তোমাতে রহিব বিলীন পর্ব ১৩+১৪

#তোমাতেই_রহিব_বিলীন
#পর্ব_১৩
#নিশাত_জাহান_নিশি

“আরিফ। কোথায় যাচ্ছ? আজ তো আমাদের ডক্টরের এপয়ন্টমেন্ট আছে। আমি তো রেডি হয়ে বসে আছি। তুমি যাবে না?”

জিজু দ্রুত বেগে সিঁড়ি টপকে দুতলায় নিজের রুমের দিকে পা বাড়াচ্ছেন আর শঙ্কিত কন্ঠে পেছন থেকে আপুকে উদ্দেশ্য করে বলছেন,,

“এপয়ন্টমেন্ট আজ ক্যান্সেল করে দাও। হৃদির বিয়ের পর এপয়ন্টমেন্ট ফিক্সড করা যাবে!”

“কিন্তু কেনো আরিফ? আজ তো তুমি ফ্রি আছো তাই না?”

জিজু রাগান্বিত কন্ঠে বললেন,,

“শরীরটা খারাপ লাগছে আজ। রেস্ট নিতে হবে। কথা না বাড়িয়ে এক কাপ ব্ল্যাক কফি নিয়ে আমার রুমে এসো।”

জিজুর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আপু তব্ধ শ্বাস ছাড়লেন। অতঃপর মাথা নিচু করে মুখমন্ডলে বিষাদের ছাপ ফুটিয়ে কিচেন রুমের দিকে পা বাড়ালেন। পাশ থেকেই মনে হলো আহনাফ দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন। কপাল কুঁচকে আমি আহনাফের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম আহনাফ আপুর যাওয়ার পথে তাকিয়ে মাএ দীর্ঘশ্বাসটা ছাড়লেন। সন্দিহান কন্ঠে আমি আহনাফের দিকে চেয়ে বললাম,,

“কি হলো? কোনো কারণে আপনি চিন্তিত বা আপসেট?”

আহনাফ প্রসঙ্গ পাল্টাতে ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললেন,,,

“রাত হয়ে যাচ্ছে। আই থিংক উই হেভ টু গো নাও।”

নেহাল ভাই তনিমা আপুর হাত ধরে আমাদের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। হাসি খুশি মেয়েটা মুহূর্তের মধ্যেই কেমন উদাসিনী হয়ে উঠলেন। মাথা নিচু করে তনিমা আপু মুখমন্ডলে নিরাগের ছাপ ফুটিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন। আহনাফ ঈষৎ বিরক্তি বোধ করে তনিমা আপুর কাঁধে হাত রেখে অধৈর্য্য কন্ঠে বললেন,,

“ডোন্ট বি আপসেট ইয়ার। তোকে এভাবে আপসেট দেখতে আমাদের ভালো লাগে বল?”

তনিমা আপু নিরুত্তর, নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। কেবল মুখের আদলে মন খারাপের চিহ্ন এঁকে রেখেছেন। মৌনতা ভেঙ্গে আহনাফ পুনরায় শান্ত কন্ঠে বললেন,,

“বাইরে চল। মন ভালো হয়ে যাবে!”

নেহাল ভাই ও তনিমা আপুকে উদ্দেশ্য করে বিরক্তি মাখা কন্ঠে পাশ থেকে বললেন,,

“প্লিজ তনিমা। একটু হাস। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা কর। এভাবে ভেঙ্গে পড়লে হবে? আমরা তো আছি তোর পাশে তাই না?”

ইতোমধ্যেই আম্মু খানিক সংকোচ বোধ করে আমাদের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন। ইতস্ততবোধ করে আম্মু আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“এই ভর সন্ধ্যায় তোমরা কোথায় যাচ্ছ আহনাফ? আসলে আত্নীয়-স্বজনরা প্রশ্ন তুলছেন তো তাই জিগ্যেসা করলাম।”

একবার দম নিয়ে আম্মু পুনরায় বললেন,,

“আসলে আরিফ একটু আগে ঠিকই বলেছিলো। তোমাদের এভাবে মেলামেশাটা সবার দৃষ্টিকটু লাগছে!”

আহনাফ যথেষ্ট স্বাভাবিক থেকে ম্লান হেসে আম্মুকে বললেন,,

“আন্টি কে কি ভাবল এসব নিয়ে আপনি খামোখা দুঃশ্চিন্তা করবেন না। হৃদির বিয়ের পর আই থিংক আমার এবং প্রভার মেলামেশাটা নিয়ে কারো কোনো অভিযোগ থাকবে না। বাকিটা সময় হলে বাবা আপনাদের অভেয়েসলি জানাবেন। সো আপাতত আমাদের মেলামেশাটাকে আপনি এবং আমাদের আত্নীয় স্বজনরা স্বাভাবিক চোখেই দেখতে পারেন!”

“ঠিক আছে। বাট তোমরা এখন কোথায় যাচ্ছ সেটা তো বলবে?”

জোরপূর্বক হাসি টেনে আহনাফ বললেন,,

“একচুয়েলি আন্টি। আমি প্রভাকে নিয়ে একটু পার্লারে যাচ্ছি। ১/২ ঘন্টার মধ্যেই আশা করি ব্যাক করব। অযথা চিন্তা করবেন না আপনি। আই থিংক, আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন? এবার আমরা আসি?”

আম্মু ইতস্ততবোধ করে মাথা নাঁড়ালেন। আম্মুর সম্মতি পেয়ে আহনাফ আমার হাত ধরে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলেন। পেছনে অবশ্য নেহাল ভাই এবং তনিমা আপু ও আছেন। পার্কিং লনে পার্ক করে রাখা আহনাফের গাড়িটায় আমরা সবাই একে একে বসে পড়লাম। আহনাফের ড্রাইভিং সিটের পাশে আমি বসলাম। ব্যাক সিটে নেহাল ভাই এবং তনিমা আপু বসেছেন। দুজনের মধ্যেই অনেকটা দূরত্ব। সেই দূরত্বটায় আরো একজন বেশ আরাম করেই বসতে পারবেন। দুজনই দুজনের বিপরীত দিকে তাকিয়ে আছেন। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছেন না পর্যন্ত। লুকিং গ্লাসে ব্যাক সিটের সম্পূর্ণটাই আমার দুচোখে স্পষ্টত। তনিমা আপুর দু চোখে বিষাদের ছড়াছড়ি। নেহাল ভাই বিদ্বেষি ভাব নিয়ে এক ধ্যানে জানালার স্বচ্ছ কাঁচের দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে গভীর মনযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছেন। দুজনের দ্বিমুখী আচরন ভীষণ ভাবাচ্ছে আমায়। তাদের আচরণে কিছু সময় মনে হচ্ছে তারা দুজনই খুব ভালো বন্ধু। পরক্ষনে আবার মনে হচ্ছে দুজনের মধ্যেই কিছু একটা চলছে! আই মিন পেয়ার, মোহাব্বত, ভালোবাসা! কি জানি। আমার ধারনা হয়তো ভুল ও হতে পারে। তবে দুজনের মাঝেই যে বিরাট একটা রহস্য লুকিয়ে আছে তা আমি ভালোই আঁচ করতে পারছি। আমার পাশে বসা লোকটার কথা না হয় বাদই দিলাম। এই লোকটার তো আপাদমস্তকই অগতিন রহস্যে ভরা। লোকটা দিন দিন এতোটাই রহস্যময় হয়ে উঠছে যে, আমি এই রহস্যের সন্ধান করতে করতে ক্লান্ত, শ্রান্ত, ক্ষান্ত হয়ে উঠছি! তবু ও মিলছে না রহস্যের কোনো আগা গোড়া!

ইতোমধ্যেই আহনাফ সিট বেল্ট লাগিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু যুগল খানিক উঁচিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে বললেন,,

“কি হলো? সিটবেল্ট এখনো লাগাও নি কেনো?”

আহনাফের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আমি গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে সিটবেল্ট লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সিট বেল্ট বাঁধার ঠিক শেষ মুহুর্তে আহনাফ ফুল স্পিডে গাড়িটা স্টার্ট করে দিলেন। এসির হাওয়াটা কেমন যেনো বিরক্তিকর ঠেঁকছে। হঠাৎ বমি বমি পাচ্ছে। ভ্যাপসা গরমের আবির্ভাব হচ্ছে। জানালার কাঁচ উঠিয়ে প্রকৃতির বিশুদ্ধতম বাতাস উপভোগ করতে মনটা ভীষন উদগ্রীব হয়ে আছে। রাতের হিমেল হাওয়ায় গাঁ ভাসাতে ভীষণ ইচ্ছে করছে, এলোমেলো খোলা চুলে স্নিগ্ধ বাতাসকে আহ্বান করার ইচ্ছে জাগছে, প্রশান্তিতে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটাতে বড্ড ইচ্ছে করছে। জানালার কাঁচ ভেদ করে ব্যস্তময়, কোলাহল পূর্ণ রাস্তা থেকে তিক্ত দৃষ্টি সরিয়ে আমি আহনাফের দিকে চেয়ে আবদার সূচক কন্ঠে বললাম,,

“জানালার কাঁচটা খুলে দেই? এসির বাতাসটা দম বন্ধ লাগছে।”

আহনাফ মৌন দৃষ্টিতে এক পলক আমার দিকে তাকালেন। চশমার ফ্রেমটা উপরের দিকে টেনে আহনাফ পুনরায় ড্রাইভিংয়ে মনযোগ দিয়ে ম্লান কন্ঠে আমায় উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“ওকে৷ তবে একটা কন্ডিশান আছে!”

“কি?”

“জানালা দিয়ে হাত বা ফেইস বের করা যাবে না। এক্সিডেন্টের রিস্ক থাকতে পারে।”

“আমাকে কোন দিক থেকে আপনার নির্বোধ, বোকা বা বাচ্চা টাইপ মনে হয়? ভালো, খারাপ আমি বুঝতে পারি। অন্তত আমাকে আপনার জ্ঞান দিতে আসতে হবে না!”

আহনাফ ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে আমার সমস্ত অবয়বে চোখ বুলিয়ে বললেন,,

“আগে তো উড়নাটা ঠিক করতে শিখো। এরপর না হয় নিজেকে খুব জ্ঞানী ভেবো!”

আহনাফের থেকে চোখ হটিয়ে আমি বুকের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখলাম উড়নাটা গলার সাথে একদম চিপকে লেগে আছে। বুকের দিকটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। তাড়াহুড়ো করে আমি উড়নাটা ভালো করে বুকে জড়িয়ে আহনাফের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,

“এই? আপনার নজর এতো খারাপ কেনো? আমি এই নিয়ে প্রায় অনেকবার খেয়াল করেছি, আপনি প্রতিবার আমার শরীরের কোনো না কোনো অংশের দিকে ঠিক নজর দিয়েছেন। একবার বলেছিলেন, শাড়ি ঠিক করতে৷ আরেকবার উড়না। অসব দিকে আপনি তাকান কেনো হুম? দৃষ্টি নুইয়ে রাখতে পারেন না?”

আহনাফ তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললেন,,

“এজন্যই লোকজনদের ভালো করতে নেই বুঝেছ? ভালো করেছ তো, ফ্রিতে গাল মন্দ খেতেই হবে। আরে বাবা। আমি যদি অসব দিকে নজরই না দেই, তবে তো বাকিরা অসব দিকে নজর দিবে। আমি জেঁচে কেনো চাইব? আমার ব্যক্তিগত সম্পদে কেউ নজর দিক? এতোটা মহান এই আহনাফ শেখ নয় অভেয়সলি!”

আমি হেয় হেসে বললাম,,

“আমি মোটে ও আপনার ব্যক্তিগত সম্পদ নই। যদি ব্যক্তিগত সম্পদই হতাম না? তবে দীর্ঘ দেড়টা বছর সেই সম্পদকে ছেড়ে আপনি এতোটা দূরে থাকতে পারতেন না। অন্তত একবার হলে ও আমার খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করতেন।”

আহনাফ ভাবশূণ্য কন্ঠে বললেন,,

“আপাতত আমরা ঐ প্রসঙ্গে না যাই? এখন বলো কোন পার্লারে যাবে? এখানে তোমার কোনো চেনা জানা বা পরিচিত পার্লার আছে?”

আমি মনমরা কন্ঠে বললাম,,

“দুর্গাপুর মেইন রুটের সামনেই একটা পার্লার আছে। একবার এসেছিলাম ওটাতে। আই থিংক ঐ পার্লারটাই বেস্ট হবে!”

আহনাফ লুকিং গ্লাসে নজর দিয়ে ব্যাক সিটের দিকে তাকালেন। ডান দিকে ছিটকে থাকা তনিমা আপুকে উদ্দেশ্য করে আহনাফ উচ্চ আওয়াজে বললেন,,

“হেই তনিমা? তুই যাবি পার্লারে? কাজ আছে?”

তনিমা আপু ব্যাক সিট থেকে মাথা তুলে জোরপূর্বক হেসে মাথা নাড়িয়ে বললেন,,

“না। আমার কোনো কাজ নেই!”

“আবারো আপসেট হয়ে আছিস? সিরিয়াসলি, আমার খুব খারাপ লাগে তোকে এই বিমূর্ষ অবস্থায় দেখলে। মনে হয় যেনো তোর এই মন খারাপের জন্য আমি ও দায়ী। প্লিজ আমাকে নিজের বিবেকের কাছে এতোটা ছোট করে দিস না!”

তনিমা আপু কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন,,

“জানিস? তুই এসব বলে আমাকে কতোটা ছোট করছিস? দোষ শতভাগ আমার ছিলো আহনাফ। আমিই ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ঠিক, ভুল জাজ করতে পারি নি তখন। হুটহাট করে ভুল মানুষটাকেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। এখন রিপেন্ড করছি আমি। বিবেকের কাছে প্রতিনিয়ত দ্বগ্ধ হচ্ছি। কাইন্ডলি তুই এসব বলে, নিজের বিবেকের কাছে আমাকে আর ছোট করিস না। নিতে পারছি না আমি এতো পেইন!”

আহনাফ প্রতিত্তুর করার পূর্বেই নেহাল ভাই পাশ থেকে ক্ষীণ কন্ঠে তনিমা আপুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“তোকে এতো পেইন নিতে কে বলেছে তনিমা? আমরা কেউ তোকে বলেছিলাম এসব উটকো পেইন নিতে? ধৈর্য্য ধরে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা কর। আগামীতে ভালো কিছুই হবে!”

নেহাল ভাইকে উদ্দেশ্য করে আহনাফ উত্তেজিত কন্ঠে বললেন,,

“বুঝলাম না। তুই পাশে থাকতে তনিমা এতো আপসেট হয়ে আছে কেনো? আর তোদের মাঝে এতো ডিস্টেন্স কেনো? তুই কি ভাবছিস এতোটা ডিস্টেন্স ক্রিয়েট করে তনিমাকে তুই সামলাতে পারবি?”

আহনাফের কথা শেষ হতে না হতেই নেহাল ভাই চোখের পলকে তনিমা আপুর সাথে একদম চিপকে বসলেন। তনিমা আপু অস্থির দুই টলমল চোখে নেহাল ভাইয়ের দিকে তাকাতেই নেহাল ভাই ম্লান হেসে বললেন,,

“ডোন্ট ক্রাই। আমি এবং আহনাফ তোর পাশে আছি। অপরাধী নিশ্চয়ই তার যোগ্য শাস্তি পাবে। আমাদের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তকে মন থেকে ফিল কর। তোর মন ভালো করার জন্যই কিন্তু আমরা তোকে নিয়ে বিডিতে ব্যাক করেরেছি। হৃদির বিয়েতে এসেছি। সো চিল ইয়ার।”

তনিমা আপু হেচকি তুলে কেঁদে আচমকা নেহাল ভাইয়ের কাঁধে মাথা ঠেঁকিয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন,,

“তোরা আছিস বলেই আমি বেঁচে আছি। নয়তো এই অপরাধবোধ নিয়ে বোধ হয় না খুব একটা বেশি দিন বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা আমি বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম। এভাবে নির্জীবভাবে বাঁচার চেয়ে তো মৃত্যু শ্রেয় হতো।”

দম নিয়ে তনিমা আপু এবার আমাকে উদ্দেশ্য করে নরম কন্ঠে বললেন,,

“স্যরি প্রভা। সব জেনে বুঝেই আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছিলাম। তোমার চরিএে আঙ্গুল তুলতে সবাইকে বাধ্য করেছিলাম। আহনাফের মনে তোমার জন্য খারাপ প্রতিক্রিয়া তৈরী করতে উঠে পড়ে লেগেছিলাম। আমার জন্যই তোমাদের মধ্যে দীর্ঘ দেড় বছরের বিচ্ছেদ ঘটল। আমি সত্যিই খুব অনুতপ্ত এবং লজ্জিত প্রভা। পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও প্লিজ।”

সরাসরি আমি আহনাফের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,

“কি চলছে এসব? একটু ক্লিয়ারলি বলবেন? তনিমা আপু হঠাৎ করে আমার কাছে ক্ষমা চাইছেন কেনো? কাইন্ডলি সবটা আমাকে খুলে বলবেন?”

আহনাফ ড্রাইভিং সিটে এক হাত রেখে অন্য হাতে খপ করে আমার ডান হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে উনার বুকের পাজরে মিশিয়ে স্বস্তির একটা শ্বাস ছেড়ে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“এই দেড় বছরে, যখন তুমি হোস্টেলে ছিলে বড় ভাইয়া কি একবার ও তোমার সাথে দেখা করতে হোস্টেলে গিয়েছিলেন?”

“হুম গিয়েছিলেন। একবার না, প্রায় অনেকবার গিয়েছিলেন। কেনো কি হয়েছে?”

হুট করে আহনাফ রাস্তার মাঝখানে গাড়ি থামিয়ে আতঙ্কগ্রস্থ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বললেন,,

“ভাইয়া তোমার সাথে খারাপ কিছু করার চেষ্টা করেন নি তো?”

কপালের ভাঁজে বিরক্তি ভর করল আমার। রাগী দৃষ্টিতে আমি আহনাফের দিকে চেয়ে বললাম,,

“হোয়াট? জিজু আমার সাথে খারাপ কিছু করার চেষ্টা করবেন কেনো? কি যা তা বকছেন আপনি?”

ইতোমধ্যেই রাস্তায় জ্যাম লেগে গেলো। ছোট, বড় সব গাড়ি উচ্চ আওয়াজে হর্ণ বাজাতে লাগাল। আশেপাশের সব গাড়ির মালিকরা চোখ লাল করে আহনাফকে হুমকি দিচ্ছেন। নেহাল ভাই ব্যাক সিট থেকে উত্তেজিত কন্ঠে আহনাফকে বললেন,,

“গাড়িটা স্টার্ট কর আহনাফ। লোকজন ক্ষেপে যাচ্ছেন!”

আমার থেকে হতভম্ব দৃষ্টি সরিয়ে আহনাফ পরিস্থিতি সামালাতে তাড়াহুড়ো করে গাড়িটা স্টার্ট করে দিলেন। মিনিট একের মধ্যে আহনাফ আচমকা আমাকে হেচকা টান দিয়ে উনার বুকের পাজরে একাত্নভাবে মিশিয়ে উদ্বিগ্নভরা কন্ঠে বললেন,,

“ভাইয়ার থেকে যথেষ্ট দূরে থাকার চেষ্টা করবে। প্রয়োজনে ভাইয়া যে পথে হাঁটবে সে পথে হাঁটা তুমি বন্ধ করে দিবে। কথাটা এমনি এমনি বলি নি আমি। কাইন্ডলি সিরিয়াসলি নেওয়ার চেষ্টা করো।”

আহনাফের বুকের সাথে মিহিভাবে মিশে আমি তটস্থ কন্ঠে বললাম,,

“কেনো? একটু ক্লিয়ারলি বলবেন? সব গুলিয়ে যাচ্ছে আমার। কাইন্ডলি একটু বলুন। আপনাদের মধ্যে কি চলছে!”

“আচ্ছা তুমি কি সত্যিই বুঝতে পারছ না? ভাইয়ার ইন্টেনশান? ভাইয়ার কু- দৃষ্টি, যেনো তেনো বাহানায় তোমাকে ছুঁতে চাওয়া, ভাবীর বিপক্ষে গিয়ে তোমাকে হোস্টেলে দেখতে যাওয়া। কিছুই বুঝতে পারছ না তুমি?”

“কি বুঝব আহনাফ? আমি তো উনাকে শুধু জিজু নয়, আমার বড় ভাইয়ের চোখে ও দেখি। উনার ছোঁয়ায় কোনো পাপ খুঁজে পাই নি আমি।”

“বিয়ের এতো গুলো বছরে ও ভাবী কেনো মা হতে পারলেন না, তোমার ফ্যামিলির এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ তৈরী হয় নি? কারো মনে কোনো দ্বিধা দ্বন্ধ তৈরী হয় নি?”

“আপু তো প্রায় অনেক বারই মা হয়েছিলেন। তবে ভুল বশত মিসকারেজ হয়ে গেলে এইখানে আপু বা জিজুর কি দোষ? আমরা কাকে দোষারোপ করব বলুন?”

“সত্যিটা এখনো বুঝতে পারো নি তোমরা। কিছুদিন পর ঠিকই বুঝবে। তবে এই কয়েকটা দিন তোমাকে খুব সতর্ক থাকতে হবে। ভাইয়ার থেকে এনাফ ডিস্টেন্স মেন্টেইন করে চলতে হবে। আই হোপ তুমি বুঝতে পেরেছ?”

ইতোমধ্যেই আহনাফ গাড়িটা দুর্গাপুর মেইন রুটের পাশ ঘেঁষে দাঁড় করালেন। আমি নিজীর্ব অবস্থায় শরীরের সমস্ত ভার আহনাফের বুকের পাজরে নিবদ্ধ করেছি। হিসবে মিলাতে পারছি না আমি মোটে ও। আহনাফ কি বললেন এসব? জিজুকে হঠাৎ সন্দেহ করছেন কেনো? জিজুর ব্যবহার আচরনে তো কখনো আমি খারাপ কিছুর আভাস পাই নি! উল্টে ফ্রি ভাবে চলেছি জিজুর সাথে। জিজু ও আমার সাথে খুব ফ্রি ভাবে মিশেছিলেন। সবকিছু ঠিক থাকতেও আহনাফ হঠাৎ কেনো নিজের বড় ভাইয়ের দিকে আঙ্গুল তুলছেন?

গাড়ির দরজা খোলার উচ্চ আওয়াজে আমার ধ্যান ভাঙ্গল। নেহাল ভাই এবং তনিমা আপু গাড়ি থেকে নেমেছেন মাএ। নেহাল ভাই শরীরের আড়মোড়া ভেঙ্গে হেয়ালী কন্ঠে তনিমা আপুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“কাঁধটা ভেঙ্গে গেলো আমার। তোর ১০০ মন ওজনের বিশাল মাথার ভারটা আমার এই নাজুক কাঁধ নিতে পারে বল?”

তনিমা আপু ভীষণ রেগে নেহাল ভাইয়ার পিঠে অনবরত কিল, ঘুষি বসিয়ে বললেন,,

“ইউ ইডিয়ট৷ আমার মাথার ভার ১০০ মন না? উল্টে তোর হাতের ভার ১০০ মন বুঝেছিস? আমার এই নরম হাত যে তোর ঐ ১০০ মন হাতের ভার নিয়েছে এই অনেক!”

আনমনেই হেসে আমি মাথা তুলে আহনাফের দিকে তাকালাম। আহনাফ নেশা ভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছেন। লোকটার এই নেশাক্ত চাহনীতে আমি ভালোবাসার অতলে ডুবে যাচ্ছিলাম ঠিকি তবে নির্বোধ মনকে প্রশ্রয় দিতে চাইছিলাম না একরত্তি। হুড়মুড়িয়ে আহনাফের উত্তাল বুক থেকে মাথা তুলতেই আহনাফ রাগান্বিত ভঙ্গিতে পুনরায় আমায় বুকের মাঝে চেঁপে ধরে তটস্থ কন্ঠে বললেন,,

“এই? তুমি কি এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে পারো না? এতো ছটফট করো কেনো?”

“আপনার কি লাজ লজ্জা নেই? দেখছেন, নেহাল ভাই এবং তনিমা আপু বাইরে আছেন, আমাদের জন্য ওয়েট করছেন। আর আপনি এখানে বসে লুতুফুতু করছেন?”

আহনাফ অট্ট হেসে বললেন,,

“ইট’স নট লুতুফুতু। ইট’স কল্ড রিয়েল লাভ। ওকে?”

“হাহ্। ভালোবাসেন আমাকে?”

“কেনো? কোনো সন্দেহ আছে?”

“ষোল আনাই সন্দেহ। বিশ্বাস নেই আপনার সাথে। আগের বারের মতো হয়তো আবারো আমায় প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে সারাজীবনের জন্য কোথাও একটা হারিয়ে যাবেন। আপনার পাশাপাশি, কাছাকাছি থাকলে নির্ঘাত আমি আবারো আপনার প্রেমে পড়ে যাবো! বার বার এভাবে আঘাত পেয়ে সেই আঘাত হজম করার ক্ষমতাটা আমার মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই। তাই আপনার থেকে দূরে থাকাটাই আপাতত ব্যাটার মনে করছি।’

জানালার কাঁচে কয়েক দফা টোকা পড়তেই আমি ডান পাশের জানালার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। নেহাল ভাই বাঁকা হেসে আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বলছেন,,

“গাড়িতেই সংসার বাঁধার ডিসিশান নিয়েছিস নাকি? ফুল, ক্যান্ডেল, পানি, লাগবে? আদার’স কিছু লাগলে ও বলতে পারিস। এনে দিবো!”

আহনাফ ক্ষীপ্ত দৃষ্টিকে নেহাল ভাইয়ের দিকে তাকাতেই নেহাল ভাই শুকনো কন্ঠে বললেন,,

“আরে ভাই। ঠান্ডা মাথায় বললেই তো হয় ডিস্টার্ব হচ্ছে। এভাবে রাগ দেখানোর কি আছে?”

নেহাল ভাই চেঁপে গেলেন। আহনাফ হুট করে আমার দিকে তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কোনো কারণ ছাড়াই আমার ঘাঁড়ের দিকে জোরে এক বাইট বসিয়ে বিক্ষুদ্ধ কন্ঠে বললেন,,

“নেক্সট টাইম অহেতুক আমাকে সন্দেহ করতে ১০০ বার ভাববে। ফার্স্টে এই বাইটের দাগটা চোখে পড়বে৷ তখন আমাকে সন্দেহ করার চিন্তাটা ও মাথায় আসবে না।”

রাগে কটমট করে আহনাফ আমাকে ছেড়ে তড়িৎ বেগে গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন। আমি বাইটের দিকটায় হাত রেখে নাক, মুখ কুঁচকে তীব্র ব্যাথায় কুঁকিয়ে আহনাফের যাওয়ার পথে তাকিয়ে মিহি কন্ঠে বললাম,,

“আস্ত রাক্ষস এই লোক। আচ্ছা? লোকটা আবার ভ্যাম্পায়ার নয় তো? ভ্যাম্পায়ারের সাথে প্রেম করছি আমি? যদি এই ভ্যাম্পায়রকেই বিয়ে করতে হয়?”

জানালায় অর্ধ মুখ ঢুকিয়ে আহনাফ রাগে গজগজ করে আমায় উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“এক্সকিউজ মি ম্যাম। হাত ধরে নামাতে হবে আপনাকে? আর কি কি সার্ভিস দিতে হবে আপনাকে কাইন্ডলি একটু বলবেন?”

দাঁতে দাঁত চেঁপে আমি তেজর্শিনী কন্ঠে আহনাফের চার চোখের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,

“শুধু হাত ধরে নামালে চলবে না ওকে? কোলে তুলে নামাতে হবে! সার্ভিস ইজ সার্ভিস।”

দম নেওয়ার সুযোগটা ও পেলাম না। সাইক্লোনের বেগে আহনাফ গাড়ির দরজাটা খুলে ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে আমাকে হেচকা টানে সিটের একদম শেষ প্রান্তে নিয়ে এলেন। কম্পিত দৃষ্টিতে আমি বুকে ধুকপুক নিয়ে আহনাফের দিকে চেয়ে আছি। মুহূর্তের মধ্যেই আহনাফ আমাকে কোলে তুলে সোজা পার্লারের দিকে মোড় নিলেন। আমি স্তম্ভিত ভঙ্গিতে আহনাফের কাঁধে দুহাত ঝুলিয়ে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে আহনাফকে অবলোকন করছি৷ নেহাল ভাই এবং তনিমা আপু মুখে হাত দিয়ে আশ্চর্যিত ভঙ্গিতে আমাদের পিছু পিছু হাঁটছেন৷ নেহাল ভাই তো পেছন থেকে আহনাফকে উদ্দেশ্য করে ইয়ার্কির স্বরে বলে উঠলেন,,

“ওহ্ মাই গড৷ হিন্দি মুভির শুটিং দেখছি আই থিংক। জিয়ো আহনাফ, জিয়ো। দম আছে তোর বলতে হবে!”

আহনাফ পিছু ফিরে অট্ট হেসে নেহাল ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“চাইলে তুই ও তনিমাকে কোলে নিতে পারিস। আমরা মাইন্ড করব না!”

নেহাল ভাই হঠাৎ হাসি থামিয়ে তনিমা আপুর দিকে ম্লান দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন,,

“উই আর জাস্ট ফ্রেন্ড৷ কোনো প্রশ্নই আসে না!”

তনিমা আপু জোরপূর্বক হাসি টেনে সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা নিচু করে নিলেন। আহনাফ কথা না বাড়িয়ে পুরো দমে সামনে হাঁটতে আরম্ভ করলেন। আমি দাঁতে দাঁত চেঁপে আহনাফের কানে ফিসফিসিয়ে বললাম,,

“এই? আমি কি আপনাকে সত্যি সত্যি কোলে তুলতে বলেছি? রাস্তাঘাটের লোকজন দেখছেন। আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করছেন। এভাবে মেলো ড্রামা ক্রিয়েট না করে আমাকে কোল থেকে নামিয়ে দিন বলছি!”

“উহু। কোনো কথা হবে না। চুপ করে আমার সাথে মিশে থাকো। মন থেকে আমায় ফিল করো!”

“আজব তো! আপনি কি আমাকে কোলে নিয়েই পার্লারে ইন করবেন?”

“ইয়েস। আই হেভ নো ডাউট!”

ইতোমধ্যেই আহনাফ পার্লারের বদ্ধ দরজাটা ওপেন করে পার্লারে প্রবেশ করলেন। সাথে সাথেই পার্লারের ১০ থেকে ১২ জন মেয়ে আমাদের দিকে হা করে তাকালেন!
#তোমাতেই_রহিব_বিলীন
#পর্ব_১৪
#নিশাত_জাহান_নিশি

ইতোমধ্যেই আহনাফ পার্লারের বদ্ধ দরজাটা ওপেন করে পার্লারে প্রবেশ করলেন। সাথে সাথেই পার্লারের ১০ থেকে ১২ জন মেয়ে আমাদের দিকে হা করে তাকালেন!

আহনাফ ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ উঁচিয়ে পার্লারের সবক’টা মেয়েকে উদ্দেশ্য করে রাগী কন্ঠে বললেন,,

“কি হলো? সার্কাস দেখছেন? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো? চোখ নামান বলছি!”

মেয়ে গুলো আর এক সেকেন্ড ও সময় ব্যয় করলেন না। আহনাফের খড়তড় কন্ঠে চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য হলেন। আমি রাগে লাল হয়ে অবিরত ধস্তাধস্তি করে আহনাফের কোল থেকে নামার চেষ্টায় অটল প্রায়। ক্ষান্ত হয়ে আমি পরিশেষে দাঁত কিড়মিড়িয়ে আহনাফের কানে গুঞ্জন তুলে বললাম,,

“ছাড়ুন বলছি। এটা একটা পাবলিক প্লেইস। নোংরামো করার জায়গা না।”

“নোংরামো করছি কোথায় হুম? উডবি ওয়াইফকে কোলে নেওয়াটা সিরিয়াসলি নোংরামি?”

“ছাড়বেন কিনা বলুন? আমি কিন্তু ভীষন রেগে যাচ্ছি।”

আহনাফ আচমকা বাঁকা হেসে বললেন,,

“রেগে গেলে কি করবে হুম? এক্সট্রা আদর দিবে?”

আমি দাঁতে দাঁত চেঁপে বললাম,,

“কিক চিনেন কিক? কিক দিবো! বুঝেছেন?”

আহনাফ অট্ট হেসে আমাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলেন। ইতোমধ্যেই পার্লার মালিক আমাদের সম্মুখে এসে হাজির হলেন। শান্ত দৃষ্টিতে মহিলাটি আহনাফের দিকে চেয়ে বললেন,,

“ভাইয়া। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। একচুয়েলি পার্লারে বয়েজ এলাউড না।”

আহনাফ শার্টের কলারটা বাঁ দিকে ঝাঁকিয়ে ভাবশূন্য কন্ঠে বললেন,,

“আই নো দ্যাট ম্যাম। পার্লারে বয়েজ এলাউড না। আমি জাস্ট আমার উডবি ওয়াইফকে পার্লার অবধি পৌঁছে দিয়ে গেলাম। যতো রূপচর্চা আছে, যতো ফেসিয়াল ট্রিটমেন্ট আছে সব এক এক করে আমার উডবি ওয়াইফকে ট্রাই করাবেন। আমি বাইরে ওয়েট করছি। আর হ্যা, জাস্ট ওয়ান আওয়ারের মধ্যে সব ট্রিটমেন্ট আপনাকে শেষ করতে হবে। ওকে?”

আহনাফের কথার মাঝখানে আমি মহিলাটিকে উদ্দেশ্য করে মৃদ্যু হেসে বললাম,,

“না আপু। সব ফেসিয়াল ট্রিটমেন্ট ট্রাই করতে হবে না। জাস্ট হোয়াইটনিং ফেসিয়ালটা করালেই হবে।”

মহিলাটি ম্লান হেসে বললেন,,

“ওকে ম্যাম। তাহলে চলুন ভেতরে। থার্টি মিনিটসের মধ্যেই আপনার হোয়াইটেনিং ফেসিয়াল কমপ্লিট হয়ে যাবে।”

মহিলাটি এবার আহনাফকে উদ্দেশ্য করে হালকা হেসে বললেন,,

“ভাইয়া। তাহলে আপনি এবার আসুন। জাস্ট থার্টি মিনিটস সময় দিন আমায়। ওকে?”

আহনাফ ডানে বায়ে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালেন। নিষ্পলক দৃষ্টিতে আমার দিকে একবার তাকিয়ে আহনাফ আমার কানে ফিসফিসিয়ে বললেন,,

“গাড়িতে ওয়েট করছি আমি। কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি এসো।”

শরীরটা কেমন যেনো কেঁপে উঠল আমার। উষ্ণ শিহরণ বয়ে গেলো শরীরের সর্বাঙ্গে। না চাইতে ও চোখ জোড়া বুজে আমি আহনাফের কানে ঠোঁট ঠেঁকিয়ে বললাম,,

“ঠিক আছে। আপনি যান।”

আহনাফ মৃদ্যু হেসে হেলেদুলে পার্লার থেকে প্রস্থান নিলেন। আমি উনার যাওয়ার পথে তাকিয়ে মৃদ্যু হাসলাম। মানুষটা আসলেই পাগল। সামান্য ফেসিয়ালের জন্য গাড়িতে আধ ঘন্টা আমার জন্য ওয়েট করবেন? ছেলে মানুষের এতো ধৈর্য্য আছে বুঝি?

যাই হোক প্রায় আধ ঘন্টার মধ্যে আমার ফেসিয়াল শেষ হলো। বিল এলো প্রায় তিনশত টাকার মতো। আপাতত আমার কাছে কোনো টাকাই নেই। আহনাফের থেকেই টাকাটা নিতে হবে। পার্লারের দরজায় দাঁড়িয়ে আমি আহনাফকে খুঁজছিলাম। রাস্তার পাশ ঘেঁষে পার্ক করে রাখা আহনাফের গাড়িটায় নজর দিলাম। গাড়ির ডিক্কিতে দু দিকে পা মেলে বসে আছেন আহনাফ। উনার পাশেই নেহাল ভাই এবং তনিমা আপু চুপচাপ বসে আছেন। একটু ভালো করে নজর দিতেই দেখতে পেলাম আহনাফের হাতে জ্বলন্ত একটা সিগারেট। খুব আয়েস করে উনি সিগারেটটায় ফুঁক দিতে যাবেন অমনি আমি রাগে গজগজ করে উচ্চ আওয়াজে আহনাফকে ডেকে বললাম,,

“আহনাফ শুনছেন?”

সঙ্গে সঙ্গেই আহনাফ সিগারেটটা হাত থেকে নিচে ছুড়ে মারলেন। গাড়ির ডিক্কি থেকে নেমে আহনাফ হাত দিয়ে সামনের এলোমেলো চুল গুলো সেট করে ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসি ঝুলিয়ে আমার দিকে অগ্রসর হলেন। আমার মুখোমুখি দাঁড়াতেই আমি চোয়াল শক্ত করে আহনাফের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,

“হাতে কি ছিলো ওটা?”

আহনাফ শুকনো কন্ঠে বললেন,,

“কি?”

“সত্যিই বুঝতে পারছেন না?”

“না তো!”

“নাটক করছেন?”

আহনাফ নির্বোধ কন্ঠে বললেন,,

“কই না তো!”

বুকের পাজরে দু হাত বেঁধে আমি ক্ষীপ্ত কন্ঠে বললাম,,

“স্মোকিং করছিলেন আপনি?”

আহনাফ ইতস্তত বোধ করে শুকনো ঢোক গিলে বললেন,,

“আরেহ্। ওটা তো নেহালের সিগারেট ছিলো। আমি তো জাস্ট একটু হাতে নিয়েছিলাম। এর মধ্যেই তোমার ডাক পড়ল! সো সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে আমি তোমার কাছে ছুটে এলাম।”

“ওহ্ আই সি। তার মানে আপনি স্মোকিং করেন নি তাই তো?”

কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম রাশি গুলো মুছে আহনাফ শার্টের কলারটা টেনে বললেন,,

“হুম করি নি! সিউর।”

আহনাফের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি রুক্ষ কন্ঠে বললাম,,,

“ওকে ফাইন। তাহলে মুখটা হা করুন। আমি চেইক করব।”

চোখে অস্থিরতা নিয়ে আহনাফ মুখে হাত দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বললেন,,

“মামামানে কি?”

“মানে আছে। দেখি? মুখ থেকে হাতটা সরান।”

“নো। আই কান্ট ডু দিজ।”

আমি রাগে গজগজ করে আহনাফের মুখ থেকে হাতটা সরানোর জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠলাম। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে আমি সফল হলাম আহনাফের মুখ থেকে হাতটা সরাতে। সাথে সাথে সিগারেটের বিশ্রি স্মেল আমার নাকে ভেসে এলো। চোয়াল শক্ত করে আমি আহনাফের শার্টের কলার চেঁপে ধরে বললাম,,

“ইউ চিটার, লায়ার। মিথ্যে বললেন কেনো আপনি? আপনি স্মোকিং করেন নি?”

আহনাফ চোখে ভয়ে নিয়ে বিচলিত কন্ঠে বললেন,,

“স্যরি। একচুয়েলি মাঝে মধ্যে স্মোকিং করা হয়। ভয়ে সত্যিটা বলতে পারি নি তোমায়। যদি তুমি রাগ করো তাই!

আহনাফের শার্টের কলারটা ছেড়ে আমি রাগে গজগজ করে গাড়ির দিকে মোড় নিলাম আর পেছন থেকে আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বললাম,,

“বিলটা দিয়ে আসুন। আমি গাড়িতে ওয়েট করছি।”

আহনাফ পেছন থেকে চেঁচিয়ে বললেন,,

“ওকে। প্লিজ ডোন্ট এংরি উইথ মি। আই উইল কাম ইন জাস্ট ফাইভ মিনিটস।”

হন্ন হয়ে গাড়ির দরজা খুলতেই তনিমা আপু আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। শান্ত কন্ঠে আপু আমায় উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“আহনাফ খুব ভালো ছেলে, খুব ভালো বন্ধু, খুব ভালো প্রেমিক ও বটে। আই থিংক নিঃসন্দেহে সে ভালো একজন হাজবেন্ড ও হবে! তোমাকে খু্ব সুখে রাখবে। ইউ উইল বি দ্যা হ্যাপিয়েস্ট ওয়াইফ ইন দিজ ওয়ার্ল্ড৷ সো প্লিজ, ডোন্ট বি এংরি উইথ হিম।”

ভাবশূন্য দৃষ্টিতে আমি তনিমা আপুকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,

“আহনাফ কি শুধুই আপনার বন্ধু? কখনো বন্ধু থেকে প্রেমিক হয়ে উঠে নি?”

তনিমা আপু তব্ধ শ্বাস ছেড়ে বললেন,,

“আমাদের মধ্যে কখনোই কোনো প্রেম জাতীয় সম্পর্ক হয় নি। উই আর জাস্ট গুড ফ্রেন্ডস।”

ইতোমধ্যেই নেহাল ভাই আমার অন্য পাশে দাঁড়িয়ে অনুশোচিত কন্ঠে বললেন,,

“স্যরি টু সে প্রভা। ঐ দিন তনিমার শুনানো কল রেকর্ডিং গুলো ফেইক ছিলো। খু্ব সাজানো গোছানো একটা প্ল্যান ছিলো। এ সবকিছুর পেছনে কিছুটা হয়তো আমি ও জড়িয়ে ছিলাম! তবে আমি ইচ্ছাকৃতভাবে জড়াই নি। নিজের অজান্তেই জড়িয়ে পড়েছিলাম। কিছুদিন পর সমস্ত ঘটনা গুলো তোমার কাছে ক্লিয়ার হবে। সেই পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরে থাকার হাম্বেল রিকুয়েস্ট করছি!”

নেহাল ভাইয়ের দিকে চেয়ে আমি অধৈর্য্য কন্ঠে বললাম,,

“আর কতো ওয়েট করতে হবে আমায় বলুন? আর কতো ধৈর্য্য ধরতে হবে? ধৈর্য্যের বিচ্যুতি তো আমারো ঘটে। সিরিয়াসলি আমি হাঁফিয়ে উঠছি আপনাদের এসব মিস্ট্রিয়াস ব্যাপারে।”

পেছন থেকেই মনে হলো আহনাফের কন্ঠস্বর আমার কর্নকুহরে ভেসে এলো। শান্ত কন্ঠে আহনাফ পেছন থেকে আমায় উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“সবুরে মেওয়া ফলে। জাস্ট হাতে গোনা ২/৩ দিন সময় দাও আমাদের। সব রহস্য ভেদ করে সত্যিটা ঠিক সামনে আসবে।”

পিছু ঘুড়ে আমি সন্দিহান চোখে আহনাফের দিকে তাকালাম। আহনাফ ক্ষীন হেসে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন,,

“কি? আর মাএ ২/৩ দিন ওয়েট করতে পারবে না?”

আমি সন্দিহান কন্ঠে বললাম,,

“আই উইল ট্রাইং!”

সংকোচ বোধ করে আমি নাক, মুখ কুঁচকে আহনাফকে বললাম,,

“আ’ম হাংরি। আই হেভ টু ইট সামথিং নাও।”

আহনাফ অস্থির চোখে রোড সাইটে দৃষ্টি বুলিয়ে রাস্তার ঠিক বাম পাশে ছোট খাটো একটা রেস্টুরেন্ট দেখা মাএই আমার দিকে উদ্বেগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,

“রাস্তার অপজিটে একটা রেস্টুরেন্ট দেখা যাচ্ছে। কাম অন, হারি আপ।”

আহনাফ আমার হাত ধরে পিছু ফিরে নেহাল ভাই এবং তনিমা আপুকে উদ্দেশ্য করে ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললেন,,

“এই তোরা ও চল। আজ আমরা রেস্টুরেন্টে ডিনার করেই বাড়ি ফিরব।”

নেহাল ভাই তনিমার আপুর হাতটা খপ করে ধরে আহনাফ এবং আমার পাশাপাশি দাঁড়ালেন। তনিমা আপু আশ্চর্যিত চোখে নেহাল ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি বুলাতেই নেহাল ভাই ম্লান হেসে বললেন,,

“এতো অবাক হওয়ার কি আছে? এর আগে ও বহুবার আমি তোর হাতে ধরেছিলাম। আজ নতুন কি আছে?”

তনিমা উৎসুক কন্ঠে বললেন,,

“আজ তোর স্পর্শ একটু অন্যরকম ই লাগছে। কেনো বল তো? তোর ছোঁয়ায় আজ বিশেষ কিছু আছে?’

নেহাল ভাই ভ্রু যুগল উঁচিয়ে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললেন,,

“বিশেষ কিছু নেই। নরমালি হাতটা ধরেছি জাস্ট!”

তনিমা আপু নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে নিলেন। আহনাফ বাঁকা হেসে তাদের দুজনকেই উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“আমি জানি, নেহালের স্পর্শে আজ নতুন কি আছে। তবে এখনই কাউকে কিছু বলব না। আই হোপ সো, কিছুদিন পর তোরা নিজেরাই তোদের মনের কথা নির্দ্বিধায় বুঝতে পারবি।”

চারজন এক সাথে রাস্তা পাড় হয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ইন করলাম। আহনাফ চার প্লেইট ফ্রাইড রাইস, চিকেন, বিফ, মাটান এন্ড কোল্ড ড্রিংকস অর্ডার করলেন। রাতে জমিয়ে ডিনার করে আমরা ঠিক ১০ টা নাগাদ বাড়ি ফিরে এলাম। বাড়ি ফিরতেই আম্মু এবং আপুর ঝাড় শুনতে হলো। আত্নীয় স্বজনদের হেয় দৃষ্টি এবং নিন্দে মন্দ সহ্য করতে হলো। সব উপেক্ষা করে রুমে প্রবেশ করতেই জিজুর মুখোমুখি হতে হলো। বুকে হাত বেঁধে জিজু রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“এতো রাত হলো কেনো বাড়ি ফিরতে? কোথায় ছিলে তোমরা?”

আমি স্বাভাবিক কন্ঠে বললাম,,

“পার্লারে গিয়েছিলাম। তাই একটু লেইট হয়ে গেলো!”

“সিরিয়াসলি? পার্লারে তুমি ৩/৪ ঘন্টা ব্যয় করে এসেছ?”

“অবাক হওয়ার কি আছে জিজু? পার্লারে ৩/৪ ঘন্টা ব্যয় করা অবশ্যই আশ্চর্যের কিছু না!”

জিজু আমার দিকে খানিক ঝুঁকে বেশ উত্তেজিত কন্ঠে বললেন,,

“আমার বিরুদ্ধে আহনাফ ঠিক তোমার কান কতোটা ভাঙ্গিয়েছে? কাইন্ডলি একটু বলবে?”

“আপনার মধ্যে এতো সন্দেহ, কৌতুহল, ভয়, উৎকন্ঠা কাজ করছে কেনো জিজু? আপনি কি সত্যিই কিছু করেছেন?”

জিজু থতমত খেয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে রাগান্বিত ভাব ভঙ্গি পাল্টে কিঞ্চিৎ নরম কন্ঠে বললেন,,

“কে আমায় কি ভাবল আই জাস্ট ডোন্ট কেয়ার। আমি নিজের বিবেকের কাছে অন্তত পরিশুদ্ধ আছি। রুমে যাও। ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো!”

জিজু দ্রুত পায়ে হেঁটে প্রস্থান নিলেন। জিজুর যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে আমি সন্দিহান কন্ঠে বললাম,,

“কি হচ্ছে কি এসব? জিজুর ভাব ভঙ্গি দেখে তো মনে হচ্ছে না জিজু কোনোভাবে অপরাধী! আহনাফ হঠাৎ জিজুর থেকে আমাকে দূরে থাকতে বললেন কেনো? জিজু কি সত্যিই কিছু করেছেন?

হাজারো প্রশ্ন, উৎকন্ঠা, উদগ্রীবতা নিয়ে আমি রুমে প্রবেশ করলাম। ফ্রেশ হয়ে রুমের লাইট অফ করে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম। আহনাফকে ভীষষষনভাবে মিস করছি। উনার হাতের স্পর্শ, উনার ঠোঁটের স্পর্শ, হুট করে আমাকে পাজা কোলে তুলে নেওয়া, লোকমা তুলে আমাকে খাইয়ে দেওয়া, অবশেষে আমার যত্ন নেওয়া। প্রতিটা মুহূর্তকে ভীষন মিস করছি। তৎক্ষনাৎ হাতে থাকা আংটিটায় চোখ বুলিয়ে আমি মৃদ্যু হেসে বললাম,,

“আগের বার আংটি টা হাতে পড়ে অতোটা রিলিফ ফিল করি নি আমি। তবে এবার আংটি টা হাতে পড়ে খুব রিলিফ ফিল করছি। মনে হচ্ছে যেনো আহনাফ শেখ আমার শরীরের একটা বিস্তর অংশ দখল করে আছেন। যাকে আমি যখন ইচ্ছে তখনই ছুঁতে পারছি, তার ভালোবাসাটাকে মন থেকে উপলব্ধি করতে পারছি!”

পরক্ষনে মুখটা কালো করে আমি নাক ছিটকে বললাম,,

“ছ্যা। মি চাশমিশ আহনাফ তো স্মোকিং করেন। ভাবতেই কেমন ঘেন্না লাগছে। এই স্মোকারকে আমি বিয়ে করব? তার সাথে সংসার করব?”

এসব ভাবতে ভাবতে কখন যেনো ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ মনে হলো কেউ যেনো আমার গাঁয়ে জড়ানো কাঁথাটা শক্ত হাতে টানছেন। অত্যধিক ভয়ে জর্জরিত হয়ে আমি ফটাফট ঘুমন্ত চোখ জোড়া খুলে পাশ ফিরে তাকাতেই চোখ জোড়া প্রকান্ড করে উচ্চ আওয়াজে চেঁচিয়ে বললাম,,

“আআপনি? আআপনি আমার রুমে কি করছেন?”

#চলবে….?

(উহুম উহুম। সবাইকে একটা জরুরী কথা বলার ছিলো। আজ সন্ধ্যা ৬ঃ৩০ মিনিট নাগাদ নতুন ধারাবাহিক গল্প নিয়ে আমি হাজির হচ্ছি। তাছাড়া তোমাতেই রহিব বিলীন গল্পটা ও প্রায় শেষের দিকে। ২০ পর্বেই গল্পটার ইতি টানা হবে। আশা করছি নতুন গল্পটায় সবার সাড়া পাবো। সবাই গল্পটার পাশে থাকবেন। ধন্যবাদ সবাইকে।)
#চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here