“দ্বিতীয় বাসর’ (গল্প),পর্ব-৮৫
হাসিনা সাঈদ মুক্তা
একটু পর জামিল আসে,হাতে করে আইসক্রীম নিয়ে।
জামিলকে দেখা মাত্র সিস্টার প্রিসিলা ছুটে আসে, সুধায় তাকে,
“জামিল প্লিজ মেয়েকে একটু বোঝাও, সি হার্টিং মি,ডাসেন্ট আন্ডারস্যান্ড মি আই এম হার মাম..
প্লিজ ডু সামথিং…’
জামিলের জবাবা,
“সেইম অন ইউ পাঁপিয়া, আমি কি বোঝাবো মেয়েকে?
যখন বুঝিয়েছিলাম তখন শুনো নি তুমি আমার কথা,দ্যাট আই ওয়ার্নিং ইউ সো মেনি টাইম?ইচ এন্ড এভরি ডে…এন্ড ইউ? একটা মিথ্যা মরিচীকার পেছনে ছুটেছো,হাউ এডামেন্ট ইউর এটেচুড দ্যাট মেইক ইউর লাইফ ডেসপারেটেড! আমার আর কিচ্ছু বলার নাই,সরি আই কান্ট ডু নাথিং ফর ইউ…’
পেছনে দাঁড়ানো কিছু ক্যাথলিক খিষ্ট্রান যারা সুদূর ভারতবর্ষ থেকে এখানে এসেছে দশর্নাথী এবং প্রতিনিধি হয়ে,তারা এবার দাঁড়িয়ে পড়ে সিস্টার প্রিসিলার আর্তনাদ দেখে।
তাদের কারো সুপারিশের মাধ্যমে পাঁপিয়া এখানে নাম, পরিচয় বদলাতে সক্ষম হয়েছিল।
সবার গলাতেই আইডেন্টিটি কার্ড ঝুলছিল বিধায় তন্নী তার মাকে সিস্টার প্রিসিলা বলে ডেকেছিল।
অদূরে দাঁড়ানো তাদের সভাপতি ফাদার জনসন বাকিংহাম প্রাসাদে যারা টুরিস্টদের গাইড করে তাদের সাথে কথা বলছিলেন। তার সাথে মধ্যবয়স্ক চশমা পড়া মহিলা এবার এগিয়ে আসে সিস্টার প্রিসিলার দিকে।
তার কাঁধে হাত রেখে ঝুকে বলে,
“হু ইজ পাঁপিয়া,সিস্টার প্রিসিলা?এন্ড হুজ দিস জ্যান্টলম্যান উইথ দিস ইয়াং লেডি?ইয়ে লাড়কি কৌন হ্যায়?অর তুমপে চিল্লাতে কিউ হ্যায়?’
প্রিসিলা সিস্টারের মুখে এবার কোনো ভাষা নেই,,,
ধাপ্ করে বসে পড়ে দুহাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করে গেয়ে ওঠে যেন সে।
ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,
“ইয়েস আই ডিড অ্যা গ্রেইট সিন আই নো…আই নো…বাট প্লিজ ইউ পিপল ডোন্ট সে লাইক দিস? প্লিজ ফরগিভ মি…প্লিজ…’
“ডোন্ট ওয়ান্ট ফরগিভনেস টু আস… ইফ ইউ ওয়ান্ট টু সে লাইক , দ্যান গো টু বন্ধন আঙ্কেল এন্ড আন্টি…দো ওয়াটএভার ইউ ডিট ইটস নট এবল টু গিভ ইউ ফরগিভ বাট ইউ মাস্ট সে দ্যাট টু দেম। দ্যা হেল্পলেস প্যারেন্টস অফ দ্যাট ইন্নোসেন্ট বেবী…’
বন্ধন এতক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবই খেয়াল করলো।
তন্নী তার মায়ের প্রতি যে তীব্র ঘৃনা ও কড়া কড়া কথা বল্ল তা যেন বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে তার কানে ভেসে উঠলো।
যদিও তন্নী,জামিল বা সিস্টার প্রিসিলা ওরফে পাঁপিয়া কেউই তাকে লক্ষ্য করেনি।
কারন বন্ধন তার মাথায় বড় হ্যাট ও সানগ্লাসের আড়ালে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিল,শেষ পর্যন্ত তন্নী বা জামিল কি আচরন করে তা দেখার জন্যে
বন্ধন এতদূর শুধু পাঁপিয়ার সাথে বোঝাপড়া করার জন্যে আসেনি তার উদ্দেশ্যে ছিল,যে করে হোক তাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে তার উচিত শাস্তির ব্যবস্থা করানো।
তার সাথে আর্মি মেজর,ব্রিগেডিয়ার, সচিব,মানবাধিকার কর্মকর্তা সহ কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে সেরকম পরিকল্পনাও ছিল কিভাবে সেটা করানো যায়।
তারা তাকে যতটা সম্ভব সহযোগিতা করবে এও জানিয়েছিল।তাই এয়ারমার্শাল বন্ধন আহমেদ বাবু ইউরোপের এ দেশটিতে তার মিশনের জন্যে আসে সাথে সাথে এই মিশনেরও চিন্তাভাবনা করেছিল।আর সেকথা সে তার সহপাঠী ও প্রিয় বন্ধু জামিলকেও জানিয়েছিল।
সে মোতাবেক তারা একসাথেই এসেছিল এখানে।
তদ্রূপ এই ঘটনাটি দেখার পর তার এসমস্ত চিন্তাভাবনা একেবারেই উবে যায়।
তন্নী এও বলে দিয়েছে,
“লিসন মিস সিস্টার প্রিসিলা? ডোন্ট ফল ইউর ক্রকডাইল টিয়ার্স,দ্যাট হেজ নো ভ্যালু ইন আওয়ার লাইফ বিকজ ইউ অলরেডি হ্যাভ ফিনিশড আওয়ার লাইফ…এন্ড ওয়াট ডিড ইউ ডু দেয়ার হ্যাস নো ফরগিভনেস টু আস ইভেন বন্ধন আংকেল এন্ড মিতু আঙ্গটি….সো প্লিজ লিভ আস এলোন ফ্রম আওয়ার লাইফ…ইউ রিমুভড অ্যান ইন্নোসেন্ট বেবী ফ্রম দ্যায়ার পেরেন্টস, নাউ হাউ দ্যাট দ্যা ফিল ওয়েন ইট উড বি হ্যাপেন টু ইউ….ইউ হ্যাভ টু ফিল ইট…’
বন্ধনের মনে হলো যা শাস্তি পাবার পাঁপিয়া পেয়ে যাচ্ছে এবং পাবে।এটা নিয়ে এখন তার আপাতোত মাথা না ঘামালেও চলবে।
সে তার প্রিয় পরিবারকে ফেলে এখানে এসেছে।মিশনও শেষ তার।
বাবাইটাকেও পাঠিয়ে দিয়েছে মেঝো আবীরের কাছে অস্ট্রেলিয়ায়।
“আর মিতুটাও অসুস্থ আমাকে ছাড়া না জানি কত অসহায়?’
বুক থেকে যেন বিশাল ভারী ওজনের একটা পাথর সরে গেল বন্ধন বাবুর।
খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় সে।জামিলকে ফোন করে জানায় সে চলে যাবে দেশে তার পরিবারের কাছে।জামিলও তাতে সায় দেয়।
বন্ধন তার দেশে ফিরে আসার জন্যে ভীষনরকম উদগ্রীব।
তবে তার আগে তার কি যেন একটা মনে হয়,
“আমার মিতুর কাছে যাওয়ার আগে দ্রুত আমায় যেতে হবে আর একটি জায়গায়,পবিত্র সে জায়গা….!'(চলবে)”দ্বিতীয় বাসর’ (গল্প),পর্ব-৮৬
হাসিনা সাঈদ মুক্তা
মিতালী খুব সযতনে তার স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
বন্ধন বাবু যখন ঘুমান তখন মিতুর ভীষন মায়া হয়,কত রাত হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে সে খেয়াল করে দেখেছে বাবুকে।
একদম শিশুর মতো একটা নিষ্পাপ মুখ হয়ে যায় যখন বন্ধন ঘুমিয়ে পড়ে।চোখের ঘন পাঁপড়ী গুলো মিতুর ছুঁয়ে দেখতে মন চায় তখন।
রাতের আঁধারে কয়েকবার চুমু বসিয়ে দিয়েছে তাতে, মিতু চুপটি করে যদিও তা অল্প।যদিও মানুষটার সাথে তার একবছরেরও কম পরিচয় ভালোভাবে , আর হবেই বা কি করে?
যখন বাবাইকে সে পড়াতে আসতো বিয়ের আগে তখন তো ঠিকমতো চিনতোই না মিতু তার বন্ধন বাবুকে।
হঠাৎ ওর মনে পড়ে যায়, বিয়ের বেশ আগে মিতালীর সাথে বন্ধনের একবার দেখা হয়ে গিয়েছিল।
সেদিন ছিল গতবছরের আগের বছরের একটি দিন।অর্থাৎ যে বছর মিতুর বিয়ে হয় তার আগের বছর।
বাবাই এর জন্মদিন ছিল সেই দিন।
বাবাই তার মিসকে প্রথম থেকেই ভীষন পছন্দ করতো।
জন্মদিনে মিতু আর তাকে পড়াতে চাইনি।তবে বাবাই এর একটা আবদার ছিল মিতুকে আসতেই হবে।
মিতু সাধারনত বিকেল পাঁচটার দিকে পড়াতে আসতো।
তবে সেদিন সন্ধ্যারর পর আসলো,মুহিন এসেছিল সাথে।
মিতু সেদিন তার মায়ের একটা শাড়ী পড়ে এসেছিল,হালকা নীল রঙা।
কপালে বরাবরের মতো ছিল ছোট্ট টিপ আর চোখে কাজল হালকা লিপষ্টিক।
বাবাই এর জন্যে নিয়ে এসেছিল একটা সুন্দর স্কুল ব্যাগ আর রঙ পেন্সিল।
নীচের রুমটায় এসে মিতু খেয়াল করলো বাবাই উঁচা লম্বা একজন ভদ্রলোকের গলা জড়িয়ে আল্লাদি করছে আর ভীষন খুশি সে।
“ভদ্রলোক বোধহয় বাবাই এর বাবা?আমি তো ভেবেছিলাম আরও বয়স্ক হবে?কে জানে বাবাই এর চাচ্চুও হতে পারে…?’
বন্ধন সেদিন পড়েছিল শুভ্র সাদা পাঞ্জাবি আর চেকরঙা ট্রাউজার।
মিতুর পায়ের আওয়াজ শুনেই বাবাই দৌড়ে আসে,মিতুকে দেখে বেজায় খুশি।
“মিস আপনি এসেছেন?আসেন এখন কেক কাঁটবো।’
মিতু আর মুহিন আশেপাশে খেয়াল করল,
“আর কেউ আসে নি বাবাই?’
“না আনটি।’ বাবাই আনটিও ডাকতো মাঝে মাঝে।
“সে কি তোমার বন্ধুরা, আত্মীয় স্বজন?’
নানু আসলেন সেসময়,মিতুকে বল্লেন,
“বোইন সে কথা আর কি বলমু,ছোট বাবুর মা মারা যাবার পর ওর আর জন্মদিন করে নাই,আইজ তাও ছোটখাট কইরা করতে চাইলো তাও বন্ধুগো দাওয়াত দেয় নাই,পোলাডা বাপের মতোই হইসে ওখনি সব বুঝবার পারে,বাপের মতো কষ্ট সহ্য করবার পারে….।’
মিতুর যেন চোখে পানি চলে এলো তৎক্ষনাত।
বাবাই এর গালে হাত দিয়ে বল্ল,
“আহা্ বাবাই আমাকে বলতে আমি তোমার বন্ধুদের আসতে বলে দিতাম?আর তাদের কাউকে বল্লা না আমাকে বল্লা?’
বাবাই কি বলবে যেন ভেবে পায় না।তবে ওকে দেখে বোঝা যায় ভীষন লজ্জা পেয়েছে সে যেন।
মিতু এবার স্থির হয়ে বলে ওঠে,
“জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা তোমাকে বাবাই, এগুলো তোমার জন্যে।’
মুহিনও শুভেচ্ছা জানায়, পকেট থেকে স্নিকারের দুটো চকলেট বের করে দেয় তার বোনের ছাত্রের হাতে।
দূর থেকে বন্ধন সব খেয়াল করে।
সেদিন একটা অন্যরকম ঘটনা ঘটে গেল।
মিতু, বন্ধন মাঝখানে বাবাই তার পাশে নানু আর মুহিন তার মোবাইলটা রেডী করে ছবি তোলার জন্যে।
বাবাই কেক কাঁটবে,তবে মিতালী কিছুতেই কেকের কাছে বাবাই এর পাশে যেতে চায় না।নানু জোর করে মিতালীকে,বন্ধন বাবাই এর পাশে দাঁড় করায়।
ভীষন লজ্জায় পড়ে যায় মিতু।
মিতু তাদের পরিবারের কেউ নয় অথচ তাকে পরিবারের সদস্যদের মতো সম্মান করা হচ্ছে।
খুব আনইজি লাগছিল তার।
“না জানি ভদ্রলোক আমাকে কি ভাবছেন?’
ঠিক হলোও তাই।
মিতু খাবারের প্লেটটা ডায়নিং রুমে রাখবার জন্যে আসে তখন প্রথমবারের মতো যেন বন্ধন বাবুর গম্ভীর গলা শুনতে পায়।
বন্ধন বলছে,
“ইনিই কি বাবাই এর টিচার নানু?’
“হো সুন্দর না মাইয়া খান?
“সুন্দর ঠিক আছে,তবে আমাকে এসব বলছো কেন?’
“তোরে ক্যান কই বুজোস না?আরে পোলারে তোর পোলাও বুজে আর তুই বুজোস না?ওর লগে তোরে গিট দিয়া দিমু কোনো ছাড়াছাড়ি নাই….বড় ভালা মাইয়া, বাবাইরে যে কত মোহাব্বাত করে?আর তোর লগে মানাইসেও হেব্বী।’
বুড়ীর দুষ্টুভরা প্রলাপ।
“নানু তোমার মাথা দেখছি পুরোই গেছে?বাবাইকে সে ভালোবাসতেই পারে?তবে ওর টিচারকে বলে দিও আমাকে নিয়ে যেন স্বপ্নটপ্ন না দেখে,নাহলে ওমন সেজে গুজে আসার কি দরকার?জন্মদিনে এসেছে উইশ করেছে চলে যাক না…..?সাথে করে ভাইকেও নিয়ে এসেছে…. আমার আর বাবাই এর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার কি কোনো দরকার ছিল?’
“তুই ওরে দুষাইতেসোছ ক্যান মাইয়াটারে তো আমিই টাইনা আনলাম?’
“তুমি টানলেই উনি আসবে কেন?এসব কি আমি বুঝি না?তাছাড়া তোমার আর বাবাই এরও দোষ আছে তোমাদের কারনে মেয়েটা এ বাড়ীর বউ হবার জন্যে স্বপ্ন দেখতেও পারে,বাট নানু একটা কথা শুনে রেখো,বিয়ে একজনকেই করেছি যাকে ভালোবেসেছি,বাবাই এর মা ছাড়া আমার পক্ষে অন্য কাউকে ভালোবাসা এখন আর সম্ভব নয়।এটা যেমন তুমি ভালো করেই জানো,ঐ মহিলাকেও জানিয়ে দিও।’
“এইভাবে কথা বলতেসিছ ক্যান বাবু?মাইয়াটা তো আসলেই ভালা ছোট বাবুরে এত ভালোবাসে এইটা ভাবলি না?’
“এত ভাবাভাবির কিছু নেই,ওকে বাইরে পাঠিয়ে দিবো,বাবাই এর মিসকে এখন থেকে আর আসতে বলো না,আমার দিকে কয়েকবার তাকিয়েছে,উনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে…না জানি তুমি উনার মাথায় আমার কথা ঢুকিয়ে দাও কি না?তা না হলে উনি বাবাইকে এতো খেয়াল করবে কেন?তাছাড়া ভাইটাও তো বড়বড় চোখ করে আমাদের বাসাটা দেখছিল?কি চলছে এদের মনে কে জানে?সি ইজ অনলি টিচার এর বেশী কখনোই কিছু নয়…।’
বন্ধনের এমন কর্কশময় রূঢ় আচরন মিতু যেন পুরোই আকাশ থেকে পরে।
মিতু জানতো বন্ধন এয়ারমার্শাল। তবে তখনও বুঝতো না এই পদটার মানে কি,শুধু জানতো সে একজন আর্মি অফিসার।
সেদিন মিতুও বুঝলো এই কারনে নানু সুযোগ পেলেই বন্ধনের গল্প করতো তার কাছে।
প্লেটটা রাখতে গিয়ে ওদের কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।পানির পিপাসাও ছিল কিন্তু আর্মি অফিসারের এমন রগচটা কথা শুনে মিতালীর পেট ভরে যায়….।
মিতুকে এবার খেয়াল করে নানু বন্ধনকে বলে চুপ করতে।
“মিতু বোইন কিসু লাগবো?’
ততোক্ষণে মিতুর গাল বেয়ে অশ্রু ছাপিয়ে বন্যা হবার যোগাড়।মিতু তাড়াতাড়ি শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুছে ফেলার চেষ্টা করে।
প্লেটটা টেবিলে কোনমতে রেখে বিদায় নেয় মিতু।
যাবার আগে নানুকে বলে ভারী কন্ঠে,
“নানু আমি চলে যাচ্ছি,বাবাইকে বলে দিবেন আমি কাল থেকে আর পড়াতে আসবো না।’ (চলবে)”দ্বিতীয় বাসর'(গল্প),পর্ব-৮৭
হাসিনা সাঈদ মুক্তা
এসব ভেবেই যেন হেসে ওঠে মিতালী,
বন্ধনের বুকের দিকে মাথাটা দিয়ে ভাবে ফের,
” না জেনে, বুঝে সেদিন কি বোকার মতোই না কেঁদেছিলাম?আপনার আচরনে এত বেশী কষ্ট পেয়েছিলাম যে কি বলবো….?কিন্তু কে জানে যে আপনার বুকের মধ্যে যে অন্তরটা সেটা তো একটা শিশু বাবু,ঠিক আপনার মতোই সুন্দর!’
ভেবে আবারও বন্ধনের বুকে আলতো করে চুমু খায় মিতু পরম আবেশে, ফের হারিয়ে যায় আবারো সেই ভাবনায়।
বাবুকে এরপর অর্থাৎ বিয়ের পর যখন মিতালী বন্ধনের সোহাগ পেতে থাকে তখন এ ব্যাপারটা নিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে।
“আচ্ছা বাবু সেদিন কেন এমন রাফ এন্ড টাফ আচরন করেছিলেন আমার সাথে?’
“কবে সোনা?’
“ঐ যে প্রথম যেদিন আপনার সাথে আমার দেখা হলো,বাবাই এর জন্মদিনে?’
“ও আচ্ছা এই ব্যাপার…?শোনো মিতালী,বিশ্বাস করবে কিনা জানি না,যা করেছিলাম ইচ্ছাকৃত নয়,সবই ছিল অভিনয় বলতে পারো নিজের ওপর জিদ করে,রাগ করে…।’
“কি বলছেন?নিজের ওপর জিদ?কেন? ‘
মিতালীর বুকে মাথা দিয়ে উত্তর করে বন্ধন,
“কারন তো একটাই মিতু,আই এম অল্ড এন্ড মোস্ট আনলাকি পারসন…তোমাকে চাইবো সে দুঃসাহস করিনি কখনোই….।’
মিতু এবার সোহাগমাখা ছোঁয়ায় বন্ধনের মাথাটা তুলে বলে,
“কি যে বলেন না আপনি?আপনি আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখেছেন কখনো?আপনি জানেন আপনি কতটা সুন্দর?আর শুনেন বারবার এসব বলবেন না আমাকে বারণ করেছি না….?
ত্রিশ বত্রিশ বছরের ছেলেরাও আমার বাবুর মতো সুপুরষ নয় বুঝেছেন?’
মিতুর ছেলেমানুষী কথা ভীষন ভালো লাগে বাবুর,
“তাই বাবু?আসলে তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো মিতু তাই আমার সবকিছুই তোমার ভালো লাগে।’
দুজনেই যেন আবেগে আপ্লুত….।
“হুম ঠিকই তো বলেছেন?এবার আপনিই বলুন তো কেন ভালোবেসেছি আপনাকে?কি দেখে খালি এককথা বলেন বুড়া বুড়া করেন নিজেকে?’কোমড়ে হাত দিয়ে শাসনের ভংগীতে বলে ওঠে এবার মিতু।
“তুমিই বলোনা সোনা?তোমার কথা শুনতে বড় ভালো লাগে ….!’
মিতু বন্ধনের বুকটাতে ফের আঁছড়ে পড়ে,
“আপনার ভেতরে যে কি আছে আপনি নিজেও তা জানেন না বাবু….!শুধু মনে হয় আপনার বুকে আমি আমার সমস্ত শান্তি খুঁজে পাই,আমার সুখ, আমার চাওয়া পাওয়া, আমার পৃথিবী,ছোট ছোট স্বপ্ন সব আপনিই বাবু….আপনি আছেন তো আমি আছি আপনি নেই মানে আমি নেই… সম্ভব না আপনাকে ছাড়া বাঁচা!’
মিতুর কথাগুলো যেন নুপূরের রিনিঝিনি ঝংকারের মতো বেজে ওঠে বন্ধনের কানে।
বন্ধন আরো বেশী জাপটে ধরে পাগলের মতো আদর করে ফের মিতালীকে।
ফের ওর মুখটায় মুখ আর ঠোঁটজোড়ায় চুমু খেয়ে বলে,
“সত্যি জান….? এতো ভালোবাসো আমাকে?কথা দাও কখনো আমায় ছেড়ে যাবে না?’
“কখনো যাবো না ছেড়ে বাবু…।আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’
“বলো সোনা?’
“আপনি কি তখনও কেয়াকে ভালোবাসতেন না?অভিনয় বল্লেন যে?’
“আরে পাগল,কেয়াকে কেন ভালোবাসবো না…তখন তো ঐ সব..। ‘
“তারপর?’
“তারপর…. নানুর মুখে তোমার কথা শুনে,তোমাকে দেখে আমার কেমন যেন ভয় হতে লাগলো।’
“কিসের ভয় বাবু?’
“তুমি তো জানোই নানু বুড়ী কতোটা চালাক তোমার আমার মিলনে কিন্তু তারও অনেক অবদান আছে?’
“হুম ঠিক।’
“নানু তোমার অনেক গল্প করতো তারপর তোমাকে যখন দেখলাম কেমন যেন মনে হতে লাগলো…. আমার বুকের ভেতরটা কেমন করতো ঠিক বুঝতাম না।মনে হলো আমি তোমার প্রতি দূর্বল হয়ে যাচ্ছি।যেটা কোনোক্রমেই ঠিক নয়।তাই সেদিন এতগুলো কড়া কথা শুনিয়েছি ইচ্ছে করেই যাতে তুমি শোনো।তারপর তো নানু আর বাবাই যেয়ে তোমার বাসায়, তোমাকে বোঝালো আমার হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিল।’
“ইশ কি যে খারাপ লেগেছিল বলার মতোন না,বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল!’
“তাই বাবু?কই দেখি দেখি কোথায় ঝাঁঝরা হয়েছিল?’
দুষ্টুমী যেন বন্ধনের।
“জ্বীনা এসব চালাকি চলবে না,যখনটা তখন হয়েছিল এখন কেন দেখতে চান হুম?যান তো… বাবাই চলে আসবে এখন কোচিং থেকে….’
দুজনের নানা রকম খুনসুটি আর দস্যিপনার স্মৃতি গুলো ভেসে আসে আবারো।
মিতু সেদিন বলেছিল,
“এত চেষ্টার পরও পারেননি তো বাবু?পারেননি মনকে বেঁধে রাখতে?আমাকে ভালো না বেসে থাকতে?’
বন্ধন পেছনে ফিরে মিতুর ফর্সা পেট আর বাহু জড়িয়ে, আবেশে বলে ওঠে,
“কেমন করে পারবো তুমি বলো মিতু?তোমার মতো মায়াবী আর সুন্দরের প্রতীক আমি কেন যেকোন পুরুষই তোমার প্রেমে পড়তে চাইবে, তোমাকে কাছে পেতে চাইবে?’
মিতু ঘাড় ঘুড়িয়ে সামনে ফিরে বন্ধনের মুখে হাত লাগিয়ে মাথা নাড়ায়।
” এ কথা আর কক্ষনো বলবেন না,আপনি ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ আমাকে ছোঁয়া তো দূর আমার মনের ধারে কাছে আর কেউ কোনোদিন আসতে পারবে না।
মিতালী শুধু আপনার জন্যে এই জন্মে কিংবা পরকালে…..অন্যপুরুষের কোনো অস্তিত্ব নেই কোনোদিন থাকবেও না….। ‘
মিতালী ভীষন ভালো লাগছিল এসব ভাবতে আজ বহুদিন পরে, স্বামীর বুকে কখন যে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল?
হঠাৎ মিতুর তন্দ্রা কেটে যায় ওর মনে হলো ডায়নীং রুমে কেউ যেন এসেছে।ফ্রিজ খোলার শব্দ পায় যদিও মুহিন সারাবছরই ফ্রিজের ঠান্ডা পানি খায়।কিন্তু মিতালী তাকে কড়া শাসনে রাখছে একেবারে ঠান্ডা পানি খাওয়া বারন।
মিতুর মনে হলো হলো কেউ গ্লাস নামিয়ে পানি খাচ্ছে।
কানখাড়া করে শোনার চেষ্টা করে,
“সেতারাআপু , মুহিন কারো গলার আওয়াজই তো পাচ্ছি না কে ঐ ঘরে তাহলে?’
মোবাইলের ঘড়িটা দেখে বারোটার উপরে বেজে গেছে।
বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে শাড়ীটা ঠিক করে এবার,ধীর পায়ে হেঁঠে ছুটে যায় মিতালী মিতু।
এতরাতে কে এলো ঘরে তা দেখতে।(চলবে)