তোমার সমাপ্তিতে আমার প্রাপ্তি ৩ পর্ব -১৫+১৬

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩
পর্ব (১৫)

ইশাদের পিছু পিছু বাইরে এসে দাঁড়ালেন রুকমিনি মুখার্জি। ভেজা চক্ষুদ্বয়ে আতঙ্কের ছাপ! ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলেন,
” তিহির কি স্মৃতি…”
” হ্যাঁ, ওর স্মৃতিশক্তি ফিরে এসেছে। ”

তাকে প্রশ্নটা শেষ করতে না দিয়েই উত্তর দিয়ে ফেলল ইশাদ। তার চোখ, মুখ ও কণ্ঠস্বর বড্ড বেশি স্বাভাবিক ঠেকল রুকমিনি মুখার্জির নিকট। সংকোচে বললেন,
” তোমাকে চিনতে পেরেছে তো? ”

ইশাদ একপাশে ঠোঁট টেনে ম্লান হাসল। চোখ নামিয়ে মেঝেতে দৃষ্টি স্থির করে বলল,
” ওর জ্ঞান ফেরার পর প্রথম প্রশ্নই ছিল, আমি কে? ”

রুকমিনি মুখার্জির চোখ বড় বড় হয়ে গেল। যেন ইশাদ অচিন্তনীয় কিছু বলে ফেলেছে। বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে পলকহীন চেয়ে থাকলেন ইশাদের মুখটায়। এখন আর স্বাভাবিক লাগছে না। বড্ড অসহায় লাগছে! তার নীরবতা ভেঙে দিয়ে ইশাদ বলল,
” সেদিনের এক্সিডেন্টের মুহূর্তটুকুতেই আটকে আছে তিহি। এরপর কী হয়েছে তার মনে নেই। ভাবছে, সেই এক্সিডেন্টের জন্যই হসপিটালে এডমিট আছে। ”
” ইনাকে দেখলেও চিনবে না? ”

এতক্ষণে ইনার কথা মনে পড়ল ইশাদের। বাসায় একা একা কী করছে মেয়েটা? কান্নাকাটি করছে না তো? সে তৎক্ষনাৎ বাসায় ফোন দিতে চাইল, সম্ভব হলো না। মনে পড়ল ফোন তিহির কাছে। রুকমিনি মুখার্জি বুঝতে পেরে নিজের ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে দিলেন। ইশাদ ফোন হাতে নিতে কল আসল। স্ক্রিনে নিজের নাম্বার দেখে চমকে গেল খানিকটা। পর মুহূর্তে ভাবল, তার মোবাইল তিহির কাছে। তারমানে এ নাম্বারে কল দিয়েছে তিহি। কিন্তু তিহি যেসময়ে অবস্থান করছে সেসময়ে রুকমিনি মুখার্জির নাম্বার জানা কথা না। তাহলে কল দিল কিভাবে? তবে কি ওর সবকিছু মনে পড়েছে? ইশাদ চিন্তায় মগ্ন হলে রুকমিনি মুখার্জি বললেন,
” কে কল করেছে দেখি? ”

ইশাদের দেখাতে হলো না। তিনি মাথা এগিয়ে এনে দেখলেন। বললেন,
” এটা তো তোমার নাম্বার! ”

ইশাদ চটপটে ফোনটা রুকমিনি মুখার্জির হাতে দিল। তিহির রুমের দিকে এগুনোর পূর্বে বলল,
” রিসিভ করবেন না। আমি আসছি। ”

একাধারে কল দিয়ে তিহি বিরক্ত হয়ে পড়লে ইশাদের কণ্ঠস্বর পেল,
” কথা হলো? ”

তিহি সামনে তাকাল। অসহায় গলায় বলল,
” না, আম্মু কল ধরছে না। ”
” আম্মু বলতে, আপনার নিজের আম্মু? ”

তিহি কপাল কুঁচকে বলল,
” নিজের আম্মু হবে না তো অন্যের আম্মু হবে? ”

তিহির বিরক্তের কারণ বুঝতে পারল ইশাদ। মৃদু হেসে তার কাছে এসে বলল,
” নেটওয়ার্কে সমস্যা মনে হয়। আমাকে দিন। ”

তিহি সহজমনেই ফোন তুলে দিল ইশাদের হাতে। সে সময় নষ্ট না করে ডায়াল লিস্টে ঢুকল। সবার উপরে রুকমিনি মুখার্জির নাম্বার দেখে যতটা না চমকাল তার থেকেও বেশি চমকাল নিজের নাম্বার দেখে। মনের মধ্যে সন্দেহ জমার আগেই তিহির দিকে ফোন বাড়িয়ে বলল,
” এই নাম্বারেও কল দিয়েছেন দেখি। এটা কার? ”

তিহি নাম্বারে চোখ বুলিয়ে বলল,
” আব্বুর। ”

ইশাদ যারপরনাই বিস্মিত হলো। তিহি এতকিছু খেয়াল করল না। বলল,
” আব্বুর নাম্বারে কল ঢুকছে না। মনে হয় সিম পাল্টেছে। এক বছর ধরে কথা হয়নি। ”

ইশাদ মনে মনে কিছু ভেবে নিয়ে বলল,
” আপনার বাসার ঠিকানা মনে আছে? ”
” কেন? ”
” ফোনে যোগাযোগ সম্ভব না হলে কাউকে দিয়ে আপনার খবর পাঠিয়ে দিব। ”

তিহি প্রথমে সন্দেহ চোখে তাকালেও পরক্ষণে বলল,
” হ্যাঁ, মনে আছে। ”
” বলুন। ”

তিহি বলার জন্য উদ্যত হয়ে থমকে গেল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে অসহায় গলায় বলল,
” মনে পড়ছে না! ”

ইশাদ ঘাবড়াল না। নার্স ডেকে এক টুকরো কাগজ আর কলমের ব্যবস্থা করল। তিহির হাতে দিয়ে বলল,
” ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অনেকটা সময় অজ্ঞান ছিলেন তো তাই একটু সমস্যা হচ্ছে। ধীরে ধীরে সব মনে পড়ে যাবে। আপনি এখন একটু বিশ্রাম করুন। ঠিকানা মনে পড়লে এখানে লিখে রাখবেন। কেমন? ”

তিহির মুখ থেকে অসহায়ত্ব ভাব কেটে গেল। হালকা হেসে মাথা একপাশে কাত করল। বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজলে ইশাদ বেরিয়ে আসে। রুকমিনি মুখার্জির কাছে হেঁটে এসে বলল,
” আমাকে ভুলে গেলেও আমার নাম্বারটা এখনও মনে আছে। ”
” মানে? ”

ইশাদ ক্লান্ত হাসল। তিহিকে একা থাকার সময় দিয়ে বলল,
” চলুন, ইনার সাথে দেখা করে আসি। ”

রুকমিনি মুখার্জিকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বের হওয়ার জন্য করিডোর পার হলো ইশাদ। রিসিপশনের কাছে দাঁড়িয়ে নিজের ফোন নাম্বারটা দিয়ে বলে, কোনো দরকার হলে এ নাম্বারে কল দিতে। তারপরেই এগোয় মূল দরজার দিকে। বাইরে বের হতে পারেনি তার আগেই পেছন থেকে ওয়ার্ডবয় ডেকে উঠল। ইশাদ থমকে পেছনে তাকালে সে দ্রুত হেঁটে এসে বলল,
” আপনি কারও মোবাইল নিয়ে এসেছেন, স্যার? ”

ইশাদ পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াল ওয়ার্ডবয়ের দিকে। সন্দেহি কণ্ঠে জানতে চাইল,
” মোবাইল? ”
” হ্যাঁ, ৩০৩ নম্বর রুমের পেশেন্ট জানাল, ড.ইশ নামের একজন তার মোবাইল নিয়েছে। এখন সেটা তার চাই। ”

ইশাদ ভ্রূ কুঞ্চিত করে মনে করার চেষ্টা করল কিছু। হঠাৎ তিহির কথা মনে পড়ল। সেই সাথে তিহির রুমের নাম্বারটাও। সে চটপটে বলল,
” তিহির কথা বলছ? আচ্ছা, তুমি যাও। আমি মোবাইল নিয়ে আসছি। ”

ওয়ার্ডবয় দায়িত্ব থেকে মুক্ত পেয়ে অন্যদিকে চলে গেল। ইশাদ রুকমিনি মুখার্জিকে সেখানে দাঁড় করেই তিহির কাছে ছুটে গেল। সে তখন আধশোয়া। ইশাদকে দরজার কাছে দেখেই অস্থির হয়ে বলল,
” মোবাইল দিন। ”

ইশাদ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে তিহির হাতের দিকে তাকাল। এমনভাবে হাত পেতে মোবাইল চায়ছে যেন সে তার মোবাইল জোর করে নিয়ে পালিয়েছে!

তিহি অধৈর্য হয়ে বলল,
” কী হলো? মোবাইল দিন। ”

ইশাদ পকেট থেকে ফোন বের করতে তিহি ছোঁ মেরে ফোন নিয়ে বলল,
” আমার বাসা থেকে কেউ কল করেছিল? ”
” না। ”

ইশাদ খেয়াল করল তিহির মধ্যে চলা অস্থিরতা ভাবটা কেটে গেছে। গভীর কোনো চিন্তা থেকে মুক্তি পেয়েছে এমনভাবে নিশ্বাস ফেলছে। ইশাদ ভীষণ কৌতূহলী হয়ে পড়ল। দমে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়লে জিজ্ঞেস করে বসল,
” কেউ কল দিলে কী হতো? ”
” আপনিও তাজের মতো আব্বুর কাছে মিথ্যে বলতেন। ”

তিহির মুখে তাজ নামটা আবারও ইশাদের হৃদয়ে ছুরির ফলার মতো বিঁধল। ব্যথা শুরু হওয়ার আগেই বলল,
” তাজ মিথ্যে বলেছিল? ”
” হ্যাঁ। ”
” কেন? ”

তিহি উত্তর দিল না। ইশাদ লক্ষ করল তিহি উদাস হয়ে পড়ছে। ভাবল আর কিছু জিজ্ঞেস করবে না। পরমুহূর্তেই টের পেল, তাজময় রহস্য উদ্ঘাটন না করলে সে শান্তি পাবে না। তাই ধীরে ও শীতল স্বরে সুধাল,
” তিহি, তাজ কেন মিথ্যে বলেছিল? ”

তিহি উদাস মনেই বলল,
” জানি না। ”

তিহির উত্তরে ইশাদ আশাহত হলো। চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালে শুনতে পেল তিহি নিচু স্বরে কিছু একটা বলছে। সে এগিয়ে এসে মনোযোগ দিল।

তিহি বলছে,
” আমার এসএসসি পরীক্ষা শেষ হতে আম্মু বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করে। পাত্র আগে থেকেই ঠিক করা, গাঁয়ের মাতব্বরের ছেলে। আমি পরীক্ষার দোহাই দিয়ে এতদিন আম্মুকে সামলে রেখেছিলাম। এবার আর পারছিলাম না। এদিকে গ্রামে কোনো কলেজ না থাকায় আব্বুও আমার পড়ালেখায় খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। আবার এত অল্প বয়সে বিয়ে হোক সেটাও চাচ্ছিল না। আমি কেঁদেকেটে অসুস্থ হয়ে পড়লে আব্বু বাধ্য হয়ে আমাকে শহরের কলেজে ভর্তি হওয়ার অনুমতি দেয়। গ্রাম থেকে অতদূর যাওয়া-আসা করতে কষ্ট হবে দেখে হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থাও করে দেয়। শর্ত একটাই, পড়ার বাহিরে অন্য কিছু করা যাবে না। ইন্টার শেষ হলে খুশিমনে বিয়ের জন্য তৈরি হতে হবে। কোনো ঝামেলা করা যাবে না। আমি রাজি হয়ে গেলাম। মন দিয়ে পড়তে থাকলাম। মনে মনে ভাবলাম, আগে তো কলেজ শেষ করি। তারপরে বাকিটা ভাবা যাবে।
হোস্টেলে উঠার কয়েকদিনের মধ্যেই আমার রুমমেটদের সাথে ভালো সম্পর্ক হয়ে গেল। সকলে আমার সিনিয়র ছিল বলে আমাকে খুব আদর করত। তাদের মধ্যে সব থেকে বেশি পছন্দ করতাম অনন্যা দিদিকে। হঠাৎ একদিন শুনি দিদির বিয়ে ঠিক হয়েছে। হোস্টেল ছেড়ে দিবে। যাওয়ার আগে সবাইকে দাওয়াত দিয়ে গেল। আমাকে তো বার বার বলে গেল অবশ্যই যেন যাই। সেসময় আমি কথা দিতে পারলাম না। কারণ, আব্বুকে নিয়ে ভয়ে ছিলাম। যদি জানে পড়া রেখে বিয়েতে গিয়েছি, তাও আবার হিন্দু বাড়ির বিয়েতে তাহলে আমাকে খুব বকবেন। কিন্তু এই ভয়টা আমি কাউকে বুঝাতে পারলাম না। রুমমেট সকলে আমাকে জোর করে বিয়েতে নিয়ে গেল। আশ্বাস দিল, এ কথা অন্য কেউ জানবে না। তাছাড়া অনন্যা দিদির বাড়ি অন্য গ্রামে। আব্বু সেখানে কখনই যাবে না। আমি বাধ্য হয়ে তাদের সাথে গেলাম। বিয়েতে কন্যাদানের পর্ব আসতেই বাড়ি থেকে কল আসল। আমার তো ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থা। ফোন ধরলে যদি উলুর ধ্বনি শুনতে পায়? শাঁখ বাজার শব্দ পায়? আবার না ধরলে যদি সন্দেহ করে? আমি বিয়ে বাড়ির শব্দ থেকে দূরে সরতে গিয়ে একদম রাস্তার কাছে চলি আসি। বাবার নাম্বারে কল দিতে গিয়ে দেখি ফোনে টাকা নেই। এদিকে আশে-পাশে কোনো দোকানও নেই। রিচার্জ করতে হলে বাজারে যেতে হবে। আবার এতদূরে চলে আসায় অন্য আপুদের ফোনও নিতে পারছিলাম না। ঠিক সেসময় চোখ পড়ল রাস্তার অন্য পাশে। অন্ধকারে মোটরসাইকেলে ঠেস দিয়ে একটা ছেলে সিগারেট খাচ্ছে। আমি ভাবলাম, তার কাছ থেকে মোবাইল চাইব বাবাকে কল দেওয়ার জন্য। পরক্ষণে মনে পড়ল, আমি তো এ গ্রামে নতুন। কাউকে চিনি না। লোকটা যদি খারাপ হয়? আশপাশটাও নির্জন। বিপদে পড়লে কেউ সাহায্য করতেও আসবে না। তাই অপেক্ষা করতে লাগলাম আব্বুর পরবর্তী কলের জন্য। অনেকটা সময় কাটার পরও যখন আব্বু কল দিল না। তখন আমার চিন্তা হতে লাগল। ভালো-মন্দ ভুলে দৌড়ে গেলাম ঐ ছেলেটার কাছে। ফোন চাইলে, দিল। আমি আব্বুর সাথে কথা বলে ফোন ফিরিয়ে চলে আসব তখনই সে আমার হাত ধরে ফেলল। আমি তো ভয়ে পেছন ঘুরতেই পারলাম না। তখন সে জিজ্ঞেস করল, ‘ নাম কী তোমার? ‘ আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘ তিহি। ‘ তারপর সে বলল, ‘ তিহি, আমাকে ধন্যবাদ দিলে না? ‘ আমি হাত-পায়ে কাঁপুনি নিয়ে তার দিকে ঘুরলাম। শ্যামবর্ণের মুখটির দিকে তাকিয়ে ধন্যবাদ দিলাম। সে হাত ছেড়ে দিল। আমি ছুটে পালালাম। ”

এতটুকু বলে তিহি দম নেওয়ার জন্য থামতে ইশাদ জানতে চাইল,
” ঐ ছেলেটি কি তাজ ছিল? ”

তিহি বোধ হয় প্রশ্নটা শুনল না। নিজের মতো বলে চলল,
” তারপর কী হলো বুঝলাম না। পরের দিন আব্বু হোস্টেলে আসল। সকলের সামনে আমাকে খুব বকল, একটা চড়ও মারল। তারপর জোর করে বাড়িতে নিয়ে গেল। আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে আম্মুকে বলল, ‘ মাতব্বরকে খবর দিতে। বিয়ের তারিখ ঠিক করবে। ‘ সেদিন বিকেলেই মাতব্বর আমাদের বাড়িতে আসল। আব্বু-আম্মু যখন তার সাথে আলোচনায় বসেছে তখন আমি দরজা আটকিয়ে কান্না করছি। হঠাৎ দেখি আমাদের বাসার পেছন রাস্তাতে সেদিনের সেই ছেলেটি মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি লুকিয়ে তার কাছে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ আমার আব্বু আপনাকে কল দিয়েছিল? ‘ সে বলল, ‘ হ্যাঁ, কল দিয়ে জানতে চাইল আমি কে। ‘ আমি জানতে চাইলে উত্তরে কী বলেছে? সে বলল, ‘ আমি বলেছি, আমি তোমার প্রেমিক। কয়েক মাস ধরে প্রেম করছি। আজ বিয়ে করব। ‘ তারপর আমার কপালে সিঁদুর পরিয়ে দিল। ”
” সিঁদুর! তোমাকে কেন সিঁদুর পরাবে? তুমি তো হিন্দু না। ”

ইশাদের বিস্ময় আর কৌতূহলপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দিল না তিহি। ইশাদের ফোনটা বালিশের নিচে লুকিয়ে বলল,
” আপনিও যাতে মিথ্যে বলতে না পারেন সেজন্য মোবাইল নিয়ে রাখলাম। আব্বু আমার কাছে না আসা পর্যন্ত দিব না। ”
#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩
পর্ব (১৬)

তিহির টুকে দেওয়া ঠিকানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিল ইশাদ। মনে সন্দেহরা বাড়ে বাড়ে প্রশ্ন তুলেছে, ঠিক ঠিকানা দিয়েছে তো? সে প্রশ্নটা জোর করেই এড়িয়ে যেতে হয়েছিল। কেননা, এই মানুষগুলোর কাছে পৌঁছানো অত্যাবশ্যক। তিহিকে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখার জন্য এই মুহূর্তে তার বাবা-মার উপস্থিতি একান্তই আবশ্যক!

ইশাদ মনের সাথে দ্বন্দ্ব নিয়ে তিহির দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছাল। তিহির বাবা রশীদ মিয়ার সাথে সাক্ষাৎ হতে চিন্তামুক্ত হলো। মনে মনে রুকমিনি মুখার্জিকে ধন্যবাদও দিল। তিহির দেওয়া ঠিকানা শেরপুরের মধ্যে হওয়ায় তিনি সহজ পথ বলে দিয়েছিলেন।

রশীদ মিয়া শুরুতে ইশাদকে সহজ চোখে দেখেননি। তাকে বাড়ির ভেতরেও ঢুকতে দেয়নি। বাইরের উঠোনে চেয়ারে বসে সবটা শুনছিলেন। শেষটায় নোনা পানিতে মনিদুটো ডুবে যেতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। স্ত্রীকে হাঁক দিয়ে বলেন, মেয়ের জামাইয়ের জন্য রাতের খাবার বাড়তে। ইশাদ সেই আনন্দটুকু উপভোগ করার সময় পেল না। সটাং দাঁড়িয়ে জরুরি গলায় বলল,
” বাবা, তিহি আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এখন বের হলে সকালের মধ্যে পৌঁছে যাব। ”

রশীদ মিয়া দর্প চাহনি ফেললেন ইশাদের দিকে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আচমকা জড়িয়ে নিলেন আলতোভাবে। বললেন,
” চলো। ”

তিহির মা তানিয়া বেগমও স্বামীর সাথে পেছনে সিটে বসলেন। রাতের ঘন অন্ধকার ছিদ্র করে ছুটে চলল ইশাদের গাড়ি।

___________

ইশাদ দূর থেকে তিহির আনন্দ দেখল। আবেগে গলে পড়া অশ্রুপাত দেখল। বাচ্চাদের মতো অভিমানে ঠোঁট ভাঙতে দেখল। সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের অনুশাসন দেখতে দেখতে আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ এক বছর নয় তিহিপাখি, সাত বছর পর বাবা-মায়ের দেখা পেলে। ‘

” তুই কি সত্যিই চাস না, তিহি তোদের বিয়ের ব্যাপারটা জানুক? ”

হঠাৎ ইমদাদের গলা পেয়ে ইশাদ চমকে যায়। দরজা ছেড়ে একটু সরে এসে বলল,
” চাইব না কেন? অবশ্যই চাই। কিন্তু এখন নয়, পরে। ”
” সেই পরেটা কবে আসবে? ”
” জানি না। ”

ইশাদের বেখেয়ালি উত্তরে ইমদাদ বিরক্ত হলো, রাগ বাড়ল। ধৈর্য্য নিয়ে বলল,
” তাহলে ইনার কী হবে?

ইশাদ সরল চাহনি ফেলল ইমদাদের মুখে। নিরুদ্বেগে বলল,
” ইনা তার বাবার সাথে থাকবে। ”
” বাবা? তাজকেও খুঁজে পেয়েছিস নাকি? ”

ইমদাদের বেফাঁসে বলে ফেলা কথাটায় কটমটে তাকাল ইশাদ। দৃঢ় স্বরে বলল,
” ইনার বাবার নাম ইশাদ। ”

ইমদাদ খানিকটা ভয় পেল। মিনমিনে বলল,
” তুই যেভাবে ওর সব ফিরিয়ে দিচ্ছিস তাই ভাবলাম…”

পরেরটুকু আর বলল না ইমদাদ। ইশাদ তাকে রেখে সামনে হেঁটে যেতে যেতে বলল,
” আমি শুধু তিহিকে সুস্থ রাখতে চাচ্ছি, এই মুহূর্তে ব্রেইনে প্রেশার না পড়াই ভালো। ভুলে যাস না ও শুধু আমাকে না পুরো ছয়টা বছর ভুলে গেছে। ”

ইমদাদ আর কিছু বলল না। ইশাদকে অনুসরণ করে রুকমিনি মুখার্জির নিকট চলে গেল। তাকে কয়েকদিন ইনার সাথে থাকার অনুরোধ করতেও শুনল। রুকমিনি মুখার্জি রাজি হলেন। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বললেন,
” তিহিকে এ অবস্থায় একা ছেড়ে দিবে? ”

ইশাদ খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়ল। চোখের চাহনি ঝাপসা হতে বলল,
” একা কোথায়? বাবা-মা আছেন। তিহির এখন আমাকে নয়, উনাদেরকেই প্রয়োজন। যখন আমাকে প্রয়োজন হবে তখন ঠিক হাজির হয়ে যাব। ততদিন নাহয় দূর থেকেই ভালো রাখার চেষ্টা চালাব। ”

ইশাদের না বলা ব্যথাটুকু রুকমিনি মুখার্জি বুঝে ফেললেন। অপ্রকাশিত কষ্টুটুকু অনুভব করলেন। ঠোঁট কামড়ে ইশাদের কাধে আলতো হাত রেখে দরদভরা গলায় বললেন,
” সব ঠিক হয়ে যাবে। তিহি তোমাকে খুব ভালোবাসে। আমি দেখেছি সেই ভালোবাসার গভীরত্ব। এত সহজে মুছে যেতে পারে না। ”

ইশাদ ক্লান্তভঙ্গিতে মাথা নাড়ল উপরনিচ। রুকমিনির হাতটা কাঁধ সরিয়ে বলল,
” আপনারা থাকুন আমি বাসের টিকেট কেটে আসছি। ”

ইশাদ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে ইমদাদ বলল,
” তোকে যেতে হবে না, আমি যাচ্ছি। ”

ইশাদের দিক থেকে কোনো জবাবের তোয়াক্কা না করেই ইমদাদ নিচতলায় চলে আসল। রিকশায় উঠে কল দিল শাহিনা শাইখাকে। তিনি ফোন ধরলে বলল,
” ইশাদ এত ছুটাছুটি করছে যে, ওষুধ নেওয়ার সময় পাচ্ছে না। তিহিকে সুস্থ রাখতে গিয়ে নিজে না বিছানায় পড়ে যায়। আপনি একটু তাড়াতাড়ি আসেন। ”
” আমি কি ওর সাথে পারি? তুই একটু জোর করে খায়িয়ে দিতে পারছিস না? ”

শাহিনা শাইখার প্রশ্নের উত্তরে চুপ হয়ে গেল ইমদাদ। হঠাৎ করেই জোর করার মতো অভিপ্রায় দেখাতে পারছে না। কেমন যেন সংকোচে ভুগছে। নিজেকে সবার থেকে আলাদা মনে হচ্ছে।

” ইমদাদ? ”

শাহিনা শাইখার ডাকে ইমদাদ উত্তর দিল,
” আমি একটু বেরিয়েছি, আন্টি। আপনি এখন আসছেন তো? ”
” হ্যাঁ, রাস্তায় আছি। ”

__________
হসপিটাল থেকে ছুটির ব্যবস্থা করতে করতে শাহিনা শাইখা চলে আসলেন। প্রথমেই ছেলেকে টেনে নিলেন এক কোনায়। জোর করে মুখে একটু খাবার দিয়ে বললেন,
” এই বয়সে মায়ের হাতে মার খেতে না চাইলে চুপ করে গিল। ”

ইশাদ বাধ্য হয়ে খাবার খাচ্ছে। সেই ফাঁকে শাহিনা শাইখা প্রশ্ন করলেন,
” তিহি তো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি, এই অবস্থায় বাসে পাঠাচ্ছিস কেন? তোর গাড়িতে করে দিয়ে আসতি। ”

ইশাদ খাবার চিবানো বন্ধ করে বলল,
” সাহস পাচ্ছি না, আম্মু। যদি আবার কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে? ”

শাহিনা শাইখা চাপা নিশ্বাস ছাড়লেন। ছেলের দিকে মমতাময়ী চাহনি আঁকলেন। কাঁধে হাত দিয়ে আদুরে মর্দন করতে থাকলেন।

____________
বিকেল নামার আগেই সূর্য ডুবে গেছে। হালকা ঠাণ্ডা ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। অন্ধকার নামতে এখনও অনেকটা দেরি। তিহি সিটে বসে মায়ের কাঁধে মাথা ফেললে ইশাদ সামনের সিটে এগিয়ে গেল। রশীদ মিয়ার হাতে তিনটা চাদর দিয়ে বলল,
” জানালাগুলো লাগিয়ে দিয়েন। বাতাস বেশ ঠাণ্ডা! ”

কথাটা বলেই রশীদ মিয়ার সিটের পাশের জানালাটা লাগিয়ে দিল। সেই সঙ্গে তিনি বুঝে গেলেন ইশাদ কোন জানালা লাগানোর কথা বলছে। ইশাদ বিদায় নিয়ে বাস থেকে নেমে যাবে সেই সময় রশীদ মিয়া বললেন,
” সাবধানে থেকো, তিহিকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না। আমরা দেখেশুনেই রাখব। ”

ইশাদ চটজলদি বললেন,
” ছি, ছি, ছি! এভাবে বলছেন কেন? আপনারা ওর বাবা-মা। আমার থেকেও যে ভালো রাখবেন তা নিয়ে সন্দেহ করা অন্যায়। ”

তিহিদের বাস ছেড়ে দিতে ইশাদের হৃদয়টা কেঁপে উঠল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো তিহিকে চিরতরে হারিয়ে ফেলছে। আর কখনও দেখা হবে না, কথা হবে না, ভালোবাসা হবে না। কেউ ফোন দিয়ে বলবে না, ‘ আমাকে নিয়ে যাও, ইশাদ। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। ‘

” বাসায় যাবি না? ”

মায়ের হাতের ছোঁয়ায় ইশাদ পাশে তাকাল। ভীত চোখ জোড়ায় জলের ছায়া নামার ভাব ধরতে গিয়েও থেমে গেল। মায়ের পেছনে বাবাকে দেখে কটাক্ষ করে বলল,
” উনি দেখি সুস্থ হয়ে গেছেন। ”

শাহিনা শাইখা ছেলের দৃষ্টি অনুসরণ করে স্বামীর দিকে তাকালেন। নিচু গলায় বললেন,
” এভাবে বলছিস কেন? ”

ইশাদ সে প্রশ্নের উত্তর দিল না। মায়ের হাত ধরে বলল,
” এখন তো আর হাসপাতালে ছুটাছুটি করার দরকার নেই। চলো, বাসায় যাবে। ”

মায়ের হাত ধরে দুকদম হেঁটেই থেমে যেত বাধ্য হলো। পেছনে তাকিয়ে বলল,
” কী হলো, আম্মু? দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? ”

শাহিনা শাইখা অন্য হাতে চোখ রাখলেন। ইশাদ সেই হাতে তাকালে দেখল, তার বাবা ধরে আছে। বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলে সোবহান শাইখ বললেন,
” শাহিনা, তোমার সাথে যাবে না। ”

একটু থেমে বললেন,
” তুমিও অন্য কোথাও যাচ্ছ না। তোমরা দুজনে আমার সাথে যাবে। ”

ইশাদ কিছু বলার জন্য তৈরি হলে সোবহান শাইখ চটজলদি বললেন,
” তোমাদের বাসায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আমি যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। বলো, আমায় কী করতে হবে? ”

ইশাদ রাগ নিয়ে বলল,
” আপনাকে কিছু করতে হবে না। কারণ, আমরা আপনার সাথে যাচ্ছি না। ”

কথাটা বলেই মায়ের দিকে তাকাল ইশাদ। তাড়া দিয়ে বলল,
” আম্মু, চলো। ”
” আমি জানি, তোমার আম্মুকে মানা করলে এখান থেকে একচুলও নড়াতে পারবে না। কিন্তু আমি মানা করব না। আমি জোর করে নয়, আপোষে ফিরিয়ে নিতে চাই। ”

সোবহান শাইখ ইশাদের কাছ ঘেষে দাঁড়ালেন। অকপটে বললেন,
” তুই বুঝাতে চেয়েছিস, তোর মা ছাড়া শুধু আমার সংসার না, আমিও অচল। আমি বুঝে গেছি। এবার রাগ-অভিমান ভাঙ। কথা দিচ্ছি, তাকে পূর্ণ সম্মান দেওয়া হবে। আর কষ্ট দিস না। তোদের ছাড়া ঐ বাড়িটা বিষাক্ত লাগে। ”

ছেলের থেকে চোখ সরিয়ে স্ত্রীর মুখে রাখলেন। হাত জোর করে বললেন,
” আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি, ক্ষমা করে দেও শাহিনা। ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here