তোমার সমাপ্তিতে আমার প্রাপ্তি ৩ পর্ব -১১+১২

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩
পর্ব (১১)

‘চৈত্রের সেতারে বাজে বসন্ত বাহার
বাতাসে বাতাসে ওঠে তরঙ্গ তাহার’

রবীন্দ্রনাথের লেখা এই দুখানা লাইন যেন তিহির জন্যই লিখেছিলেন! চৈত্রের প্রথম সপ্তাহের ঝকঝকে সকালে তিহির হাসির খিলখিল শব্দেই বুঝা যায়, মনের সকল প্রকোষ্ঠ বসন্তের রঙের মাখামাখি। চালচলনে সমুদ্রের ছন্দময়ী আদুরে তরঙ্গ।

রুকমিনি মুখার্জি সকালের নাস্তা সাজাতে গিয়ে আড়চোখে তাকাচ্ছেন তিহির দিকে। ইনার সাথে হাসিখুশি মুহূর্ত চলছে। তিহি কিছু একটা বলতে ইনা হাসতে হাসতে গলে পড়ছে মায়ের কোলে। সঙ্গে সঙ্গে গলে পড়া নরম শরীরটাকে ঝাপটে ধরছে তিহি। ঠোঁট থেকে যেন হাসিটুকু সরছেই না দুজনের। তিনি দেখছেন আর মুগ্ধ হচ্ছেন। তার সেই মুগ্ধতা কাটল তাপান মুখার্জির আগমনে। চেয়ার টেনে খাবারের জন্য প্লেট উল্টালেন। রুকমিনি মুখার্জি তিহির থেকে চোখ সরিয়ে আনলেন দ্রুত। স্বামীর প্রতি তটস্থ হলেন তাৎক্ষণিক। হাতে হাতে খাবার এগিয়ে দিচ্ছেন মনোযোগে।

তাপান মুখার্জি খাবার মুখে তুলতে ব্যস্ত হলে তিনি আবারও ফিরে তাকালেন তিহি আর ইনার দিকে। তারা আর দূরের সোফাতে বসা নেই। একটু পাশে সরে কিছু একটা নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে। তার কপাল কুঁচকে এলো। কী নিয়ে কথা হচ্ছে বুঝার চেষ্টা করলেন। দূর থেকে পারছেন না দেখে দুই কদম এগিয়ে গেলেন তাদের দিকে। সেই সময় ইনা দৌড়ে এলো। তার পিছু পিছু তিহিও এলো। রুকমিনি মুখার্জিকে মাঝখানে রেখে একে অপরের পেছন পেছন ঘুরছে। তাদের এই ছেলেখেলায় রুকমিনি মুখার্জি হেসে ফেললেন। কাঙ্ক্ষিত শান্তির বাতাসে দোল খেল মনের জানালার পাল্লা। বিড়বিড় করে বললেন, ‘ অবশেষে মা-মেয়ের দূরত্ব ঘুচল! ‘ সেসময় কাচ ভাঙার শব্দে কর্ণলতিকা কেঁপে উঠল। রুকমিনি মুখার্জি চমকে পেছনে তাকালেন। সাথে সাথে ভয়ে মুখমণ্ডল পাংশুটে বর্ণে ছেয়ে গেল। ছুটে গেলেন খাবার টেবিলে। স্বামী অগ্নিশর্মা হওয়ার আগেই ধমকে উঠলেন তিহিকে,
” কী করলি এটা? গ্লাসটা ভেঙে ফেললি? ইশ! উনার পুরো শরীর ভিজে গেছে। এখন বাইরে যাবে কিভাবে? ”

ধমকাতে ধমকাতে তিহিকে দূরে ঠেলে দিলেন রুকমিনি মুখার্জি। ইনা আম্মুর হাত ধরে টানতে টানতে বলল,
” আম্মু, পালাও। দাদু বকবে। ”

তিহি তখনও মাথা নিচু করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। যেন তাপান মুখার্জির বকা না খাওয়া পর্যন্ত সরবে না! রুকমিনি মুখার্জি স্বামীকে চেয়ার থেকে দাঁড় করিয়ে দ্রুত বললেন,
” চলো, শার্টটা পালটে দেই। ”

তিনি চোখমুখ শক্ত করে তিহির দিকে তাকালে রুকমিনি মুখার্জি চট করে তিহির সামনে এসে দাঁড়াল। কাঁধে হাত রেখে জোর করে অন্যদিকে ঘুরিয়ে সামনে ঠেলে দিলেন। রাগ সুরে আবারও ধমকে উঠলেন,
” এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছিস? মানুষটাকে শান্তিতে পানিও খেতে দিলি না। যাবি নাকি থাপ্পড় খাবি? ”

রুকমিনির এমন কৃত্রিম রাগে তিহিকে একফোঁটাও ভয় দেখাতে পারল না। শুধু ঘাড় বাঁকিয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকল। ইনা আর অপেক্ষা করতে পারল না। সে সর্বশক্তিতে আম্মুকে টেনে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। সে সুযোগে রুকমিনি মুখার্জি স্বামীর দিকে ঘুরলেন। শশব্যস্ত হয়ে বললেন,
” শার্ট ইস্ত্রী করাই আছে। তুমি এসো আমার সাথে। ”

রুকমিনি মুখার্জি তাড়া নিয়ে রুমের দিকে হাঁটা ধরলে তাপান মুখার্জি বললেন,
” মেয়েটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে। ”

স্বামীর এমন বাক্যে রুকমিনি মুখার্জি নিজের জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মন্থর গতিতে পেছন ঘুরলেন। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলেন,
” কার কথা বলছ? ”

তাপান মুখার্জি ভেজা শার্টে চেয়ারে বসলেন। রুটি ছিঁড়ে বললেন,
” যাকে নিজের মেয়ের মতো আগলে রাখছ তার কথা বলছি। তিহি সুস্থ হচ্ছে। ”

তাপান মুখার্জির মুখে তিহির নাম শুনে হকচকিয়ে গেলেন। এক্সিডেন্টের পর তিহিকে বাড়িতে আনায় ঘোর আপত্তি করেছিলেন তিনি। স্ত্রীর অশ্রুসিক্ত নয়নের অনুরোধ ফেলতে পারছিলেন না বলে বাড়িতে জায়গা দিলেও স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন তিহি সম্পর্কিত কোনো প্রসঙ্গেই যেন তাকে টানা না হয়। রুকমিনি মুখার্জিও স্বামীর সেই কথা মেনেছেন। সেই প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত এক হাতে সব সামলেছেন, সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেই মানুষটা এই প্রথম তিহিকে নিয়ে কথা বলছেন। তার পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন। ব্যাপারটা তাকে খুব আনন্দ দিল। হৃদয় পুলকিত হলো। উৎসাহ নিয়ে স্বামীর কাছে ছুটে এসে বললেন,
” হ্যাঁ, একদম সুস্থ হয়ে গেছে। ইনাকে মেনে নিয়েছে, ভালোবাসছে, হাসছে, খেলছে। পুরো বাড়ি মাতিয়ে রেখেছে। আমি তো এইটুকুই চেয়েছিলাম। আমার এত দিনের পরিশ্রম, কষ্ট আজ সার্থক। ”

তাপান মুখার্জি রুটি মুখে দিতে গিয়েও মাঝপথে থেমে গেলেন। একপেশে হেসে বললেন,
” তোমার কি মনে হয় এই আমূল পরিবর্তন তোমার জন্য ঘটেছে? ”

রুকমিনি মুখার্জি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারলেন না। কেমন যেন দ্বিধায় জড়িয়ে গেলেন। সন্দেহ দৃষ্টি রেখে বললেন,
” আমার জন্য নয়? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” ইশাদের জন্য। ”

ইশাদের নাম কানে বাজতে তিনি মৃদু কেঁপে উঠলেন। এক মুহূর্তের জন্য চেতনা হারালেন। দুর্বল কণ্ঠে প্রতিবাদ করলেন,
” না। ওর জন্য কিছু হয়নি, কিছু না। তিহিকে আমি সুস্থ করেছি। আমি দেখে রেখেছি, সামলেছি। ”

তাপান মুখার্জি পাশের চেয়ারটি টেনে বের করলেন। স্ত্রীকে টেনে এনে বসিয়ে বললেন,
” সত্যিটা তোমাকে মানতে হবে, রুকমিনি। আমি মানছি তিহির বেঁচে থাকা সম্ভব হয়েছে তোমার জন্য। কিন্তু সঠিকভাবে জীবনযাপন করা সম্ভব হয়েছে ইশাদের জন্য। তিহি আর তোমার মধ্যে আমি কখনও ছিলাম না। তবুও বলতে পারি, ইশাদের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই তিহির চালচলনে ইতিবাচক পরিবর্তন শুরু হয়েছে। ”

রুকমিনি মুখার্জি প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে পারলেন না। না চাইতেও ইশাদের সাথে তিহির কাটানো দিনগুলো মস্তিষ্কে ঘুরঘুর করতে লাগল। মানতে ইচ্ছে হলো, ইশাদের উপস্থিতিতেই তিহি প্রথম হেসেছে, রাগ করেছে, অভিমান করেছে, কেঁদেছে, আহ্লাদী আবদার নিয়ে হাজির হয়েছে। একজন সুস্থ মানুষের মতো অনুভূতির নানা দিকগুলো প্রকাশ করেছে। তার আগে বেঁচে থাকলেও সবকিছুতে ছিল উদাসীনতা, অসারতা, অনীহা। যেন বসে বসে মৃত্যুর অপেক্ষা করত।

তাপান মুখার্জি মাথাটা স্ত্রীর দিকে এগিয়ে নিলেন খানিকটা। কোমল স্বরে বললেন,
” মেনে নেও, রুকমিনি। এতেই তিহির ভালো হবে। ”

রুকমিনি মুখার্জি রাগে জ্বলে উঠলেন। মমতাময়ী চেহারায় অগ্নি দর্শন হলো। চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে বললেন,
” কী মেনে নিব? কেন মেনে নিব? তোমার কি জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে? ভুলে যেও না তিহি তাজের বউ। ”

তাপান মুখার্জিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তিনি আবার বললেন,
” তুমি তো বলেছিলে তিহির কোনো ব্যাপারে কথা বলতে আসবে না। তাহলে আজ কেন আসছ? ”

তাপান মুখার্জি স্ত্রীর প্রশ্ন উপেক্ষা করে বললেন,
” তিহিকে ছেলের বউ হিসেবে গ্রহণ করলেও যত্ন-আত্তি করেছ মেয়ের মতো। তাই বলব, শাশুড়ির মতো না মায়ের মতো ভাব। তোমার এক সিদ্ধান্তে ওর জীবনটা সম্পূর্ণ বদলে যাবে। ”

কথাটা বলে তাপান মুখার্জি গ্লাসে পানি ঢেলে খেলেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে বাইরে যাওয়ার জন্য মূল দরজার দিকে এগুচ্ছেন। তখনই পেছন থেকে স্ত্রীর আকুল গলা পেলেন,
” কিন্তু আমার ছেলের কী হবে? ও যে তিহিকে খুব ভালোবাসে! ”

তাপান মুখার্জি পেছন ঘুরার প্রয়োজন মনে করলেন না। দরজার বাইরে একপা ফেলে বললেন,
” বাবা হিসেবে যেমন মানি, তিহির জন্য আমার ছেলেকে হারিয়েছি তেমন বাবা হিসেবে এটাও মানি তিহির এই দুর্দশার জন্য দায়ী আমার ছেলে। তাজের মা হিসেবে তোমারও এটা মানা উচিত। কারণ, আমার থেকে তুমি ওকে ভালো করে চিনো, জানো। ”

তাপান মুখার্জি বেরিয়ে গেলেন। রুকমিনি মুখার্জি স্তব্ধ, স্থির হয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলেন অনেক্ষণ। কাজের মেয়েটা দরজা আটকে দুপুরের রান্নার কথা জিজ্ঞেস করলে চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেলেন। ভেতরে ঢুকতেই ইনা বিরতিহীন চিৎকার করল,
” দাদি এসেছে, দাদি এসেছে। ফোন লুকাও, ফোন লুকাও। আম্মু, ফোন লুকাও। ”

তিহি ফোন লুকানোর আগেই রুকমিনি মুখার্জি ফোন কেড়ে নিলেন৷ কানে চেপে ধরতে শুনলেন ইশাদ বলছে,
” এত অধৈর্য্য হলে কীভাবে হবে, তিহিপাখি? একটু অপেক্ষা করো, তোমার আম্মা ঠিক বিয়েতে রাজি হবে। আমি উনাকে যতটুকু দেখেছি তাতেই বুঝে গেছি, তোমাকে কতটা ভালোবাসেন। আল্লাহ নিশ্চয় উনার মন সহজ করে দিবেন। বুঝিয়ে দিবেন কোনটাতে তোমার…..”
” তুমি কি বাসায়? ”

তিহির বদলে রুকমিনি মুখার্জির কণ্ঠস্বরে থতমত খেল ইশাদ। অপ্রস্তুত হয়ে টেনে টেনে বলল,
” কেমন আছেন, আন্টি? ”

রুকমিনি মুখার্জি প্রশ্নটা এড়িয়ে বললেন,
” তোমার আম্মু যদি আশেপাশে থাকে তাহলে তার কাছে ফোনটা দেও। ”

ইশাদ ভয় পেল। ইতস্ততভাবে বলল,
” আমি তো হসপিটালে। ”
” তাহলে উনার নাম্বারটা আমাকে পাঠাও। ”
” কেন? ”
” শুধু তোমার কথাই তো মেয়েকে তুলে দিতে পারি না। অভিভাবকের মত লাগবে। ”

___________
ইশাদ হঠাৎ কল দিয়ে বলেছিল, সে আসছে। দুপুরে একসাথে খেতে খেতে একটা সুসংবাদ দিতে। ইমদাদ তার কণ্ঠের উচ্ছলতায় বুঝে গিয়েছিল কী সুসংবাদ শুনতে চলেছে। তবুও তার কাছ থেকে না শোনা পর্যন্ত চাপা একটা উত্তেজনায় ডুবে থাকল। ফোন করে মিহিকে বলে দিল রাধুনিকে বলতে ভালো কিছু রান্না করতে।

ইমদাদ ইশাদকে তার চেম্বার থেকে নিয়ে একসাথে বাসায় ফিরেছে। ভেতরে ঢোকার পর থেকে তার অস্থিমজ্জায় বাচ্চাদের মতো চঞ্চলতা ঢুকে গেল। ইশাদকে ফেলে নানা বাহানায় রান্নাঘরে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। একবার তো বলেই ফেলল,
” মিহি, তোমাকে অন্য রকম লাগছে কেন? ”

মিহি স্বাভাবিক গলায় বলল,
” মা বলেছিল, শাড়ি পরলে মেয়েদের অন্য রকম লাগে। ”

ইমদাদ সন্দেহ কাটাতে সাথে সাথে প্রশ্ন করল,
” বিয়ের দিনও তো পরেছিলে তখন তো অন্য রকম লাগেনি। ”

মিহি শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে বলল,
” লেগেছিল, আপনি খেয়াল করেননি। ”

ইমদাদ ভাবনায় পড়ে গেল। মনে করার চেষ্টা করতে লাগল, সেদিনও মিহিকে অন্য রকম লাগছিল নাকি।

খাবার খেতে খেতে ইশাদ সুসংবাদ বলে দিল। ইমদাদের চাপা উচ্ছ্বাসটা ঠিক মতো প্রকাশ পেল না। এই প্রথম তার মনোযোগ ইশাদের চেয়ে মিহির দিকে চলে গেছে। সে বিস্ময় নিয়ে বলছে,
” শুক্রবার তো কালকেই। তার মানে কালকেই তিহি আপু আর তোমার বিয়ে? ”

ইশাদ ভাতের দলা জমাতে জমাতে বলল,
” সেরকমই তো মনে হচ্ছে। উনি অবশ্য সরাসরি বিয়ের কথা বলেননি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আর দেরি করবেন ন। ”

মিহি ইশাদের পাতে সালাদ দিয়ে বলল,
” বিয়েতে আমিও যাব? ”
” হ্যাঁ, তোরা না গেলে হবে নাকি! ”

মিহি খুব খুশি হলো। হালকা হেসে ইমদাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
” খাচ্ছেন না কেন? রান্না ভালো হয়নি? ”

ইমদাদের চোখের পলক নড়ল। ঘন ঘন পাতা ফেলে ভাত মুখে দিয়ে বলল,
” হ্যাঁ, খুব ভালো হয়েছে। ”

মিহি ইমদাদের সামনে থেকে প্লেট সরিয়ে বলল,
” ভালে হলে তো খেতেনই। ”

অন্য প্লেটে নতুন করে ভাত আর ভাজা মাছ দিয়ে বলল,
” ঐ তরকারিটা আমি রেঁধেছি, তাই ভালো হয়নি। আপনি এটা খান। ”

ইমদাদ ভারি অখুশি হলো। বুঝতে পারল মিহির রান্না করা তরকারি না খেয়ে তাকে দেখা উচিত হয়নি। নিশ্চয় দুঃখ পেয়েছে। এমন শাড়ি পরা অন্য রকম দেখতে হওয়া মেয়েটাকে দুঃখ দেওয়া অন্যায়। তার একটা শাস্তি পাওয়া উচিত। কী শাস্তি পাবে? কে দিবে এই শাস্তি?

ইশাদ খাওয়া শেষে হাত ধুতে ধুতে বলল,
” তোর কি আজ সরকারি ছুটি? চেম্বারে ফিরবি না? এমন পিঁপড়ের মতো খাচ্ছিস কেন? ”

ইশাদের ধমকে নাকেমুখে খাবার তুলে খাওয়া শেষ করল ইমদাদ। মিহির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সিঁড়ি কাটতে কাটতে আচমকা চেঁচিয়ে বলল,
” মিহি বড় হয়ে গেছে! ”

ইশাদ পাশ থেকে জিজ্ঞেস করল,
” কী হয়েছে? ”

ইমদাদ দাঁত দিয়ে জিভ কাটল। কথা কাটিয়ে নিতে বলল,
” রিকশা নিবি নাকি হেঁটে যাবি? ”

ইশাদ উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেল না। তার আগেই ইমদাদ বলল,
” বন্ধু, আমার শরীরটা আজ ঠিক লাগছে না। তুই চলে যা। আমি একটু বিশ্রাম নিয়ে পরে যাব। ”

ইশাদ উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
” ঠিক লাগছে না? হঠাৎ কী হলো? আচ্ছা, আমিও নাহয় পরে…”

ইমদাদ তাৎক্ষণিক বলল,
” এই না। তুই কেন পরে যাবি? তেমন কিছু না। বেশি খেয়ে ফেলেছি তো তাই মাথা ঘোরাচ্ছে। একটু বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে। তুই যা। ”

ইশাদকে ঠেলেঠুলে বড় রাস্তায় পাঠাল ইমদাদ। দূর থেকে রিকশা ইশারা করে বলল,
” বেশি খারাপ লাগলে আমি ফোন করব। ”

ইশাদ খানিকটা চিন্তিত বদনেই রিকশা করে চলে গেল। ইমদাদ ছুটে ফিরে আসল। চপলতায় কলিংবেল চাপছে বিরামহীন। মিহি দরজা খুলে খানিকটা অবাক হয়ে বলল,
” আপনি এখনও যাননি? ”

ইমদাদ তার থেকেও দ্বিগুণ পরিমাণের অবাক কণ্ঠে বলল,
” তুমি না শাড়ি পরেছিলে? ”
” হ্যাঁ। ”
” তাহলে পাল্টেছ কেন? ”
” ইশাদ ভাইয়া চলে গেছে তাই। ”
#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩
পর্ব (১২)

” তুমি না শাড়ি পরেছিলে? ”
” হ্যাঁ। ”
” তাহলে পাল্টেছ কেন? ”
” ইশাদ ভাইয়া চলে গেছে তাই। ”

ইশাদের চলে যাওয়ার সাথে শাড়ি পালটানোর কী সম্পর্ক বুঝতে পারছে না ইমদাদ। সন্দেহ কাটাতে জিজ্ঞেস করল,
” ইশাদ চলে গেলে শাড়ি পালটাতে হবে? ”
” হ্যাঁ। ”
” কেন? ”
” আমি তো উনার জন্যই শাড়ি পরেছিলাম। ”

ইমদাদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি ইশাদের জন্য শাড়ি পরেছিলে? ”

মিহি আগের মতোই সরলমনে বলল,
” হ্যাঁ। মা বলেছিল, আমি যেন ইশাদ ভাইয়ের সামনে শাড়ি পরে ঘুরঘুর করি। তাহলে উনার ভালো লাগবে। আপনার এখানে আসার পর আমার কোনো শাড়ি ছিল না তাই পরতে পারিনি। ঐ দিন আসার পথে আন্টি একটা উপহার দিয়েছিল। সেটাই আজ পরেছি। ”

মিহির সরল বয়ানে ইমদাদ ভারি বিরক্ত হলো। রাগও হলো খুব। চটে গিয়ে বলতে চাইল, ‘ তখন তোমার ইশাদের সাথে বিয়ের কথা ছিল তাই হয়তো বলেছে। কিন্তু এখন তো তোমার বিয়ে হয়েছে আমার সাথে। সে হিসেবে শাড়ি পরে আমার সামনে ঘুরঘুর করবে। ‘ বলা হলো না। ভেতরের রাগ ভেতরে নিয়েই দরজা ছেড়ে ফিরে গেল সিঁড়ির মুখে। মিহি চিৎকার করে জানতে চাইল,
” আপনি কি চলে যাচ্ছেন? ”
” হ্যাঁ। ”
” কেন এসেছিলেন সেটা তো বললেন না? ”

ইমদাদ কয়েক সিঁড়ি নেমে পেছনে তাকাল। মিহির আপাদমস্তকে দ্রুত চোখ বুলিয়ে বলল,
” তোমার কাছে নয়, অন্য একজনের কাছে এসেছিলাম। ”

কথাটা বলে আরেক সিঁড়িতে পা দিবে সেসময় মিহি বলল,
” মিতু আপুর কাছে এসেছিলেন? ”

মিতু নামটা কর্ণ গহ্বরে প্রবেশ করতে ইমদাদ এলোমেলো হয়ে গেল। শরীরের বল হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়! সিঁড়ির রেলিং চেপে ধরে নিজেকে রক্ষা করে বলল,
” মিতু! কে মিতু? তুমি চিনলে কী করে? ”

মিহি দরজা ছেড়ে ইমদাদের দিকে অগ্রসর হতে হতে বলল,
” সকালে চিনেছি। আপনাকে খুঁজতে এসেছিল। ”

ইমদাদ ঘোড়ার ন্যায় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো। মিহির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে জিজ্ঞেস করল,
” তোমার সাথে দেখা হয়েছে? কথা হয়েছে? ”

মিহি মাথা উপরনিচ করতে সে দ্রুত প্রশ্ন করল,
” কী কথা? ”

মিহি একটু সময় নিয়ে বলল,
” তেমন কিছু নয়। আমি কে, এখানে কেন, আপনার কী হই এসব জিজ্ঞেস করছিল। ”
” উত্তরে কী বলেছ? ”
” বলেছি, আমি মিহিম্মা মিহি, আপনার বউ। বিয়ে হয়েছে তাই এখানে আছি। ডিভোর্স হলে চলে যাব। ”

ইমদাদ বিস্ফারিত চোখে বলল,
” এগুলো বলেছ? ”

মিহি নিরুদ্বেগে বলল,
” হ্যাঁ। ”

ইমদাদ কিছু বলতে পারল না। কয়েক সেকেন্ড ফোঁসফোঁস শব্দে নিঃশ্বাস ফেলে চলে গেল।

_______
ইমদাদের পুরো বিকেল কাটল বিরক্তে, রাগে আর দুঃখে। একটুতে রাগারাগি করল চিকিৎসায় সহযোগিদের সাথে। একবার তো একটা ইনজেকশন ভেঙেই ফেলল। চিনি কম হয়েছে বলে চা দিতে আসা এক বাচ্চা ছেলেকে চড় মেরে বসল। সন্ধ্যা কাটাল এই রাগের কারণ খুঁজতে খুঁজতে, পেল না। মিতুকে ভাবনায় আনতেই পারল না। বার বার মিহির কথাগুলোই মনে পড়ছে। তাহলে কি মিতুর সামনে বউ বলেছে বলে তার রাগ হয়েছে নাকি ডিভোর্স হলে চলে যাবে বলে কষ্ট হচ্ছে! যে কষ্ট প্রকাশ পাওয়ার পথ না পেয়ে রাগে রুপান্তর হয়েছে? ইমদাদ চেয়ারে শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে এসব ভাবছিল তখনই ল্যান্ডলাইনে কল আসল। ধরতে মিহি বলল,
” আপনি কি মোবাইল নিতে আসবেন না? মিতু আপু বার বার কল করছে। আমি কি ধরব? ”

ল্যান্ডলাইনে মিহির কণ্ঠ পেয়ে ইমদাদ বিস্মিত হলো। পরমুহূর্তে মিতুর নাম শুনে আগের রাগ তাজা হলো। একটা রামধমক দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। চুপচাপ ফোন কেটে দিল। কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থেকে নিজেই কল দিল মিহির কাছে। সে ধরলে বলল,
” মিতুর সাথে আমার দু-মাসের প্রেম ছিল। আমরা একসাথে ঘুরেছি, থেকেছি, ঘনিষ্ঠ হয়েছি। ”
” আপনি এটা বলার জন্য কল দিয়েছেন? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” মিতুর মতো আমার অসংখ্য মেয়ের সাথেই এমন প্রেম ছিল, ঘনিষ্ঠতা ছিল। যাদের নাম আমার মনে নেই। ”
” নাম মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য কল করেছেন? কিন্তু আমাকে তো আগে তাদের নাম বলেননি। মনে করিয়ে দিব কিভাবে? ”

ইমদাদ ফট করে কল কেটে দিল। মনে মনে নিজেকে গালাগাল করে বিড়বিড় করল, ‘ আমি কাকে কী বলছি? কেন বলছি? মিহি কি এসবের কিছু বুঝবে? বাচ্চা একটা! ‘ বাচ্চা শব্দটা উচ্চারণ করতেই দুপুরের সেই শাড়ি পরা মিহির মুখটা ভেসে উঠল। মুহূর্তে ইমদাদের রাগ পড়ে গেল। দুষ্টু হেসে বলল, ‘ অতটাও বাচ্চা নয়। পুরুষের নজরে পড়ার মতো হৃষ্টপুষ্ট গড়ন আছে তার। ‘

_________
ইমদাদ রাতে বাড়ি ফিরল হাতে শপিং ব্যাগ নিয়ে। মিহির হাতে দিয়ে বলল,
” ফোনে বলছিলে না তোমার শাড়ি নেই? তাই নিয়ে আসলাম। ”

মিহির নিজের বলা কথাটুকু মনে করিয়ে দিয়ে বলল,
” নেই বলিনি তো, বলেছিলাম আপনার এখানে আসার পর…”
” ঐ একই হলো। ”

মিহিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল,
” তুমি মাঝে মাঝে বেশি কথা বলো। ”

মিহি কিছু একটা বলতে চেয়েছিল আর বলল না। চুপ হয়ে গেলে ইমদাদ বলল,
” দাঁড়িয়ে আছ কেন? প্যাকেট খুলে দেখ, ঠিক আছে নাকি। ”

মিহি শপিংব্যাগের মুখ খুলে ভেতরে তাকিয়ে বলল,
” ঠিক আছে। ”

ইমদাদ অসন্তোষ্ট হয়ে বলল,
” এভাবে দেখলে বুঝবে নাকি? পরে দেখ। ”
” আমি শাড়ি পরতে পারি না। ”
” দুপুরে না পরলে? ”
” তখন রাধুনি খালা পরিয়ে দিয়েছিল। ”

ইমদাদ হতাশ হলো। নিরাশমনে কাপড় বদলাতে স্নাগারে ঢুকল। ক্লান্ত ধুয়ে সতেজ হয়ে বেরুতে চমকাল। বিস্ময়াভিভূত হয়ে মিহিকে সুধাল,
” তুমি না বললে শাড়ি পরতে পার না? ”
” ভেবেছিলাম পারি না। চেষ্টা করতেই পারলাম। ”

ইমদাদ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে মিহিকে দেখছে। এমন গাঢ় দৃষ্টিতে এর আগে কাউকে দেখেছিল কি? ইমদাদ ঘোর কাটিয়ে বলল,
” ভালো লাগছে। ”
” ভাত দেব? ”

এমন মুহূর্তে ভাতের প্রসঙ্গ টেনে আনায় ইমদাদ হেসে ফেলল। খেতে বসে বলল,
” তুমি খুব সরল ও সাদাসিধে। ”
” আপনার এমন পছন্দ না, তাই না? ”
” এরকম বলেছি? ”

মিহি পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,
” বলতে হবে কেন? আমি বুঝেছি। ”
” কী করে বুঝলে? ”
” মিতু আপুকে দেখে। ”
” একজনকে দেখেই বুঝে গেলে? ”
” হ্যাঁ, আপনিই তো বললেন আপনার সব প্রেমিকা মিতু আপুর মতো। ”

_______
শাড়ি পরেই মিহি বিছানায় শুয়ে পড়ল। ইমদাদ আলো নেভানোর আগে জিজ্ঞেস করল,
” শাড়ি বদলাবে না? ”
” ইচ্ছে করছে না। ”

ইমদাদ আলো নিভিয়ে মিহির পাশে শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করতে মনে হলো মিহির গলাটা অন্য রকম লাগছে। সে মিহির দিকে ঘুরে বলল,
” তোমার কি মন খারাপ? ”

মিহি সাথে সাথেই উত্তর দিল,
” হ্যাঁ, মায়ের কথা মনে পড়ছে। ”

ইমদাদের মনটাও খারাপ হয়ে গেল। ইচ্ছে করছে মিহির মাথায় হাত রাখতে। কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। দুপুর থেকে তার চিন্তা-ভাবনা পালটে গেছে। যদি ভুলে যায় মিহি এখনও ছোট?

” আপনার আমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে না? চুমু খেতে ইচ্ছে করে না? ”

ইমদাদ অন্ধকারেও টের পেল মিহি তার দিকে ঘুরে একটু কাছে সরে এসেছে। নিঃশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে স্পষ্ট।

মিহি আগের সুরেই বলল,
” আমি জানি, আপনার ইচ্ছে করছে। তাহলে কেন ধরছেন না? ”

বলতে বলতে মিহি কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” আমি মায়ের কাছে যাব। আমাকে দিয়ে আসুন। এখনই। ”

মিহির চাপা কষ্টটা ইমদাদ অনুভব করতে না পারলেও কান্নাটা সহ্য করতে পারল না। আলতো জড়িয়ে ধরে বলল,
” আচ্ছা, দিয়ে আসব। কিন্তু এখন না, কাল। এত রাতে গেলে তোমার মা ভয় পাবে তো। মিহি, কান্না থামাও। প্লিজ! ”

মিহি সুযোগ পেয়েই ইমদাদের বুক ভিজিয়ে দিল চোখের পানিতে। শক্ত করে পিঠ খামচে ধরে বলল,
” আমার খুব কষ্ট হচ্ছে! ”
” ঘুমালেই আর কষ্ট হবে না। কান্না থামিয়ে ঘুমাও। ”

মিহি আর কথা বলল না। ইমদাদ চুলে হাত বুলিয়ে দিতে ঘুমিয়ে পড়ল।

__________
সকালে ইমদাদের ঘুম ভাঙল ইশাদের কলে। ঘুমের ঘোরেই ফোন কানে ধরতে ইশাদ ধমকে উঠল। মনে করিয়ে দিল আজ তাদের তিহিদের বাড়িতে যাওয়ার কথা। এক ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে যেন মোড়ে এসে দাঁড়ায়। সেখান থেকেই তাকে গাড়িতে তুলবে।

ইমদাদ ফোন কানে নিয়েই মিহিকে খুঁজছে। বিছানায় না পেয়ে কান থেকে ফোন নামাল। তোয়ালে নিতে নিতে বেশ কয়েকবার মিহিকে ডাকল, সাড়া পেল না। তোয়ালে কাঁধে নিয়ে গোসলখানার দরজা মেলল। সেখানে না পেয়ে রান্নাঘরের দিকে এগুলো। রান্নাঘরেও মিহি নেই।

ইমদাদ খানিকটা চিন্তায় পড়ল। একা একা বাইরে বের হওয়ার মেয়ে তো সে নয়। তারমধ্যে এত সকালে তাকে রেখে বাইরে যাবে? অনুমতি না নিয়ে? ইমদাদ নিজেকেই প্রশ্ন করল, ‘ গোসল করে কাপড় নাড়তে ছাদে যায় নি তো? ‘

সে ছুটে ছাদে গেল। ছাদের চারধার ঘুরে কোথাও মিহিকে না পেয়ে ইমদাদের হৃদয় কেঁপে উঠল। বেফাঁসে বলে ফেলল, ‘ মিহি মায়ের কাছে চলে যায়নি তো? ‘

চলবে
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here