তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৩০
________________
রুদ্র অরূণীর হাত ধরে টেনে ছাদে নিয়ে গেল।অরূণী বিস্ময়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে নির্বাক হয়ে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে রইল।ছাদের দরজা বন্ধ করে দেয় রুদ্র।অরূণী কোনো প্রশ্ন করলো না। রুদ্র অরূণীর হাত ছেড়ে ছাদের এক কোণে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায়।অরূণী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে। হঠাৎ প্রশ্ন করলো, “সমস্যা কী আপনার রুদ্র আকন?”
– “বেয়াদব মেয়ে। ফাজিল! আমার নাম ধরে কথা বলে।মাথা ভরা গোবর।গুনে গুনে দশ’টা চড় দিবো এখন।”
অনেকক্ষণ ভেবেও রুদ্রর এই অদ্ভুত আচরণ বুঝতে ব্যর্থ হলো অরূণী। ভাবনা-চিন্তা বাদ দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কী কথা বলবেন?বলেন।আর ছাদের দরজা আটকিয়েছেন কেন?কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।”
– “কেউ যাতে না দেখে সেজন্যই তো আটকিয়েছি দরজা।”
অরূণী ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায় রুদ্রর দিকে।একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করলো। ভারী গলায় বলল, “যে কেউ আমায় খোঁজ করতে পারে। আপনার কী কথা বলুন?”
– “তোমার ফোন বন্ধ কেন আগে সেটা বলো?আর তুমি হুট করে পটুয়াখালী চলে এসেছো কেন?এসেছো ভালো কথা কিন্তু এতদিন কেউ বেড়ায়?”
– “আপনি কী বুঝতে পারছেন আপনি অদ্ভুত আচরণ করছেন?আমি আপনায় বলেছি না আমি সবকিছুর জন্য দুঃখিত।আর আমি আমার সেই হাস্যকর আবেগ, অনুভূতি গুলো ভুলতেই এখানে এসেছি।আমি সবকিছুর জন্য অনুতপ্ত।তবুও আপনি কেন এমন করছেন এখন?মজা নিচ্ছেন আপনি?”
অরূণী কিছুটা চেঁচিয়ে উঠলো। তীব্র ক্ষোভ গলায়। রুদ্র অরূণীর দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হাসলো।অরূণীর অসহ্য লাগছে।কী চায় রুদ্র? ভালোবাসার মানুষ থাকতেও কেন অরূণীর সাথে এমন করে?অরূণীর চোখ দু’টো জলে ছাপিয়ে ওঠলো। বিনা বাক্যে ছাদ থেকে নেমে যেতে উদ্যত হলে রুদ্র পথ রোধ করে দাঁড়ায়।
– “এমন কেন করছো তুমি অরূণী?কথা তো শুনবে।এত অভিমান কীসের তোমার?”
অরূণীর শক্ত গলার স্বর, “আপনি কী বুঝতে পারছেন আপনি অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছেন?”
রুদ্র ঠাণ্ডা গলায় হেসে বলল, “এসব বাড়াবাড়ি তো তুমিই শিখিয়েছো। তোমার সংস্পর্শে বাড়াবাড়ি নামক ছোঁয়াচে রোগে পেয়ে বসেছে আমায়।”
কথা’টা শেষ করে রুদ্র অরূণীর দিকে তাকাতেই দেখে অরূণীর গাল বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে।রুদ্র বিস্ময়বিহ্বল হয়ে তাকায় সেদিকে।ব্যগ্র গলায় জিজ্ঞেস করে, “অরূণী কী হয়েছে কাঁদছো কেন?”
অরূণী’কে নিরুত্তর দেখে রুদ্র ফের একই প্রশ্ন করলো।অরূণী কিছুক্ষণ পর তীব্র রোষ নিয়ে বলল, “আপনি কেন আমার সাথে এমন করছেন? আপনি কী বুঝতে পারছেন না আমি ওসব থেকে বেড়িয়ে আসতে চাচ্ছি।আর আপনি আমার সাথে মজা করছেন।আমার আবেগ নিয়ে মজা করছেন।হাত ধরে ছাদে নিয়ে আসলেন! আপনি বুঝেন না এসবে আমার কষ্ট বাড়ে?”
রুদ্র কয়েক পা এগিয়ে অরূণীর কাছাকাছি দাঁড়ায়, “কে বলছে আমি মজা নিচ্ছি?আমি পটুয়াখালী কেন এসেছি তুমি জানো?”
– “তা জেনে আমি কী করবো?”
– “তোমায় যে কথা বলার জন্য ডেকেছি তা কী তুমি শুনবে না?”
– “আপনার সাথে আমার কীসের কথা?”
রুদ্র ধমকে ওঠে, “এবার কিন্তু সত্যি সত্যি চড় খাবে অরূণী। ফাজিল!”
– “আপনার এ ধরণের আচরণের কারণ’টা একটু বলা যাবে?”
– “একটু না সম্পূর্ণ বলা যাবে।”
রুদ্র একটু থেমে বলল, “আমি পটুয়াখালী এসেছি কেন জানো?”
– “কেন?”
– “তোমার জন্য।”
অরূণী হেসে ফেলল। আনন্দ কিংবা খুশিতে হাসে নি।তাচ্ছিল্য করে হেসেছে।
– “আশ্চর্য অরূণী তুমি হাসছো যে?”
– “কৌতুক শুনলে যে কেউই হাসে।প্রাঙ্ক করছেন?কোথায়ও ক্যামেরা লুকানো আছে?”
এই বলে আশেপাশে চোখ বুলায় অরূণী। চারপাশ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে অরূণী বলল, “রুদ্র ভাই অনেক হয়েছে এবার দয়া করে এসব বন্ধ করেন।আমি অনেক বাড়াবাড়ি করেছি সেটা আমি মানছি।আমি স্যরিও বলেছি। কিন্তু আমি সত্যি ভালোবেসে ছিলাম।সকল নিয়ম-কানুন ভেঙে ভালোবেসে ছিলাম। আপনার কাছে আমার সেই ভালোবাসা সব সময় খামখেয়ালি ছিলো।আমি খামখেয়ালিপনা ছেড়ে দিয়েছি।অথচ আপনি নতুন করে আমার সেই আবেগ,অনুভূতি নিয়ে মজা করছেন।আপনি ই বলেন কারো আবেগ,অনুভূতি নিয়ে কী মজা করা উচিত?”
রুদ্র হতাশ চোখে তাকিয়ে আছে অরূণীর দিকে।অরূণী যে কিছুতেই রুদ্রর কথা বিশ্বাস করবে না সেটা রুদ্র বুঝতে পেরেছে।অরূণী আবার বলল, “এখন তো আমার মনে হচ্ছে আপনার চরিত্রে সমস্যা আছে।”
রুদ্র বিস্ময় ভরা গলায় বলল, “চরিত্রে সমস্যা মানে?”
অরূণী কোনো উত্তর না দিয়ে দৌড়ে ছাদ থেকে নেমে গেল। রুদ্র স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল।অরূণী রুমে গিয়ে সজোরে দরজা বন্ধ করে দিয়ে খাটে বসে পড়লো।চোখ বেয়ে পানি গড়াচ্ছে শুধু।রুদ্র কেন এমন করছে?কেন এসেছে রুদ্র এখানে?আরিফা দরজায় আঘাত করছে, “অরূ আপা, দরজা খোলো।”
অরূণী দ্রুত চোখ মুছে দরজা খুললো। আরিফা রুমে ঢুকে অরূণীর দিকে তাকিয়ে বলল, “কোথায় গিয়েছিলে তুমি?আমি কতক্ষণ ধরে খুঁজছি তোমায়।”
– “নিচে গিয়েছিলাম।কেন খুঁজেছিস?”
– “নিচে গিয়েছিলে?আমিও তো নিচে গিয়েছিলাম তোমায় খুঁজতে।কই পেলাম না তো।”
_____________
রুদ্র ছাদ থেকে নেমে কিরণ কে ডাকলো। কিরণ আর রুদ্র নুরুল উদ্দিনের বাসার সামনের চায়ের দোকান’টার উদ্দেশ্যে হাঁটছে।কিরণ ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আরে কী হয়েছে বল? বলেছিস?”
রুদ্র বিরক্ততে মুখ বিকৃত করে।চড়া মেজাজ নিয়ে বলে, “আরে অরূণী তো আমার কথাই শুনতে চাচ্ছে না। যেটুকু বললাম তাও বিশ্বাস করছে না।এই মেয়ে কিছুতেই বিশ্বাস করবে না।”
কিরণ হালকা গলায় বলল, “স্বাভাবিক।”
– “স্বাভাবিক?কি স্বাভাবিক?”
– “বিশ্বাস না করা স্বাভাবিক।অরূণীর জায়গায় অন্য যে কেউ থাকলেও বিশ্বাস করতো না।”
– “কীভাবে বিশ্বাস করাবো বল তো?মেয়েটা কেঁদেকেটে অস্থির। ইস্! ইচ্ছে করছে চোখের পানি মুছিয়ে দিই।”
– “এত ইচ্ছে ভালো না বন্ধু।”
রুদ্র কিছু বলল না।কিরণ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, “এখন কী করবি?ঢাকায় যাবি কবে? উনারা কিন্তু দারুণ আন্তরিক মানুষ।”
– “দেখি।”
রুমের দরজা বন্ধ করে বসে আসে অরূণী।সকালের পর আর রুম থেকে বের হয় নি। দুপুর গড়িয়ে গেছে। রুদ্র বেশ বিরক্ত হয়ে বলল, “অরূণী রুম থেকেই বের হচ্ছে না।এই মেয়েটায় তো আমার মেজাজ খারাপ করছে।”
– “মেজাজ খারাপ করলে হবে না বন্ধু। ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো।”
অরূণীর সাথে দেখা হয় লাঞ্চের সময়। নিচের দিকে তাকিয়ে খাবার মুখে দিচ্ছে অরূণী। আশেপাশে তাকাচ্ছে না। রুদ্র অরূণী’কে স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করে, “অরূণী বাসায় যাবে কবে?”
অরূণী রুদ্রর কথার উত্তর না দিয়ে নুরুল উদ্দিনের উদ্দেশ্যে বলল, “মামা আমি কাল বাসায় যাবো। সূর্য দাদা’কে আসতে বলো।”
চম্পা বেগম বলল, “তুই না বলেছিলি এক মাস থাকবি? হঠাৎ কী হলো?”
– “আমার লেখাপড়ায় ঘাটতি হচ্ছে মামি।”
নুরুল উদ্দিন বলল, “তাও ঠিক।”
রুদ্র ফের প্রশ্ন করে, “অরূণী তাহলে কাল চলে যাচ্ছো?”
অরূণী হ্যাঁ সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ায়। রুদ্রর মেজাজ খারাপ হচ্ছে প্রচুর। খাওয়া শেষে আবার রুমে গিয়ে ঘাপটি মেরে রইলো অরূণী। সোলেমান অরূণীর রুমের সামনে ঘুরঘুর করছে। প্রতিদিন বিকাল বেলায় সোলেমান আর আরিফা’কে নিয়ে ছাদে বসে হাসি-ঠাট্টায় মেতে থাকতো অরূণী। আজ হঠাৎ অরূণী’কে না দেখে অরূণীর রুমের সামনে ঘুরঘুর করছে সোলেমান। আরিফা সোলেমান’কে ডেকে বলল, “অরূ আপার মাথা ব্যথা।আজ আড্ডা হবে না।”
রুদ্র খাটে বসে আছে।ফোনে গান চলছে।কিরণ হতাশ গলায় বলল, “এখানে এসে লাভ হলো কী?অরূণী তো রুম থেকেই বের হচ্ছে না।”
রুদ্র চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “অরূণী কী বলেছে জানিস? আমার না-কি চরিত্রে সমস্যা।অরূণী কীসের জন্য এমন করছে বুঝতে পারছি না।”
– “ওঁর সাথে আবার উল্টাপাল্টা কিছু করিস নাই তো..”
– “আবোলতাবোল বলিস না তো কিরণ।অরূণী না-কি কাল চলে যাবে। তাহলে এসে লাভ হলো কী?”
– “আমরা এসেছি বলেই তো কাল চলে যাবে।আমরা না আসলে তো এক মাস যেতো।”
– “সেটাও একটা কথা।”
রুদ্র একটু থেমে আবার বলল, “অরূণী’কে একটু রুম থেকে বের করার ব্যবস্থা কর তো।”
কিরণ গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল, “আমি কী ব্যবস্থা করবো?”
রুদ্র আর কিরণ সন্ধ্যার দিকে বাসা থেকে বের হয়েছিলো। নয়টার দিকে আবার বাসায় ফিরলো।রাতে অরূণী খাওয়ার জন্যও বের হলো না। বাসা একদম নীরব। মাঝে মধ্যে আরিফার গলা শোনা যাচ্ছে।রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে রুদ্র বিছানায় শুয়ে সিগারেট টানছে। কিরণের উদ্দেশ্যে বলল, “আর একটু রাত হোক!ও’কে কোলে তুলে বের করবো রুম থেকে। ফাজিল মেয়ে।”
কিরণ হেসে সকৌতুকে বলে, “দরজা তো ভিতর থেকে আটকানো। দরজা ভেঙে বের করবি?”
কিরণ বিষয়’টা নিছক’ই মজা ভেবেছে। কিন্তু কিরণের ধারণা মিথ্যে করে দিয়ে রাত বারো টার দিকে রুদ্র বলে, “কিরণ আমি যাচ্ছি।চড় যদি না মেরেছি দেখিস।”
কিরণ হকচকিত হয়ে বলল, “যাচ্ছিস মানে?কোথায় যাচ্ছিস?অরূণী কী এখনো সজাগ না-কি? দোস্ত পাগলামি করিস না।রিস্কি ব্যাপার।”
রুদ্র এতসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শুধু বলল, “আমি জানি অরূণী সজাগ।”
অরূণীর খাটের পাশের জানালা’টা খোলা। রুদ্র সতর্ক পায়ে সেখানে যায়।অরূণীর রুমে লাইট জ্বলছে।আরিফা ঘুমাচ্ছে।অরূণী খাটের উপর আধশোয়া অবস্থায় চোখ মেলে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। রুদ্র কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো অরূণীর দিকে।চাপা গলায় ডাকলো, “সাথি আক্তার চারু।”
রুদ্রর গলায় রসিকতা।অরূণীর ভয়চকিত হয়ে চারদিকে তাকায়। জানালার কাছে রুদ্র’কে দেখে চমকে ওঠে।তড়াক করে খাট ছেড়ে নেমে জানালার কাছে যায়।
– “আপনি?আপনি এখানে? সমস্যা কী আপনার?”
– “রুম থেকে বের হও।আমি এত কষ্ট করে পটুয়াখালী এসেছি তোমার জন্য।আর তুমি রুমে বসে আছো?থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে দিবো ফাজিল।”
রুদ্রর আচরণ অস্বাভাবিক লাগছে অরূণীর কাছে।ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। রুদ্র ফের বলল, “অরূণী বের হতে বলছি তোমায়।নয়ত কিন্তু দরজা ভেঙে ঢুকবো।”
অরূণী আস্তে আস্তে রুম থেকে বের হয়। রুদ্রর কাছে গিয়ে চাপা গলায় বলল, “কী হয়েছে আপনার?এত রাতে আপনি এখানে কেন?”
– “আমার টাকা ফেরত দেও।বসন্ত এসে গেছে।এই বসন্ত কিন্তু গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত শীত বসন্ত।সেই বসন্ত না।”
অরূণী যেন কিছুই বুঝলো না। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকলো। অস্ফুট স্বরে বলল, “মানে?”
– “সামান্য এইটুকু কথার মানে বুঝো না?আমি কী উর্দু ভাষায় বলেছি? লুকিয়ে লুকিয়ে অন্যের বাসর ঘর দেখো সেটা তো ভালোই বুঝো।আর এইটুকু কথা বুঝো না? নিজের কথা নিজে বুঝো না? এসব কথা তো তুমিই বলেছিলে।”
এক শ্বাসে এতগুলো কথা বলে থামলো রুদ্র।অরূণী স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কি বলছে রুদ্র এসব? রুদ্র আবার বলল, “বসন্ত এসে গেছে।দেও আমার টাকা ফেরত দেও।”
এখন তো হেমন্ত কাল।কীসের বসন্ত?
(চলবে)
অনেক সুন্দর হয়েছে। next part taratari please please please please please please please…. opekhay korchi Apu….