দ্বিতীয় ফাগুন পর্ব -০৮

#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্বসংখ্যা_৮
#লেখিকা_Esrat_Ety

“আমার জীবনের আপডেট হলো খুবই আশ্চর্যজনক ভাবে আমি একজনের প্রেমে পরেছি। আমি যার প্রেমে পরেছি তার প্রেমে পরার কথা আমার ছিলো না। এটা খুবই আশ্চর্যজনক একটি ব্যাপার আমার কাছে। ভদ্রমহিলার নাম রোদেলা আমিন। আমি অবশ্য পেঁচা মুখী বলে ডাকি মনে মনে। আমি তার প্রেমে পরেছি,পরতেই পারি, স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে তিনটা সমস্যা আছে। সমস্যা নাম্বার এক হচ্ছে আমি যার প্রেমে পরেছি সে আমার থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত স্বভাবের একজন মানুষ। আমি সদা হাস্যোজ্জ্বল,ফ্রেন্ডলি আর সে গোমরামুখো,রাগী, বদমেজাজি। সবসময় মুখে চাবুক নিয়ে ঘোরে। আমার সাথে তার কোনোই মিল নেই। এটাও আপাতত বড় সর কোনো সমস্যার মধ্যে আমি ধরছি না ,আমার দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে আমি যে ভদ্রমহিলার প্রেমে পরেছি তা ওই ভদ্রমহিলাকে বলার সাহস আমার নেই। একেবারেই নেই। সমস্যা নাম্বার তিন, আমার মা বিয়ের জন্য মেয়ে দেখেই যাচ্ছে মনে হচ্ছে এবছর তিনি ঘরে বৌ এনেই ছাড়বেন। কিন্তু যেখানে একজনকে বেশ মনে ধরেছে আমার সেখানে অন্যত্র বিয়ে করাও সম্ভব না আমার পক্ষে। আর সমস্যার উপরে সমস্যা যেটা হলো, এই রোদেলা আমিনের কথা মায়ের কাছে বলার সাহসও আমার নেই কারন আমার মা বৌ হিসেবে যেমন মেয়ে চায়, রোদেলা আমিন সম্পূর্ণ তার বিপরীত।”

মোবাইলের নোট প্যাডে কথাগুলো লিখে ফেলে তাশরিফ। অগোছালো কিছু কথা।‌ সে নিজেও বুঝতে পারছে না কথাগুলো কেনো লিখেছে সে। দরজায় টোকার আওয়াজ পেয়ে মোবাইল টা রেখে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয় সে। তাহমিনা দাঁড়িয়ে আছে,তার মুখ হাসি হাসি।
“কিরে ঘুমিয়ে পরেছিস?”
_এটা কেমন প্রশ্ন মা? তুমি দেখছো আমি দাঁড়িয়ে আছি তোমার সামনে। ঘুমিয়ে পরেছি মানে কি?”
তাহমিনা হাসে,বলে,”হয়েছে কি বল তো আসলে একটু আনন্দিত আমি তাই এলোমেলো কথা বের হচ্ছে মুখ থেকে।”
_এতো কিসের আনন্দ তোমার?
তাহমিনা ঘরে ঢুকে তাশরিফের বিছানায় বসে তার মোবাইলটা তাশরিফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”একে দেখ! ট্যারা হয়ে যাবি একেবারে!”
তাশরিফ বিরক্ত মুখে বলে,”মা,আবার!”
_আরে শোন না, তোর কথাই রেখেছি। এই মেয়েটা এইবার উচ্চমাধ্যমিক পরিক্ষা দিচ্ছে। অতটাও ছোটো না, এর ভোটার আইডি কার্ড আছে ,আমি খোজ নিয়েছি। তোর বাবা আমাকে পাঠিয়েছে তোর মতামত জানতে।
তাশরিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে,”মা। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি,আমি বিয়ের কথা এখন আর ভাবতে চাচ্ছি না। আমাকে কিছুদিন সময় দাও। অফিসে প্রচুর প্রেশার যাচ্ছে, তাই আপাতত এগুলো বন্ধ করো। আমার বিয়ে করার যখন দরকার হবে আমি তোমাকে বলবো।”

তাহমিনা মন খারাপের মতো করে বলে,”আল্লাহ দুইটা ছেলে দিয়েছে আমায়। একটা মেয়ের অভাব প্রতি মূহুর্তে বোধ করি। তোরা দুই ভাই তো মহা ব্যস্ত।‌ আর তোদের বাবা তো রিটায়ারমেন্টের পরে আরো ব্যস্ত হয়ে পরেছে। তাকে তো ঘরেই পাওয়া যায়না। আমার সময় কিভাবে কাটে খোজ নিস কেউ? ”

তাশরিফ হাসে। তাহমিনা বলে,”তোর সমস্যা কোথায় বল আমাকে! কাউকে পছন্দ করলে তো বলতে পারিস। কাউকে পছন্দও করছিস না। চাস কি তুই?”

_তেমন কিছু না। একটু সময় চাচ্ছি। আপাতত বিয়ের কথা ভাবতে চাচ্ছি না। তুমি একটু অপেক্ষা করো। প্লিজ লক্ষি মা!

***
“চিন্তা করো না। আপু সুস্থ হয়ে যাবে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”

বৃষ্টির শুকনো মুখটার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় আদিল বলে। মাথাটা নিচু করে রেখেছে মেয়েটা। আদিলের ইচ্ছে করছে থুতনি ধরে মুখটা কিছুটা উপরে তুলে মেয়েটির চোখ দুটো দেখতে। কিন্তু এতো সাহস আদিলের নেই। ঘড়ির কাঁটা চলতে থাকে, তাদের মধ্যে নীরবতা ভাঙে না। দুজনে পাশাপাশি বসে আছে প্রায় একঘন্টা হয়ে গিয়েছে। আজ বৃষ্টি চুলে বেনী করেছে। কপালের কাছের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। তবুও বৃষ্টিকে কি সুন্দর লাগছে ! আদিল বেশ কিছুক্ষণ পরে অনেকটা সাহস সঞ্চয় করেই বৃষ্টির হাতের ওপর একটা হাত রাখে। সাথে সাথে বৃষ্টি নিজের হাত টা সরিয়ে নেয়। আদিল ভীত চোখে বৃষ্টির দিকে তাকায়। মেয়েটা মাইন্ড করলো না তো আবার !
বৃষ্টি হাত গুটিয়ে নিজের কোলের কাছে রাখে, তারপর বলে,”কেনো দেখা করতে এলে এখন? ফোনেও তো বলতে পারতে !
_দেখতে ইচ্ছে করছিলো খুব তোমাকে।
_দেখা হয়ে গেলে বলো, আমাকে উঠতে হবে।

_হয়ে গিয়েছে। চলো তোমাকে তোমাদের গলির সামনে নামিয়ে দেই।

দুজন হাঁটতে থাকে পাশাপাশি। কিছুক্ষণ পরে আদিল বলে,”তোমার দুলাভাইটাকে এখনো জেলে দিচ্ছো না কেনো? ওটা তো আস্ত একটা জানোয়ার।”
_মেজো আপু চাইছে লিগ্যাল একশন নিতে। বড় আপু বাঁধা দিচ্ছে।

_হু,বড় আপু খুবই কাইন্ড হার্টেড পারসন বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে তো শয়তান টাকে ছাড় দেওয়া যাবে না। এক কাজ করলে কেমন হয়? আমার কিছু গুন্ডা টাইপের বন্ধু বান্ধব আছে,ওদের দিয়ে একটু হালকা করে ……
_পাগল হয়েছো তুমি? সে একজন পুলিশ। হিতে বিপরীত হবে। আর তুমি এরকম বখাটে ছেলেদের মতো কথা বলছো কেনো?

আড়চোখে বৃষ্টি তাকায় আদিলের দিকে। আদিল হেসে ফেলে,”তোমার মেজো আপুই তো সেদিন বললো,আমি নাকি বখাটে টাইপ দেখতে, গাঁজা ফুকি।”

বৃষ্টি কপাল কুঁচকে ফেলে। আদিল হাসে, কিছুক্ষন পরে বলে,”সত্যিই। তোমার মেজো আপুর মতো এতো সিরিয়াস মহিলা আমি খুবই কম দেখেছি জীবনে। এ যে বাড়িতে বৌ হয়ে যাবে তাদেরকে “না ঘাটের,না ঘরের” বানিয়ে রাখবে। যাই হোক , বাড়ি গিয়ে সিমেন্ট আপুকে আমার সালাম দিও।”

আদিল হাসতে থাকে। বৃষ্টি আদিলের দিকে চোখ মুখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে।

***
“স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কয়েক দিন ধরে মুখ দেখাদেখি বন্ধ। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেন না। আর যতটুকু বলা প্রয়োজন, তা ইশারায় জানিয়ে দেন। স্বামী দেখলেন, পরের দিন ভোরে তাঁর ফ্লাইট। তাঁকে উঠতে হবে ভোর পাঁচটায়। কিন্তু স্ত্রী যদি জাগিয়ে না দেন, তবে কিছুতেই ভোরবেলায় তাঁর ঘুম ভাঙবে না। কিন্তু তাঁরা কথাও তো বলেন না। কী আর করা! স্বামী একটা কাগজে লিখে দিলেন, ‘দয়া করে ভোর পাঁচটায় আমাকে জাগিয়ে দেবে।’ কাগজটি টেবিলের ওপর রেখে দিলেন, যাতে স্ত্রী দেখতে পান। কিন্তু পরের দিন যখন তাঁর ঘুম ভাঙল, তখন সকাল নয়টা বেজে গেছে এবং বিমানও তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে। তিনি রেগে টং হয়ে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন তাঁকে জাগানো হলো না। এদিকে স্ত্রীও সমান তেড়িয়া, ‘এত রাগছ কেন? আমি তো তোমার ওই কাগজটিতে লিখে রেখেছি যে এখন ভোর পাঁচটা বাজে, ঘুম থেকে ওঠো। কিন্তু তুমি তো টেরই পেলে না। আমার কী দোষ?’”

একাউন্টস ডিপার্টমেন্টে চাপা হাসির শব্দ হচ্ছে। খলিলুর রহমান স্বভাব মত জোকস্ বলে সবাইকে হাসানোর চেষ্টা করছে। কারো কারো তার জোকস্ শুনে হাসি আসছে না,তবুও তারা হাসির ভান করছে।‌ কারন সামনে জিএম স্যার একটা প্রমোশনের ঘোষণা দেবেন। খলিলুর রহমানের রেফারেন্স ছাড়া প্রমোশন অসম্ভব। তাই তাকে খুশি রাখতে তার জোকস্ শুনে হাসতে হবে। রোদেলা নিজের ডেস্কে চুপচাপ বসে আছে। তাশরিফ এই অফিসের কেয়ার টেকার মিন্টুর কাছ থেকে চায়ের কাপ টা নিয়ে রোদেলার দিকে এগিয়ে যায়। রোদেলা তাশরিফের দিকে মাথা তুলে তাকাতেই তাশরিফ একটা ধাক্কার মতো খায়। কেমন একটা অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছে তার, যা আগে হতো না রোদেলাকে দেখে। সে খানিকটা ঘামছে, যদি তার চোখ দেখে রোদেলা সবটা বুঝে ফেলে!
একটা শুকনো হাসি দিয়ে তাশরিফ বিনয়ের সাথে বলে,”আপনার বোনের কি খবর?”
_এইতোহ। বাড়িতে নিয়ে গিয়েছি তিনদিন হলো।
ম্লান হেসে বলে রোদেলা। তারপর আবার বলে,”আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। সেদিনের জন্য।”
তাশরিফ কথাটি শুনে যেন বিনয়ে নুয়ে যায়,”প্লিজ ধন্যবাদের কিছু নেই। মানুষ হিসেবে এটা আমার কর্তব্য।”

রোদেলা শুকনো হাসি দিয়ে আবারো নিজের কাজে মন দেয়। তাশরিফ বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর নিজেই নিজেকে বলে,”এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো তাশরিফ? ধন্যবাদ তো দিয়ে দিয়েছে, আর কি শুনতে চাচ্ছো তুমি? তুমি একটা উপকার করেছো মাত্র,তার বিনিময়ে সে তো আর “আই লাইক ইউ” বলবে না। বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে ছ্যাবলা ধরনের পুরুষ প্রমান না করে নিজের কাজ করো গিয়ে যাও।”
তাশরিফ পা বাড়িয়ে নিজের ডেস্কে ফিরে যেতে উদ্যত হয়। রোদেলা পেছন থেকে বলে ওঠে, “শুনুন তাশরিফ ভাই!”

তাশরিফের মনে হলো ঠিক এইমাত্র কেউ তার গালে একটা ঠাঁটিয়ে চড় মেরেছে। রোদেলা তাশরিফকে অফিসের অন্যান্য নারী কলিগদের মতো “তাশরিফ ভাই” বলে ডেকেছে। তাশরিফ বিব্রত হয়, সে প্রচন্ড বিব্রত এবং আহত দৃষ্টি দিয়ে রোদেলার দিকে চায়। রোদেলা একটা প্যাকেট তার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে,”সেদিন ব্লাড দেওয়ার সময় হাতঘড়ি টা খুলে রেখেছিলেন ‌। ওটা আর নিয়ে আসেন নি। নিন ধরুন।”
তাশরিফ রোবটের মতো রোদেলার কাছ থেকে প্যাকেট টা নিয়ে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে। সেখানে গিয়ে সে আবারো রোদেলার দিকে তাকায়। ছেলেদের কাছে পছন্দের নারীর মুখ থেকে “ভাই” ডাক শোনা আর দ্রৌপ্রদির গা থেকে বস্ত্রহরণ করা একই রকমের লাঞ্ছনার একটি ব্যাপার। বার বার মাথা ঘুরিয়ে রোদেলার দিকে বিরস মুখে তাকায় সে, কিছুক্ষণ পরে নিজেই নিজেকে শান্তনা দেয়,
” তাশরিফ হাসান রিল্যাক্স, ‘তাশরিফ ভাই’ ডেকেছে। ভাইয়া তো আর বলেনি। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। টেনশনের কিছু নেই তাশরিফ হাসান। যাস্ট রিল্যাক্স!

***
“হ্যা আমি আমার বোনকে নিয়ে যথাসময়ে উপস্থিত থাকবো। আপনি তাদের নোটিশ দিয়ে দিন‌। ডিভোর্সের বিষয় টা ঝুলে থাকুক আমি চাই না। আমার বোনকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা সুস্থ জীবন দিতে চাই আমি।”
উকিলের সাথে কথা বলতে বলতে গেইটের বাইরে পা রাখতেই রোদেলা দাঁড়িয়ে পরে। একটু দূরেই জাহিন দাঁড়িয়ে আছে। রোদেলা খানিকটা বিব্রত হয়। তার এখন কি করা উচিত? জাহিনের সাথে কথা বলা উচিত নাকি তাকে উপেক্ষা করে এখান থেকে রিক্সা নেওয়া উচিৎ। জাহিন এগিয়ে আসছে। রোদেলা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে,যেন তার পা দুটো কেউ শক্ত করে আটকে রেখেছে। জাহিন রোদেলার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। রোদেলা কয়েক পলক দৃষ্টি দিয়ে জাহিনকে দেখে,”এখানে কেনো এসেছো?”

জাহিন বলে,”খুব অন্যায় করে ফেলেছি বুঝি?‌”

রোদেলা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে তারপর বলে,”বিয়ে ঠিক হয়েছে তোমার?”

_না। মেয়ে দেখছে। একজনও পছন্দ হচ্ছে না মায়ের।
_ আর তোমার? তোমারো কি পছন্দ হচ্ছে না? বিয়ে টা তো তুমি করছো, সংসার টা তো তুমি করবে।

_রোদেলা। আমরা কি আরো একবার বসে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিতে পারি?

রোদেলা হেসে ফেলে।
“কিসের আলোচনা? শোনো “বিয়ে” নামক শব্দটার প্রতিই আমার বিতৃষ্ণা জন্মে গিয়েছে। তাই বিয়ে,সম্পর্ক বা যেকোনো ধরনের কমিটমেন্ট থেকে দূরে থাকতে চাই আমি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি জীবনে কখনোই বিয়ে টিয়ে করবো না আমি। তুমি তোমার মায়ের পছন্দ মতো একজনকে বিয়ে করে নাও।”

দূর থেকে রোদেলাকে দেখতে পেয়ে দাড়িয়ে পরে তাশরিফ। রোদেলার সাথে এই ছেলেটি কে? হঠাৎ করে মুখভঙ্গি বদলে যায় তাশরিফের,তাকে খুবই বিষন্ন দেখাচ্ছে। কয়েক পলক রোদেলার দিকে তাকিয়ে বাইক স্টার্ট করে সে।

***

ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পরে রোদেলা। সে বসেছে ঠিক মেঘলার মাথার কাছে।‌ মেঘলা ঘুমিয়ে আছে। হসপিটাল থেকে বাড়িতে আনার পর থেকে সে মেঘলার সাথে এক ঘরে শোয়। যতক্ষন বাড়িতে থাকে মেঘলাকে একা থাকতে দেয়না রোদেলা। আয়েশা সিদ্দিকা ঘরে ঢোকে রোদেলার জন্য শরবত নিয়ে। মেঘলার মুখের দিকে তাকিয়ে রোদেলা আয়েশা সিদ্দিকাকে প্রশ্ন করে,”খাচ্ছে ঠিক মতো?”
_একটু করে মুখে দেয়।‌ তারপর প্লেট সরিয়ে রাখে।

শরবত খেয়ে আয়েশার হাতে গ্লাস তুলে দিয়ে রোদেলা মেঘলার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। রোদেলার হাতের স্পর্শে মেঘলা ধরফরিয়ে উঠে বসে। রোদেলা সাথে সাথে বলে,”শান্ত হ আপু। আমি রোদেলা।”
মেঘলার শরীর একটু একটু কাঁপছে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নেয় সে। রোদেলা বোনকে দেখতে থাকে। তারপর বলে,”বাজে স্বপ্ন দেখেছিস?”
মেঘলা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”আমার জীবনের থেকে বাজে নয়।”

রোদেলা চুপ করে থাকে। মেঘলা বলে ওঠে, “ও একবারো ফোন দেয়নি তাইনা?”

রোদেলা কিছু বলে না। সে তাকিয়ে দেখছে একটা মেয়ে কতটা অবলা হতে পারে ! নিজের জীবনের চূড়ান্ত ক্ষতির পরেও সেই মানুষের মতো দেখতে ফেরাউনটার কথা জিজ্ঞেস করছে ! ভালোবাসলে এভাবেই বুঝি অন্ধ হয়ে যেতে হয় ! রোদেলা তো অন্ধ হয়নি ! তবে কি রোদেলা কখনো ভালোই বাসেনি!

বোনকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে বসে থাকে রোদেলা। মেঘলা কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠে,”জানিস। তোর গা থেকে কেমন একটা মা মা গন্ধ পাচ্ছি আমি রোদেলা।”

রোদেলা হাসে। চোখের কোনায় দুফোঁটা পানি এসে ভীড় করেছে। সেটুকু হাত দিয়ে মুছে ফেলে সে!

বৃষ্টি হুট করে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে। দুইবোনকে দেখে অভিমানী সুরে বলে,”কখনো তো আমাকে একটু আদর করো না কেউ। আমাকে তো একটু জরিয়ে ধরো না।”

রোদেলা এক হাত বাড়িয়ে বৃষ্টিকে ডাকে। বৃষ্টি দৌড়ে গিয়ে দুই আপুকে জরিয়ে ধরে।

***
একটু দেরি করেই আজ অফিসে এসেছে রোদেলা। আসার পথে উকিলের চেম্বারে গিয়েছিলো কথা বলতে। সেখান থেকে আসতে আধা ঘন্টার মতো দেড়ি হয়ে গেছে। আতংকে জমে গিয়েছিলো প্রায় সে। ভেবেছিলো অফিসে ঢুকেই আজ হেড অব দ্যা ডিপার্টমেন্টের ঝারি খাবে সে। কিন্তু সে অফিসে পৌঁছে একটু অবাক হয়।‌ পুরো অফিসে আজ মিষ্টি বিলি হচ্ছে। কারন জানতে মেহরিনকে বলে রোদেলা,”কি ব্যাপার আপা! আজ কি বিশেষ কিছু হয়েছে অফিসে?”

মেহরিন খুবই আনন্দিত গলায় বলে,”হয়েছে মানে‌ ! আজ অফিসে মতিঝিল ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার পদে প্রমোশনের নাম ঘোষণা করেছে! সব তাবড় তাবড় সিনিয়র এম্প্লয়িকে টেক্কা দিয়ে প্রমোশন টা কে পেয়েছে জানো? তাশরিফ! আমি তো আগেই জানতাম।”

রোদেলা অবাক হয়ে তাশরিফকে দেখে। তাশরিফ হেসে হেসে সবার থেকে শুভেচ্ছা গ্রহণ করছে।
মেহরিনের দিকে তাকিয়ে রোদেলা বলে,”আপনি যেভাবে খুশি হচ্ছেন মনে হচ্ছে প্রমোশন টা আপনি পেয়েছেন।”
_আরে খুশি হবো না? আমি তো ভাবছি আজকেই আমার ননদের কথাটা তুলবো তাশরিফের মায়ের কানে। ওদের বাড়িতে আমার যাওয়া আসা আছে!

তাশরিফ এখন একা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে একা দেখে রোদেলা তাশরিফের দিকে এগিয়ে যায়। তাশরিফ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। রোদেলা বলে,”অভিনন্দন তাশরিফ ভাই।”

আবারো “ভাই” ডাক শুনে বেশ বিরক্ত হয়ে যায় তাশরিফ। রোদেলার অভিনন্দন গায়ে না মেখে চোখ মুখ কুঁচকে বলেই ফেলে,”আপনি আমাকে তাশরিফ ভাই বলে ডাকছেন কেনো?”

আচমকা প্রশ্নটি শুনে রোদেলা খানিকটা অবাক হয়। তারপর বলে,”আপনি আমার সিনিয়র,নাম ধরে ডাকবো নাকি!”

রোদেলার উত্তরে তাশরিফ বেশ স্বস্তি পায়। সিনিয়র বলে “তাশরিফ ভাই” বলে ডাকছে! মনে মনে আতংকে ছিলো সে, ভেবেছিলো রোদেলা বলে ফেলবে,”আপনি আমার ভাইয়ের মতো তাই আপনাকে ভাই ডাকি!”

রোদেলা বলে ওঠে,”ও সরি। আপনাকে তো এখন থেকে স্যার ডাকতে হবে! আমি ভুলেই গিয়েছিলাম!”

রোদেলার কথায় তাশরিফ লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে। হেসে ফেলে রোদেলাও….

তাশরিফ মনে মনে বলতে থাকে,”দেখলে তো তাশরিফ! তোমায় ভাই ভাবছে না সে। ভয়ের কিছুই নেই। যাস্ট রিল্যাক্স!”

চলমান……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here