তোমার পরিনীতা পর্ব ২৫+২৬

তোমার পরিনীতা ২৫

( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত পরিনীতার ছায়া অবলম্বনে)

লেখিকা- ফায়জা করিম

( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)

বৃষ্টিতে ভিজে প্রীতির শোপিস নিয়ে আসতে আসতে সুমন কাক ভেজা হয়ে বাসায় ফিরলো।

“সুমনদি পেয়েছো?”

“পেয়েছি কিন্তু আজ তোর মেয়ের বিয়েতে আমি তিনটে মিষ্টি খাবো… এতো কষ্ট করিয়েছিস আজ তুই পাঁজি মেয়ে.. অ্যা.. হ্যাচ্চো ” সুমন মুখ চেপে হাঁচতে লাগলো। রেস্টুরেন্ট থেকে বাকি পথ ও আর আদিত্য হেটেই ফিরেছে, তবে সুমন, প্রীতির জন্য শোপিস কিনতে ঢুকলে আদিত্য ওকে রেখে চলে এসেছে মোড়ের মাথায়, এটা সুমনের পছন্দ হয়েছে। ওদের একসাথে দেখলে না হয় লোকে নানা রকম কথা জুড়ে দিবে।

প্রীতি, সুমনের অবস্থা দেখে হেসেই কুপোকাত। সুমনের অবস্থা আসলেই বেহাল, কয়েকবার হাঁচতেই নাক লাল হয়ে এলো ওর।

“কিরে ওরকম করে হাসছিস কেন তুই প্রীতি? ” সুমন এবার রুমাল খুঁজতে লাগলো। নাকে জল ঝরা শুরু হয়ে গেছে ওর ইতিমধ্যে।

“হাসবো নাতো কি সুমনদি? বিয়ের জন্য মিষ্টি জোগাড় হয়েছে মাত্তর চারটা… তার একটা আমার বকুলের বরের জন্য আর দুটো বরযাত্রীর।”

” তবে আর কি… যে একলা কানাই বাকি রইলো সেটা তবে আমার ”

” না,না ওটা শ্রাবনদাকে দিবো.. তা না হলে শ্রাবনদার সাথে দেখা হলেই বলবে কিরে প্রীতি উপহার দিলাম কিন্তু তোর মেয়ের বিয়ের মিষ্টি তো খেলাম না। ”

শ্রাবনদার জন্য মিষ্টি!

সেদিনের কথা মনে করে সুমন, প্রীতিকে জিজ্ঞেস না করে পারলো না… “মামী শুনলে নির্ঘাত চিল্লাবে, তুই মামীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছিস? ”

” মা জানবেনা আর মিষ্টি আনিয়েছি মা তো সেটাই জানেনা ”

“সেকি, তবে মিষ্টি কাকে দিয়ে আনালি… ডাব্বুকে পাঠাসনিতে আবার? ”

” না কিন্তু সত্যি বললে তুমি বকবে না আগে বলো ? ”

” না.. কিন্তু কাকে দিয়ে আনালি সেটা বল।”

“আদিত্যদাকে দিয়ে… উনি তখন বাসায় এসেছিলেন ঠাকুরদাকে দেখতে, আমি আমনি ওনাকে কাচুমাচু হয়ে অনুরোধ করেছিলাম আমার পুতুলের বিয়ের জন্য দুটো মিষ্টি এনে দিতে। ”

সর্বনাশ.. প্রীতি শ্রাবনদার টাকা দিয়ে আদিত্যকে মিষ্টি আনতে দিয়েছে… খুব ভালো। একেবারে সাপে নেউলে সম্পর্ক….

“কি হলো সুমনদি তুমি আমার দিকে অমন করে তাকাচ্ছো কেন? ”

” কিছু না…. কতো টাকার মিষ্টি আনালি? ”

“আমি টাকা দিতে চাইলাম কিন্তু আদিত্যদা কোন টাকা নিলোনা। বললো, ওটা আমার মেয়ের বিয়ের উপহার৷ ”

“ধন্যি মেয়ে তুই প্রীতি এক পুতুলের বিয়ে দিতে যেয়েই তো তুই ওয়েডিং প্ল্যানার হয়ে গেছিস দেখছি… তো এবার আর কার কার কাছ থেকে উপহার নেয়া বাকি রইলো ?”

” হি হি দি আপাতত আর কেউ নেই সুমনদি কিন্তু সত্যি মেয়ের বিয়ের সময় কিন্তু তোমার কাছ থেকে এত্তো বড় গিফট নিবো। ”

” হমম…. নিস। ”

সুমন কাপড় চোপড় ছেড়ে বিছানায় গিয়ে শোয়ার পায়তারা করছিলো। বৃষ্টিতে ভেজায় শরীর কেমন গরম ঠেকছে ওর, জ্বর আসবেনা কিনা বুঝতে পারলনা সুমন কিন্তু প্রীতির অত্যাচারে ওকে আবার উঠে বসতে হলো। বকুলের বিয়ের লগ্ন শুরু হতে আর বেশি দেরী নেই অথচ প্রীতির এখনো বিয়ের জন্য মালা গাঁথাই শেষ হয়নি। সুমনকে ঠেলে ধাক্কিয়ে তুলে দু’বোন তাই মালা গাঁথতে বসলো।

“হ্যারে প্রীতি বকুল চলে গেলে তোর মন খারাপ হবে না? ” সুমন একটা একটা করে রজনীগন্ধা নিয়ে সুঁইয়ের মাথায় ঢোকাচ্ছিলো।

“তাতো একটু হবেই দি কিন্তু কি আর করা… মেয়ে যখন… শ্বশুরবাড়িতে তো ওকে পাঠাতেই হবে। মেয়ে মানুষ জন্মায়ই পরের ঘরে যাবে বলে,” প্রীতি ভারিক্কি চালে জবাব দিলো।

” সবজান্তা প্রীতু আমার, ” প্রীতির মুখভঙ্গি দেখে সুমন প্রীতির গালটা না টিপে পারলনা।

“বারে আমি কি ভুল বললাম? এই যে বাড়িতে সারাক্ষণ তোমার বিয়ে নিয়ে কতো তোড়জোর চলছে… তারপর এমনি একদিন হুট করে তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে আর অমনি তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে… ঠিক না? ”

সুমনের মনটা ভার হয়ে এলো। খুব শিগগীরই হয়তো ওকে এ বাড়ির মায়া ছেড়ে চলে যেতে হবে অনেক দূরে… পিছনে থেকে যাবে ওর শৈশব আর কৈশরের অজস্র স্মৃতি। সেই স্মৃতির মধ্যে কত নামহীন অনুভূতির মৃত্যু ঘটবে তার খবর কে রাখবে?

” সুমনদি? ”

” কিরে? ”

” বলছি এই মালাটা তুমি একটু কষ্ট করে শ্রাবনদাকে দিয়ে আসবে? আমার দেখো না এখনো কতো কাজ বাকি। ”

” না আমি এখন যেতে পারবো না, তোর মেয়ের বিয়ে তুই দিয়ে আয়,” সুমনের তখন মনে পড়লো শ্রাবনদা ওকে দেখা করতে বলেছিলো।

“সুমনদি লক্ষী বোন আমার… একটু কষ্ট করে মালাটা দিয়ে আসো নাগো প্লিজ। বিয়ের লগ্ন শুরু হয়ে গিয়েছে… বরযাত্রী এই আসলো বলে, কাপড় চোপড়গুলো গুছিয়ে এক্ষুনি বাক্সে না দিলে শেষে শ্বশুরবাড়ি খালি হাতেই পাঠাতে হবে আমার মেয়েটাকে। ”

প্রীতির গিন্নিপনা দেখে সুমন হেসেই খুন হলো।

“আচ্ছা যা দিয়ে আসছি, ” আলগোছে সুমন সামনের থালিতে রাখা একটা ফুলের মালা হাতে জড়িয়ে নিলো। শ্রাবনদা এখন আবার কোন সমন জারি করবে কে জানে.. হুহ।

” সুমনদি ওটা না… ওটা না, এটা নাও। এটা বেশ লম্বা আছে, শ্রাবনদার গলায় ভালো মানাবে,” প্রীতি পিছু ডাকলো।

“তুই কি পাগল হলি প্রীতি… শ্রাবনদা বুঝি এই মালা গলায় পরে বসে থাকবে ? সে এটা নিয়ে পড়ার টেবিলের উপর গোল করে রেখে দিবে আর মাঝে মাঝে শুঁকে দেখবে… তার জন্য ছোট মালাটাই ভালো।”

“না.. না.. সুমনদি তুমি বড় মালাটাই নাও। ওটা দেখতে বেশ ভালো লাগছে। ছোট দুটো বর কনের জন্যই থাক। ”

সুমন আর তর্কে গেল না। বড় মালাটা হাতে নিয়ে মন্থর গতিতে চৌধুরী বাড়ির দিকে হাটতে লাগলো। আজকাল এ বাড়ি মুখো হলেই ওর বুক ঢিপ ঢিপ করে। কখন যে বড়মা ওকে ধরে বসবে কে জানে? কিন্তু বড়মার সাথে দেখা করাও দরকার। বন্দনা বৌদির ডেলিভারির সময় হয়ে এসেছে… কবে হবে শুনতে হবে ওর।

শ্রাবনের ঘরের বড় শিকের জানালার সামনে দাড়িয়ে এক ঝলক আগে ঘরের ভিতরটা পুরো দেখে নিলো সুমন। শ্রাবনদা মনযোগ দিয়ে কিছু লিখছে আর যখন কিছু মনে করার চেষ্টা করছে তখন থুতনির নিচের দাড়িগুলো থেকে থেকে চুলকাচ্ছে…

শ্রাবনদার এই ভঙ্গিমাগুলোর সাথে সুমন বহু দিন ধরে পরিচিত। দরজার গোড়ায় এসে দাড়িয়ে সুমন একা একাই ক্ষানিকটা সময় নিয়ে হাসলো। দুষ্ট একটা বুদ্ধি ততক্ষনে ওর মাথার মধ্যে কিলবিল করে বেড়াচ্ছে…

বৃষ্টি শেষে চারদিকটা কেমন যেন থমথমে হয়ে এসেছে, একভাবে ঝি ঝি পোকার ডাক ছাড়া আর তেমন কিছু কানে আসছে না… এমন সময় হুট করে কি একটা শ্রাবনের মাথা গলে গলার কাছে পড়তেই শ্রাবন চমকে উঠলো,” অ্যাই প্রীতি ”

কিন্তু পরক্ষনেই বড় দেয়াল আয়নায় পরিচিত একটা অবয়ব দেখতে পেয়ে নিজেকে দ্রুত সামলে নিলো শ্রাবণ। তারপর মালাটা একবার হাত দিয়ে পরখ করে দেখে জলদ গম্ভীর স্বরে বলে বসলো,”এটা কি করলি সুমো? ”

সুমন এতক্ষণ বেশ দুষ্টুমির মুডে ছিলো কিন্তু এবার শ্রাবনের গলার স্বরের গাম্ভীর্যে ভয় পেয়ে গেল।

“কে.. কেন..শ্রাবনদা.. কি হয়েছে? ”

” কি হয়েছে মানে? আজ এই সময় কারো গলায় মালা দিলে কি হয় তুই জানিস না? না জানলে প্রীতিকে জিজ্ঞেস করে আয়, আজ রাতে কারো গলায় মালা পরিয়ে দিলে কি হয়। ”

একেতো শ্রাবন খুব গম্ভীর হয়ে কথাগুলো বললো, সাথে তার চোখে মুখে কোথাও কোন কৌতুকের আভাস দেখা গেল না…. সবটা মিলিয়ে সুমন এবার বেশ ভয় পেলো। এসব কি আবোল তাবোল বলছে শ্রাবনদা! ভয়ে এতেটুকুন হয়ে গেলো সুমন। শ্রাবনদা কি বললো তার মানে এখন ওর কাছে স্পষ্ট কিন্তু এরকম বিষয় নিয়ে সুমনের সাথে পরিহাস করা কি শ্রাবনদার মানায় ?

“না.. না.. কক্ষনো তা নয় ” সুমন নিজেকে সামলাতে দ্রুত পালঙ্কের মাথা আকড়ে ধরলো। কিভাবে এতো বড় ভুল করে বসলো ও। ছি ছি লজ্জা….

” কি কক্ষনো নয়… আমাকে পছন্দ নয়? ” শ্রাবন হাতের কাগজগুলো ফাইলে ঢুকিয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো সুমনের দিকে।

“শ্রাবনদা ভালো হবে না বলছি… এসব নিয়ে তামাশা করবে না একদম, ” সুমন কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো।” এরকম ঠাট্টা করলে সত্যি আর কোনদিন তোমার সামনে আসবোনা কিন্তু ।”

” বারে তামাশা হবে কেন? এই নিয়ম তো আর আমি বানাইনি আর এখন বলেও কোন লাভ নেই, যা হবার হয়ে গেছে… মালা তুই আমার গলায় দিয়েছিস।”

সুমনের চোখদুটো তখন নোনাজলের ভারে নুজ্ব্য। শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে সুমনের হঠাত চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো.. এ কেমন ধরনের উপহাস.. ও ছোট মানুষ বলে, ওরা গরীব বলে বুঝি ওদের কোন আত্মসম্মানই থাকতে নেই! সবসময় শয়তানি..

” দিয়েছি তো দিয়েছি… এখন তুমি ওটা আমায় ফিরিয়ে দাও,” স্বরটা বুকের ব্যাথায় ভেঙ্গে আসতে লাগলো বুঝি সুমনের। অভাগীদের বোধহয় জীবনের পদে পদে এসব বিপদ লেখা থাকে, সামান্য একটু মজা করতে গেলেও তার চরম মূল্য দিতে হয় ওদের।

” বিয়ের মালা এভাবে চাইলেই ফিরিয়ে দেয়া যায় নাকি? এদিকে আয় আমি পরিয়ে দিচ্ছি।”

সুমনের মেজাজ এবার তুঙ্গে উঠলো , রাগে শ্রাবণের গলা থেকে টান দিয়ে মালাটাকে ছেড়ার জন্য হাত বাড়ালো , কিন্তু শ্রাবণের চোখে চোখ পড়তেই থেমে গেলো… সাহসে কুলালো না।

“খবরদার সুমো মালায় হাত দিলে আজ তোর জান খাব আমি, হাত সরা বলছি।”

কিন্তু রাগ তখনও সুমনের অস্থি মজ্জায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। শ্রাবনদা এভাবে ওকে অপমান করতে পারেনা, এতোটা অধিকার সুমন তাকে দেয়নি।

” তাহলে মালাটা তুমি আমায় ভালোয় ভালোয় ফেরত দাও। ”

” হুমকি দিচ্ছিস নাকি… বড্ডো বার বেরেছে আজকাল না? ”

” শ্রাবনদা দাও বলছি ” রাগ ছাপিয়ে অভিমান আর লজ্জা ধীরে ধীরে ছেঁকে ধরতে লাগলো সুমনকে। শ্রাবনদা এমন দুষ্টামী কেন করছে.. ওর সাথে এসব সিরিয়াস বিষয় নিয়ে হাসি ঠাট্টা করা কি শ্রাবনদার মানায়?

“বললাম তো এদিকে আয় আমি পরিয়ে দিচ্ছি।”

“না, কক্ষনো না.. তুমি.. তুমি ওটা ওখান থেকেই ছুড়ে দাও। ”

” জীবনেও না.. এটা পেতে হলে এখন তোকে আমার হাত থেকেই নিতে হবে। ”

” তবে থাক.. আমার ওটার কোন দরকার নেই, তুমিই ওটা দিয়ে বসে বসে পূজো করগে।”

শ্রাবনের হাসতে হাসতে বললো,” কিন্তু বিয়েটা অর্ধেক হয়ে থাকলো কিন্তু ”

“হলে হোকগে, “সুমন দুমদাম করে জোরে জোরে পা ফেলে ও ঘর থেকে বের হয়ে এলো।

কিন্তু শ্রাবণের ঘর থেকে বের হয়ে এলেও সুমন নিচে নামলো না। এ অবস্থায় ওর নিজের উপর বিন্দু মাত্র নিয়ন্ত্রণ নেই, বাড়ির লোকজন দেখল কি হয়েছে জানতে চাইবে, চোখ মুছতে মুছতে তাই ছাদে যাবার সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসলো সুমন।

মেঘ সরে গিয়ে তখন একটু একটু করে আকাশে চাঁদের আলোর সাথে তারার দলেরা ফুটছে। সুমন আচ্ছন্নের মতো সেদিকে তাকিয়ে নিজের মনের হাজার রকম প্রশ্নের সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছিলো। সুমন জানে সামাজিক ভাবে ওর মামাদের অবস্থান শ্রাবণদের তুলনায় কত নিচুতে… তার উপর ও আবার সেই মামার আশ্রিতা। ওদিকে রামনাথ চৌধুরী প্রতিনিয়ত তার ছোট ছেলের জন্য কত ভালো ভালো জায়গা থেকে শিক্ষিত,সুন্দরী মেয়ের প্রস্তাব আনছেন… পাত্রীর অভিভাবকরাও কত টাকা যৌতুকের প্রস্তাব রাখছে.. দুদিন আগে হোক বা পরে তাদের কারো সাথেই যে শ্রাবণদার বিয়ে হবে সেটা বলাই বাহুল্য। বড়মার মুখে প্রায়দিনই এসব প্রস্তাবের ফিরিস্তি শোনে সুমন, এরকম অবস্থায় শ্রাবনদার এমন আচরন সুমনের কাছে অপমান ছাড়া আর কি হতে পারে।

হতাশা আর অপমানের ব্যাথা এতো তীব্র যে রূপালী চাঁদের দিকে তাকিয়েও আসলে সুমন কিছুই দেখছিলো না। ছাদের রেলিংটা দুহাতে আকড়ে ধরে শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে রইলো। নিজের এই ছোট্ট জীবনের পথ চলাটা আজ আরও বেশি কঠিন মনে হতে লাগলো সুমনের, চোখের পানিতে সমস্তকিছু ঝাপসা হয়ে গেল ওর।

আচমকা নরম কিছু একটা বুকের কাছে এসে ঠেকতেই ঘাড় ঘুরালো সুমন। দেখলো শ্রাবন ওর পাশে নিঃশব্দে হাসছে। ঠিক যেমন কায়দায় ও শ্রাবনের গলায় মালা পরিয়ে দিয়েছিলো ঠিক সেভাবেই মালাটা আবার ওর গলায় ফিরে এসেছে।

দূরে তখন প্রীতির মেয়ের বিয়ের শাঁখের ঘন ঘন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে.. মেঘ সরে গিয়ে পরিপূর্ণ চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে গাছের পাতায় পাতায় …. তার নিচে একজোড়া মানব -মানবী শব্দহীন ভাবে এক অপরকে দেখছে নতুন আলোয় , নতুন সুরে।

চলবে……
তোমার পরিনীতা – ২৬

( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত পরিনীতার ছায়া অবলম্বনে)

লেখিকা- ফায়জা করিম

( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)

“কি হলো ওরকম বাঘের মাসির মতো চেয়ে আছিস কেন তুই? ”

সুমনের হঠাত ভীষন রাগ হলো, শ্রাবনদা শয়তানি করতে করতে আজকাল মাত্রা হারিয়ে ফেলছে। অন্য সময় যেমন তেমন… কিন্তু বিয়ে নিয়েও কেউ শয়তানি করে! কথা নেই বার্তা নেই দুম করে মালা পরিয়ে দিলো,তাও আবার এখন লগ্ন চলছে.. সুমন ভেবে পেলো না.. শ্রাবনদার সত্যি বিয়ে হলে নতুন বৌদি এসে বউয়ের কর্তব্য সব পালন করবে নিশ্চই কিন্তু ও না মানলে কি শ্রাবনদার ক্ষতি হয়ে যাবে ? কিন্তু ও তো আর সত্যি বউ না.. খালি মালা পরালেই কি বউ হয়.. শাখা নেই সিঁদুর নেই.. সাত পাকে ঘোরা নেই।

সুমনকে বাস্তবিক অর্থেই চিন্তিত দেখালো।

“যাও একটু দেখার মতো লাগছিলো একটু আগে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সিয়ামিজ বেড়ালের নানি.. চোখ দুটো ঠিক শাঁকচুন্নির মতো… কি অতো ভাবছিস শুনি? ” শ্রাবন হাসতে হাসতে সুমনের খোপাটা ধরে আলগোছে টান দিতেই, সুমনের চুলগুলো সারা পিঠ জুড়ে খেলে বেড়াতে লাগলো।

সুমনের এখন মেজাজ সত্যি খারাপ.. চট করে মালাটা খুলে শ্রাবণের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
” এটা প্রীতি তোমায় দিতে বলেছিলো… ।”

কিন্তু শ্রাবন মালাটা না নিয়ে উল্টো নিজের হাতদুটো বুকের উপর আড়াআড়ি শক্ত করে বাঁধলো,” যে জন্য এটা চেয়েছিলাম সেটা হয়ে গেছে। ”

উত্তর তো নয় যেন হুকুম জারি করলেন রাজা মশাই। সুমনের ঘটে ঢুকে না কেন অযথা শ্রাবনদা এমন করে সব পাকায়… ওর সাথে ঝামেলা করে কি সুখ পায় কে জানে, দুনিয়ার মেয়ে দেখে বেড়ায় অথচ একটাকেও বিয়ে করে না। ওকেই বা কত নম্বর গাধা মনে করে সেটাও এক কথা.. কিন্তু
সুমন ঠিকই জানে না যে ওর সাধ্য নেই শ্রাবণের পাশে থাকার, তবুও… শুধু শুধু শ্রাবনদা।

“আমি একটা ভুল করে ফেলেছি.. কিন্তু আমি তো ছোট শ্রাবনদা… তুমি গুরুজন, তোমার কি সেটা নিয়ে তামাশা করা মানায়? ” সুমন কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠলো।

“তামাশা! তামাশা করলাম কখন?” শ্রাবন বিস্মিত।

” নয়? শ্রাবনদা বিয়ে সমানে সমানে হয়… আমার মতো অনাথ, আশ্রিতা.. একজন গলগ্রহের তোমার মতো রাজপুত্রের পাশে কি করে মানায়… আর না লোকে সেটা মানবে? বলবে ঘুঁটেকুড়ানি এসেছে রাজপ্রাসাদ দখল করতে ”

শ্রাবন এতোক্ষণ হাসছিলো কিন্তু এবার সুমনের কথায় ওর হাসি মিলিয়ে গেল। এতো মোটেই ছোট বাচ্চাদের মতো অবুঝ কথা নয়, বরঞ্চ বেশ যুক্তিদিয়ে গোছানো কথা।

তাই শ্রাবনও এবার গম্ভীর হলো…

” আজকাল বেশ কথা বলতে শিখে গেছিস সুমো… এতো জানিস তো কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ সেটা কেন চিনতে শিখিস নি? ”

সুমন, শ্রাবণের কথার অন্তর্নিহিত অর্থ ঠিক ধরতে পারলনা। এর মধ্যে আবার কিসের ভালো আর কিসের মন্দ? কিন্তু বাইরে যতোই দেখাক ভিতরে ভিতরে সুমন কাঁপছিলো… সত্যিই বুঝি ওরম হয়.. শ্রাবনদা সত্যি কখনো ওর হতে পারে বুঝি! ওগুলো তো কেবল সিনেমা, নাটকে হয়।

শ্রাবন, সুমনের হাত থেকে মালাটা নিয়ে আবার সুমনের গলায় পরিয়ে দিতেই সুমনের চোখদুটো নদীর মতো ছলছল করতে লাগলো, অভিমানে ঠোঁটজোড়া ফুলে ফুলে উঠতে লাগলো।

সুমন কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বিকৃত স্বরে বলে উঠলো, “বার বার এই অত্যাচার করে খুব সুখ হচ্ছে বুঝি… কেন আমাকে এতো ছোট করছো?”

“মোটেই অত্যাচার করছি না, আমার জিনিস খোলা পেয়ে মানুষ যেমন খুশি পরখ করে দেখছিলো… তাই সুযোগ পেয়ে আজ সেই পথটাই আগে বন্ধ করলাম, এতে ছোট করার, কান্নাকাটি করার মতো কিছু হয়নি,” শ্রাবন থমথমে সুরে জবাব দিলো।

” মানে? ” সুমন অবাক, গরীব বলে শ্রাবনদা ওকে জিনিস ভাবে!

” কোন মানে নেই, তোকে অত বুঝতে হবে না ”

” কেন… কেন বুঝতে হবে না, আমি এখন এতোও ছোট না, বুঝুয়ে দিলে সব বুঝতে পারি।”

“তাই.. সব বুঝিস?” সরু চাঁদের মতো একফালি হাসি ঝলকে উঠে দ্রুত মিলিয়ে গেল শ্রাবণের ঠোঁটের কোনে।

“হ্যাঁ… বুঝিই তো ”

এরপর কথা নেই বার্তা নেই আচমকা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো শ্রাবন, সুমনকে জড়িয়ে ধরে ওর নরম কোমল ঠোঁটের উপর নিজের শুষ্ক খসখসে ঠোঁটজোড়া সজোরে চেপে ধরলো।

সুমন, শ্রাবনের এমন আচরনে বস্তুতো একশ তলা বিল্ডিং থেকে লাফিয়ে পড়লো কিন্তু ওর মরন হলো না। তবে সুমন পুরোপুরি ভড়কে গেলো। এরকম কিছু কখনো ওর সাথে বাস্তবে হতে পারে সেটা একেতো ওর কল্পনারও অতীত আর তার উপর আবার সেটা যদি হয় স্বয়ং শ্রাবনদা… যাকে হিসেবে সুমন যমের পরেই ভয় পায় তা সে মনে মনে যতোই ও তাকে ভালোবাসুক।

কিন্তু শ্রাবন তখন ভিন্ন জগতের আমোঘ আকর্ষনে ডুবে গিয়েছে। প্রিয়তমার অধরসুধা পান করার যে তীব্র ইচ্ছা এতোদিন ধরে একটু একটু করে সে নিজের ভিতরে লালন করছিলো… সেটা এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত মুহুর্তের সুযোগে মহীরুহর মতো ডালপালা ছড়িয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো শ্রাবন সমস্তটাই কেবল ওর নিজের আবেগ দিয়ে একতরফা ভাবে বিবেচনা করলো… অপরপক্ষ কি ভাবে পুরো বিষয়টা নিবে বা নিলো সেটা তখন ওর চিন্তারও বাইরে।

কয়েকটা মুহুর্ত সুমনের মনে হলো পৃথিবী স্থির আর ও বন বন করে ঘুরছে কিন্তু তারপরই অনুভব হলো, না… ও জায়গাতেই আছে কিন্তু ওর চারপাশের পৃথিবী নিজ অক্ষে ষোলশ কিলোমিটারের চাইতে বেশি বেগে ঘুরছে। মাথা ভালো করে ঘুরে উঠার আগেই এরকম অদ্ভুত মুহূর্ত থেকে মুক্তির জন্য সর্বোচ্চ গতিতে আঘাত হানলো সুমন।

শ্রাবন তখন কতটা বেসামাল ছিলো বলা মুশকিল
তবে এরকম অবস্থানে থেকে অতর্কিত আঘাত ওকে দুম করে বাস্তবে ফিরতে বাধ্য করলো।

থাপ্পরটা নিজে অতোটা বলশালী না হলেও শ্রাবণের মনের দেয়ালে তা বেশ জোরেশোরেই আঘাত হানলো।

একেত সুমনকে একান্তই তার নিজের অধিকারের বলেই মনে করে শ্রাবন, তার উপর এরকম রোমাঞ্চকর মুহুর্ত যখন মাথার উপরে চাঁদের আলোর ঢল নেমেছে, গলায় ভালোবাসার সাক্ষী সরূপ রজনীগন্ধার মালা ঝুলছে.. চোখের সাম্রাজ্যে হাজারো ফুটন্ত পদ্মের চাইতেও রক্তিম দুটো ঠোঁটের অভিমান ঝরে পড়ছে.. এমন অবস্থায় নিজেকে ধরে রাখা বড্ডো কঠিন ছিলো শ্রাবনের জন্য। তাই সুমনের ছোট্ট প্রতিরোধটি থামানোর বদলে উল্টো মৌচাকে ঢিল ছোড়ার কাজ করলো। বাঁধা পেয়ে আহত বাঘ আরও বেশি আক্রমনাত্মক হয়ে উঠলো।

সুমন সম্পূর্ণ বুঝে ওঠার আগেই এবার ছাদের চিলেকোঠার দেয়ালে ওকে চেপে ধরলো শ্রাবন।

“বড্ডো ঘেন্না হচ্ছে বুঝি? আমি না হয়ে আদিত্য হলে বোধহয় ভালো লাগতো তাই না? ”

সুমন, শ্রাবণের এমন ভয়ঙ্কর রাপের সাথে একেবারেই পরিচিত নয়। ছোটবেলা থেকেই শ্রাবণের কিছুটা শাসন আর কিছুটা স্নেহের সংমিশ্রণেই বড় হয়েছে সে কিন্তু তার কোনটার সাথেই আজকের শ্রাবনের কোন মিল খুঁজে পাচ্ছিলো না সুমন… এ যেন নতুন কেউ।

শ্রাবন যেন কোন মানুষ নয়, বিষধর সাপের মতোই ফোঁস ফোঁস করছিলো সে। সুমন এবার সত্যি ভয় পেলো।

“তু..তুত.. তুমি এমন কেন করছো শ্রাবনদা? ” ভয়ে কান্নার বেগ আরও বাড়লো সুমনের।

“কেন করলাম!.. তোর সাহস হলো কি করে আমার গায়ে হাত তোলার? তোকে আজ জ্যান্ত খেয়ে ফেলবো আমি শয়তান মেয়ে।”

সুমন এবার মাথা নিচু করলো, সত্যিই তো.. ওর এতো সাহস হলো কি করে শ্রাবনদার গায়ে হাত তোলার… অথচ ওই গালে সে প্রতিরাতে কতবার করে চুমু খায় মনে মনে, আর আজ সুযোগ পেয়েও হেলায় হারালো… আর কোনদিন হয়তো গালটা ছুঁয়ে দেখারও সুযোগ হবেনা।

“কি হলো জবাব দিচ্ছিস না কেন? ”

“আ.. আমি ইচ্ছে করে করিনি, ভুলে হয়ে গিয়েছে ”

সুমনের কান্নায় একটু নরম হলো শ্রাবন। কিন্তু তারপরও সদ্য ভালেবাসা জাহির করা প্রেমিক হৃদয়ের জ্বালাপোড়া তখনও বিদ্যমান। সেখানে ক্রোধের বদলে অভিযোগ আর অনুরাগ তখনও রেশারেশি করে নিজেদের জায়গা দখলের জোর চেষ্টা চালাচ্ছে… এমন অবস্থায় কাঁপতে থাকা ওষ্ঠপুট আর ভয়ার্ত দুটো চোখ শ্রাবণের মনের অবস্থার চৌদ্দটা বাজালো।

” তুই আজ আদিত্যর সাথে ডিলাক্সের ভিতর ঢুকেছিলি? ”

এই রে.. সুমনের হাত পায়ের তালুতে এবার জং ধরলো। কে ওর সাথে এমন শত্রুতা করলো যে শ্রাবনদার কাছে এই সামান্য খবরটাও চলে এলো। একদিনই মাত্তর ঢুকেছে..

“ও… ও.. আদিত্যবাবু জোর করলো, আমি তো যেতে চাইনি কিন্তু উনি জোর করে খাওয়াবেনই তো আমি কি করবো? ” মনে মনে আদিত্যর পিন্ডি চটকালো সুমন.. কি দরকার ছিলো ওকে নিয়ে ডিলাক্সের ঢোকার.. যত্তোসব।

” তাই… আদিত্যবাবু খুব জোর করলো বুঝি? ”

” তা নয় তো কি.. আমার কি খেয়ে দেয়ে কাজ নেই যে ওই ভর দুপুরে বৃষ্টিতে ভিজে রেস্তোরায় ঢুকবো, কিন্তু উনি এতো অনুরোধ করছিলেন , “বাকিটুকু মিনমিন করে বললো সুমন।
” তাই যেতে হলো।”

” হমম.. তারমানে তোর মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ফালুদাটা খেলি তাইতো? ”

শ্রাবণের স্বরে জিজ্ঞাসা না বিদ্রূপ ধরতে পারলনা সুমন তবে যাই হোক না কেন সেটা যে বিশেষ সুখকর কিছু নয় সেটা বুঝতে বিশেষ বেগ পেতে হলোনা সুমনের।

সুমন আসলে তখন ওর পায়ের নিচের মাটি খুঁজতে ব্যাস্ত… ফালুদার খবর শ্রাবনদা জানলো কি করে? দোকানের মালিক কি তাহলে শ্রাবনদার বন্ধু? শ্রাবনদাকে কি ও একবার জিজ্ঞেস করবে?

কিন্তু সুমন প্রশ্ন করার আগেই শ্রাবনের হিম শীতল চোখদুটো ফলার মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওকে এফোড় ওফোড় করতে লাগলো। সুমন উত্তর দিবে না নিজের পতন ঠেকাবে… ভয়ে জিহ্বাটাও যে ওর একচুল নড়তে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।

“কি হলো বল? ”

“ও আমি খাইনি… বিশ্বাস করো শ্রাবনদা ”

“কেন… আদিত্য কতো যত্ন করে তোর জন্য অর্ডার করলো দেখলাম ”

” কি! তুমি দেখলে? ” সুমনের চোখদুটো ছিটকে বের হয়ে আসতে চাইলো।

“হমম.. দেখলাম তো ”

” মিথ্যে কথা.. আমি যখন ডিলাক্সে ছিলাম তখন তুমি যে আমায় ফোন দিলে? ”

” দিলাম তো? দেয়া মানা নাকি… না আদিত্যর সাথে থাকলে তোকে বিরক্ত করা যাবে না? ”

“এ আবার কেমন কথা… কিন্তু তুমি তখন ওখানে সত্যি ছিলে? ”

“ছিলাম… কোনার কেবিনে এক ক্লায়েন্টের সাথে আলোচনা করছিলাম ”

“ওহ….. ”

সুমনের মুখটা সত্যি সত্যি এবার ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। কিন্তু আদিত্যর সাথে খেলে ওর অপরাধ হবে কেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন করার দুঃসাহস ওর হলোনা, যেন এটাই হওয়ার কথা ছিলো…. খুবই স্বাভাবিক।

সুমনের আধমরা চেহারাটা শ্রাবণের কাঠিন্যকে তরলে দ্রবীভূত করতে খুব বেশী সময় নিলো না যদিও সুমনের উপর অভিমানটা তখনও জারি আছে। দুপুরে মিস্টার অনিমেষ রায়ের সাথে ডিলাক্সে কথা বলে বের হবার সময় আদিত্যকে চোখে পড়ে শ্রাবনের। তার সূত্র ধরেই সামনে তাকাতে দূর থেকে সুমোকেও চোখে পড়ে ওর।

” আমি ফালুদা খাইনি শ্রাবনদা… একদম সত্যি বলছি।”

” কেন… ডিলাক্সের ফালুদাতো সবার পছন্দ ”

সুমনকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো শ্রাবণ।

“তা তো পছন্দ কিন্তু আদিত্যবাবু একটা আনালো”

“ওহ তাই বুঝি খেতে পারিসনি… ”

” না না, ওতো আমার জন্যই আনালো ”

” তবে…”

” আরে আমি খেতে যাবো তার আগেই আদিত্যবাবু হুট করে খানিকটা খেয়ে নিলো,আরেকজনের এঁটো খাবার.. ইয়াক.. দেখেই আমার গা গুলোচ্ছিলো ”

“তাই নাকি? ”

“তা নয়তো কি? নইলে ডিলাক্সের ফালুদা আমারো অনেক পছন্দ ”

” হমম.. বুঝলাম ” শ্রাবন মনে মনে কিছু একটা হিসেব করলো।

সুমন বুঝলনা সেটা কি তবে শ্রাবনদার রাগ একটু পড়েছে বলে মনে হলো, তাই আলগোছে নিজের মাথাটা দুলিয়ে সায় দিলো।

এরপর খানিকটা সময় দুজনেই আর বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছিলো না। হঠাত করে ঝোঁকের বশে যে সত্যটা শ্রাবন স্বীকার করে নিলো.. সুমনের কাছে সেটার উপস্থাপন তো হলো কিন্তু এই স্বীকারোক্তির মূল কারন যে প্রনয়ঘটিত জটিলতা, তার গভীরতা সুমন কতটুকু অনুধাবন করতে পারলো সেটা খোলাখুলি প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত বোঝা দায়, শ্রাবনের ভিতরের মাতাল হৃদয়টা ঘড়ির পেন্ডুলামের মতোই আশায়- নিরাশায় দুলতে লাগলো।

কিন্তু সুমনের মাথায় তখন হাজারো প্রশ্ন ডানা ঝাপটাচ্ছে। সত্যি কি ওর বিয়ে হয়ে গেল? কিন্তু কোন অনুষ্ঠান তো হলোনা… তবে আগের কালে নাকি শুধু মালা বদল করেও বিয়ে হয়ে যেত.. শকুন্তলা আর রাজা দুষ্মন্তর যেমন হয়েছিলো কিন্তু ওতে তো বর আর কনের মধ্যে ভালোবাসা থাকতে হয়… এমন খালি মালা পরালেই হলো নাকি.. তাহলে তো সিনেমা আর থিয়েটারে গন্ডায় গন্ডায় বিয়ে হতো। ওরা তো আবার নকল নকল শাঁখা আর সিঁদুরও পরায়। উমম… তাহলে বোধহয় এটাও হয়নি, কিন্তু আবার লগ্ন চলছে যে…

প্রীতি বাটিতে করে একটা মিষ্টি নিয়ে পিঁপড়ের মতো সারা বাড়িতে শ্রাবনকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলো… হাজার হোক ওর মেয়ের বিয়ের মিষ্টি বলে কথা কিন্তু শ্রাবনকে প্রীতি কোথাও খুঁজেই পেলনা। শেষকালে রামনাথের দূর সম্পর্কের এক বিধবা ভাগ্নীকে সামনে পেয়ে তাকে থামালো প্রীতি।

“ও নিমুদি ”

” কি প্রীতি? ”

“শ্রাবনদা কোথায়.. খুঁজেই পাচ্ছিনা।”

“আছে দেখোগে.. আধাঘন্টা আগে তো সুমনকে শ্রাবণের ঘরে যেতে দেখলাম ”

তাইতো সুমনদি তো মালা দিতে এসেছিলো.. প্রীতি আবারো শ্রাবনকে খুঁজতে লাগলো।

সুমন ভেবেই পাচ্ছিলো না, এখন আসলে ওর কি করা উচিত। তখন দুম করে ওর রাগ হয়ে গিয়েছিলো তাই কিন্তু এখন শ্রাবনদার পাশে দাড়িয়ে সুমন জ্বরো রোগীর মতো কাঁপছিলো। শ্রাবনদা ওকে চুমু খেয়েছে সজ্ঞানে এতো রীতিমতো দিনের বেলা তারা দেখার মতো অবিশ্বাস্য বিষয় সুমনের জন্য… সেই লটারীটা লাগলো কিন্তু ও টিকেট হারিয়ে ফেলেছে যে।

মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিলো ঘটনাটা কি সত্যি হয়েছিলো.. সুমন ঠিকমতো ঠাহরই করতে পারছিলনা।

“সুমনদি… ”

আচমকা চিলেকোঠার দরজা কাছে প্রীতির গলাটা শুনতে পেয়ে ধ্বক করে উঠলো সুমনের বুকটা। প্রীতু সবটা দেখে ফেলেনিতো?

” কিক.. কিরে? ”

” তোমরা এখানে আর আমি সারা বাড়ি চরকির মতো ঘুরলাম ”

“তোর মেয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে বুঝি প্রীতি? ” এতক্ষণে শ্রাবন মুখ খুললো।

” না শ্রাবনদা… বর পক্ষ মাত্র খাচ্ছে, আমি তো কতো কাজ ফেলল শুধু মেয়ের বিয়ের মিষ্টি বলে তোমাকে দিতে এলাম ” প্রীতি ব্যাস্ত ভাবে উত্তর দিলো।

” তাই বুঝি… আহ দেতো দেখি… শুভ কাজে মানুষকে মিষ্টি খাওয়াতে হয় এটা আবার অনেকে জানেই না, ” শ্রাবন হাত বাড়িয়ে মিষ্টির বাটিটা নিলো তাড়াতাড়ি।

“এ আবার না জানার কি হলো, আমি এগুলো কক্ষোনো ভুলি না শ্রাবনদা.. কতগুলো মেয়ে পার করলাম এ পর্যন্ত কিন্তু কখনো কেউ এতোটুকু ভুল ধরতে পারেনি, ” প্রীতি বিজ্ঞের মতো উত্তর দিলো।

” হমম.. তোকে দিয়ে হবে.. ভাবছি আমার বিয়ের দায় দায়িত্বও তোকেই দিয়ে দিবো ” শ্রাবন মুচকি হাসলো।

” সত্যিই শ্রাবনদা… আমি না বড় হয়ে ওয়েডিং প্ল্যানার হবো কেমন হবে বলতো? ”

” দারুন.. মিষ্টিটা ভালো কোথ থেকে আনালি রে?”

“ওই মোড়ের দোকান থেকে.. প্রীতি তুই এবার নিচে যা, আমরা এখুনি আসছি, ” সুমন তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে দিলো, আদিত্য মিষ্টি এনেছে শুনলে সেটা নিয়ে আবার কোন যুদ্ধ শুরু হয় কে জানে।

“আচ্ছা আমি তবে গেলাম, সুমনদি তুমি খাওয়া হলে বাটিটা সাথে করে নিয়ে এসো না হলে মা আবার চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় তুলবে ”

“আনছি তুই যা ”

প্রীতি চলে যেতেই সুমনও নিচে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো…

শ্রাবন তখনও খুটিয়ে খুটিয়ে মিষ্টিটা খাচ্ছে।

“সুমো ”

” বলো শুনছি ”

” নিচে নেমে আগে মাকে যেয়ে প্রনাম করে আশীর্বাদ নিবি, যদি জানতে চায় হঠাত প্রনাম করলি কেন বলবি আমি নিতে বলেছি..বলবি ছেলেমেয়ের জন্য মায়ের আশীর্বাদ সবচেয়ে বেশি জরুরি ”

” আচ্ছা…”

“এটা নে.. মিষ্টিটা ভালই.. খা.. ”

শ্রাবন আর দাড়ালো না, তরতর করে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো।

সুমন নির্নিমেষে বাটির অর্ধেক মিষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলো, মিষ্টিটা খেতে ওর সত্যি বড় লোভ হচ্ছে… কিন্তু ও খেলে শ্রাবনদার অকল্যান হবে না তো? কিন্তু..

কিন্তু স্ত্রী, স্বামীর এঁটো খেলে পাপ হয়না.. নইলে শ্রাবনদা ওকে নিজের আধা খাওয়া মিষ্টি খেতে দিতো নাকি?

চলবে…..

( ভুল ত্রুটি থাকতে পারে… চোখে পড়লে কমেন্ট করে জানানোর অনুরোধ রইলো)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here