তোমায় দিলাম কফির নিমন্ত্রণ পর্ব -০১+২

#তোমায়_দিলাম_কফির_নিমন্ত্রণ
By #Arifa_Afroze

#পর্ব_১
.
.
.
ক্যাফের মোটা কাঁচের ওপাশে আবছা লাল হলুদ আলোর খেলা,প্রতিবার বৃষ্টির ফোঁটায় নতুন রূপ নিচ্ছে।শব্দহীন অবিরাম ঝরে পড়া বৃষ্টির এক রূপকথার দেশ যেন কাঁচের ঐ পাশটা,মনে হচ্ছে আলতো করে তর্জনী টা ছোঁয়ালেই গ্রাস করে নিবে আমার অস্তিত্ব।হঠাৎ সেই রাজ্যে আরেকটা বৃষ্টির ফোঁটা,সাথে দুজন কপোত কপোতির কাছে আসা।

না না,রূপকথার রাজপুত্র রাজকন্যা নয়,উল্টোপাশে তাকিয়ে এই ধূসর বাস্তবতার আসল রূপ দেখলাম,আমার পাশের টেবিলে থাকা জুটির প্রেমলীলা।অমনি বিষম খেলাম আর খুব খারাপভাবে কফি ছিটকে পড়ল আমার অনেক সাধের বেগুনি কুর্তি টার উপর।কফি মগ নিচে নামিয়ে টিস্যু দিয়ে মুছতে শুরু করলাম,এর মাঝেই চোখ গেল আমার বাম হাতের স্মার্ট ওয়াচ এর দিকে আর চিরাচরিত ভ্রু কুঁচকানো ‘আমি’ কে এক নজর দেখে নিলাম ঐ ছোট্ট স্ক্রিন এ,আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারী, বিশ্ব …..।থাক আর না বলি।সবাই জানে।একটা অভিশপ্ত দিন আমার মত চির একলা মানুষদের জন্য।

শুধু আমার পাশের টেবিল নয়,পুরো ক্যাফে জুড়েই আজ ভালোবাসার ছড়াছড়ি।নাটক সিনেমায় যে দৃশ্য দেখার জন্য অধীর আগ্রহে মগ্ন থাকি আমি,সেই একই দৃশ্য বাস্তবে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলি প্রতিবার কেন তা জানা নেই।

-করো করো,প্রেম করো সবাই।আজ আমি একা বলে!!না না,একা কেন হবো?আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আসছে তো।

মনে মনে ইহা উচ্চারণ করিয়া অনেক গর্বের সহিত যখন মোবাইল টা হাতে নিলাম,তৎক্ষণাৎ সেই ভ্রু কোচকানো ‘আমি’ কে আবার আবিষ্কার করলাম।
প্রীতির মেসেজ,

–দোস্ত মাফ করে দিস।’ও’ আজকে আমাকে সারপ্রাইজ দিতে খুলনা থেকে ঢাকায় চলে আসছে।তোর সাথে পরে দেখা করব।

কপাল।একেই বলে কপাল।আমি ড.আরুশি আরমিন বর্তমানে একটা সরকারি মেডিক্যাল কলেজে সার্জারি ট্রেইনি হিসেবে আছি তবুও সাতাশ বছরের চিরকুমারী জীবনে প্রেম কিভাবে করতে হয় সেটা পর্যন্ত শিখতে পারলাম না,পারলে কি আজ বান্ধবীর ভরসায় ভালোবাসা দিবসে এমন ক্যাফে তে একলা বসে থাকি!!রাগ,দুঃখ,অভিমান,হতাশা কিংবা সারাদিনের হাসপাতালে ডিউটির ক্লান্তি যেটাই বলিনা কেন,প্রচন্ড ক্ষুদায় অবশেষে সামনে রাখা স্যান্ডউইচ এ মনযোগ দিলাম,আর নিজেকে কাউন্সেলিং শুরু করলাম,

-মন খারাপ করিসনা আরুশি,কি হবে প্রেম করে!দেখ কত শান্তিতে আছি,এই যে যখন তখন খুশিমত কফিশপে আসতে পারছি।রিলেশন এ থাকলে এই স্বাধীনতা কোথায় পেতাম।

তবুও নাছোড়বান্দা ‘মন খারাপ’ কে সঙ্গে নিয়েই স্যান্ডউইচ শেষ করে যেইমাত্র কফির কাপে ঠোঁট টা ছোঁয়ালাম সাথে সাথে শুনতে পেলাম,

“আজ তোমার মন খারাপ মেয়ে।
তুমি আনমনে,বসে আছো।
আকাশপানে দৃষ্টি উদাস,
আমি তোমার জন্য এনে দেবো মেঘ থেকে
বৃষ্টির ঝিরিঝিরি হাওয়া,
সে হাওয়ায় ভেসে যাবে তুমি।”

ভরাট কিন্তু অসম্ভব মায়া ভরা কন্ঠ,আর তাই গানের সুরেই বরং আমি একটু বেশী ভেসে গেলাম বাইরের প্রিয় বৃষ্টি থেকে।গীটারের সুরে কখন উঠে গিয়েছি জানিনা,সামনে গিয়ে দেখলাম ক্যাফের মোটামুটি অর্ধেক মানুষ জটলা পাকিয়ে গান শুনছে।আমিও সেই মাঝারি ভিড়ের মধ্যে নিজের জায়গা করে নিয়ে সামনে এগুলাম।

অন্তরা শুরু হওয়ার আগেই গায়ক কে দেখতে পেলাম।সাদা শার্ট ,হাতা গুটানো, সাথে জিন্স এর প্যান্ট, চোখে আমার মতই হালকা পাতলা চশমা,শ্যামলা গায়ের বরণ ছেলেটা পরের লাইন গাইবার আগেই নিজের ব্যক্তিত্ব জানান দিলো তার হাসি দিয়ে।আর অমনি,ঠিক অমনি আমি যেন হারিয়ে গেলাম তার মায়াভরা হাসিতে।অবাক আর মোহে ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।

কখনও প্রেমে পড়িনি বললে ভুল হবে,কিন্তু এমন হঠাৎ কারো হাসিতে হারাইনি।কি আশ্চর্য!চারদিকের সুর মাধুরী,সংগীত,করতালি সব বাদ দিয়ে একজনের হাসির মিষ্টতায় মুগ্ধ হলাম আমি।

লোকলজ্জা ভুলে ,আশেপাশের মানুষের চাহুনি উপেক্ষা করে কিছুটা নির্লজ্জ কিন্তু প্রেমে পড়া সলজ্জ চাহনী নিয়ে এগিয়ে গেলাম।ততক্ষনে গান গাওয়া শেষ,গীটার টা পাশে নামিয়ে রাখছিল সে।হুট করেই একটা কাজ করে বসলাম যা কখনো কল্পনাতেও হয়তো ভাবিনি।সেই অপরিচিত প্রথম দেখার গীটারবাদকের সামনে গিয়ে চোখে চোখ রেখে কোনো প্রকার জড়তা ছাড়া হঠাৎ বলে বসলাম,

–এই যে হাসিমুখ আগন্তুক,এক কাপ কফি খাবেন আমার সাথে?

(( চলবে….. ))

◆◆◆◆◆

#তোমায়_দিলাম_কফির_নিমন্ত্রণ
By #Arifa_Afroze

#পর্ব_২

১৫ই ফেব্রুয়ারি,সকাল ৮:৩০

খানিকটা রেকুন এর মত চোখ,আর আউলঝাউলা চুল আমার।যে কেউ দেখলে বুঝবে সারারাত ঘুমায়নি মেয়েটা।আর ঘুমাবেই বা কেন?গতকাল যে নবম আশ্চর্য সাথে সবচেয়ে বোকার মত একটা কাজ করেছে এই মেয়েটা,তার কি সুখনিদ্রা সাজে!!ভাগ্গিস পরিচিত কেও ছিলনা।থাকলে আর অপমান থেকে আমায় বাঁচায় কে!মনে পড়তেই আবার মাথার চুল ছিড়তে শুরু করলাম আর মনে মনে বললাম,

-আরুশি,তুই একটা গাধা,গাধা,গাধা।যে আমি ছেলেদের থেকে একশ হাত দূরে থাকি সবসময়,কিভাবে অচেনা অজানা একটা ছেলেকে ইনডিরেক্ট প্রপোজাল দিয়ে বসলাম?

পরক্ষনেই মুখে একটা কেবলা মার্ক হাসি দিয়ে একাই বললাম-

–অমন মায়াভরা হাসি…..

নিজের গালে একটা থাপ্পড় মেরে বললাম,

-বাস্তবে আয় আরুশি।এভাবে কারো হাসির প্রেমে পড়া যায়না,এটা প্রেম না মোহ।মোহের দুনিয়া থেকে এবার বাইরে এসো।

অনেকদিন পর আজ দেরি করে ডিউটি তে গেলাম।আমার দিকে অপরাধী দৃষ্টি দিয়ে বারবার আমার রাগ ভাঙানোর চেষ্টায় আছে প্রীতি।কিন্তু ওর তো জানা নেই আমার মন খারাপের কারণ।শেষে আমার মন ভালো হবে ভেবে রাউন্ড শেষে আমাকে ডক্টরস ক্যান্টিন এ নিয়ে গিয়ে কফি খাওয়াবে ঠিক করল।আর সেই কফি দেখে আমার অবস্থা….

●●●
১৪ই ফেব্রুয়ারি…(বাকী অংশ)

সাধারণত ছেলেদের সাথে কথা বলতে আমার যত সংকোচ।পড়াশুনা আর কাজের ক্ষেত্রে ঠিক আছে কিন্তু এর বাইরে কথা বলতে গেলেই আমি হয়ে যাই নিশ্চুপ মূর্তি।বন্ধু মহলে অনেকদিন পর্যন্ত আমার পরিচিতি ছিল মুডি আরুশি হিসেবে।খুব কাছের কিছু বন্ধু ছাড়া কেউ কখনো বুঝতেই পারেনি মানুষের সাথে মিশতে গেলে আমার জড়তার বিষয়টা।সেই আমি মোটামুটি ত্রিশজন লোকের সব ধরনের চোখের ইশারা অবজ্ঞা করে কারো হাসিতে মাতাল হয়ে তাকে গিয়ে বললাম,

— এই যে হাসিমুখ আগন্তুক,কফি খাবেন আমার সাথে?

সামনে থাকা মানুষটার চেহারা মুহূর্তে বদলে যাওয়া কিংবা সেই গম্ভীরতা থেকে তিরস্কার এর হাসি অবধি মুখভঙ্গি কোনোকিছুই আমার দৃষ্টি এড়াল না।তবুও কি এক মোহে নির্লজ্জের মত উত্তরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলাম।এবার সে মুখ খুলল,

–ধন্যবাদ।আমরা কি একে অপরকে চিনি?

–কফি খেতে খেতে পরিচিত হতেও তো পারি।

আমার নির্লজ্জ জবাব।

চিরাচরিত সেই হাসি দিয়ে স্টেজ থেকে নামতে নামতে ছেলেটি আবার বলে উঠল,

–পরিচয়টা যদি ভুল মানুষের সাথে হয়ে যায়,তখন?

–ভুল ঠিক তো আপেক্ষিক বিষয়।কোন পরিস্থিতি, কোন মানুষের জন্য ভুল সেটা আগে থেকেই বিচার করা কি ঠিক? হতেও তো পারে আমি সবচেয়ে সঠিক মানুষটার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে।

–আপনি খুব স্মার্ট।কিন্তু হয়ত আজকের পরিস্থিতি সঠিক নয় আপনার আমার কারো জন্যই,সেটুকু বলতে পারি।তাই আপনার নেমন্তন্ন গ্রহণ করতে পারলাম না,দুঃখিত।

কথাগুলো বলেই হাতের গিটার টা কাঁধে নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলে আমি ফের বলে বসলাম,

–তার মানে অন্য কোনো পরিস্থিতি হলে মানুষটা ঠিক হত হয়ত?

আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে আর একবার মাতাল করা হাসি দিয়ে বলল,

–হয়ত!! কে জানে আবার হয়ত কোনোদিন এক সঠিক পরিস্থিতিতে আপনার সাথে দেখা হবে,সেদিন হয়ত আমিই কফির নেমন্তন্ন জানাবো।

আমার মুখের বেকুব মার্কা হাসি দেখে কেও বলতে পারবেনা যে আমি এইমাত্র চরমভাবে প্রত্যাখ্যাত হলাম।অবশ্য সেই আগন্তুকের বিদায় হওয়ার পরে আশেপাশের সবার বিদ্রুপাত্মক হাসি আমার অবস্থান জানিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলোনা।তাই কোনোরকমে নিজ টেবিল এ গিয়ে ব্যাগটা নিয়ে দ্রুতপায়ে ক্যাফের সেই মোটা কাঁচের ড্রিম ক্যাচার লাগানো দরজা দিয়ে থেকে বের হয়েই এপাশ ওপাশ আবার তাকালাম,বৃষ্টিশেষের স্নিগ্ধ হাওয়ায় হয়ত সেই হাসিমুখ আগন্তুক এর দেখা আবার পাবো বলে।

●●●
সব কিছু শুনে প্রীতির হা হওয়া মুখে একটা আস্ত সিঙ্গারা ঢুকিয়ে দিলাম।বেচারি তাতেও মাইন্ড না করে হাততালি দিল আর বলল,

–আরুশি,দারুন দারুন।গল্পটা আজ ই পেন্সিল এ পোস্ট করবি।এত সুন্দর একটা গল্প লিখেছিস।

এরপর চলল আমার লেখার প্রশংসা।

আমি আর কিছু বললাম না।হয়ত সেদিন আমার জীবনের একটা গল্পই ছিল।অনুগল্প!!শুরু থেকে শেষ শুধু একটা হাসির মায়াজালে লেখা।ভাবতেই আমার ঠোঁটে একটা ভালোলাগার হাসি ফুটে উঠল।

●●●

মাঝখানে এক সপ্তাহ বেশ ব্যস্ততায় কাটল,হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা যেন হুট করে বেড়ে গেলো,রোগী দেখা,সার্জারি সব মিলিয়ে খুব একটা সময় পেলাম না আমার নির্বুদ্ধিতার কথা ভাবার।তবে হাসিমুখ সেই আগন্তুক,হুম তার কথা ভেবেছি বৈকি,নীল সাদার দুনিয়াতে হাতড়ে বেড়িয়েছি যদি দেখা পাই এই ভেবে।যে হাসির মায়াজালে জড়িয়েছি তা থেকে বের হতে সময় লাগবে বেশ বুঝতে পেরেছিলাম।

●●●
২৭ফেব্রুয়ারি…

সপ্তাহের ক্লিনিক্যাল মিটিং টা মিস করলাম আজ।বৃষ্টির কারণে গাড়ি পেতে দেরি হওয়ায় সব ওলট পালট হয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে ওয়ার্ড এ গেলাম,আজ নিশ্চিত আসাদ ভাইয়ের গালি খাবো।ব্যাগ থেকে বৃষ্টির পানি ঝাড়তে ঝাড়তে ডক্টরস রুমে ঢুকে দেখি প্রীতি ছাড়া আর কেও নেই।প্রীতি তড়িঘড়ি করে ঐ অবস্থায় আমায় টেনে বলল,

–চল তাড়াতাড়ি।আসাদ ভাই সবাইকে সি এ এর রুমে ডাকছে।

–আমাদের তো সি এ পোস্ট খালি গত তিন মাস ধরে।ঐ রুমে কি করে সবাই?

–নতুন সি এ জয়েন করবে আজকে,ভুলে গেছিস নাকি?

–ওহ হো!আমার তো খেয়াল ই ছিলনা।চল।

রুমে ঢুকতেই শুনতে পেলাম আসাদ ভাই নতুন সি এ এর সাথে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন,প্রথমে ছোট থেকে শুরু ,আমাদের ইন্টার্ন ডক্টরস তারপর আমাদের ট্রেইনি দের পরিচয়ের পালা।আমার নাম টা নেয়ার সাথে সাথে চিরাচরিত ভদ্রতার হাসি জড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম।আসাদ ভাই বলে উঠলেন,

–রেশাদ, এ আমাদের সবচেয়ে সিনসিয়ার ট্রেইনি ,ডক্টর আরুশি আরমিন।

মুহূর্ত থমকে যাওয়া শুনেছিলাম,প্রেমে পড়লে হয়। কিন্তু কোনও সাইক্লোন এর মধ্যে যদি মুহূর্ত স্থবির হয়ে যায় তাহলে কেমন লাগবে? কেমন লাগবে একবার দেখায় মুগ্ধ করা সেই ‘হাসির’ মালিক হাসিমুখ আগন্তুক হঠাৎ চলে আসে আপনার সামনে?

ডক্টর রেশাদ হাসান চৌধুরী,আমার হাসিমুখ আগন্তুক।

(( চলবে…. ))

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here