তোমার সমাপ্তিতে আমার প্রাপ্তি ৩ পর্ব -০১+২

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩
#পর্ব (১)

” এটা কার বাসা এমদাদ ভাইই..”
কথাটা শেষ করার পূর্বেই বেনারশীতে পা জড়িয়ে পড়ে গেল মিহি! হাতের কনুই আর হাঁটু চাপ খেল কংক্রিটের মেঝেতে। খোঁপা খুলে চুলের অগ্রভাগ শামিয়ানার ভেতর দিয়ে বেয়ে এসে বাড়ি খেল গালে। ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করতে ইমদাদ দৌড়ে এসে বাহু চেপে ধরল মিহির। সাবধানে দাঁড় করিয়ে বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
” ঠিক করে হাঁটতে পার না? ”

মিহি মন খারাপ চোখে তাকাল। ছলছল চোখে কনুইয়ে ফু দিল কয়েক বার। তারপর বলল,
” আমরা এখানে এসেছি কেন? বাসায় যাব না? ”

ইমদাদ উত্তর দিল না। বিরক্তমাখা চাহনি ফেলে মিহিকে ছেড়ে বাসার গেইটের ভেতর ঢুকল। দ্রুত কদমে দুতলা সিঁড়ি কাটছে। মিহি পিছু পিছু আসছে নাকি দেখার প্রয়োজনবোধও করছে না। পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুলতে খুলতে চুড়ির ঝনঝন শব্দ পেল। পেছন না তাকিয়ে বলল,
” ভেতরে এসে দরজা আটকে দেও। ”

মিহি ভেতরে ঢোকার আগে ডানে-বায়ে তাকাচ্ছিল। সে সময় হাতে হেঁচকা টান খেল। কিছু বুঝার আগেই দরজায় খিল টেনে ইমদাদ বলল,
” কানে শুনতে পাও না? ”

মিহি মৃদু কেঁপে উঠল। অসহায় চোখে তাকাল ইমদাদের মুখে। কয়েক ঘণ্টা আগেও মানুষটা কী মিষ্টি করে কথা বলছিল! সেই মিষ্টি কণ্ঠে ভুলেই তো বিয়ের আসর ছেড়ে এসেছিল তার সাথে। কোথায় গেল সেই কণ্ঠ? নরম ব্যবহার? মিহি ভীষণ অসহায়বোধ করছে। ভেতরটা ভয়ে জমে যাচ্ছে। মুহূর্তে মনের আয়নায় মায়ের মুখটা উঁকি দিল। তারপরে ইশাদের মুখ, আংকেলের মুখ। শেষে তো তিহির মুখটাও!

ইমদাদ তোয়ালে কাঁধে নিয়ে স্নাগারে ঢুকল। দরজা আটকানোর পূর্বে বলল,
” আমাকে না বলে দরজা খুলবে না কিন্তু! ”

মিহি সম্মতিতে মাথা একপাশে কাত করল ভীষণ উদাসীনে। পরক্ষণে ছুটে গেল স্নাগারের দরজার কাছে। ততক্ষণে ইমদাদ দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল সেই বন্ধ দরজায় খটখট শব্দ করে বলল,
” আমরা বাসায় যাব কখন, ইমদাদ ভাইয়া? অনেক রাত হয়েছে। মা চিন্তা করবে তো! ”

একই কথা ঘন ঘন উচ্চারণ ও অবিরত দরজায় ঠকঠক শব্দে আধ গোসলে দরজা খুলতে বাধ্য হলো ইমদাদ। সাবান মাখা মুখটা বের করে ধমকের সুরে বলল,
” একটু চুপ করে বসবে, প্লিজ? ”

মিহি চুপ হয়ে গেল। বাধ্য মেয়ের মতো বিছানার কিনারে বসে ইমদাদের অপেক্ষা করছে।

ইমদাদ গোসল শেষে বের হলো প্রায় পনেরো মিনিট পর। শরীর মুছে গায়ে ইস্ত্রী করা শার্ট পরল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে আঙুল ডুবাতে গিয়ে চোখ পড়ে মিহির উপর। হাঁটুর উপর মুখ ফেলে চোখ বুজে আছে। ঘুমিয়ে পড়েছে বোধ হয়। নিষ্পাপ মুখখানায় দৃষ্টি স্থির হতেই ফোনের রিংটোন বেজে উঠল ইমদাদের। স্ক্রিনে প্রিয়া নামটা দেখতে সে অস্থির হয়ে পড়ে। রিসিভ করে উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” কোথায় আছ? ”
” তোমার বাসার নিচে। ফ্ল্যাট নাম্বার বলো। ”

ইমদাদের কণ্ঠ আগের চেয়েও দ্বিগুন উত্তেজিত হয়ে পড়ে। বলল,
” এই না, এসো না। ”

কথাটা বলেই ফোন নামিয়ে ফেলে ইমদাদ। বুকের সাথে চেপে ধরে মিহির দিকে তাকায়। বুঝতে পারে বেশি জোরে কথা বলে ফেলেছে, ঘুম না ভেঙে যায়! কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পরও মিহিকে নড়তে না দেখে ফোন কানে তুলে নেয় পুনরায়। গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল,
” তোমার আসতে হবে না, আমি আসছি। ”
” কেন? ”
” কী কেন? ”
” আসব না কেন? কাল রাতে তো তুমিই বললে আজ রাতটা আমরা একসাথে কাটাব। ”

প্রিয়ার কথাগুলো এবার বিরক্ত লাগল ইমদাদের নিকট। খানিকটা রাগ ধরা পড়ল নাকের পাটায়। মিহি আছে দেখে ঠিকমতো কথা বলা যাচ্ছে না। সে নিজেকে সংযত রেখে ধীরে বলল,
” নিচে অপেক্ষা করো, প্লিজ। দু-মিনিটের মধ্যে নামছি। ”

কথাটা বলেই কল কেটে দিয়ে ফোন পকেটে ভরল। মিহির দিকে এক পলক চেয়ে ধীর পায়ে দরজার দিকে এগুচ্ছে।সিটকানি খুলে বের হবে ঠিক সেসময় মিহি চিৎকার করে উঠল,
” কোথায় যাচ্ছেন? ”

ইমদাদ চমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। চকিত চোখে পেছন ঘুরলে মিহি বিছানা থেকে নেমে আসে দ্রুত। উৎসাহিত স্বরে বলল,
” আমাদের বাসায় যাচ্ছেন? আমিও তো যাব। চলুন। ”

মিহি ইমদাদকে রেখে আগে আগে দরজা ছেড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করল।

_______

ইশাদদের বাসার বসার রুমে বসে আছে রেখা ভূইয়া। তার একপাশে স্বামী ও অন্যপাশে তিহি। যার হাতটা এখনও রেখা ভূইয়ার হাতে বন্দী। শাহিনা শাইখা সকলের জন্য পানি সাজিয়ে আনলেন গ্লাসে। প্রথম গ্লাসটা ইশাদের দিকে এগিয়ে দিলে সে হাত দিয়ে বাঁধা দেয়। অস্থিরচিত্তে রেখা ভূইয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
” আমি কিছু বুঝতে পারছি না, আন্টি। দয়া করে সবটা খুলে বলুন! ”

রেখা ভূইয়া সহানুভূতি চোখে তাকাল ইশাদের দিকে। তারপরেই দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল তিহির দিকে। সেখানে দৃষ্টি স্থির রেখে বলতে শুরু করল,
” আমাদের একমাত্র সন্তান তাজ। ভীষণ আদরের! ছোট থেকে কোনো চাওয়া অপূর্ণ রয়েছে বলে আমার মনে নেই। ব্যবসার কাজে ওর বাবা প্রায়ই দেশের বাইরে থাকত। সে সুযোগে ভীষণ বেপরোয়া হয়ে পড়ে। তাকে সামলানোর সাধ্যি টুকু ছিল না আমার। তেমন অবস্থায় একদিন এসে বলল, ‘ মা, আমি বিয়ে করব। ‘ আমি তো খুব অবাক! খুশিও হয়েছিলাম এই ভেবে যে, ওকে সামলানোর দায়িত্ব এবার আরেকজনের উপর ছাড়তে পারব। তাই খুশিমনে জানতে চেয়েছিলাম কাকে বিয়ে করবে? মেয়ে পছন্দ নাকি। বাড়ির ঠিকানা দিক বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাব। সাথে সাথে মুখ কালো করে জানায়, মেয়ে পছন্দ কিন্তু তার বাড়ি থেকে নাকি মানবে না। আমি খুব রেগে গেলাম। ছেলে আমার কমতি কিসে? মানছি একটু উগ্র স্বভাব তাই বলে ফিরিয়ে দিবে? আমি সগর্বে মানিয়ে নিব এমন শপথে ঠিকানা চাইলে তাজ বলে, ‘ তিহিরা মুসলিম, মা! ”

এতটুকুতে আসতে ইশাদের দৃষ্টি তাৎক্ষণিক সরে গেল রেখা ভূইয়ার স্বামীর দিকে। কপালে তিলকটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আপনারা হিন্দু? ”

রেখা ভূইয়া ভারী নিশ্বাস ফেলে। ইশাদের দিকে তাকিয়ে দুর্বল কণ্ঠে বলল,
” হ্যাঁ, আমার ছেলের পুরো নাম তাজাস মুখার্জি। ছোট্ট করে ডাকি তাজ। ”

তারপর স্বামীর দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে বলল,
তাজের বাবা তাপান মুখার্জি আর আমি রুকমিনি মুখার্জি। ”
#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩
পর্ব (২)

তাজ হিন্দু! তিহিকে যার স্ত্রী বলে দাবি করছে সে হিন্দু! কথাটা ভাবতেই মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেল। ছোটখাটো ভূমিকম্পের মতো ইশাদের চিন্তা-ভাবনাকে লণ্ডভণ্ড করে দিল যেন! সে কতক্ষণ ভাষা হারিয়ে তিহির দিকে তাকিয়ে থাকল। স্তম্ভিত দৃষ্টি ধীরে ধীরে সহানুভূতিতে পরিণত হতে জিজ্ঞেস করল,
” তারপর? ”

রুকমিনি মুখার্জি (রেখা ভূইয়া) ইশাদের দিকে তাকালেন। আগ্রহ নিয়ে বললেন,
” তাজ তিহিকেই বিয়ে করবে বলে জেদ ধরে। তার পরিবার মানবে না এটাও জানে তাই ঠিক করে পালিয়ে বিয়ে করবে।আমি ছেলের জেদের কাছে পরাজিত হলেও ওর বাবা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। দুজনের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হয়। আমি কার পক্ষে কথা বলব সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। এক পর্যায়ে তাজের বাবা জানিয়ে দেন, কোনো মুসলিম ঘরের মেয়েকে বিয়ে করলে তাজকে বাড়ি ছাড়তে হবে। তাজ আর একটি কথাও বলেনি। নীরবে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। সে যাওয়ায় ছিল তার শেষ যাওয়া। ”
” শেষ যাওয়া মানে? ”

ইশাদের কণ্ঠে বিস্ময়াকুল। রুকমিনি মুখার্জি সাথে সাথে উত্তর দিলেন না। ইশাদ খেয়াল করল তার চোখে জল জমছে। তিনি বেশ কিছুক্ষণ পর ভার স্বরে বললেন,
” সেদিনের পর আমার ছেলে আর বাড়ি ফিরেনি! ”
” কেন? ”
” নিশ্চিত বলতে পারব না। কিন্তু আমার ধারণা সেদিনই তিহিকে বিয়ে করে তাজ। ”

তিহির সাথে ‘ বিয়ে ‘ শব্দটা উচ্চারণ হতেই ইশাদের ভেতরটা নড়ে উঠল। যেন গড়িয়ে পড়ল কোনো গভীর খাদে। যেখান থেকে উঠে আসার কোনো পথ নেই। তাকে একাই থাকতে হবে সেখানে, অনন্ততকালের জন্য। ইশাদের ভেতরটা হাঁসফাঁস করতে লাগল। ভীষণ অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” বিয়ের পর উনি আপনাদের সাথে যোগাযোগ করেনি? ”
” না। ”
” আপনারা করেননি? ”
” চেষ্টা করেছিলাম অনেক। কিন্তু কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারিনি। যোগাযোগের সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল। একসময় আমরা থানায় ডায়রীও করেছিলাম। তাতেও লাভ হয়নি। ছুটাছুটি করে ক্লান্ত হয়ে একসময় বসে পড়লাম। তাজের বাবা আমাকে সান্ত্বনা দিলেন, তাজ নিজে থেকেই যোগাযোগ করবে। আমি সে আশায় দিন গুণতে লাগলাম। এভাবেই কেটে গেল প্রায় এক বছর। হঠাৎ এক সন্ধ্যাবেলা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসল। আমি ধরতেই তাজের গলা পেলাম। ”

ইশাদ বসা অবস্থায় শিরদাঁড়া সোজা করল। গলা সামনে বাড়িয়ে ভীষণ কৌতূহলে জানতে চাইল,
” কী বলেছিল? ”

রুকমিনি মুখার্জি সাথে সাথেই বললেন,
” প্রথমদিকে কিছুই বলেনি। শুধু জোরে জোরে শ্বাস টানছিল। তারপর অস্পষ্টে বলেছিল, তিহিকে বাঁচাও। আমি অস্থির হয়ে পড়ি। বুঝতে পারি আমার ছেলে ঠিক নেই। তাড়াহুড়ায় জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে? আমার ছেলে সে উত্তর দিতে পারেনি। আমি অনেকবার একই প্রশ্ন করার পর বহুকষ্টে ‘ মাওয়া ফ্লাইওভার ‘ নামটা বলেই চুপ হয়ে যায়। আমি অনেকবার ডাকার পরও তার গলা আর শুনতে পাইনি। অসংখ্যবার কল দিলেও কেউ ধরেনি! আমি তখনই পাগলের মতো বাসা থেকে বের হয়ে যাই। গাড়িতে উঠার পর মনে পড়ে আমি তো শেরপুর টাউনে আছি। মাওয়া যেতে অনেক সময় লাগবে। ততক্ষণে আমার ছেলের যদি কিছু হয়ে যায়? যাকে বাঁচাতে বলছিল তাকে যদি বাঁচাতে না পারি? সে চিন্তায় আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া যোগাড়। শেষে গিয়ে মনে পড়ে মাওয়ার কাছেই আমার এক পরিচিত বড় ভাই থাকে। তাকে কল করে সব বলতেই সে আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলে তাজ যদি সেখানে থাকে অবশ্যই খুঁজে বের করবে। ”

ইশাদ আর রুকমিনি মুখার্জির বলার অপেক্ষা করতে পারল না। অধৈর্য্য হয়ে প্রশ্ন করে বসল,
” খুঁজে পেয়েছিল? ”
” না। তাজকে পায়নি। তবে আমাদের গাড়ি পাওয়া যায়। যার অনেকটা দূরে একটা মেয়ে আহত অবস্থায় পড়ে ছিল। যে কিনা আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমি সেখানে পৌঁছে শুনি স্থানীয়রা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। অবস্থা খুব খারাপ, ও’টিতে আছে। আমার সেই ভাইয়ের কাছে মেয়ের পরিচয় জানতে চাইলে বলে, তেমন কিছু জানা যায়নি। তবে জ্ঞান হারানোর পূর্বে নাম বলেছিল তিহি। আমি তিহিকে আগে দেখিনি। তাজের মুখে নাম শুনেছিলাম শুধু। সেখান থেকেই বিশ্বাস করি এই আমার ছেলের সেই ভালোবাসা। আমি যতক্ষণে ডাক্তারের কথা বলতে গেলাম ততক্ষণে অপারেশন শেষ। ডাক্তার আমাকে জানায়, প্রিম্যাচিউর বেবিকে এনাইসিইউতে রাখা হয়েছে। তিহির অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। আইসিইউতে আছে। জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। আমি তিহির জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় হাসপিটালেই থাকলাম। তার জ্ঞান ফিরল তিন দিন পর। প্রথম এক সপ্তাহ কথা বলেনি, শুধু ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকত। তারপর যখন কথা বলতে শুরু করল তখন দেখি নিজের সম্পর্কে কিছুই বলতে পারছে না। ডাক্তারের কথায় তাকে আরও সময় দেওয়ার পরও যখন কিছু জানাতে পারল না তখন সন্দেহ করলেন তিহির স্মৃতিশক্তি হারিয়ে গিয়েছে। এদিকে বাচ্চার ওজন দিনে দিনে কমছিল। মায়ের বুকের দুধ দরকার, ওম দরকার। যার কোনোটাই সম্ভব ছিল না। কেননা, বাচ্চাকে তার কাছে নিলেই চিৎকার করে। পাগলের মতো কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। শেষে বাধ্য হয়ে বাচ্চাকে তার থেকে দূরে রাখা হয়। ডাক্তারদের তত্বাবধানে থেকে বাচ্চার ওজন বৃদ্ধি পেতেই দুজনকে ছেড়ে দেয়। তাদেরকে নিয়ে আমাদের বাসায় উঠি। সেখানে গিয়ে আরেক ঝামেলা! আমাকে পূজা করতে দেখলে চিৎকার চেঁচামেচি করে। দূর্গা মায়ের মূর্তি দেখলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এমনকি আমার সিঁথিতে সিঁদুর দেখলে আমার থেকে দূরে পালিয়ে যায়। তার মধ্যে কারও মুখে তাজের নাম শুনলেও পাগলামি শুরু করে। আমি না পারছিলাম তিহিকে সামলাতে, না পারছিলাম তাকে অন্য কোথাও রেখে আসতে। সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, এ আমার ছেলের বউ। তাজের সন্তানের মা। একে সুস্থ করতে হবে। হয় তো এই মেয়েই আমার ছেলের সন্ধান দিতে পারবে। না জানা কথাগুলো জানাতে পারবে। তাই তিহি ভয় পায় যেসকল ব্যাপারে সেসকল ব্যাপারগুলো আমি এড়িয়ে চলতে শুরু করি। নিজেদের বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় ভাড়া বাসায় উঠি। কাছেই একটা বেবিকেয়ারে ইনাকে রেখে আসি। ”
” তিহির জন্যই আপনি মুসলমানের পরিচয় বানিয়েছেন? ”

ইশাদের প্রশ্নে রুকমিনি মুখার্জি মাথা নাড়েন। একটু চুপ থেকে বলেন,
” আশেপাশে সবার কাছে নিজের মেয়ে হিসেবে পরিচয় করিয়েছি যাতে কেউ তাজের সম্পর্কে জানতে না চায়। ইনা যখন কথা বলতে শিখল তখন আমাকে আম্মা বলে ডাকত। শুরুর দিকে বাঁধা দিলেও পরবর্তীতে মেনে নিয়েছি। ভেবেছি বড় হলে বুঝিয়ে বলব। ”

ইশাদ ক্ষণিকের জন্য চুপ হয়ে থাকল। মুহূর্তকাল পরে বলল,
” আমি কি তাকে একটু দেখতে পারি? ছবি হবে? ”

রুকমিনি মুখার্জি একবার তিহির দিকে তাকালেন। মেয়েটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে বসে আছে। চোখ,মুখ উদাস! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিহির হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাজের একটা ছবি লুকিয়ে বহন করেন সবসময়। সুযোগ পেলে ছবি দেখিয়ে আশেপাশে খোঁজ করেন।

__________
মিহি দুইতলা থেকে একতলা নেমে আসতে ইমদাদ পেছন ডাকল। মিহি সেই ডাকের পরোয়া না করে ছুটে যাচ্ছিল গেইটের দিকে। গেইট পেরুতে বাইরে একপা রেখে পেছন তাকাল। ইমদাদকে তাড়া দিয়ে বলল,
” তাড়াতাড়ি আসুন। হাঁটছেন কেন? দৌড় দিন। ”

কথাটা বলে আরেকপা গেটের বাইরে দিতে গিয়ে পা আটকে গেল গেটের নিচের আংটায়। সামনে উপুড় হয়ে পড়ল প্রিয়ার উপর। সে টাল সামলাতে না পেরে পেছন বেঁকে পড়ে গেল মিহিকে নিয়ে। তাকে সরিয়ে উঠতে গিয়ে দেখল তার আঁটসাঁট হয়ে থাকা লাল টপসটা এক সাইড থেকে ছিঁড়ে গেছে। প্যান্টে ও চুলে ময়লা লেগে বিকিচ্ছিরি অবস্থা! রাগে-ক্ষোভে চটে গেল খুব। মিহির দিকে অগ্নি চোখে চেয়ে ইংলিশে দু-একটি গালি দিল। থাপ্পড় দেওয়ার জন্য হাত উঠে যেতেই ফোন বেজে উঠল। ইমদাদ কল করেছে। রিসিভ হতে ইমদাদ বলল,
” সোনা, আমার পেটে একটু সমস্যা হয়েছে। আজ দেখা না করলে হয় না? ”

প্রিয়ার রাগ দ্বিগুন হলো। ধমকে কিছু একটা বলতে গিয়ে চুপ হয়ে গেল। নিজের দুরবস্থায় চোখ বুলিয়ে বলল,
” ঠিক আছে। রাতে কল দিও। ”

প্রিয়া আরেকবার মিহির দিকে রাগীচোখে তাকিয়ে উঁচু হিলের শব্দ তুলে চলে গেল। তার একমিনিট পরে আগন্তুকের মতো উপস্থিত হলো ইমদাদ। মিহিকে টেনে নিয়ে আসল রুমে। দরজা আটকে রুক্ষস্বরে বলল,
” একটু চুপচাপ বসতে পারো না? আসতে না আসতে মাথা নষ্ট করে দিচ্ছ! ”

মিহি সে কথার প্রত্যুত্তর না করে বলল,
” চলে এলেন যে? বাসায় যাবেন না? ”

ইমদাদ আগের স্বরেই বলল,
” না। ”
” কেন? ”
” ইচ্ছে হয়েছে তাই। ”

ইমদাদের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না মিহি। চোখ নামিয়ে ফেলল। সাথে সাথে চোখে পানি জমে গেল। একফোঁটা গাল বেয়ে পড়তে ফুঁপিয়ে উঠে। ইমদাদ প্রথমে পাত্তা না দিলেও পর মুহূর্তে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করল। না পেরে বলল,
” এসব কান্নাকাটি আমার একদম পছন্দ নয়। নেচে নেচে বিয়ে করেছ, এবার সংসার করো। ”

মিহি ভেজা চোখে তাকাল ইমদাদের দিকে। ভারি আশ্চর্য হয়ে উচ্চারণ করল,
” সংসার! ”

ইমদাদ কপাল কুঁচকে নিলে মিহি বলল,
” আমি সংসার করব? ”

ইমদাদ উত্তর দিল না। মিহি আগ্রহ নিয়ে বলল,
” সংসার করতে হলে তো বিয়ে করতে হয়। ”
” তুমি বিয়ে করোনি? ”
” করেছি? ”
” তো ইশাদের সামনে কাজী অফিসে ওটা কী করেছিলে? ”
” ওটা বিয়ে ছিল? ”

মিহি আগের চেয়েও আশ্চর্য হয়ে বলল,
” তারমানে আপনি আমার স্বামী? ”

মিহির এমন বাচ্চামি প্রশ্ন ইমদাদের পছন্দ হচ্ছে না। সে পরনের শার্ট পালটাতে চলে গেলে মিহি পেছন গিয়ে বলল,
” সত্যি আপনি আমার স্বামী? ”

ইমদাদ বিরক্ত চোখে তাকিয়ে ছোট্ট করে বলল,
” হ্যাঁ। ”
” এটা আমার শ্বশুরবাড়ি? ”
” না, স্বামীর বাড়ি। ”

মিহির চোখ ছোট হয়ে গেল। পরক্ষণে বিস্মিত হয়ে বলল,
” এখন থেকে আমি আপনার সাথে থাকব? ”
” হ্যাঁ। ”

মিহি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আচমকা বলল,
” কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন, মিথ্যে অভিনয় করতে। ইশাদ ভাইয়াকে মিথ্যে বলতে আমি আপনাকে ভালোবাসি। ”

এ পর্যায়ে ইমদাদ মিহির দিকে ঘুরল। সরাসরি চেয়ে বলল,
” মিথ্যে ভালোবাসি বলতে বলেছিলাম, বিয়ে করতে নয়। ”
” ওটা মিথ্যে বিয়ে ছিল না? ”

ইমদাদ সাথে সাথে উত্তর দিল না। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
” আর একটা প্রশ্ন করলে পাগলের ইনজেকশন দিয়ে দিব বলে দিলাম। ”

_____________
রুকমিনি মুখার্জি ছবি নিয়ে বসার রুমে আসতে দেখলেন তিহি তার জায়গা থেকে উঠে ইশাদের পাশে বসেছে। সে সামনে গিয়ে দাঁড়াতে চট করে ইশাদের এক হাত চেপে ধরে মাথা নিচু করে ফেলল। তিনি সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে ইশাদের হাতে তাজের ছবিটি দিলেন। ছবির দিকে তাকিয়ে অসাবধানে বলে ফেলল,
” ইনা একদম বাবার মতো হয়েছে। ”

ইনা এতক্ষণ তাপান মুখার্জির কোলে বসেছিল। বাবার কথা শুনতেই দৌড়ে এলো ইশাদের কাছে। হাত থেকে ছবি কেড়ে নিয়ে তিহির হাতে দিয়ে বলল,
” আপু, আমাকে দেখতে সত্যি বাবার মতো? ”

ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে ইশাদ আর রুকমিনি মুখার্জি সামাল দিতে পারলেন না। ইশাদ তিহির থেকে ছবি নেওয়ার জন্য দ্রুত হাত বাড়াতেই রুকমিনি চিৎকার করে উঠল,
” তিহি! ”

চলবে
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here