তোর চোখে আমার সর্বনাশ পর্ব – ১৬

তোর চোখে আমার সর্বনাশ

১৬.

” আপনার স্ত্রী’র প্রতি খেয়াল রাখবেন মিস্টার নাহিয়ান সারাফাত , আর হ্যাঁ দুই বা তিন বছর পর বেবি নিতে পারবেন। ”

পেরিয়ে গেছে সাপ্তাহ খানিক ফারাহ্ এখন মোটামুটি সুস্থ। সব আগের মতো হলে ও ফারাহ্ হয় নি আগের মতো। চুপচাপ হয়ে গেছে। নাহিয়ানের সাথে কথা তো দূরে থাকা দেখা ও করে না। হাস্পাতাল থেকে আসার পর ফারাহ্ , সুফিয়া হানজালার সাথেই থাকে এক রুমে। অসুস্থ অবস্থায় মেয়েকে একা ছাড়ছেন না উনি। প্রথমে চেয়ে ছিল নাহিয়ানের কাছে রাখতে। তার মেয়ে এক রোখা , নাছোড়বান্দা। কিছুতেই নাহিয়ানের কাছে যাবে না। নাহিয়ান সে দিন আ’হ’ত চোখে চেয়ে ছিল ফারাহ্’র দিকে। মেয়েটা আগের চেয়ে কঠিন হয়ে গেছে। সবাই পরিস্থিতি মেনে নিয়ে ফারাহ্ কে স্বাভাবিক হওয়ার সময় দিল। দক্ষিণা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে নাহিয়ান। সেদিন ফারাহ্ কে র’ক্তাত অবস্থায় মেঝেতে দেখে শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে গিয়ে ছিল। পা দুই টো পাথরের ন্যায় ধারণ করে ছিল নিমেষেই। সিড়ি ডিঙিয়ে নিচে নেমে যাওয়ার সাহস হয় নি। গলা শুকিয়ে কাঠ। পা গুলো টেনেটুনে ও নিচে যেতে পারছিল না। ফারাহ্’র আহাজারি , কান্না , চিৎকার , ব্যথা কাতরাতে দেখে নিজেকে যথা ক্রমে ঠেলে নিচে নিয়ে গেলো। কালচে লালর’ক্তের স্রোত পেরিয়ে। ঝাপটে ধরল ফারাহ্ কে। অস্থিরতা পুরো দেহ ঝাং’কার দিয়ে উঠে ছিল সে দিন। মনে হয়ে ছিল এই দম বন্ধ হয়ে এলো। কারো ডাকে ধ্যান ভাঙল নাহিয়ানের। চোখ বন্ধ করে ভারী শ্বাস ছেড়ে পিছনে মুড়ে রিশাব কে দেখতে পায়।

” রিশাব তুমি? ”

রিশাব সামান্য হাসলো , কয়েক পা এগিয়ে এসে বলল ,

” বিয়ের অনুষ্ঠান গ্রামে করা হচ্ছে। ”

” শুনেছি। ”

” আসচ্ছো তুমি? ”

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে চুল গুলো ব্যাকব্রাশ করতে করতে সরল ভাবে বলল ,

” যেতেই হবে। ”

” সে টা কি বলছো তোমরা ছাড়া আমাদের আর কে আছে। ”

” ওকে বেশ যাচ্ছি। ”

রাত টা বেশ ভ’য়ং’ক’র অন্ধকারে মুড়ানো। চার দিক থেকে শুধু কুকুরের ডাক ভেসে আসছে৷ কিছু সময় পর পর। ফারাহ্ একটু একটু নড়েচড়ে উঠে। আজকে একাই শুয়েছে নিজের রুমেই। সুফিয়া হানজালা থাকতে চেয়ে ছিল। ও জোর করে মা কে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন বুঝতে পারছে , না পাঠানোই উচিৎ ছিল। পানির তেষ্টার সাথে খিদে ও পেয়েছে বেশ। উঠার শক্তি পাচ্ছে না। হাই ডোজের ঔষধ খাওয়ার ফলে ঘুম ছাড়ছে না। বিছানা খামচে চটপট করতে থাকে। মুখ দিয়ে আওয়াজ বের করার চেষ্টা করতে করতে আবার ঘুমের দেশে তলিয়ে যেতে লাগলো। তখন-ই দুই ঠোঁটের মাঝে ঠান্ডা জাতীয় কিছুর স্পর্শ ফেলো। ওর ঘাড়ের নিচে কেউ হাত রেখে ঠোঁটের মাঝে কিছু দিল। যখন বুঝতে পারলো পানির গ্লাস এটা চোখ না খুলেই আস্তে করে পানি কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নিল। স্বযত্নে ফারাহ্ মাথা বালিশের উপর রেখে দিয়ে কপালে ওষ্ঠদ্বয় ছুয়ে দিতে গিয়ে আবার দূরে সরে আসে নাহিয়ান। ফারাহ্’র শ্বাসের গতি গভীর , ভারী। যদি ও ঘুমের মাঝে একবার টের পায় নাহিয়ান এসেছে ওর রুমে তাহলে কি করবে মেয়েটাই ভালো জানে। নাহিয়ান ফারাহ্’র দিকে হতাশ চোখে চেয়ে মনে মনে বলল ,
‘ আমার ঘুম কেড়ে নিয়ে তুই দিব্বি শান্তির ঘুম দিচ্ছিস , এই যে ভারী অন্যায়। ‘
.
অন্ধকার কাটিয়ে ভোরের আলোর আহবানে। সূর্য মামা উঠল উঠল বলে। স্নিগ্ধ , শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে শহর জুড়ে। সকালের ঠান্ডা পরিবেশ। সারাফাত ম্যানসনের সকলে উঠে যে যার কাজে ব্যস্ত। কেউ জগিং নিয়ে , কেউ পত্র-পত্রিকা নিয়ে , কেউ রান্নাবান্না নিয়ে। এদিকে ফারাহ্’র ঘুমের রেশ মাত্র কাটলো পাখির কলকল আওয়াজে। কপালে ভাজ ফেলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। মন টা কেমন ভার হয়ে আছে। খুব করে চাইছে নাহিয়ানের সাথে কথা বলতে। কিন্তু চাপা অভিমানে দূরে সরে এলো। ওই দিন নাহিয়ান যদি এমন কিছু না বলতো তাহলে আজকে এই পরিস্থিতিতে পড়তে হত না। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বিছানা ছেড়ে নামলো।
ফুল পরোটা বেলে দিচ্ছে মিনা আরাফা পরোটা ভাজছেন। কিছু তেল দিয়ে আর কিছু তেল ছাড়া। ফাতেহ বাজার থেকে এলো। বাজের ব্যাগ থেকে সব কিছু ঠিক করে রাখতে রাখতে বলল ,

” শুধু আজকের জন্য বাজার এনেছি। ”

” ভালো করেছিস আগামী কাল সকালেই রওনা দিব রিশাবদের গ্রামের দিকে। ”

কথা শেষ করে ব্লেন্ডারের মগ থেকে জুস ঠেলে নিলে সুফিয়া হানজালা। পপি আর ফারাহ্ নিচে নেমে এলো। মূলত পপি ফারাহ্ কে আনার জন্য উপরে গেছে। ফারাহ্ ড্রাইনিং এ বসিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল ,

” কি খাবে? ”

” পরোটা আর ভাজি দাও শুধু। ”

” আচ্ছা দিচ্ছি আগে খালি পেটের ওষুধ খেয়ে নাও। ”

ফারাহ্ ওষুধ খেয়ে প্লেটের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। কারণ নাহিয়ান এসেছে তাই। ভুলে ও নাহিয়ানের দিকে তাকাচ্ছে না। দুঃখ আর সুখ একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। মানুষ সব সময় সুখে থাকে না। আবার দুঃখে ও না। নাহিয়ান জানে ওর ছোট্ট ফারাহ্ রা’গ ভুলে ওর কাছে ফিরে আসবে। সবাই চুপচাপ খাচ্ছে। কারো মুখে কথা নেই। থমথমে পরিবেশ। মুলত ফারাহ্’র জন্য। ও চুপচাপ থাকলে কেউ কথা বলে মজা পায় না। তাই পপি ফারাহ্’র মান ভাঙানোর চেষ্টা করার জন্য বলল ,

” বিয়েতে যাবো একটু শপিং করবো না সেটা কি হয়। ”

মিরাজ পরোটা চিবিয়ে জবাব দিল ,

” কয়েক দিন আগেই তো শপিং করলে এখন আবার কিসের শপিং? ”

” কয়েক দিন আগে নরমাল শপিং ছিল ওটা। ”

” শপিং আবার নরমাল ও হয় নাকি? ”

” হ্যাঁ হয় , বাড়িতে যে ড্রেস গুলো পড়া হয় ওই গুলো কে সিমসাম ড্রেস বলে। বাড়িতে মেহামান আসলে যে ড্রেস পড়া হয় ওই গুলো কে নরমাল ড্রেস বলে। আর বিয়ে সাদি , কোথাও ঘুরতে যাওয়ার সময় যে ড্রেস পড়া হয় ওই গুলো কে গর্জিয়াস ড্রেস বা পার্টি ড্রেস বলা হয়। আন্ডারস্ট্যান্ড। ”

” মাই গড তুমি তো দেখে ড্রেসের উপর পিএইচডি অর্জন করে এসেছো। ”

পপি মুখ বাঁকিয়ে পরোটা চিবিয়ে বলল ,

” আমি ফারাহ্ আর ফুল যাবো শপিং বাকি তোমাদের কিছু লাগলে বলো না হয় চল আমাদের সাথে। ”

উঠে দাঁড়ালো ফারাহ্। টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে গম্ভীর কণ্ঠে বলল ,

” আমার কিছুর দরকার নেই ভাবি যা আছে তা দিয়ে ও চলবে। পারলে তো বিয়েতেই না যাই। ”

হনহনিয়ে ড্রাইনিং রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে এসে দরজা লকড করে দিয়ে বারান্দায় এসে দোলনায় বসল। দৃষ্টি নাহিয়ানের বারান্দায়। কত সময় কাটিয়েছে ওই বারান্দায়। সব মুহূর্ত চোখের দৃশ্য পটে ভাসমান। সুফিয়া হানজালা ফুঁপিয়ে উঠে বললেন ,

” আমার মেয়ে টা কি আগের মতো আর হবে না। ”

কাথা টা বলেই উনি ও উঠে চলে গেলেন। সাথে এহনাস সারাফাত ও। মিরাজ মধ্যমা আঙুল দিয়ে পরোটার উপর আঁকি বুকি করছে। পপি হতাশ কি বলবে ও। ওর জানা মতে সব কিছু দিয়ে ও চেষ্টা করে ফারাহ্ কে স্বাভাবিক করতে পারছে না। শামীমা আখতার থেকে নজর সরিয়ে থমথমে গলায় বললেন ইফতেখার সারাফাত ,

” নাহিয়ান আমি তোমাকে কখন ও কিছু বলি নি কারণ আমি জানি তুমি সব ঠিক করো। কিন্তু আজকে আমি যা দেখছি তা আমি মেনে নিতে পারছি না। তোমার জন্য আমার আমাদের সাজানো সংসার ভাঙতে বসেছে তুমি যে ভাবেই পারো ফারাহ্ কে মানিয়ে নাও৷ যা সময় দিয়েছো তাতেই ইনাফ করো। আরো আগে তোমাকে এসব বলতাম তোমার মায়ের জন্য পারি নি। আর আজকে ছোট কে দেখে আমি আর শান্ত থাকতে পারছি না। ”

নাহিয়ান চায়ের কাপের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে। ওর ভিতরে কি চলছে! কিভাবে নিচ্ছে ফারাহ্ এসব ব্যবহার? শুধুই ও ছাড়া আর কেউ জানে না। বুক ভারী হয়ে এলো। নিঃশ্বাস নিতে ও বাঁধছে। ওর ও তো ইচ্ছে করে আগের ফারাহ্ কে দেখতে। ফারাহ্ কে নিজের বাহু ডোরে বন্ধি করতে। এটা তো এত দিনে বুঝে গেলো ফারাহ্ নিজে থেকে আসবে না। ধরা দিবে না নাহিয়ানের কাছে। ওকেই কিছু একটা করতে হবে।

_

সন্ধ্যার লগ্ন পেরিয়ে রাতের আঁধার নেমেছে ৷ রাত্রি প্রিয় জোঁনাকিরা বের হল ঝাঁকে ঝাঁকে। কি সুন্দর জ্বল জ্বল করছে। কখন ঝপ ঝাড়ে বসছে তো কখন ও গাছে বসছে আবার কখন ও উড়ছে। বিয়ে বাড়ি গমগম করছে। খানিক ক্ষণ আগেই হলুদের প্রোগ্রাম শেষ হয়েছে। ফারাহ্ শাড়ি বদল করে ঘুমাতে যাচ্ছিল তখনই নাহিয়ান এসে রুমে ডুকে দরজা বন্ধ করে দিল। অনেক দিন পর সরাসরি একান্তে নাহিয়ানের মুখোমুখি ফারাহ্। নাহিয়ানের চোখের দিকে এক পলক তাকিয়ে রুম থেকে বের হওয়ার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে নাহিয়ান দুই হাঁটু ভেঙে মেঝেতে বসে যায়। বাঁ কানে ডান হাত ডাঁ কানে বাম হাত ক্রসিং করে কান ধরে ঘাড় বাঁকিয়ে আসহায় মুখ করে বলল ,

” হেই সুইটহার্ট আর কত কষ্ট দিবে আমাকে? এই কয়েক সাপ্তাহ কিভাবে কাটিয়েছি শুধু আমি জানি। এক রাতে ও ঘুমাতে পারি নি শান্তি মতে। একটু ও কি মায়া হয় না তোর এই অদম স্বামীর প্রতি। ”

ফারাহ্’র খুব হাসি পাচ্ছে নাহিয়ানের কান্ড দেখে। এমনিতে এখানে আসার পর ওর সব রা’গ উদাউ হয়ে গেছে। কৃত্রিম রা’গ দেখিয়ে বলল ,

” কথা বলা শেষ হলে আসতে পারেন। ”

মনঃক্ষুণ হল নাহিয়ানের। তবে নড়লো না। অনেক হয়েছে এসব লুকোচুরি খেলা আজকে যেই করেই হোক ফারাহ্’র রা’গ ভাঙাবেই। গলা উঁচু করে শুধায় ,

” দেখ তুই আজকে যতক্ষণ আমার সাথে আগের মতো কথা বলবি না ততক্ষণ আমি উঠবো না এন্ড কান ও ছাড়বো না। ”

” বেশ এভাবেই থাকেন। ”

বলেই খাটে গা এলিয়ে দিল। নাহিয়ান আহম্মক বনে গেল। বলে তো দিয়েছে উঠবে ও না কান ও ছাড়বে না কথার দাম তো রাখতে হবে। এদিকে মশা কামড়াচ্ছে তাকে। হাঁটু মুড়ে বসে থাকতে থাকতে হাঁটুতে ব্যথা হয়ে গেছে। নড়চড় করছে ঠিকই না উঠছে না হাত কান থেকে নামাছে৷ ফারাহ্ কাঁথার নিচ থেকে উঁকি মেরে দেখছে। ফের কাঁথা নিচে মাথা ঢুকিয়ে নিঃশব্দে হাসছে। প্রায় কয়েক ঘন্টা পর। নাহিয়ানের হতাশ মুখ দেখে এবার খারাপ লাগতে শুরু করল ফারাহ্’র একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে৷ নাহিয়ান ওর কথাই টনক। এক বিন্দু ও নড়ে নি। ফারাহ্ ধপ করে উঠে নাহিয়ানের সামনে গেলো। মেয়ালি পায়ের পাতা দেখে মাথা উঁচু করে তাকালো নাহিয়ান। এত ক্ষণ নত জানু হয়ে ছিল। নাহিয়ানের চোখ দু’টি ট’গ’ব’গে লাল হয়ে আছে৷ ক্রো’ধে নাকি অন্য কিছু বুঝলো না ফারাহ্। সে ও হাঁটু মুড়ে বসল নাহিয়ানের দুই হাত ধরে কান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বাহু ধরে টেনে উঠালো। এত ক্ষণ বসে থাকার ফলশ্রুতি পা দুই টো জিম ধরে আছে নাহিয়ানের। ফারাহ্ নাহিয়ান কে খাটের উপর বসিয়ে দিয়ে দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে গেল। নাহিয়ান নিশ্চুপ। কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না তার। খানিকের জন্য ভালো লেগে ছিল প্রিয়াসীর ছোয়া। তার অভিমানী প্রিয়াসী কি তাকে কখন ও ক্ষমা করবে না। মস্তিষ্ক শূন্য শূন্য লাগছে। ভাবনার মাঝেই দরজা লাগানোর শব্দ ফেলো। ফারাহ্ আইস ব্যাগ নিয়ে নাহিয়ানের পাশে বসে হাঁটুতে ঘেঁষতে ঘেঁষতে ধমকে সুরে বলল ,

” বাজে অবস্থা হয়ে গেছে এমন পা’গ’লামো কেউ করে? ”

” বউ আমার সাথে কথা বলে না , বউয়ের ছোয়া পেতে আদর পেতে এমন পা’গ’লা/মো আমি প্রতিদিন প্রতি ক্ষণ করতে পারবো। ”

বেবি ফেস করে বলল কথা গুলো। ফারাহ্ এমন বাচপানা কথা শুনে রে’গে মে/গে আ-গু/ন হয়ে উচ্চ শব্দে বলে উঠে ,

” চুপ আর একটা বাজে কথা বললে খ’উন করে ফেলবো। ”

ঠোঁটের উপর আঙ্গুল দিয়ে বসল নাহিয়ান। বউয়ের ধমক শুনে কলিজা লাফিয়ে উঠল। ফারাহ্ নাহিয়ানের হাঁটুতে কিছু ক্ষণ আইস ব্যাগ ঘেঁষে তাকালো নাহিয়ানের চোখের দিকে। সে গভীর দৃষ্টি। দুই জনের চোখা চোখি অনেক কথা হচ্ছে৷ হচ্ছে এত দিনের না দেখে তৃষ্ণা দূর। হঠাৎ নাহিয়ানের চেহারা সিরিয়াস ভাব ফুটে উঠল। কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিল বৈকি।

” প্লিজ আজকে কোন কথা বলবেন না। আমি আপনার উপর রে’গে নেই। একটু বুকে নিয়ে ঘুমাবেন কত দিন আপনার বুকে মাথা রাখি না। ”

ফারাহ্ আবদার শুনে তড়িৎ গতিতে বুকের সাথে চেপে ধরল ফারাহ্’র মাথা। খাটে পিঠ এলিয়ে দিল নাহিয়ান। অস্থিরতা কর্পূরের মতো উবে গেছে। হ্যাঁ শান্তি লাগছে আজকে ভিষণ। ফারাহ্ দুই হাত দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল নাহিয়ান কে। কান পেতে শুনছে নাহিয়ানের বুকের ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়া হার্টবিটের গতি।

____

দিন , সাপ্তাহ , মাস ঘুরিয়ে কেটে গেলো। দুই বছর সাত মাস। রোজকারের মতো আজকের দিন টা সুন্দর মতে কেটে গেলো ফারাহ্’র। ফুলের সাথে কথা বলে সিড়ি বেয়ে উপরের দিকে যাচ্ছিল তখনই সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতে লাগলো নাহিয়ান। পড়নে ডার্ক চকলেট টিশার্ট , নীল জিন্স প্যান্ট। ফারাহ্ ভ্রু কুচকে তাকালো। সে নিচের দিক থেকে চার নাম্বার সিড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই নাহিয়ান ফারাহ্ কে পাঁজকোলে তুলে নিল। ফারাহ্ হকচকিয়ে বলল ,

” আরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? ”

নাহিয়ান উত্তর না দিয়ে হাঁটতে থাকে। বাড়ি থেজে বের হয়ে ফারাহ্ কে কোলে নিয়ে রিকশায় চড়ে বসল। ফারাহ্ ‘র তো বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে বের হয়ে পড়ল। এই সহ কয় শ বার জিজ্ঞেস করল কোথায় যাচ্ছে? ও যাবে না ৷ হ্যানত্যান নাহিয়ান কিছু কানেই নিচ্চে না। রিকশা চলছে আপন গতিতে। রাত প্রায় দশ টা। রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেছে। ফারাহ্’র বকবকানি থামানোর জন্য নাহিয়ান ফারাহ্’র ঠোঁটে ঠোঁট ছুয়ে দিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বলল ,

” আরেক বার যদি প্রশ্ন করো , একই কাজ টা বারবার করব তাও ডিপলি। লজ্জায় তো তুমি পড়বে। ”

চুপসে যায় ফারাহ্। এমনিতে সে শকড। এত রাতে ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে৷ এখন কিছু জিজ্ঞেস করাই বেকার। দীর্ঘ দিন পর বাসা থেকে বের হল সে। ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ পেয়ে অন্য রকম ভালো লাগছে। একটা ঘন জঙ্গলের পাশে এসে রিকশা থেকে নেমে পড়ে নাহিয়ান। ভাড়া হয়তো আগেই দিয়ে রেখে ছিল। কারণ রিকশা থেকে নেমেই হাঁটা ধরল নাহিয়ান। ফারাহ্’ র মাথা ভনভন করে উঠলো। এই কোথায় নিয়ে এলো ওকে? হাজার ও প্রশ্ন দল বেঁধে বসল ইতি মধ্যে। শত শত জোনাকিপোকার ভিড়ে এসে কোল থেকে নামালো ফারাহ্ কে। ফারাহ্ চার দিকে নজর ভুলিয়ে বলল ,

” এখানে কেনো নিয়ে আসলেন? ”

ফারাহ্ কন্ঠ ভীত। চোখের চাহনি বলছে অনেক কিছু। নাহিয়ান ফারাহ্ কে নিজের সাথে চেপে ধরে চোখে চোখ রেখে শুধালো ,

” কয়েক দিন ধরে নয়! দুই মাস ধরেই দেখছি আমার থেকে নিজেকে ঘুটিয়ে নিচ্ছো। কি করেছি আমি? ”

” এটা জানার জন্য এখানে নিয়ে এসেছেন? ”

” না। ”

সোজাসাপটা উত্তর দিল নাহিয়ান। ফারাহ্ কে ছেড়ে দিয়ে ডান দিকে ঘুরিয়ে ফের স্লো ভয়েজে বলল ,

” ফিল করো। ”

ফারাহ্ সব কিছু ভুলে জোনাকিপোকা দের খেলা দেখতে মত্ত হয়ে পড়ে। চাঁদের আলোর সাথে জোনাকিপোকার আলো খুব সুন্দর , মনোরোম পরিবেশ। মন চাইছে ক্যামেরা বন্দী করে রাখতে৷ ফাঁটা কপাল ক্যামেরা কোথায় পাবে এখন। আগে জানলে গলার সাথে ক্যামেরা ঝুলিয়ে রাখতো। আকষ্মিক শুনতে পায় নাহিয়ানের আওয়াজ ,

” কেউ এক জন আমাকে জিজ্ঞেস করে ছিল? এত ভালোবাসো! ওই মেয়ে টা তে কি এমন আছে? আমি জবাবে বলে ছিলাম মেয়ে টা ছাড়া আমার জীবনে আর কিছু নেই ব্যস্। ”

ফারাহ্ বাঁকা চোখে তাকালো নাহিয়ানের দিকে। এখানে মেয়েটা বলতে তারা বুঝিয়েছে নাকি? ওকে বুঝিয়েছে। তা সে বুঝলো না। নাহিয়ান ফারাহ্ দিকে নজর রেখেই দুই হাত মুষ্ঠি বেঁধে পিছনে ক্রস করে রেখে। ফারাহ্’র পিছনে গিয়ে ঝুকে পড়ল কানের কাছে। কানের ললিতে হালকা করে কামড় বসিয়ে। অতঃপর লো ভয়েজে বলল ,

” জানতে চাও সে কে? ”
ফারাহ্ মাথা ধুলালো নাহিয়ান আগের ভঙ্গিতেই বলে ,
” আমার প্রাণপাখি আমার ফা__ ”

দমকা হাওয়ার মতো ছিটকে মেঝেতে পড়ল ফারাহ্। নাহিয়ানের মুখে থাকা বাকি কথা আর বের হল না। দূর থেকে আমজাদ শরিফ বি’চ্চি’রি হাসলেন।

” আমার ছেলেকে আমার বুক থেকে কেড়ে নিয়ে তুই সুখের সংসার করবি তাও আমার সামনে হতে দিব না সেটা। ”

নাহিয়ান এখন ও আগের ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে আছে। বোধ হয় ঘন ভুবনে সে হারিয়ে গেছে৷ চার দিকে শূন্য। চোখের দৃশ্য পটে ভেসে উঠল একটু আগে অভিমানে মুখ ফুলিয়ে রাখা মেয়েটার মুখশ্রী। খিলখিল করে হাসা মুহূর্ত খানি। ওর কাছ থেকে দূরে যাওয়ার মুহূর্ত চোখের সামনে আসতেই ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল। ফারাহ্’র বুক থেকে র’ক্তের ধারা বয়ে গেছে। আঁখি যুগোল বন্ধ। নাহিয়ান সপ্রশ্ন চোখে একবার ফারাহ্’র অবচেতন শরীরে চোখ বুলিয়ে নিল। জিভ দিয়ে ওষ্ঠপুট ভিজিয়ে বার কয়েক বার ঢোক গিলে। নিজেকে স্থির করল পরিস্থিতির উপর। আজকে এই মুহূর্তে ফারাহ্ ছুতে ভ’য় পাচ্ছে ও। জোর পূর্বক হাত টেনে রাখল ফারাহ্ গালে। হিম শীতল হয়ে গেছে শরীর টা। বুক কেঁপে উঠল নাহিয়ানের। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে। আর কত সহ্য করবে? আর কত হারাবে প্রিয়জন? আর কত….

এত টুকু পড়ে উপন্যাসের বই টি বন্ধ করল জেনিফার। কারণ এর পর থেকে আর কিছু লিখা নেই বই তে। আধুরা অন্তিম। এর পর কি হয়ে ছিল জানতে ইচ্ছে করছে খুব জেনিফারের। ফারাহ্ কি মা’রা গেছে? নাকি জীবিত আছে? ইশশহ্ নাহিয়ানের জন্য বড়ই কষ্ট হচ্ছে ওর। এত দারুণ হ্যান্ডসাম ছেলে। অথচ সুখ নামক পাখি টা ধরা দিতে গিয়ে ও দে না। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বই টি বুকে চেপে ধরে খোলা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সবুজ অরণ্যের দিকে। মনে মনে ভিষণ কষ্ট পাচ্ছে সে ‘ তোর চোখে আমার সর্বনাশ ’ উপন্যাস টির বাকি অংশ জানার জন্য। কিভাবে জানবে? কে বা জানাবে ওকে?

#চলবে

®️আহমেদ মুনিয়া
•••••×কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ×

(বিভ্রান্তবোধ করবেন না কেউ। দয়া করে শেষাংশ পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here