দুপাতার পদ্ম পর্ব -০৬-১০

#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_০৬
#Writer_Fatema_Khan
নিস্তব্ধ রাত, কিছুক্ষণ পর পর রাত জাগা পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ সাথে কিছু শ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ। আজ আকাশের চাঁদটাও গোল আর বড় দেখাচ্ছে। চাঁদের আলোয় পুরো ছাদ আলোকিত হয়ে আছে৷ মেহের আয়াতের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আয়াত তুই কি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিস এভাবে চুপ করে চাঁদ দেখার জন্য? যদি এমনটাই হয় তাহলে আমি নিজের ঘরে যাচ্ছি।”
মাথা নিচু করে হালকা হেসে আয়াত মেহেরের দিকে তাকালো। আজ আয়াতের চাহনীকেও মেহেরের অপরিচিত লাগছে। মেহের ভাবলো,
“আয়াত যদি এসব সবাইকে না বলতো তাহলে হয়তো আয়াত আমার কাছে ঠিক আগের মতোই লাগত। কিন্তু এখন আয়াত আর আমার সম্পর্কটা ঠিক আগের মতো নেই। আমাদের মাঝে অনেক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। যার কারণ শুধুমাত্র আয়াত।”
“কি হলো কি ভাবছো? আমি হয়তোবা জানি তুমি কি ভাবছো৷ দেখো তোমার ব্যাপারটা এমন নয় যে আমি আজকেই প্রথম ভেবেছি৷ আমি দেশের বাইরে যাওয়ার আগে থেকেই তোমার প্রতি আলাদা অনুভূতি কাজ করে আমার মাঝে। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি ভালোবাসার অনুভূতি সম্পর্কে তখন থেকে তোমাকেই ভেবেছি৷ জানি না এটা আমার উচিত হয়েছে কিনা, তবে আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকেই ভাবতে পারব না। তোমার কাছে হয়তো এসব শুনে অনেক অবাক লাগছে, কিন্তু আমিতো আমার অনুভূতিকে অস্বীকার করতে পারি না।”
“আয়াত দেখ তুই যা ভাবছিস তা কখনোই সম্ভব না।”
“কিন্তু কেনো?”
“আমি একজন তালাক প্রাপ্তা মেয়ে, যার এই সমাজে কোথায় অবস্থান এটা সবাই জানে। সাথে আমার একটা মেয়েও আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা তোর আর আমার বয়স। আর আমাদের সম্পর্কটা তো দেখবি আমরা ভাই বোন। কোনোভাবেই আমার আর তোর বিয়ে সম্ভব না।”
“অনেকেই নিজের থেকে বড় মেয়েদের বিয়ে করে তো সেখানে তো তাদের সমস্যা হচ্ছে না। আর রইলো ভাই বোনের কথা। আমি আর তুমি কি আপন ভাই বোন, না তাই তো? তাহলে এখানে ভাই বোনের সম্পর্ক কোথা থেকে আসছে। আমি সবসময় তোমার মাঝে আমার প্রেয়সীকে দেখেছি। আমার প্রেয়সী।”
“আয়াত আমি ঘরে যাচ্ছি তোর এসব শোনার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই।”
মেহের যেতে নিলেই আয়াত মেহেরের হাত ধরে নেয়।
“এগুলো কি ধরনের অসভ্যতা আয়াত। হাত ছাড় আমার। তুই আমার রাগ উঠাস না আয়াত হাত ছাড়।”
“মেহের আমি অসভ্যতা কোথায় করলাম ওইটা আগে বলো? আচ্ছা তুমি সবসময় আমার অনেক ক্লোজ ছিলে তাহলে তুমি কি কখনো আমার চোখে তোমার জন্য ভালোবাসার অনুভূতি দেখতে পাও নি নাকি আবিরের ভালোবাসায় এতটাই মগ্ন ছিলে যে, যে সত্যিকারের তোমাকে মন দিয়ে ভালোবাসে তার টাই চোখে পরে নি?”
“হাত ছাড় আয়াত, এখন কিন্তু খুব রাগ লাগছে।”
“তুমি আমাকে একটুও বুঝো না মেহের। তোমার চোখের কোথাও আমি আমার জন্য ভালোবাসা তো দূর একটু মায়াও দেখছি না। যা আগে কিছুটা হলেও দেখতে পেতাম। আর আজ সেই মায়াটাও নেই। সেই মায়াটা হয়তোবা আমি নিজেই কেড়ে নিয়েছি।”
“তোর কথা শেষ হলে আমি নিজের ঘরে যাই?”
“একটা অনুরোধ করবো যদি রাখো?”
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মেহের আয়াতের চোখের দিকে তাকালো। কিন্তু বেশিক্ষণ সেই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে নি মেহের। কারণ চোখের কোণে চোখের পানি স্পষ্ট চিকচিক করছে। চোখ সরিয়ে মেহের বললো,
“কি অনুরোধ?”
হালকা হেসে আয়াত মেহেরের হাত ছেড়ে তার দিকে কিছুটা এগিয়ে বললো,
“রাতটা আমায় দিবে আয়াত? শুধু আজকের রাতটা। আর কিন্তু বেশিক্ষণ নেই সকাল হতে, তোমার সাথে সূর্যোদয় দেখতে চাই। ভয় নেই তোমার হাতটাও ছুয়ে দেখবনা। সবাই ঘুম থেকে উঠার আগেই চলে যেও।”
“মাহি একা আছে ঘরে, আমাকে যেতে হবে।”
বলেই আয়াত আর পেছনে ফিরে তাকালো না সোজা সিড়ি বেয়ে নিচে চলে গেলো। নিজের ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে হাটু মুড়ে কাদতে লাগলো।
“কেনো আয়াত এমন করলি আমার সাথে, আমি এখন কারো সামনে যেতেও পারছি না। নিজের মাঝেই কেমন ছোঁয়া হয়ে আছি আমি। নিজের বাড়িতেও চোরের মতো থাকতে হচ্ছে আমাকে। কখনো ক্ষমা করবো না তোকে, কখনো না।”
তারপর ফ্লোরের উপর শুয়েই কাদতে লাগলো। তারপর ধীরে ধীরে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে এলো।আর ছাদের রেলিং ধরে আয়াত দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। এক রক্তিম আভা পূর্ব আকাশে দেখা যাচ্ছে, যেনো এই আভা সবকিছু জ্বালিয়ে দিতে সক্ষম। আয়াতের চোখ দুটোও আকাশের ন্যায় লাল হয়ে আছে। টলমল করছে চোখের উপরে ভেসে বেড়ানো লোনা পানি। চোখ বন্ধ করলেই বুঝি এরা টুপ করে বেয়ে পরবে। আয়াত তাদের বাধা দিলো না চোখ বন্ধ করেই তাদের মুক্তি দিলো। ঝাপসা দুটি চোখ যেনো আবার তাদের প্রাণ ফিরে পেলো। চারপাশে পাখিরা ডাকা শুরু করলো, ভোরের আলো ফোটে উঠেছে পূর্ব দিগন্তে। আয়াত চোখ খুলেই একটা বড় শ্বাস নিলো আর মেহেরকে কোনো ভাবেই কষ্ট দিবে না সেটা ভেবে নিলো। ছাদে ছোট একটা রুম আছে। এখানে অবশ্য কেউ থাকে না। আগে এখানেই আয়াত থাকত কিন্তু এবার সে নিজের রুমেই থাকে। কারণ নিচে থাকলে মেহেরের দেখা বারবার পাওয়া যায়। ছাদের ঘরটার দেয়াল ঘেঁষে বসে পরলো আয়াত। মিনিট কয়েকের ভেতর আয়াতের চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এলো। চাইলেও সে চোখ আর আয়াত খুলে রাখতে পারলো না।
দরজা ধাক্কানোর শব্দে ঘুম ভাঙলো মেহেরের। বাইরে কাসফির ডাক শুনে মেহের বললো,
“খুলছি।”
নিজেকে ফ্লোরে আবিষ্কার করে বুঝলো রাতে এসে এখানেই ঘুমিয়ে পরেছে। উঠে আয়নায় নিজেকে দেখে সে অবাক। চোখ মুখ ফুলে নাক লাল হয়ে রয়েছে। ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে নিলো মেহের। এখন কিছুটা স্বাভাবিক লাগছে। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখতে হবে সবার সামনে। না হলে সবাই আন্দাজ করে ফেলবে মেহের সারারাত কান্না করেছে। বাইরে এসে মোটামুটি সবাইকেই কাল রাতের চেয়ে স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। তাই মেহের তাদের দিকে এগিয়ে গেলো। খাবার টেবিলে সবাই থাকলেও আয়াত নেই৷ সবার আড়ালে লুকিয়ে বারবার মেহের আয়াতের ঘরের দিকে তাকাচ্ছে। মেহেরের মা আয়াতকে টেবিলে না দেখে কাসফিকে বললো,
“কাসফি তোকে না বললাম মেহের আয়াত সবাইকে ডেকে আনতে। তাহলে আয়াতকে ডাকিস নি?”
“মা আয়াত ভাইয়া তো নিজের ঘরেই নেই।”
“এই ছেলেটা আবার সকাল সকাল কোথায় চলে গেলো?”
আয়াতের বাবা বললেন,
“তোমরা নিজেদের খাবার খেয়ে নাও। আয়াত এসে পরবে একটু পরেই। আর মেহের মা তোর কি হয়েছে, কেমন যেনো আজ লাগছে তোকে?”
“আসলে মাহি রাতে ঘুমায় নি তো তাই আমাকেও জেগে থাকতে হয়েছে। সকালের দিকে একটু ঘুমিয়েছিলাম, তাই এমন দেখাচ্ছে।”
“ওহ! আচ্ছা। তাহলে আজ এক কাজ কর আজ আর তোর অফিস যেতে হবে না, তুই বরং বাসায় রেস্ট নে।”
মেহেরেরও আজ অফিসে যাওয়ার ইচ্ছে নেই তাই মেহেরও না যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেলো।”
সবার খাওয়া শেষে যে যার ঘরে চলে যায় অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে। আর কাসফি গেলো স্কুলের জন্য তৈরি হতে। আয়াত আর মেহেরের মা গেলো রান্নাঘরে। এই সুযোগে মেহের সোজা ছাদে চলে গেলো। ছাদে গিয়ে আয়াতকে কোথাও না দেখে মেহের কিছুটা চিন্তিত হয়ে গেলো। ফিরে আসতেই দেখলো দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। মেহের এগিয়ে গিয়ে আয়াতের সামনে বসলো। রোদের আলোয় কুচকানো চোখ আর কপাল স্বাভাবিক আকার নিলো। কপালের উপর ঘামে ভিজে থাকা চুলগুলো মেহের সরিয়ে দিতেই আয়াত চোখ খুলেই মেহেরের হাতটা ধরে ফেলে। আকস্মিক এমনটা হওয়াতে মেহের কিছুটা ঘাবড়ে যায়। মেহেরের হাত ছেড়ে আয়াত নিচে নেমে এলো।
(আমি খুবই দুঃখিত প্রতিদিন গল্প না দিতে পারার জন্য। আর গল্প কেমন হচ্ছে তা অবশ্যই মন্তব্য করে জানাবেন।)
চলবে,,,,,#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_০৭
#Writer_Fatema_Khan
আয়াতের এভাবে চলে যাওয়া মেহেরের কাছে অবাকের শীর্ষে। যে কিনা কয়েক ঘন্টা আগেও তার কাছে কিছুটা সময় চাইলো আর এখন কিনা কথাও বললো না। মেহেরও নিচে চলে এলো। আয়াত সোজা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। মেহের আয়াতের ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কিছুক্ষণ আয়াতের ঘরের দরজার দিকে চেয়ে রইলো। তারপর নিচে চলে গেলো। সেখানে মা আর চাচীকে কাজে সাহায্য করতে লাগলো। কাজের ফাকে ফাকে মেহের বারবার উপরের দিকে তাকাচ্ছে আয়াত আসছে কিনা। মেহেরের নিজের মাঝেই খারাপ লাগছে তার জন্য আয়াত আজ নিচে খেতেও নামে নি।
“মেহের।”
মায়ের ডাকে হুশ ফেরে মেহেরের।
“হুম মা কিছু বলবে?”
“কি এত ভাবছিস?”
“কই কিছু নাতো মা।”
“আচ্ছা আমেনা যা না একটু দেখে আয় ছেলেটা এখনো খেতে আসে নি কত বেলা হয়ে এলো।”
“ভাবি কাসফি তো বললো আয়াত ঘরে নেই সে ডাকতে গিয়েছিলো।”
“এখন একটু দেখ গিয়ে।”
আয়াতের মা উপরে চলে গেলেন আয়াতের কাছে। আর মেহের নিজের হাতের কাজ শেষ করে নিজের ঘরে চলে গেলো। কিছু সময় পর মেহের অফিসের জন্য বেড়িয়ে যায়। তারপরেই আয়াতের মা মুখ গোমড়া করে নিচে নেমে আসে। মেহেরের মা আমেনার মুখ ফ্যাকাসে দেখে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে, আয়াত কিছু বলেছে?”
“ভাবি আয়াত বলেছে ছাদের উপরের ঘরটা গুছিয়ে দিতে, আজ থেকে আয়াত উপরেই থাকবে।”
“একি কেনো! ও নিজেই তো এবার নিচে থাকতে চেয়েছে।”
“আমি এই প্রশ্ন করাতে আয়াত বলে যাকে দেখার জন্য নিচে থাকতে চেয়েছিলাম সে আমাকে দেখতে চায় না। তাই আমিও আর এখানে থাকব না। আর তোমরা আমাকে আর কোনো কাজে বাধা দিও না প্লিজ।”
মেহেরের মায়ের চোখে পানি এসে গেলো বাড়ির ছেলেটার এই অবস্থার কথা শুনে।
“ভাবি তোমার দুইটা হাত ধরি মেহেরকে তুমি একটু বুঝাও, আমার ছেলেটা ওকে খুব ভালোবাসে। সেই ছোটবেলা থেকেই।”
“আমেনা এর মানে তুই সব আগে থেকেই জানতি কিন্তু কাউকে বলিস নি কখনো।”
“আয়াত আমাকে সবকিছুই বলেছিলো। কিন্তু কি করে বলব ভাবি, তখন আয়াত মানা করেছিলো যাতে কাউকে কিছু না বলি। সময় হলে সে নিজেই জানাবে। কিন্তু এর মাঝেই মেহের জানালো সে আবিরকে পছন্দ করে তাকে বিয়ে করতে চায়৷ আমি আয়াতকে জানালাম সবকিছু আর বললাম সবাইকে জানাতে। কিন্তু মেহের আরেকজনকে ভালোবেসে জেনে আয়াত আমাকে চুপ করিয়ে দিয়েছিলো। তাই আমি আর কাউকে কিছুই বলি নি। ভাবি আমার ছেলেটার উপর একটু দয়া করো মেহের রাজি হলেই ভাইয়া আর আয়াতের বাবা রাজি হয়ে যাবে।”
“তুই আমাকে এসব আগে বলিস নি কেনো, তাহলে হয়তো আমাদের ছেলে মেয়ে দুইটাই সুখে থাকত।”
“আমি যাই ভাবি উপরের ঘরটা গুছিয়ে দিয়ে আসি।”
“দাড়া আমার কাজএ শেষ। আমিও সাথে আসছি।”

ছাদের ঘরটা গুছাতে দুপুর গড়িয়ে গেলো। অনেক বছর কেউ এখানে থাকে না। তাই গুছানোও হয়নি৷ ধূলোময়লা জমে একাকার। আয়াতের মা আর মেহেরের মা আয়াতের প্রয়োজনীয় সব জিনিস গুছিয়ে দিয়ে নিচে চলে এসেছে। আয়াত দুপুরে খেয়ে একেবারে ছাদে চলে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলো। তারপর আয়াত বিকেলের দিকে বেড়িয়ে পরলো উদ্দেশ্য কাসফির স্কুল। কাসফির স্কুলের সামনে মিনিট পাচেক অপেক্ষা করতেই কাসফি বের হয়ে এলো তার বান্ধুবিদের সাথে কথা বলতে বলতে৷ আয়াত যে গেইটে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে তার কোনো নজর নেই৷ আয়াত কাসফির এমন চঞ্চলতা দেখে হেসে ফেললো। তারপর কাসফির একটা বেণি ধরে টান দিলো। চুলে টান খেতেই কাসফি বলে উঠলো,
“কার এতবড় সাহস কাসফির চুলে হাত দেয়?”
পেছনে ফিরে আয়াতকে দেখে অবাক।
“ভাইয়া তুমি! এই তোরা যা আমার ভাইয়া আসছে আমি ভাইয়ার সাথেই যাব।”
কাসফির বান্ধুবিরা চলে গেলো। কাসফি আয়াতের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসছে৷
“কিরে পিচ্চি এভাবে তাকিয়ে হাসছিস কেনো?”
“ভাইয়া এখন না আমরা বাসায় যাব না।”
“বাসায় না গেলে কই যাব!”
“আমি আর তুমি ঘুরব আর অনেক কিছু খাব। জানো তো এই মেহের আপু না বাইরের কিছুই খেতে দেয় না। খালি ধমকের উপর রাখে কিছু বললে।”
আয়াত শব্দ করে হেসে কাসফির মাথায় একটা বারি দিয়ে বলে,
“আচ্ছা চল আজ আমি তোকে অনেক কিছু খাওয়াবো।”
কাসফি খুশি হয়ে আয়াতের সাথে চলতে লাগলো। কিছুদূর যাওয়ার পর আয়াত একটা রিকশা ডাকলো। রিকশা গিয়ে থামলো একটা রেস্টুরেন্টের সামনে। কাসফি রিকশা থেকে নেমে বললো,
“আমি কি একবারও বলছি যে আমি রেস্টুরেন্টে খাব, আমি অন্যকিছু খাব।”
“আচ্ছা কি খাবি বল?”
“আমি ঝালমুড়ি, ফুসকা, চটপটি, বাদাম, হাওয়াই মিঠাই আর সবশেষে বাসায় যেতে যেতে আইসক্রিম খাব।”
“এইজন্যই মেহের তোকে বকে বুঝলি।”
“ভাইয়া তুমিও।”
“আচ্ছা চল।”
আয়াত পুরো বিকাল কাসফি যা যা চাইলো সব আবদার পূরণ করলো। তারপর দুইজনে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে রাতের খাবার খেয়ে নিলো।
“ভাইয়া আমি আর পারব না। এবার বাসায় চলো। কিন্তু রিকশায় যাওয়ার পথে একটা আইসক্রিম।”
আয়াত হেসে দিলো। তারপর দুইজনের জন্য দুইটা আইসক্রিম কিনে রিকশায় উঠে বসলো৷ বাসায় ঢুকে কাসফি খুশিতে নিজের মাকে সব বলতে লাগলো আজ কি কি করেছে। মা তাকে থামিয়ে আগে ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হতে বললো। তাই কাসফি নিজের ঘরে চলে গেলো। আয়াতও তার মাকে বললো,
“মা আমি আর কাসফি খেয়ে এসেছি, তাই আমি আর রাতে খাব না। আমি ঘুমাতে গেলাম।”
সোফায় বসে থাকা মেহেরের দিকে একবার তাকিয়ে আয়াত উপরে চলে গেলো৷ মেহের আয়াতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।
কাল শুক্রবার কাসফির স্কুল নেই, তাই সে খুব খুশি কারণ আয়াত আসার পর সে একদিনও ছুটি পায় নি। রোজ স্কুলে যেতে হয়েছে। কিন্তু কাল সে অনেক মজা করবে ভাইয়ার সাথে। কাসফি রাত ৯টার দিকে আয়াতের ঘরের সামনে যায়। দরজায় কয়েকবার টোকা দিতেই ভেতর থেকে আয়াত দরজা খুলে দেয়। কাসফিকে দেখে হেসে বললো,
“পিচ্চি তুই না পড়ে এখানে কি করিস?”
মুখ ভেঙচি দিয়ে রুমের ভেতর ঢুকে পরলো কাসফি।
“কেনো ভাইয়া তোমার রুমে আসা বারণ নাকি? বললে আর আসব না।”
“ওমা পিচ্চির দেখি রাগও আছে।”
খাটের উপর পা তুলে বসে কাসফি বললো,
“আর তুমি কি জানো না আমার পড়তে ভালো লাগে না। আর কাল তো শুক্রবার স্কুলও বন্ধ। কি মজা তাই না ভাইয়া!”
“হুম অনেক মজা।”
আয়াতের রুমটা ভালো করে দেখে কাসফি বললো,
“ভাইয়া তোমার রুমটা এমন দেখাচ্ছে কেনো? কোনো কিছুই নেই খালি তুমি আছো।”
“আমিও চলে যাব। আমার ল্যাপটপ টা নিতে এসেছিলাম শুধু। এখন নেওয়া হয়ে গেছে তাই চলে যাচ্ছি।”
“ভাইয়া তুমি আমাদের সবাইকে ছেড়ে প্লিজ যেও না। কত বছর পর আসলে দেশে এখন আবার চলে যাবে?”
“আরে পাগলি আমি কোথাও চলে যাচ্ছি না, আমি আগে সবসময় যেখানে থাকতাম সেখানেই যাচ্ছি। আর তখন তো তুই আরও পিচ্চি ছিলি তাই হয়তো ভুলে গেছিস। আমি ছাদে যে ঘরটা আছে ওইটাতেই থাকতাম আগে। তাই এখন আবার ওখানে চলে যাচ্ছি।”
“ওহ তাই বলো আমি আরও ভাবলাম আপু তোমাকে বিয়ে করবে না বলে রাগ করে আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছ।”
কথাটা বলেই জিভে কামড় কাটলো কাসফি। আয়াতেরও হাসি মিলিয়ে গেলো কথাটা শুনে। তবে কাসফির দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা স্বাভাবিক করার জন্য আয়াত হেসে দিলো আর বললো,
“তোর বোনের চেয়ে কত সুন্দরী আমার চারপাশে ঘুরঘুর করতো বিদেশে তুই জানিস?”
“না তো! অনেক মেয়েরা ঘুরতো বুঝি?”
“হুম, পরে একসময় সব বলব। এখন তুই ঘুমাতে যা।”
কাসফিও আয়াতের কথামতো নিজের ঘরে চলে গেলো আর আয়াত নিজের ল্যাপটপ নিয়ে ছাদে চলে গেলো।
চলবে,,,,,#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_০৮
#Writer_Fatema_Khan

মেহেরের বুকের মাঝে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে মাহি। চারদিকে ফজরের আজান দিচ্ছে৷ আজানের শব্দে মেহেরের ঘুম ভেঙে গেলো। মাহিকে ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে মেহের উঠে গেলো। নামাজের জন্য অজু করে জায়নামাজে দাড়ালো। নামাজ শেষ করে নিচে নেমে নিজের জন্য এক কাপ চা করে আবার ঘরে ফিরে এলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে৷ এখনো সূর্য উঠেনি পূর্ব দিগন্তে। চারদিকে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই গরমেও ঠান্ডা ফুরফুরে হাওয়া বইছে। মেহেরের মনটা এমনিতেই ভালো হয়ে গেলো সকালের এমন পরিবেশে৷ কাল সারাদিন মেহেরের মন ভালো ছিলো না আয়াতের জন্য। আর আজ এই সকাল মূহুর্তেই মেহেরের মন ভালো করে দিলো। আজ বোধহয় বৃষ্টি নামবে। পরিবেশ তারই জানান দিচ্ছে। আজ শুক্রবার তাই মেহেরও অফিস যাবে না। চায়ের কাপটা রেখে বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করেই বৃষ্টি নামা শুরু হলো। মেহের নিজের হাত দুটি গ্রিলের বাইরে দিয়ে বৃষ্টির প্রথম ফোটা অনুভব করছে। মেহের ঘরের দরজা লক করে নি এমনি চাপিয়ে রেখেছিলো। হঠাৎ করেই কেউ দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করলো। আচমকা দরজা খোলার জন্য মেহের ভয় পেয়ে যায় আর পেছনে তাকায়।
“কাল এত গরম পরছিলো আর আজ সকালে এত ঠান্ডা লাগছে কেনো?”
কাথাটা টেনে গায়ে জড়াতে জড়াতে আয়াত বললো। আয়াতের এখনো ঘুম ভাঙে নি। আর আয়াত এত সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেও না। দেশে আসার পর ৯টার আগে এখনো আয়াত উঠে নি। কাথাটা মুরো দিয়ে আবার ঘুমের ঘোরে চলে গেলো আয়াত। প্রায় মিনিট পনেরো পর আয়াত কোনো মেয়ের হাসির শব্দে চোখ মেললো৷ তাড়াতাড়ি মোবাইল হাতে নিয়ে আয়াত দেখলো মাত্র ৬টা বাজে।
“এত ভোর বেলা ছাদে কোনো মেয়ে আসবে কোত্থেকে! আর কাসফি বা মেহেরও তো এত ভোরে ছাদে আসবে না, আর আসলেও এভাবে হাসবে কেনো?”
মনে মনে এসব ভেবেই আয়াত বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। যদিও তার বিছানা ছাড়ার কোনো ইচ্ছা ছিলো না কিন্তু বাইরে কি হচ্ছে জানার জন্য তাকে উঠতেই হলো। বিছানার পাশে থাকা জানালার পর্দা সরিয়ে দেখে জানালার গ্লাসে পানি। আয়াত বুঝতে পারলো বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।
“ওহহো, বাইরে তাহলে বৃষ্টি হচ্ছে তাই আমার এত ঠান্ডা লাগছিলো। কিন্তু এই বৃষ্টির মাঝে হাসছিলো কে?”
ছাদে ভালো করে তাকিয়ে দেখে কাসফি বৃষ্টিতে ভিজছে আর হাসছে। আর কি যেনো বলছে। আয়াত ভালো করে চারদিক তাকিয়ে দেখলো আর কেউ নেই তাহলে কাসফি কথা কার সাথে বলছে? কাসফির বাচ্চামো দেখে আয়াত নিজেও হেসে দিলো। জানালার পর্দা লাগিয়ে আবার শুতে যাবে তখনি কাসফি ছুটে কোথাও যেনো গেলো, তা দেখার জন্য আয়াত আবার তাকালো৷ আয়াত দেখলো কাসফি মেহেরকে টেনে ছাদে নিয়ে আসছে আর মেহের মানা করছিলো।
“কি ভেবেছো এত ভোরে তোমাকে কি ডেকে এনেছি ছাদের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য? জি না আমার সাথে মজা করার জন্য।”
“পাগল হয়ে গেছিস কাসফি তোর ক্লাস আছে কাল ঠান্ডা লেগে যাবে তো?”
“কিচ্ছু হবে না আপু আসো অনেক মজা লাগছে।”
এতক্ষণে মেহেরও পুরো ভিজে গেছে। মেহেরও আর কিছু না বলে বৃষ্টির প্রতিটি ফোটার অনুভূতি নিচ্ছে। চোখ বন্ধ করেই হাত দুটি প্রসারিত করে আছে। তার মন যেনো হঠাৎ আন্দোলিত হয়ে উঠেছে। না চাইতেও দুটি চোখ মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। ভোর বেলার এই বৃষ্টি তার বুকে ঝড় তুলে আনবে কে জানত! পরনের মেরুন রঙের শাড়ি যেনো বৃষ্টিতে ভিজে পুরো লেপ্টে আছে শরীরে। মেদহীন শরীরের সাথে কাপড় লেপ্টে থাকায় মেহেরের শরীরের প্রতিটি ভাজ দৃশ্যমান। খোলা লম্বা লতানো চুলগুলো তার সৌন্দর্য ঢাকতে ব্যস্ত। বারবার চোখ ফিরিয়েও আয়াত আবার মেহেরের দিকে তাকাচ্ছে। বেহায়া মন আরেকটু দেখার জন্য ছটফট করছে। তবুও নিজের মনকে বাধা দিয়ে জানালার পর্দা টেনে শুয়ে পরলো আয়াত৷ রীতিমতো ঘামছে সে৷ মেহেরকে আগে কখনো এতটা মোহনীয় রূপে দেখে নি সে৷ চেষ্টা করেও দু চোখের পাতা আর বন্ধ করতে পারে নি আয়াত৷ বারবার মেহেরের মুখটা ভেসে উঠছিলো তার সামনে। তাই আর ঘুমানোর চেষ্টা না করে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে জানালা খুলে দেখে বৃষ্টি থেমে গেছে৷ তাই দরজা খুলে ছাদে এসে দাড়ালো। কাসফি আর মেহের নেই হয়তো তারা নিচে চলে গেছে। ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ আগের কথা ভাবছিলো। আর ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ফুটে উঠে আয়াতের৷
“ভালোবাসি কেন বুঝো না?”

পাঁচ দশ মিনিট আগে নিচে এসেছে মেহের আর কাসফি। দুইজনে নিজেদের ঘরে গিয়ে কাপড় বদলে নেয়। মেহের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের লম্বা চুলগুলো মুছছে। কলা পাতা রঙের শাড়ি পরে আছে। মেহের হাতের গামছাটা বারান্দায় ছড়িয়ে দিয়ে কাসফির ঘরে গেলো। গিয়ে দেখে দরজা চাপানো। হাত দিয়ে হালকা ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। মেহের ভেতরে ঢুকে দেখে কাসফি কাথা মুরি দিয়ে শুয়ে আছে৷ মেহের কাছে গিয়ে কাথা সরিয়ে দেখে কাসফি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে৷ মেহেরকে দেখে কাসফি উঠে বসলো। মেহের দেখলো কাসফির চুলগুলো এখনো ভেজা। তাই ড্র‍য়ার থেকে গামছা বের করে কাসফির পেছনে গিয়ে বসলো৷ আর কাসফির চুল মুছে দিতে লাগলো।
“এভাবে ভেজা চুলে শুয়ে থাকলে তো ঠান্ডা লেগে যাবে তাই না। আর আমি বলেছিলাম বৃষ্টিতে না ভিজতে তুই তো শুনলি না।”
“আপু তুমিই বলো অনেক মজা হয়েছে না? এমন সুযোগ কি সবসময় পাওয়া যায় বলো? মা, বাবা, চাচা, চাচী সবাই ঘুম তাই আমাদের বকা দেওয়ার মতোও কেউ নেই। আমার কাছে তো আজকের সকালটা খুব আনন্দের ছিলো।”
“সত্যি বলতে আমারও ভালো লেগেছে।”
“দেখলে তোমারও ভালো লেগেছে।?
” আচ্ছা কাসফি একটা কথা জিজ্ঞেস করি তোকে?”
“বলনা আপু কি বলবে?”
“তুই তো আগে সবসময় আমার ঘরে ঘুমাতি এখন ঘুমাস না কেন?”
“আপু তুমিও না আমি তো তোমার সাথেই থাকি। তবে বলতো এখন একটু পড়তে হয় রাত অবদি তাই আসি না তোমার কাছে। আর যেদিন ভয় করবে সেদিন তো আমি তোমার কাছেই ঘুমাব। আচ্ছা আপু তোমার কি চুল মোছা হয় নি?”
“এইতো হয়ে গেছে।”
“আপু একটা কথা বললে রাগ করবে নাতো?”
“রাগ করবো কেনো বলনা।”
“আপু আয়াত ভাইয়া সত্যি তোমাকে খুব ভালোবাসে। তুমি রাজি থাকলেই কিন্তু বাসার সবাই রাজি হয়ে যাবে। আর দেখেছো ভাইয়ার মনটাও কত খারাপ কাল থেকে। কাল আমি ভাইয়ার সাথে ছিলাম। ভাইয়াকে অন্যদিনের মতো খুশি দেখায় নি। তবে আমাকে অনেক কিছু খাইয়েছে জানো তো।”
“ওহ ভালো।”
“আর দেখো ভাইয়া কাল থেকে কিভাবে সবার আড়ালে আড়ালে থাকে।”
“কাসফি তুই ঘুমা আমি নিচে গিয়ে কিছু কাজ করে আসি। আবার মাহি উঠে গেলে কাজে হাত দিতে পারব না।”
কাসফিকে ঘুমাতে বলে মেহের নিচে চলে এলো। বৃষ্টি হওয়াতে ঠান্ডা আবহাওয়া পেয়ে এখনো কেউ ঘুম থেকে উঠেনি হয়তো। তাই মেহের ভাবলো আজ সকালে সবার নাস্তার জন্য খিচুড়ি, ইলিশ ভাজা, গোল করে কেটে বেগুন ভাজা আর ঝাল করে গরুর মাংস করবে৷ যেই ভাবনা সেই কাজ শুরু করে দিলো। খিচুড়ি হয়ে গেছে, বেগুন ভাজাও হয়ে গেছে চুলায় মাংস রান্না আর ইলিশ ভাজা হচ্ছে। সেই মুহূর্তে মেহেরের মা আর চাচী দুইজনে রান্নাঘরে ঢুকলো। এসেই রান্নার এত সুন্দর সুবাসে তারা বললো,
“আরে মেহের তুই তো সকালের রান্না করে ফেলেছিস প্রায়। কখন উঠলি? আর এদিকে আমরা দুইজন ঘুমাচ্ছিলাম।”
“সমস্যা নেই চাচী আমার মন চাইছিলো সকালের খাবার আমিই তৈরি করি তাই রান্না করতে চলে এলাম। আর দেখো আজ বৃষ্টি পরছে বলে খিচুড়ি, ইলিশ ভাজা, বেগুন ভাজা আর গরুর মাংস রান্না করছি।”
“এতো খুব ভালো রান্না হচ্ছে। বাসার সবাই খুশি হয়ে যাবে। বিশেষ করে আয়াত। ওর তো এসব খুব পছন্দের খাবার। কিন্তু তুই প্রতিদিন এতো খাটা খাটুনি করিস কই আজ একটু ঘুমাবি আজ ছুটির দিন তাও তুই কাজ করছিস।”
“আমার তো ভালোই লাগে চাচী।”
“আচ্ছা এক কাজ করি আয়াত এদিকে তুই এগুলো সামলা আমি আর চাচী বরং তোর বাবা আর চাচাকে ডেকে নিয়ে আসি। আর চল ছোট দেখে আসি আয়াত আর কাসফি উঠলো কিনা?”
“আচ্ছা ভাবি চলো।”
মেহেরের মা আর চাচী চলে যাওয়ার পর মেহের আবার রান্নায় মনোযোগ দিলো৷ আর ভাবলো,
“সত্যি তো আয়াতকে আমি কাল থেকে ভালো করে দেখিই নি৷ আজ আয়াতের পছন্দের সব খাবার দেখে হয়তো মনটা একটু খুশি হয়ে যাবে।”

প্রায় ৩০মিনিট পর সবাই খাবার টেবিলে এসে জড়ো হচ্ছে৷ মেহেরের সাথে মেহেরের চাচীও সবকিছু টেবিলে আনতে সাহায্য করছে। আয়াত সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে মেহেরের দিকে তাকিয়ে ছিলো। কোমড়ে শাড়ির আচল গুজে ঘামযুক্ত মুখশ্রী টা বেশ আবেদনময়ী লাগছিলো আয়াতের কাছে। যেনো কোনো ঘরের গিন্নি সবটা নিজ হাতে সামলাচ্ছে।

চলবে,,,,,#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_০৯
#Writer_Fatema_Khan

অন্ধকার দূর আকাশের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ মেহেরের। চোখ দুটো ছলছল করছে। এক অজানা ভয় আকড়ে ধরছে তাকে। আবার বুঝি তার আর মাহির জীবনে আসতে চলছে কোনো নতুন ঝড়।
“তুমি না চাইলে কেউ তোমাকে জোর করবে না মেহের।”
কারো গলার শব্দে চমকে পেছনে তাকালো মেহের। সামনে থাকা ব্যক্তির কাছে তার নেত্রদ্বয়ের পানি চোখ এড়ালো না। খুব দ্রুতই কাছে চলে আসলো মেহেরের। তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিলো মেহের।
“আড়ালে চোখ মুছে ফেললেই বুঝি সবকিছু সবার থেকে লুকানো যায়?”
“কেন এসেছেন এখানে আয়াত চৌধুরী? এবার আপনি খুশি তো, শেষ পর্যন্ত আপনার সাথে আমার বিয়েটা তাহলে হচ্ছে।”
“আমি কিন্তু তোমাকে জোর করছি না, আর না এখনো জোর করছি। তুমি চাইলেই বিয়েটা ভেঙে দিতে পার, এতে আমার একটুও আপত্তি থাকবে না। কারণ আমি তোমাকে ভালোবেসে পেতে চেয়েছি তোমার অমতে নয়।”
“আপনি খুব ভালো করেই জানেন আমি এখন হাজার চাইলেও মানা করতে পারব না। তাই মজা নিচ্ছেন বুঝি?”
আয়াত আয়েকটু কাছাকাছি এসে দাঁড়ায় মেহেরের। মেহের দূরে যেতে চেয়েও নড়লো না। আয়াত মেহেরের দুই গালে হাত রেখে বললো,
“একবার বিশ্বাস করেই দেখো না আমাকে, তোমার ওই দুই চোখের পাতায় কখনো পানি আসতে দেব না। ওই দুপাতার পদ্ম হয়েই থাকব আমি এটা আমার বিশ্বাস।”
আর কিছু না বলে আর মেহেরের জবাবের অপেক্ষা না করে বারান্দা থেকে প্রস্থান করলো আয়াত। কারণ সে জানে মেহেরের কাছে আশানুরূপ কোনো উত্তরই পাবে না সে। মেহের আয়াতের যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকে আর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
“কখনোই আপনি আমার চোখের দুপাতার পদ্ম হয়ে উঠতে পারবেন না। কারণ আপনার প্রতি আগে যেই মায়াটা ছিল আজ থেকে সেটার সমাপ্তি ঘটেছে। আর ভালোবাসা সে তো অনেক দূর।”
সকালের কথা মনে পরতেই আবার কান্নায় ভিজে গেলো চোখ দুটি। সকালে সবাইকে টেবিলে আসতে দেখে খুশিতে সবাইকে নিজ হাতে সার্ভ করে দিল মেহের। সবাই এই বৃষ্টি মুখর দিনে খিচুড়ি, ইলিশ ভাজা, বেগুন ভাজা আর গরুর মাংস পেয়ে তো খুব খুশি। আয়াতের বাবা মেহেরকে বললো,
“মেহের মা তুই আমার কাছে এসে বস আর সার্ভ করতে হবে না। যার যা লাগবে নিজে নিয়ে নিবে। তুই আমার কাছে বসে খা।”
মেহের হাসি মুখে চাচার পাশের চেয়ারটাতে বসে পরলো। আয়াতের নজর মেহেরের পানেই৷ কাসফি তো একমনে খাচ্ছে আর সবার কথা শুনে হাসছে। সে আয়াতের দিকে তাকিয়ে দেখে আয়াত না খেয়ে প্লেটে হাত ঘুরাচ্ছে আর মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। কাসফি বোকার মতো বলে বসলো,
“আয়াত ভাইয়া এ সব কিছুই তো তোমার পছন্দের, তাহলে না খেয়ে মেহের আপুর দিকে তাকিয়ে আছো কেন? তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও না হলে ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
আয়াত তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে খাওয়াই মনোযোগী হলো। সবার সামনে লজ্জায় ফেলো দিলো। মেহেরের মা পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বলে উঠলো,
“আয়াত ভালো হয় নি খেতে নাকি শরীর খারাপ লাগছে?”
“না না চাচী আমি ঠিক আছি। আর খাবার খুব ভালো হয়েছে।”
বলেই আরেকবার মেহেরের দিকে তাকালো। মেহেরের বাবা সবাইকে বললেন,
“রাতের খাবার শেষ করে সবাই যেন বসার ঘরে উপস্থিত থাকে। সবার সাথে আমাদের কিছু জরুরি কথা আছে৷”
“কি বলবে চাচা, আমি আবার বের হব একটু রাতে আসতে দেরি হতে পারে।”
“খাবার শেষ করো সবাইকে এক সাথেই বলবো।”
আয়াত আর কথা বাড়ালো না নিজের খাবার চট জলদি শেষ করে উঠে উপরে চলে গেলো। বাকি সবার খাবারও প্রায় শেষ। সবাই খাবার টেবিল ছেড়ে যার যার ঘরে চলে যায়। মেহের, মেহেরের মা আর চাচী মিলে টেবিল গুছিয়ে নেয়। মেহেরের মা আর চাচী রান্নার কাজ শুরু করেন৷ বৃষ্টি থেমে গেছে সেই অনেক আগেই। আয়াতের মা মেহেরকে বললো,
“মেহের যা তো ছাদে ভেজা কাপড় গুলো একটু ছড়িয়ে দিয়ে আয়। কাল রাতে ধুয়ে দিয়েছিলাম, রাতে তো শুকায় নি। এখন বৃষ্টি কমে রোদ উঠেছে এখন একটু দিয়ে আয়।”
“আচ্ছা চাচী।”
“আর শোন। কাসফিকে নিয়ে যাইস অনেকগুলো কাপড় তো।”
“ঠিক আছে।”
মেহের চাচীর ঘর থেকে সব কাপড় একটা বালতিতে করে ছাদের উদ্দেশ্যে যেতে নিলে কাসফিকে ডাকার জন্য কাসফির ঘরে উঁকি দেয়। দেখে কাসফি ঘুমাচ্ছে। তাই আর কাসফিকে না ডেকে নিজেই ছাদে চলে গেলো। ছাদের দরজা খোলা দেখে আবার অবাক হলো মেহের। কারণ ছাদের দরজা কখনো খোলা থাকে না, সবসময় তালা লাগানো থাকে। মেহের ছাদে ঢুকে এক এক করে কাপড় দড়িতে ছড়িয়ে দিতে লাগলো। হঠাৎ মেহেরের নজরে এলো ছাদের ঘরটায় আলো জ্বলছে। মেহের উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো৷ দরজায় হালকা ধাক্কা দিতেই মেহের বুঝতে পারলো দরজা ভেতর থেকে খোলা আছে। মেহের ছাদের ঘরটাতে ঢুকে উঁকি দিতে লাগলো। কিন্তু ভেতরে ঢুকে কাউকেই খুঁজে পায় না মেহের।
“এই ঘরে আবার কে এলো? এখানে তো আয়াত থাকত আগে। আর ঘরটাও পরিষ্কার করে গুছিয়ে দেওয়া হয়েছে! কিন্তু আয়াতের ঘরে থাকে কে?”
“আয়াতের ঘরে এখনো আয়াতই থাকে৷”
পেছনে ফিরে দেখে আয়াত সবে মাত্র গোসল সেড়ে বের হয়েছে৷ চুল থেকে টপটপ পানি পরছে৷ পরনে খালি একটা শর্ট প্যান্ট আর হাতে টাওয়েল চুল মুছছে। মেহের কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরে আয়াতকে এভাবে দেখে৷ আয়াত মেহেরের দিকে এগিয়ে আসে অনেকটাই৷ মেহের পিছিয়ে যায় কিছুটা।
“তা তুমি হঠাৎ এখানে? কোনো কাজ ছিল নাকি?”
“না মানে আমি তো ছাদে কাপড় দিতে এসেছিলাম, দেখলাম এই ঘরে আলো জ্বলছে তাই দেখতে এলাম এখানে কে আছে?”
“ওহ, এটাই স্বাভাবিক। আমি যে দুই দিন ধরে ছাদে থাকি তার খবর তুমি মাত্র পেলে তাহলে।”
“তা তুই তো এবার নিজের ঘরেই থাকবি বললি, তাহলে এখানে আসার কারণ কি?”
আয়াত আরও কিছুটা এগিয়ে বলে,
“যদি বলি যাকে দেখার জন্য নিচে সেই আমাকে দেখতে চায় না তাই ছাদের ঘরে চলে আসা।”
মেহের এদিক ওদিক তাকাতে থাকে, কি বলবে বুঝতে পারে না। আয়াত তার অবস্থা বুঝে বলে,
“আচ্ছা মেহের এসেই যখন গেছো একটা কাজ করে দিবা আমার।”
“কি কাজ?”
“আমি আসলে একটু বের হবো, লেইট হচ্ছে। তাই তুমি যদি আমার শার্টটা আয়রন করে দিতে তাহলে তাড়াতাড়ি হত।”
“এই সকাল সকাল কই যাবি তুই তাও শুক্রবারে?”
“আজ শুক্রবার বলেই তাড়াতাড়ি বাইরে যাচ্ছি।”
“মানে!”
“মানে অনেক সহজ। আজ বাসায় সবাই থাকবে তাই আমি চাই না আমার জন্য কেউ বিব্রতবোধ করুক। তাই ভাবলাম বাইরে ঘুরে বেড়ানোই ঠিক হবে তাই না।”
মেহের আর কথা বাড়ালো না। খাটের উপর থাকা শার্ট নিয়ে আয়রন করতে লাগলো৷ আয়াত আয়নার সামনে গিয়ে নিজের চুল ভালো করে মুছে নিলো। শার্ট আয়রন করা হয়ে গেলে মেহের বলে,
“আয়াত।”
“হুম বলো।”
“শার্ট আয়রন হয়ে গেছে, আমি নিচে যাই।”
“সকালের খাবার খুব মজার ছিলো, থ্যাঙ্কিউ।”
“সকালে বৃষ্টি ছিলো তাই ভাবলাম এসব রান্না করি এই আর কি। তোর ভালো লেগেছে শুনে ভালো লাগলো।”
“সকালে তোমাকেও অনেক ভালো লাগছিলো একদম মায়াবতী। ভেজা চুল, স্নিগ্ধ তোমার চাউনি, নিষ্পাপ তোমার মুখ। সব মিলিয়ে মায়াবতী।”
“আমি আসছি আয়াত।”
বলেই আর এক মিনিটও দাড়ালো না মেহের। মেহেরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে হালকা হাসলো আয়াত।
“সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে তুমি কখনো আমার হবে না। আমার ভালোবাসা কখনোই তোমার বোধগম্য হবে না। যদি তুমি বুঝতে তোমার প্রতিটা চাউনি আমার বুকে কি ঝড় তোলে তাহলে হয়ত কিছুটা আন্দাজ করতে পারতে৷ আমার ভালোবাসায় কোনো খাত নেই, আছে শুধু তোমার জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা। যা কখনো ফুরাবার নয়।”
আয়াত আয়রন করা শার্টটা গায়ে জড়িয়ে তৈরি হয়ে বের হয়ে গেলো। নিচে এসে দেখে মেহের মাহিকে খাওয়ানোতে ব্যস্ত৷ আয়াত এগিয়ে মাহিকে কোলে তুলে নিলো আর বললো,
“আমার সোনা টা বলো তো কি নিয়ে আসবে মামা তোমার জন্য?”
মাহি কিছুই না বলে খিলখিল হাসি দিয়ে উঠলো। মাহির হাসি দেখে আয়াতও হাসলো। তারপর বললো,
“মামা আসার পথে এত্তগুলা চকলেট নিয়ে আসব ঠিক আছে।”
মাহি মাথা নেড়ে হাত তালি দিতে থাকে। যার মানে সে খুব খুশি।
“কিন্তু এই পেত্নীটাকে একটাও দেওয়া চলবে না।”
কাসফির মাথায় একটা চাটি মেরে।
“আহ্! ভাইয়া লাগছে।”
“পিচ্চির আবার লাগে নাকি? আচ্ছা মাহি মামা তাহলে যাই ঠিক আছে।”
“ঠিক আছে।”
মাহিকে আবার সোফায় রেখে আয়াত যেতে নিলে আয়াতের বাবা ডেকে বলেন,
“এত সকাল কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
“কিছু কাজ আছে আমার তাই যাচ্ছি।”
“রাতে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসো, সবার সাথে কিছু কথা আছে আমাদের।”
“ঠিক আছে। যাচ্ছি তাহলে।”
মেহেরের দিকে একপলক তাকালো আয়াত। তারপর বের হয়ে গেলো বাড়ি থেকে।

চলবে,,,,,,#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_১০
#Writer_Fatema_Khan

রাত দশটা বাজে। এখন অবদি আয়াতের বাসায় আসার কোনো নাম নেই। বাসার সবাই কল করেই যাচ্ছে কিন্তু কল রিসিভ করছে না আয়াত৷ আয়াতের মা দুশ্চিন্তায় মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। তাকেই বুঝানোর চেষ্টায় আছে তারই জা। মেহেরের চোখ বরাবরই দরজার দিকে। কখন আসবে আয়াত। কাসফি আর মাহি উপরের ঘরে। আর তাদের এসব নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথাও নেই৷ রাত প্রায় সাড়ে দশের ঘরে তখন কলিংবেলের শব্দে আয়াতের মা ছুটে দরজা খুলে দিলো। দরজার বাইরে আয়াতকে দেখে যেন তার কলিজায় প্রাণ ফিরে এলো৷
“এত দেরি করে কেউ বাসায় ফিরে বাবা, আর সারাদিন কোথায় ছিলি? কত চিন্তা হচ্ছিলো জানিস তুই।”
“মা আমি কোথায় যাব বলো, ঘুরে ফিরে তো তোমার কাছেই আসতে হবে তাই না।”
“ফোনটা তো রিসিভ করবি বল।”
“মোবাইল হয়তো সাইলেন্ট আছে তাই শুনতে পাই নি।”
আয়াতের বাবা মা ছেলের কথা শুনে বলে উঠলেন,
“এতটা কেয়ারলেস কবে থেকে হলে, ভাবতেই অবাক লাগছে দেশের বাইরে তোমাকে পড়তে পাঠালে তুমি এতটা দায়িত্বহীন হয়ে উঠবে। আমরা ভুল করে ফেললাম মনে হয় তোমাকে নিজেদের থেকে দূরে পাঠিয়ে৷”
আয়াত জবাব দিল না। চুপচাপ বাবার সামনে এসে দাড়ালো। মেহেরের বাবা বললেন,
“আহ্, ছেলেটা মাত্র বাসায় আসলো এতটা বকছিস কেন? সারাদিন বাসায় ছিল না খাওয়া হয় নি মনে হয়। ফরিদা আয়াতকে খাবার দাও তো ছেলেটার মুখটাও শুকিয়ে গেছে।”
“এখনি দিচ্ছি।”
বলেই মেহেরের মা আর আয়াতের মা রান্নাঘরে গেলেন। আয়াত তার চাচা আর বাবাকে উদ্দেশ্যে বললো,
“তোমরা কিছু বলবে বলেছিলে, বলো আমার ঘুম পাচ্ছে আমি নিজের ঘরে যাব।”
“খেয়ে নাও তুমি তারপর বলছি।”
আয়াত কথা না বারিয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণের ভেতর সব আয়াতের মা আয়াতকে খাবার বেড়ে দিলো। আর আয়াতও খেয়ে নিলো৷ তারপর সোফায় গিয়ে বসলো তার বাবা আর চাচার কথা শোনার জন্য।
“এবার বলো কি বলবে?”
আয়াতের বাবা কিছুটা রেগে বলেন,
“তোমার মনে হয় খুব তাড়া আছে!”
“বললাম তো ঘুমাতে যাব তাই।”
“দেশে এসেছো কিছুদিন হয়ে গেছে। তাই আমি আর তোমার চাচা ভাবছি তুমি আমাদের অফিসে জয়েন করো আর সেটা কাল থেকেই। আমি, তোমার চাচা আর মেহের তো দেখছিই সাথে তুমিও জয়েন করলে আমাদের ব্যবসা আরও উন্নতি করবে।”
“এটা বলার জন্যই কি সকালে বললে সবার সাথে কথা আছে!”
“হুম তোমাকে তো পাওয়া যায় না অন্যান্য সময়। আজ শুক্রবার ভাবলাম বাসায় থাকবে, কিন্তু তোমার দর্শন যে আমাদের কারও হবে না কে জানতো!”
“বাবা আর চাচা আমি তোমাদের সিদ্ধান্তকে সম্মান করি। কিন্তু আমার দ্বারা তোমাদের অফিসে জয়েন করা সম্ভব না। আর আমি বসে বসে তোমাদের অন্ন ধ্বংস করব এটাও ভেবো না, আমি শীঘ্রই একটা ভার্সিটিতে লেকচারের জব নিচ্ছি। তাই তোমাদের আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।”
“মানে কি তুমি আমাদের নিজেদের ব্যবসা থাকতে বাইরে কেনো জব করতে যাবে?”
“আমাদের ব্যবসা দেখার জন্য তুমি আছো চাচা আছে আর মেহের তো আছেই। আমার মনে হয় না আমার সেখানে কোনো প্রয়োজন আছে। আর আমি নিজেও অফিসে কাজ করতে চাই না। আমার মনে হয় আমাকে এই নিয়ে কেউ জোর করবে না। উঠছি।”
আয়াত সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো। আয়াতের যাওয়ার দিকে সবাই তাকিয়ে আছে। মেহের উঠে নিজের ঘরে চলে গেলো। আয়াতের মা মেহেরের বাবার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন,
“ভাইয়া আমি একটা অনুরোধ কর‍তে চাই আপনার কাছে। দয়া করে আমার অনুরোধ আপনি ফেলবেন না।”
“কি হয়েছে আমেনা, তুমি নিসংকোচে বলো কি বলতে চাও। বড় ভাই হিসেবে আমার দায়িত্ব সবার অসুবিধা গুলো দেখা।”
“ভাইয়া আপনার মেহেরকে আমার আয়াতের জন্য চাই। আমার আয়াত যে মেহেরকে খুব ভালোবাসে সেই স্কুল জীবন থেকেই। মেহেরের প্রতি আয়াতের দূর্বলতা আছে আমি সেটা আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু মেহেরের বিয়ের সময় বলতে পারি নি। কি করে স্বার্থপর হতাম নিজের ছেলের জন্য যেখানে মেহের নিজে আবিরকে পছন্দ করতো?”
আয়াতের বাবা ধমকের সুরে বললেন,
“আমেনা তুমি ঘরে যাও। বেশি বলে ফেলছো। যেটা সম্ভব না তা নিয়ে কথা না বলাই উচিত।”
“আমি মোটেও বেশি বলছি না। একবার তো আয়াতের কথা পাশে রেখে মেহেরের খুশিটা দেখেছি এবার যেখানে জানি এই সম্পর্কে মেহেরও ভালো থাকবে আর আমার ছেলেটাও তাহলে আমি চুপ থাকব কেনো? আমার ছেলেটা সারাদিন বাসায় ফিরে না, নিজের ঘর ছেড়ে ছাদে চলে গেছে যাতে মেহেরের সামনে তাকে আসতে না হয়। মেহেরের তাকে নিয়ে যাতে কোনো অস্বস্তি না হয় আয়াত যদি এতটা ভাবে তাহলে আমরা কি আয়াতের জন্য এটুকু ভাবতে পারি না। আমার মনে হয় ভাইয়া আপনি আর আয়াতের বাবা বললে মেহের কখনোই মানা করবে না। আর মেহের কি সারাজীবন এভাবেই থাকবে, নাতো আমরা মেহেরকে আজ না হয় কাল বিয়ে দিবই। তাহলে সেই ছেলেটা আয়াত কেনো নয়?”
মেহেরের মা বলে উঠলো,
“আমারও মনে হয় আমেনা ঠিক বলছে। মেহেরের বয়সই কত, আমরা মেহেরের বিয়ের কথা আজ না হয় কাল ভাববোই। তাহলে আয়াত যেহেতু মেহেরকে পছন্দ করে তাহলে আয়াতের সাথেই মেহেরের বিয়ে দিতে আপত্তি কোথায়? আমার আয়াত আর মেহেরের বিয়ে নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। বাকিটা আপনারা দুই ভাই ভেবে দেখুন। ছেলে মেয়ে দুইটাই আমাদের। তাহলে তাদের সুখের কথাও আমাদের ভাবা উচিত। আর দেশে আসার পর থেকেই ছেলেটা কেমন ছন্নছাড়ার মতো ঘরের বাইরে বাইরে থাকে। আয়াত আমাদের ছেলে তার দিকটাও আমাদের দেখা উচিত৷ মেহেরের জীবনে এক দূূর্ঘটনা ঘটে গেছে বলে আমরা বসে থাকতে পারি না৷ আমার মনে হয় আমাদের আয়াত ও মেহেরের বিয়ে নিয়ে ভাবা দরকার।”
উপরে সিড়ির কাছে দাঁড়িয়ে সবকিছু শুনছিলো মেহের। তার যেনো পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে৷ চোখের পানি যেনো বাধ মানতে নারাজ৷ শ্রাবণের ধারার মতো চোখের পানি ঝরে পরলো দু চোখ গড়িয়ে৷ মেহের তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে চলে গেলো। মেহের ঘরে গিয়ে দেখে কাসফি বসে বসে গেমস খেলছে আয়াতের ফোনে আর আয়াত মেহেরের খাটে শুয়ে মাহিকে বুকের উপর নিয়ে খেলছে৷ মাহির হাতে দুইটা চকলেট আর বিছানায় কিছু চকলেট। কাসফিও চকলেট হাতে গেমস খেলায় ব্যস্ত। মেহের যে ঘরে এসেছে সেদিকে তাদের তিনজনের খেয়াল নেই। মেহের নিজের চোখের পানি লুকাতে তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে আয়াত আর কাসফি দুইজনেই ওইদিকে তাকালো। আয়াত বললো,
“কিরে তোর বোন কি ঘরে এসে গেছে?”
“হ্যাঁ মনে হয়।”
“আচ্ছা তাহলে তোরা থাক আমি আমার ঘরে যাই, এখানে থাকলে তোর বোনের আবার ভালো লাগবে না।”
আয়াত মাহিকে বুকের উপর থেকে উঠিয়ে বিছানায় বসিয়ে গালে একটা আদর দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। আয়াত ছাদের দিকে যেতে নিলে মেহেরের বাবা আয়াতকে পেছন হতে ডেকে বলে,
“আয়াত একটু নিচে আসো তো তোমাদের সাথে কিছু কথা আছে।”
“চাচা প্লিজ আমাকে তোমাদের অফিসে জয়েন হওয়ার জন্য জোর করো না আমি চাই না ওইখানে কাজ করতে।”
“অন্য কথা আছে তোমার আর মেহেরের সাথে।”
বলেই মেহেরের বাবা সিড়ি বেয়ে নিচে বসার ঘরে চলে গেলেন৷ আয়াতও আর কিছু না ভেবে তার পেছন পেছন নিচে চলে এলো। মিনিট দশেক পর মেহেরের মা মেহেরকে নিয়ে নিচে এলেন৷ আয়াত সোফায় বসে মোবাইল চালাচ্ছিলো। মেহেরের দিকে একবার তাকিয়ে মোবাইল পকেটে রেখে মেহেরের বাবার উদ্দেশ্যে বললো,
“মেহের এসে গেছে চাচা এবার বলো কি বলবে?”
“আয়াত আর মেহের আমরা বড়রা সবাই অনেক ভেবেছি তোমাদের নিয়ে আমরা চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে। আয়াতের এতে কোনো আপত্তি থাকবে না জানি। কারণটা আয়াত নিজেই আমাদের কাছে বলেছে কিন্তু মেহের আমরা চাই তুই এই বিয়েতে অমত করিস না।”
মেহের আগেই সব শুনেছে তাই তার মুখের কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না কিন্তু আয়াত যেনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে সবার কথায়। সবাই তাদের বিয়েতে সম্মতি দিয়েছে। আয়াত মেহেরের দিকে তাকিয়ে দেখে মেহের চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া নেই তার মুখে যেনো এটাই হওয়ার ছিল৷ মেহের বললো,
“তোমরা যেটা ভালো বুঝবে সেটাই করো, আমার তোমাদের উপর পুরোপুরি ভরসা আছে।”
আর কারো কথার অপেক্ষা না করে মেহের দ্রুত উপরে চলে গেলো৷ আয়াতের যেনো কিছুই মাথায় আসছে না। সবার কি হলো সবাই হঠাৎ করে কিভাবে তাদের বিয়ের কথা ভাবছে। কালও সবাই এই কথা নিয়ে অমত ছিলো। আয়াতও কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে গেলো।

সব কথা আবার মনে পরতেই মেহেরের চোখ ভেঙে অঝোর ধারায় পানি বেয়ে পরলো। কি থেকে কি হয়ে গেলো তার জীবনে। সেতো এমনটা ভাবে নি। সেতো বাকি জীবনটা মাহির সাথে একা থাকতে চেয়েছিলো৷ তাহলে কেনো সবাই আবার তাকে বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ করে দিতে চাইছে?

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here