দ্বিতীয় ফাগুন পর্ব -০৬+৭

#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্ব_সংখ্যা_৬
#লেখিকা_Esrat_Ety

নিজের ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় রোদেলা। ক্লান্তিতে তার চোখ বুজে আসছে। অফিসের কাজের চাপ আর অসভ্য জিএম এর অত্যাচারে তার জীবন ওষ্ঠাগত প্রায়। রোদেলার এখন মনে হচ্ছে ডলি খালার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়ে বিয়ে করে নেওয়াই ভালো, ইতালিতে বসে বসে স্বামীর সাথে সারাদিন পিৎজা খাওয়া যাবে।
আয়েশা ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়,পর্দা সরিয়ে রোদেলাকে দেখে।
“ভাত খাবেনা রোদেলা?”

রোদেলা মাথা কিছুটা উঁচুতে তুলে আয়েশার দিকে তাকিয়ে বলে,”বিছানা থেকে একটুও উঠতে ইচ্ছা করছে না। খুব ক্লান্ত আমি। ভাত খাওয়ার মতো শক্তিও শরীরে অবশিষ্ট নেই।”

আয়েশা কিছুক্ষণ নিরব থাকে। তারপর বলে,”আমি ভাত মেখে খাইয়ে দেবো?”
রোদেলা আয়েশার দিকে তাকিয়ে আছে। আয়েশা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়। কেনো যে সে বলতে গেলো এই কথাটা! তার হাতের রান্না খায় বলে কি তার হাতের মাখা ভাত খাবে নাকি! বলাটা ঠিক হয় নি।

রোদেলা মৃদু হাসে। তারপর আয়েশাকে অবাক করে দিয়ে বলে,”ঠিকাছে।”
আয়েশার মুখ প্রস্বস্ত হয়ে যায় হাসিতে। সে প্রায় দৌড়ে যায় রোদেলার জন্য খাবার আনতে।
রোদেলা আনমনে হেসে ফেলে , মনে মনে বলে, “আপনার মতো সৎ মা যদি সবাই পেতো আন্টি!”

আয়েশা রোদেলাকে খাইয়ে দিচ্ছে। রুহুল আমিন ক্রাচে ভর দিয়ে রোদেলার ঘরে ঢোকে। বিষন্ন মুখে বলে,”মেঘলাকে ফোন দিচ্ছি ধরছেই না। মাইনুল ও ধরছে না। মেঘলার শাশুড়ির নাম্বার আছে তোর কাছে? আমাকে দে,ফোন দেই উনাকে…

রোদেলা খেতে খেতে বলে,”তুমি এতো টেনশন করো নাতো। কাল আমি নিজে গিয়ে আপুকে নিয়ে আসবো ও বাড়ির লোকদের বুঝিয়ে। তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো। যাও।”

_তুই একটা ফোন দে না। দিয়ে দেখ না।
_আচ্ছা দেবো সকালে। এখন অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। তুমি যাও।

রোদেলার ফোন দিতে হয়না কাউকে। রুহুল আমিনের ফোনেই কল আসে মাইনুলের। তখন রাত দুইটা বেজে গিয়েছে। মেঘলাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। পা পিছলে ওয়াশ রুমে পরে গিয়ে নাকি পেটে প্রচন্ড ব্যাথা পেয়েছে সে।

বাবা রুহুল আমিন ছিলো একজন মালয়েশিয়ান প্রবাসী। সেজন্য মায়ের সাথে তাদের ছোটো বেলাটা নানাবাড়িতেই কেটেছে। ছোটো বেলায় প্রচন্ড দুষ্টু একটা মেয়ে ছিলো রোদেলা। এজন্য মা প্রচুর মারতো ওকে। মাকে সে প্রচন্ড ভয় পেতো,কিন্তু দুষ্টুমি তার কমতো না। মেঘলা আপু ছিলো বরাবর শান্ত স্বভাবের মেয়ে। তার বয়স যখন দশ, মেঘলা আপুর বয়স তখন বারো। বৃষ্টি ছিলো দু’বছর বয়সী। একদিন হঠাৎ করে তাদের মা উধাও হয়ে গেলো, গোটা দু দিন মাকে তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো। তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেলো না। দুদিন পরে তার দুজন মামা গিয়ে কোথা থেকে খুজে নিয়ে আসলো তাদের মাকে। কিছুদিন পর বাবা দেশে এলেন, তারপর নানাবাড়িতে গিয়ে তাদের বড় দুবোনকে নিয়ে চলে এলেন। তাদের দাদীর কাছে রাখলেন। মা আর বৃষ্টি এলো না। দাদী বললো,”তোমরার মায়রে তোমরার বাপে তালাক দিসে। হে আর আইতো না।”
বৃষ্টিকে কোর্ট মায়ের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নিলো, কিন্তু মা হয়তো সে সিদ্ধান্তে খুশি হয়নি। বাবা গিয়ে মাকে বললেন,”আমি বৃষ্টিকেও নিয়ে যাচ্ছি, তোমার আর অসুবিধা হবে না।”
মা সেদিন বৃষ্টিকে আটকাতে চায়নি। বৃষ্টি বড় হতে থাকলো মেঘলা আপুর হাতে। কিছুদিন পরে খবর আসলো তাদের মায়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। যে লোকটার সাথে বিয়ে হয়েছে তাকে রোদেলা চিনতো,ওই লোকটা প্রায়ই আসতো তাদের নানাবাড়িতে।

“আপা হসপিটাল পৌঁছায়া গেছি নামবেন না?”
ড্রাইভারের কথায় ঘোর কাটে রোদেলার। সে কিছুটা বিরক্ত হয় নিজের ওপর। একটু ডিপ্রেশড হয়ে পরলেই ছোটোবেলার সেদিন গুলোর স্মৃতি গুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
পাশে তাকিয়ে আয়েশা সিদ্দিকাকে বলে,”নামুন আন্টি।”

সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে তারা নেমে পরে। এতো রাতে কপাল ভালো ছিলো বলে তারা এই সিএনজি টাকে পেয়েছে,তাই ভাড়া একটু বাড়িয়ে দেয় রোদেলা। আয়েশা সিদ্দিকা চোখ বড় বড় করে সব দেখতে থাকে। শহরের এতো উঁচু উঁচু দালান খুব কমই দেখেছে সে তার জীবনে।

রোদেলাকে দেখতে পেয়ে জোবাইদা কান্নার মতো শব্দ করে ওঠে। পুরোটাই ভান। রোদেলা বিরক্ত হয়ে যায়। মেঘলার কেবিনের সামনে মাইনুল দাঁড়িয়ে আছে। রোদেলাকে দেখতে পেয়ে নাক চোখ কুঁচকে ফেলে। রোদেলা তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ডাক্তারকে জিগ্যেস করে,” কতটুকু ক্ষতি হয়েছে? বাচ্চা ঠিক আছে?”

ডাক্তার মুখের মাস্ক খুলে বলে,”ব্লিডিং হচ্ছে প্রচুর। আপনাদের পরে জানাচ্ছি। আপাতত ব্লাড ব্যাংক থেকে এক ব্যাগ ব্লাড দিয়েছি। এ বি নেগেটিভ রক্ত সন্ধানে রাখুন,আরো প্রয়োজন পরতে পারে।”

ডাক্তার হন্তদন্ত হয়ে চলে যায় মেঘলার কেবিনে। দরজার কাচ থেকে রোদেলা একবার উকি দিয়ে তাকায়, তার বুকটা হঠাৎ করে মোচড় দিয়ে ওঠে। মনে মনে বলে,”না রোদেলা। তোকে শক্ত থাকতে হবে। শক্ত থাকতেই হবে।”
মাথা ঘুরিয়ে মাইনুলের দিকে কঠিন দৃষ্টি দেয়, মাইনুল সে দৃষ্টি দেখে খানিকটা ভড়কে যায়।
রোদেলা বলে,”এসব কিভাবে হয়েছে?”
তার কন্ঠে ধমকের সুর। মাইনুল বিরক্ত ভাব নিয়ে বলে,”এভাবে চেঁচিয়ে জেরা করছো কেনো? এটা হসপিটাল। তোমার আপা ওয়াশ রুমে পরে গিয়েছে, শোনোনি সেকথা?”
_কি হয়েছে সেটা পরেই জানতে পারবো আপুর থেকে। আপাতত আপনি এবং আপনার মা এখান থেকে কেটে পরুন। আপনাদের চেহারা দেখলেই আমার মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে।
মাইনুল পাল্টা জবাবে বলে,”কেটে পরবো মানে? তোমার কথায় কেটে পরতে হবে? আমার বাচ্চা ঠিক আছে কি না তা আমাকে দেখতে হবে না? আর হসপিটালের বিল তো আমাকেই দিতে হবে।”

_আপনাকে কোনো বিল দিতে হবে না,আপনি যান এখান থেকে। বাচ্চার ব্যাপারে আপনাকে জানিয়ে দেওয়া হবে।

মাইনুল কিছুক্ষণ রোদেলার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর তার মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে। হাটুর যন্ত্রনা নিয়ে হসপিটালে থাকতে তার মায়ের কষ্ট হতে পারে। তাই সে মাকে নিয়ে বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু তার মনে ভয়, মেঘলার জ্ঞান ফিরলে যদি রোদেলাকে সব বলে দেয় সে !

মাইনুল তার মাকে নিয়ে চলে যাওয়ার পরে সারারাত রোদেলা এবং আয়েশা হাসপাতালের করিডোরে পায়চারি করতে থাকে। আয়েশা এসে এক ফাঁকে রোদেলাকে বলে,”তুমি যাও মেঘলার কেবিনে। ওখানে একটা বেড খালি পরে আছে। গিয়ে রেস্ট নাও। কাল তো তোমার অফিস আছে।”
_এখন একটুও স্থির হয়ে থাকতে পারছি না আন্টি। কাল অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নেবো। আপনি গিয়ে শুয়ে পরুন।
আয়েশা যায়না। রোদেলার মতো সকাল পর্যন্ত পায়চারি করেছে সে করিডোরে,একটু পরপর দরজায় উকি দিয়ে দেখেছে মেঘলাকে।

“স্যার,আপনি বোঝার চেষ্টা করুন। আমি তো এই মাসে কোনো লিভ নেইনি। আমার তো লিভ পাওনা আছে।”
রোদেলার কন্ঠে আকুতি। ওপাশ থেকে তাদের ডিপার্টমেন্টের হেড খলিলুর রহমান বলে,”তোমার সব কথা ঠিকাছে কিন্তু রোদেলা এখন তো অডিট চলছে অফিসে। এমতাবস্থায় আমি তোমাকে ছুটি দিতে পারবো না। একটা বেলারই তো ব্যাপার। আজ লাঞ্চের পরে সব এম্প্লয়িকে ছেড়ে দেওয়া হবে।”

_স্যার আপনি জিএম স্যারের সাথে একটু কথা বলে তো দেখুন।

_ক্ষেপেছো তুমি? জিএম স্যারের সাথে তার ওয়াইফের কোর্টে ঝামেলা চলছে কদিন ধরে। তার মন মেজাজ ঠিক নেই,তুমি বলছো তাকে বলি আমি? অসম্ভব। তুমি অফিসে এসো। লাঞ্চের পরপর ছেড়ে দেবো।

রোদেলা ফোন কেটে দিয়ে বসে থাকে চুপচাপ। তার ইচ্ছে করছে কিছুক্ষণ কাঁদতে, শব্দহীন কান্না। কিন্তু তার চোখে পানি আসছে না। আশ্চর্য!
মাথার চুলে বেনী করা, কপালের কাছে চুলগুলো এলোমেলো, গাঁয়ে যে শাড়িটা পরে আছে তার কুঁচি গুলোও এলোমেলো হয়ে আছে। শাড়ির সাথে আজ ম্যাচিং ব্লাউজ পরেনি রোদেলা। মেঘলার খবর পেয়েই রাতেই কোনো মতে শাড়িটা পাল্টে বেরিয়ে ছিলো আয়েশাকে নিয়ে। সকালে সোজা হসপিটাল থেকে রওনা দিয়েছে অফিসের উদ্দেশ্যে সে। এর মাঝে একটিবারো নিজের দিকে তাকানো সময় বা ইচ্ছে কোনটিই হয়ে ওঠেনি তার। দ্রুত পায়ে সাতাশ বছর বয়সী এই তরুণী তার বিদ্ধস্ত চেহারা নিয়ে অফিসে ঢুকে পরলে সবাই তাকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। কেউ কেউ মনে মনে হাসতে থাকে তাকে দেখে। অফিসে সবাই যে যার ডেস্কে বসে আছে। রোদেলা নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে থাকে চুপচাপ। একটু পর ফোন বের করে বাড়িতে ফোন দিয়ে বৃষ্টির থেকে জেনে নেয় রুহুল আমিনের কথা। মেঘলার খবরটা শোনার পরপর তার প্রেশার বেড়ে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পরেছিল সে।

জিএম স্যার তার কেবিনে রয়েছে। একটু পরেই সবাইকে মিটিং রুমে ডেকেছে সে। সবাই নিজেদের ডেস্কে বসে জিএম স্যারের কেবিন থেকে বের হবার অপেক্ষা করছে।

রোদেলা ফোন নামিয়ে ডেস্কে রেখে দেয়। অফিসের সিনিয়র পারসন ও ডিপার্টমেন্টের হেড খলিলুর রহমান হেসে হেসে সবার সাথে আড্ডা দিচ্ছে। খলিলুর রহমান অফিসে তার কাজের চেয়ে বেশি কৌতুকের জন্য বেশি পরিচিত।
“তো এখন আরেকটা জোকস্ বলি শুনুন আপনারা। এটা সর্দারজিদের জোকস্। আপনি যদি একটা স্বাভাবিক মানুষকে একটা পৃষ্ঠা ফটোকপি করতে দেন তাহলে সে সর্বোচ্চ তিন-চার মিনিট সময় নিয়ে সেটি ফটোকপি করে দেবে , কিন্তু সর্দারজিরা একটি পৃষ্ঠা পুরো একঘন্টা সময় নিয়ে ফটোকপি করে এনে দেবে। বলুন তো কেনো?”
অফিসের কিছু উৎসাহী এবং কৌতুহলী কর্মচারী বলে ওঠে,”কেনো?”

_কারন তারা মেইন পৃষ্ঠার সাথে ফটোকপি মিলিয়ে দেখে নেয় হুবহু ঠিক আছে কিনা।

সবাই উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। তাশরিফও হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে তার চোখ যায় রোদেলার দিকে। যেখানে অফিসের সবাই গা দুলিয়ে হাসছে সেখানে এই পেঁচা মুখী তার স্বভাব মতো কঠিন হয়ে বসে আছে। রামগরুরের ছানা,হাসতে তাদের মানা। হাসির কথা শুনলে বলে হাসবো না না না।

শারমিন নামের মেয়েটি রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”কি ব্যাপার রোদেলা। আপনার হাসি আসছে না? নাকি আপনি জোকসটা ধরতে পারেননি!”
পাশ থেকে একজন বলে ওঠে,”মিস রোদেলা সর্দারজিদের মতোই ভোলাভালা, হা হা হা !”

রোদেলা তাদের দিকে শীতল চোখে তাকায়।
“আপনাদের জীবনে খুব আনন্দ তাই না? প্রচুর ফাজলামিতে ভরপুর আপনাদের জীবন।”
শারমিন খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে বলে,”আমি তো শুধু একটু মজা করছিলাম আপনার সাথে।”
রোদেলা কর্কশ কন্ঠে বলে,”জোকস্ টা আমি বুঝতে পেরেছি। একটা জোকস্ বোঝার মতো স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তা আমার আছে, কিন্তু আপনাদের তো একজন মানুষকে দেখে তার মুড বোঝার মতো স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তাই হয়নি এখনো। নয়তো আমার পোশাকের অবস্থা ইনফ্যাক্ট চেহারা দেখেই বুঝে যাওয়া উচিত আমি ডিস্টার্বড।”

শারমিন চুপ হয়ে যায়। অফিসে আর কেউ কথা বাড়ায় না। তাশরিফ আরো একবার রোদেলাকে দেখে। সত্যিই অস্বাভাবিক লাগছে আজকের রোদেলাকে। মনে হচ্ছে খুবই অসুস্থ সে। কি হয়েছে ওনার!

মিটিং প্রায় শেষ। রোদেলার ফোনে বারবার ফোন দিয়ে যাচ্ছে আয়েশা সিদ্দিকা। রোদেলা ফোন সাইলেন্ট করে ঢুকেছিলো মিটিং-এ।
মিটিং শেষ হয়ে গেলে অফিসের সব এম্প্লয়িকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আজ তাদের ছুটি। সকাল থেকেই বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে । অফিস থেকে সবাই বের হচ্ছে একে একে। রোদেলা ফোন বের করে সময় দেখার জন্য,তখন দেখতে পায় আয়েশা সিদ্দিকার ফোন থেকে অনেকগুলো মিসডকল। লিফট থেকে নামতে নামতে সে আয়েশাকে ফোন দেয়। ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে আয়েশা আহাজারি করে ওঠে,”তুমি ফোন ধরছিলে না কেনো রোদেলা।”

_আন্টি আপুর কি খবর বলেন। আপনার কথা এমন শোনাচ্ছে কেনো?
আয়েশা একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে,”তুমি ডাক্তারের সাথে কথা বলো।”

“আপনার বোনের বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে মিস রোদেলা। উই আর সরি। এবং……..”
ডাক্তারটা কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে যায়। রোদেলার গলা কেঁপে ওঠে,চেঁচিয়ে বলে,”এবং কি ডক্টর?….”

“ওনাকে বাঁচাতে আমাদের অপারেশন করতে হয়েছে এবং ওনার জরায়ু কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। আপনার বোন আর কখনো মা হতে পারবে না রোদেলা।”

রোদেলা থমকে যায়। বাইরে বৃষ্টি পরতে শুরু করেছে। হু হু করে বাতাসের বেগ বাড়ছে।
আয়েশা সিদ্দিকা ডাক্তারের থেকে ফোন নিয়ে কেঁদে ফেলে,বলে,”তাড়াতাড়ি এসো রোদেলা। তুমি তাড়াতাড়ি এসো।”

ফোন কেটে দিয়ে রোদেলা এদিক ওদিক দেখতে থাকে। রাস্তা এতো ফাঁকা কেনো। সামান্য বৃষ্টি হচ্ছে বলে রাস্তা এভাবে ফাঁকা হয়ে যাবে ! দুয়েকটা রিক্সা তার সামনে দিয়ে যেতেই সে চেঁচাতে থাকে,”চাচা ঢাকা মেডিকেল হসপিটাল যাবেন?”
রিক্সা ওয়ালা মাথা ঝাঁকিয়ে না বলে দেয়।
_আরে ডাবল ভাড়া দেবো চাচা!
কন্ঠে আকুতি রোদেলার।
রিক্সাওয়ালা ডাবল ভাড়ার লোভেও থামে না। তার বাড়ি ফেরার বড্ড তাড়া।
রোদেলা এদিক সেদিক তাকাতে থাকে।‌ বৃষ্টি খুব জোরে পরতে শুরু করেছে। তার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই, সে অপেক্ষা করছে একটা গাড়ির জন্য। অপেক্ষা করছে তার বোনকে দেখার জন্য।

অফিসের বাইরে কলিগদের নিয়ে টং-এর দোকানে চায়ের আড্ডা দিচ্ছিলো তাশরিফ। বৃষ্টি দেখে বাইক একটা ছাউনির নিচে দাড় করিয়ে রেখেছে সে। হঠাৎ দেখতে পায় রোদেলা নামের মেয়েটি বৃষ্টির মধ্যে মেইনরোডের মাঝখানে দাড়িয়ে রিক্সা থামানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কৌতুহলী হয়ে একটু সামনে আগায় সে,”আরে এই মেয়ে পাগল নাকি! বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিসের এতো তাড়া মেয়েটির!”

রোদেলা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে। ব্যাগের মধ্যে তার মোবাইলের রিংটোন বেজে যাচ্ছে। সে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কয়েক মূহুর্ত যেতেই ডুকরে কেঁদে ওঠে সে। তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। বৃষ্টির মধ্যে সেই কান্নার আওয়াজ বেশি দূরে যেতে পারে না।
কিন্তু তাশরিফ ঠিকই দেখতে পাচ্ছে তাদের অফিসের সবথেকে রাগী, বদমেজাজি,দেমাগী এবং অভদ্র মেয়েটি হাউমাউ করে ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে, একটু পরপর তার শরীর কাঁপছে।
চায়ে চুমুক দিয়ে মনে মনে বলে ওঠে,”বাহ। এই পেঁচা মুখী তো দেখছি কাঁদতেও পারে!”

তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে রোদেলাকে লক্ষ্য করতে থাকে সে। হঠাৎ করে সে টের পেলো এই মাত্র, হ্যা ঠিক এই মাত্র সে রোদেলা নামের বদমেজাজি, অভদ্র মেয়েটির প্রেমে পরে গিয়েছে।

অঝোর ধারায় বৃষ্টি পরতে শুরু করেছে। চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বিল মিটিয়ে বাইকের কাছে গিয়ে বাইক স্টার্ট করে সে। বাইক ঘুরিয়ে রোদেলার সামনে গিয়ে থামে। রোদেলা চমকে গিয়ে তার দিকে তাকায়। তাশরিফ রোদেলার দিকে এক পলক তাকায়। ঠান্ডায় জমে গিয়ে ঠোঁট দুটো নীল বর্ণের হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টির পানি আর চোখের পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে।
সে মাথা ঘুরিয়ে সামনে তাকিয়ে রোদেলাকে উদ্দেশ্য করে বলে,” কোথায় যাবেন,বাইকে উঠুন। আমি পৌছে দিচ্ছি।”

চলমান……#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্বসংখ্যা_৭
#লেখিকা_Esrat_Ety

***
হসপিটালের সামনে বাইক দাঁড় করিয়ে নিজেও নেমে দাঁড়ায় তাশরিফ। রোদেলাকে বলে,”কেউ অসুস্থ আপনার?”

রোদেলা নিশ্চুপ হয়ে কেঁদেই যাচ্ছিলো। তাশরিফের প্রশ্নে মাথা নাড়ায়। গলা দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না তার। তাশরিফ কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বলে,” আমি কি আপনার সাথে আসতে পারি? আপনি স্বাভাবিক নেই, আপনাকে আপনার রিলেটিভের কেবিনে দিয়ে আসি চলুন। কেবিন নাম্বার বলুন!”
রোদেলা কাঁপছে,কাঁদতে কাঁদতে অস্ফুট স্বরে জবাব দেয়,”টু জিরো টু”

তাশরিফ হাঁটতে থাকে। রোদেলা তার পিছু পিছু হেঁটে যায়। করিডোরে আয়েশা সিদ্দিকা রোদেলাকে দেখতে পেয়ে ছুটে আসে তার কাছে। রোদেলাকে দেখে আঁতকে উঠে বলে,”কি অবস্থা তোমার! ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছো।”
_আপু কোথায় আন্টি!
কেঁপে ওঠে রোদেলার গলা।
_কেবিনে দিয়ে দিয়েছে। জ্ঞান ফেরেনি ওর। কিছুই জানে না এখনো।

রোদেলা একটা বড় নিশ্বাস নেয়। তাকে স্বাভাবিক হতেই হবে,হতেই হবে।
আয়েশা কাঁদছে, বলে,”ওকে রক্ত দেওয়া হচ্ছে রোদেলা। একটা সমস্যা হয়েছে। আরো এক ব্যাগ রক্ত লাগবে। হাসপাতালে আর এ বি নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত নেই।”
রোদেলা আতংকিত হয়ে তাকায়। বলে,”আমায় আগে জানাননি কেন? এতক্ষনে রক্তের ব্যাবস্থা হয়ে যেতো।”
_ফোন দিয়েছি তোমাকে বহুবার। তুমি ফোন ধরোনি। মেঘলার স্বামী মেঘলাকে কেবিনে দেওয়ার সাথে সাথে কোথায় চলে গেলো। ডাক্তার এসে তার কিছুক্ষণ পরে জানালো রক্তের কথা। তার নাম্বারও নেই আমার কাছে যে তাকে ফোন দেবো।

রোদেলা বুঝতে পারে,যখন সে রিক্সা থামানোর চেষ্টা করছিলো তখন তাকে আয়েশাই ফোন দিচ্ছিলো। সে বিরবির করে বলে,”এখন আমি রক্ত কোথায় পাবো। এতো কম সময়ের মধ্যে কিভাবে ম্যানেজ করবো। ও আল্লাহ,প্লিজ একটা উপায় বের করে দাও।”

“আমার রক্তের গ্রুপ এ বি নেগেটিভ। আপনি চাইলে আমি রক্ত দিতে পারি।”
রোদেলা মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। তাশরিফ তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে এখনো যায়নি।
রোদেলা একটু অবাক হয়ে বলে,”আপনি!”
_হ্যা। আমি নিয়মিত রক্ত দেই। আমার কোনো শারীরিক সমস্যা নেই। আপনি চাইলে আমি রক্ত দিতে পারি।

***
ভেজা শার্ট তার গায়ে শুকিয়ে গিয়েছে। রক্ত দেওয়ার অভ্যাস থাকায় তাকে তেমন বিচলিত লাগছে না। বেড থেকে ধীরে ধীরে উঠে বসে তাশরিফ। হাত ঘড়িতে সময় দেখে সন্ধ্যা সাতটা। কোথাও রোদেলাকে দেখা যাচ্ছে না। কোথায় গেলো সে !

কিছুক্ষণ পরে দরজা ঠেলে রোদেলা ভেতরে ঢোকে। তার দুই হাতে দুটো ডাব। তাশরিফের কাছে এসে তার পাশে ডাব দুটো রাখতে রাখতে বলে, “আপনি অনেক দুর্বল হয়ে গিয়েছেন। এই দুটো আপনার জন্য।”

তাশরিফ মৃদু হেসে বলে,”অতটাও দুর্বল হইনি। মাত্র এক ব্যাগই তো দিয়েছি। উনি আপনার কি হয়,বোন?”
_হু।
_কি হয়েছিলো?
নরম সুরে জানতে চায় সে‌। রোদেলা কয়েক মূহুর্ত চুপ থেকে অস্ফুট স্বরে জবাব দেয়,”গর্ভপাত। পাঁচ মাস চলছিলো।”
তাশরিফের শুনে খারাপ লাগে,সে আর কোনো কথা বারায় না। রোদেলাকে দেখতে থাকে সে। কি অদ্ভুত মেয়েটা। রাস্তার মাঝখানে দাড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পরা মেয়েটা এখানে এসে সম্পুর্ন স্বাভাবিক। নিজেকে খুব শক্ত প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই কি সবসময় এই মেয়েটি নিজের দুর্বলতা লুকিয়ে রাখে। নিজের যন্ত্রনা গুলো লুকোতে গিয়েই কি স্বভাবে এতো কাঠিন্যতা প্রকাশ করে ফেলে রোদেলা !

“আপনি তো পুরো ভিজে গিয়েছেন। এভাবে কতক্ষন থাকবেন!”

_আমার ছোটো বোন আসছে বাবাকে নিয়ে এখানে, ও আমার পোশাক নিয়ে আসবে। অসুবিধা নেই।

তাশরিফ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। রোদেলা বলে,”কি ব্যাপার। আপনি উঠছেন কেনো?”
_আমার যেতে হবে।
_কিন্তু এই শরীরে এখনই বাইক চালাতে পারবেন?
_অসুবিধা নেই আই এ্যাম টোটালি ফিট।

রোদেলা আর কোনো কথা বলে না। কেউ নিজে থেকে যেতে চাইলে বারবার বাধা দেওয়াটা অনধিকার চর্চা করা হয়। তাই রোদেলা চুপ হয়ে থাকে।

তাশরিফ রোদেলার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দেয়,”আশা করি আপনার বোন শিঘ্রই সেরে উঠবে, তাকে এই তীব্র শোক কাটিয়ে ওঠার মতো শক্তি দিক আল্লাহ। ভালো থাকবেন।”

তাশরিফ চলে যায়। রোদেলা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সেদিকে,কথায় কথায় মানুষটাকে ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি। বেডের কাছে মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখতে পায় তাশরিফ তার হাত ঘড়ি টা ভুল করে ফেলে চলে গিয়েছে।
তাশরিফ চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই বৃষ্টি এবং রুহুল আমি এসে হসপিটালে পৌঁছায়। রুহুল আমিন এসে কান্নায় ভেঙে পরে।

“হে আল্লাহ! আমার কোন পাপের শাস্তি তুমি ওই নিষ্পাপ মেয়েটাকে দিচ্ছো? এতো কেনো ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে আমার মেয়ে গুলো কে?”

রোদেলা বাবার থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার বাবার কান্না দেখতে একটুও ভালো লাগে না। সহ্য করতে পারে না সে। অসহনীয় যন্ত্রণা হয় বুকে। ছোটো বেলায় যখন তারা অসুখে পরতো বাবা ঠিক এভাবেই কাদতো, অসহায়ের মতো। তিন মেয়ের প্রতি বাবার অপরিসীম ভালোবাসার প্রকাশ সেই একই রকম রয়ে গিয়েছে। একটুও কমেনি। জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রোদেলা। বৃষ্টির আনা শাড়ি টা তো পরে নিয়েছে কিন্তু সে বেশ টের পাচ্ছে তার ঠান্ডা লাগতে চলেছে।
“আপু।”
রোদেলা বৃষ্টির দিকে ফিরে তাকায়। মুখ শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গিয়েছে পরীর মতো সুন্দর দেখতে মেয়েটির। যে বয়সে বন্ধু বান্ধব নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে আনন্দ করবার কথা,সেখানে এইটুকু বয়সে সম্পর্কের সব রকমের জটিলটা, জীবনের তিক্ত বাস্তবতা দেখে ফেলেছে সে ।
রোদেলা নিষ্প্রান গলায় বলে,”কিছু বলবি?”
_মাকে জানাবো না?
রোদেলা কড়া গলায় বলে,”না!”
_মায়ের তো অধিকার আছে জানার।
_তোর উপর থাকতে পারে। আমার কিংবা আপুর উপর নেই।

বৃষ্টি কোনো কথা বলে না। চুপচাপ বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
মেঘলার জ্ঞান এখনো ফেরেনি। হাসপাতালের করিডোরে বসে অপেক্ষা করছে সবাই, অপেক্ষার প্রহর যেন কাটছে না।

***

“আপনি কেনো এসেছেন।‌ কি দেখতে এসেছেন?”
রোদেলার ধমকে খানিকটা ঘাবড়ে যায় মাইনুল। মেঘলার জ্ঞান ফেরার পরে মেঘলা কি সব বলে দিয়েছে ! কপালে চিন্তার রেখা তার।

নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে,” মেঘলার কি অবস্থা।”
_আপুর কি অবস্থা তা আপনার জানতে হবে না। আপনার বাচ্চা আর আপুর পেটে নেই। এবার আপুর প্রতি দরদের নাটক টা বন্ধ করুন।

মাইনুল চুপচাপ হজম করে নেয় রোদেলার অপমান। এই মেয়েটাকে সহজ ভাবলে চলবে না। এর সাথে তর্কে গেলেই বিপদ। নিজের ভোল পাল্টে নরম সুরে বলে,”আমার বৌয়ের প্রতি আমি দরদের নাটক দেখাবো কেনো!”

_বৌ আর থাকবে না। আপু সুস্থ হলেই তালাকের কাগজ রেডি করবো। কষ্ট করে এসে সাইন করে যাবেন।

বৃষ্টি দৌড়ে এসে বলে,”আপু বড় আপুর জ্ঞান ফিরেছে। চলো দেখা করে আসি।‌”

রোদেলা ছুটে চলে যায় মেঘলার কেবিনের কাছে। মাইনুল করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকে। মেঘলা যদি সব বলে দেয় তাহলে !

***
মায়া মায়া মুখটার দিকে তাকাতেই বুকটা হুঁ হুঁ করে ওঠে রোদেলার। বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে সে। মেঘলা তার দিকে তাকিয়ে আছে।‌ অস্ফুট স্বরে বলে,”খুব ব্যাথা করছে।”
বোনের ডান হাতটা কাছে টেনে চুমো খেয়ে বলে,”ডাক্তার অষুধ দিয়ে দিয়েছে। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

কয়েক মুহূর্ত পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে ওদের মাঝে। একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে মেঘলা বলে,”ও চলে গিয়ে বেঁচে গিয়েছে রোদেলা বল!”
কথাটি বলেই ঝরঝর করে কেঁদে দেয় মেঘলা। রোদেলা বোনকে আগলে নেয়। কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে বলে,” চুপ! একদম চুপ!”

মেঘলা বলতে থাকে,”না ও বেচেই গিয়েছে। এই পৃথিবীতে জন্মালে ও আরেকটা “মেঘলা” হতো, একটা “মেঘলার” মতো জীবন পেতো ও। আমার মতো এমন জীবন যে আমার শত্রুরও চাইনা আমি। সেখানে ও তো আমার সন্তান। আমি খুব খুশি হয়েছি রোদেলা।”
অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে মেঘলা। রোদেলা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”তোকে বাঁচাতে এমন টা করতে হয়েছে আপু। একটু ধৈর্য্য ধর! সব ঠিক হয়ে যাবে।”

_সব ঠিক হয়ে গিয়েছে রোদেলা। সবকিছু ঠিক হয়ে গিয়েছে। জানিস অনেক দুশ্চিন্তা হতো, ভাবতাম এই যে একজনকে পৃথিবীতে আনছি,আমি ভালো মা হতে পারবো তো! সবাই সবসময় বলে আমাদের গায়ে তো আমাদের মায়েরও রক্ত বইছে,আমরাও ওনার মতো হবো। আমিও ভাবতাম,আমিও যদি খারাপ মা হই! কিন্তু দেখ এখন টেনশন করার কিছুই নেই। আরে,আমি তো মা-ই হতে পারবো না! খারাপ মা কি করে হবো বল। টেনশনের কিছু নেই। কেউ ভুগবে না আর, আমার মাধ্যমে আর কোনো রোদেলা,মেঘলা,বৃষ্টি আসবে না এই পৃথিবীতে ভুগতে।
অঝোর ধারায় মেঘলার চোখ থেকে পানি বেয়ে নামছে। বুকটা অসম্ভব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সন্তান হারানোর কষ্ট, আজীবনে আর মা না হতে পারার যন্ত্রনায় তার কলিজাটা ছিরে বেরিয়ে যেতে চাইছে। রোদেলা শক্ত করে বোনের হাতদুটো মুঠোয় ভরে রাখে নিজের । বোনকে শান্তনা কিভাবে দেবে সে? বোনের যন্ত্রনাটুকুও বা নিভাবে ভাগ করে নেবে সে? এমন তো কোনো উপায় নেই। তার চেয়ে বোন একটু কাদুক। কাঁদলে যদি এক সমুদ্র যন্ত্রনার এক বিন্দুও চোখের পানির সাথে ঝরে যায় ক্ষতি তো কিছু নেই!

***
বৃষ্টি আর রুহুল আমিনকে রোদেলা সিএনজিতে তুলে দিয়ে আসে। আজও আয়েশা আর রোদেলা থাকবে মেঘলার কাছে। ডাক্তার বলেছে দুদিন পরে নিয়ে যেতে পারবে মেঘলাকে তারা। মেঘলার শশুর বাড়ি থেকে কেউ আসেনি দেখতে। রোদেলা মনে মনে দোয়া করেছিলো ওরা যেন না আসে। তাহলে সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারতো না,হসপিটালে কোনো হাঙ্গামা সে করতে চায়না।

রোদেলা ধীরপায়ে হেটে মেঘলার মাথার কাছে গিয়ে বসে। কপালে হাত রেখে মৃদু স্বরে ডাকে,”আপু।”

মেঘলা চোখ মেলে তাকায়। কোনো সারা না দিয়ে চুপচাপ তাকিয়েই থাকে। রোদেলা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”এখন বলো। কি হয়েছিলো? কিভাবে ঘটেছে এসব!”

রোদেলার সরাসরি প্রশ্নে মেঘলা চোখ মুখ শক্ত করে ফেলে, ঠোঁট জোড়া কাঁপতে থাকে তার। রোদেলা মেঘলার চোখ দেখে সবটা বুঝে নেয়। তার চোখে মুখে রাগ আর ঘৃনায় আগুন জ্বলে ওঠে,তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,”থানায় ডায়েরি করতে যাচ্ছি।”

মেঘলা রোদেলার হাত ধরে রাখে। রোদেলা বলে,”কি! এখনো বলবি বাদ দে রোদেলা‌? মানুষ টাতো আমাকে ভালোবাসে। এখনো এটা বলবি?”
মেঘলা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে,”নাহ বলবো না।”
_তাহলে আমায় আটকাচ্ছিস কেনো? তুই মরে যেতে পারতি আপু। তোর সন্তান মরে গেছে ওই লোকটার জন্য,তোর জীবনের চূড়ান্ত সর্বনাশ হয়েছে ওই জানোয়ারটার জন্য,তুই আমায় আটকাচ্ছিস কেনো?
ধমকে ওঠে রোদেলা। দুফোঁটা চোখের পানি গড়িয়ে পরে মেঘলার চোখ থেকে, নিচু স্বরে বলে,”ও না বাসুক,আমি তো একটা দীর্ঘ সময় ওকে ভালোবেসেছি। সেজন্য বাদ দে। আমি কারো শাস্তি চাইনা রোদেলা। তবে কি জানিস, লাথি টা সরাসরি আমার বুকে লেগেছিলো, আমি মাটিতে লুটিয়ে পরার কয়েক মুহূর্ত আগে পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে ও সত্যিই এমনটা করেছে।”

রোদেলা আহত দৃষ্টিতে মেঘলার দিকে তাকিয়ে থাকে। অস্ফুট স্বরে বলে,”তুই না চাইলেও আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো। জেলে পচিয়ে মারবো ওকে।”

***
“শুনুন।”
আয়েশা সিদ্দিকা ঘুরে তাকাতেই দেখতে পায় তারই বয়সের একজন ভদ্রমহিলা তার দিকে তাকিয়ে আছে। আয়েশার কাছে ভদ্রমহিলার চেহারা খানিকটা চেনা চেনা লাগে। মেঘলা, রোদেলা, বৃষ্টির চেহারার সাথে বেশ মিল আছে ভদ্রমহিলার। সবাই বলে ওরা তিনবোন মায়ের মতো সুন্দরী দেখতে। তবে কি ইনিই তিনি ! আয়েশা এর আগে কখনো দেখেনি মেঘলাদের মাকে। আয়েশা সিদ্দিকা পা থেকে মাথা অব্দি একবার তাকিয়ে বলে,”বলুন।”
ভদ্রমহিলার সাথে একজন ভদ্রলোক আছে। সে ভদ্রমহিলার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
“আপনার নাম কি আয়েশা?”
আয়েশা কিছুটা অবাক হয়। মাথা নাড়িয়ে বলে,”জ্বি, আপনি?”

_আমি মলি। নাম শুনেছেন হয়তো।

আয়েশা মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যা বলে।
মলি বলে,”202, এইটা মেঘলার কেবিন?”
আয়েশা মাথা নাড়ায়।

“রোদেলা।”
আয়েশার ডাকে দুবোন মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে চায়। আয়েশা বলে,”মেঘলার সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে।”
রোদেলা খানিকটা অবাক হয়। মেঘলার শশুর বাড়ি থেকে কেউ আসবে না তা জানে, তাহলে কে এসেছে! নানাবাড়ি থেকে কেউ!

“আপনারা ভেতরে আসুন।”
আয়েশা তাদের ডেকে একপাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কেবিনের পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢোকে নাজমুন্নেছা মলি এবং রুবায়েত ফরাজী।

তাদের দেখতে পেয়ে দুইবোন চোখ মুখ শক্ত করে ফেলে। রোদেলা বেডের সাদা চাদর খামচে ধরে বসে আছে। আয়েশা বাইরে চলে যায়। এখানে এখন তার থাকা ঠিক না। রুবায়েত ফরাজির হাতে কিছু ফলের প্যাকেট। তিনি টেবিলের উপর সেগুলো রেখে মেঘলার দিকে একবার তাকায়। তারপর রোদেলাকে বলে,”কবে যেতে পারবে এখান থেকে?”
রোদেলা কিছুক্ষণ চুপ থেকে জবাব দেয়,”কাল বিকেল অথবা পরশু সকালেই।”

রুবায়েত ফরাজী নামের লোকটা তারপর মলির দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমরা কথা বলো। আমি বাইরেই আছি।”

অতঃপর সে চলে যায়। মলি একটা চেয়ারে বসে। রোদেলা দৃঢ় কন্ঠে বলে ওঠে,”কেনো এসেছেন এখানে?”
মলি নিজের মেয়ে দুটোর মুখের দিকে তাকায়। রোদেলার দৃষ্টি বিছানার দিকে,মেঘলা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কেউই তার দিকে তাকাচ্ছে না। কয়েক মুহূর্ত পরে সে বলে,”আমি আমার মেয়েকে দেখতে এসেছি।”
রোদেলা খিলখিল করে হাসতে থাকে। মেঘলার মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। মলি চুপ চাপ রোদেলাকে দেখতে থাকে।
রোদেলা হাসি থামিয়ে বলে চোখ মুখ কঠিন করে ফেলে, তারপর বলে,”আমার ছোটো বেলায় আপনার কোনো এক পাড়াতো ভাই এসে আমাকে আদর করার ছলে রোজ বাজে ভাবে ছুঁতো। আমার খারাপ লাগলেও বিষয়টা বুঝে ওঠা কিংবা ব্যাখ্যা করার মতো বুদ্ধিমত্তা তখনও আমার হয়ে ওঠেনি। আপনাকে যখনই বলতে যেতাম যে “মা ওই মামাকে আমার ভালো লাগে না”,আপনি গায়ে মাখতেন না, তখন তো আপনি আপনার কথিত প্রেমিক নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, নিজের মেয়ের দিকে আপনার হুঁশ কোথায়! সেদিন গুলোর সেই দুর্বিষহ স্মৃতি গুলো ট্রমা হয়ে আমার পিছু নিয়েছে। আমাকে রোজ একটু একটু করে মারছে। বিশ্বাস করুন ওই সময়টায় আপনাকে আমার খুব খুব খুব প্রয়োজন ছিলো। আপনার আর বাবার ডিভোর্সের পরে,মেঘলা আপুর প্রথম যখন পিরিয়ড হলো। স্কুলে থেকে ম্যামের ফোন পেয়ে বাবা গিয়ে টিচার্স রুম থেকে মেঘলা আপুকে তার গায়ের একটা জ্যাকেট পেঁচিয়ে নিয়ে এসেছিলো । ভয়ে,সংকোচে,লজ্জায় এক সপ্তাহ আপু বাবার সামনে যায়নি। পেটে ব্যাথায় আপু খুব কাতরাতো পেটে হাত চেপে। বাবা কিছু বুঝতে পারতো না,তার বোঝার কথাও না। ওই সময়টায় আপনাকে আপুর প্রয়োজন ছিলো। একবার বৃষ্টির নিউমোনিয়া হলো, মা মা বলে প্রলাপ বকতো সারাদিন। ওই সময়টায় বৃষ্টির আপনাকে প্রয়োজন ছিলো। ওই সময় গুলোতে আপনাকে সত্যিই আমাদের তিন বোনের খুব খুব খুব প্রয়োজন ছিলো। বিশ্বাস করুন….এখন আর আপনাকে আমাদের প্রয়োজন নেই, একটুও নেই। আমরা নিজেদের কষ্ট নিজেরা লাঘব করতে শিখে গিয়েছি। অনেক বড় হয়ে গিয়েছি আমরা। আমাদের জীবনে আপনার সত্যিই আর কোনো প্রয়োজন নেই। তাই দয়া করে হুট হাট এভাবে আপনার উপস্থিতি দেখিয়ে আমাদের বিব্রত করবেন না।”

মলি তাকিয়ে থাকে তার মেজো মেয়ের দিকে। কয়েক মুহূর্ত পুরো কেবিন জুরে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে। সত্যি কথাই তো বলেছে রোদেলা,এর জবাব তো তার কাছে নেই! কিছুক্ষণ পর সে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”আয়েশা নামের ভদ্রমহিলাকে দেখলাম। দেখে খুব ভালো মানুষ মনে হলো।”
_হু, ভালো মানুষ এবং একজন ভালো মা হওয়ার ও চেষ্টা করছে সে।
একবাক্যে জবাব দেয় রোদেলা। মেঘলা নীরবতা ভেঙে দৃঢ় কন্ঠে বলে ওঠে,”রোদেলা ওনাকে এখন যেতে বল প্লিজ। শরীরটা যন্ত্রনায় বিষিয়ে উঠেছে,মনটাকেও বিষিয়ে দিতে নিষেধ কর।”

চলমান….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here