তোর মায়ায় আবদ্ধ পর্ব ১৪

#তোর_মায়ায়_আবদ্ধ
#পর্ব_১৪
#আঁধারিনী(ছদ্মনাম)

আমার জীবন থেকে কেটে গেছে গোটা একটা সাপ্তাহ।আর এই গোটা একটা সাপ্তাহ যাবত আমি একরকম গৃহ বন্দি জীবন কাটিয়েছি।এক সাপ্তাহ আগে ভার্সিটিতে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনার পর পুরো সাপ্তাহ শুভ্র আমাকে বাড়ি থেকেই বের হতে দেয়নি।বাড়ির চার দেয়ালের মাঝেই আবদ্ধ ছিলো আমার গোটা একটা সাপ্তাহ।তবে এই এক সাপ্তাহ যাবত শুভ্রের মাঝে একটু একটু করে অনেক পরিবর্তন লক্ষ করেছি।

যেই মানুষ টা আমাকে দেখতেই পারতো না সেই মানুষ টাই এই গোটা একটা সাপ্তাহ আমি যাতে একাকিত্ব বোধ না করি তার জন্য আমাকে সঙ্গ দিতো।যতোক্ষণ বাড়ি থাকতো তখনই আমার সাথে এটা ওটা নিয়ে কথা বলতে থাকতো।উনার জন্যই হয়তো আমি মুভ অন করতে পেরেছি।প্রথম দিকে অভ্রের বলা কথা গুলোর শোনার পর থেকে নিজের ভেতর অপরাধ বোধ কাজ করতো।কোথাও না কোথাও মনে হতো আমি মনে হয় আমার ভালোবাসার মানুষটার সাথে প্রতারণা করেছি।আমি বিশ্বাস রাখতে পারিনি!

কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম আসলেই কি আমার কোনো দোষ ছিলো এখানে?ভরা বিয়ের আসরে একটা মেয়ের এবং তার মায়ের চরিত্রের উপর দাগ লাগিয়ে চলে গেলে মেয়েটার আর তার পরিবারের ঠিক অবস্থা হতে পারে, তা কি এক বারের জন্যেও ভাবা উচিত ছিলো না!মানলাম কোনো কোনো উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে এমন করেছে।তাই বলে কি অভ্রে আমাকে একবারের জন্যও জানানো উচিত ছিলো না।গোটা একটা দিন চলে যাওয়ার পর আমার কথা মনে পরেছে।শুধুমাত্র নিজের বাবার একটা অযুক্তিক কথা রাখার জন্য আমার গোটা পরিবার কে টেনে হিঁচড়ে নিচে নামিয়ে এক বারের জন্য আমাদের দিকে না তাকিয়ে চলে গেলো।এতোকিছুর পর আমার অভ্রের উপর থেকে বিশ্বাস চলে যাওয়াটা কি খুব বেশি ভুল।

যেই বাবা আমার জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে সমাজের প্রত্যেকটা মানুষের সাথে লড়াই করে আমাকে এতো গুলো বছর ধরে আগলে রেখেছে সেই বাবার মুখে হাসি ফোঁটানোও কি আমার ভুল ছিলো!কখনোই না অভ্র যদি ওর জায়গায় থেকে ঠিক থেকে থাকে তাহলে বলবো আমি আমার জায়গায় থেকে তখন তার থেকেও হাজার গুন বেশি ঠিক ছিলাম।আমি এখন একজনের বিবাহিত স্ত্রীর কারো বাড়ির বউ।আমি নিশ্চয়ই এখন এসব কিছু ছেড়ে অভ্রের কাছে চলে যেতে পারি না।

হ্যা প্রথম দিকে শুভ্র আমাকে মেনে নিতে পারেনি।কেই বা মানতে পারতো বিয়ের দাওয়াত খেতে গিয়ে বলা নেই কওয়া নেই হুট করে একজনের সাথে বিয়ে হয়ে গেলো।শুভ্রের জায়গায় আমি থাকলেও হয়তো মেনে নিতে পারতাম না।কিন্তু এখন তো শুভ্রের আচরণে বোঝা যাচ্ছে উনিও আমায় একটু একটু করে মেনে নিচ্ছেন।তাহলে এখন কিভাবে আমি অভ্রের কাছে ফিরে যাই!আল্লাহ তায়ালা হয়তো আমাদের ভাগ্য গুলো এভাবেই লিখে রেখেছিলেন। তাই হয়তো অভ্রের সাথে আমার বিয়েটা শেষ অবধি হয়েও হয়নি।অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি অভ্রের সাথে একবার দেখা হলেই আমি সাপ সাপ বলে দিবো যাতে আমাকে আর কোনো কিছু জেনো না ভাবে।আমাদের একসাথে পথ চলা এখানেই সমাপ্ত।

আজ এক সাপ্তাহ পর ভার্সিটি এসে ক্লাস করতে পারলাম।তবে এতো গুলোদিন ভার্সিটি আসতে পারিনি বলে কিন্তু আমার পড়াশোনায় কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি।বরং আগের থেকে আরো ভালো চলেছে। আমার মতো ফাঁকিবাজ মেয়েই এখন পুরো দমে মন দিয়ে পড়াশোনা করছি।সবটাই সম্ভব হয়েছে শুভ্রের জন্য।লোকটা সত্যি অদ্ভুত একেক সময় একেক রকম ভাবে নিজেকে উপস্থান করে।এসব ভেবেই মৃদু হেসে আবার ক্লাসে মনযোগ দিলাম।

নিয়ম অনুযায়ী একটা বাজতেই ক্লাস শেষ হলো।ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে ক্যান্টিনের দিকে গেলাম।শুভ্র বারবার করে বলে গিয়েছিলেন ক্লাস শেষে উনার জন্য ক্যান্টিনে বসে অপেক্ষা করতে।তাই এখানে আসা কিন্তু একা একা বোর লাগছে যদি শুভ্র তাড়াতাড়ি এসে পরবে বলেছিলো।তারপরও একা বসতে ইচ্ছে করলো তাই একটা চেনা মুখের অনুসন্ধান করছি।ইরানিকে একা একটা টেবিলে বসে থাকতে দেখে ওর টেবিলে গিয়েই বসলাম।ইরানি আমার ক্লাসমেট আজ ওর সাথেই এক বেঞ্চে ক্লাস করেছি। যার দরুন ওর সাথে ভালোই আলাপ হয়েছে।

” তোমার সাথে বসতে পারি?”

” আরে বসো বসো।”

সৌজন্য মূলক হাসি দিয়ে আমি বসতেই ইরানি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

” তুমিও কি কারো জন্য অপেক্ষা করছো?”

” হ্যাঁ। তুমিও তাহলে অপেক্ষা করছো।”

” আমার ভাইয়া আমাকে নিতে আসবে তাই অপেক্ষা করছি।”

এভাবেই কিছুক্ষণ আমাদের মধ্যে টুকটাক কথা চললো।পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ইরানির ভাই চলে আসাতে ও চলে গেছে।এদিকে অভ্রের কোনো দেখা নাই।আর অভ্রের ফোন নাম্বার টাও আমার কাছে নেই। আসলে কখনো নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি তাই আর নেওয়া হয়ে উঠেনি।এখন কি করবো একাই বাড়ি ফিরে যাবো নাকি অপেক্ষা করবো।এরমধ্যেই আমার ফোনে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এলো।সচরাচর আমি অপরিচিত নাম্বার ধরি না।কিন্তু এখন অনুমান বলছে এটা শুভ্রের কল হলেও হতে পারে তাই রিসিভ করলাম।

” হ্যালো আলমুন।” শুভ্রের কন্ঠ পেয়ে নিশ্চিত হলাম।

” আমি তো ক্যান্টিনে বসে আছি। আপনি কোথায়?”গড়গড়িয়ে একসাথে বলে উঠলাম।

” তুমি আর পাঁচ মিনিট ওখানে বসো আমি আসছি।আমি ট্রাফিক জ্যামে আটকে গেছি গো বউ তাই আসতে পারছি না।যদি সঙ্গে তুমি থাকতে না তাহলে ওই গানটা ধরতে পারতাম ‘এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলো তো’ কিন্তু আমার বর্তমান অবস্থা তো উল্টো।”

শুভ্রের কথায় হেঁসে উঠলাম।আজকাল লোকটা কেমন জেনো রসিক রসিক ভাব এসে পরেছে। আগের সেই গম্ভীর লোকটা যে হাসতেই বোধহয় জানতো না সে-ই এখন সবাইকে হাঁসানোর কাজে নিয়জিত হলো।একটা মানুষের ভিতরে এতো পরিবর্তন এতো তাড়াতাড়ি কি করে সম্ভব আমার জানা নেই।ট্রাফিক জ্যামের জন্য শুভ্রের আসতে আসতে আরো দশমিনিট লাগলো।তারপর একসাথে আমরা বাড়ি ফিরলাম।

বিকেল পাঁচ টা বেজে বোধহয় এবাড়িতে আসার পর থেকে একবারো ছাঁদে যাওয়া হয়ে উঠেনি তাই আজ খুব ইচ্ছে জাগলো ছাঁদে যাওয়ার।যেই ভাবা সেই কাজ।ছাঁদে আসতেই একটা মেয়ের অবয় ছাঁদে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।মেয়েটা আর কেউ নয় মিহি।কিন্তু ওকে আমি পিছন থেকে কয়েকবার ডাকার পরও কোনো সাড়া দিচ্ছে না।ঠায় একি ভঙ্গিমায় একিভাবে পাথরের মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে।তাই এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়াতেই স্পষ্ট দেখতে পেলাম মিহি কাঁদছে।আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

” কি হয়েছে মিহি? কাঁদছো কেনো?

মিহির এবার টনক নড়লো আমাকে দেখেই তাড়াতাড়ি চোখ মুছতে লাগলো।আর মুখে হাসি হাসি ভাব ফুটিয়ে তলার চেষ্টা করে বললো,

” আরে কিছু না ভাবী আসলে চোখে কি জেনো একটা ময়লা পরলো তাই চোখ থেকে পানি বেরিয়েছে।”

” মিথ্যে বলার প্রয়োজন নেই মিহি। আমি স্পষ্ট দেখেছি তুমি কাঁদছিলে।কিন্তু কেনো কি হয়েছে তোমার? ”

” তেমন কিছু না ভাবী।আসলে….”

” আচ্ছা সমস্যা নাই একান্ত ব্যক্তিগত হলে থাক।”

” আসলে ভাবী আমি একজনকে ভালোবাসি আর সেও আমাকে খুব ভালোবাসে।” মাথা নিচু করে বললো মিহি।

মিহির কথা শুনে প্রথমেই আকাশ ভাইয়ার কথা মনে পরলো।বেচারা কতো আশা নিয়ে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলো।বাড়ি থেকে আসার পর ভুলেই গিয়েছিলাম এখন মিহির কথায় মনে পড়লো।আহারে বেচারা ভাইটা আমার জীবনে প্রথম একটা মেয়েকে মনে ধরলো তাও মেয়েটা মিঙ্গেল।কিন্তু মিহির কাঁদার কারণ কি সেটা তো জানা হলো না।আমি জিজ্ঞেস করার আগেই মিহি নিজে থেকে বলতে লাগলো,

” আজ দুই সাপ্তাহ যাবত আমাদের সম্পর্ক টা টেনেটুনে কোনোরকমে চলছিলো। কিন্তু আজ আদিব সব কিছু পুরোপুরি শেষ করে।” বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলো মিহি।

” তোমাদের মধ্যে কোনো সমস্যা ছিলো কি?”

” না আদিব হঠাৎ করেই কেমন যেনো হয়ে গেলো।একটু থেকে একটুতেই খুব রেগে যেতো আমাকে সন্দেহ করতে লাগলো আমার নাকি অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছি।আমি ওকে অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু ও আমার কোনো কথাই শুনতো না।মাঝে মধ্যে তো ফোনই বন্ধ করে রাখতো।কিন্তু জানো আমাদের সম্পর্ক টা না এমন ছিলো না।আমরা আমাদের সম্পর্কটাতে খুব হ্যাপি ছিলাম।কিন্তু জানি না হঠাৎ কি হলো ওর ও কেনো এমন করলো আমার সাথে। এই তো পনেরোদিন আগেও আমরা ঘুরতে গিয়েছিলাম তখনও সব কিছু ঠিকছিলো।দাঁড়াও তোমাকে আমাদের ঘুরতে যাওয়ার পিক দেখাই তাহলেই হয়তো কিছুটা বুঝতে পারবা।”

একনাগাড়ে কথা গুলো বলেই হন্তদন্ত হয়ে ফোন থেকে একটা কাপল পিক বের করে আমার সামনে ধরলো। কিন্তু পিকটা দেখে আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো।আমার চোখ গুলো যেনো ঝাপসা হয়ে উঠলো।এ আমি কাকে দেখলাম!আমার সব বিশ্বাস যেনো এক সেকেন্ডেই ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো।

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here