েছিলেন, ওখানে আহনাফের গার্লফ্রেন্ড আছে।” তাও আপু নেহাল ভাইয়ের কথা কানে তুলতে চান নি। কারণ, আপু জানতেন প্রথম থেকেই আমার এই বিয়েতে মত ছিলো না। নানাভাবে আমি আহনাফের বিরুদ্ধে আপুর কান ভাঙ্গিয়েছিলাম। সেই জের ধরেই আপু ধরে নিয়েছিলেন সম্পূর্ণটা আমার কারসাজি। আমার কারণেই আহনাফ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন!
দু পরিবারের সবাই খুব ভেঙ্গে পড়েছিলেন ঐদিন। ইয়ানাত আঙ্কেল আমার আচরণে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। প্রেশার ফল করেছিলো ঐ দিন উনার। আব্বু লজ্জায় মাথা নিচু করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সবটা আমার চোখের সামনেই ঘটছিলো। আহত দৃষ্টিতে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটা পর্যবেক্ষণ করছিলাম। আপুর শ্বশুড় বাড়ির প্রতিটা লোক আমাকে ছিঃ চিৎকার করেছিলেন। হৃদি আপু, শ্যামা আপু, শশী আপু, নেহাল ভাইয়ের আম্মু, আপুর ফুফু শ্বাশুড়ী যতো রিলেটিভস আছে সবাই আমাকে হেয় করছিলেন! গোটা সমাজের কাছে আমার পরিবার এবং আহনাফের পরিবার হাসির পাত্র হয়েছিলেন। দু মহল্লাতেই জানাজানি হয়ে গিয়েছিলো আমাদের বিয়ের খবরটা। যখন বিয়েটা ভেঙ্গে যায়, তখন তো পাড়া, মহল্লায় নানা ধরনের কুৎসা রটবেই। দুটো পরিবারকে হেনস্তা হতে হবেই। আব্বু হঠাৎই আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন। আম্মু কথায় কথায় রাগ দেখাতেন, মাঝে মাঝে গাঁয়ে ও হাত তুলতেন। বাড়ি থেকে বেরুলেই পাড়ার লোকজনদের কড়া সমালোচনা সম্মুখীন হতে হতো। এর মধ্যেই আবার নেহাল ভাইয়ের হুটহাট কল করা। রাত বিরাতে দেখা করতে চাওয়া, কথা বলতে চাওয়া ভীষণ বিরক্তিকর ঠেঁকছিলো আমার। নিতে পারছিলাম না এতোসব যন্ত্রণা একসাথে। মানসিক চাঁপে অত্যধিকভাবে জর্জরিত হয়ে পড়ছিলাম। অবস্থা মৃত্যুসম ছিলো! নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে বাধ্য হয়ে সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে আমি কলেজ হোস্টেলে উঠি। পরিবার, আত্নীয়-স্বজন, সমাজ সবার দৃষ্টির অগোচড়ে চলে আসি। তিস্তার সাথে হোস্টেলে পার্মানেন্ট হয়ে যাই!
পড়ালেখার খরচ যদি ও আব্বু বহন করছেন, তবে আমার সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলা, যোগাযোগ করা উনি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আম্মুর সাথে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়। যদি ও কলটা আমার তরফ থেকেই যায়! বিনা প্রয়োজনে আম্মু কল করেন না। মেয়ে যে তাদের সম্মান রাখতে পারেন নি, কোন খাতিরে উনারা আমার সাথে কথা বলবেন? আমার খোঁজ খবর রাখবেন? জিজু মাঝে মধ্যে হোস্টেলে আসেন। আমার সাথে দেখা করে যান। যাওয়ার সময় বিভিন্ন গিফটস, নাশতা, চকলেট, আইসক্রীম দিয়ে যান। জিজুর আসা যাওয়ার ব্যাপারে অবশ্য আপু কিছু জানেন না। যদি জানেন, তাহলে হয়তো জিজুর সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিবেন!
নেহাল ভাই ৬ মাস পূর্বে কানাডা ব্যাক করেছেন! প্রায় দুবার উনি আমাকে বিয়ের প্রপোজাল দিয়েছিলেন। প্রতিবারই আমি উনাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। কোনো কারণ জানাই নি। শুধু বলেছিলাম, “এখনি বিয়ে করতে চাইছি না।” প্রতিবার ব্যর্থ হয়ে উনি বিষন্ন মনে পিছু ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে আক্রমনাত্নক কোনো মনোভাব উনার মধ্যে দেখি নি। কানাডা ব্যাক করার পূর্বে একদিন দেখা করেছিলাম নেহাল ভাইয়ের সাথে। জানতে চেয়েছিলাম, “আহনাফ কেমন আছে? বিয়ে করে স্যাটেল্ড হয়ে গিয়েছেন তো?” নেহাল ভাই কেবল রহস্যময় হাসি হেসেছিলেন৷ প্রতিত্তুরে কিছু বলেন নি! আমি ও জানার আগ্রহ প্রকাশ করি নি। হয়তো উনার প্রতিত্তুরে ভীষণ আঘাত পেতে হবে! জেঁচে কে আঘাত চায় বলুন?
,
,
আজ বিকেলটা একটু অন্যরকম। অন্যদিনের মতো অতোটা স্বাভাবিক নয়। কারণ আমার সামনেই আপু এবং আব্বু বসে আছেন। দুজনই গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে আমার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। চোখ তুলে উনাদের দিকে তাকানোর সাহসটা পর্যন্ত কুলোতে পারছিলাম না আমি। তাই মাথা নিচু করে থাকাটাই আপাতত শ্রেয় মনে করছি। আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আব্বু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,,
“বাড়ি ফিরবে না তুমি? এই ভাঙ্গা চূড়া ছোট্ট খোঁপড়ীর মতো রুমটাকেই নিজের বাসস্থান হিসেবে ধরে নিয়েছ?”
মাথা তুলে আব্বুর তুলে তাকালাম। স্থির দৃষ্টিতে আব্বুর দিকে চেয়ে বললাম,,
“কোথায় যাবো? আমার কি আদৌ কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা আছে?”
“বাড়ি ফিরে চলো। দেড় বছর অনেক হয়েছে। আমি এবং পল্লবী তোমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে এসেছি!”
পল্লবী আপু ও এবার আব্বুর সঙ্গে সুর মিলেয়ে তটস্থ কন্ঠে বললেন,,
“বাড়ি ফিরে চল। অনেক হয়েছে মান অভিমান। সবাইকে ছেড়ে নিজেকে এভাবে গুটিয়ে রাখার কোনো মানেই হয় না।”
“একা থাকতেই স্বস্তি বোধ হচ্ছিলো। তবে তোমরা এসেছ, হয়তো ফিরিয়ে দিতে পারব না!”
“সামনের সপ্তাহে হৃদির বিয়ে। শ্বশুড় আব্বু তোকে হৃদির বিয়েতে দেখতে চাইছেন।”
কেনো জানি না মনটা আনচান করে উঠল। অজানা কোনো সম্ভাবনায় অন্তঃকরনের আশপাশটা দ্রুত গতিতে কাঁপতে আরম্ভ করল। কৌতুহল বশত জানতে ইচ্ছে হলো,
“আহনাফ কি আসবেন বিয়েতে?”
মনের সব কথাকে প্রশ্রয় দিতে হবে কেনো? মন যা বলবে তাতেই কেনো সায় দিতে হবে? চুপচাপ আমি আপুর কথা মেনে নিয়ে আপুকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,
“বাড়ি ফিরে গেলে তোমাদের আবার মান সম্মান খোঁয়া যাবে না তো?”
মুহূর্তের মধ্যে আপু নাক, মুখ কুঁচকে আমার মাথায় গাড্ডা মেরে বললেন,,
“খুব বড় বড় কথা শিখে গেছিস তাই না? ভুল তো করবি করবিই আবার গলা উঁচিয়ে কথা ও বলবি? ঐ দিনের পর থেকে আহনাফের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই আমাদের। আহনাফ কথাই বলতে চাইছে না আমাদের সাথে। ভেবে দেখ, ছেলেটা কতো কষ্ট পেয়েছে!”
নিশ্চুপ থেকে আমি ব্যাগপএ গুছিয়ে আব্বু এবং আপুর সাথে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। হোস্টেল ম্যানেজারকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আব্বু আমায় নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। তিস্তার জন্য মনটা খুব খারাপ করছিলো। আর একসাথে থাকা হবে না হয়তো! সুখ, দুঃখের বন্টনটা ও স্থগিত হয়ে যাবে বোধ হয়।
,
,
হৃদি আপুর বিয়ের ঠিক তিন দিন পূর্বেই আমরা নেহাল ভাইদের বাড়িতে এসে শিফট হলাম। আপুর শ্বশুড় বাড়ির সব আত্নীয়, স্বজন নেহাল ভাইদের বাড়িতে বিয়ের চারদিন আগেই উঠে গেছেন। বিয়ে বাড়ি খুব জমজমাট৷ আত্নীয়-স্বজনদের রোল পড়ে গেছে। সবাই আমাকে হেয় চোখে দেখলে ও নেহাল ভাইয়ের আম্মু এবং হৃদি আপু আমায় ভীষণ আগলে রেখেছেন। ইয়ানাত আঙ্কেল সব ভুলে আমাকে আপন করে নিয়েছেন। আগে যেমনটা ভালোবাসতেন এখনো ঠিক তেমনটাই ভালোবাসছেন।
নেহাল ভাইদের বাড়িতে আসার পর থেকে ভীষণ চুপচাপ থাকার চেষ্টা করছি। কোনো কিছুতেই শান্তি খুঁজে পাচ্ছি না আমি। খুব নিরাগ নিরাগ লাগছে। সারাক্ষণ রুমে বন্ধী হয়ে থাকছি। কেনো জানি না, লোকজনদের সাথে মিশতে এখন একদমই ভালো লাগে না। কথাবার্তা, হাসাহাসি সবকিছুই এখন বড্ড বিরক্তির ঠেঁকে। শব্দ দূষণ মনে হয়! রুমে নিসঙ্গ বসে থাকতে ও আজ কেনো জানি না ভীষণ অস্বস্তিকর ঠেঁকছে। অতঃপর দম বন্ধকর পরিস্থিতি এড়াতেই আমি বিকেলের দিকে ছাঁদে উঠে এলাম। ছাঁদের প্রতিটা আনাচে কানাচে বিভিন্ন বাগান বিলাসের সমারোহ। গাঁদা, গোলাপ, ডালিয়া, শিউলি, ফুলের ঘ্রাণের পুরো ছাঁদটা ম ম করছিলো৷ কমলা রঙ্গের সূর্যটা ও পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। একটু পরেই বুঝি সন্ধ্যা নেমে আসবে। বিস্তীর্ণ লালচে আকাশটা আজ নীলে নীলে ছেঁয়ে আছে। চোখ ফেরানোই দায় হয়ে পড়েছে। প্রকৃতির এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে করতে ছাঁদের ডান পাশে থাকা দোলনাটায় চড়ে বসলাম। সাথে সাথেই দমকা হাওয়া এসে দেহ, মনকে বেসামাল ভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছিলো৷ দুপাশে ঝুলে থাকা খোলা চুল গুলো ও বাতাসে দোল খেতে আরম্ভ করল।
ছাঁদের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় ড্রইং রুম থেকে শুনছিলাম, নেহাল ভাই আসবেন। এয়ারপোর্টে আছেন। একটু পরেই হয়তো বাড়ি এসে পৌঁছাবেন। তবে কারো মুখে আহনাফের কথাটা একবার ও শুনি নি! কেউ উনার নামটা পর্যন্ত উচ্চারণ করছেন না। তবে কি উনি আসবেন না? আমি যে চোখে এক সাগর তৃষ্ণা নিয়ে উনাকে এক পলক দেখার জন্যই বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলাম তা কি উনি কখনো বুঝবেন না? উনাকে একটু ছোঁয়ার আশায় যে চাঁতক পাখির মতো তাড়পাচ্ছি তা কি উনি আদৌ বুঝবেন না? উনাকে ঘিরে আমার মনে যে তীব্র প্রখর অনুভূতি গুলো বাসা বেঁধেছে সে বাসার পাকাপোক্ত একটা নীড় হয়ে কি উনি ফিরে আসবেন না? নাকি তনিমাকে বিয়ে করে উনি কানাডাতেই স্যাটেল্ড হয়ে গেছেন? সত্যিই কি উনি তনিমাকে ভালোবাসতেন? নেহাল ভাই ঐ দিন কেনো কিছু বললেন না? কেনো মৌণ থেকেই কানাডা ফিরে গেলেন? ইদানিং তো দেখছি নেহাল ভাই ও আমায় কল করছেন না। কেউ আহনাফ সম্পর্কে আমায় কোনো খবর ই দিচ্ছেন না। কি চলছে তবে আমার অগোচড়ে?
এসব ভাবনা চিন্তার মাঝেই ছাঁদে দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি টের পেলাম। কারো ধপাধপ পায়ের শব্দ আমার কর্ণকুহরে খুব কঠিন ভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আগ্রহ নিয়ে পিছু ফিরে তাকাতেই হাসোজ্জল মুখে নেহাল ভাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। কোঁমড়ে দুহাত গুজে নেহাল ভাই কুঁজো ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে অনবরত দম নিচ্ছেন আর হাঁফিয়ে উঠা কন্ঠে বলছেন,,
“হেই? তুমি এখানে কি করছ?”
বিস্মিত ভঙ্গিতে দোলনা থেকে উঠে দাঁড়ালাম আমি। এক ছুটে নেহাল ভাইয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি অস্থির কন্ঠে উনাকে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে বললাম,,
“আহনাফ আসেন নি?”
“আহনাফের জন্য ওয়েট করছিলে?”
“বলুন না? আহনাফ আসেন নি?”
“আহনাফ তো আসে নি!”
তব্ধ শ্বাস ছেড়ে আমি মাথা নিচু করে পুনরায় দোলনায় গিয়ে বসলাম। এই মুহূর্তে আমি অনুভূতি শূন্য। বেহায়া মনকে বুঝাচ্ছিলাম, “এতো আশা করিস কেনো?” আশা ছাড়তে পারিস না? যে তোর না, তাকে নিয়ে এতো ভাবিস কেনো? আত্নসম্মানবোধ নেই তোর? তোর ও কি অবস্থান ঐ অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মতো? ক্লান্ত হতে পারিস না তুই? একটু তো ক্ষান্ত হতে পারিস। বিশ্রাম তো তোর ও প্রয়োজন তাই না? আশা ছেড়ে দে প্লিজ। তবেই ভালো থাকতে পারবি!
চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়াতেই মনে হলো সেই চির কাঙ্ক্ষিত চেনাকন্ঠি স্বরটা আমার কর্ণকুহরে খুব মধুরভাবে প্রতিধ্বনিত হলো। দম ফাঁটা শ্বাস ছেড়ে আমি পিছু ফিরে তাকাতেই তব্দিত ভঙ্গিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আহনাফ স্বয়ং আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। তবে উনি আমার দিকে নয় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ব্ল্যাক টপস পরিহিতা সুন্দুরী মেয়ের দিকে তাকিয়ে খুব হেসে হেসে কথা বলছেন। মেয়েটা মৃদ্যু হেসে আহনাফের হাতে হাত রেখে বলছেন,,
“রিয়েলি ইয়ার৷ নেহালদের বাড়ির ছাঁদটা সত্যিই নজর কাড়ার মতোন।”
“ইয়েস। তাই তো ফার্স্টেই তোকে ছাঁদে নিয়ে এলাম।”
নেহাল ভাই আমার পাশ থেকে সরে এসে অট্ট হেসে আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,
“হেই আহনাফ? একটু এদিকে ও তাকা। ছাঁদে কিন্তু একটা ফুটন্ত গোলাপ ও দাঁড়িয়ে আছে। তোর অপেক্ষায় মুর্ছে যাচ্ছে যে। কেয়া ইয়ার? কৃপা করে একটু নজর তো দে!”
আহনাফ হাসি থামিয়ে নেহাল ভাইয়ের দিকে নজর দিতেই সেই নজরটা দুর্ভাগ্যবশত তিন ফুট দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আমার উপর পড়ল। আহনাফের স্থির দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আমার চোখ দুটো বেসামাল হয়ে পড়ল। দৃষ্টি জোড়া সংকুচিত করে আমি তড়িৎ গতিতে মাথা নিচু করে নিলাম। বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো সবেমাএ শান্তির দেখা পেলো। বিষাদের সুর গুলো অনুরাগে মধুর রাগিনী তুলছিলো। মনে হলো থমকে থাকা পৃথিবীটা যেনো মুহূর্তের মধ্যে নতুন উদ্দমে আবারো পুর্নজীবিত হলো। এই বুঝি খুশিতে হতবিহ্বল হয়ে আমি দম আটকে মরেই যাবো! বাঁচার আশা সত্যিই দুরাশা হয়ে পড়েছে!
অচেনা মেয়েটাকে আহনাফের সাথে দেখে বিন্দু পরিমান খারাপ লাগা কাজ করছে না আমার। শুধু এই ভেবেই শান্তি লাগছে যে, উনাকে তো একটা পলকের জন্য দেখত পেলাম! এই বা আমার জন্য কম কিসের?
ইতোমধ্যেই চারদিকে মাগরিবের আযান পড়তে আরম্ভ করল। নেহাল ভাই এবং ঐ মেয়েটার ফিসফিসানির আওয়াজ আমার কানে মিহি ভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো। ফিসফিসিয়ে উনারা কিছু বলছিলেন। এর মধ্যে হুট করেই মেয়েটা অনর্গল কন্ঠে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,,
“হেই প্রভা। তোমাকেই তো এতোক্ষণ খুঁজছিলাম!”
উদ্বেলিত দৃষ্টিতে আমি সামনে ফিরে তাকাতেই খেয়াল করলাম আহনাফ হাত দিয়ে দুজনকে ইশারা করে বলছেন ছাঁদ থেকে নামতে। নেহাল ভাই মেয়েটার মুখ চেঁপে ধরে জোর করে মেয়েটাকে টানতে টানতে ছাঁদ থেকে প্রস্থান নিচ্ছেন। মেয়েটা ও নাছোড়বান্দা। কিছুতেই যেনো ছাদ থেকে নামতে চাইছেন না! নেহাল ভাইয়ের সাথে অবিরত ফাইটিং করে চলছেন। মুখ ফুটে কিছু বলার জন্য ছটফট করছেন।
নেহাল ভাই এবং মেয়েটা ছাঁদ থেকে নিশ্চিহ্ন হতেই আহনাফ প্যান্টের পকেটে দুহাত গুজে ভীষন গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে এক পা দু পা করে আমার দিকে এগিয়ে আসতে আরম্ভ করলেন। ঠোঁটের আলিজে উনার এক প্রকার দুষ্টু হাসি লেগে আছে। প্রকান্ড চোখে আমি শুকনো ঢোক গিলে কুন্ঠা, উদ্বিগ্নতা এবং জড়তা নিয়ে পেছনে হটতে লাগলাম। দোলনার সাথে এডজাস্ট হয়ে দাঁড়াতেই আমার অন্তর্আত্তা কেঁপে উঠল। এবার কোন দিকে যাবো আমি? ওয়ে খুঁজে পাচ্ছিলাম না পালানোর! ঐদিকে আহনাফ আমার থেকে মাএ এক ফুট দূরত্বে অবস্থান করছেন। চোখের পলকেই হয়তো এক ফুট দূরত্বটা ও এখন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কপালে কয়েক দফা ভাঁজ ফুটিয়ে আমি আহনাফের ঐ নেশাক্ত দু চোখে তাকিয়ে কম্পিত কন্ঠে বললাম,,
“সামনে থেকে সরুন। এভাবে এগিয়ে আসছেন কেনো?”
মুহূর্তের মধ্যেই আহনাফ সমস্ত দূরত্ব নিশ্চিহ্ন করে আমার গাঁয়ের সাথে একদম চিপকে দাঁড়িয়ে আমার মুখে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে ফিসফিসে কন্ঠে বললেন,,
“আহনাফ শেখকে কতোটা ভয় পাও দেখছিলাম! আশ্চর্যের বিষয় কি জানো? ভয় পাওয়া চেইক করতে গিয়ে অজান্তেই তোমার বুকের হার্টবিটের আওয়াজ শুনতে পেলাম! আচ্ছা? আওয়াজটা কি আদৌ ভয় থেকে? নাকি অন্য কোনো রিজন আছে?”
দম নিলেন উনি। মুখ থেকে নির্গত হওয়া উনার প্রতিটা তপ্ত শ্বাস আমার শরীরের প্রতিটা শিরা উপশিরায় অদ্ভুত এক মন মাতানো শিহরণ জাগিয়ে তুলছিলো। মন কাননে বাহারী রঙ্গের সব প্রজাপতিরা পাখা ঝাঁড়ছিলো নিঃসংকোচে। এক ঝাঁক জোনাকীর আলোয় বোধ হয় তমসা এবং বিষাদের নীল রঙ্গে ঢাকা মনের শহরটা মিটমিটে আলোর দিশা খুঁজে পাচ্ছিলো। বাতাসে বাহারী ফুলের চাঁপা ঘ্রাণ ভেসে আসছিলো। পুষ্প কাননে সদ্য ফোঁটা ফুলের কুঁড়িরা কানে কানে যেনো বলছিলো,,
“বসন্ত এসে গেছে!”
সমস্ত অনুভূতিকে মনের গুপ্ত কোটরে তালাবন্ধি করে আমি অকপট রেগে আহনাফের দিকে তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,
“নাটক করতে এসেছেন? দেড় বছরে ও নাটক শেষ হয় নি?”
আচমকা আহনাফ বাঁকা হেসে হেয়ালী কন্ঠে বললেন,,
“নাটকের লাস্ট মোমেন্টে দাঁড়িয়ে আছি। নাটকের মূল চরিএ, “তনিমা ও এসে গেছে!”
“মানে? ঐ মেয়েটা তনিমা ছিলো?”
“উহু। তনিমা নয়। তনিমা ভাবী হবে!”
কন্ঠ জড়িয়ে আসছিলো আমার। অজানা এক ভয়ে শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসার পূর্বেই আমি টাল মাটাল কন্ঠে আহনাফকে বললাম,,
“ভাভাভাবী?”
আহনাফ চশমার ফ্রেমটা উপরের দিকে টেনে বাঁকা হেসে বললেন,,
“আলবাত ভাবী! উডবি ভাবী!”
“কাকাকার উডবি?”
আহনাফ রহস্যময়ী হাসি টেনে বললেন,,
“এখনি বলতে পারছি না কিছু। হ্যাঁ, তবে সময় হলে সবটাই চোখের সামনে দেখবে।”
আযানের মধুর ধ্বনিতে চারপাশটা মুখরিত হচ্ছিলো ঠিকই, তবে আমার মনে বাজছিলো বেদনার সুর। খুব তিতা, তিক্ত এই সুর। কোনো ব্যক্তিই চাইবে না স্ব-ইচ্ছায় সেই বেদনার সুরকে আপন করে নেওয়ার। বিশ্বাস করুন, আমি চেষ্টা করছিলাম কান্না চেঁপে রেখে যথেষ্ট স্বাভাবিক থাকতে। তবে কন্ঠনালী থেকে হু হু করে শব্দে বিষাদের সুর নির্গত হচ্ছিলো খুব মর্মান্তিকভাবে। জানি না, আমার সামনের মানুষটা সেই নিরাগের সুর শুনতে পাচ্ছিলেন কিনা। আদৌ আমার দিকে উনার ধ্যান আছে কিনা। ইতোমধ্যেই মনে হলো কেউ আমার উড়নায় হাত দিয়েছেন। উড়নায় সামান্য টান অনুভব করছিলাম। অশ্রুসিক্ত চোখে আমি অগ্রে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই অবলোকন করতে পারলাম, আহনাফ ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসি ফুটিয়ে আমার মাথায় ঘোমটা টেনে দিচ্ছেন। সম্পূর্ণ ঘোমটটা আমার মাথায় টেনে দিয়ে আহনাফ মুগ্ধ নয়নে আমার দুচোখে চেয়ে বললেন,,
“কি দরকার ছিলো ঐ দিন আমাকে সেইফ করার? সমস্ত দোষ নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার? খুব মহান হতে চাইছিলে? আমাকে তোমার বিবেকের কাছে ছোট করে?”
#তোমাতেই_রহিব_বিলীন
#পর্ব_১২
#নিশাত_জাহান_নিশি
“কি দরকার ছিলো ঐ দিন আমাকে সেইফ করার? সমস্ত দোষ নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার? খুব মহান হতে চাইছিলে? আমাকে তোমার বিবেকের কাছে ছোট করে?”
নিষ্ক্রিয় দৃষ্টিতে অল্প সময় আমি আহনাফকে পর্যবেক্ষন করছিলাম৷ প্রেমময় দৃষ্টিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উনাকে অবলোকন করছিলাম। কি অদ্ভুত সুন্দর লাগে লোকটাকে, যখন লোকটা প্রেমময়ী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়! চোখে উনার অজস্র ভালোবাসার রংধনু ফুটে উঠছিলো খুব গাঢ় ভাবে। বিপরীত পাশের লোকটার প্রতি যদি আপনার তীব্র ভালোবাসা কাজ করে, তবেই আপনি তার চোখে ভালোবাসার সাত রং উপলব্ধি করতে পারবেন। লোকটা মুখ ফুটে কিছু প্রকাশ না করলে ও আমি বেশ বুঝতে পারছি, চোখে উনার তীব্র প্রেমের আবেদন। তবে আমি যে চাই, উনি মনের কথাটা চিবুক দ্বারা প্রকাশ করুক। অনুভূতি মিশ্রিত কয়েক গুচ্ছ শব্দযুগলে আমায় প্রেম নিবেদন করুক!
আপাতত ভাবনা চিন্তা গুলোকে দমিয়ে রেখে আমি তব্ধ কন্ঠে নিষ্পলক দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে চেয়ে বললাম,,
“ঐ দিন তো মহান আপনি ও সেজেছিলেন। আমার সামান্য সুখ, শান্তির জন্য আমাকে ছেড়ে অনেক ক্রোশ দূরে হারিয়ে গিয়েছিলেন! আপনার চলে যাওয়াতে আমি মোটে ও কষ্ট পাই নি আহনাফ। বিলিভ মি, আমি খুব হ্যাপি। আপনাকে ছাড়া আমি ভালোই আছি!”
আমার পুরো আপাদমস্তকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আহনাফ পরিশেষে আমার মুখের আদলে অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আহত কন্ঠে বললেন,,
“কতোটা ভালো আছো, তা তো শুকনো মুখের আদল দেখেই বুঝা যাচ্ছে। আমায় ছেড়ে তুমি মোটে ও ভালো ছিলে না প্রভা। সেই বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই!”
অট্ট হাসলাম আমি। দু সেকেন্ডের মাথায় হাসি থামিয়ে বিদ্রুপসূচক কন্ঠে বললাম,,
“কে রাখে কার খোঁজ? আপনার শহরে তো আমি নিঁখোজ প্রায়। শুকিয়ে যাওয়া কিছু ক্ষত আপনার হাস্যকর কথায় পুনরায় তরতাজা হয়ে উঠছে। কেনো এলেন আবার বলুন তো? জখম তাজা করতে? কিছু কিছু মানুষ এমন হয় জানেন? অপর পাশের মানুষকে আঁচড়ে ক্ষত বিক্ষত করার পরে ও সেই ক্ষতটায় মলম লাগাবে না মোটে ও। তবে ক্ষতটা যখন তার পাওয়া অযত্নে প্রখর যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে শুকিয়ে কাঠ হয়ে উঠবে। ঠিক তখনই আবার সেই ব্যক্তিটা কাঠ হয়ে যাওয়া ক্ষতটায় অগ্নিশিখা জ্বালাতে একদম সাইক্লোনের বেগে ছুটে আসবে। আপনি ও তাদের কাতারে পড়ছেন! মনের কথা বুঝতেই চাইবেন না।”
আহনাফ স্তম্ভিত ভঙ্গিতে কিছু সময় মৌণ রইলেন। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার থেকে দৃষ্টি ফেরাতে বাধ্য হলেন। প্যান্টের পকেটে দু হাত গুজে আহনাফ আমার সম্মুখ থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে মিহি কন্ঠে আধো অন্ধকার আকাশের দিকে চেয়ে বললেন,,
“কিছু সত্যি এমন হয় জানো প্রভা? যার সম্মুখীন হতে অধিক ধৈর্য্যের প্রয়োজন হয়। দেহ থেকে প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেলে ও হয়তো অতোটা কষ্ট হবে না যতোটা কষ্ট তুমি তোমার খুব কাছের বা প্রিয় মানুষ থেকে পাবে! আর সেই প্রিয় মানুষটা যদি তোমার রক্তের সম্পর্কের কেউ হয়, তবে তো আর কোনো কথাই নেই! ফ্রি তে তুমি নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার সার্টিফিকেট পেয়ে যাবে। তখন মনে হবে, ছেড়ে চলে যাচ্ছিনা কেনো এই সবকিছু? কি হবে এই ঠুনকো সম্পর্কের টান রেখে? এর’চে তো নিঃসঙ্গতা ভালো। নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া অত্যধিক শ্রেয়।”
ফুসফুসে দম সঞ্চার করে আহনাফ পিছু ঘুড়ে আহত দৃষ্টিতে আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তব্ধিত শ্বাস নির্গত করে আহনাফ পুনরায় বললেন,,
“এমন কিছুই ঘটেছিলো আমার সাথে। আমার অগোচড়ে সেই প্রিয় মানুষটাই আমার সাথে বেইমানি করছিলো। প্রতিনিয়ত আমাকে ঠকাচ্ছিলো। আমার উইক পয়েন্ট বুঝে আমার সাথেই প্রতারনা করছিলো। বিষ খেয়ে বিষ হজম করার শক্তিটা আর জোগাতে পারছিলাম না সত্যি। যদি ও তাকে কখনো প্রকাশ্যে আনতে চাই নি আমি। তবে এবার মনে হচ্ছে তাকে প্রকাশ্যে আনাটা ভীষণ জরুরী। অন্তত নিজেকে ভালো রাখার জন্য। হারানো সুখকে পুনরায় ফিরে পাওয়ার জন্য! অনেক তো হলো মানিয়ে নেওয়া৷ বিশ্বাস করো, আমি পারছিলাম না। তাকে দূরে রেখে স্বাভাবিকভাবে সবকিছু মানিয়ে নিতে। এই কয়েক বছরে তোমার বুকের ক্ষতটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলে ও আমার বুকে যে ক্ষতটা জমাট বেঁধেছিলো না? তা আজ ও পর্যন্ত শুকোয় নি। রোজ নিয়ম করে একটু একটু করে তাজা হচ্ছিলো। সঠিক যত্নের অভাবে দুরারোগ্য রোগে পরিণত হচ্ছিলো!”
স্মিত দৃষ্টিতে আমি চোখে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে আহনাফের দিকে তাকালাম। নিঁখুতভাবে উনার নেএ যুগল পর্যবেক্ষণ করছিলাম। অজানা সেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। তবে হায়! উনার নেএ যুগল দেখে মনে হচ্ছে না আদৌ সেই প্রশ্নের উত্তর গুলো ঐ রহস্যময়ী দুচোখে খুঁজে পাওয়া যাবে। বৃথা চেষ্টা আমার এখনই ছাড়তে হবে। আমার আঁখি জোড়ায় নির্বিকার সব প্রশ্নের ছড়াছড়ি দেখে আহনাফ মৃদ্যু হাসলেন। দ্রুত গতিতে আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে উনি সন্দিহান কন্ঠে বললেন,,
“কি? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে উঠে পড়ে লেগছ? তবে ছেড়ে দাও এই আশা। আমার রহস্যময়ী এই দুচোখে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে না এই জন্মে!”
ইতোমধ্যেই নীল, সাদা, কমলা রঙ্গের বাহারী আকাশটা ঘোর অমানিশায় ঢেকে গেলো। গোধূলী লগ্ন পেরিয়ে ধরায় জাগতিক নিয়মে সন্ধ্যে নেমে এলো। ছাদ জুড়ে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছিলো খুব মিহিভাবে। পাখিদের কিচির মিচির আওয়াজ যদি ও অনেক পূর্বেই থেমে গেছে। তবে রোড সাইটের যাহবাহনের অসহ্য আওয়াজ ও আসছিলো না কানে। তবে কি কোনো কারণে হঠাৎ করেই যানবহনের চলাচল থেমে গেছে? কি জানি, বুঝতে পারছি না কিছু। তবে নিস্তব্ধ আকাশে চাঁদ উঠি উঠি করছে। এই বুঝি তাঁরা রা ও দল পাঁকিয়ে চাঁদের পাশে তাদের আবির্ভাব ঘটাবে। দমকা হাওয়ায় বাগান বিলাসের প্রতিটা ফুলের মিষ্টি ঘ্রান হুড়মুড়িয়ে ভেসে আসছিলো নাকে। মাতাল করা এই ঘ্রাণ। পরম আবেশে চোখ বুজতে আপনি বাধ্য হবেন। প্রকৃতি বোধ হয় আজ অত্যধিক রোমাঞ্চে ছেঁয়ে আছে।
আমার সম্মুখে যে ব্যক্তিটা দাঁড়িয়ে আছে তার চোখে প্রখর রোমাঞ্চের আবাস পাচ্ছি আমি। প্রেমভরা নেশাক্ত উত্তাল দুচোখে আমি ভালোবাসার অতলে ডুবে যাচ্ছি। নির্ঘাত কিছু ভুল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। প্রেমে ভুল করতে চাই না আমি! তাই এই মুহূর্তে এই রোমাঞ্চকর পরিবেশ থেকে পালিয়ে যাওয়াটা আমার ভীষণ জরুরী। ভাবনা অনুযায়ী মাথা নিচু করে আমি যেই না আহনাফের সম্মুখ থেকে প্রস্থান নিবো অমনি মনে হলো উত্তেজিত দুটো হাত আমার হিম হয়ে আসা ডান হাতটাকে আঁকড়ে ধরল। শ্বাস যেনো পাল্লা দিয়ে ভারী হচ্ছিলো। উনার তপ্ত হাতের স্পর্শে আমার হিম হাতটা মুহূর্তের মধ্যেই তপ্ত হয়ে উঠল। ঘোর উত্তেজনা কাজ করছিলো শরীরের সর্বাঙ্গে। তবে কি আমি ও উনার মতো অত্যধিক রোমাঞ্চে উত্তেজিত হয়ে উঠছি? না। এই ভুলটা এখনি করা যাবে না। কিছুতেই উনাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। উনার উপর যে আমার পাহাড়-সম অভিমান জমা আছে! পাহাড় তো কখনো মাথা নিচু করতে পারে না। চূড়ান্ত কঠিন আর দাম্ভিক সে। খুব সহজ হবে কি? এই কয়েকটা সুন্দর, রোমাঞ্চকর মুহূর্তের জন্য দীর্ঘ দেড় বছরের পাহাড়-সম অভিমানকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে তার সামনে মাথা নত করা? আর, ঐ যে তনিমা মেয়েটা। আহনাফ কি ঐ তনিমাকেই বিয়ে করবেন? এর জন্যই কি উনি মেয়েটাকে নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন? যদি ও প্রশ্নটা অজানা। তবে মন বলছে, আহনাফ হয়তো তনিমাকেই বিয়ে করবেন! দেড় বছরে হয়তো উনাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরী হয়েছিলো। হাহহহহ্! তবে যাই হোক, আহনাফ ভালো থাকুক। যার সাথেই থাকুক, উনি ভালো থাকুক। প্রেমিকা হিসেবে ব্যাস এতটুকুই আমার উপর ওয়ালার কাছে চাওয়া! তবে তনিমা মেয়েটা এখন আমার কাছে “ঘোর আতঙ্ক।” এর সম্মুখীন হওয়া যাবে না মোটেও!
এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যেনো আনমনেই আমার ঠাঁই মিলল আহনাফের বুকের পাজরে! হার্টবিটের অত্যধিক আওয়াজ আমার কর্নকুহরকে অস্থির, অসহ্য, তিক্ত করে তুলছিলো। মনে হচ্ছিলো যেনো কান দুটো এখনই ফেঁটে যাবে। বুকের ছাতি ফেটে রক্তক্ষরণ হবে নির্ঘাত। নিমিষেই চোখ জোড়া বুজে আমি না চাইতে ও আহনাফকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলাম। আমার সায় পাওয়া মাএই আহনাফ শরীরের সমস্ত জোর কাজে লাগিয়ে আমাকে ঝাপটে ধরে করুন আকুতি ভরা কন্ঠে বললেন,,
“ভীষন প্রয়োজন তোমাকে। অন্তত বুকের এই গভীর ক্ষতটা সারানোর জন্য তোমার একটুখানি যত্নের ভীষন প্রয়োজন। আমাকে এই অসহনীয় অবস্থায় রেখে প্লিজ তুমি চলে যেও না এভাবে। আর একটু একাত্ন ভাবে মিশে থাকো আমার মাঝে! প্রেমের আকুতি বুঝতে চেষ্টা করো। এবার ভুল হবে না ঘুনাক্ষরে ও। তোমার অবস্থানটা আজীবন আমার এই সমুদ্রসম উত্তাল বুকেই থাকবে।”
খাঁপ ছাড়া কন্ঠে আমি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললাম,,
“তনিমার কি হবে তবে? তনিমা কি এই দেড় বছরে ও আপনার বুকের ক্ষতটা সারাতে পারেন নি? আমাকেই কেনো এই যত্নের দায়ভার নিতে হবে?”
আচমকা আচমকা শক্ত কন্ঠে বললেন,,
“আঘাতটা তুমিই দিয়েছ। তনিমা নয়। সেই অসহ্য আঘাতটা তোমাকেই সারিয়ে তুলতে হবে! কথা না বাড়িয়ে যতোটা সম্ভব আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখো। যতোটা জড়ালে এই বিশ্ব ভ্রমান্ডের কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না।”
লোকটা কিছুতেই শিকার করবেন না, উনি ঠিক কাকে ভালোবাসেন! খামখেয়ালিপনা রেখেই যাবেন। আমি ও কম যাই না। কোনো রকম যত্নের দায়িত্ব আমি নিতে পারব না। শরীরের সমস্ত জোর খাটিয়ে আমি চেষ্টা করছিলাম আহনাফ থেকে নিজেকে ছাড়ানোর। কিন্তু হায়! আমি যতোই ধস্তাধস্তি করছি, আহনাফ যেনো ততোই আমাকে ঝাপটে ধরছেন। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে, ক্লান্ত শরীর নিয়ে আমি শরীরের সর্ব শক্তি আহনাফের উপর ছেড়ে দিতেই আহনাফ অট্ট হেসে বললেন,,
“সো স্যাড ফর ইউ মিসেস প্রভা! এতো চেষ্টার পরে ও ব্যর্থ হলে। কি দরকার ছিলো বলো? জেঁচে শরীরের এনার্জি লস করার? আহনাফের থেকে তোমার ছুটি মিলবে না এই জন্মে। আহনাফ তোমাকে অন্ততকালের জন্য নিজের করে নিতে এসেছে!”
কপালের ভাঁজে যেনো আমার শত প্রশ্নের আবির্ভাব ঘটল। মাথা উঁচিয়ে আমি প্রশ্নবিদ্ধ দুচোখে আহনাফের শান্ত দুচোখে তাকিয়ে বললাম,,
“মানে কি? মিসেস প্রভা বলছেন কেনো আমায়? আবার বলছেন আমাকে অনন্তকালের জন্য নিজের করে নিতে এসেছেন। তাহলে তনিমা কে? তনিমার কি হবে?”
আহনাফ পুনরায় রহস্যময়ী হাসি হেসে বললেন,,
“তনিমা ও থাকবে। তনিমা ও কারো মিসেস হতে এসেছে!”
পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ার পূর্বেই আহনাফ মুহূর্তের মধ্যে আমাকে ছেড়ে প্যান্টের পকেট থেকে খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে কিছু একটা বের করলেন। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদ্যু হেসে আহনাফ আমার বাঁ হাতটা খপ করে ধরে হাতের ঠিক তর্জনী আঙ্গুলটাতে ঐ দিনের খুলে রাখা সেই রিংটা পুনরায় আঙ্গুলে পড়িয়ে দিলেন। আমি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকাতেই আহনাফ বাঁকা হেসে একটু ঝুঁকে আমার বাঁ হাতটায় দীর্ঘ একটা চুমো এঁকে দিলেন! হতভম্ব, নিশ্চুপ, নির্বিকার, সম্পূর্ণ নির্জীব ভঙ্গিতে আমি দাঁড়িয়ে আছে। আহনাফের দেওয়া প্রথম চুমোটায় আমি আশ্চর্যের চরম সীমায় পৌঁছে গেছি। এই প্রথম আহনাফের ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ আমার শরীর পেলো! এ যেনো এক অন্যরকম প্রেমানুভূতি। শরীরের লোপকূপকে সূঁচালোভাবে জাগিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট। মুহূর্তের মধ্যেই মনে হলো আহনাফ আমার কপালে ও দীর্ঘ শব্দে একটা চুমো এঁকে দিলেন। আমি সম্মোহিত দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকাতেই আহনাফ পুনরায় আমার দুচোখে চুমো এঁকে দিলেন! ভ্রু যুগল উঁচিয়ে আমি মুখশ্রীতে বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে আহনাফকে কিছু বলার পূর্বেই আহনাফ আকস্মিক ভাবে আমার ঠোঁটে ও দীর্ঘ এক চুমো এঁকে দিলেন। চরম আশ্চর্যিত চোখে আমি ঠোঁটে হাত চেঁপে আহনাফের দিকে চেয়ে আছি। শরীরটা ঢকঢক করে কাঁপছে আমার৷ শরীর জুড়ে মিহি ঘামের আবির্ভাব হচ্ছে৷ আহনাফ বুকে দুহাত বেঁধে এক পায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে মাথাটা বাঁ দিকে বাঁকা করে রেখেছেন। দাঁতে দাঁত চেঁপে আমি আহনাফের দিকে তাকাতেই বাঁকা হেসে আহনাফ আমায় পুনরায় ঝাপটে ধরে আদুরে কন্ঠে বললেন,,
“ফিলিং ব্যাটার নাও। কোনো অভিযোগ শুনতে চাইছি না কিন্তু আমি। আমার শতভাগ অধিকার আছে তোমাকে চুমো খাওয়ার।”
“আমাদের এনগেজমেন্টটা কিন্তু ভেঙ্গে গিয়েছিলো আহনাফ৷ তারপরে ও কেনো আপনি এসব চুমো টুমো খেতে গেলেন? কোন অধিকারের কথা বলছেন আপনি হুম? কোন অধিকার? আমার উপর আপনার কিসের এতো অধিকার?”
নিরুত্তর থেকে আহনাফ মুহূর্তের মধ্যে আমায় ছেড়ে মুচকি হেসে আমার দিকে তাকালেন। আমার ডান হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আহনাফ আমার সমগ্র মুখমন্ডলে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমাকে নিয়ে সোজা ছাঁদের দরজার দিকে পা বাড়ালেন। ভ্রু যুগল কুঁচকে আমি জিগ্যাসু কন্ঠে আহনাফকে উদ্দেশ্যে করে বললাম,,
“কোথায় যাচ্ছেন?”
আহনাফ ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললেন,,
“পার্লারে!”
“মানে? আপনার পার্লারে কি কাজ?”
“আমার না! কাজটা তোমার।”
“আমার আবার কি কাজ?”
“তোমার ফেইসের ট্রিটমেন্ট করাতে হবে! অযত্নে, অবহেলায় ফেইসের ১২ টা বাজিয়েছ। আমি আবারো সেই দেড় বছর পূর্বের প্রভাকে দেখতে চাই। যে নিজের ত্বকের খুব যত্ন নিতো, চুলের যত্ন নিতে ও খুব পছন্দ করত। তার ফেইসের সেই জৌলুসতা, আকর্ষণীয়তা, চাকচিক্যতা আমি আবারো দেখতে চাই। আমি জানি, গত দেড় বছরে পার্লারের ধারে কাছে ও যাও নি তুমি। বিমূর্ষ অবস্থায় ছিলে। যেহেতু আহনাফ এবার এসেই পড়েছে তবে এবার তোমার কোনো রূপ অযত্ন আহনাফ হতে দিবে না!”
“হাসালেন। পারবেন? ঘন্টার পর ঘন্টা পার্লারের সামনে দাঁড়িয়ে ওয়েট করতে? সেই অসাধ্য ধৈর্য্য আছে আপনার?”
“ধৈর্য্যটাকে অভ্যেসে পরিণত করতে হবে। কোনো ব্যাপার নাহ্। তুমি চলো!”
ড্রইং রুমে পা রাখতেই ড্রইং রুম ভর্তি বাড়ির সব মেহমানরা এমনকি পরিবারের সবাই আমাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। সবার চোখেই ঘোর কৌতুহল এবং প্রশ্নবোধক চিহ্ন। জিগ্যাসু দৃষ্টিতে আপু আমাদের সম্মুখস্ত হয়ে বললেন,,
“কোথায় যাচ্ছ তোমরা?”
এর মধ্যে কোথা থেকে যেনো জিজু আমাদের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন। আপুকে উপেক্ষা করে জিজু উগ্র কন্ঠে আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,
“দেড় বছর আগে তোদের বিয়েটা ভেঙ্গে গিয়েছিলো আহনাফ। সবার সামনে এভাবে বেহায়ার মতো প্রভার হাত ধরে আছিস কেনো? বুঝতে পারছিস না? বিষয়টা সবার চোখে দৃষ্টিকটু লাগছে!”
আহনাফ প্রচন্ড রেগে জিজুকে উদ্দেশ্য করে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললেন,,
“কারণ আছে, তাই ধরেছি। কিছুদিন পরেই কারনটা বুঝতে পারবে। কে আমাকে কি ভাবল, কে কোন চোখে দেখল আই জাস্ট ডোন্ট কেয়ার। তুমি ও বিষয়টা ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নাও। আর আপাতত আমার সামনে থেকে সরো। আমরা একটা জরুরী কাজে বাইরে যাচ্ছি।”
জিজুর দেওয়া বাঁধাকে প্রত্যাখান করে আহনাফ পরিবারের সবার সামনে আমার হাত ধরে সদর দরজা ক্রস করতেই পেছন থেকে নেহাল ভাই আহনাফকে উদ্দেশ্য করে উচ্চ শব্দে চেঁচিয়ে বললেন,,
“এই আহনাফ দাঁড়া। আমি এবং তনিমা ও তোদের সাথে যাবো!”
আহনাফ এবং আমি পিছু ফিরে তাকালাম। তনিমা মেয়েটার দিকে দৃষ্টিলোকন করতেই আমি খেয়াল করলাম মেয়েটা জিজুর দিকে কেমন যেনো ঘৃনা এবং রাগ মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন। জিজু শুকনো মুখে অস্থির দৃষ্টিতে তনিমার দিকে তাকাতেই আহনাফ অট্ট হেসে জিজুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,
“কি ভাইয়া? চিনতে পারছ তো তনিমাকে?”
জিজু ঘর্মাক্ত মুখমন্ডলে জিহ্বা দ্বারা ঠোঁট যুগল ভিজিয়ে কম্পিত কন্ঠে আহনাফের দিকে চেয়ে বললেন,,
“আআআমি চিনব কিকিকিভাবে? হুহুহু ইজ তনিমা?”
নেহাল ভাই কটমট দৃষ্টিতে জিজুর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললেন,,
“না চেনাই ভালো ভাইয়া। চিনলে তো হাজারটা সমস্যা!”
জিজু আর একটা মুহূর্ত ও ব্যয় করলেন না। ছটফটে ভঙ্গিতে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন। আপু উদ্বেগি কন্ঠে পেছন থেকে জিজুকে ডেকে বললেন,,
“আরিফ। কোথায় যাচ্ছ? আজ তো আমাদের ডক্টরের এপয়ন্টমেন্ট আছে। আমি তো রেডি হয়ে বসে আছি। তুমি যাবে না?”
#চলবে…?
(জানি, কমেন্ট সেকশনে আজ বিদ্রোহের ঝড় উঠবে। সবাই বলবেন, লেখিকা এতো রহস্য রাখে কেনো? অনেকে হয়তো ফালতু ও বলবেন। আসলে গল্পের থিমটা আমি যেভাবে ভেবে রেখেছিলাম, গল্পটা ঠিক সেভাবেই এগুচ্ছে। শেষ পর্যন্ত গল্পটার পাশে থাকার অনুরোধ রইল।)
#চলবে….?