তোমার পরিনীতা – ২৭
( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত পরিনীতার ছায়া অবলম্বনে)
লেখিকা- ফায়জা করিম
( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)
সুমন বুঝতে পারছেনা মৌমিতাদির বিয়েতে ওকে সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য শ্রাবনদা এতো খেপেছে কেন?
এমনিতে আজ বহুদিন পর বাড়িতে সরিষা ইলিশ রান্না হচ্ছে, তার উপর আবার আদিত্য তার এক বন্ধু সহ রাতে এ বাড়িতে খাবে। মঞ্জু মামী সকাল থেকে বাড়ি মাথায় করে রেখেছে… তার মধ্যে সুমন কি করে বলে যে ও আজ বেড়াতে যাবে?
“বড়মা আজ রাতে বাড়িতে বাইরের লোক খাবে, আমি গেলে যদি মামী রাগ করে? ” সুমন যথা। সাধ্য চেষ্টা করতে লাগলো বিয়েটা এড়ানোর কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না।
বড়মা জানালো সে মঞ্জুমামীকে সাহায্য করার জন্য পরানের মাকে পাঠিয়ে দিবে। মৌমিতাদি নাকি বারবার করে সুমনকে যেতে বলেছে নিজের বিয়েতে । সুমন কিছুক্ষন গাইগুঁই করে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিলো।
শ্রাবন যখন অফিস শেষে বাসায় ফিরলো তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। নিজের ঘরে পা দিতেই
পিচ ফলের রঙের বাহারি শাড়ি পরা রাজকন্যাকে দেখতে পেয়ে দরজাতেই থমকে দাড়িয়ে গেল সে।
কমলাটে রঙের সূর্যটা হঠাত ওর ঘরে কি করে এলো সেটাই বিরতি নিয়ে দেখলো কিছুক্ষন… টুংটাং চুড়ির শব্দ আর মসৃন শাড়ির আলতো খসখসে শব্দও যে কারও নিস্তব্ধ ঘরকে জীবন্ত করে তুলতে পারে সেটা যেন আবারো অনুভব হলো শ্রাবনের। সুমন ওর কাছে ভর দুপুরের স্নিগ্ধ বাতাস… বাতাসটা তাই বুক ভরে টেনে নিলো ও।
সুমন এমনিতে দেখতে ভারি ফর্সা নয়, উজ্জল শ্যামলা বললে বরং ঠিকঠাক মানায় কিন্তু এই মুহুর্তে সুমনকে দেখে শ্রাবণের হাল বেহাল। কাজল দেয়া চোখ দুটো যেমন তেমন, পিঠের উপর তাল করে রাখা খোঁপার কাঁটার তিনটে বল দেয়া সরু চেইনগুলো যেন হিল্লোল তুলছে ওর ধমনীতে… আগুনের ফুলকি উঠলো… সেই আগুনে রক্ত বলকে উঠতে সময় লাগলো সেকেন্ডেরও এক শতাংশ, আজকাল বেঁচে থাকাটাই যেন দায় হয়ে উঠছে শ্রাবনের।
“কি হয়েছে শ্রাবনদা? ”
“কই… কিছু হয়নিতো ”
” তবে দরজায় অমন ভাবে দাড়িয়ে রইলে কেন? শরীর খারাপ লাগছে বুঝি? ”
শ্রাবণ অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো।
সুমন খুব মনযোগ দিয়ে কিছু একটা আটকানোর চেষ্টা করছে… ওর স্ট্যাম্পবুকটায় নতুন কোন সদস্যের আর্বিভাব ঘটেছে হয়তো… শ্রাবণের মোহগ্রস্থ চোখের চাউনি তাই সুমনের ভিতরে কোন ভাবান্তর ঘটাল না, গভীর মনযোগ দিয়ে সে তার কাজ করে যেতে লাগলো।
শ্রাবনের একবার লোভ হলো, সুমনের কানের ঝুমকোটা একবার নেড়েচেড়ে দেখে… নরম ঠোঁটদুটো আলতো করে একটু আঙ্গুল ছুঁইয়ে দেয় কিন্তু পরে এক রকম জোর করেই নিজেকে সামলে নিলো সে নিজেকে। এই সাতদিনে সুমো ওর সাথে মোটে কথাই বলেনি…এড়িয়ে গেছে বুঝতে পেরে শ্রাবণও আর জোর করেনি।
যা একান্তই নিজের বলে মনে করেছে এতোকাল তার উপরই সে অধিকার খাটিয়েছে, তা না হলে শ্রাবন নিজেও জানে যে ভালোবাসা জোর করে আদায়ের জিনিস নয়। এখন নিজের পক্ষ থেকে যেটুকু ওর বলার ছিলো শ্রাবন বলেছে… বাকি পথটা একসাথে চলতে চাইলে এখন সুমোকেও হাত বাড়াতে হবে। নয়তো সময়ের টানে দুজন দুদিকে ছিটকে যাবে… সময় এসেছে কোন একটা জরুরি সিদ্ধান্ত নেবার।
তাছাড়া সুমোর মত ছাড়া মায়ের কাছেই বা কিভাবে কথা তুলবে শ্রাবণ?
” দাদাবাবু মা আপনাকে খেতে ডাকছে “রাজুর ডাক শুনে ধ্যান ভাঙ্গলো শ্রাবনের।
” আসছি যা.. ”
শ্রাবন কাপড় পাল্টে এসেও দেখলো সুমন একমনে তার কাজ করে যাচ্ছে।
” এতো কি করছিস শুনি? ”
” কিছু না একটা জিনিস বানানোর চেষ্টা করছি… মৌমিতাদিকে উপহার দিবো ”
” উপহার! সে আবার কি? ” শ্রাবনের মুখে এতক্ষনে হাসির চমক দেখা গেলো। তারমানে সুমো শেষ পর্যন্ত বিয়েতে যেতে রাজি হয়েছে৷ উহ শান্তি… গত তিনদিন যাবত বলে বলে কোন উত্তর পায়নি শ্রাবণ সুমোর কাছ থেকে।
“উপহার মানে উপহার… বিয়েতে গেলে উপহার দিতে হবেনা বুঝি? ” সুমন মাথা না তুলেই জবাব দিলো, ও একটা কাগজের গিফট বক্স বানাচ্ছে মৌমিতাদির জন্য।
শ্রাবন আয়নায় দাড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আড় চোখে এক নজর দেখার চেষ্টা করলো যে সুমন কি এমন মহার্ঘ বস্তু বানাচ্ছে.. কিন্তু সুমন এতো রেখে ঢেকে তার উপহার বানাচ্ছে যে দূর থেকে দাড়িয়ে সেটা শ্রাবণের পক্ষে দেখা সম্ভব হলো না।
পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে শ্রাবন বলে উঠলো, “উপহার দিতে চাচ্ছিস দে কিন্তু আমি দিলেই তো তোর উপহার দেয়া হয়ে যাবে, আলাদা করে কষ্ট করার কোন মানেই ছিলোনা।”
সুমন শুনেও কোন উত্তর করলনা। শ্রাবনদার যা একটা কিছু মনে হলেই হলো… সুমন ওর মতো করেই মৌমিতাদিকে উপহার দিবে তা সে যতো ঠুনকো হোক না কেন।
………………………………………
মৌমিতা আজ কনের সাজেও বারবার ফোন ধরছিলো। আসলে ওর আর অমিয়র বিয়েটা খুবই অল্প সময়ের মধ্যে একদম সাদামাটা ভাবে হচ্ছে.. যে টুকু লোকাচার না করলেই নয় কেবল সেটুকুরই ব্যাবস্থা করা হয়েছে। তাই আত্মীয়- স্বজন বাদে কাছের কিছু বন্ধু- বান্ধবকেই কেবল দাওয়াত করতে পেরেছে ও।
“মৌমি তুই দয়া করে ফোনটা কান থেকে
নামাতো, ” লাবন্যর কণ্ঠে বিরক্তি ঝরে পড়লো।
“ফোনটা আমার দেখলেই মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ”
লাবণ্যর চেহারা দেখে মৌমিতা এবার সত্যি সত্যি ফোনটা ভয়ে পাশে রেখে দিলো। একটু আগে শ্রাবণের ফোন এসেছিলো ওর কাছে। বিয়েতে শ্রাবন একলা নয় তার সাথে সুমনও আসছে খবরটা কানে যেতেই লাবণ্যর মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মৌমিতারই বা এ বিষয়ে কি করার আছে? বিয়ের দাওয়াত পেয়ে শ্রাবণ প্রথমেই ওর কাছ থেকে সুমনের জন্য দাওয়াত চেয়ে নিয়েছিলো। মৌমিতা অনেক করে চেয়েও শ্রাবনকে না বলতে পারেনি… এখন তাই চেয়ে চেয়ে লাবন্যর রাগ দেখা ছাড়া মৌমিতার আর কিছু করার নেই।
সুমনরা যখন বিয়ে বাড়িতে পৌছালো তখন মৌমিতার হাতে বিয়ের জন্য শাখা পড়ানো হচ্ছে। সুমন পিপাসার্তের মতো কনের কাছে দাড়িয়ে বিয়ের সব আচার অনুষ্ঠান দেখছিলো… এরমধ্যে হঠাত পাশ থেকে নিচু গলার ধমক খেয়ে চেয়ে দেখলো লাবণ্যদি গম্ভীর সুরে ওকে ওখান থেকে বের হয়ে যেতে বলছে। সুমনের একবার মনে হলো বলে যে এখানে ও কেবল একলা ভীড় করে নেই, আরও অনেক লোক এই ঘরে আছে কিন্তু পরে আবার চুপ করে থাকাটাই ও ঠিক মনে করলো।
এদিক সুমনকে মৌমিতার আশে পাশে না পেয়ে শ্রাবন, সুমনের ফোনে বার বার কল করতে লাগলো কিন্তু ওর কোন কলই সুমনের ফোনে ঢুকলো না। বিয়ে বাড়িতে ঢুকে মৌমিতার ঘরে মেয়েদের ঢল দেখে সুমনকে ওখানে রেখেই শ্রাবণ বের হয়ে এসেছিল, কিন্তু এখন সুমনকে সেখানে খুঁজে না পেয়ে ভয়ে ওর বুক কাঁপতে লাগলো ।
” কিরে শ্রাবণ বার বার এতো কোথায় যাচ্ছিস? ”
সিড়ির গোড়ায় সুজয়কে দেখতে পেয়ে দাড়িয়ে পড়লো শ্রাবন, ” সুমোকে খুঁজছি… ওকে দেখেছিস কোথাও। ”
” সুমো.. মানে যে মেয়েটা তোর সাথে এলো ”
” হুমমম ” দুশ্চিন্তায় শ্রাবণের বুদ্ধি লোপ পাচ্ছিলো।
“ওকে তো মনে হয় অমিয়র বোনের পাশে বসা দেখলাম ”
শুনে শ্রাবণ হতবাক, “সেকি আমি ওকে মৌমির ঘরে রেখে এলাম আর… এই মেয়ে, বড্ডো তুরতুরি হয়েছে আজকাল , চেনেনা জানেনা কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, শেষে হারিয়ে গেলে। ”
শ্রাবন দ্রুত বরকে যেখানে বসানো হয়েছে সেখানে ছুটলো।
সুমনের খুব কান্না পাচ্ছিলো, শ্রাবনদাকে ও খুঁজেই পাচ্ছে না। ওদিকে ওর ফোনটা হাত থেকে পড়ে গিয়ে বন্ধ হয়ে গেলো .. হতভাগাটা এখন চালুও হচ্ছে না।
“কি ব্যাপার সুমো…. তুই ফোন ধরছিস না কেন? ”
শ্রাবনদা..! উহ… শ্রাবনদার বাজখাই গলার ধমকও যে এতো সুন্দর জানা ছিলো না সুমনের। বাপরে…. সুমনের জানে পানি এলো এবার।
“আ…আমি তোমাকে খুঁজেই পাচ্ছিলাম না ” চোখের পলকে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললো সুমন।
“তো একটা ফোন দিলেই তো আমি হাজির হতাম ”
জলে টলমল দুটো চোখ দেখে শ্রাবণ মুহুর্তেই গলে আইসক্রিম .. ভিতরের আগুনে ছাই চাপা পড়লো।
“ফোনটা বন্ধ হয়ে গেলো যে ”
” কি করে… চার্জ দিয়ে আনিস নি? ”
“তা নয়.. সিড়ি দিয়ে নামার সময় হঠাত হাত ফসকে পড়ে গেল, তারপর থেকে আর চলছে না, ” মিনমিন করে বলে উঠলো সুমন, জানে এবার দু ঘা পরতে পারে ফোন ভাঙ্গার অপরাধে।
কিন্তু সুমনের আজ কপাল ভালো, শ্রাবন হাসতে জানতে চাইলো, ” খুব ভালো… তা মৌমির ঘর থেকে এখানে আসতে তোকে কে বলেছিলো পন্ডিতি করে। আমি এ পর্যন্ত কত বার ও ঘরে তোকে খুঁজে এসেছি তুই জানিস? ”
এতো মন খারাপের মধ্যেও শ্রাবণের এই জেরা করাটা সুমনের খুব ভালো লাগলো। এই যে শ্রাবনদা ওকে খুব করে শাসন করছে, ওকে খুঁজে না পেয়ে রাগ হচ্ছে… এটা সুমন খুব করে চায়। কি যেন এক সময় হয়তো এটুকুর অভাবেই ও মরে কাঠ হয়ে যাবে… সুমন চায়না শ্রাবনদা আর কাউকে এমন করে বকুক, এই বকাগুলো শুধু ওর একার হয়ে থেকে যাক।
” অ্যাই তুই কি আজকাল দিবাস্বপ্ন দেখিস নাকি… হাবার মতো খালি খালি হাসছিস কেন? ” শ্রাবন চট করে সুমনের নাকটা টেনে দিলো।
” কোথায় হাসছি… আর হাসবো না তো কি বিয়ে বাড়ি এসে গাল ফুলিয়ে রাখবো? ”
” তোর যা মুখের চেহারা তাতে গাল ফুলো থাকলেই ঠিক লাগে ”
” শ্রাবনদা…” রেগে উঠলো সুমন, খালি যত্তোসব ইয়ে…
” আস্তে.. তুই দয়া করে আমায় শ্রাবনদা বলা বন্ধ করবি এবার, নিজের বউয়ের মুখে দাদা শুনতে শুনতে আমার কানদুটো পচে যাচ্ছে।”
সুমন মুহুর্তের জন্য মরে গেলো… লজ্জায় মরে গেলো.. আরেকবার শুনতে ভারি লোভ হচ্ছে কিন্তু শ্রাবনদাকে সেটা বলা যাবেনা একদম।
” যাও আবার তুমি শয়তানি শুরু করে দিয়েছো, ” সুমন ঠোঁট ফোলালো।
” তারমানে কি… তোর কাছে আমার মালা পড়ানোটা ফালতু বলে মনে হয়েছে? কিন্তু আমি কিন্তু মোটেই শয়তানি করছি না সুমো.. সত্যি তখন তোকেই বিয়ে করে নিয়েছি। ”
“আ.. আমার না বড্ডো ক্ষুধা পেয়েছে শ্রাবনদা, কিছু খাবার ব্যাবস্থা করোনা প্লিজ ”
শ্রাবণের খুব জেদ হলো, মনে হলো যে সুমনের বসার চেয়ারটা এক লাথি দিয়ে ভাঙ্গে কিন্তু হলঘরে অনেক লোক বসা তাই আর কোন কথা বাড়ালো না, সামনে যেয়ে খাবারের খোঁজ করতে চলে গেলো।
“ওরা অনেক দামী বউ তাইনা শ্রাবনদা? ” সুমন বিয়ের মন্ডপের তাকিয়ে জানতে চাইলো। সামনে মৌমিতা আর অমিয়র বিয়ের জন্য সুন্দর করে মন্ডপ সাজানো হয়েছে। তাতে জোরেসোরে বিয়ের আয়োজন চলছে… মৌমিতার বাড়ির লোকজন সবাই ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে ছুটোছুটি করছে.. কনেকে পিড়িতে বসানোর জন্য।
” মানে… ” শ্রাবন অবাক হয়ে জানতে চাইলো। সুমো ইদানিং খুব অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু প্রশ্ন করে.. শ্রাবণ ঠিক বুঝতে পারে না সেগুলো।
“ওদের জন্য কত সুন্দর বিয়ের শাড়ি, শাখা পলা.. সিঁদুর আরো কত কিছু ” সুমন মনমরা সুরে বলে যায়।
এলোমেলো টুকরো টুকরো দুএকটা কথা… কিন্তু তার গভীরতা অনেক, সুমনের আনমনে বলা কথাগুলো শ্রাবনকে নাড়িয়ে দেয় প্রচন্ড ভাবে। সুমো কি তাহলে এ জন্য দুঃখ পাচ্ছে? ওর কাছে কি শুধু এসব শাড়ি চুড়ি এগুলোরই মূল্য আছে, শ্রাবণের মুখের কথার কোন দাম নেই! এই যে শ্রাবন ওকে মনে মনে নিজের বলে মনে করে সেটার কোন গুরুত্ব নেই সুমোর কাছে !
প্রথমে রাগ, তারপর জেদ আর তারপরে অভিমান একে একে সাপের মতো ফনা তুলতে শুরু করলো শ্রাবণের মন জুড়ে। তারমানে কি দাড়ালো… শ্রাবন ঠকবাজ, বিয়ে না করে সুমোকে ঠকানের মতলব করেছে তাই ওসব শাড়ি, চুড়ির ধার ধারেনি ?
” সুমো আয়তো দেখি ” শ্রাবন হঠাত সুমনের হাত ধরে টান দেয়।
” এখন! এখনতো মাত্র বিয়ে শুরু হবে শ্রাবনদা ” সুমন বিস্মিত।
শ্রাবনদা শুনে এবার মেজাজ তুঙ্গে উঠলো শ্রাবনের, ওর সাথে ফাজলামো করা এখনি ঘুচাবে ও সুমোর। হনহন করে হাটতে লাগলো ও বিয়ের আসর ছেড়ে৷
সুমন বুঝতেই পারলোনা শ্রাবনদার মাথায় হঠাত কিসের ভূত চাপলো… বিয়ে না খেয়েই কেন ওরা আবার বাড়ি চলে যাচ্ছে সেটা শ্রাবনদাই ভালো জানে।
কিন্তু শ্রাবণ গাড়ি যেখানে দাড় করালো সেদিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলো সুমন, এ তো মন্দির! বিয়ে ফেলে এই অসময়ে ওরা মন্দিরে কেন এলো?
“চুপ করে করে বসে থাকবি একদম আমি আসছি ”
সুমন কেন বলারও সময় পেলো না তার আগেই দুম করে গাড়ির দরজাটা জোরে বন্ধ হয়ে গেলো ওর মুখের উপরে। সুমন জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে শ্রাবন কোথায় গেলো বোঝার চেষ্টা করলো কিন্তু কিছুই দেখতে পেলো না, অগত্যা বসে অপেক্ষা করা ছাড়া ওর আর কোন উপায় রইলো না।
কিছুক্ষণ পরে শ্রাবন এসে সুমনকে নিয়ে সোজা মন্দিরে গিয়ে ঢুকলো। ওখানে ঢুকে সুমন যা দেখলো তার জন্য ও মোটেই প্রস্তুত ছিলো না… মন্দিরে কারো বিয়ের আয়োজন চলছে।
” এ..এগুলো কি? ”
“তোর শাড়ি, শাখা পলা… ”
” মানে? ”
” মানে তুই দামী বউ হতে চাস… তার বন্দোবস্ত হচ্ছে ”
” শ্রাবনদা তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ”
” হ্যা..কারন তোর মালা বদলে হবে না… শাখা পলা, সিঁদুরেও হবেনা… তোর আয়োজন করে বিয়ে চাই,তাই তো? তো ঠিক আছে তাই সই… আমি মাকে নিয়ে বাইরে থেকে ঘুরে এসে সেটাও না হয় করে দেখাবো, ” শ্রাবনের গলার সুরে ঝড়ের আভাস।
সুমন হা করে তাকিয়ে রইলো.. শ্রাবনদার ভিতর কিছু একটা ভর করেছে.. কি সব আজব আজব কাজ করছে সে একের পর এক।
” শ্রাবনদা শোন বাড়ি চলো… আমার কিছুই চাইনা। তুমি কেবল দাদুর কাছে আমার হাতটা চেয়ে নিয়ো আর বড়মা আর কাকাবাবুর অনুমতি নিয়ো আর কোন আয়োজনই চাইনা।’
কিন্তু শ্রাবনের ভিতরে আজ রাক্ষস ভর করেছে.. গায়ের রক্ত গুমড়ে গুমড়ে মরছে .. আজ তাকে থামায় সাধ্যি কার।
চলবে……
তোমার পরিনীতা -২৮
( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত পরিনীতার ছায়া অবলম্বনে)
লেখিকা- ফায়জা করিম
( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)
প্রতিটা পাক ঘোরার সময় যখন পুরোহিত মন্ত্র পড়ছিলেন সুমনের পায়ের নিচের মাটি যেন থরথর করে কাঁপছিলো… সুমন এতোটাই বেসামাল হয়ে যাচ্ছিলো যে শ্রাবন শক্ত হাতে ওকে ধরে না রাখলে ও মাথা ঘুরেই পড়ে যেতো মন্দিরে।
বিয়ে সেড়ে ওরা যখন আবার মৌমিতাদের বাড়ি এসে ঢুকলো সুমনের কপালে তখনও এক মুঠো সিঁদুর লেপে দেয়া রয়েছে। সুমন কি রেখে কি করবে, কি হওয়া উচিত কিছুই ঠাহর করতে পারছিলনা… মনে হচ্ছিলো যা হলো সেটা বোধহয় একটু পরেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। ব্যাপারটা তাতে সুখের হবে না দুঃখের সেটাও মাথায় খেলছিলো না ওর ঠিকমতো।
শুধু এটুকু অনুভব হচ্ছিলো যে পাশে বসা লোকটার সাথে ওর জীবনের নোঙর ফেলা হয়ে গেছে.. এখন জাহাজের গতি যেদিকে যাবে তার সাথে তাল মিলিয়ে ওর গতিপথও তাই হবে , আলাদা করে কোন কিছু আর ভাবার অবকাশ নেই এখন।
“কপালটা একটু মুছে ঠিকঠাক কর, সবার সামনে এক্ষুনি ঘটনাটা চাউর হোক সেটা চাইনা,” শ্রাবণ থমেথমে সুরে বললো, মেজাজ ওর তখনও সপ্তমে চড়ে আছে। রাগটা যে আসলে ঠিক কার উপর ছাই সেটাই তো শ্রাবন বুঝতে পারছেনা।
” কি বলছো তুমি… মুছে ফেলবো! ” সুমন ভয়ে আতকে উঠলো.. ও তো মরে গেলেও এই কাজ জীবনে করতে পারবেনা… শ্রাবনদার জীবন নিয়ে যদি সংশয় হয় তখন?
শ্রাবন নিজেও এবার কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেলো। সত্যিই তো রাগের মাথায় কান্ড তো একটা করে আসলো কিন্তু এখন এতো কিছু সুমো লুকাবে কি করে… এমনিতেই যা বুদ্ধির ঢেঁকি একটা।
” ও শ্রাবনদা, ” সুমো আবার কাঁদো কাঁদো সুরে ডেকে উঠলো। সিঁথির সিঁদুর মুছতে ওর ভারী ভয় হয়… স্বামীর অমঙ্গল হয় যদি? শ্রাবনদা মরে গেলে ও এমনি মরে যাবে, এক সেকেন্ডও বাঁচবেনা।
“সুমো তুই কি আমার হাতেই মরতে চাস? ”
“অ্যা.. না, না তা কেন। ”
“তবে আমার নামের শেষে এই দা বলা তুই এক্ষুণি বন্ধ কর… তোর সাথে দাদার মতো ওই সম্পর্ক আমি ঘুচিয়ে দিয়ে এসেছি অনেক কাল আগেই।”
আস্তে কিন্তু ভরাট গলায় আদেশ করলো শ্রাবণ।
” আচ্ছা ” সুমনের কেন যেন হঠাৎ শ্রাবণের এই দাঁত মুখ খিচানো রাগ রাগ চেহারাটা দেখে ভীষন হাসি পেতে লাগলো শ্রাবনদা হুট করে কি জগাখিচুরি একটা কাজ করে ফেললো… ভাবতেই হাত পা সিটিয়ে যাচ্ছে একদম। বড়মা, কাকাবাবু জানলে আস্ত রাখবেনা ওদের কাউকে।
” হমম ” শ্রাবন একমনে ভাবছিলো, এখন কি করা উচিত। বন্ধুদের না জানালে ওদের কাছ থেকে কোনরকম সাহায্য শ্রাবণ পাবে না আর জানালে ওদের সাহায্য পাওয়ার সাথে সাথে…বরঞ্চ লাবন্য আর সুজয়ের সম্পর্কটা গড়ে দেয়ার ক্ষেত্রে ও সাহায্য করতে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো সুজয় আবার ওকে মন থেকে বিশ্বাস করতে পারবে।
” কিন্তু এখন কি হবে… আমি কিন্তু সিঁদুর, শাখা পলা কিচ্ছু খুলবো না বলে দিলাম ” সুমন হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিলো সবকিছু… কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে সবকিছু, মনে মনে কত জন্মের শখ ছিলো ওর।
” এক কাজ কর এখন আপাতত শাখা পলাটা পরে থাক,কিন্তু কপালটা দয়া করে মোছ ”
” কিন্তু… স্বামী বেঁচে থাকতে… ”
সুমনের মন একটুও সায় দিলোনা… কি সব অলক্ষুণে কথা বলছে শ্রাবনদা সেই থেকে… একদম মনে ধরছে না ওর। মাত্র মাত্র এর স্পর্শ পেয়ে সরাতে আছে বুঝি এসব? পাপ, পুণ্য বলে কথা আছে না?
” কোন কিন্তু নেই, এক কাজ কর সিঁথির নিচে লুকিয়ে অল্প খানিকটা দিয়ে রাখ যাতে বাইরে থেকে দেখা না যায়, কিন্তু তোর ওই এমাথা ওমাথা পশ্চিমের আকাশটা ধুয়ে মুছে ঠিক কর।”
সুমন অনিচ্ছা সত্বেও নিঃশব্দে গজ গজ করতে করতে সিঁদুরটা মুছলো, চোখ দিয়ে টুপ টুপ করে বেশ খানিকটা জলও গড়িয়ে পড়লো… তারপর কেবল সিঁথির নিচে একটা ফোঁটার মতো সিঁদুর রেখে খানিকটা চুল দিয়ে সেটা ঢেকে দিলো।
” কিন্তু শাখা পলাও তো মানুষ দেখবে শ্রাবনদা ”
এখন এটাও মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো সুমনের, এ ও কিছুতেই খুলবে না।
” আবার দা “… এবার সত্যি সত্যি তেড়ে এলো শ্রাবন।
” হুশশ…, এতোকালের ডাক, একদিনে যায় নাকি? কিন্তু এর কি হবে বলোনা? ” সুমন নাছোড়বান্দার মতো শ্রাবনকে জিজ্ঞেস করতেই লাগলো।
” উমম.. তুই আমার সাথে সাথেই থাক বুঝলি , একদম আমার কাছ ছাড়া হবিনা। মৌমি আর অমিয়র বিয়েটা হয়ে যাক তারপর আমি মৌমির সাথে কথা বলে সব ঠিক করছি।”
“আচ্ছা ”
“হমম ”
” ও শ্রাবনদা… ”
” কি.. ”
“বলছি আমাদের সত্যি বিয়ে হয়ে গেলো… তুমি আমায় সত্যি বিয়ে করলে! ”
“না তো…. আমি এতক্ষণ সিনেমার স্যুটিং করে এলাম.. তুই দেখলি না? ”
“ধ্যাত… ”
” এখন দয়া করে থাম.. কিভাবে কি সামাল দিবো সেটা ভাবতে দে… মেয়েতো না একদম শনি ”
” কি বললে আমি শনি? ”
“না রবি,সোম, মঙ্গল, বুধ সবই এখন তুই ”
” তুমি জোর করে আমায় বিয়ে করলে কেন আর এখন আমার ঘাড়ে দোষই বা দিচ্ছো কেন? ”
“অ্যাই তুই থামবি বাচাল কোথাকার ”
শ্রাবণের ধমকে এবার কিছুটা কাজ হলো… সুমন অভিমানে মুখ ফোলাল।
………………………………………
” কি বললি.. তুই আর একবার বল?”
শ্রাবণের কথা শুনে মৌমিতার চোখ ঠিকরে আসার জোগাড় হলো।
“এক কথা এতোবার বলতে পারবোনা, ” শ্রাবণ কথা ঘোরালো।
” কিন্তু শ্রাবন তুই এভাবে.. এরকম হুট করে বিয়ে করে বসলি কেন? ”
” মৌমি প্লিজ… তোর কি মনে হচ্ছে আমি ঠান্ডা মাথায় ভেবে চিন্তে এসব করেছি? সেদিন হুট করে এমন একটা অবস্থা তৈরী হয়ে গিয়েছিলো আর তার জের ধরেই আজ মন্দিরে বিয়েটা করতে হলো… সুমো ভরসা পাচ্ছিলো না। ”
” হমম সেতো বুঝলাম কিন্তু তোর বাবা-মা, পরিবার পরিজন তাদের সামাল দিবি কি করে? ”
” সেটা পরে ভাবছি আগে তুই আমাকে এখনকার মতো বাঁচা। সুমো কিছুতেই ওই শাখা পলা খুলবেনা আর ভুল করেও যদি এটা লাবন্যর চোখে পড়ে তাহলে তো হয়েই গেলো… কালই আমার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করবে বাবা। ”
“হমম.. আচ্ছা দাড়া আমি দেখছি কি করতে পারি।”
পরের দুই ঘন্টায় মৌমিতা কনের সাজেই অনেক কিছু করলো বসে বসে। সুজয়কে ডেকে শ্রাবন আর সুমনের বিয়ের খবরটা দিতেই সুজয় খুশিতে বাক্যহারা। লাবণ্য এবার না মেনে যাবে কোথায়? কিন্তু একটু পরেই সুজয়ের সেই আশার গুড়ে বালি পড়লো….. মৌমিতার কড়া নির্দেশ লাবণ্যর কানে যেন এই বিয়ের ‘ব ‘ ও না যায়। গেলে লাবণ্যর আশা এ জন্মের মতো ওকে ছেড়ে দিতে হবে। অগত্যা সুজয়কে এইটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট হতে হলো যে, লাবণ্যর দিক থেকে না হোক… অন্তত শ্রাবণের কাছ থেকে ওর আর কোন বিপদের সম্ভাবনা নেই৷
কিন্তু মৌমিতার অনুরোধে লাবণ্যকে কি করে ও শ্রাবন, বিশেষ করে সুমনের থেকে দূরে রাখবে সেটা একটা চিন্তার বিষয় হয়ে উঠলো সুজয়ের জন্য।
…………………………………………………
সুমনের পক্ষে আর চোখ খুলে রাখা সম্ভব হচ্ছিলো না। রাতভর মৌমিতা আর অমিয়কে ঘিরে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনেরা নানা রকম হাসি তামাশা করছিলো। সেই ঘরের এক কোনে বসে তখন সুমনের মরার মতো ঘুম আসছিলো। তাতে আবার কেউ কেউ গান ধরলো আর গান শুনে সুমনের মনে হলো ও ঘুমের ডবল ওষুধ খেয়েছে, ভোরের দিকে ঢুলু ঢুলু চোখে মৌমিতার ঘরে এসে সটান হয়ে শুয়ে পড়েছিলো সুমন।
এখন ঘুম শেষে… আরাম করে হাই তুলে বার কয়েক চোখ পিট পিট করতেই সুমনের মনে পড়লো, আরে এটাতো ওর বিছানা নয়। সাথে সাথে এই অচেনা বাড়িতে শ্রাবনদা কোথায় মনে হতেই লাফিয়ে উঠতে গেলো সুমন, কিন্তু বিধি বাম… উঠতে যেয়ে শাড়িতে হ্যাচকা টান খেয়ে উল্টো কারো গায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো ও।
কিন্তু সরার জন্য গায়ে হাত পড়তেই জমে গেলো সুমন… এতো কোন মেয়ে মানুষের শরীর নয় গো… হৃৎপিণ্ডটা ওর এতো জোরেই লাফাচ্ছিলো যে ভয়ে মুখ দিয়ে ওমা গো বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো ও।
” তুই কি সব সময় এমন উদ্ভট উদ্ভট শব্দ করে ঘুমাস সুমো ? ”
শ্রাবণ বিরক্ত হয়ে জানতে চাইলো। গল্প গুজব শেষ করে ঘন্টা দেড়েক হলো ও সুমোর পাশে এসে শুয়েছে আর তখন থেকে একের পর এক কর্মকান্ড চলছে। কখনো সুমো ওর গায়ে পা তুলে দিচ্ছে তো, তো কখনো সজোড়ে হাত নিয়ে মুখের উপর ছুড়ে দিচ্ছে।
” তু..তুত..তুমি? ” সুমন মাছের মতো খাবি খাচ্ছিলো, শ্রাবণদা এখানে এসে শুয়েছে কেন?
“হ্যাঁ কেন..? ”
” না.. মানে তুমি এখানে কেন.. না মানে তোমরা তো গান বাজনা করছিলে,” মিনমিন করে বললো সুমন। এক বিছানায় এরকম করে শোয়নি ও আগে কখনও শ্রাবনদার সাথে… বুকের ভিতরে ঢেঁকির পাড়া পড়ছে ওর।
” করছিলাম, কিন্তু তাই বলে সারারাত সেটাই করতে হবে নাকি… আর তুই আমায় না বলে এঘরে চলে এলি কেন? ”
“আমি মৌমিতাদিকে বলে এসেছি আর তুমি তখন গল্প করছিলে।”
” গাধী নাম্বার ওয়ান… তুমি গল্প করছিলে!
আরে গল্পই তো করছিলাম.. মরে তো যাইনি আর যতোই গল্প করি তুই আমাকে না বলে একা এখানে আসবি কেন? আমি কথা বলছি আর সেই ফাঁকে তুই চলে এলি, আমার দুশ্চিন্তা হতে পারে সেটা নিয়েও তোর কোন ভাবনা হলো না?”
” উমম.. আমার খুব ঘুম পাচ্ছিল.. মাথাই কাজ করছিলো না।”
সুমন বিষন্ন সুরে বললো, সত্যি শ্রাবনদা ওকে খুঁজে না পেয়ে দুশ্চিন্তা করছিলো!
” এখন কাজ করছে? ”
” হমম…”
” গুড ” শ্রাবন মুচকি হাসলো।
তারপরের মুহুর্তেই সুমন নিজেকে আবার বালিশের উপর আবিস্কার করলো।
“শ্রাবনদা..”
কিন্তু সুমন ততক্ষনে নিজের ঠোঁট দুটোর নাড়াচাড়ার শক্তি হারিয়েছে। শ্রাবণ ও দুটো এমন ভাবে দখল করে নিয়েছে যে সুমনের তাতে বাধা দেয়ার কথাও মনে এলোনা।
বহুক্ষণ বাদে যখন সুমন শ্বাস নিলো তখন বুকটা হাপরের মতো উঠা নামা করছে দু পক্ষেরই উত্তেজনায়। প্রথম অনুভূতি আর আনকোরা অভিজ্ঞতা দুইয়ে মিলেমিশে তাল মেলানো দায় হয়ে যাচ্ছিল ওদের।
“সুমো… ” আবেগে তখন শ্রাবণের গলা কাঁপছে।
সুমন তখন বধির .. শ্রাবনদার এতো কাছাকাছি আসা হয়নি ওর এর আগে, সম্পর্কের গন্ডীও ছিলো ভিন্ন কিন্তু এখন স্বামী হয় যে। সুমনের শরীরে হাজার অনুভূতি ডানা ঝাপটাচ্ছিলো।
শ্রাবণের শ্বাস তখন ক্রমশও ভারী হচ্ছে। সুমোকে কি অদ্ভুত মায়াকাড়া লাগছে ওর.. টুলটুলে গাল দুটো যে ভীষন আদরের, কাজলটা চোখের আশেপাশে অযত্নে লেপ্টে আছে। হুট করে আবারো নিজের দুহাতের পরিধির ভিতর সর্বশক্তি দিয়ে বুকের সাথে আকড়ে ধরলো শ্রাবণ। ফিসফিস করে আলতো নিঃশ্বাসের ছোঁয়ায় প্রশ্ন করে বসলো, ‘সুমো.. তুই আমার হবি বউ? ”
বউ.. কি ভীষন রিনরিনে একটা শব্দ।
সুমন আমতা আমতা করে বলে উঠে, ” কিন্তু আমার যে বড্ডো ভয় করে শ্রাবনদা।”
” ধুর পাগলী… আমি থাকতে ভয় কি? ”
সেও বটে, শ্রাবনদা থাকতে ভয় কি… ওযে নিজেই যমরাজ.. সুমন ওতে কবেই মরে বসে আছে।
” সুমো… কি অত ভাবিস? ”
” কিছু না শ্রাবনদা ”
বলেই সুমন জিভ কেটে লজ্জায় শ্রাবণের বুকেই মুখ লুকায়। ও মুখপুরী কিছুতেই নিজের স্বামীকে অন্য কিছু বলে ডাকতে পারছেনা যে.. শ্রাবনদা এখন স্বামীই হয় জানে ও… তারপরও জিভ ওর ওনামেই গেয়ে উঠে যে।
শ্রাবণ হাসলো,” তুই আমায় জনমভর এই নামেই ডাকবি তাহলে… দেখিস ছেলেমেয়ে আমায় শেষকালে মামা না ডেকে বসে।”
“ধ্যাত..যাও ভাল হবে না বলছি। ”
সুমনের গাল দুটো লাল হয়.. এরমধ্যে ছেলেমেয়ে আসবে কোথ থেকে?
” ভালোর কথা আমি কি আর বলছি, আমি তো বলছি আমার দুর্গতির কথা, বউ আমায় আদর করে দাদা বলে ডাকে যে। ”
শাস্তি সরূপ কপালে একটা ছোট্ট চুমুর দাগ পড়ে সুমনের।
” আবার!” সুমনও কপট অভিমান দেখায়। আজ শ্রাবনদার বকার মধ্যেও আহ্লাদ আছে সুমন টের পায়।
” আচ্ছা থাক আর বললাম না কিন্তু তুই বললি না কিন্তু তুই আমার হবি কিনা? ”
” জানিনা.. ” সুমনের চোখদুটো হাসে।
” তারমানে তুই রাজি না..। ”
” আমি কি তাই বললাম ”
“তারমানে তুই রাজি? ”
“শ্রাবনদা…”
“দেখেছিস ফের তুই ওই ডাকছিস.. রাখ তোর এখন অনেক শাস্তি পাওনা,” শ্রাবন কেমন কাল বৈশাখির মেঘ হয়ে ঘিরে ধরে সুমনকে আষ্টেপৃষ্টে।
সুমনের চোখ মুখ লজ্জায় বুজে আসতে চায় .. শ্রাবনদা কি অদ্ভুত অদ্ভুত কায়দায় ওকে আদর করছে.. শরীর তখন বাঁশ পাতার মতোই কাঁপছিলো ওর.. ভালোবাসা পাবার আশায়, ভালোবাসা দেবার ভরসায়।
………..
” তুমি আমায় বিয়ে কেন করলে শ্রাবনদা ? ”
ঝড়টা থেমে যেতেই সুমনের মনে প্রথম এই প্রশ্নটা এলো। চারদিকটা তখন একদম সুনসান.. জানালার ফাঁক দিয়ে কেবল ভোরের পাখির দল কিচির মিচির করছে।
“কেন করলাম? ”
শ্রাবন তখন সুমনের মসৃণ চুলের প্রান্তগুলো নেড়েচেড়ে আঙ্গুলে প্যাচাচ্ছিলো। সুমোর চুলগুলো দিয়ে কেন যে এতো ফুলের গন্ধ পায় ও, আলতো করে নাক ডুবিয়ে দেয় শ্রাবন। আহ… শান্তি
“হমম.. কেন করলে?” আদুরে স্বরে জানতে চায় সুমন, কি যেন একটা বাঁধ হঠাত ভেঙ্গে গেছে… পর্দা উঠে গেছে দুজনের মধ্যে থেকে এতোকাল পরে।
” তুই বল দেখি কেন করলাম.. ” নতুন বউয়ের মুখটা ভারী মায়া মায়া লাগে শ্রাবণের, বড্ডো ভালোবাসার। সুমোর মুখটা আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় ও।
” উমম.. বুঝেছি, ওই যে ভুল করে লগ্নের সময় গলায় মালা পরিয়ে দিলাম সে জন্য? ” সুমন অনেক ভেবে উত্তর দেয়, ভয়ে ভয়েই সত্যটা জানতে চায়। সত্যি ও জেনে বুঝে কিচ্ছুটি করেনি.. কিন্তু শ্রাবনদা ওকে বিশ্বাস করবেনা হয়তো।
হো হো করে হেসে উঠে শ্রাবণ, ” ভাগ্যিস তোর বুদ্ধি তোর হাঁটুর কাছে সুমো নাহলে আমি হয়তো আফসোস করেই মরে যেতাম।”
“তারমানে এটা ঠিক উত্তর নয়… তারমানে আমি বোকা.. তারমানে আমার তোমার বউ হওয়ার কোন যোগ্যতা নেই, ” সুমন রেগে উঠে। ইচ্ছে হয় শ্রাবনদার ফর্সা বুকটা বিড়ালের মতো খামচে দেয়।
এতো আদুরে চোখ মুখ শ্রাবণ আর কোথাও দেখেনি.. এ যেনো ভরা বর্ষার জলে বাতাসের এলোমেলো ঢেউ, নতুন জেগে উঠা ধানের শীষের সোনালী আহ্বান… শ্রাবন তাতে আবারো বুঁদ হয়ে থাকতে চায় আজন্মকাল।
সুমন পাতার ঝিরিঝিরি ডাক শুনতে পায়… কেউ নেশাতুর স্বরে অভিযোগ করে উঠে, “তুই এতো বোকা কেনরে সুমো.. ভালোবাসি এ কথাটা আমার মুখ দিয়ে না বলালে বুঝি তোর শান্তি হচ্ছিলো না?”
চলবে….