তোমার পরিনীতা পর্ব ১০+১১

তোমার পরিনীতা -১০

( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিনীতা গল্পের ছায়া অবলম্বনে)

লেখিকা- ফায়জা করিম

( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)

“তুই তো ছিলি
মনের দেয়াল জুড়ে
রাতের তারার সাথে
আমার আকাশ আলো করে। ”

সুমন ব্যাগ কাঁধ থেকে নামাতেই প্রীতি দৌড়ে এসে জানালো শ্রাবনদা নাকি ওকে ডাকার জন্য এ পর্যন্ত তিনবার লোক পাঠিয়েছে। কি একটা কাগজ বলে খুঁজে পাচ্ছে না।

সুমনের বুক ধরফড় করতে লাগলো দুশ্চিন্তায়। এই কয়দিন আগের মতো শ্রাবনদার ঘরে যায়নি ও, শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে প্রতিবারই বড়মার সাথে দেখা করে চলে এসেছে। এখন শ্রাবণদা ঠিক কোন কাগজটার কথা জিজ্ঞস করছে সুমন বুঝতে পারছে না।

প্রায় উড়ে যাওয়ার মতো গতিতে শ্রাবণের ঘরের দরজায় পৌঁছাল সুমন।

“আমায় ডাকছিলে…. ”

সুমনের ডাকে ঘোর ভাঙ্গলো শ্রাবণের। এতোক্ষন একমনে বড় জানালাটার সামনে দাড়িয়ে বাসার পিছনের শিমুল গাছটা দেখছিলো সে। শিমুল ফুলের লাল টকটকে রঙটা বরাবরই শ্রাবনের খুব পছন্দের। গাঢ় লাল রঙটা যে জীবনের স্পন্দন……

“শ্রাবণদা ”

বহুদূরে… কল্পনার সুতোয় ভর করে কি একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করছিলো শ্রাবণ আনমনে, কিন্তু চিরচেনা সেই ডাকটা টলটলে জলের উপর ওর একে চলা প্রতিবিম্বকে নেড়েচেড়ে একেবারে দিশেহারা করে দিলো।

“প্রীতি বললো তুমি নাকি আমায় খুঁজছিলে? ”

“এখন তবে পাইনা
কেন খুঁজে?
রঙিন ঘুড়ি নতুন লাটাই
কেন আজ অন্য কারো হাতে? ”

উত্তর দেবার জন্য খানিকটা সময় কোন কথা যোগালো না শ্রাবনের মুখে। তিন চারদিন সুমনের মুখটা একদম চোখের সামনে আসেইনি বলা চলে। এখন হঠাৎ করে সুমনের মুখে নিজের নামটা শুনে কেমন একটা ভাঙচুর শুরু হলো বুকের ভিতরে, কয়েক সেকেন্ডের একটা কাঁপন উঠলো আর তাতেই গোটা দুনিয়া থরথর করে কেঁপে উঠলো। অভিমানের আর অনুযোগের বিশাল এক অদৃশ্য দেয়াল আছড়ে পড়লো দুজনের মাঝের বাতাসে আলোড়ন তুলে।

নিজের নামটা… ওই মুখে প্রতিদিন শুনতে শ্রাবণ এতোই অভ্যস্ত যে কখনো সেটা থেমে যেতে পারে…. এটা ওর মনে কখনো ঠাঁই পায়নি। আজ তার কাজের তাড়া নেই, আজ সুমন দিব্যি সুস্থ… তাহলে আজও এতোটা সময় সুমন কেন অনুপস্থিত ছিলো? আজ হিসেবের খাতায় তার বড় রকমের গরমিল চোখে পড়েছে। শ্রাবণের বিরক্তি তাই তুঙ্গে।

সুমন জানেনা ওর এই রিনেরিনে সুরেলা ডাকটা শ্রাবণের কাছে মর্নিং প্রেয়ারের মতো, প্রতিদিন শোনার পর দিনটা ঝরঝরে হয়ে যায়। মনে হয় মাত্রই এক কাপ কফি খেয়ে দিন শুরু হলো… আসলে গত তিন চারদিন ধরেই এই ডাকটাকে খুব মিস করেছিলো সে।

কিন্তু শ্রাবণের মনের ভিতরে অস্থির এক জ্বালা, অসহ্য এক যন্ত্রনা কুড়েকুড়ে খাচ্ছে সেই কখন থেকে। সুমন ওকে জেনে বুঝে অপমান করেছে, ঠিক ওর চোখে আঙ্গুল দিয়ে বোঝাতে চেয়েছে যে শ্রাবণ না থাকলেও সুমনের এখন চলবে, এটা শ্রাবণ মোটেই মানতে পারছে না।

সুমনের উপর ছোটখাট একটা অভিমানের পাহাড় জমে গেছে শ্রাবনের ঘন্টা খানেকের মধ্যে।

“এদিক তাকাই ওদিক খুঁজি
নীল ফটকের মাঝেই বুঝি
তোর নামেরই উড়োচিঠি
মুখ লুকিয়ে আছে।”

কিন্তু সেটা অভিমান না বিরক্তি, দরজার ওপাশে দাড়িয়ে থাকা সুমনের পক্ষে সেটা আদৌ বোঝা সম্ভব হলো না।

সুমন কেবল খেয়াল করলো যে শ্রাবণের লম্বা চোয়ালটা আগের চেয়ে আরও একটু শক্ত হলো। চোখের চাউনিতেও কি যেন একটা গড়বড় চোখে পড়ছে… বকা খাওয়ার ভয়ে মুখ শুকিয়ে এলো সুমনের। ভয়ে ভয়ে দুতিন বার ঢোক গিললো…

“কোন কাগজটা খুঁজে পাচ্ছো না শ্রাবণদা? আমি তো এ ক’দিন তোমার কাগজ পত্র কোন কিছুতে হাত দেইনি।”

কিন্তু সুমনের এই সোজাসাপ্টা উত্তর তো চায়নি শ্রাবণ। হাত দিয়েছে কি দেয়নি সেটাতো বড় কথা না, কথা হচ্ছে মহারানী অসুস্থ শরীর ঠেঙ্গিয়ে যদি চারুদের বাসা অব্দি যেতে পারে তাহলে শ্রাবণের ঘরে নয় কেন? শ্রাবণের ঘর কি চারুদের বাসার চাইতে দূরে? নাকি চারুর পরে আজকাল গুরুত্ব পায় শ্রাবণ 😤

“কেন? হাত কেন দেওয়া হয়নি? নাকি পড়াতে পারবনা বলে তুই গুছানোর চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিস একেবারে। ”

প্রশ্নতো নয়…. মনে হলে গুমগুম করে কালো কালো তুলোর মতো এক দঙ্গল মেঘ হুড়মুড় করে সুমনের মাথার উপর ভেঙ্গে পড়লো। বাবা কি রাগ হয়ে গেছে… সুমন ভয়ে চোখ নামালো। ও কিছুতেই ওই চোখে তাকাবে না, ওই চোখে তাকালে সুমনের আবার সর্বনাশ হবে, আজকাল ওই চোখে অহরহ পুড়তে ইচ্ছে হয় সুমনের।

ইশশশশ… সুমন তুই মরবি….

আবার ওই বিশ্রী ভাবনা জড়িয়ে ধরছে ওকে।

“কি হলো…. কঠিন কাজ দেখে হাঁফিয়ে গেছিস বুঝি?” যতোটা বিষ বুকের মধ্যে টগবগ করছে বলকে কথার সাথে মিশে উঠে আসতে চাইলো শ্রাবণের। এই জ্বালা বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারছেনা ও নিজেই। বিষের তেজ বড় বেশি কিনা? কিন্তু সুমনের এতো আস্পর্ধা ওকে গ্রাহ্যি করে না!

শ্রাবণের এমন উদ্ভট প্রশ্ন শুনে ভিতরে ভিতরে ভড়কে গেল সুমন….. এ আবার কেমন কথা।

“কি রে উত্তর দিচ্ছিস না কেন?”

“ওরকম কিছু না… বিশ্বাস করো শ্রাবনদা, মাঝখানে অসুস্থ ছিলাম বলে পড়া নষ্ট হয়েছে অনেক, তাই একটু বেশি পড়ে সেটা পুষিয়ে নিচ্ছিলাম,” সুমন জেরার মুখে দ্রুত সামাল দেয়ার চেষ্টা করলো। কোন জরুরি কাগজ নিশ্চিত হারিয়েছে, না হলে এতো তো রাগ হয়না কখনো টেবিল গোছানো নিয়ে।

“বই নিয়ে আয় যা ”

“অ্যা…. ” সুমন কি করবে বুঝতে পারলনা। মাত্রই তো পড়ে এলো চারুদের বাড়ি থেকে। আজ কি পড়া দিবস নাকি?

“সবগুলো বই এখুনি নিয়ে আসবি.. কদিন অসুস্থ ছিলো বলে ছেড়ে দিয়েছি আর অমনি উনার পাখনা গজিয়েছে। চরম স্বার্থপর একটা মেয়ে.. বেঈমানের বেঈমান, “বিরবির করে কথাটা শেষ করলো শ্রাবণ।

সুমন অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলো। ও তো বকার ভয়ে পড়া ছাড়েনি। কিন্তু যার ভয়ে পড়া ছেড়েছে সে তো এখনো ওর পিছু ছাড়েনি। কিন্তু শ্রাবণদাকে যে সে কথা বলা বারণ।

“তুই কি ইদানিং সত্যি কানে কম শুনিস সুমো নাকি ভাব ধরিস আমার সামনে।”

শ্রাবনের কথায় এতটুকুন হয়ে গেলো সুমনের মুখটা। শ্রাবনদা শুধু শুধুই ওকে ভুল বুঝছে… বেঈমানি করবে না বলেই তো ও নিজেই যা পারে একা একা পড়ছিলো। তাই দেখে চারুর মা মনোরমা মাসি ওকে বললেন ওনার পিসতুতো ভাই আদিত্য নারায়ন নামকরা এক কলেজের টিচার। কিন্তু সামনে তার বিদেশে যাওয়ার কথা আরও বড় ডিগ্রী করবে বলে, তাই এখন চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।

তবে আদিত্যর যাবার তারিখ এখনো ঠিক হয়নি, তাই চারুদের বাসায় বেড়াতে এসেছেন ছুটির ফাঁকে। সেদিন মনরোমার মুখে সুমনের বিপদের কথা শুনে আদিত্য নাকি বলেছিলো যে, সুমন ইচ্ছে হলে চারুর সাথে আদিত্যর কাছ থেকে কয়েকটা বিষয় দেখে নিতে পারে, কোন টাকা পয়সা দেয়া লাগবেনা।

একথা শুনে মঞ্জু মামীও আর তেমন গাই গুই করেননি।

কিন্তু এখন শ্রাবণদা যেরকম সিংহের মতো কেশর ফোলাচ্ছে তাতে তো সুমনের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া… এতো কঠিন উত্তর মেরুর বরফের মতো ঠান্ডা সুরে কথা বললে তো সুমনের নিউমোনিয়া,টাইফয়েড সব হবে, কেউ বাঁচাতে পারবেনা।

“কি হলো এখনো সঙ এর মতো দাড়িয়ে আছিস কেন? ”

“যাচ্ছি… ”

সুমন পায়ে পায়ে শ্রাবণের রুম থেকে বের হয়ে আসলো। আজ কি ওর উপর দিয়ে সব ফাড়া একসাথে চলবে……

………………………………….

খাতা উল্টাতেই অপরিচিত হাতের লেখাগুলো যেন নাচতে নাচতে এসে খোঁচা মারতে লাগলো শ্রাবণের চোখে। যতো দ্রুত সম্ভব আগের পাতাগুলো উল্টে নতুন একটা পাতা খুললো শ্রাবণ। এরপর খসখস করে কি একটা লিখে সুমনকে এগিয়ে দিলো, “নে পুরো পাতাটা জুড়ে এই লাইনটা লিখ।”

সুমন লিখতে গিয়ে থতমতো খেয়ে থেমে গেলো। শ্রাবণ খাতার উপর গোটা গোটা অক্ষরে লিখে রেখেছে ‘আর কোনদিন পড়ার খাতায় আজেবাজে জিনিস লিখবো না। লিখলে শ্রাবণদা যা শাস্তি দিবে সেগুলো নিঃশব্দে মাথা পেতে নিব, কারো কাছে কোন ভাবেই নালিশ করবো না।’

“শ্রাবণদা আমি কোন আজেবাজে জিনিষ লিখিনি,” সুমন মরিয়া হয়ে বলে বসলো। আজ শ্রাবনদার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই যে ওর পিছনে এসে লাগছে। ওর পুরো খাতাতেই কেবল দরকারি জিনিস লেখা।

“একটা চড় খাবি কিন্তু সুমো… আমি দিব্যি দেখছি তোর খাতায় অন্য মানুষের হাতের লেখা। নিশ্চই সিনেমার গান ফান লিখিয়েছিস কাউকে দিয়ে আবার।”

“বিশ্বাস করো ওটা চারুর মামা আদিত্য বাবুর হাতের লেখা, উনি আমাদের কিছুদিন পড়া দেখিয়ে দিতে রাজী হয়েছেন।”

“তুইতো আছিস দিব্যি
আমার মনের অসুখ হয়ে,
ছাড়তে গেলেও পাইনা ছাড়া
বুকে ভীষন বাজে।”

“চারুর মামা তোর পড়া কেন দেখাবেন, তোকে পড়িয়ে তার লাভই বা কি? আর চারুর মামার কাছে তুই পড়তেই বা যাবি কেন? ” এই প্রশ্নটা করার জন্য ভিতরটা একদম মুখিয়ে ছিলো শ্রাবণের। করতে পেরে খানিকটা জ্বালা কমলো ওর।

“বারে উনিতো একটা কলেজের স্যার। কিছুদিন পরে আবার বিদেশেও চলে যাবেন আরও পড়তে। তখনতো আরও অনেক দামী শিক্ষক হয়ে যাবেন, তাই না শ্রাবণদা?” সুমন সাধারন ভাবেই কথাটা বললো। কিন্তু যাকে করলো তার ভিতরের ছাই চাপা আগুনটা আবারো ধ্বক করে জ্বলে উঠলো। সুমনের আজকাল তবে বিদেশি টিচার দরকার।

“হবে হয়তো কিন্তু তোমার এই ইন্টার পাশের জন্য এদেশের কলেজের শিক্ষকরাই যথেষ্ট। বিদেশি টিচারের হাত পা ধরার কোন প্রয়োজন হয় না তাতে।” শ্রাবণের বলার ধরনটা মোটেই সুবিধার মনে হলোনা সুমনের।

“তা অবশ্য ঠিক।”

“এখন যা লিখে দিয়েছি সেটা আগে শেষ করে দেখাবি, তারপর আমি তোকে পড়া বোঝাবো।”

“এতক্ষণ তো পড়েই এলাম আদিত্যবাবুর কাছ থেকে।”

“তো…… তার কাছে ওই দু’চার লাইন পড়াই তোর কাছে এখন একদম শ্রেষ্ঠ পড়া হয়ে গেছে মনে হচ্ছে?” ঝাঁঝিয়ে উঠলো শ্রাবণ।

“আমি তা বলিনি শ্রাবনদা। তুমি শুধু শুধু আমাকে ভুল বুঝছো। আমি মাত্রই এলাম ওখান থেকে, এখনও কিছু খাইনি, ওষুধও খাওয়া হয়নি।তাই বলছিলাম কিছু খেয়ে আসি?”

সুমন পালানোর কোন রাস্তা পাচ্ছে না।

খাওয়া হয়নি শুনে এবার একটু নরম হলো শ্রাবণ কিন্তু সুমনের দেয়া তথ্যগুলো তে শ্রাবণের রাগ আরও একধাপ বেড়েছে। বিদেশে যাওয়া টিচারের কাছে পড়ে মুখে খই ফুটছে ম্যাডামের। তাই আজ ওর কোন ছাড়াছাড়ি নেই।

“তুই নাস্তা খাসনি এটা কোন সমস্যা না। তুই লিখতে শুরু কর, নাস্তা রাজুকে বললেই দিয়ে যাবে।”

“আমি বড়মার কাছে চেয়ে খেয়ে আসি?”

“না, আমিও নাস্তা খাইনি, তুই লেখ আমি দেখছি।”

সুমন মনে মনে প্রমাদ গুনলো,আজ ওর এমনি তলপেট মোচরাচ্ছে বিশেষ দিন বলে আর শ্রাবনদার আজই ওকে পাকড়াও করা লাগলো। চারুদের বাসায় বসে থাকতেই ওর যন্ত্রনা হচ্ছিল খুব। বাড়ি এসেও দু দন্ড বসতে পারেনি। এখন শ্রাবনদার হাত থেকে কি বলে ছাড়া পাওয়া যায় সেটা বসে বসে ভাবতে লাগলো সুমন।

খানিকবাদে রাজুকে সাথে নিয়ে ঘরে ঢুকলো শ্রাবণ।

সুমন তাকিয়ে দেখে থালা ভরে খাবার সাজানো। অন্যদিন খাবারগুলো দেখলে খেতে লোভ লাগে ওর কিন্তু এই মুহুর্তে ওর প্রান যায় যায়, এখন ভালো খাবারেও ওর গা গুলোচ্ছে।

“শ্রাবনদা তোমার সেই কাগজটা কি খুঁজে পেলে? না পেলে আমি বিকেলে এসে খুঁজে দেবখন কিন্তু এখন আমি যাই। বড্ড যন্ত্রনা হচ্ছে।”

শ্রাবণের হাসি হাসি মুখটা হঠাৎ মিইয়ে গেল। সুমোর কোমরের যন্ত্রনাটা বোধহয় বেড়েছে।

“আচ্ছা তাহলে তুই বাড়ি যেয়ে শুয়ে পড়। ”

যাবো? সত্যি বলছো… পরে আবার মারধোর করবে নাতো?

সুমনের কথায় কি না জানেনা তবে শ্রাবণের ভিতরে খচ করে আবার নতুন একটা কাঁটা ফুটলো। সুমোর বোধহয় ওর বকাবকি করাটা, অধিকার ফলানোটা আদতেই পছন্দ নয়, শ্রাবনই ভুল ছিলো… ও অযথা মায়ের উপর রাগ হচ্ছিলো। অভিযোগটা তাহলে বোধহয় সুমোরই ছিলো। তা না হলে ওভাবে জিজ্ঞেস করতো না। শ্রাবণের এই প্রথম কেমন যেন নিজেকে ভারী অসহায় মনে হলো।

সুমনের দায়িত্ব নিতে ওকে কেউ কোনদিন জোর করেনি বরং সুমনের ছোট মুখটা দেখলেই ওর ভিতরে কেমন একটা অদৃশ্য টান তৈরি হতো। সেই অদৃশ্য টানই ওকে দিয়ে এতোটা বছর সুমোর জন্য যাবতীয় সব ছোট – বড় কাজ করিয়ে নিয়েছে কেবল প্রতিবেশী হওয়া সত্বেও। শ্রাবণ কখনও ভাবেইনি সুমনকে শাসন করা ওর এখতিয়ারের বাইরে।

ও যেমন সুমনকে এতোকাল বিশেষ স্নেহ দিয়েছে বিনিময়ে সুমনও ওকে তার সমস্ত কিছুর অভিভাবক বলে মেনে নিয়েছে। কিন্তু এতোকাল পরে সেই নিয়মে অন্য কোন সুর কেন শুনতে পাচ্ছে শ্রাবণ।

“ছাড়বিনা বল ছাড়বো তবে
বুকের ব্যাথা কমবে কবে?
একটু কান্না একটু হাসি
বলবি কবে ভালোবাসি। ”

চলবে…..
তোমার পরিনীতা – ১১

( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিনীতা গল্পের ছায়া অবলম্বনে)

লেখিকা- ফায়জা করিম

( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)

“নির্মলা…… ছেলেকে বলেছো সময় মতো বাসায়, থাকতে? ” রামনাথ পাঞ্জাবীর বোতাম লাগাতে লাগাতে জিজ্ঞেস করলেন। একটু পরেই সব মেহমান আসতে শুরু করবে।

“বলেছি… ”

“তারপরও যদি তোমার গুনধর ছেলে মনের ভুলে হাওয়া খেতে চলে যায় তাহলে তুমি আমায় কিছু বলতে পারবে না,” জোরোর সাথে আলমারির দরাজাটা বন্ধ করলেন নির্মলা।

আজ সকাল থেকে প্রচন্ড গরমে নেয়ে একাকার হচ্ছেন তিনি। ওদিকে বড় বৌমা কিছুই খেতে পারেনা, একেবারেই দুর্বল হয়ে গেছে। কাল তাই তার বাপ- মা এসে নিয়ে গেছে। তার একটা খবর যে তিনি নেবেন সে সময়টা অব্দি নির্মলা করতে পারছে না। এখন সুমন আসলে তাকে দিয়েই বন্দনার একটা খবর নেয়াতে হবে ভাবলেন তিনি।

“হমম, ” বলে ঘর থেকে বের হলেন রামনাথ। আজকাল ছাব্বিশ, সাতাশ স্কোয়ার ফিটের উপর যে ফ্ল্যাট বাড়ি গুলোই দেখেন সবগুলোই বেশ মনে ধরে তার। ইচ্ছে আছে দুই ছেলের জন্য দুটো আলাদা প্লটে বাড়ি তুলে দেবার। ছড়ান ছেটানো এতো জায়গা ফেলে না রেখে ফ্ল্যাট করলে ওদের পক্ষে মেইনটেইন করাটা অনেক সহজ হবে।

আসলে রামানাথ চৌধুরী অপেক্ষা করছেন পাশের বাড়ির বীরেন বাবুর বাড়িটি কিনবার জন্য। এক সময় বীরেন বাবুও বেশ দুদে উকিল ছিলেন। কিন্তু বীরেন বাবুর ছেলে সমীর তেমন উন্নতি করতে পারেনি, কোনমতে এম এ পাশ করে একটা বেসরকারি চাকরিতে ঢুকেছে। বেতন যদিও তেমন ভালো না তবু সমীর চাকরিটা করছে বহু বছর, কারন বর্তমান বাজারে চাকরির বড় অভাব আর বেকারের সংখ্যা অগুনিত। এছাড়া ছেলে অনুজকে বিদেশে পাঠাবার সময় অনেক টাকা লোন করতে হয়েছে সমীরকে, তার সিংহভাগই রামনাথের কাছ থেকে নেয়া। রামনাথও খুশি হয়েই দিয়েছে। একটা সময় এতো বড় বাড়ি ওরা আর চালাতে পারবেনা। তখন এমনিও বেচবে আর অমনিও বেচেবে। তাই সুযোগের অপেক্ষায় আছেন রামনাথ। সমীর আরও একটু অভাবে পড়লেই তিনি মোচড়টা দিবেন টাকার জন্য। আর হুট করে বেশি টাকা যে সমীর যোগাড় করতে পারবেনা সেটা রামনাথ স্পটই জানেন। তার কেবল দরকার একটু ধৈর্য ধরবার অপেক্ষা।

বীরেন বাবুর বাড়িটা কেনা হলেই দুই ছেলের নামে দুটো আট তলা বাড়ি তুলে ফেলবেন রামনাথ। বড় ছেলে শান্তনু এমনিতেই বৈষয়িক,তাকে নিয়ে রামনাথের তেমন কোন টেনশন নেই, যতো টেনশন এই ছোট ছেলেটাকে নিয়ে। দেয়া থোয়ায় সে ওস্তাদ, বন্ধু- বান্ধবরা কেবল চাইতে যা দেরি, নইলে শ্রাবণের কাছে চেয়ে পাবেনা এমন লোক খুব কম আছে। তাই বন্ধু মহলে সে বেশ সুপরিচিত।

শ্রাবণের যেন সর্বদা দেয়ার তাড়া থাকে। সমীরের ভাগ্নিটাকে ওই টাকা পয়সা দিয়ে মানুষ করে দিলো। ভবিষ্যতে বিয়ের খরচাটাও হয়তো চৌধুরী বাড়িকেই বইতে হবে। রামনাথের স্ত্রী নির্মলাও সুমন মেয়েটাকে যথার্থ ভালেবাসে। তাই বিয়ের খরচটা দিতে রামনাথের বিশেষ কোন আপত্তি নেই। এলাকায় তারা বিত্তশালী হিসেবেই সুপরিচিত। রামনাথের চাওয়া কেবল একটাই, কোন ক্রমেই ও বাড়িটা যেন বেহাত না হয়।

“কেউ কথা রাখেনি ভালোবাসেনি
কেউ চুপি চুপি পায় কাছে আসেনি,
কেউ গোধূলি বেলায় দু’হাত বাড়িয়ে
খুব আদর মেখে আর ডাকেনি।
আর ডাকেনি..”

সুমন চুপচাপ বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবছিলো। ওর এমন কেন হলো? সুমন এখন কি করবে? কে ওকে বাঁচাবে, কে ওকে উপায় বলে দিবে… কি করলে এমন যন্ত্রনা কমে। সুমন এতোকাল যে কোন ধরনের সমস্যায় একটা লোকের উপরই নির্দ্বিধায় নির্ভর করে এসেছে, তার শ্রাবণদার উপর। আজ সেই মানুষটার কাছে একটা সৎ বুদ্ধি নেবার উপায় ওর নেই .. এর চেয়ে বড় বিপদ আর কি হতে পারে।

খানিক আগে ও বাড়ির কাজের লোক এসে ডেকে গেছে একবার সুমনকে। বন্দনা বৌদিকে ফোন করে বড়মার সাথে কথা বলিয়ে দিতে হবে। কিন্তু গেলেই যে আবার শ্রাবণদার সাথে দেখা হবে… আর দেখা হলেই ওর বুকে ভালো লাগার অনুভূতির ছোট ছোট দুলুনি উঠবে আর সেই দুলুনির ধাক্কায় ওর ছোট্ট পালের নৌকটা কোন ঘাটে গিয়ে ভীড়বে তার কোন ঠিক আছে?

আজ বাদে কাল শ্রাবনদার বিয়ে হয়ে যাবে দিপ্তী নামের মেয়েটার সাথে। এমন অবস্থায় কোথায় সুমন, শ্রাবনদার বিয়েতে নাচবে, গাইবে, ফূর্তি করবে কি…. উটকো এক রোগ বাঁধিয়ে বসে আছে। নিজেকে তুই তোকারি করতে করতে মেরে ফেলছে সুমন… রাগে কতক্ষণ নিজের চুল মুঠি করে টেনেছেও, ও অন্ধ কেন হলোনা?

“সুমনদি তুমি এখনও শুয়ে আছো? বড়মা যে তোমায় ডাকতে লোক পাঠিয়েছে। ”

প্রীতির কথাটা শুনে হুড়মুড় করে উঠে বসলো সুমন।

“কে এসেছে… তাকে বল আমি যাচ্ছি এক্ষুনি।”

“বাগানের মালীর মেয়ে নয়ন, আমি এমনি বলে দিয়েছি যে তুমি যাচ্ছো।”

সুমন পেটের কাছের বালিশটা সরিয়ে উঠে দাড়ালো। চারদিকে সন্ধ্যা নেমে আসছে। পাখির ডাকগুলো কেমন অস্থির, যেন দিন শেষে ভীষন ঘরে ফেরার তাড়া ছিলো। তারপর একদম চুপচাপ,কেবল ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। সুমন চোখের জলটুকু মুছে নিলো। ওরও ভীষন ঘরে যেতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু সত্যিকারের ঘর মেলা যে সহজ নয়… অনেক সাধ্য সাধনার ব্যাপার, বড় কপাল করে আসতে হয় ঘর পেতে হলে।

সুমনকে দেখেই বাটিতে গাজরের হালুয়া তুলে দিলেন নির্মলা। সুমন কথা না বলে বাটিটা হাতে নিয়ে খেতে বসে গেলো। আজ সারাদিন ব্যাথার জ্বালায় ও বিছানাতেই পড়ে ছিলো শ্রাবণের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে। এখন খাবার দেখেই পেটে ছুঁচো নাচা শুরু করেছে।

“সুমনদিদি দাদাবাবু ডাকছে… ” রাজু চায়ের কাপ বেসিনে ধুতে ধুতে বলে গেলো।

“শ্রাবনদা কি এখন রেগে আছে বড়মা? ”

“রেগে আছে কি না জানিনা তবে তোর কাকাবাবু আজ ওকে বাসার বাইরে বের হতে দেননি, সেই রাগে বাবু দুপুরে কিছু খায়নি, বিকেলে অবশ্য লুচি করে দিয়েছিলাম। এখন রাগ পড়েছে কি উঠেছে তা জানি না। ”

“সেকি দুপুরে কিচ্ছু খায়নি?” সুমনের মুখের হালুয়া মুখে রয়ে গেলো।

“খেয়েছে লুচি, সে নাকি বাড়ির কেউ না।”

“আমি কি একটু হালুয়া নিয়ে যাবো বড়মা… খেতে ভালো স্বাদ হয়েছে,” সুমনের মনটা খারাপ হয়ে গেছে। শ্রাবনদা সহজে খাবার বন্ধ করেনা। কাকাবাবু কি অনেক বকলো?

“নিয়ে গিয়ে দেখ… খেলে তো ভালই। বাবার উপর রাগ সেটা আমার উপর ঝাড়া কেন বাপু… আমি তো তাই বলেছি যা আমাকে হুকুম করেছে।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নির্মলা। শান্তনুটা বাবা কিছু বললে নির্বিচারে মেনে নেয় কিন্তু শ্রাবনটা শুধু গোল বাধায়। এই ছেলে নিয়ে হয়েছে তার যতো জ্বালা।

সুমন ঘরে ঢুকে দেখে শ্রাবণের আলমারি মোটামুটি লন্ডভন্ড।

“তুমি কি খুঁজে পাচ্ছোনা?”

“ও তুই এসে গেছিস, দেখতো কোন পাঞ্জাবিটা পরি?”

সুমন হেসে ফেললো। মেহমান আসবে বলে কাকাবাবু নিশ্চই ভালো কিছু পরতে বলেছে। তবে বাবুর রাগ পড়েছে।

“তুমি পাঞ্জাবি পরবে না শার্ট… সেদিন যে মেয়ে দেখতে যাবে বলে শার্ট বানাতে দিলে, ওগুলো হয়ে গেছে… আমি নিয়ে এসেছি টেইলার্স থেকে।”

“তোকে এই কথা কে বললো যে আমি পাত্রী দেখার জন্য শার্ট বানাতে দিয়েছি… যত্তোসব ফালতু কথা, ” শ্রাবণের ভ্রু ততক্ষণে কুঁচকে গেছে। অস্থির ভাবে নিচের ঠোঁটে নিচে আঙ্গুল ঘষছে সে।

“না কেউ বলেনি… আমি নিজেই মনে করেছিলাম।
কিন্তু ওগুলো একদম নতুন আর আয়রন করা আছে, পরলে পরতে পারো কিন্তু।”

“না থাক আজ পাঞ্জাবি পরি, তুই একটা ঠিক করে দে দেখি, আমার মাথা গুলাচ্ছে।”

“তো এত্তো গাদা খানিক কাপড় আরও বের করো… খালি যত্তোসব উল্টাফুল্টা কাজ করবে আর সুমো সুমো বলে চেঁচাবে। ”

“ওই… আজকে কখন চ্যাচালামরে তোর সাথে.. হ্যা… পটপট বেশি না করে আমার কাপড় ঠিক করে দিয়ে এখান থেকে ফোট।”

সুমন হালুয়ার বাটিটা ঠক করে টেবিলের এক পাশে রেখে কাপড় বাছতে লাগলো। কি সব কাপড় বের করেছে… নিশ্চই নিচের তাকের কাপড়ও সব বের করেছে। সুমন, শ্রাবণের কতগুলো কাপড় আলাদা করেছিলো রিপেয়ারিং করতে হবে বলে। সেগুলো ও আলাদা করে সরিয়েও ছিলো কিন্তু মাঝখানে কিছু দিন নানা কারনে সেগুলো ঠিক করতে দেওয়া হয়নি। শ্রাবণ সেগুলো সহ সব ঘেটে একাকার করে রেখেছে। কপাল……

সুমন খুঁজে খুঁজে গত পূজোর একটা পাঞ্জাবি শ্রাবণের হাতে ধরিয়ে দিলো,” এটা পরো এর ভাঁজ এখনো ভাঙ্গা হয়নি।”

“তোর ব্যাথা কমেছে?”

সুমন মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো। বেশি কথা না বলাই শ্রেয়, শেষে আবার লেখা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ফ্যাসাদ শুরু হবে।

“ভালো… ওষুধ নিয়ম করে খাচ্ছিস? ”

শ্রাবণ গায়ের শার্টটা খোলার জন্য বোতামে হাত দিতেই সুমন দ্রুত কিছু কাপড় বিছানা থেকে তুলে দরজার কাছে গিয়ে দাড়ালো।

“খাচ্ছি… তুমি কাপড় পাল্টে হালুয়াটুকু খাও। আমি এই কাপড়গুলো রিপায়েরিংয়ে দেয়ার ব্যাবস্থা করি।”

“হমম,”শ্রাবণ কাপড় পরায় মনযোগ দিলো।

সুমন এক দৌড়ে ঘরের বাইরে এসে দম ফেললো। এর আগে ওর সামনে হাজার দিন শ্রাবনদা শার্ট পাল্টিয়েছে কিন্তু সুমন না কোনদিন সেটা খেয়াল করে দেখেছে না ওর বুক এরকম ধুকধুক করেছে। কিন্তু আজ শার্টের বোতামে হাত দিতেই ওর নাক, কান গরম হচ্ছিলো… দৌড়ে না এসে ওর উপায় ছিলো না। শ্রাবনদা জানেও না সুমন আগের সেই লক্ষী মেয়েটা নেই, বড্ড খারাপ হয়ে গেছে।

আটটা বাজার পরপরই রামনাথ চৌধুরীর পরিচিত গণ্যমাণ্য লোকজন চৌধুরী বাড়ির গেট দিয়ে ভিতরে ঢোকা শুরু করেছে। রামনাথ ছোট ছেলেকে সাথে নিয়ে হলরুমের দরজায় এসে দাড়ালেন।

সুমন বাসার পিছনের গেট দিয়ে শ্রাবণদের বাড়িতে এসে ঢুকলো। এখন বাসার সামনের গেটে গাড়ির হাট বসেছে। সুমন তাই ওইদিকের পথই মাড়ায়নি।

সুমন শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে চলে আসতে চাইছিলো, যে আজ রাতে ও আর আসবে না চৌধুরী বাড়ি। একেতো সুমনের মন ভালোনা…. সাথে শরীরও খারাপ। কিন্তু বড়মা বলে বসলেন, “তুই একটা ব্যাথার ওষুধ খেয়ে, কাপড়টা পাল্টে চলে আয় সুমন।”

অগত্যা সুমনকে আসতেই হলো। বড়মাকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা ওর নেই। মাথায় হাত দিয়ে খোঁপার কাটা গুলো ঠিক আছে কিনা একবার দেখলো সুমন।

ও কাপড় পরে চারুদের বাসায় ঢুকতেই মনোরমা মাসি বললেন, “চুলগুলো একটু ভালো করে খোঁপা কর সুমন, ভারী সুন্দর লাগবে। ”

সুমনের ইচ্ছে না থাকা সত্বেও তাই মনোরমার কাছে গিয়ে বসেতে হয়েছে। গুরুজনের কথা উপেক্ষা করা বেয়াদবি হয়ে যায়।

মনোরমার বিউটিশিয়ান কোর্স করা আছে। চারুর চুল তিনি নিজেই কেটে দেন, মাঝেমাঝে এই সুবিধাটা সুমনও নেয়। মনোরমা খুব যত্নের সাথে বেনি করে করে সুন্দর একটা খোঁপা করলেন সুমনের লম্বা চুলগুলো নিয়ে,সাথে নিজের কয়েকটা ঝুনঝুনি দেয়া রূপার কাটাও সুমনের খোঁপায় গুঁজে দিলেন। সুমন কাটাগুলো আবারো হাত দিয়ে দেখলো ঠিকঠাক আছে কিনা।

পিছনের গোল প্যাঁচানো সিড়ি বেয়ে দোতালায় উঠতেই শান্তনুদার সাথে দেখা হলো সুমনের।

“কিরে সুমন, তোর বৌদির খোঁজ নিয়েছিলি একবারো? ”

“নিয়েছি খানিক আগেই… বৌদি বলেছে তোমার সাথে আর কোনদিন কথা বলবে না।”

“কেন আমি আবার কি করলাম? ”

“বৌটাকে বাপের বাড়ি পাঠালে বুঝি একবার খবর নিতে হয়না? ”

“আমি তো পাঠাইনি, সে নিজে সেচ্ছায় গেছে… তাহলে আবার এখন এতো তলব কেন?”

“সে যাই হোক তুমি যেয়ো কিন্তু ”

“দেখি। কিন্তু তুই আজ এতো সাজুগুজু করেছিস কেনরে ?”

“ওমা সাজগোজ কই করলাম, কেবল চোখে একটু কাজল টেনেছি।”

“কি জানি আমার তো মনে হচ্ছে পা থেকে মাথা অব্দি সেজেছিস, ” বলতে বলতে শান্তনু হলরুমের দিকে এগুলো। আরও দেরি করলে বাবার কাছে ভয়নক ধমক খেতে হবে।

হলরুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে শ্রাবণ বাবার পাশে উুসখুশ করতে লাগলো।

“কি হলো.. এমন করছো কেন? ”

“কিছু না, পায়ে মনে হয় মশা বসছে।”

“তুমি তাহলে সৌরভ বাবুর সাথে গিয়ে কথা বলো, আমি আসছি।”

“আচ্ছা…, ” শ্রাবণ কথা না বাড়িয়ে সৌরভ বাবুর কাছে এসে দাড়ালো। সৌরভ সম্পর্কে পাত্রীর বড়মামা হন আর স্বপরিবারে বিদেশে থাকেন।এর চেয়ে বেশি শ্রাবণ আর বেশি কিছু জানেনা।

শ্রাবণ এগিয়ে গিয়ে সৌরভ বাবুর কুশল জানতে চাইলো। কথায় কথায় সৌরভ জানালেন তার ভাগ্নী দিপ্তী সর্ব গুনে গুণান্বিতা। শ্রাবণ সব কথাতেই কেবল হেসে হেসে মাথা নাড়াতে লাগলো। না বুঝে উল্টোেপাল্টা কিছু না বলাই ভালো, এছাড়া এতো গুনে গুনান্বিতা মেয়ের প্রসংশা কি করে করে… শ্রাবণ এ ব্যাপারে তেমন পটু না।

“তোমার কি এখানেই থেকে যাবার ইচ্ছা না বাইরে সেটেল হতে চাও? ” সৌরভ জিজ্ঞেস করলেন। শ্রাবণ ছেলেটা দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম, ভাগ্নীর সাথে মানাবে ভালো।

“আপাতত বাইরে যাবার কোন ইচ্ছে নেই। তাছাড়া আমরা মাত্র দুটো ভাই। একজন, আরেকজনকে না দেখে বেশিদিন থাকতে পারিনা।”

“ওহহোহো… হোম সিকনেস আছে তাহলে ভালোমতো। ”

“জ্বী তাও বলতে পারেন।”

শ্রাবণের সাথে আরও টুকটাক নানা বিষয়ে কথা বলছিলো সৌরভ। হঠাৎ করেই পাশের থেকে একটা বাচ্চা এসে শ্রাবণের উপর পড়লো। বাচ্চাটার হাতে সফট ড্রিংসের গ্লাস ছিলো। গ্লাসটা ভেঙ্গে গিয়ে চুরচুর হলো, কিন্তু জুসটুকু গিয়ে ছিটকে পড়লো সৌরভের গায়ে। দামী একটা পাঞ্জাবি পরে এসেছিলেন তিনি। বেচারার মনটা যারপরনাই দুঃখিত হয়ে গেলো। রামনাথ চৌধুরী দ্রুত শ্রাবণকে বললেন সৌরভকে তার রুমে নিয়ে যেতে।

শ্রাবণ, সৌরভকে নিয়ে নিজের ঘরে যাওয়ার মুখে নির্মলা আর সুমনকে দেখে থমকে দাড়ালো।

“সুমো শোন তো…. ”

“কি হয়েছে শ্রাবণদা? সুমন, শ্রাবণের সাথের লোকটিকে চিনতে না পারলেও বুঝতে পারলো ইনিই হয়তো নতুন বৌদির মামা।

“একটা কাজ করতে হবে যে,জুস পড়ে উনার কাপড়টা নষ্ট হয়ে গেছে। চট করে আমার আলমারি থেকে একটা পাঞ্জাবি বের করে দে।”

সুমন ততক্ষণে নতুন বৌদির মামাটিকে ভালো মতো দেখে নিয়েছে। লোকটি, শ্রাবনদার মতো অতো লম্বা না হলেও কাছাকাছি তবে পেটটা একটু সৌখিন। সুমন চাবি দিয়ে আলমারি খুলে ভালো একটা পাঞ্জাবি খুঁজে বের করে দিলো দ্রুত হাতে। সৌরভ পরিচ্ছন্ন হয়ে কাপড় পাল্টে আসতে আসতে একবার পিছন ফিরে চাইলেন। শ্রাবণ তখন মাথা নিচু করে সুমন নামের মেয়েটিকে কি যেন বলছে।

………………………………………..

“শোন”

“বলো ”

“বলছি আমার কিন্তু পাত্রকে তেমন সুবিধার ঠেকছে না, শেষে দেবদাস – পার্বতী কেস না হয়। ওই মেয়ের তো দেখি শ্রাবণের কি খেলে অ্যালার্জি হয় সব মুখস্থ, এরকম হলে তোমার ভাগ্নী এবাড়ি এসে করবেটা কি?”

“মানে? “সৌরভ তার স্ত্রী লতার কথায় যথেষ্ট বিপদের গন্ধ পেলেন।

“মানে ওই মেয়েতো মনে হচ্ছে তোমাদের জামাইবাবুর ব্যাংকের ক্যাশিয়ার কাম বাবুর্চি।”

“কি বলছো?”

“হ্যাগো, আমি আড়ি পেতে শুনলাম মাত্রই। শ্রাবণ মেয়েটাকে বলছে আমার ড্রয়ারে কত টাকা থাকে কার্ডের টাকা জমা দিলে? আর মেয়েটা কিরম সব গড়গড় করে হিসেব দিয়ে দিলো। ওই মেয়ের সাথে নির্ঘাত লটর পটর আছে এই ছেলের। ”

“হমম… ব্যাপারটা একটু গোলমেলেই লাগছে।” সৌরভের চোখের সামনে খানিক আগে দেখে আসা ব্যাপারটা ভেসে উঠলো।

“একটু না অনেক, আমি বলি কি তুমি বরং ওদের না করে দাও। এই ছেলের চাইতে মহিম কিন্তু ঢের ভালো আর দিপ্তীকে মহিম অনেক পছন্দও করে।”

“দেখছি, কিন্তু দিদিকে বলবোটা কি?”

“সে আমি দেখছি, দিদিকে বুঝিয়ে বললে কোনমতেই এখানে মেয়ে দিতে রাজি হবে না। বিয়ের পরে জানলে না হয় ভিন্ন কথা, এখানে তো সতীন বিয়ের আগেই খেলেধূলে বেড়াচ্ছে।”

সৌরভও ব্যাপরটা গুরুত্বের সাথেই নিলেন। ছোটখাট অনেক ঘটনা অনেক সময় অনেক বড়বড় ঝড়ের পূর্বাভাস দেয়, এটাকে তাচ্ছিল্য করা মোটেই উচিত হবেনা।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here