তোমাতে রহিব বিলীন পর্ব ৭+৮

#তোমাতেই_রহিব_বিলীন
#পর্ব_৭
#নিশাত_জাহান_নিশি

শনিবার আজ। বিকেল ৫ টা বাজতেই ঐ বাড়ি থেকে ফোন কল আসতে আরম্ভ করল। নেহাল ভাই আজ দেশে ফিরছেন! সেই খুশিতে ঐ বাড়ির প্রত্যেকেটা সদস্য আত্নহারা। আহনাফ তো বিকেল হতেই এয়ারপোর্ট পৌঁছে গেছেন, নেহাল ভাইকে পিক করতে। আম্মু সহ আমি রেডি হয়ে বিকেল ঠিক ৫ঃ৩০ বাজতেই ঐ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। যদি ও আমার ইচ্ছে নেই ঐ বাড়িতে যাওয়ার, আহনাফকে ফেইস করার। তবু ও আপু, জিজু এবং আঙ্কেলের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে আমাকে রাজি হতে হলো!

গৌধূলীর অন্তিম লগ্ন ঘনিয়ে এলো। ঘড়িতে ৬ঃ১০ মিনিট বাজতেই আশেপাশের প্রতিটা মসজিদে পালাক্রমে মাগরিবের আযান পড়তে আরম্ভ করল। গাড়িতে বসেই আমি একাগ্রচিত্তে আযানের সুমধুর ধ্বনি শ্রবণ করছিলাম। মনটা যেনো বিশেষ এক ভালো লাগা এবং পবিএতায় ভরে উঠছিলো। রবের প্রতি আলাদা একটা টান অনুভব করছিলাম। হৃদয়ে জমে থাকা সমস্ত ক্লেশ যেনো মুহূর্তের মধ্যেই উধাও হয়ে গেলো। মনটা প্রাণোচ্ছ্বলায় ভরে উঠল। আযান শেষ হতেই গাড়ি এসে আহনাফ শেখের বাড়ির পার্কিং লনে বিকট শব্দে থামল। মাথায় বড় করে ঘোমটা টেনে আমি গাড়ি থেকে নেমে আম্মুসহ ঐ বাড়ির সদর দরজায় পা রাখলাম। পর পর দুবার কলিং বেল চাপতেই মাঝ বয়সী শিউলি আপা (বাড়ির কাজের মহিলা) হাতে ঝাড়ু নিয়ে খুব ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গিতে সদর দরজাটা খুলে দিলেন। আমাদের দেখা মাএই শিউলি আপা আশ্চর্যিত ভঙ্গিতে ঝাড়ুটা নিচে নামিয়ে মুচকি হেসে বললেন,,

“আরে। আফনারা আইসা পড়ছেন? ভাবী তো হেই কখন থাইক্কা আফনেগো লাইগ্গা অফেক্ষা করতাছিলো। দেহি, আহেন আহেন। তাড়াতাড়ি ঘরে আহেন।”

আম্মু উর্ধ্ব আওয়াজে হেসে বললেন,,

“আসছি, আসছি। তুমি এতো ব্যস্ত হয়ো না তো শিউলি!”

বাড়ির ড্রইং রুমে প্রবেশ করতেই শিউলি আপা সদর দরজাটা আটকে দৌঁড়ে আমার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আমায় প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“কি গো আফা? আফনের মন খারাপ ক্যান?”

শিউলি আপা অবশ্য ভুল কিছু বলেন নি। মুখটাকে আমি সত্যিই মন খারাপের রেশে অসম্ভবভাবে ফুলিয়ে রেখেছি। শুধু শিউলি আপা কেনো? যে কোনো ব্যক্তি আমাকে দেখলেই অনায়াসে বলতে পারবেন, আমার প্রচন্ড মন খারাপ। বিষাদের নীল রঙ্গ ফুটে আছে সমস্ত মুখমন্ডলে!

শিউলি আপা প্রতিত্তুরের আশায় আমার মুখেপানে অধীর আগ্রহে চেয়ে আছেন। প্রসঙ্গ পাল্টাতে আমি উনাকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে ইতস্তত কন্ঠে বললাম,,

“এনগেজমেন্টের দিন কোথায় ছিলে তুমি? বাড়িতে কোথাও দেখলাম না যে!”

“পাশের বাসায় নতুন কাজ নিছি আফা। ঐ বাড়িতেই আছিলাম। কাজের চাপ একটু বেশিই আছিলো! তাই আফনার আংটি পড়ানোর অনুষ্ঠানে থাকতে পারি নাই।”

“ওহ্ আচ্ছা।”

“আমি যাই আফা। কাজ আছে। ভাবীরে ও ডাকতে হইব৷ আফনারা আইছেন, বলতে হইবো না?”

“আচ্ছা যাও।”

“আফনারা সোফায় বহেন। আফা উপরে আছে। আমি ডাক দিয়া আইতাছি।”

শিউলি আপা হাসি মুখে প্রস্থান নিলেন। ড্রইং রুমটা বেশ পরিপাটি ভাবেই সাজানো হয়েছে। সোফা সেট গুলো সম্পূর্ণ নতুন মনে হচ্ছে। ডাইনিং টেবিলের ধরনটা লম্বায় একটু বেশিই প্রশ্বস্ত মনে হচ্ছে। তিনটে চেয়ার বেশি দেখা যাচ্ছে। হয়তো ডাইনিং টেবিলটা ও সদ্য কেনা। গোলাপী রঙ্গের প্রতিটা দেয়ালে দেয়ালে লাল, নীল রঙ্গের টিমটিমে ঝাড়বাতি জ্বলছে। এতে রুমের আকর্ষনীয়তা যেনো দ্বিগুন বেড়ে উঠছে। উপর তলা থেকে মহিলাদের হাসি হট্টগোলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। পরিচিত দু, একজনের কন্ঠস্বর ও আমার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। তাদের মধ্যে নেহাল ভাইয়ের আম্মুর (রাহেলা হক) কন্ঠস্বর অন্যতম।

সোফায় প্রায় দু মিনিট বসতেই লক্ষ্য করলাম আপু খুব প্রফুল্লিত মনে তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি টপকে নিচে নামছেন। আপুর পেছনে আপুর একজন খালা শ্বাশুড়ী, ফুফু শ্বাশুড়ী, দুই চাচাতো ননাশ, এমনকি নেহাল ভাইয়ের ছোট বোন ও আসছেন। ঐ দিকে আম্মু আমাকে পই পই করে বুঝিয়ে বলছিলেন, একটু হাসিখুশি থাকতে, তাদের সাথে যতোটা সম্ভব মেশার চেষ্টা করতে, কৌশল বিনিময় করতে, ভদ্রভাবে কথা বলতে। অযথা মন খারাপ করে না থাকতে। আমার এই বিরূপ মুখভঙ্গি দেখলে বাড়ির সবাই নানা ধরনের প্রশ্ন তুলবেন। আম্মু এতো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না। দয়া করে আম্মুকে এই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে না ফেলতে।

আম্মুর বলা প্রতিটা কথায় সম্মতি জানিয়ে আমি জোর পূর্বক হাসি টেনে আপু এবং আপুর শ্বশুড় বাড়ির প্রতিটা লোকের দিকে হাসি মুখে তাকালাম। বয়োজৈষ্ঠ্যদের সালাম জানিয়ে আমি তাদের সাথে কৌশল বিনিময় করলাম। তারা ও আমার সাথে খুব হাসি হাসি মুখে কথা বলে আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলেন। বিশেষ করে নেহাল ভাইয়ের আম্মু। উনি প্রথম থেকেই আমার ভীষণ প্রশংসা করতেন৷ সেই ধারাটা এখনো অবধি বজায় আছে। আপুর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে আমি আপুর ননাশদের সাথে আলাপে মগ্ন হয়ে গেলাম। হৃদি আপু (নেহাল ভাইয়ের ছোট বোন) আমার থেকে প্রায় দু বছরের বড় হবেন। খুব বন্ধুসুলভ আচরণ উনার। আপুর দুই চাচাতো ননাশ (শশী এবং শ্যামা) আপু বিবাহিত দুজনই। হাজবেন্ডের বাড়ি থেকে উনারা নেহাল ভাইকে দেখতে এই বাড়িতে এসেছেন। কিছুক্ষন পর উনাদের হাজবেন্ডরা ও চলে আসবেন নেহাল ভাইকে দেখতে!

,
,

ঘন্টা খানিক পর। ড্রইং রুমে আড্ডার মহল বেশ জমতে শুরু করেছে। সবাই কফি এবং স্ন্যাকসে সাথে আড্ডাটাকে অধিক জাকজমক করে তুলেছে। কফিতে চুমুক দিয়ে আপু আচমকা শিউলি আপাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“শিউলি আপা। আর একটু কষ্ট করেন। আহনাফের রুমটা একটু গুছিয়ে দিয়ে আসুন। এই আড্ডার মহল ছেড়ে আমার উঠতে ইচ্ছে করছে না একদম।”

শিউলি আপা কিছু বলার পূর্বেই আম্মু উদগ্রীব কন্ঠে বলে উঠলেন,,

“শিউলি কেনো? প্রভা আছে না? প্রভা গুছিয়ে দিবে আহনাফের রুম।”

আম্মু এবার আমাকে উদ্দেশ্য করে বেশ চড়া কন্ঠে বললেন,,

“যা। আহনাফের রুমটা গুছিয়ে দিয়ে আয়। আহনাফরা হয়তো চলে ও আসছে। এসে যেনো রুমটা গোছানো দেখে।”

আমি কটমট চোখে আম্মুর দিকে চেয়ে বললাম,,

“আমাকেই যেতে হবে?”

আপুর সব ননাশরা বাঁকা হেসে একসাথে বলে উঠলেন,,

“তুমি নয়তো কে? বিয়েটা কার সাথে হচ্ছে শুনি?”

নিরত্তুর থেকে আমি চোখে, মুখে প্রবল রাগ নিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। বিরক্তি মনোভাবটা তড়তড় করে আমার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। হাত, পা কচলাতে কচলাতে আমি সিঁড়ি টপকে আহনাফের রুমে প্রবেশ করলাম। রুমের দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করে আমি রাগান্বিত ভঙ্গিতে বিছানার উপর দুহাতে ভর করে বসলাম। পুরো রুমটা অগোছালো হয়ে আছে। বিছানার চাঁদর, বালিশের কাভার সব খসে খসে পড়ছে। টেবিলের উপর কফির মগ, বিভিন্ন ফাইলপএ, ল্যাপটপ, পেন, ডায়েরীসহ আদার’স অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কাবার্ডের উপর শার্ট, প্যান্ট, টাই, মৌজা, কোট সব এলোমেলো হয়ে আছে। দাঁতে দাঁত চেঁপে আমি পুরো রুমটা অত্যধিক অগোছালো করতে উঠে পড়ে লাগলাম। মিনিট কয়েকের মধ্যে আমার লাগামহীন জেদে রুমটা আপাতত জঙ্গলে রূপান্তরিত হয়েছে!

টেবিলের এক কোণায় পড়ে থাকা নীল রঙ্গের ডায়েরীর মলাটটা পাখার বাতাসে লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে। ডায়েরীর প্রতিটা পাতা জুড়ে দূর থেকে আমি গোটা গোটা হাতের অক্ষর দেখতে পারছি। ডায়েরীটার একটা পাতা ও খালি নেই। কালো কালিতে ছেঁয়ে আছে শুভ্র ডায়েরীটা। তবে কি ছেলেরা ও ডায়েরী লিখে? তাদের মনের ও গোপন থাকে? পার্সোনাল লাইফ কি তারা ও ডায়েরীতে শেয়ার করে?

উৎসুক চিত্তে আমি এক পা দু পা করে টেবিলের দিকটায় এগিয়ে গেলাম। চোখে, মুখে ঘোর কৌতুহল নিয়ে আমি ডায়েরীটায় হাত দিতেই মনে হলো দরজায় কড়াঘাত পড়ল। ভয়ে আতকে উঠে আমি দরজার দিকে তাকাতেই আহনাফের ক্ষিপ্র কন্ঠস্বর আমার কর্ণকুহরে খুব ভয়াল ভাবে প্রতিধ্বনিত হলো। দরজায় সশব্দে কড়া নেড়ে আহনাফ উত্তেজিত কন্ঠে বলছেন,,

“হোয়াট দ্যা হ্যাল! হু ইজ ইন মাই রুম?”

অস্থিরতা নিয়ে আমি পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে কম্পিত কন্ঠে বিড়বিড়িয়ে বললাম,,

“ইসসস, রুমের যা অবস্থা করেছি আমি। লোকটা তো আজ আমাকে মেরেই ফেলবেন। কিভাবে ফেইস করব উনাকে আমি?”

দরজার কড়াঘাতের আওয়াজ যেনো বাড়ছিলো মাএাতিরিক্তভাবে।। কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। বুকে থু থু ছিটিয়ে আমি এক দৌঁড়ে রুমের দরজাটা খুলে দিতেই চাশমিশ আহনাফের মুখোমুখি হয়ে গেলাম। চশমা ভেদ করে উনার রাগী দৃষ্টি আমার ভয়ার্ত দৃষ্টিকে নাড়িয়ে তুলছিলো ভয়ঙ্করভাবে। শরীর আমার এতোটাই কাঁপছিলো যে, মনে হচ্ছিলো যেনো ভূমিকম্পের তান্ডব আরম্ভ হয়েছে এই মুহূর্তে। ভ্রু যুগল খড়তড় ভাব কুঁচকে উনি দাঁতে দাঁত চেঁপে বললেন,,

“ইউ ইস্টুপিট গার্ল৷ আমার রুমে কি করছিলে তুমি?”

কম্পিত চোখে আহনাফের দিকে চেয়ে আমি শুকনো কন্ঠে বললাম,,

“রুরুরুম গোছাতে এসেছিলাম!”

আমাকে হালকা ধাক্কা মেরে সামনে থেকে সরিয়ে আহনাফ ঝড়ের বেগে রুমে প্রবেশ করলেন। উন্মাদের মতোন উনি পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে অবশেষে টেবিলের উপর থাকা ডায়েরীটার উপর স্বস্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। দ্রুততার সহিত উনি ডায়েরীটাকে হাতে নিয়ে উদগ্রীব দৃষ্টিতে পুরোটা ডায়েরী উলটে পাল্টে দেখলেন। পরক্ষনে আমার দিকে তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উনি প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“ডায়েরীটা পড়েছিলে তুমি?”

“নানানাহ্৷”

কপাল কয়েকটা তিক্ত ভাজ ফেলে উনি সন্দিহান কন্ঠে বললেন,,

“সিউর?”

“হুহুহুম।”

তড়িঘড়ি করে উনি ডায়েরীটা বেডের তোশকের তলায় রেখে দ্রুত পায়ে হেঁটে আমার সম্মুখে দাঁড়ালেন। অল্প সময় উনি আমার চোখের দিকে সম্মোহিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বেশ শান্ত কন্ঠে বললেন,,

“এক সপ্তাহ খুব শান্তিতেই ছিলে তাই না?”

নিরুত্তর ভঙ্গিতে আমি উনার দিকে তাকাতেই উনি হঠাৎ শান্ত ভাব ভঙ্গি পাল্টে বুকে দু হাত বেঁধে মুডি ভাব নিয়ে জিগ্যাসু কন্ঠে বললেন,,

“উইদাউট পারমিশান তুমি আমার রুমে ইন করলে কেনো?”

আমি নতজানু হয়ে কম্পিত কন্ঠে বললাম,,

“আআম্মু বললেন, আআআপনার রুমটা গুছিয়ে দিতে!”

পুরো রুমটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পুনরায় পর্যবেক্ষন করে উনি আমার দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,

“আর ইউ সিউর প্রভা? তুমি আমার রুম গুছাতে এসেছিলে?”

শুকনো কন্ঠে আমি মাথা নত করে বললাম,,

“হুহুম।”

আহনাফ ফিক করে হেসে বললেন,,

“রুম গুছানোর এই নমুনা? এভাবে কে রুম গোছায় ভাই?”

চোখ তুলে আমি মুগ্ধিত দৃষ্টিতে উনার দিকে চেয়ে আছি। লোকটা এতো সুন্দর করে হাসতে পারেন, আমার সত্যি জানা ছিলো না। রাগী আদলে এক চিলতে মন মাতানো হাসি। বিষয়টা সত্যিই খুউব রোমাঞ্চিত৷ আপাতত রোমাঞ্চে ধ্যান দিতে চাইছি না আমি। তাই ধ্যান পাল্টাতে আমি এক ভ্রু উঁচিয়ে নাক ফুলিয়ে উনার দিকে চেয়ে বললাম,,

“আমি আপনার কোন জাতের ভাই লাগি শুনি?”

উনি থতমত খেয়ে খানিক ইতস্ততবোধ করে বললেন,,

“কথার কথা বললাম জাস্ট। কথা না ঘুড়িয়ে মেইন পয়েন্টে আসো। এভাবে রুম গোছায় কে? পৃথিবীতে কোন মেয়েরা এই তুফান স্টাইলে রুম গোছায়?”

ফ্যাল ফ্যাল চোখে আমি উনার দিকে চেয়ে কাঠ কাঠ গলায় বললাম,,

“কেন? আমি গুছাই! আমি এভাবেই রুম গুছাই। ফার্স্টে পুরো রুমটা পূর্বের তুলনায় বেশি এলোমেলো করি দেন আরো সুন্দর করে গুছাই।”

আমার দিকে খানিক ঝুঁকে এসে উনি ট্যারা চোখে বললেন,,

“ওহ্ রিয়েলি?”

“হুম। আপনার কোনো ডাউট আছে?”

“তুমি বলতেই ডাউট। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলব বলো?”

আমি দৃঢ় কন্ঠে বললাম,,

“সবক’টাই বলুন। আমি সব শুনব!”

“ক্ষমতা আছে শোনার?”

“থাকবে না কেনো?”

এক পায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে আহনাফ আমার কানের কাছে খানিক ঝুঁকে এসে ফিসফিসে কন্ঠে বললেন,,

“নিজের কুকীর্তি ঠিকভাবে নিতে পারবে তো? মানে হজম করতে কোনো প্রবলেম হবে না তো?”

আমি সাবলীল স্বরে বললাম,,

“যথেষ্ট ধৈর্য্য আছে আমার। যদি ও আমি কোনো কু-কাজ করি নি। তা ও আপনার মুখ থেকে আমি সেই না করা কু-কাজ গুলোই শুনতে চাই!”

উত্তেজিত কন্ঠে উনি আচমকা বলে উঠলেন,,

“মৃ না লি নী। ফেইসবুক একাউন্টটা কার?”

থতমত খেয়ে আমি কাঠ কাঠ গলায় বললাম,,

“জাজাজানি না। আআমি জানব কিভাবে?”

ক্ষুব্ধ হয়ে উনি দুহাত দিয়ে আমাকে ঝাঁকিয়ে বললেন,,

“মিথ্যে বলছ তুমি? মিথ্যে বলছ?”

ভয়ে কাত হয়ে আমি কম্পিত কন্ঠে বললাম,,

“আআআমার একাউন্ট৷ ততবে ওওওটা আমার ফেইক একাউন্ট।”

“এই ফেইক একাউন্ট দিয়েই কুকীর্তি চলছে তাই না? ছেলেদের প্রেমের জালে ফাসিয়ে তাদের সাজানো জীবনটাকে নরক করে তুলছ তুমি তাই না?”

“আআআপনি কিভাবে জানলেন এএএটা আমার ফেইক একাউন্ট। আপনার সাথে তো আমার ঐ একাউন্টের এড নেই!”

উনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,,

“ব্লকটা খুলো। পুনরায় এড হয়ে যাবো!”

“আজব তো! আমি ব্লক করব কেনো আপনাকে? আমি তো আপনার ফেইসবুক একাউন্টের নাম, ডিটেলস কিছুই জানি না। আপনার সাথে এড পর্যন্ত নেই আমার। তাহলে ব্লক খুলার কথা আসছে কেনো এখানে?”

আহনাফ আমার দিকে হাত বাড়িয়ে রুক্ষ কন্ঠে চেঁচিয়ে বললেন,,

“দেখি ফোনটা দাও। এক্ষনি ফোনটা চেইক করে তোমার ড্রামা আমি অফ করছি৷”

“ফোন তো ড্রইং রুমে, আমার সাইড ব্যাগে!”

ইতোমধ্যেই রুমের দরজায় টোকা পড়ল। অপরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে এলো। আহনাফ কটমট চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,

“নেহাল এসেছে। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করবে। স্বাভাবিক মানে হাসি খুশি ওকে?”

আমি জড়তা ভরা কন্ঠে বললাম,,

“ওকেহ্।”

আহনাফ হম্বিতম্বি হয়ে রুমের দরজাটা খুলে দিতেই আমার চোখ পড়ল নেহালের দিকে। ব্লু শার্টের সাথে ব্ল্যাক জিন্স পরিহিত অবস্থায় উনি প্রাণোচ্ছ্বল হাসিতে আহনাফের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“এই? তুই একা রুমে কি করছিস?”

আহনাফ জোর পূর্বক হাসি টেনে আমার দিকে আঙ্গুল তাক করে বললেন,,

“একা কোথায়? তোর ভাবি ও আছে!”

নেহাল ভাই চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। দৃষ্টি উনার কেমন যেনো উদ্ভট টাইপ। মনে হচ্ছে উনি আমাকে দেখে খুশি হন নি। তিক্তার ছাপে ছেঁয়ে গেছে সমস্ত মুখ মন্ডলে। অপ্রত্যাশিতভাবে আমার থেকে চোখ সরিয়ে নেহাল ভাই ছোট আওয়াজে আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“এতো কিছুর পরে ও তুই প্রভাকেই বিয়ে করবি? এই সারপ্রাইজটা দেওয়ার জন্যই তুই আমাকে সুদূর কানাডা থেকে ইমার্জেন্সি দেশে ফিরতে বলেছিস?”

আহনাফ আমার দিকে মিহি চোখে চেয়ে হালকা হেসে বললেন,,

“বেহায়া হতে হয়। নয়তো এতো শতো দুঃখের বোঝা বইবে কে? আমার শান্তি চাই, ব্যাস এটুকুই। আমি রিয়েলাইজ করতে পেরেছি, তার মাঝেই আমার দুনিয়ার সমস্ত সুখ, শান্তি নিহিত।”
#তোমাতেই_রহিব_বিলীন
#পর্ব_৮
#নিশাত_জাহান_নিশি

“বেহায়া হতে হয়। নয়তো এতো শতো দুঃখের বোঝা বইবে কে? আমার শান্তি চাই, ব্যাস এটুকুই। আমি রিয়েলাইজ করতে পেরেছি, তার মাঝেই আমার দুনিয়ার সমস্ত সুখ, শান্তি নিহিত।”

হতভম্ব দৃষ্টিতে আমি আহনাফের দিকে চেয়ে আছি। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার বোধ শক্তি লোপ পেয়েছে। শরীরের তাল খুঁজে পাচ্ছি না মোটে ও। বাক শক্তি রোধ হয়েছে কিনা জানি না, তবে গলা জড়িয়ে আসছে। আসলে আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না, লোকটা আমাকে মিন করে তার মনে লুকায়িত করুন আকুতি গুলো নির্দ্বিধায় প্রকাশ করে গেলো। যে আমাকে দু চোখে ও দেখতে পারে না, যার চোখে আমি তার চক্ষুশূল। সেই ব্যক্তিটাই নাকি আমাকে তার দুনিয়ার সমস্ত সুখ, শান্তির সাথে তুলনা করল? তা ও আবার প্রকাশ্যে, আমার সামনে! কুন্ঠাবোধ হলো না মোটেও?

আহনাফ এখনো প্রেম জড়ানো দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছেন। দৃষ্টি উনার পলকহীন। শরীরের লোমরাশিকে কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য উনার এই উত্তাল দৃষ্টি যথেষ্ট। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারছিলাম না আমি উনার ঐ নেশাক্ত দু চোখে। শরীর কাঁটা দিয়ে উঠছিলো সূঁচালোভাবে। ফটাফট উনার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমি মাথা নত করে নিতেই নেহাল ভাই খড়তড় কন্ঠে আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“আর ইউ সিউর আহনাফ? প্রভাকেই তুই বিয়ে করবি?”

আহনাফ ম্লান কন্ঠে বললেন,,

“এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে অলরেডি। বিয়ে করব না মানে? আলবাত বিয়ে করব! বিয়ে তো আমার তাকে করতেই হবে।”

নেহাল ভাই কপাল কুঁচকে চরম আশ্চর্যিত কন্ঠে বললেন,,

“হোয়াট? এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে মানে?”

আহনাফ উচ্চ শব্দে হেসে বললেন,,

“সারপ্রাইজ ইয়ার। এতো হাইপার হচ্ছিস কেনো? প্লিজ কুল!”

“মানে কি এসবের? কেউ আমাকে কিছু জানানোর প্রয়োজন ও মনে করলি না? মানে পরিবারের কেউ ও না?”

“আমিই সবাইকে বারণ করেছিলাম, তোকে কিছু না জানাতে। একচুয়েলি আমি তোকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। এখন তো মনে হচ্ছে আমি পেরেছি। তোকে সারপ্রাইজড করতে! চেহারাটা দেখার মতো হয়েছে, জানিস?”

নেহাল ভাই রাগান্বিত কন্ঠে বললেন,,

“আমি একটু ও সারপ্রাইজড হই নি আহনাফ। বরং হার্ট হয়েছি।”

হাসি থামিয়ে আহনাফ এবার বেশ সিরিয়াস কন্ঠে বললেন,,

“দেখ নেহাল, ফাস্টে যা হয়েছে ভুলে যা। আমি ও ভুলে গেছি। যে আমাকে হার্ট করেছে, আমার সাথে সাথে তোকে ও হার্ট করেছে, সে নিশ্চয়ই এর ফল পাবে। একরত্তি ছাড় ও পাবে না সে। তবে এতো কিছুর মাঝে ও- “তার প্রতি গড়ে উঠা ভালোবাসা আমি অস্বীকার করতে পারছিলাম না।” আমি তাকে ফাস্টে যেমন ভালোবেসেছিলাম, যেমনটা চেয়েছিলাম। এখন ও ঠিক তেমনটাই চাই আর ঠিক ততোটাই ভালোবাসতে চাই। হয়তো মাঝখানে একটু রাগ, জেদ, ঘৃণা জন্ম নিয়েছিলো তার প্রতি। তবে আমার আকাশসম ভালোবাসার কাছে- এসব কোনো ম্যাটারই করে না। তুই ও প্লিজ মন থেকে সব মেনে নে নেহাল। ইউ নো হোয়াট? আই লাভস হার লট।”

আহনাফের বলা কথা গুলো শ্রবণ করা মাএই আমি ভড়কে উঠলাম। উনি আমাকে ভালোবাসতেন মানে? শুধু তাই নয়, উনি তো বলছেন, এখনো উনি আমায় ভালোবাসেন! হচ্ছে কি এসব? মাথাটা মনে হলো ১৬০° এঙ্গেলে ঘুড়ছে। সমস্ত কথা মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। বুঝাই যাচ্ছে, আমার অগোচড়ে অনেক কিছু ঘটে গেছে। যা হয়তো আমি কখনো আঁচ করতে পারি নি। না এখনো কিছু আঁচ করতে পারছি। দুজনের মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু একটা চলছে। যা হয়তো দুজনই আমার থেকে গোপন করেছে নয়তো গোপন করার চেষ্টা করছে!

নেহাল ভাই নিরুত্তর, নিশব্দ ভঙ্গিতে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন। আহনাফের বলা কথা গুলো উনি ঠিকভাবে নিতে পারছেন না, যা উনার বিরূপ মুখভঙ্গি দেখেই ক্লিয়ার বুঝা যাচ্ছে। কিছু সময় মৌণ থেকে নেহাল ভাই একবার ক্ষীণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। অতঃপর চোখে, মুখে প্রখর রাগী ভাব ফুটিয়ে উনি দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে প্রস্থান নিলেন। নেহাল ভাইয়ার যাওয়ার পথে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে চোয়ে থেকে আহনাফ এক পায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে কপাল ঘঁষে প্রখর বিরক্তি প্রকাশ করে মিহি কন্ঠে বললেন,,

“ড্যাম ইট। হি ইজ ভেরি এংড়ি!”

পর পর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে আমি আহনাফের চোখকে ফাঁকি দিয়ে মন্থর গতিতে হেঁটে যেই না রুম থেকে প্রস্থান নিতে যাবো অমনি আহনাফ পেছন থেকে আমার হাতটা টেনে ধরে রূঢ় কন্ঠে বললেন,,

“হেই ইউ? তুমি কোথায় যাচ্ছ?”

আতঙ্কে চোখ জোড়া প্রকান্ড করে আমি পিছু ফিরে আহনাফের দিকে চেয়ে বললাম,,

“নিনিনিচে।”

আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,,

“রুমটা কে গোছাবে?”

না চাইতে ও আমি কম্পিত কন্ঠে বলে উঠলাম,,

“আআআমি।”

হেচকা টান দিয়ে আহনাফ আমাকে উনার দেহের সাথে মিশিয়ে বাঁকা হেসে বললেন,,

“সো? কি করবে এখন?”

আমি ছটফটে কন্ঠে বললাম,,

“রুরুরুম গোছাবো।”

উনার বলিষ্ঠ বাহুতে আমাকে আবদ্ধ করে উনি রুমের দরজাটা ভেতর থেকে লক করে পুনরায় উনার বুকের সাথে আমাকে মিশিয়ে কড়া চোখে আমার দিকে চেয়ে বললেন,,

“আধ ঘন্টার মধ্যে রুমটা গোছাবে ওকে?”

আহনাফের থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য আমি ধস্তাধস্তি করে দাঁতে দাঁত চেঁপে বললাম,,

“ছাড়ুন। না ছাড়লে আমি রুম গোছাবো কি করে? আজব!”

এক গালে হেসে উনি আমার কানের কাছে ঝুঁকে এসে ফিসফিসিয়ে বললেন,,

“ইচ্ছে করে রুমটা অগোছালো করেছ না? আমার উপর রাগ থেকে, জেদ থেকে, অভিমান থেকে? খুব ঘৃণা করো আমাকে তাই না?”

“হুম করি। আমি আপনাকে ঘৃণাই করি। পারলে বিয়েটাই ভেঙ্গে দিতাম৷ আপনার মতো অসভ্য, বদরাগী, উন্মাদ একটা ছেলেকে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছেই নেই আমার। যে প্রকাশ্যে পাবলিক প্লেইসে আমাকে ইনসাল্ট করে, উইদাউট এ্যানি রিজন আমায় কান ধরতে বাধ্য করে, সবসময় খিটখিট করে, মেজাজ দেখায়। ভালো ভাষায় দুটো কথা ও বলতে পারে না। সে আর যাই হোক আমার জীবন সঙ্গী হতে পারে না। শুধু আমি কেনো? পৃথিবীর কোনো মেয়েই আপনার মতো নিচু মনের মানুষকে জীবন সঙ্গী হিসেবে চায় না। সত্যি বলতে গেলে আপনি ভালো কোনো জীবনসঙ্গীর কাতারেই পড়েন না। সেই জায়গা থেকে আপনাকে বিয়ে করলে আমাকে সারাজীবন পস্তাতেই হবে। যন্ত্রনাই ভোগ করতে হবে। সংসার করাটা আর হবে না!”

আহনাফ নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ ভঙ্গিতে আমার দুচোখে চেয়ে আছেন। আঁখিতে উনার জমকালো মেঘ জমেছে। যার ছিঁটেফোঁটা আমি আঁচ করতে পারছি। আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি খুব শক্ত করে আমাকে ঝাপটে ধরে কেমন যেনো গলা জড়ানো কন্ঠে বললেন,,

“সত্যিই আমাকে বিয়ে করা যায় না? আমি এতোটাই খারাপ?”

“ভুল কিছু বলি নি। আপনি সত্যিই খারাপ! আপনার প্রতি আমার কোনো ভালো লাগা, ভালোবাসা কাজ করে না। শুধু ভয়, ভীতি কাজ করে। প্রতিটা মুহূর্তে আমি ভয়ে থাকি। কখন আপনি আমার উপর রাগ দেখাবেন, কখন ইনসাল্ট করবেন, কখন সিনক্রিয়েট করবেন। কখন আমাকে আপনার রুড বিহেভে কাঁদতে হবে।”

“৬ মাস রিলেশানে থেকে ও আমাকে চিনতে পারো নি প্রভা? বুঝতে এতোটাই ভুল করলে? তোমার চোখে আমি এতোটাই নিচ? যাকে ভালো লাগা বা ভালোবাসা যায় না? যার সমস্ত রাগ, জেদ, রুড বিহেভ গুলো মানিয়ে নেওয়া যায় না?”

“আপনি আবারো একই কথা রিপিট করছেন? আচ্ছা আপনার মাথায় কি সত্যিই কোনো গন্ডগোল আছে? সাইকো আপনি? একবার বললে বুঝতে পারেন না? আপনার সাথে আমার কখনো কোনো সম্পর্ক ছিলো না?”

এক ঝটকায় উনি আমাকে ছেড়ে বিপুল রাগান্বিত ভাব নিয়ে পকেট থেকে উনার ফোনটা বের করে ফোনে কিছু একটা করে আচমকা উনি আমার মুখের সামনে উনার ফোনের গ্যালারি ধরে বললেন,,

“লুক হেয়ার। সবক’টা কনভারসেশানের সস এখানে সেইভ করা আছে। তুমি এই মৃ না লি নী একাউন্ট থেকে প্রতি সপ্তাহে একবার হলে ও আমায় টেক্সট করতে,ভয়েস পাঠাতে এমনকি মেসেন্জ্ঞার কল ও করতে!”

অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আমি ফোনের ম্যাসেজ গুলোর দিকে চেয়ে আছি। মৃ না লি নী আইডিটা থেকে পর পর সবক’টা ম্যাসেজ করা। হায়, হ্যালো, কেমন আছো, কি করছ, খেয়েছ, লাভ ইমোজি, কিসির ইমোজি, ভয়েস, কল। এসব অবান্তর কনভারসেশানে ভর্তি পুরো গ্যালারী। আহনাফের প্রোফাইলে আহনাফের ছবি শো করছে। এমনকি মৃ না লি নী একাউন্টে আমি যে প্রোফাইলটা সেট করেছিলাম সেই প্রোফাইলটা ও এখানে শো করছে। অথচ বিগত ৪ মাস যাবত আমার ঐ একাউন্টে লগ ইন করা হয় না৷ তবে আমার অগোচড়ে কে এই ম্যাসেজ গুলো করেছে?

ক্ষনিকের মধ্যে ফোনটা আমার মুখের সামনে থেকে সরিয়ে আহনাফ তটস্থ কন্ঠে বললেন,,

“টেল মি? এই ম্যাসেজ গুলি কে করেছিলো? কে আমাকে লাভ এন্ড কিস ইমোজি দিয়েছিলো? কে আমাকে ভালোবাসার কথা বলেছিলো? ভয়েজ পাঠিয়েছিলো, কল করেছিলো? তুমি ছাড়া এই কাজ গুলো কে করবে? যেখানে আইডিটা তোমার নিজের!”

“বিলিভ মি আহনাফ। গত ৪ মাস যাবত আমি ঐ আইডিতে লগ ইন করি না। প্রয়োজনই পড়ে না আসলে। রিয়েল আইডি থেকেই মাঝে মাঝে ফ্রেন্ডদের সাথে ডেয়ার খেলার জন্য এই ছেলে ঐ ছেলেদের সাথে চ্যাট করা হয়। কখনো আবার ফোন কল ও করা হয় রং নাম্বারে। আমি সত্যিই জানি না আহনাফ, আপনার সাথে কে কথা বলেছে, কে আপনার সাথে রিলেশানে জড়িয়েছে।”

আহনাফ কিছু বলার পূর্বেই দরজায় পুনরায় কড়াঘাত পড়ল। উচ্চ শব্দে নেহাল ভাইয়ের কন্ঠস্বর ভেসে এলো। আহনাফ তাড়াহুড়ো করে আমার সম্মুখ থেকে সরে রুমের দরজাটা খুলে দিলেন। নেহাল ভাই গম্ভীর মুখে হাতে থাকা ফোনটা আহনাফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,,

“তনিমা লাইনে। তোর সাথে কথা বলতে চাইছে!”

আহনাফ ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে বললেন,,

“আমার সাথে? কিন্তু কেনো?”

নেহাল ভাই কেমন যেনো দুষ্টু হাসি দিয়ে বললেন,,

“তোকে মিস করছে!”

“আর ইউ ক্রেজি নেহাল?”

“ভালোবাসে তোকে। এমন ভাব করছিস মনে হচ্ছে তুই কিছুই জানিস না!”

“ইয়ার্কি করছিস তুই? তনিমা আমাকে পছন্দ করে৷ আমি না!”

আহনাফ পিছু ফিরে একবার অস্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। অতঃপর খানিক ইতস্ততবোধ করে নেহাল ভাইয়ের হাত থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে উনি পুনরায় আমার দিকে তাকিয়ে সংকোচিত কন্ঠে বললেন,,

“আমি আসছি।”

আহনাফ ফোনটা কানে দিয়ে প্রস্থান নিলেন। মনটা কেনো জানি না খুব খারাপ হয়ে গেলো আমার। তনিমা মেয়েটা কে? মেয়েটার সাথে কি কথা বলাটা খুব জরুরী উনার? এতোটাই জরুরী যে, এই মুহূর্তেই মেয়েটার সাথে কথা বলতে হবে? কিছুক্ষণ পরে বললে হতো না? মেয়েটার সম্পর্কে জানার আগ্রহটা যেনো আমার দ্বিগুন বেড়ে গেলো। সত্যিই কি মেয়েটা আহনাফকে ভালোবাসেন? আর আহনাফ? আহনাফ ও কি মেয়েটাকে…

আমার কল্পনায় ছেদ ঘটিয়ে নেহাল প্যান্টের পকেটে দু হাত গুজে ডান দিকে একটু কাত হয়ে আমার সম্মুখে দাঁড়ালেন। ঠোঁটের কোণে উনার দুষ্টু হাসি লেগে আছে। আমি সংকোচবোধ করে উনার দিকে তাকাতেই উনি ক্ষীন হেসে বললেন,,

“তনিমা। আহনাফকে ভীষন পছন্দ করে। দীর্ঘ ২ বছর ধরে মেয়েটা আহনাফের পেছনে ঘুড়ছে। তবে আহনাফ তোমাকে ভালোবাসে! যদি ও আহনাফের মনে তনিমার জন্য একটু আধটু ফিলিংস জন্ম নিয়েছিলো!”

“কিন্তু উনি তো বললেন, মেয়েটা উনাকে পছন্দ করেন৷ উনি নাহ্।”

“হয়তো, তুমি সামনে ছিলে তাই বলে নি!”

“আচ্ছা ওসব বাদ দিন। আগে একটু ক্লিয়ারলি বলবেন? আপনাদের মধ্যে কি চলছে? আহনাফ কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসেন? উনার সাথে সত্যিই আমার যোগাযোগ হতো?”

নেহাল ভাই রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বললেন,,

“সেই মেয়েটা তুমি কিনা জানি না! তবে একটা মেয়ের সাথে আহনাফের যোগাযোগ হতো। হতে পারে সেই মেয়েটা তুমিই। যাই হোক, ঐ দিকে ধ্যান দিয়ে আপাতত কোনো লাভ নেই৷ তুমি বরং তনিমার বিষয়টাতে ধ্যান দাও। তোমার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়া সত্ত্বে ও আহনাফ না আবার ঐ তনিমার…

ইতোমধ্যেই আহনাফ রুমে প্রবেশ করলেন। রাগী ভাব নিয়ে উনি ফোনটা নেহাল ভাইয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে তটস্থ কন্ঠে বললেন,,

“নেক্সট টাইম তনিমার কোনো ফোন কল এলে ফর দ্যা গড সেইক আমার হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিস না। তুই তোর মতো কথা বলে নিস। আমাকে এর মাঝে জড়াস না।”

নেহাল ভাই হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেঁপে বললেন,,

“কিন্তু তনিমা তো তোকে এখনো ভালোবাসে আহনাফ। তোর ও হয়তো ওর প্রতি এখনো ফিলিংস আছে!”

“জাস্ট শাট আপ নেহাল। আমি অলরেডি এনগেজড। প্রভাকে ভালোবাসি আমি। কেউ না জানুক, অন্তত তুই সেটা খুব ভালোভাবে জানিস৷”

“তুই সিউর? প্রভাই ঐ মেয়েটা? যাকে তুই ভালবেসেছিলি? যার সাথে তুই কথা বলেছিলি? অন্য কেউ ও তো হতে পারে, যে তোর সাথে প্রভা হিসেবে কথা বলেছে, তোর সাথে ফ্রড করেছে!”

“তুই এতোটা সিউর কিভাবে? ঐ মেয়েটা অন্য কেউ? প্রভা না? তুই ও তো ভুল হতে পারিস!”

নেহাল ভাইয়ের অভয় পেয়ে আমি দুজনের কথার মাঝখানে প্রসঙ্গ টেনে আহনাফকে উদ্দেশ্যে করে বললাম,,

“আমি সিউর আহনাফ। ঐ মেয়েটা আমি না। সত্যিই আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। কেউ হয়তো আপনাকে ফাঁসিয়েছে। অন্য কাউকে আপনি আমি ভেবে গুলিয়ে ফেলছেন।”

আহনাফ অগ্নিঝড়া দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন৷ আমি উনার দিকে এগিয়ে এসে পুনরায় শান্ত কন্ঠে বললাম,,

“দেখুন আহনাফ। আমি যদি সত্যিই আপনার সাথে যোগাযোগ করতাম, আপনার সাথে রিলেশানে থাকতাম, ভালোবাসতাম আপনাকে। তাহলে কেনো আমি এসব অস্বীকার করব বলুন? যে জায়গায় আপনার সাথেই আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। সে জায়গায় অস্বীকার করার তো কোনো কজই তো খুঁজে পাচ্ছি না আমি। আবারো বলছি আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে আহনাফ! বিষয়টা আপনি ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন।”

“তোমার কন্ঠস্বর কিভাবে ভুল হতে পারে প্রভা? হুবহু মিলে যাচ্ছে ঐ ভয়েসের সাথে। তোমাকে ভেবেই আমি ঐ মেয়েটার সাথে কথা বলেছিলাম।”

আমি আহনাফের দিকে ডান হাতটা বাড়িয়ে বললাম,,

“আপনার ফোনটা দিন। আমি ঐ আইডিতে লগ ইন করে দেখছি। আদৌ ঐ আইডি থেকে আমি আপনার সাথে কথা বলেছিলাম কিনা!”

আহনাফ উনার ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিতেই আমি ফোনটা হাতে নিয়ে আমার ঐ ফেইক একাউন্টে লগ ইন করার অনেক চেষ্টা করে ও বার বার ব্যর্থ হচ্ছিলাম। ইনকারেক্ট পাসওয়ার্ড দেখাচ্ছিলো। আহনাফ আমার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে অনেক চেষ্টা করে ও আইডিটাতে লগ ইন করতে পারছিলেন না। আমাদের ব্যতিব্যস্ত রূপ দেখে নেহাল ভাই গলা খাঁকিয়ে বললেন,,

“ব্যাপারটা আমি বুঝতে পেরেছি। প্রভার আইডিটা নিশ্চয়ই হ্যাক হয়েছিলো। অথবা প্রভার পরিচিত কেউ আইডি পাসওয়ার্ডটা জানত৷ সেই হয়তো আইডি পাসওয়ার্ডটা কোনোভাবে পাল্টে আহনাফের সাথে কথা বলেছিলো, প্রেমের অভিনয় করেছিলো, প্রভার কন্ঠে কথা বলেছিলো প্রভার ছবি, প্রভার ডিটেলস সব ইউজ করেছিলো। যখন মেয়েটা দেখল আহনাফ খুব সিরিয়াস হয়ে পড়েছে। ঠিক তখনই ব্রেকাপ করেছে। নিজের আসল রূপটা দেখিয়েছি। ব্যাস হয়ে গেলো রহস্যের মিমাংসা। দুজনের মাঝের ভুল বুঝাবুঝিটা ও দূর হয়ে গেলো।”

নেহাল ভাই দম নিয়ে পুনরায় আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বেশ সিরিয়াস কন্ঠে বললেন,,

“এতোদিন ব্যাপারটা নিয়ে আমি অতোটা ভাবি নি আহনাফ। তবে আজ ভাবতে হলো! আই থিংক আহনাফ, প্রভার কোনো দোষ নেই এই সবকিছুতে। কেউ তোকে ট্রেপে ফেলেছে। জেনে বুঝে তোকে ঠকিয়েছে। তোর উচিত, বিয়েটা এই মুহূর্তে ভেঙ্গে দেওয়া। কারণ, তুই প্রভাকে নয়। প্রভার মুখোশধারী মেয়েটাকে ভালোবেসেছিলি! এসবের মাঝে প্রভা কেনো রিপেন্ড করবে বল?”

ইতোমধ্যেই নিচ থেকে সবার হাকঁডাকের আওয়াজ কানে এলো। দম নেওয়ার পূর্বেই রুমের দরজা ঠেলে আপু, শশী এবং শ্যামা আপু হৈ-হুল্লোড় করে আহনাফ এবং আমাকে টেনে একসাথে দাঁড় করিয়ে প্রফুল্লিত কন্ঠে আমাদের দুজনকে ঝাঁকিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,,

“ইয়েস। তোমাদের বিয়ের ডেইট ফিক্সড হয়ে গেছে৷ আগামী মাসেই তোমাদের বিয়ে। আর মাএ ১৫ দিন পর।”

আহনাফ হতবিহ্বল চোখে আমার দিকে তাকালেন। চোখ দুটো অসম্ভব রকম লাল হয়ে চোখের কোটরে জল জমেছে উনার। যেকোনো মুহূর্তে শ্রাবণ ধারা বইবে। সেই ধারায় বুঝি আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে বহুদূর!

#চলবে….?
#চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here