তোমার পরিনীতা – ৮ম
( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিনীতা গল্পের ছায়া অবলম্বনে)
লেখিকা- ফায়জা করিম
( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)
লাবণ্য ঠিক বুঝতে পারছেনা এভাবে হুট করে মৌমিতার বুদ্ধিতে শ্রাবণদের বাসায় যাওয়াটা ওর ঠিক সিদ্ধান্ত হচ্ছে কিনা। সেদিন অমন করে শ্রাবণ চলে যাওয়ার পর মৌমিতাই ওকে বুদ্ধিটা দিলো…যে লাবণ্য এই সুযোগে সুমোর নাম করে শ্রাবণদের বাসায় ঘুরে আসতে পারে।
“কিরে অমন গুম হয়ে রয়েছিস কেন? ”
“অস্বস্তি হচ্ছে।”
“তুই না লাবু… এই বয়সে এসে অস্বস্তি হলে আর সাহস করবিটা কবে। দেখ আমার কথা শোন, যাই হোক তুই এটেম্টটা অন্তত নে। আমার ধারনা শ্রাবণ না তো বলবেই না উল্টো কিস করে বসতে পারে তোকে…. তাউ যদি…”
“যদি…. ”
“মনে কর শ্রাবণ ডিনাই ই করলো তোকে .. তবু তোর জন্য সামনে এগুনোটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। অন্তত ভুল অনুভূতি, দোদুল্যমান স্বপ্ন এগুলো তোকে আর তাড়া করে ফিরবে না।”
“হুম… ঠিকই বলেছিস। ”
“ইয়েহ…. ”
“আচ্ছা সুমোর জন্য কিছু একটা নিয়ে যাওয়া উচিত না। আফটার অল আমরা ওকে কেন্দ্র করেই ও বাড়িতে যাচ্ছি।”
“হ্যা.. সামনে কোথাও থেকে একটা গিফট বক্স নিয়ে নেই, ছোট মানুষ খুশি হয়ে যাবে।”
“নিয়ে নে, সাথে শ্রাবণের জন্যও বোধহয় কিছু একটা নেওয়া উচিত আমার। একদম প্রথম ওদের বাড়ি যাচ্ছি.. স্টুডেন্ট তো আর নই এখন। ”
“তাহলে চল সামনের মলে ঢুকি।”
“চল।”
অনেক ঘুরে ফিরে সুমনের জন্য একটা কাজল, এক ডজন চুড়ি আর এক বক্স চকলেট কিনলো মৌমিতা। লাবণ্য পছন্দ করে নেভী ব্লু রঙের একটা টি-শার্ট কিনলো শ্রাবণের জন্য, যদিও কেনার পর থেকে আবার কেমন যেন অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছিল… ভয় আর ভালোবাসার মিশেল।
শ্রাবনদের বাড়ির গেটে দিয়ে ওদের গাড়িটা ঢুকতেই কেমন যেন উল্টা পাল্টা লাগতে লাগলো লাবণ্যর। মনে হচ্ছে যেন ও নয়, শ্রাবণ ওকে দেখতে আসছে। টেনশনে বুকের মধ্যে এতো জোরে দ্রিম দ্রিম হচ্ছে যে হাতের তালু রীতিমতো ভিজে জবে জবে হয়ে গেছে।
ওদের দেখে নির্মলাতো রীতিমতো কেঁদে ফেললেন। মৌমিতাকে বলেই বসলেন, “তোমরা এসেছ খুব ভালো হয়েছে মা। এখন দু বান্ধবীতে মিলে কিছু একটা ম্যাজিক করতো দেখি যাতে তোমাদের গুনধর বন্ধুটি আমাকে একটা বৌ মা এনে দেয়। আমি আর বলে বলে পারছিনা।”
মৌমিতা, লাবণ্যর দিকে এক চোখ টিপে বললো “দেখেছিস লাবন্য . মাসীমা এখন শ্রাবণের জন্য বৌ খুঁজছে।”
“হ্যা মা.. তোমাদের বন্ধুটিকে একটু দয়া করে রাজি করাও। পাশ করে দু পয়সা আয় করছে সেই কবে থেকে… আর কতদিন এমন বাঁধনহারা হয়ে থাকতে চায় ও। সেই সংসারের জোয়াল যখন কাঁধে নিতেই হবে তখন এতো দেরি করে লাভই বা কি… বাচ্চা-কাচ্চা মানুষতো করতে হবে নাকি? ”
“একদম খাঁটি কথা বলেছেন মাসীমা.. আমরা এখন শ্রাবণ চৌধুরীর বিয়ের বাদ্য শুনতে চাই। প্যাম প্যা… প্যাম… ” মৌমিতা হাত দিয়ে ভেঁপু বাজালো।
মৌমিতার দুষ্টমিতে বাড়ির সকল উপস্থিত সদস্যরা খুব মজা পেলো।
শ্রাবণের খোঁজ করতেই জানা গেলো সে কোর্ট থেকে এখনও বাড়ি ফিরেনি, আরও আধাঘন্টা লাগবে। শ্রাবণের দেরী দেখে মৌমিতাদের দুপুরের খাবার একরকম জোর করেই খেতে বসালেন নির্মলা। খাবারের পরেও শ্রাবণ কেন… শ্রাবণের ছায়াও নজরে আসলনা লাবণ্যর। তার খানিকবাদে মৌমিতা বললো, “চল তো। ”
“কোথায়? ”
“তোর শ্রাবণের কাছে,” ফিসফিস করে বললো মৌমিতা।
“মানে? ”
“মানে সে কোর্ট থেকে এসে সোজা সুমনদের বাড়ি গিয়ে ঢুকেছে। মেয়েটা বোধহয় বেশ অসুস্থ। ”
সুমন অসুস্থ এ কথার চাইতে… শ্রাবণ বাড়ি না এসে সোজা সুমনকে দেখতে ছুটেছে এটাই লাবণ্যর জন্য ভয়নক ব্যাথার কারন হয়ে দাড়াল। কই সেদিন তো শ্রাবণ ওকে কথা বলার কোন সুযোগই দিলো না, উল্টো চলে এলো.. শ্রাবণের ওই ব্যবহারে লাবণ্য কত হার্ট হয়েছিলো, তার জন্য কি শ্রাবণের একটুও সরি ফিল করা উচিত ছিলনা। একটাবার কি সে ফোনে সরি বলতে পারতো না। মৌমিতা যতোই বলুক, সত্যি কথা হচ্ছে শ্রাবণের মনে ওর জন্য কোন অনুভূতিই নেই।
“নে চল।”
“চল।”
মৌমিতার তাড়ায় শেষ পর্যন্ত লাবণ্য উঠতে বাধ্য হলো। কিন্তু ও বাড়ি গিয়ে লাবণ্যর বুক ক্ষত বিক্ষত হওয়া ছাড়া আর কিছুই হলো না।
সুমন নামের মেয়েটা এক রকম নির্জীব হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে আর ওর মাথার কাছে বসে শ্রাবণ জলপট্টি দিচ্ছে। এই দৃশ্য হয়তো এই দুই বাড়ির সদস্যদের জন্য খুব স্বাভাবিক কিন্তু লাবণ্যর বুকটা ঈর্ষায় জ্বলে গেলো। কেন শ্রাবণ ওই মেয়ের জলপট্টি দিবে… আর কেউ কি নেই?
মৌমিতা ঘরে ঢুকেই আগে বিছানায় ঝুঁকে পড়ে হাত দিয়ে সুমনের গায়ের তাপটা মেপে নিলে,
” নাহ গায়েতো বেশ জ্বর আছে দেখছি। ”
“হুমম… শ্রাবণ ভারী স্বরে বললো।”
মৌমিতার স্পর্শের কারনেই হোক বা অন্য যে কোন কারনে সুমন আচ্ছন্ন ভাবে ওদের দিকে চোখ মেলে তাকালো। তারপর কাতর স্বরে বললো,” বড্ড জলের তেষ্টা পেয়েছে।”
সুমন আবার চোখ বন্ধ করার আগেই শ্রাবণ জলের গ্লাসটা সুমনের মুখের সামনে উচু করে ধরলো। শ্রাবণের সাথে সাথে মৌমিতাও সুমনকে পানি খেতে সাহায্য করলো।
কিন্তু যত্ন করে পানি খাওয়ানোর এই দৃশ্যটা সত্যি সত্যি ভীষন এক ঝড় তুললো লাবণ্যর মনের কুঠুরীতে, তুমুল তান্ডব শুরু করে দিলো। এই যে এতো যত্ন করে পানি খাইয়ে দিলো শ্রাবণ,সুমন নামের মেয়েটাকে সে কি শুধুই স্নেহ…. মৌমিতা ঠিক জানেতো?
“আমার মনে হয় জ্বর বেশি হলে বাড়ি না রেখে ওকে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করানো ভালো, ” মৌমিতা সুমনের গায়ে কাঁথা টেনে দিলো।
“সেটাই ভাবছি। আসলে আমার কাজের চাপ এই কয়দিনে এতো বেড়েছে যে হাসপাতালে থাকার মতো সময় করে উঠতে পারছিনা। আর আমি না থাকলে একা প্রীতি, সুমোর দেখাশোনা করতে পারবেন। ”
“তোর থাকা লাগবে কেন? ওর আত্মীয়রা সব কোথায়? ”
“আর আত্মীয়, যাক তোরা এসেছিস খুব ভালো লাগলো। সুমোটাকে নিয়ে বড্ড ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে ক’দিন। তোদের কোন খবরই জানিনা। অমিয় কোথায়? আর ঝগড়াঝাটি করিস নিতো? ”
“একদম জিজ্ঞেস করবিনা ওর কথা তুই, বাবুর আজ ব্যাংকে ইমপর্টেন্ট মিটিং আছে৷ তাই বের হতে হতে রাত হবে।” মৌমিতা গাল ফুলালো।
“তাহলে তো আটকে গেছে ভালোমত। ”
“হুম।”
“মৌমি তোরা সত্যি এসেছিস আমার না অনেকক্ষণ বিশ্বাস হচ্ছিল না। কতদিন পর আমাদের বাড়ি এলি বলতো। ”
মৌমিতা হাসলো,”আজকের সব ক্রেডিট কিন্তু লাবণ্যর। ওই বললো সুমন নামে কারো কিছু হয়েছে। সেজন্যই আমি বুঝতে পারলাম যে তোর সুমোর কিছু হয়েছে। ”
“একদম বাঁদর একটা, পড়ে গিয়ে যদিও হাত পা ভাঙ্গেনি কিন্তু গায়ে ব্যাথা আর জ্বর এসেছে ভালোই। অত ভারী মইটা যে ওর উপর এসে পড়েনি এটাই ওর সাত কপালের ভাগ্য বলতে হবে।”
“বাচ্চা মেয়ে… মাত্রই তো স্কুলের গন্ডী ছাড়িয়েছে। আর কিছুদিন যাক দেখবি কি রকম গম্ভীর হয়ে যায়… তখন নিজেই না আবার ভয় পেয়ে যাস।”
“আর…… কথায় আছে না যার নয়তে হয়না তার নব্বইতেও হয়না।”
“এতোও লাগবে না….. চার, পাঁচটা বছর যাক দেখবি কত বদলে যাবে,” মৌমিতা সুমনের মাথার চুলগুলো কপালের উপর থেকে সরিয়ে দুই পাশের কানের কাছে গুঁজে দিলো। সুমন আবার ঘুমে তলিয়ে গেছে।
লাবণ্য এতক্ষণ দুই বন্ধুর কথা শুনছিলো নীরবে কিন্তু এবার আর চুপ থাকতে পারলনা। ভিতরে ভিতরে একটা কালসাপ যেন প্রতিনিয়ত নিজের অস্তিত্বকে জানান দিচ্ছে, এক রকম ফুঁসে উঠেই জানতে চাইলো, ” শ্রাবণকে কি সুমনের গম্ভীর হওয়া দেখার জন্য নব্বই বছর পর্যন্ত সুমনকে তাড়া করে ফিরতে হবে? ”
প্রশ্নটা যতো রুক্ষভাবে করেছিলো লাবণ্য তার জবাবটা এলো তেমনি প্রান চাঞ্চল্যের সাথে।
“ঠিক বলেছ লাবণ্য… এই হতচ্ছাড়ি, মুখপুড়ির জন্য আমার নব্বই বছর পর্যন্ত ঠেঙ্গাতে বয়েই গেছে, আমি পারলে কালই ওর দায়িত্ব থেকে মুক্তি চাই। মৌমি দেখিস তো এই ফাজিলটার জন্য কোন বি.এ পাশ পাত্র চোখে পড়ে কিনা।”
উফ… উফ… উফ… শান্তি শান্তি… লাবণ্যর মনটায় আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো। সত্যি! সত্যি শ্রাবণ, সুমনের একটা ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দিতে চায়! এতো খুব ভালো একটা খবর।
মৌমিতা না পারুক দরকার হলে লাবণ্য নিজেই সুমনের জন্য ভালো একটা বিয়ের সম্মন্ধ খুঁজবে। বিয়ের পর শ্রাবণ, সুমনকে এতো যত্ন করতে চাইলে সুমনের শ্বশুর বাড়ির লোক সেটা কখনই মানবে না আর এই ফাঁকে লাবণ্য ঠিকই শ্রাবণকে নিজের করে নিবে।
…………………………………………
ঘুম ঘুম ক্লান্ত চোখে পাশ ফিরতেই মিষ্টি একটা হাসি ছড়িয়ে পড়লো সুমনের চোখে মুখে। হসপিটালের বেডের একদম শেষ প্রান্ত ঘেষে দু’হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে শ্রাবণ। মাথাটা এক পাশে কাত হয়ে থাকার কারনে ওর চুলগুলোর অর্ধেকটা অংশ এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে সুমনের বালিশের উপর। সুমন নিজের দুর্বল হাতটা বাড়িয়ে শ্রাবণের চুলগুলোর মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিলো। হালকা মুঠি করে আলতো সুরে ডাকলো, “শ্রাবণদা… ওঠ।”
“উমম ”
সুমনের ডাকে এটুকু জবাব এলো কেবল। তারপর মাথাটা পাশে থাকা বালিশের উপর রাখার একবার বৃথা চেষ্টা করলো শ্রাবণ তারপর আবারো গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। সুমন পুরো সময়টা চুপ করে কেবল দেখলো।
চারদিকটা এখনও ভালো করে পরিস্কার হয়নি। কেবিনের ঘষা কাঁচের ওপাশ দিয়ে বারান্দায় লোকজনের চলাচল দেখা যাচ্ছে অস্পষ্ট । দরজায় ভারাী পর্দা দুটো মাঝে মাঝেই হালকাভাবে দোল খেয়ে থেমে যাচ্ছে…. তার ফাঁক দিয়েই হঠাৎ হঠাৎ স্ট্রেচার টেনে নেওয়ার আর লোকজনের শব্দ কানে ভেসে আসছে।
সুমন আস্তে আস্তে উঠে বসলো। সামনের ঘুমন্ত মুখের একপাশটা এখন পুরোটাই ওর সামনে দৃশ্যমান। সুমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ঘুমন্ত শ্রাবণের দিকে, তারপর নিজেই ভয়ে জমে গেলো।
এই কয়েক সেকেন্ড আগেও সুমন একদম ঠিক ছিলো কিন্তু এই এক মুহুর্তের মধ্যেই ওর ভিতরে উল্টা পাল্টা কিছু একটা হয়েছে… ওর অনুমতি ছাড়াই। ঋতু যেমন পালা বদলায় তেমনি নিঃশব্দে সুমনের অনুভূতির রাজ্যে আচমকা এক পরিবর্তন ঘটে গেছে। কি ভীষন অদ্ভুত এক ইচ্ছে ওর উপর কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভর করলো ,এমন অদ্ভুত ইচ্ছে সুমনের আগে কক্ষনো, কোনদিন হয়নি। সুমন হতভম্বের মতো ঢোক গিললো।
এরকম দম আটকে আসা অনুভূতি সুমনের আগে কখনও হয়নি, ওর কোন ইচ্ছেই বোধহয় এর আগে কোনদিন এতো প্রগাঢ় ছিল না, কোন ভোর কখনও এতো আপন লাগেনি, এতোদিনের চেনা শ্রাবনদাকে দেখে বুকের মধ্যে এমন অল্প অল্প যন্ত্রনা মাখা সুখের ঢেউ কখনো উঠেনি … সুমন কাঁপতে কাঁপতে দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকলো, ওর এখন শ্রাবণদার থুতনিতে ভীষন একটা চুমু খেতে ইচ্ছে হচ্ছে…. এই.. এই ভয়নক বেয়াদবি ইচ্ছে ওর হলো কি করে… সুমন চেষ্টা করেও নিজের এই ভয়নক কাঁপুনি থামাতে পারছিলনা।
“কিরে সুমো এতো কাঁপছিস কেন? জ্বর কি আবার বেড়েছে? ” হাই তুলতে তুলতে জানতে চাইলো শ্রাবণ, আড়মোড়া ভাঙ্গলো। পাশের বেডে সুমনের মঞ্জু মামী তখনও ঘুমাচ্ছে।
“কিরে উত্তর দিচ্ছিস না কেন? ”
সুমনের কপালে হাত ঠেকিয়ে তাপটা দেখলো শ্রাবণ। না তাপমাত্রা তো স্বাভাবিকই আছে।
কিন্তু এমন হাতের স্পর্শে সুমনের কাঁপুনি বাড়লো বই কমলো না। কিন্তু এই কথা কোনভাবেই যে শ্রাবনদাকে বলা যাবেনা, জানলে সুমনকে জায়গাতেই গলাটিপে মেরে ফেলবে শ্রাবণ।
চলবে…….