তোলপাড় পর্ব ৩১

তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৩১
______________
– “অরূণী তোমার সাথে যখন আমার দেখা হয় তখন আমি সদ্য ছ্যাকা খাওয়া এক যুবক। প্রেমিকা জাতির প্রতি তখন আমার তীব্র বিতৃষ্ণা।কাঠখোট্টা, নিরাবেগ একজন মানুষ হয়ে যাই।আমার বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যেত যদি কিরণ আমার পাশে না থাকতো।তুমি হয়ত এতদিনে বুঝতে পেরেছো কিরণ আর আমার বন্ধুত্ব’টা কত গভীর!কিরণ মানুষ’টা..আমি বলে বুঝাতে পারবো না কিরণ আমার কাছে কী। একজন ভালোবাসার মানুষ আমায় বিশ্রী ভাবে ঠকিয়েছে।‌‌‌‌‌‌যেমন ভাবে ঠকালে কারো জীবনের প্রতি অনীহা জাগে ঠিক তেমন।
আমি প্রথম প্রথম তোমার পাগলামি গুলো নিছকই মজা ভেবেছি। ভেবেছি ওসব তোমার খামখেয়ালি।আর ওই মুহূর্তে তেমন কিছু ভাবার মানসিকতাও আমার ছিলো না। মাঝে মাঝে তোমার প্রতি এত রাগ হতো ইচ্ছে করতো সজোরে থাপ্পড় দিই কয়েক’টা। কিন্তু কোথায়ও যেন বাঁধা পড়তো।সেই রাগ’টা কেন জানি বেশিক্ষণ স্থায়ীত্ব লাভ করতো না।তোমার কর্মকাণ্ড গুলোর কথা ভেবে খানিক বাদে আমিই হেসে ফেলতাম‌‌।আসলে জগতে কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের সাথে খারাপ আচরণ করা যায় না।তুমিও সেরকম একজন। আস্তে আস্তে আমি বুঝতে পারলাম তুমি আমায় সত্যি ভালোবাসো। কিন্তু প্রেম-ভালোবাসার প্রতি তখনো আমার তীব্র বিতৃষ্ণা ছিলো।তাই আর তোমায় নিয়ে ভাবা হতো না। কাকতালীয় ভাবে ট্রেনে দেখা,বিয়েতে দেখা!
তুমি কি কারণে যেন হঠাৎ আমার প্রতি ভীষণ রাগ করে বসলে।ফোন দেও নি,কথা বলো নি।তখন আমি কোনো একটা কিছুর শূন্যতা অনুভব করতে থাকি। এভাবে কত দিন‌ গেল! তোমায় পড়াতে যেতাম প্রতিদিন তোমার বিধ্বস্ত মুখ দেখতাম।তোমার চঞ্চলতা আমার মন ছুঁয়ে গিয়েছিলো যা আমি নিজেও বুঝতে পারি নি।তোমার জ্বর আসা, বাড়াবাড়ি রকমের পাগলামী।আসলে অরূণী তুমি এমন একটা মানুষ যাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না।হুট করে পটুয়াখালী এসে পড়লে,ফোনও বন্ধ তোমার। আমি তখন পুরোপুরি বুঝতে পারলাম আমি আটকে গেছি তোমাতে। আমি তোমার জন্য পটুয়াখালী এসেছি।”
তমসাবৃত আকাশের দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বলল রুদ্র। যেদিকে তাকায় চোখের দৃষ্টি অন্ধকারে মিলে যায়।অরূণী রুদ্রর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্র কথা গুলো শেষ করে অরূণীর দিকে তাকালো।অরূণীর মুখের অভিব্যক্তি দেখতে চায় রুদ্র। কিন্তু অন্ধকারে শুধু বোঝা যাচ্ছে একটা মানব মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্র দ্রুত মোবাইলের টর্চ জ্বালালো। আলো-অন্ধকার মিশানো এই পরিবেশে শুধু বুঝতে পারলো অরূণীর হাত-পা ঈষৎ কাঁপছে।অতি বিস্ময় আর আশ্চর্যে স্তম্ভিত হয়ে আছে। নির্বাক চাহনি। রুদ্র অরূণীর জন্য পটুয়াখালী এসেছে?প্রশ্ন’টা মুহূর্তেই কয়েক হাজার বার উত্থাপিত হয় অরূণীর মস্তিষ্কে। গলা ধরে আসছে,অরূণী কিছু বলতে পারছে না। জগতের সমস্ত বিস্ময় যেন অরূণীর গলায় আস্ত হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে। রুদ্রও কিছু বলছে না। এই সময়’টা কে উপভোগ করছে। অনেকক্ষণ পর অরূণী ক্ষীণ গলায় ধরনী সমস্ত বিস্ময় জড়ো করে অস্ফুট স্বরে বলল, “আপনি আমার জন্য পটুয়াখালী এসেছেন?”
অরূণী যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। সেদিনের ঘটনা’টা অরূণীর মনের অবিশ্বাসের পাল্লা’টা আরো ভারী করে দিচ্ছে। রুদ্র মিথ্যে বলছে? অরূণীর কথার প্রত্যুত্তরে রুদ্র বলল, “হ্যাঁ আমি তোমার জন্য এসেছি।”
কথা’টা অরূণীর কানে বিঁধতেই অরূণী প্রশ্ন করে, “আপনি আমার সাথে মজা করছেন?আপনাকে আমি দেখেছি শপিং মলের সামনে একটা মেয়ের সাথে। প্লীজ আমার সাথে মজা করবেন না।”
লাবণ্যের সাথে দেখেছে? মুহুর্তেই রুদ্রর মনে প্রশ্ন জাগে।লাবণ্যের সাথে যেদিন শেষ দেখা করেছে সেদিন দেখেছে অরূণী? রুদ্র লাবণ্যের ব্যাপার’টা বললো অরূণীর কাছে। লাবণ্য’কে দেখে রেস্টুরেন্টে বসে অরূণীর হাত ধরেছিলো সেটাও বললো।অরূণী তাকিয়ে আছে, অবিশ্বাস্য চাহনি। রুদ্রর কথা বিশ্বাস করতে পারছে না কিছুতেই।অরূণীর এসব ভাবনা চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে রুদ্র ধমক দিয়ে বলল, “ফোন অফ কেন তোমার?বেশি ফাজিল হয়েছো?”
অরূণী কোনো কথা বলতে পারছে না। মূর্তির মত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল শুধু। বুকের ভেতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে অরূণীর।উদ্ভ্রান্তের মত চাহনি।এই মুহূর্তে অরূণীর শব্দ ভাণ্ডারের সব শব্দ যেন ফুরিয়ে গেছে। রুদ্র কয়েক পা এগিয়ে অরূণীর কাছাকাছি দাঁড়ায়।অরূণী কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপা গলায় বলল, “ইঁচড়ে পাকা মেয়ে একটা!এখন কথা বলছো না কেন?রাস্তার ভিতর জড়িয়ে ধরতে লজ্জা লাগে নি, এখন লজ্জা লাগছে?”
রুদ্রর এমন গলার স্বরে অরূণী সর্বাঙ্গে শিউরে উঠে। হাত-পা হিম শীতল হয়ে যাচ্ছে।অরূণীর মনে হচ্ছে এক্ষুণি ও ঢলে পড়ে যাবে।মদোন্মত্ত মানুষের মত অবস্থা।অরূণীর মাথার ভিতর ঝিমঝিম করছে শুধু। রুদ্র অস্থির গলায় ডাকতে লাগল, “অরূণী,অরূণী।কী হলো?”
অরূণী ঠোঁট নেড়ে কোনো রকমে বলল, “আমি পাগল হয়ে যাবো।”
রুদ্র আর অরূণী দাঁড়িয়ে ছিলো অরূণী যে রুমে ঘুমোয় সে রুমের পাশে। হঠাৎ খাবার রুমের বাতি জ্বলে উঠলো।খট করে দরজা খোলার শব্দ আসলো। নিস্তব্ধ থমথমে রাতের নিগূঢ় শব্দহীনতার মাঝে ভেসে আসলো নুরুল উদ্দিনের গলা। নুরুল উদ্দিনের মাঝরাতে ক্ষুধা লাগে।এটা তাঁর আজন্ম অভ্যাস যেন। খাওয়া-দাওয়া করে বাড়ি জুড়ে পায়তারা করবে। অরূণীর এতক্ষণে সম্বিত ফিরে যেন। রুদ্রও ত্রাসিত হয়ে তাকায়। দুইজনের বুকের ভিতর ধুকধুক করছে, একটা বাজে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে সে আশঙ্কায়। রুদ্র চাপা গলায় ব্যস্ত হয়ে বলল, “অরূণী রুমে যাও।”
নুরুল উদ্দিন কী দেখে ফেলবে?এই শঙ্কায় অরূণীর হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। সতর্ক পায়ে রুমের দিকে হাঁটতে লাগলো। খাবার রুম থেকে এই জায়গায় টা স্পষ্ট দেখা যায়। অরূণীর প্রাণ ভয়ে ওষ্ঠাগত।অরূণী ত্রাসিত হয়ে আশেপাশে না তাকিয়ে দ্রুত ঢুকে পড়ে। রুমে ঢুকে জোরে জোরে কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেলল অরূণী। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন।
অরূণী শুয়ে পড়ে।কী বললো ওসব রুদ্র?অরূণী ছটফট করতে লাগলো। রুদ্রর প্রতি যে রাগ অভিমান এতদিন ধরে পুষে রেখেছিল তা অজানায় হারিয়ে গেল। রুদ্রর সামনে ঘোরের ভিতর ছিলো অরূণী।গলা থেকে কোনো কথা বের হচ্ছিলো না। অরূণীর পাগল প্রায় অবস্থা,বেহাল দশা।এমন অনুভূতি আর কখনো হয় নি অরূণীর। কিছু ভাবতে পারছে না। শুধু বুঝতে পারলো জ্বর আসলো অরূণীর গায়ে, ভীষণ জ্বর।
অরূণী রুমে চলে যাওয়ার পর রুদ্র স্বাভাবিক ভাবেই নিজের রুমের দিকে গেল। নুরুল উদ্দিন জিজ্ঞেস করে বলবে ছাদে গিয়েছিলো। কিন্তু নুরুল উদ্দিন আশেপাশে তাকালো না। নুরুল উদ্দিনের প্রতি মনে মনে ক্ষুব্ধ হচ্ছে রুদ্র এত সুন্দর সময়’টা নষ্ট করে দেওয়ার জন্য। অরূণীর কাছে ফোনও নেই যে ফোন দিয়ে কথা বলবে। অরূণীর উপরও মেজাজ টা খারাপ হয়ে যাচ্ছে রুদ্রর।অরূণী সাথে প্রচণ্ড কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। অরূণীর নাস্তানাবুদ মুখ’টা বার বার রুদ্রর চোখে ভেসে ওঠছে। রুদ্রর ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি।কিরণ ঘুমাচ্ছে। রুদ্রর ঘুম হচ্ছে না। অরূণীর গায়ের জ্বর ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগলো সারারাত ঘুম হলো না।
_______________
সকাল বেলা সূর্য এসে হাজির।অরূণী’কে নিতে এসেছে।চম্পা বেগম অরূণী’কে ডেকে তুলল।
– “অরূ ওঠ সূর্য এসেছে।তোকে ডাকে।”
হুট করে সূর্য এসেছে?সারা রাত ঘুম না হওয়ার দরুন অরূণীর মাথা প্রচণ্ড ব্যথা করছে। গায়ের জ্বর’টাও যেন ক্রমশ বাড়ছে।চম্পা বেগমের কথা যেন বুঝতে পারলো না। রুদ্র উপর রাগে কিংবা অভিমানে কালেকে সূর্য কে ফোন দিয়ে বলেছিলো নিতে আসতে। সূর্য সত্যি সত্যি এসে গেল?রাতের কথা মনে পড়তেই অরূণীর বুকের ভিতর আরেক ধাপ মহাপ্রলয় হয়ে গেল। রুদ্র এখনো ঘুমাচ্ছে। সূর্য অরূণী’কে তাড়া দিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি রেডি হ। আমি জরুরি কাজ ফেলে আসছি।”
নুরুল উদ্দিন বলল, “কী এত জরুরি কাজ তোর?আরে কি অদ্ভুত ব্যাপার! কালকে যাবি আজকে থাক।”
সূর্য জোর গলায় না বলল।অরূণী যেন কেঁদেই দিবে।কেন আসতে বলেছিলো সূর্য’কে? রুদ্র এই বাসায় আর অরূণী চলে যাবে?অরূণী সোলেমান’কে আড়ালে ডেকে বলল রুদ্র’কে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে। অরূণী বিষণ্ণ মনে কাপড় চোপড় গোছাতে লাগলো। সোলেমান রুদ্র আর কিরণ কে ডেকে তুলল। সূর্য কিরণ আর রুদ্র’কে দেখে বেশ অবাক হলো। আশ্চর্য হয়ে বলল, “আরে রুদ্র তুমি?”
চম্পা এক গাল হেসে বেগম বলল, “বেড়াতে এসেছে।”
রুদ্র বলল, “ঠিক বেড়াতে আসি নি।এক বন্ধুর বাসায় এসেছিলাম।একটু ঝামেলার কারণে এখানে এসেছি আর কি!”
রুদ্র বার বার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।অরূণী কোথায়?এর ভিতর সূর্য উঁচু গলায় ডাকলো, “অরূণী হয় নি তোর এখনো?”
সাথে সাথে রুদ্রর মনে প্রশ্ন জাগলো অরূণী চলে যাবে?কিরণও একই প্রশ্ন নিয়ে তাকালো রুদ্রর দিকে? চম্পা বেগম বিরক্ত গলায় বলল, “সূর্য কীসের এত কাজ তোর?নাস্তাও খাবি না?”
– “আমি অনেক জরুরি কাজ রেখে এখানে এসেছি। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।”
অরূণী রেডি হয়ে এসে বিষণ্ণ চোখে-মুখে বার বার তাকাচ্ছে রুদ্রর দিকে। কেঁদে ফেলবে যেন এক্ষুণি। রুদ্র সুযোগ বুঝে শুধু বলল, “ এত মন খারাপ করার কী হলো?তুমি চলে যাচ্ছো আমি থেকে আর কী করবো?আমিও আসছি।”
অরূণী প্রত্যুত্তর করার সুযোগ পেলো না। অরূণী চলে যাওয়ার পর কিরণ হতাশ গলায় জিজ্ঞেস করলো, “এটা কী হলো?”
রুদ্রও হতাশ গলায় বলল, “কপাল!এখন আমরাও জরুরি কাজের অজুহাতে চলে যাবো।আর কি করবো?”
রুদ্র আর কিরণও জরুরি কাজের অজুহাতে রওয়ানা দিলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। চম্পা বেগম আর নুরুল উদ্দিন যথারীতি মন খারাপ করছ ফেলল। থাকার জন্য খুব জোরাজুরি করলো। সবকিছু উপেক্ষা করে ফিরে চলল ঢাকায়।
অরূণীর কাছে ফোন না থাকার দরুন আর কথা হলো না।বাসায় পৌঁছানোর পর অরূণীর গায়ে এত জ্বর দেখে অস্থির হয়ে গেল সেলিনা আহমেদ।জ্বর এসেছে সেদিকে যেন খেয়াল নেই অরূণীর। অরূণীর মন জুড়ে তখন অন্য চিন্তা,অন্য অনুভূতি! আনন্দে পুলকিত হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। সবকিছু স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে।অরূণী এখনোও বিশ্বাস করতে পারছে না‌।সূর্য’কে বলল, “দাদা আমার মোবাইল লাগবে।আজকেই কিনে দিতে হবে।”
– “এত জরুরি?”
– “হ্যাঁ জরুরি।”
সূর্য একটু চুপ থেকে হেসে বলল, “তোকে তো একটা কথা বলাই হয় নি। সারপ্রাইজ।”
অরূণী আগ্রহী গলায় বলল, “কী?কী সারপ্রাইজ?”
– “আমাদের এ্যাংগেজমেন্ট।”
অরূণী বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল, “মানে?মানে কী বলছো?”
– “আপাতত এ্যাংগেজমেন্ট।বিয়ে কয়দিন পরে।”
অরূণী খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো। ইস্! চারদিকে এত খুশি কেন? সূর্য কী সত্যি বলছে না-কি মজা করছে?অরূণী সেলিনা আহমেদের কাছে জিজ্ঞেস করলো। সেলিনা আহমেদ বলল, “সত্যি,সত্যি।ছেলে বড় হয়েছে বিয়ে করাতে হবে না?এখানো কাউকে জানাই নি।দুই এক দিন পর জানাবো।”
অরূণী রুমে গিয়ে চোখ বুঁজে রুদ্রর বলা কথা গুলো ভাবছে।যত ভাবছে ততই যেন হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে।সময়’টা থেমে থাকলো না কেন?
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here