দুরে নয় কাছেই আছি পর্ব -০৮ ও শেষ পর্ব

#দূরে নয় কাছেই আছি!
#লেখিকাঃতামান্না
#পর্বঃঅন্তিম পর্ব

–” মজা করছেন?খবর করলে বললে তাই বললাম,খবর তো টেলিভিশনে পাঠ করা হয়! আর এখন বারবার যে আপনি করছো আমিও তোমার মত খবর করতাম তবে সেটা তো টেলিভিশনে দেওয়া যাবে না। সিক্রেট, সিক্রেট!

–“অসভ‍্য লোক!”বলেই শায়োরী আরাফকে ধাক্কা দিয়ে চলেগেল বাইরে। আরাফ সেই দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল। গুমরে থাকা মেয়েটি একটু একটু করে চঞ্চলা হয়ে উঠছে, আগের সেই গুমোট প্রকৃতির ভাব এখন কিছুটা কমেছে মেয়েটার মধ‍্যে থেকে।
এ যেন মরা ডালে নতুন কুড়ি আর পাতার আবির্ভাব!
___________________________________

ভার্সিটিতে গ্রেজুয়শন উপলক্ষে সব ছাত্র- ছাত্রীরা তাদের পরিবার নিয়ে দাড়িয়ে আছে। মঞ্চে ডেকে উঠলেন ভাইস-প্রিন্সিপাল একটি মেয়ের নাম যে কিনা ভার্সিটিতে স্নাতক পর্যায় প্রথম স্থান অর্জন করেছিল।
মেয়েটি পাশে বসা তার মা- বাবা, ছেলের দিকে তাকালো, তারপর নিজের পাশে বসা ব‍্যাক্তিটির দিকে তাকালো। ব‍্যাক্তিটি এবার মেয়েটির হাতের উপর হাত রেখে আশ্বাস দিল সামনে এগিয়ে যেতে। মঞ্চে যত এগুচ্ছে ততই মেয়েটির পিছনের স্মৃতিগুলো বারবার হাতরাচ্ছে। সামনে দাড়িয়ে মাইকটাকে নেড়েচেড়ে বলতে লাগল –

—” আজ থেকে পাচঁ বছর আগে আমি একজন সাধারণ মানুষ ছিলাম, একদমই সাধরণ পরিবার থেকে উঠে আসা একটি মেয়ে। যার বেচে থাকার মত ছিল না কূল! কূল বুঝেন? কূল হচ্ছে নদী বা সমুদ্র তীর বর্তি স্থান। জলে ভেসে যাওয়া কোন কাঠ কড়ির মত ছিল আমার জীবন। যার ছিলনা কোন কূল,. কিছু আকড়ে ধরবো সেই দ্রব‍্য ও আমার ছিলনা। তারপর! হ‍্যা তারপর আমার জীবনে একটা অন‍্যরকম ঘটনা ঘটে, সব ঝড় আর প্রাকৃতিক দূর্যোগের মধ‍্যে দিয়ে আমি আছড়ে পরলাম কারো পায়ের কাছে। সেই মহামানবটি আমার সামনে বসে আছেন। যিনি আমাকে সামান‍্য পাথর থেকে নিজ হাতে গড়ে তুললেন পাথর থেকে মহামূল‍্যবান পাথর! বড্ড বেশি কি বলে ফেলছি আমি? যদি এমন হয় ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আপনাদের কাছ থেকে। আমার সামনের সেই মহামানব আমার স্বামী, বিয়ের উনিশ দিনের মাথায় আমি এবং আমার স্বামী একটা এক্সিডেন্ট খুব মারাত্মক ভাবে জখম হই। সেই সময় আমার ব্রেইন পুরোপুরি ডেমেজ হয়ে যায়। প‍্যারালাইসিস হিসেবে আমি একবছর পরে ছিলাম। দীর্ঘ একবছরে আমার স্বামী আমার বা- মামা আমার পিছনে সারাদিন যেভাবে লেগেছিলেন। সত‍্যি অন‍্য কেউ হলে হয়তো ফিরে ও তাকাতো না। ”

হঠাৎ মেয়েটি কাদতে লাগল, কাদতে কাদতে মেয়েটি বলে উঠলো –

—” আমার স্বামী তখন অফিসের কাজ সেরে বাসায় আসতো, যে জায়গায় অন‍্যান‍্য স্বামীরা ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় আসলে তার স্ত্রী তার জন‍্য খাবারের ব‍্যবস্থা করতো, দৌড়ে তার জন‍্য এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত নিয়ে এসে পাশে বসতো। তখন আমার স্বামী আমার মাথার পাশে বসে আমার চোখের পানি মুছে দিত। আমার শরীর মুছিয়ে দিত।”

উপস্থিত সবার চোখে জল, সবার মাঝে একটা অন‍্যরকম অনূভুতি তৈরি হয়েছে।

–” আমার স্বামী দীর্ঘ একবছর আমাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর, ইতালি এমন কোন জায়গা বাদ নেই নিয়ে যায় নি।
সে তো পারতো অফিসের দোহাই দিয়ে ঘরে বসে থাকতে। কিন্তু না সে সেটা করেনি, সে সেই সময় আমার অশ্রুগুলোকে মুছে দিয়ে বলতো। জীবন থেমে থাকে না শায়োরী, জীবন থেমে থাকেনা। আজ তুমি বেডে শুয়ে আছো, ভবিষ্যতে তুমি নিজেই নিজের সব চেয়ে বড় খুটি হবে ”

–“হ‍্যা আমি খুটি হয়েছি! আমি শুধু আমার একার নই দশের খুটি হয়েছি, দেশের ও খুটি হবো! ”

উপস্থিত সবার হাতে কড়তালি বেজে উঠলো। সবার মাঝে যেন এখন সেই চাপা রোধ মুহূর্তটা কেটে গিয়েছে।
শায়োরী স্থান ত‍্যাগ করে বসে পরল। আরাফ তার কাধে হাত রেখে কাছে টেনে ধরল। তারপর ছেলে সারাফকে মায়ের কোল থেকে নিয়ে শায়োরীর কোলে দিয়ে দিল।
ছোট্ট সারাফ মায়ের মুখে হাত দিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে হাসছে। দাদা -দাদির দিকে চোখ পরতে আবার নেচে নেচে জানান দিচ্ছে সে আবার ও দাদা -দাদির কোলে যাবে। আরাফ কোলে নিয়ে বসল অনুষ্টান শেষ হলে তারপর তারা পাচঁজন মিলে বেরিয়ে এলো।

অফিস থেকে আরাফ বলে এসেছে আজ শায়োরীর গ্রেজুয়েশন পাওয়ার মুহুর্ত! এমন একটা সময় সে বাদ দিতে পারেনা। শায়োরী আর বাবা- মাকে পৌছে দিয়ে সে অফিসে চলেগেল।

সেদিন শায়োরীর কথা মতো আরাফ সকাল সকাল রওনা দিয়েছে, যাতে সন্ধ‍্যায় কোন খারাপ কিছু না হয়।
কিন্তু ঐ যে মানুষ যে জিনিস থেকে পালিয়ে বেড়াক না সেই জায়গায় গিয়েই বারাবার হোচট খায়। শায়োরী আর আরাফ ও সেদিন খুব সাবধানে থাকার পরও কোথা থেকে বেপরোয়া একটা লড়ি এসে গাড়ি টাকে ধাক্কা দিয়ে দিল। আরাফের সঙ্গে তেমন কিছু খারাপ না ঘটলে ও শায়োরী খুব বেশি আঘাত পায় এক বছর কেন সারাজীবন ও অনেক রুগী বিছানায় পরে থাকে। সেখানে অনেকটা উপরওয়ালার দোয়ায় শায়োরী বেচে যায়। সেই ঘটনার ঠিক দুবছর পর শায়োরী কনসিভ করে, সবার ভালোবাসার হাতের স্পর্শে বেড়ে উঠতে থাকে তাদের সন্তান, গর্ভধারন শায়োরী করলেও পিতার আদর গুলো যেন সন্তান অনুভব করতে পারে। ঠিক সেই ভাবেই আরাফ তাদের আগলে রেখেছিল।
শায়োরীর ছোট্ট মাতৃ গহব্বর টা আরাফ আর তাদের পরিবারের সবার আদরে আস্তে আস্তে বেড়ে উঠতে লাগল তাদের পূত্র সন্তান। মাতৃত্বের স্বাদ বরণ করে নিতেই যেন তার জীবন পূর্ণ হয়েগেল আরও।
সংসার, স্বামী, আর সন্তান এই তিন মিলিয়ে হয় একজন নারীর জগৎ সংসার।
“যদি এই তিনে হয় মিল – সুখ থাকে চিরদিন ”

_________________________

শায়োরী বাবুকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ হাটার পর দেখল বাবু ঘুমিয়ে পরেছে, তারপর কোল থেকে নামিয়ে দোলনায় শুইয়ে দিল।

কিছুক্ষণ বাবুটার দিকে তাকালো, চোখগুলো তারই পেয়েছে ছেলেটা, আদর করে দিল তার কপালে।

আরাফ বাসায় এসেছে অনেকক্ষণ হলো, এসেই দেখল ছেলেটা মুখে একটা আঙ্গুল দিয়ে ঘুমাচ্ছে।
আরাফ বাবুর মুখ থেকে খুব সাবধানে আঙ্গুল টানলেও
বাবু জেগে যায়। জেগেই তার চিৎকার শুরু হয়ে যায়।
বিছানায় শুয়েছিল শায়োরী, ছেলের চিৎকারে উঠে পরল। সামনে আরাফকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলে উঠলো –

–“কখন এসেছো?”

–” এই তো কিছুক্ষণ আগে,এসেই দেখি ছেলে তোমার মুখে আঙ্গুল দিয়ে রেখেছে। আঙ্গুল মুখ থেকে বের করতেই কাদতে লাগল।”

–” ও, আচ্ছা কোলে নেও! আমি ওর জন‍্য ফিডারে করে সুজি নিয়ে আসি। ঐ সময় খেয়াল ছিল না নিয়ে আসতে।”

আরাফ ছেলেকে কোলে নিয়ে বলতে লাগল-” আমার সোনা বাবাটা কি হয়েছে? এত এত খাবার থাকতে আপনি আঙ্গুল কেন চুষতে থাকেন বলুন তো?”

আরাফের কথায় ছোট্ট সারাফ খিলখিলিয়ে হাসতে লাগল। আরাফ তো ভাবছে ছেলে তার কান্না বন্ধ করে হাসছে। কথা শুনেই চুপ, ভালোই হয়েছে। কিন্তু এরপরই আরাফ বুঝলো কেন ছেলে তার এত বাধ‍্য হলো। আরাফের হাতের মধ‍্যেই সারাফ হিসু করে একদম শার্ট ভিজিয়ে দিয়েছে। শার্ট ভিজিয়ে যেন তার হাসি আর থামছে না, খিলখিল করে হাসতে লাগল, শায়োরী এসে বলল-

–” বাহ! আজ বাবা আমার খুব খুশি মনে হচ্ছে! বাবাকে কি আজ স্পেশাল মনে হচ্ছে? বাবা আজ খুব আদর করেছে নাকি?”

—” আদর আমি না ও করেছে তাইনা বাবা?”
সারাফ আরও বেশী হাসতে লাগল। আরাফ নিজের ভিজে শার্ট টা শায়োরীকে দেখিয়ে বলল –

–” দেখো তোমার ছেলে কি করেছে!”

–” ও এই কথা!”

—” জ্বী ম‍্যাডাম এই কথাই, কেমন হাসছে দেখলেন।”

–” এত কথা বলো নাতো, পটি তো আর করেনি, ”

–” এই হচ্ছে মেয়েদের সমস‍্যা তখন সেখানে কাদতে কাদতে শেষ! তার স্বামী তাকে সবসময় আগলে রেখেছে, এখন আবার এক চুল ও ছাড় দিবে না। মেয়ে মানুষ মানেই ঝামেলা বুঝলি বাবা! বড় হও বাপ তবে মেয়েদের থেকে একটু সাবধান!” বিরবির করে কথাটা সারাফের কানের সামনে বলল।

—” কি বললা?”

–” কিছু না,” বলেই আরাফ চলেগেল।

আর শায়োরী হাসতে লাগল, বাবুর প‍্যান্ট পরিয়ে দিতে লাগল। আরাফ কাছে এসে সারাফকে কোলে নিয়ে বসল। দুজন থেকে তাদের সংসারে আরও একজন সদস‍্য বাড়লো। দেখতে কখন কিভাবে দাম্পত্য জীবনের
পাচঁটা বছর দুজনে একসাথে কাটিয়ে ফেলল। বুঝতেই পারল না। ছোট্ট সারাফ যখন দোলনায় দুলতে লাগল। দুজনের মধ‍্যে আবারও চলতে থাকলো খুনসুট।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here