১.
‘মিস.ইসানা ইবনাত। আপনার বয়স ২৭। আমার চেয়ে আপনি এক-দেড় বছরের বড়ো। আপনি পি.এ হবার যোগ্যতা রাখেন না। আসতে পারেন।’ গম্ভীর গলায় রাদ আনসারী অপর প্রান্তে থাকা ইসানাকে কথাগুলো বলল। অসহায় ভঙ্গিতে ইসানা রাদের দিকে তাকিয়ে রইল। রাদ ফাইল নড়াচড়া করতে ব্যস্ত। ইসানা হাল না ছেড়ে বিনয়ী স্বরে বলল,
‘আমাকে একটি বার সুযোগ দেওয়া যায় না স্যার। অন্যদের তুলনায় চাকরীটা আমার ভীষণ প্রয়োজন।’
রাদ কাগজগুলোতে চোখ বুলাতে বুলাতে গম্ভীর কণ্ঠেই বলল,
‘প্রথমত আপনি আমার থেকে বড়ো৷ দ্বিতীয় আপনি গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেন নি। তৃতীয় আপনি ডিভোর্সি। কোন যোগ্যতায় আমি আপনাকে চাকরী দিবো বলুন তো?’
এরূপ বাক্য তাকে শুনতে হবে ভেবে আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে ইসানা। দৃষ্টি নত রেখে মনঃক্ষোভ প্রকাশ করছে নিজের ওপর। ছোট বেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে মামা বাড়িতে শৈশব-কৈশোর কেটেছে তার। মামি নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসলেও, মামা দুচোখের বি*ষ মনে করতো ইসানাকে। বহু কষ্টে কলেজের দণ্ডি পাড় করে, ভার্সিটিতে থাকাকালীন বিদেশি ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। বিয়ের পরের দিন সদ্য বিবাহিত স্বামী না জানিয়ে এক প্রকার পালিয়ে বিদেশে চলে যায়। বিয়ের সময় এক ঝলক স্বামীকে দেখেছিল। তারপর আর দেখা হয়নি তাকে। বাসর রাত তার একাকী কেঁটেছে। চার বছর স্বামীর অপেক্ষায় শশুড়বাড়ি থেকেছে সে। সেখানে সকলের অবহেলা, লা*ঞ্ছ*না সহ্য করতে হয়েছে। জানুয়ারি মাসের তিন তারিখে বিদেশ থেকে ডিভোর্সের পেপার পাঠান হয়। শত বেদনাকে উপেক্ষা করে ডিভোর্স পেপারে সাইন করে শ্বশুরবাড়ি ত্যাগ করে ইসানা। মামা বাড়িতে না এসে তার প্রিয় বান্ধবী সোহানার বাড়িতে উঠে। এক সপ্তাহ সেখানে থেকে বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরীর ইন্টারভিউ দিয়েছে সে। কিন্তু ভাগ্য তার সায় দিচ্ছে না। আজকে রাদ টেক্সটাইল কোম্পানিতে পি.এ পদে চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে এসেছে। যে কোনো মূল্যে তাকে চাকরী পেতেই হবে। এভাবের বান্ধবীর ওপর নির্ভর হয়ে চলতে চাইছে না ইসানা। হয়তো এখান থেকেও আজ ফিরে যেতে হবে তাকে। সামনে বসা রুক্ষ সুশ্রী যুবক ডেস্কের ওপর ফাইল রেখে অন্য ফাইল ঘাঁটতে আরম্ভ করল। সে যে এখানে বসে আছে এতে তার বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই। এখানে আসার পর থেকেই তার দিকে না তাকিয়ে কথা বলেছে। একবারের জন্য তাকায় নি সে। দেখে মনে হচ্ছে তার মেয়েদের দিকে তাকান নি*ষি*দ্ধ! রাদের তেজি স্বর শুনে ইসানা চৈতন্য ফিরে পায়।
‘মিস.ইসানা আপনাকে যেতে বলা হয়েছে।’
ইসানা মিনতি করে বলল,
‘প্লিজ স্যার, একবার সুযোগ দিন। আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব সারাজীবন।’
‘আউট!’ রু*ক্ষ জড়িত কণ্ঠে শুধালো রাদ।
ইসানা ছলছল আঁখিযুগল দ্বারা ফাইল হাতে নিয়ে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করল। বের হবার পর আরেকটি মেয়েকে ভেতরে ডাকা হয়। ইসানা বক্ষে ফাইল জড়িয়ে বেরিয়ে আসে বাহিরে। তখন গাড়ি থেকে কালো স্যুট পড়া আরেক জন ব্যক্তিকে বের হতে দেখে ইসানা বুঝতে পারে ওনি এই কোম্পানির ম্যানেজার মুরাদ শেখ। ভেতরে রাদ আনসারীকে নিয়ে বাকি সবাই ক*টূ*ক্তি করছিল। কিন্তু মুরাদের সম্পর্কে ভালো সুবাক্য বলছিল তারা। ইসানা যেন তাকে দেখে এক চিতলে আশার আলো খুঁজে পায়। ভেতরে যাওয়ার পূর্বেই এগিয়ে যায় তার নিকট। ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করে ডাক দেয় মুরাদকে। সানগ্লাস চোখ থেকে খুলে মুরাদ ইসানার দিকে দৃষ্টি ফেলে। এক দৃষ্টিতে ইসানাকে পর্যবেক্ষণ করে নেয় তার তীক্ষ্ণ আঁখিযুগল দ্বারা। গোলাপি রঙের সেলোয়ার-কামিজ পরিধান শ্যামলা বর্ণের লাবণ্যময়ী অধিকারী ইসানা। মুরাদ মৃদুস্বরে বলল,
‘ইয়েস! বলুন কীভাবে সাহায্য করতে পারি?’
ইসানা ইতস্তত বোধ ফেলে সরাসরি বলে ফেলে,
‘আমার চাকরীটা খুব প্রয়োজন। প্লিজ, যদি একটু সাহায্য করতেন।’ কণ্ঠে অনুরোধ তার। মুরাদ বুঝতে পারে ইন্টারভিউতে মেয়েটি টিকেনি। আর এমনতেও রাদ যাদের ইন্টারভিউ নিবে তাকে অবশ্যই সব দিক থেকে পারফেক্ট হতে হবে। বিন্দুমাত্র ক্ষুত থাকা চলবে না। মুরাদ সেকেন্ড কয়েক চুপ থেকে কোমল স্বরে বলল,
‘আপনি আমার সঙ্গে আসুন। আপনার ফাইলটি দিন আমাকে।’
ইসানা সন্তোষি প্রকাশ করে ফাইল এগিয়ে দিলো। মুরাদের পিছু পিছু হাঁটতে আরম্ভ করল। মুরাদ ফাইল ঘেঁটে দেখতে দেখতে রাদের কেবিনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু স্টাফ তাকে দেখে ‘গুড মর্নিং’ বার্তাটি জানাচ্ছে।
__
বিরতিহীন এলার্ম বেজে চলেছে। ঘড়ি জানান দিচ্ছে আটটা বাজে। রাদ ঘুমন্ত অবস্থায় টের পেয়ে টেবিলে হাতড়িয়ে বন্ধ করে দেয় এলার্ম ঘড়িটি। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ত্যাগ করে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। তৎক্ষনাৎ হুড়মুড়িয়ে এক ফালি রোদ জানালার কাঁচ ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করে। সকালের স্নিগ্ধ রোদ রাদের খুব প্রিয়। কপালে জড়ো হওয়া এলোমেলো চুলগুলো এক হাত দিয়ে সরিয়ে দেয়। সে-ই হাত কাঁচের ওপর রাখার পূর্বেই তার ফোনটি বেঁজে উঠে। দ্রুত এগিয়ে যায় বিছানার নিকট। স্ক্রিনে মামনি নামটি লিখা দেখে তৃপ্তিময় মৃদু হেসে রিসিভ করে বলল,
‘গুড মর্নিং মামনি।’
রেহানা আনসারী রাশভারী কণ্ঠে জবাব দিলো,
‘মর্নিং। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে বাহিরে এসো। আমি ড্রইংরুমে অপেক্ষা করছি তোমার জন্য।’ বাক্য শেষ করেই ফোন কেঁটে দিলেন।
রাদের কপালে চিকন ভাঁজ পড়ে। সঙ্গে কিছুটা বিস্ময় বোধ করে। হঠাৎ তার মামনি সিলেট থেকে ঢাকায় এসেছে, এবং-কি তাকে না জানিয়ে। বেশ ভাবাচ্ছে তাকে। আপাতত এসব পাশে রেখে ফ্রেশ হতে যান।
রেহানা আনসারী সোফা থেকে জানালার কাছে ঘেঁষে দাঁড়াল। পরনে তার বেগুনি রঙের সিল্কের শাড়ী। হাতে সোনালী রঙের দামী ঘড়ি। চোখে রয়েছে মোটা ফ্রেমের চশমা। আদলে ফুটে আছে এক রাশ গুরুগম্ভীর ভাব। বয়স আনুমানিক চল্লিশ কি পাচল্লিশ হবে।
সিলেটি মেয়ে রেহানা। ২৫ বছর আগে রেজাউল আনসারীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। ঢাকায় রেজাউল আনসারীর নিজস্ব টেক্সটাইল ফ্যাক্টরি রয়েছে। রাদের বয়স যখন তিন বছর আমেরিকায় যাওয়ার পথে হাঁপানি রোগে আক্রান্ত থাকায়, শ্বাসকষ্টে মৃ*ত্যু বরন করেন তিনি। তারপর থেকে রেহানা আনসারীর শুরু হয় নতুন জীবনের পথচলা। স্বামীর ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে এবং ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন নি। তাদের এক মাত্র ছেলেকে পালল-পালন করার দায়িত্বর মাঝে স্বামীর বিজনেসের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তার কাঁধে চলে আসে। ঢাকার পাশাপাশি রাদ টেক্সটাইল ফ্যাক্টরি সিলেটেও নির্মাণ করেন। দ্বিগুণ হয়ে উঠে তাদের অর্থসম্পদ। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আজ তিনি এতদূর আসতে পেরেছে। এক বছর হলো রাদ তার মায়ের সঙ্গে বাবার বিজনেসে যুক্ত হয়েছেন। সিলেটের ফ্যাক্টরি রেহানা আনসারী দেখছেন। ঢাকারটি দেখছে রাদ। একটি বিষেশ কারণে তিনি রাদকে না জানিয়ে ঢাকায় এসেছেন।
‘মামনি!’
রেহানা আনসারী চৈতন্য ফিরে পান ছেলের স্বরে। সরে এসে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘বোসো।’
রাদ কোট পাশে রেখে বসলো। তিনি ওপর পাশের সোফায় বসলেন। ছেলেকে মনোযোগ সহকারে দেখেনিলেন। রাদ রুটিং অনুযায়ী কাজকর্ম করতে পছন্দ করে। অফিসিয়াল পোষাকে কোট হাতে বের হয়েছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে কথা শেষে অফিসের গন্তব্যে রওয়ানা হবেন।। রাদ শান্ত কণ্ঠে শুধালো,
‘কোনো সমস্যা?’
‘তুমি নাকি নতুন পি.এ নিচ্ছো।’
‘হ্যাঁ!’
‘ছেলে নাকি মেয়ে?’
‘ছেলে, মেয়ে মেটার না। কাজের দক্ষতা ভালো হতে হবে। ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড মামনি। তোমার হঠাৎ ঢাকায় আসার কারণ জানতে পারি?’
‘তোমার জন্য নতুন পি.এ নিয়োগ করেছি আমি।’
‘মেয়ে নাকি ছেলে?’
‘মেয়ে।’
‘পরিচয়?’
রেহানা আনসারী তার ম্যানেজার রফিকের দিকে তাকায়। আঙুলের ইশারায় তাকে একটি বার্তা বোঝায়। রফিক তার কথা অনুযায়ী বাহিরে গিয়ে ফিরে আসে ইসানাকে সঙ্গে নিয়ে। ইসানা রফিকের পিছু পিছু গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। ঈষৎ ভয় তাকে কাবু করে ফেলছে বারংবার। ইসানা রেহানা আনসারীর পাশে এসে দাঁড়ায়। তিনি ইসানাকে দেখিয়ে রাদের উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ইসানা ইবনাত। যাকে তুমি কাল রিজেক্ট করেছো।’
রাদ এক পলক তাকিয়েই ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘মামনি তাকে কেন… ‘
‘উঁহু!’ বাকি অংশ শেষ করার পূর্বেই হাত জাগিয়ে রাদকে থামান। তিনি বলেন,
‘অনেক ক্ষেত্রে পড়া শোনার দক্ষতা দেখতে হয় না। কাজ ও বুদ্ধির দক্ষতাও দেখতে হয়। ইসানা বুদ্ধিমতী, পরিশ্রমিক একটি মেয়ে। আজ থেকে ও তোমার পি.এ।’
চেহারায় বিরক্তি ভাব নিয়ে নজর ফিরিয়ে নিলো রাদ। মামনির কথার ঊর্ধ্বে কথা বলার সাহস দেখাল না। তাকে যেমন শ্রদ্ধা করে। তেমনি কিঞ্চিৎ ভয় করে চলে। ছেলের নাকমুখ কোঁচকান দেখে তাতে তার কিছু যায়-আসে না। তিনি গুরুগম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
‘অফিশিয়াল কাজের পরও সে তোমার বাড়িতে সার্ভেন্ট হিসাব কাজ করবে। তুমি তোমার নির্দেশ অনুযায়ী সব কাজ করাতে পারবে ইসানাকে দিয়ে।’
‘ইউ মিন, ওনি আমার বাড়িতে থাকবে?’ আঙুল তুলে ইসানাকে দেখিয়ে বলল রাদ।
‘অফকোর্স!’
রাদের চোখমুখে বিরক্তির সঙ্গে সঙ্গে কিঞ্চিৎ রাগ এসে ভর করল। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে ইসানার প্রতি ভীষণ ক্ষোভ জন্মাচ্ছে তার। নেহাৎ মামনি সামনে, নয়তো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে দ্বিতীয় বার ভাবতো না সে। এই সামান্য একটি বিষয় নিয়ে সিলেট থেকে ঢাকায় এসেছে তার মামনি। এর পিছনে নিশ্চয় মুরাদের হাত রয়েছে। আপাতত রাদ নীরব রয়ে যায়। রেহানা আনসারী ইসানার সঙ্গে টুকটাক কথা বলছিল। অফিসে লেট হচ্ছে বলে ড্রইংরুম ত্যাগ করল রাদ। ইসানা রাদের পিছু পিছু এলো। ওঁকে দেখে চোখমুখ ঘুঁচে এলো তার। বিরক্তি প্রকাশ করে গাড়িতে উঠে বসে। ইসানা পাশে বসতে নিলে জোরেশোরে বলল,
‘সামনে গিয়ে বসেন। আমার পাশে বসার যোগ্যতা আপনার নেই।’
অপমানসূচক কথা শুনে ইসানা মুখ মলিন করে চুপচাপ সামনে এসে বসল। ড্রাইভার গাড়ি চালাতে লাগলো।
.
.
.
.
#চলবে?
#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#সূচনা_পর্ব
#সুমাইয়া মনি
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।