দহন পর্ব ৬

#দহন
#পর্ব_৬
#লেখা_মিম

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছে শিমুল। অনিম খাটের উপর বসে আয়েশ করে মুখে চিপস ঢুকাচ্ছে আর আয়নায় শিমুলকে দেখছে।
-” অনিম তোমার কি যাওয়ার কোনো ইচ্ছা আছে?”
-” অবশ্যই আছে।”
-” তাহলে বসে আছো কেন?”
-” তো কি করবো?”
-” রেডি হও।”
-” আমি তো রেডিই আছি। শুধু শার্টটা গায়ে দিবো।”
-” শুধু শার্ট গায়ে দিলেই হবে নাকি?”
-” আরও কিছু কি করতে হবে নাকি?”
-” হ্যাঁ।”
-” কি করবো?”
-” ভালো করে মুখটা ধুয়ে আসো। এরপর চুলে জেল লাগিয়ে ব্যাকব্রাশ করো। ব্যাকব্রাশে তোমাকে খুব ভালো মানায়।”
অনিম চুপচাপ উঠে চলে গেলো। কিছুক্ষন পর ফেসওয়াশ হাতে নিয়ে এসে শিমুলের সামনে দাঁড়ালো।
-” কি ব্যাপার? ফেশওয়াশ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”
-” বউ আমার মুখে অন্নেএএএক ময়লা জমে আছে। ফেসওয়াশটা দিয়ে মুখটা একটু ভালোমতো ঘষে দাওনা।”
শিমুল অনিমের কথা বলার ভঙ্গি দেখে অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ছে। অনিম মুখ ভেংচি কেটে বললো,
-” পাগলের মতো হাসছো কেন?”
-” তোমার ঢং দেখে হাসছি। এত ঢং কোথায় পাও তুমি?”
-“তোমাকে দেখলে ঢং আপনাআপনিই চলে আসে।”
-” হয়েছে। কাছে আসো এখন।”
শিমুল হালকা করে অনিমের মুখটা ঘষে দিচ্ছে। তিন চার মিনিট পর শিমুল হাত সরিয়ে বললো,
-” মুখটাও কি এখন আমাকে ধুয়ে দিতে হবে?”
-” নাহ্ সেটা আমি নিজেই পারবো। তুমি আমার মুখটা ধুইয়ে দিতে গেলে তোমার জামায় পানি লেগে যাবে। শুধু শুধু জামা ভিজিয়ে লাভ নেই।”
অনিম চলে গেলো মুখ ধুতে। কয়েক সেকেন্ড পরই অনিমের মোবাইলে ফোন এলো। শিমুল উকিঁ দিয়ে দেখলো আননোন নম্বর। তাই সে ফোনটা রিসিভ না করে অনিমকে ডেকে আনাটাই শ্রেয় মনে করলো।
-” অনিম তোমার ফোন এসেছে।”
-” রিসিভ করো। আমি মুখ ধুয়ে আসছি।”
-” আননোন নম্বর। তুমিই রিসিভ করো।”
কলটা ইতিমধ্যে কেটে গিয়ে ফের আবার বাজতে শুরু করেছে। অনিম এসে কলটা রিসিভ করলো,
-” হ্যালো…..”
-” ভাই আমি সজীব।”
-” হ্যাঁ বল”
-“ভাই, মুহিব ভাই তো বাইক এক্সিডেন্ট করছে। অবস্থা বেশি ভালো না।”
-” কোথায় করলো এক্সিডেন্ট?”
-” টি এস সি তে আসছিলো আড্ডা দিতে। এখান থেকে যাওয়ার সময় এক্সিডেন্ট করছে। আপনি জলদি আসেন।”
-” হুম।”
অনিম ফোনটা রেখে একবার শিমুলের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে। শিমুলও অনিমের দিকে তাকিয়ে আছে কে এক্সিডেন্ট করেছে এই উত্তরটা জানার আশায়। কিছু মুহূর্ত চলে যাওযার পরও যখন অনিম নিজ থেকে মুখ খুললো না তখন শিমুলই তাকে জিজ্ঞেস করলো,
-” কি ব্যাপার অনিম? কে এক্সিডেন্ট করেছে?”
-” ইয়ে….. শিমুল মুহিব তো এক্সিডেন্ট করেছে।”
-” হায় আল্লাহ…… কিভাবে?”
-” কিভাবে করেছে সেটা ডিটেইলস এখনো জানি না। একটা কথা বলার ছিলো তোমাকে?”
-” হ্যাঁ বলো।”
-” শিমুল আজকের প্ল্যানটা cancel করলে হয়না? মুহিবটা এক্সিডেন্ট করেছে। ওর পাশে আমার থাকাটা অতি জরুরি।”
-” এই সামান্য একটা কথা তুমি এমন আমতা আমতা করে বলছো কেন?”
-” তুমি যদি কষ্ট পাও? কত শখ করেছিলে আমাকে নিয়ে আজকে ডিনার ডেটে যাবে!”
-” তুমি কি আমাকে পাগল ভাবো? তোমার বেস্টফ্রেন্ড এক্সিডেন্ট করে হসপিটালে পড়ে আছে আর তুমি বলছো তোমাকে নিয়ে আমি ডেটে যাবো? ডেটে আমরা পরেও যেতে পারবো। এখন হসপিটাল চলো।”
-” Thanks শিমুল।”
-” থ্যাংকস পরে দিও। এখন চলো। দেরী করে লাভ নেই। আচ্ছা উনার বাসায় কি জানানো হয়েছে?”
-” বলতে পারি না। সেখানে গেলে বলতে পারবো।”
শিমুল অনিম রওয়ানা হলো হসপিটালের দিকে। যাওয়ার পথে অনিম শিমুলকে বললো,
-” তোমাকে নিয়ে কাল পরশু আমি ঘুরতে বের হবো। সারিদিন তোমাকে নিয়ে ঘুরবো। তবুও তুমি মন খারাপ করোনা প্লিজ।”
-” ধুর অনিম, আমি মোটেই মন খারাপ করিনি। বিপদে যদি বন্ধুর পাশে না দাঁড়াও তাহলে তুমি কেমন বন্ধু? আর বিপদ তো মানুষের বলে কয়ে আসে না।”
শিমুলের এই ব্যাপারগুলো অনিমের খুব পছন্দ। মেয়েটা কখনোই অনিমকে ধরে বেঁধে রাখেনা। ওর বন্ধু-বান্ধবের ব্যাপারে পুরো ছাড় দেয় শিমুল তাকে। আধাঘন্টা পর হসপিটাল পৌঁছালো তারা। হসপিটালে মুহিবের কেবিনের সামনে কোরিডোরে প্রচুর ভীড়। এরা সবাই হচ্ছে মুহিবের বাবার লোকজন আর মুহিবের বন্ধুবান্ধব।। অনিম আর শিমুলকে দেখে সবাই সরে দাঁড়িয়ে তাদের যাওয়ার পথ খালি করে দিলো। অনিম ভেতরে যেয়ে মুহিবের হাত চেপে ধরে ওকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখছে। মুহিবের কপালে ব্যান্ডেজ করা। দুই হাত বেশ খানিকটা ছিলে গেছে। ডান পা টা প্লাস্টার করা। পা টা খুব সম্ভবত ভেঙে গিয়েছে। ওকে এই হালে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে অনিমের। শিমুল মুহিবের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-” -” এক্সিডেন্ট করলেন কিভাবে করলেন মুহিব ভাই? কি হাল হয়েছে আপনার!”
-” ঐ…… ফোনে কথা বলতে বলতে বাইক চালাচ্ছিলাম। উল্টা দিক থেকে কখন বাস আসছে টেরই পাইনি। তখনই…….”
-” -” তুই কি জীবনে মানুষ হবি না মুহিব? কত বলেছি সাবধানে বাইক চালাবি। তুই আমার কথা পাত্তাই দেসনা। আজ যদি তোর কিছু হয়ে যেতো! আংকেল আন্টির কি হতো আমার কি হতো তা তুই ভাবতে পারছিস?”
-মুহিব কোনোমতে একটা হাসি দিয়ে বললো,
-” আমি মরে গেলে তুই আমার বাসায় চলে যেতি। আমার বাবা মা এর ছেলে হয়ে থাকতি। আর তোর তো এখন শিমুল আছেই। আমার কথা তখন তোর খুব একটা বেশি মনে পড়তো না।”

-” মুহিব ভাই, আপনার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে আমি বুঝি আপনার সতীন। অনিমকে আপনার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছি। সে আমাকে পেয়ে আপনাকে ভুলে গেছে।”
-” হা হা হা শিমুল যে কি বলো না!”
-” শিমুল তো ঠিকই বলছে। তুই তোর জায়গায়, শিমুল শিমুলের জায়গায়। তোর কিছু হয়ে গেলে তোর জায়গাটা শিমুল পূরন করবে সেটা তুই ভাবলি কি করে?”
-” আরে একটা কথার কথা বললাম আর তোরা দুজন কি না সিরিয়াসলি নিয়ে নিচ্ছিস।”
-” আচ্ছা তোর কি পা টা ভেঙে গেছে?”
-” হুম।”
-” ডক্টর কি বলেছে? কতদিন লাগবে ঠিক হতে?”
-” মাসখানেকের উপর লাগবে।”
-” আন্টিকে জানিয়েছিস?”
-” না আব্বা জানে শুধু। আম্মাকে এখনও কিছু জানায়নি। আম্মাকে পরে আব্বা ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলবে। তোদের না আজ ডেটে যাওয়ার কথা ছিলো?”
-” হ্যাঁ ছিলো। সেটা cancel করে দিয়েছি।”
-” কেন?”
-” তুই অসুস্থ আর তোকে এই অবস্থায় রেখে আমি যাবো ডেট করতে তাই না?”
-” গেলে সমস্যা কি? কত মানুষ আছে হসপিটালে। তুই নাহয় পরে আসতি।”
-” সবাই আর আমি কি এক হলাম?”
-” না আমি তোকে সেটা বুঝাইনি। শিমুল এত শখ করে তোকে সারপ্রাইজ দেয়ার প্ল্যান করলো অথচ তুই কিনা আমার জন্য ওর প্ল্যান নষ্ট করে দিলি।”
-” আমি প্ল্যান cancel করিনি। শিমুল নিজে থেকেই cancel করে দিয়েছে।”
-” সরি শিমুল। আমার জন্য তোমাদের ডেট প্ল্যানটা cancel করতে হলো।”
-” কি যে বলেন না মুহিব ভাই! আজ যদি আমাদের জায়গায় আপনি থাকতেন তাহলে আপনিও একই কাজ করতেন।”
-” তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? এখানে এসে বসো।”
-” না মুহিব ভাই। আমি এখানেই ঠিকাছি।”
-” আরে আসো তো। আমার পাশে বসলো অনিম কিছু মনে করবে না।”
-” শিমুল , মুহিব এতো করে বলছে তুমি এসে ওর পাশে বসো। আমি একটু আংকেলের সাথে কথা বলে আসি।”
অনিমের কথামতো শিমুল মুহিবের পাশে এসে বসলো। শিমুল এদিক ওদিক দেখছে। মুহিবের সাথে কোনো কথা বলছে না। মুহিবই নিরবতা ভেঙে শিমুলকে জিজ্ঞেস করলো,
-” তারপর শিমুল…… তোমার কি খবর বলো? কেমন লাগছে নতুন সংসার?”
-” হুমমমম ভালো।”
-” অনিম অসম্ভব ভালো মানুষ। তোমাকে তিল পরিমান কষ্ট ও দিবেনা। অনেক ভালোবাসে তোমাকে।”
-” হ্যাঁ জানি। এজন্যই তো ওকে বিয়ে করেছি।”
-” একটা ব্যাপার খেয়াল করছি আমি।”
-” কি ব্যাপার?”
-” তোমার চেহারায় অন্যরকম একটা সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। এতদিন তোমার মাঝে এই সৌন্দর্যটা আমি দেখিনি। ঘটনা কি বলো তো?”
-” কি জানি আমি তো এমন কিছু খেয়াল করিনি।”
হঠাৎ অনিম পেছন থেকে এসে বললো,
-” আমার শিমুল বরাবরই সুন্দরী।”
কথাটা বলেই শিমুলের কাঁধ জড়িয়ে ধরলো অনিম।
-” তোদের ভালোবাসা দেখলে আমার গা জ্বলে। শিমুলের মতো এমন একটা বউ পেলে জীবনে আর কি চাই! শোন, জলদি আমার জন্য মেয়ে দেখ। আমি বিয়ে করতে চাই। সুস্থ হয়েই বিয়ে করবো। আর হ্যাঁ মেয়ে অবশ্যই শিমুলের মতো সুন্দরী আর লক্ষ্মী হতে হবে।”
-” বন্ধু, শিমুল একটাই। ওর মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কখনোই না….”
-” তাহলে কি আর করার! শিমুলকেই পটাতে হবে যাতে তোকে ছেড়ে আমাকে বিয়ে করে। হা হা হা।”
অনিমও হেসে উত্তর দিলো,
-” তুই যদি ওকে পটাতে পারিস তাহলে নিয়ে যা আমার কোনো আপত্তি নেই।”
-” তুই খুব ভালো করেই জানিস শিমুলকে আমি কখনোই পটাতে পারবো না। শুধু আমি কেনো, পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ এসে ওর পা ধরে পড়ে থাকলেও কোনো লাভ হবে না।”
-” আমি জানি। এজন্যই তো তোকে বললাম যদি পটাতে পারিস তাহলে নিয়ে যা।”
-” আচ্ছা অনিম, তোর কানের পাশে কিসের আঁচর লেগেছে?”
-” ঐ তো…. শিমুলের নখের আঁচর। গতকাল রাতে………”
কথাটা বলতে যেয়েও থেমে গেলো অনিম। কথার তালে তালে অনিমের মুখ ফস্কে কথাটা বেরিয়ে আসতে নিয়েছিলো গতকাল রাতে প্রবল অনুভুতি মাখা এক মুহূর্তে শিমুলের নখের আঁচর লেগেছে তার কানে। শিমুল অনিমের মুখ ফস্কে বেরিয়ে আসা কথাটায় অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। শিমুলের মুখ দেখে মুহিব বুঝতে পেরেছে অনিম কি বলতে গিয়েও থেমে গেলো। তাই আর সে কোনো কথা বাড়ায়নি। কিছুক্ষন পরপরই এইজন সেইজন এসে মুহিবকে দেখে যাচ্ছে। রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে। মুহিব অনিমকে বললো,
-” অনিম তুই বাসায় চলে যা। অনেক রাত হয়ে গেছে।”
-” আমি থাকি এখানে। শিমুলকে বাসায় পাঠিয়ে দেই কাউকে দিয়ে।”
-” কাকে দিয়ে পাঠাবি?”
-” এখানে তো কত ছোটভাই ই আছে। যেকোনো একজনকে দিয়ে ওকে ওর বাবার বাসায় পাঠিয়ে দেই। আজরাতটা নাহয় ও ওর বাবার বাসাতেই থাকবে।”
-” কোনো দরকার নেই অনিম। নতুন বিয়ে করেছিস তুই। এই মূহূর্তে আলাদা থাকার কোনো মানেই হয়না। এমনিতেই আমার জন্য তোদের ডেট cancel হয়েছে। আমি চাইনা এখন আমার জন্য তোরা রাতেও আলাদা থাক। তুইছ শিমুলকে নিয়ে এক্ষুনি বাসায় যা।”
-” মুহিব ভাই, আমার কোনো সমস্যা হবে না। অনিম থাকুক আপনার সাথে।”
-” শিমুল কথা বাড়িও না তো। যেটা বলছি সেটা করো।”
-” তোকে এভাবে……..”
-” অনিম আমি কিন্তু বিরক্ত হচ্ছি। তুই বাসায় যা তো এখন। কালকে আবার আসিস। ”
শেষমেষ মুহিবের জোরাজোরিতে অনিম শিমুলকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো।
পরদিন সকালে অনিমের ফোনে কল এলো। সে খবর পেলো মুহিবের পুরো শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। কোনোভাবেই জ্বর নামানো যাচ্ছে না। এক মুহূর্ত দেরী না করে শিমুলকে ঘুম থেকে উঠিয়ে হসপিটালে রওয়ানা হলো অনিম। শিমুল বের হবার সময় অনিমকে বলেছে সে যেনো হসপিটাল পৌঁছেই তাকে ফোন দিয়ে মুহিবের অবস্থা জানায়। । হসপিটালে যেয়ে মুহিবের অবস্থা দেখে অনিমের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কি হয়েছে মুহিবের? এমন হচ্ছে কেন ওর? পুরো শরীর খিঁচুনী দিয়ে জ্বর এসেছে তার। মুহিবের কপালে হাত রেখে অনিম কানের কাছে আস্তে করে বললো,
-” ভাই তোর কি খুব কষ্ট হচ্ছে? ”
মুহিব অনিমকে কিছু বলতে চাচ্ছে। কিন্তু কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পারছে না অনিম।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here