দুরে নয় কাছেই আছি পর্ব -০৪

#দূরে নয় কাছেই আছি!
#লেখিকাঃতামান্না
#পর্বঃচতুর্থ

প‍্যাকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে তাতে আগুন ধরিয়ে আবার টান দিল। না এত এত ভাবনা আর জড়তাকে সে প্রশ্রয় দিবে না। বউ তো তারই, বিয়ে হয়েছে তার! আগে কি ছিল তা ভেবে কি করবে সে?
বউকে নিজের একার করেই রাখবে, জোর করে নয় তারমতই সে তাকে আগলে রাখবে। সিগারেটের ফিল্টার টা বিনে ফেলে দিয়ে সে রুমের ভিতর ঢুকে পরল। যত ভাববে ততই খারাপ চিন্তা আর ভয় মাথার ভিতর জেঁকে বসবে আরাফ রুমের ভিতর ঢুকে বিছানায় বসে পরল। ফোনটা হাতে নিয়ে শায়োরীর ছবিগুলো দেখতে লাগল। ফোনের স্ক্রিনে শায়োরীর মায়া মাখানো মুখটা হাত দিয়ে ছুয়ে দিতে দিতে বললো-

–” এমন একটা মুহুর্তে তুমি আমায় ফেলে দিলে যেখান থেকে যে আমি বের হতে পারছিনা। তবে মনে রাখো এত সহজে তোমার হাত আমি ছাড়ছি না।” আরাফ স্ক্রিনে একটা চুমু দিয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে শুয়ে পরল।”
__________________________

সকাল বেলা ব্রেকফাস্ট করতে বসেছে আরাফ, আরাফের মা শায়োরীকে বললেন শায়োরী যেন একসাথে বসে যেতে। শায়োরী বসতে না চাইলেও শাশুড়ি মায়ের জোরাজুরিতে বসতে হলো। আরাফ আড়চোখে তাকালো শায়োরীর দিকে। ডাগর ডাগর চোখ জোড়া যেন লাল বর্ণ ধারণ করেছে। স্নিগ্ধ মুখ জুড়ে বিষণ্ণতায় ছেয়েগেছে। আরাফ চোখ নামিয়ে খেতে লাগল, তেমন বেশি একটা খেতে ও তার ভালো লাগল না। অল্প একটু খেয়ে আর খেতে পারল না, টেবিল থেকে উঠে পরল। শায়োরী আরাফের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। তার প্রতি আরাফের এতটাই অবিশ্বাস আর ঘৃণা যে, আরাফ এখন তার জন‍্য খাবারে ও অনিয়ম করবে? তাকে দেখে খাবার ও খেলো না।
শায়োরী ও কিছু খেতে পারল না অল্প কিছু খেয়ে সে ও উঠে পরল।
___________________________________

অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরেছে আরাফ। বাসায় ফিরে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসে পরল। আরাফের বাবা বাসায় ছিলেন তখন। আরাফকে ডেকে বলে উঠলেন –

–” কেমন লাগছে অফিসে? কাজ ভালোভাবে চলছে তো?”
আরাফ নড়েচড়ে স্বাভাবিক ভাবে বসল, বাবার প্রশ্নের উত্তরে বলল-

–” ভালোই চলছে, তবে এখন একটু চাপ বেশি মনে হচ্ছে। ”

–” এই তো এখনই যা একটু কাজের চাপ বেশি পরবে, কয়েক মাস পরে দেখবে কাজের চাপটা কমে গিয়েছে।”

–” হুম,”

–” আরাফ তুমি না হয় শায়োরীকে নিয়ে শিমুলনগরে একবার ঘুরে আসো। মেয়েটার মনটা ও ভালো নেই,
তোমার ও অফিসে চাপ পরেছে একটু ফ্রেশনেসের প্রয়োজন আছে। শায়োরী গ্রামের মেয়ে খোলামেলা পরিবেশ তার পছন্দ, এখানে বন্দি থেকে মেয়েটার
ভালো লাগছে না হয়তো। আমাদের সাথে হেসে বা স্বাভাবিক ভাবে কথা বললে ও, ওর মুখটা আসলে স্বাভাবিক নয় চাপা একটা ভাব আছে। আর বিয়ের পর ও একা ওদের বাড়িতে গিয়েছিল। তুমি ওর সাথে যাওনি। এখন আবার গিয়ে ঘুরে আসো, ও হ‍্যা আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছি তোমাকে,শুনো শায়োরীর বাবা ও নাকি খানিকটা অসুস্থ, এই সময়ে তাকে ও দেখে আসতে পারবে। তুমি ওদিকে গেলে আমি এদিকটা সামলাবো। কি বলো যাবে তুমি?”

–” আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যেহেতু এত করে বলছ আমি যাবো ওকে নিয়ে।”

–” হুম, যা বলেছি তাই করো।”
আরাফ কিছুক্ষণ জিরিয়ে রুমে চলেগেল।

________________________________

পরেরদিন যথারীতি আরাফের মা নিজেই শায়োরীকে আর আরাফকে সকাল সকাল গ্রামে যাওয়ার জন‍্য তাগাদা দিতে লাগলেন। দুজন মিলে তৈরী হয়ে গাড়িতে উঠে পরল। জানজট ময় ঢাকার পথ পেরিয়ে আস্তে আস্তে সবুজে ঘেরা পথ গুলো চোখে পরতে লাগল।
শায়োরী জানালা খুলে বাইরে চেয়ে আছে। আর আরাফ গাড়ি চালাতে চালাতে আড়চোখে শায়োরীকে দেখছে।

শায়োরী বাইরে চেয়ে কতদিন পর আবার গ্রামে যাচ্ছে।
মনটা যেন তার ধরছে না ‍খুশিতে। আরাফ যদি পারতো এই মুহূর্তে গাড়ি চালানো বন্ধ করে শায়োরীর মুখের দিকে প্রাণ ভরে চেয়ে থাকতো। কিন্তু বাড়িতে ও তো যেতে হবে তারাতারি। পুরোটা পথ শায়োরী আর আরাফ দুজনের একজন কোন কথা বলেনি। গ্রামের ভিতর ঢুকতেই আরাফের মনে হলো তার কিছু নিয়ে যাওয়া উচিৎ, যা সে একদম ভুলে গিয়েছিল ড্রাইভিং করতে করতে। মেইন রোড থেকে গ্রামের ভিতর ঢুকতেই একটা ব্রিজ আছে, আরাফ ব্রিজের উপর গাড়ি থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো-.

–” আপনি বসুন আমি একটু পাশের দোকানে যাচ্ছি, দেখি কি পাওয়া যায়। ”

–” আমি ভিতরে বসবো না, দরজাটা খুলেদিন। অনেকক্ষণ তো বসেই এলাম এবার একটু বের হই।”
আরাফ কথা না বাড়িয়ে নিজে গাড়ি থেকে বেড়িয়ে শায়োরীকে বের করে দিল। আর সে নিজে চলেগেল দোকান গুলোতে।

ব্রিজটার নিচে বয়ে চলেছে বিরাট বড় খাল। খাল টার একটা শাখা গিয়ে মিলেগেছে নদীর সাথে। উদ্দম পানির ছলাৎ ছলাৎ করে বেয়ে চলা আর শীতল হাওয়া শায়োরীকে বেশ টানছে। খোলা চুল, আর শাড়ির আচল উড়ে বাতাসের ছন্দে মেতে উঠেছে। নির্জন রাস্তা, খুব একটা গাড়ি আসা যাওয়া করে না এই পথটাতে। তাই হয়তো আরাফ এইপথে নিয়ে এসেছে। আরও একটি পথ বাজারেই ছিল। আরাফ সব কিনে এনে গাড়ির সামনে এসে দেখল শায়োরী ব্রিজের উপর দাড়িয়ে আছে। তাকে ডেকে দিয়ে একসঙ্গে দুজনে মিলে গাড়িতে বসে পরল।

বাড়িতে ঢুকা মাত্রই শায়োরীর মা যেন একদম চোখে হারাচ্ছেন জামাইকে। শায়োরীকে কোন কাজ করতে দিচ্ছেন না। শুধু বলছেন জামাইয়ের বাড়িতে গিয়েছিস কত কাজ আমার এখানে করতে হবে নাকি? বস বস কোন কাজ করতে হবে না। শায়োরী যেন আকাশ থেকে টুপ করে মাটিতে আছড়ে পরল। এত সুন্দর ভাবে মিষ্টি মুখের কথা হয়তো তার মত কেউই পারেনা।

শায়োরীকে বসিয়ে দিয়ে উনি খাবারের আয়োজন করতে লাগলেন। অতি উৎসাহে সব তৈরি করলেও আরাফ আর শায়োরী সেই খাবার তেমন একটা মুখে দিতে পারেনি। আরাফ কিছুটা খেয়ে আর খেতে পারল না। ভদ্রতার খাতিরে প্রশংসা করে সে কোনরকম উঠে গেল। তা কারো নজরে না পরলে ও শায়োরীর নজরে ঠিকই পরল।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব সেরে বসেছেন শায়োরীর বাবা
খুব ভালোই লাগছে তার বড় মেয়ের জামাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে। আরাফ খুব মিশুক প্রকৃতির শশুর হোক বা অন‍্য কেউ সবার সঙ্গেই সে খুব ভালোই মিশতে পারে।
সারাদিন দুজন মিলে গল্প করে কাটিয়ে দিয়েছে।
বিড়িতে আসা অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে নতুন জামাইকে। খুব ভালোই কাটলো দিনটা তার।

রাতের বেলায় শায়োরী তার সৎমায়ের আড়ালে ভেজে রাখা কুমড়োর ফুলের বড়া, কুচে চিংড়ি দিয়ে লতি, সঙ্গে ডিম ভাজা করে এক প্লেট ভাত নিয়ে এলো। আরাফ তখন বিছানার উপর শুয়ে শুয়ে মোবাইল হাতিয়ে চলেছে। যদিওবা সে পুরো পুরি ব‍্যার্থ কারন গ্রামে নেটওয়ার্ক তেমন পাওয়া যায় না। শায়োরী টেবিলের উপর প্লেট টা রেখে বলে উঠলো –

–” এই যে শুনছেন, উঠুন!”

–” উমম,”

–” বলছি উঠুন!”
আরাফ পাশ ফিরেই শায়োরীর দিকে তাকালো তারপর বলল-

–” এগুলো কি?”

–” আপনার জন‍্য খাবার নিয়ে এসেছি!”

–” খাবার আবার কেন? তখন না খেলাম!”

–” আপনি তখন ভালো ভাবে খেতে পারেননি, মা মাঝে মাঝে রান্নায় তালগোল পাকিয়ে ফেলে। আপনি না বললেও আমি জানি আপনি খেতে পারেননি। তাই নিয়ে আসলাম।”

–” আমার জন‍্য এত কষ্ট না করলেই পারতেন!”

—” তা নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না!”

–” আচ্ছা আপনি যখন এত করে বলছেন, আপনার কথাতো আর ফেলতে পারিনা, দিন এখানে।”
শায়োরী আরাফের সামনে নিয়ে প্লেটটা ধরিয়ে দিল।
উপর থেকে ঢাকনা খুলেই আরাফ দেখল,
ছোট ছোট কুচে চিংড়ি আর চিকন চিকন কচুর লতি,
আর কুমড়ো ফুলের বড়াটা নেড়েচেড়ে বলে উঠলো –

–” এটা কি?”

–” কুমড়ো ফুলের বড়া,”

–” স্ট্রেঞ্জ, ফুলের বড়া!”

–” হুম”

–” আপনি খেয়েছেন তো?”

–” হুম,

–” না বসুন আমি খাবো, আপনি ও খেয়ে নিন!”

–” না আপনি খান!”

–” নিন,” বলেই আরাফ শায়োরীকে জোর করে তার মুখে এক মুঠো ভাত মেখে মুখে দিয়েদিল।
শায়োরী আরাফের মুখের দিকে চেয়ে আছে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here