#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩
পর্ব (১৭)
শুক্রবার ছুটির দিন। জুমু’আর নামাজ পড়ে নিল ইমদাদ। পাঞ্জাবি বদলে এক রঙের শার্ট আর জিন্স পরল। হাতাগুলো গুটাচ্ছিল তন্মধ্যে ফোন বাজে। সে কল রিসিভ করে ফোন কাঁধ দিয়ে চেপে ধরে বলল,
” হ্যাঁ, মৃধা। বলো। ”
ওপাশ থেকে উচ্ছল গলা ভেসে এলো,
” ইমু, কখন আসবে? আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। ”
” আসছি, বাবু। পাঁচ মিনিট সময় দেও? ”
মেয়েটি শব্দ করে হেসে বলল,
” পাঁচ মিনিটই কিন্তু। ”
ইমদাদ আর কিছু বলল না। কল কেটে ফোন ঢিল মেরে রাখল বিছানায়। হাতা গুটানো শেষে আঙুল চালাল চুলে। ঠোঁটের সাহায্যে শিস বাজাতে বাজাতে সুগন্ধী মাখল শরীরে। পকেটে মানিব্যাগ পুরে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়েও আবার ফিরে আসল আয়নার সামনে। নিজেকে আগাগোড়া দেখে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল,
” কেমন লাগছে আমাকে? ”
প্রশ্ন করেই ঠোঁট টেনে লাজুক হাসল। পরমুহূর্তেই হাসিটা মিলিয়ে গেল। গাঢ় দৃষ্টি পড়ল চোখজোড়ায়। সুন্দর মুখটার মধ্যে এই চোখজোড়া অসুন্দর লাগছে কেন? এত মলিন, নিষ্প্রভ, নিস্তেজ! ইমদাদ ঘন ঘন পাতা ফেলল। ছুটে গিয়ে চোখে পানি ছেটাল বেশ কয়েকবার। তারপর পূর্বের ন্যায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
” looking so handsome. ”
মৃদু হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। দরজায় তালা মেরে চাবি ঢুকাল পকেটে। ঠোঁটের আগায় গুনগুন সুর নিয়ে সিঁড়ি কাটছে। গেইট থেকে বের হয়ে রিকশা ডাকার জন্য হাত উঁচু করল। সেসময় একটা বাচ্চা ছেলে উপুড় হয়ে পড়ল তার সামনে, পায়ের কাছে। ইমদাদ রিকশা ডাক দেওয়া থামিয়ে তড়িঘড়িতে ছেলেটিকে তুলে দাঁড় করাল। বয়স পাঁচ কী ছয় হবে। নিষ্পাপ চোখ দুটি ব্যথার জলে টলটল! ঠোঁট উল্টে চিৎকার করে ডাকল,
” মাম্মাহ! ”
ডাকটি বাতাসে বাড়ি খেতে মা দৌড়ে এলো। ছেলেকে কোলে নিয়ে বকাঝকা শুরু করলেন। পরনের হলুদ রঙের গেঞ্জি খুলে হাতিয়ে দেখতে দেখতে কেঁদে ফেললেন। ছিলে যাওয়া অংশে ফুঁ দিতে দিতে ইমদাদকে জিজ্ঞেস করল,
” এখানে হাসপাতাল আছে? ”
ইমদাদ এতক্ষণ মাকে দেখছিল বেশ মনোযোগে। একরকম ঘোরেই চলে গিয়েছিল। তার ডাকে ঘোর ভাঙে। প্রশ্নটা বুঝতে পারেনি এমন ভঙ্গিতে বলল,
” জি? ”
মা কান্না জড়ানো গলায় বলল,
” এখানে হাসপাতাল আছে? ”
ইমদাদ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
” কেন? ”
” রক্ত বের হচ্ছে। নিশ্চয় খুব ব্যথা করছে আমার বাবাটার! ”
ইমদাদ খেয়াল করল ছেলেটি পড়ে যাওয়ার পর কান্না না করলেও এখন শব্দ করে কাঁদছে। সেদিকে তাকিয়ে বলল,
” হাসপাতাল একটু দূরে। ফার্মেসী আছে রাস্তার ঐপাশে। কিন্তু এসময় তো খোলা পাবেন না। ”
ইমদাদের কথায় মা এমনভাবে তাকাল যে তার ভীষণ মায়া হলো। বলল,
” তেমন কিছু নয়, আপা। একটু ছিলে গেছে। আমার সাথে আসুন। আমার কাছে অ্যান্টিবায়োটিক মলম আছে। ”
ইমদাদ বাসার গেইটের দিকে হাঁটা ধরে পেছনে তাকায়। ছেলে কোলে মাকে সন্দেহ চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
” আমি ডাক্তার। এ বাসার দো’তলায় থাকি। ”
এবার একটু ভরসা করল বোধহয়। ইমদাদের পেছন পেছন রুমে ঢুকল। ইমদাদ ছেলেটির ক্ষতস্থান তুলো দিয়ে পরিষ্কার করে নিওমাইসিন মলমের প্রলেপ দিয়ে বলল,
” হয়ে গেছে, আপা। ”
বাচ্চাটির মা কৃতজ্ঞতা দেখাতে মৃদু হাসল। ছেলেকে কোলে নিয়ে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। ইমদাদ রুমে তালা মেরে তার পেছনে পেছনে ধীরে নামছে। সেসময় দেখল বাচ্চাটির মা তার স্বামীর সাথে ফোনে কথা বলছে। ছেলের পড়ে যাওয়া ঘটনা বলতে গিয়ে আরেকদফা কেঁদে ফেলেছে। কাঁদতে কাঁদতে আবার বলছে, ‘ তুমি তো কাজের চাপে আসতে পার না, তাই আমিই চলে এসেছি। সাথে করে তোমার পছন্দের রান্না নিয়ে এসেছি। তোমার পাঠানো শাড়িও তো পরেছিলাম। কিন্তু কে জানত শাড়ি সামলাতে গিয়ে ছেলেকে সামলাতে পারব না। সব দোষ আমার, তোমার কথা না শুনে এত দূর…”
ইমদাদের নজর গিয়ে পড়ল শাড়িতে। মুহূর্তে মিহির মুখখানা ভেসে উঠল চোখের পর্দায়। শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে রান্না করা ব্যস্ত মেয়েটা মনে আঘাত করে হারিয়ে গেল। ইমদাদ শিউরে উঠল। নিজের গন্তব্য ভুলে গেল। মৃধার কথা ভুলে হাজির হলো ইশাদের বাসায়।
___________
ইশাদের হাতে কয়েক লাইনের একটি চিঠি। সেদিন তিহির বাবা রশিদ মিয়ার সাথে কথা বলার এক ফাঁকে তিনি চিঠিটি এনে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তিহি তাজ নামের এক হিন্দু ছেলেকে ভালোবাসে। বাবা মানবে না জেনে বিয়ের আসর ছেড়ে তার সাথে পালিয়ে যায়। ইশাদ সেসময় চিঠিটি খুলে দেখেনি। আজ দেখছে। এর মধ্যেই বেশ কয়েকবার পড়া শেষ। যত পড়ছে তত দুর্বল হয়ে পড়ছে। আশা হারিয়ে ফেলছে। হতাশ মনে প্রশ্ন রাখছে, ‘ তিহির মনে আমার জায়গা হবে তো? ‘
” ইমদাদ এসেছে। ”
মায়ের গলা পেয়ে ইশাদ চিঠি ভাঁজ করতে করতে পেছনে তাকাল। বুক পকেটে রেখে বলল,
” ইমদাদ! এসময়? ”
শাহিনা শাইখা খানিকটা আশ্চর্য হয়ে বললেন,
” মুখটাকে এমন বানিয়েছিস যেন অবাস্তব কিছু ঘটেছে। ”
ইশাদ বসা থেকে দাঁড়াল। মায়ের দিকে এগুতে এগুতে বলল,
” তেমন নয়, আম্মু। আমার বাসায় আসার আগে সবসময় কল দেয়। আজ দেয়নি তাই অবাক হয়েছি। ”
ইশাদ বসার রুমের দিকে হাঁটা ধরলে শাহিনা শাইখা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বললেন,
” তোর বাবা খাবার টেবিলে বসে আছে। ইমদাদকে নিয়ে সেখানে চলে যা। ”
ইশাদ দূর থেকে ইমদাদকে পর্যবেক্ষণ করছে। সে স্থির হয়ে বসে নেই। এক সোফা থেকে উঠে আরেক সোফাতে গিয়ে বসছে। কুশন টেনে একবার কোলে নিচ্ছে তো আবার সোফাতেই সাজিয়ে রাখছে। সেন্ট্রাল টেবিলে রাখা কাগজের ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে মুখে ঢোকাতে ইশাদ ধমকে উঠল,
” তোকে না বলেছি, আমাকে ফোন না দিয়ে বাসায় আসবি না? ”
ইমদাদ ভয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। বোকা চোখে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
” ফোন বাসায় ফেলে আসছি। ”
ইশাদ আর কিছু বলল না। ইমদাদের ভাব-সাব অদ্ভুত লাগছে। ছেঁড়া ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকলে ইমদাদ বলল,
” তোর সাথে কথা আছে। ”
ইশাদ শুনতে পেয়েও ইমদাদের কথাটা উপেক্ষা করে বলল,
” এসেছিস ভালো হয়েছে। আমি এখনই তোকে কল দিতাম। ”
ইমদাদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রুমে ফিরে গেল ইশাদ। মিনিটের মধ্যে ফিরে এসে ইমদাদের হাতে একটি কাগজ গুঁজে দিয়ে বলল,
” তোকে একজনের সাথে দেখা করতে হবে। ঠিকানা লিখে দিয়েছি। পৌঁছে আমাকে ফোন দিবি। ”
ইমদাদ বলতে চাইল, ‘ আমি এখন কোথাও যেতে পারব না। আমি মিহির সাথে দেখা করতে চাই। কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস? ‘
” এখনই বেরিয়ে পড়। ”
ইশাদের তাড়া দেওয়ায় ইমদাদ নিজের কথাটুকু বলতে পারল না। চুপচাপ বেরিয়ে যেতে নিলে ইশাদ পেছন থেকে বলল,
” তুই তো কিছু বলতে এসেছিলি। বলবি না? ”
ইমদাদ কাগজের দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বলল,
” পরে বললেও চলবে। তোর থেকে বেশি জরুরি না। ”
_________
ইমদাদ তার কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায় পৌঁছাল সন্ধ্যার পর। কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার চিঁড়ে বাড়ির ভেতরে উঁকি দিতেই নিশ্বাস আটকে গেল। চোখ বড় বড় করে স্থির চেয়ে থাকল কলপাড়ের মেয়েটির দিকে। বিস্ময়াবিষ্ট থেকেই বলল,
” মিহি! ”
মিহি চাপকল থেকে জগে পানি ভরছিল। হঠাৎ পুরুষ কণ্ঠ পেয়ে চকিতে পাশে তাকায়। উঠোনের শেষ মাথায় ইমদাদকে দেখে বিস্মিত হয়। বিস্ময় কাটিয়ে উঠার আগেই ইমদাদ ঝড়ের মতো মিহির সামনে এসে দাঁড়াল। বলল,
” তুমি এখানে কী করছ? ”
মিহি বিরক্ত হলো। পানির জগ তুলে নীরবে হাঁটা শুরু করে। ইমদাদ পেছন আসতে আসতে বলল,
” আমাকে না বলে পালিয়েছ কেন? বলে আসলে কি মানা করতাম? তোমার আমাকে সেরকম মনে হয়েছিল? ”
মিহি হাঁটা থামাল। রাগ চোখে ইমদাদের মুখটিতে তাকাল। কিছু একটা বলতে গিয়ে চুপ হয়ে যায়। আবার হাঁটা শুরু করলে ইমদাদ বলল,
” এমন অভদ্রের মতো আচরণ করছ কেন? কয়েক দিন আগেও তো আমার সাথে কথা বলার জন্য আগে-পিছে ঘুরতে। ”
এ পর্যায়ে মিহি দাঁড়াল। পেছন ঘুরে বলল,
” অভদ্র আমি না আপনি? একটা মেয়ের রুমে ঢুকে ধমকাচ্ছেন। ”
ইমদাদ চট করে আশেপাশে তাকাল। সত্যি সে একটা রুমের ভেতরে চলে আসছে। বেরিয়ে যাবে ভেবেও বেরুল না। সন্দেহ নিয়ে বলল,
” তোমার রুম মানে? এটা তোমাদের বাসা? কিন্তু ইশাদ তো আমাকে অন্যকারো সাথে…”
পরের কথাটুকু মনে মনে বলল ইমদাদ। চুপচাপ কিছু একটা ভাবতে ভাবতে চোখে-মুখে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে।
” কার সাথে কথা বলছিস, মা? ”
মায়ের ডাক পেয়ে মিহি চেঁচিয়ে বলল,
” চিনি না, মা। গাঁয়ে নতুন আসছে মনে হয়। ঠিকানা জিজ্ঞেস করছে। ”
মিহির কথা শুনে ইমদাদ যেন আকাশ থেকে পড়ল। এমন ভাব ধরে বলল,
” তুমি আমাকে চিনো না? ”
মিহি উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” কেন এসেছেন? ”
ইমদাদ উত্তর দেওয়ার পূর্বেই রুবিনা এসে দাঁড়ালেন দোরগোড়ায়। ধমকের সুরে বললেন,
” অচেনা মানুষকে ঘরে ঢুকিয়েছিস কেন? ”
ইমদাদ পেছনে তাকালে রুবিনার গলার স্বর পাল্টে গেল। লাজুক হেসে বলল,
” তুমি ইমদাদ না? ”
ইমদাদ সালাম দিয়ে বলল,
” জি। কেমন আছেন, মা? ”
রুবিনা ইমদাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে মেয়ের দিকে তাকাল। চোখের ইশারায় কাছে ডেকে নিল। ফিসফিসে বলল,
” ও আসবে আগে বলবি না? এখন কী দিয়ে খেতে দিব? ”
মিহি গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে বলল,
” উনি খেয়ে এসেছেন। এখন চলে যাবে। ”
” কী বলছিস এসব? প্রথমবারের মতো এসেছে, কিছু খাবে না? বাইরে দেখেছিস কী হাওয়া? সোয়েটারও আনেনি দেখছি। যাবে কীভাবে? ”
ইমদাদ মা-মেয়ের কথপোকথনে বুঝে গেল মিহির রাগ করে চলে আসার ব্যাপারটা মা জানে না। সুযোগকে কাজে লাগাতে বলল,
” হ্যাঁ, মা। অনেক ঠাণ্ডা। এই দেখুন কেমন কাঁপছি। ”
রুবিনা ইমদাদের দিকে তাকাল। সত্যি সত্যি কাঁপছে। দাঁতে দাঁত লেগে শব্দ হলে সে দৌড়ে কোথাও গেল। একটা চাদর জড়িয়ে দিয়ে বলল,
” এটা মিহির বাবার চাদর। ওম আছে। ”
ইমদাদ চাদর ভালো করে জড়িয়ে আরামভঙ্গি করলে রুবিনা মৃদু হেসে বলল,
” ভেতরে লেপ আছে। তুমি একটু বিশ্রাম নেও। আজকে আর যেতে হবে না। ”
ইমদাদ বাধ্য ছেলের মতো চৌকিতে গিয়ে বসল। লেপ ছড়িয়ে গায়ে টেনে বলল,
” আমি কিন্তু রাতে খাব। ঘুমিয়ে পড়লে ডাক দিবেন। ”
#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩
পর্ব (১৮)
রুবিনার ঝাড়ি খেয়ে ইমদাদকে ডাকতে আসে মিহি,
” এই যে, শুনছেন? ”
মিহির ডাকে ইমদাদ ঝট করে চোখ মেলে। সটাং উঠে বসে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি কি আমাকে ডাকছ? ”
মিহি বিরক্তের মুখ বানাল। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
” না। মা ডাকছে। ”
ইমদাদ খুশি হলো। দারুন উৎসাহ নিয়ে বলল,
” রান্না হয়ে গেছে? ”
মিহি উত্তর দিল না। এক পলক চেয়ে দরজার দিকে হাঁটা ধরল। ইমদাদ তার চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে থেকে চিৎকার করে বলল,
” আমি খাব না। ”
মিহি দরজার মুখে পৌঁছে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে দাঁড়াল। বিস্ময় নিয়ে বলল,
” কেন? ”
ইমদাদ ভেবেছিল মিহি বলবে, ‘ না খেলে আমার কী? ‘ তেমন বলেনি। উল্টো কারণ জানতে চাওয়ায় ভীষণ খুশি হলো সে। মনে মনে বলল, ‘ জোর করে মন বদলানো যায় না, যেটা তুমি করছ। ‘ ইমদাদ বাচ্চাদের মতো জেদ ধরে বলল,
” আমার উত্তর চাই। ”
মিহির ভুরুর মাঝে একাধিক ভাঁজ পড়ল। কৌতূহলী হয়ে পড়ল কিশোরী মন। ইমদাদের দিকে এগিয়ে এসে জানতে চাইল,
” কিসের উত্তর? ”
ইমদাদ বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। মিহির কাছ ঘেষে এসে দাঁড়াল। চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” এই যে, আমাকে না বলে পালিয়ে আসা হলো কেন? ”
ইমদাদের চাহনিতে মিহি অস্বস্তিতে পড়ে গেল। চোখ নামিয়ে নিলে ইমদাদ মনে করিয়ে দিল,
” সেদিন তো আমাদের মধ্যে ঝগড়া হয়নি। তুমি কষ্ট পাবে এমন কোনো কথা বলিনি, তোমাকে খুশি করতে জড়িয়েও ধরেছিলাম। তাহলে কেন চলে এসেছ, মিহি? ”
মিহির চোখ ছলছল হলো। গলা ধরে এলো। বুকে চিনচিনে ব্যথা শুরু হলো।
ইমদাদ মিহির নিচু করে থাকা মুখটায় চেয়ে নরম সুরে ডাকল,
” মিহি? ”
মিহি হালকা কেঁপে উঠল। নিচু কণ্ঠে বলল,
” কয়েকদিন পর তো আপনি আমাকে রেখেই যেতেন, আপনি রেখে চলে গেলে যদি আমার কষ্ট হতো? কান্না পেত? সে ভয়ে আমি চলে এসেছি। ”
মিহির কণ্ঠে অপ্রকট ব্যথা। ইমদাদের ভেতরটা কেমন নড়ে গেল। কিছু একটা চুরমার হলো সেটাও টের পেল। জানতে চাইল,
” নিজে থেকে চলে এসেছ বলে কষ্ট হয়নি? কান্না পায়নি? ”
মিহি চোখ তুলে তাকাল। টলমল চোখদুটো ইমদাদের মনজুড়ে মনখারাপের বাতাস ছড়িয়ে দিল। সে গলার স্বর পাল্টে ফেলল। উত্তর না নিয়ে প্রশ্ন করে বসল,
” আমি তোমাকে রেখে যাব কেন? এমনটা কখনও বলেছি? ”
” না, বলেননি। তাহলে কি ইশাদ ভাইয়াকে বলতেন রেখে আসতে? ”
ইমদাদ ব্যস্ত হয়ে বলল,
” ইশাদকেই কেন বলব? রেখে আসার কথা উঠছে কেন? তুমি কি ডিভোর্সের জের ধরে এমন ভেবেছ? ”
” ডিভোর্স হওয়ার পর রেখে আসেন? ”
” রেখে আসি মানে কী? কাকে রেখে আসলাম? ”
” যাদের সাথে ঘুমিয়েছেন। ”
ইশাদের চোখজোড়া মাত্রাতিরিক্ত বড় হয়ে গেল। গোল গোল চোখ নিয়ে বিস্ময় ঝরে পড়ল কণ্ঠ থেকে,
” ঘুমিয়েছি! কে বলেছে এসব? ”
” আপনি বলেছেন। মিতু আপুও বলেছে। ”
ইমদাদ বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলে মিহি বলল,
” ঘুমানোর পর নাকি তাদের সাথে সম্পর্ক রাখেন না। আমিও তো আপনার সাথে ঘুমিয়েছি। তারমানে আমার সাথেও রাখবেন না। ”
ইমদাদ বিস্ময়ভরা চোখ দুটো স্বাভাবিক হয়ে এলেও পলক পড়ল না। বোঝার চেষ্টা করছে মিহি ঘুমানো মানে কী বুঝেছে। বুঝে আসতেই বলল,
” আরে, এ ঘুমানো সে ঘুমানো নয়। ”
” তাহলে কেমন ঘুমানো? ”
ইমদাদ কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। খানিকটা ভেবে বলল,
” স্বামী-স্ত্রীর মতো ঘুমানো। ”
মিহি সরলমনে বলল,
” আমরা তো স্বামী-স্ত্রীই। ”
ইমদাদ যেন ভুলে গেছিল এমনভাবে বলল,
” হ্যাঁ, তাই তো। ”
” আপনি উত্তর পেয়েছেন? ”
ইমদাদ বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
” হ্যাঁ, পেয়েছি। কিন্তু..”
” কিন্তু কী? ”
” তোমার বুঝায় ভুল হয়েছে। ”
ইমদাদ একটু চুপ থেকে আবার বলল,
” তুমি কি আসলেই ঐ ঘুমানোর মানে বুঝতে পারনি? ”
” কোন ঘুম? ”
ইমদাদ সরাসরি বলতে গিয়ে আবার আটকে গেল। বুদ্ধিমত্তা জেগে উঠল। মনে করিয়ে দিল, এই মেয়েটি তার স্ত্রী। স্বামী অন্য মেয়ের সাথে দৈহিক মিলনে মজেছে। একবার নয়, বারবার। সেটা নিশ্চয় সহ্য করবে না। সে কেন কোন স্ত্রীই সহ্য করবে না। সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার জন্য খুব একটা সময়ও নিবে না। কিন্তু ইমদাদ চায় না, মিহির সাথে সম্পর্কটা ভেঙে যাক। অসহণীয় কষ্ট পাক। তাই প্রশ্নটা এড়িয়ে বলল,
” চলো খেয়ে আসি। মা অপেক্ষা করছে। ”
মিহি কোনোরূপ বাধা দিল না। ইমদাদকে নিয়ে বাইরে বের হলো। দরজা ডেঙাতে রুবিনার সাথে দেখা হলো। দুজনের আসতে দেরি হওয়ায় সে দেখতে এসেছিল কিছু সমস্যা হয়েছে নাকি। ইমদাদকে দেখে বললেন,
” ঘুম ভাঙছিল না? ”
ইমদাদ মৃদু হেসে বলল,
” ভেঙেছে। খুব ঠাণ্ডা তো তাই লেপ ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। ”
” তাহলে কষ্ট করে এলে কেন? মিহিকে বলে পাঠাতে আমি খাবার নিয়ে ভেতরে আসতাম। ”
ইমদাদ কী উত্তর দিবে বুঝতে পারছিল না। চুপ হয়ে গেলে রুবিনা বললেন,
” তুমি যাও, আমি মিহিকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। ”
ইমদাদ ব্যস্ত হয়ে বলল,
” আরে না, না। লাগবে না। আমি বাইরে খেতে পারব। ”
রুবিনা ইমদাদের বাধা শুনল না। জোর করে ভেতরে পাঠিয়ে দিল। খাবারের প্লেট নিয়ে নিজেই ভেতরে আসল। ইমদাদের গায়ে লেপ দিয়ে বললেন,
” আমার মেয়েটার বয়স কম, একটু বোকাও। তোমাকে খুব সমস্যায় ফেলছে, তাই না? ”
ইমদাদ মিহির দিকে এক পলক তাকাল। উত্তর দেওয়ার জন্য শাশুড়িমার দিকে ঘুরতে অবাক হলো। তিনি ভাত মেখে তার মুখের সামনে ধরে আছে। ইমদাদ সেই লোকমা ফিরিয়ে দিতে পারল না৷ কিংবা মায়ের হাতের স্বাদ নেবার লোভ সামলাতে পারল না। ইমদাদ মুগ্ধতায় ডুবে মুখ হাঁ করল। রুবিনা স্বাভাবিকভাবেই খালি হাত নিয়ে রাখলেন মাখা ভাতে। আরেকটু মেখে বললেন,
” মিহি বোকা হলেও খুব লক্ষ্মী মেয়ে। মুখে মুখে তর্ক করে না। যে যা বলে তাই বিশ্বাস করে, মেনে নেয়। তুমি শুধু কষ্ট করে শিখিয়ে নিও। ”
ইমদাদ চুপচাপ খেয়ে চলল আর মাথা একবার ডানদিকে তো আরেকবার বামদিকে কাত করল। খাওয়া শেষে পানির গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন রুবিনা। ইমদাদ বেখেয়ালে পানি মুখে দিতে গিয়ে ঠোঁট পুড়িয়ে ফেলল। হাত থেকে গ্লাস পড়ে গেলে মিহি উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
” গরম পানি ছিল তো। ধোয়া উড়ছিল দেখতে পাননি? ”
বলতে বলতে বাইরে থেকে ঠাণ্ডা পানি নিয়ে এসে বলল,
” ঠোঁটে ঠাণ্ডা পানি দেন। ”
ইমদাদ ঠাণ্ডা পানি দেওয়ার বদলে খেল। পানি হাতে মিহিকে বলল,
” এদিকে এসো। ”
” কেন? ”
” কানে কানে কথা বলব। ”
মিহি পেছনে তাকিয়ে বলল,
” মা তো নেই। তাহলে কানে কানে বলবেন কেন? ”
” সেই ঘুমানোর কথা কানে কানেই বলতে হয়। ”
” কোন ঘুমের কথা? ”
ইমদাদ খানিকটা শক্ত গলায় বলল,
” তোমার মাকে ডেকে দেখাব, তুমি কেমন তর্ক করতে পার? ”
মিহি মনখারাপ করে ফেলল। ধীরে মাথা ঝুকালে ইমদাদ কান টেনে কিছু একটা বলতেই মিহি মাথা সরিয়ে নিল। এককদম দূরে সরে নাক-মুখ কুঁচকে বলল,
” ছি! ”
তারপর আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না৷ ইমদাদের পাশে থাকা বালিশটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ইমদাদ কতক্ষণ থম মেরে থেকে বিড়বিড় করল, ‘ আমি তো ভেবেছিলাম এই মেয়ে কিছুই বুঝে না। এখন তো দেখছি একটু বলতে আরেকটু বুঝে গেল। বোকামো করে বসলাম না তো? বাড়ি থেকে যদি বের করে দেয়? এত রাতে ফিরব কী করে? ‘ ইমদাদ মহাচিন্তায় পড়ে গেল। তার চিন্তা বাস্তব করতে কেউ এলো না। রাত গভীর হতে সে নিজেই রুম থেকে বেরুল। গুটিগুটি পায়ে মিহিকে খুঁজতে শুরু করে। একটু হেঁটে যেতে আরেকটি রুম দেখতে পায়। দরজার ফাঁক দিয়ে ক্ষীণ আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। ইমদাদ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকল,
” মা? ”
সাথে সাথে দরজা খুলে গেল। রুবিনা জিজ্ঞেস করলেন,
” কিছু লাগবে, বাবা? ”
ইমদাদ ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল,
” মিহি? ”
” ও তো ঘুমিয়ে পড়েছে। ”
ইমদাদ ভারি আশ্চর্য হলো। মিহি এ রুমে এসে শুয়েছে অথচ তার মা একবারের জন্যও প্রশ্ন করছে না তাদের মধ্যে কিছু হয়েছে নাকি। তাহলে কি মিহি সন্দেহ না করার মতো কিছু বলেছে? ইমদাদ মনে মনে আওড়াল, ‘ মিহি মোটেও বোকা নয়। খুব চালাক। ‘ সামনাসামনি বলল,
” আমি আপনার ছেলে নই? ”
রুবিনা সংশয় নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” হঠাৎ এমন বলছ কেন? ”
” আগে বলুন, আমি আপনার ছেলে নই? ”
” হ্যাঁ। ”
” তাহলে তো ছেলে মায়ের রুমে ঘুমাতেই পারে। ”
বলতে বলতে ভেতরে ঢুকে গেল। মাটিতে শুয়ে পড়লে রুবিনা হায় হায় করে উঠলেন,
” মাটিতে শুচ্ছ কেন, বাবা? উপরে শোও। আমি নাহয় অন্যরুমে…”
” তাহলে আমিও যাব। আমি তো আপনার সাথেই ঘুমাব। ”
ইমদাদ কথা শেষ করতেই মিহির নড়াচড়ার শব্দ পেল। জিভ কামড়ে বলল,
” মানে ঐ রুমের মাটিতে শোব। ”
রুবিনা ইমদাদের সাথে না পেরে মাটিতে কাঁথা পেরে দিয়ে মিহির সাথে শুয়ে পড়লেন।
মিহি ঘুমানোর ভাব ধরে শুয়ে থাকলেও ঘুমাতে পারল না। মাথা উঁচু করে মাকে ডিঙিয়ে নিচে তাকাতে দেখল, ইমদাদ বসে আছে। চাঁদের আলো ঘরে পড়লেও ইমদাদের মুখাবয়ব দেখা যাচ্ছে না। তবুও মিহির মনে হলো সে কোনো দুশ্চিন্তা করছে। সেজন্যই ঘুম হচ্ছে না। তার ইচ্ছে হলো ইমদাদের পাশে গিয়ে বসতে। কিন্তু গেল না। আগের ন্যায় চোখ বন্ধ করে শিথীল হয়ে পড়ে রইল।
ইমদাদ বসা থেকে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে হেঁটে গেল। কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকারে তাকাতে মনটা বিবশ হয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে তিহি আর তার পরিবারের মিলনের মুহূর্তটা মনে করল। ইশাদের বাবার জোর করে ছেলেকে ঘরে নিয়ে যাওয়া মুহূর্তটা মনে করল। সেই বাচ্চাটার মায়ের রোদন মুখটা মনে করল। মুহূর্তে তার বুকের ভেতরটা ফাঁকা লাগতে লাগল। নিঃসঙ্গ চেপে ধরল মন ও মস্তিষ্ক। এই সাতাশ বছরে পা দিয়ে প্রথমবারের মতো মনে হলো, সে একা। তার পরিবার নেই। নিশ্বাসটা আটকে চোখ বন্ধ করে নিতে শুনল,
” এভাবে জানালা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে তো। বুকে সর্দি… ”
মিহি কথাটা শেষ করতে পারল না। তার আগেই হাওয়া গতিতে মিহিকে জড়িয়ে নিল। হাওয়ার মতোই মিশে যেতে চাইল মিহির নরম শরীরটাতে। ঘটনার আকস্মিকতায় মিহি হতবাক। অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ল। বেশ কিছুক্ষণ পর চাপা স্বরে বলল,
” কী করছেন? মা দেখবে তো। ছাড়ুন। ”
ইমদাদ ছাড়ল না। আগের চেয়েও আরও গভীরভাবে জড়িয়ে বলল,
” তুমি আমার পরিবার হবে, মিহু? ”
চলবে
চলবে