#দ্বিরাগমন
#পর্ব_১২
শাশুড়িকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো। সুলতানা আপা সাথে গেলো। সালমানও গেলো। আমি বাসায় একা রইলাম। রাত তখন নয়টা। আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু একটা কথাই,
সালমান আমাকে বলেছে বেহায়ার মতো এখানে না থাকতে। জীবন নিয়ে চিন্তা হতে থাকলো আমার।আসলেই এখানে থাকা আমার উচিত হবে না। আমার মেয়ের দিকে তাকালাম একবার। মেয়েটার অপরাধ, সে মেয়ে হয়ে জন্মেছে। এই মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধে আমার মেয়েকে এরা বাঁচতে দিবে না। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম, এই ঘরে আর আমি থাকবো না। দূরে কোথাও চলে যাবো আমি। আমার মেয়েটাকে আমি মানুষের মতো মানুষ করবো। অনেক বড় বানাবো।তার পাষণ্ড পিতার সাহচর্য তাকে দিবো না।দিবো না দাদির কোনো শিক্ষাও। আমার মেয়েকে আমি একাই বড়ো করে তুলবো।
খাতা কলম হাতে নিলাম। লেখতে থাকলাম……
সুলতানা আপা,
চলে যাচ্ছি আমার মেয়েকে নিয়ে।আমার খোঁজ তোমরা আর করো না। আমি অনেক অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। শাশুড়ি আম্মার অবস্থা কেমন আমি জানি না। শুধু এটুকুই চাওয়া আল্লাহ তাকে সুস্থ করে দিক। মুনা আগামী পর্শু দেশে চলে আসবে।মেয়েটা অসুস্থ। সম্ভব হলে বলে দিও মুনার উপর আমার কোনো অভিযোগ নেই। নেই কোনো কষ্টও। সে তো আমাদের বোনের মতোই। আর ছোট বোনেরা ভুল করলে সেই ভুলকে ধরতে নেই। এই ভুলটা মেনে নিতে হয়। মুনাকে দেখে রেখো। আমার মেয়েটাকে পৃথিবীতে আনতে তুমি আর তারানা আপা কম কষ্ট করোনি। জেনে রেখো, আমার মেয়েটা আমার মেয়ে না। এই মেয়েটা আমি আমার কাছে তোমাদের আমানত হিসেবে রাখবো। জন্মের আগে তোমরা দুজন আমার মেয়েকে রক্ষা করেছো, একমাত্র বাঁচিয়ে রাখার জন্য আর আজ থেকে আমি আমার মেয়ে না, বরং তোমাদের আমানত হিসেবে আমার মেয়েকে দেখে রাখবো। অনেক অনেক অনেক দূরে চলে যাবো। জানি না কোথায় যাবো তবুও চলে যাবো আমি। শাশুড়ি আমার ছেলে হবে শুনে যে চুড়ি দিয়েছিলেন, সুগুলো আমার আলমারির দুই নাম্বার তাকে রাখা শাড়ি যে, এর মধ্যে হলুদ কালার শাড়ির ভাজে রাখা আছে। শাশুড়ির হাতে সুগুলো দিয়ে দিও। আমার গায়ের গহনা খুলে আমার ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা বক্সে রেখে যাচ্ছি। এই ঘরের কোনো কিছুই আমি নিয়ে যাচ্ছি না।
আমার পেটে বাচ্চা, আর ছেলে বাচ্চা শুনে বাসা, দোকান সব আমার নামে করে দিয়েছিলো সালমান।আমি তখনই সব তোমার আর তারানা আপার নামে করে দিয়েছিলাম।কারণ আমি জানি এমন একদিন আসবে, যেদিন তোমাদের বেঁচে থাকার জন্য হলেও অবলম্বন থাকা চাই। তারানা আপা কোথায় আছে আমি জানি। এতোদিন বলিনাই। কারণ, তারানা আপা অপমান নিয়ে বাঁচতে জানে না। আর আমার শাশুড়ি তাকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করবেন না। তাই আমি তারানা আপাকে খুব কাছই লুকিয়ে রেখেছি। আমার মায়ের বাসায় আজ চার মাস ধরে তারানা আপা আছে। আমি চলে যাওয়ার পর তোমার অবলম্বনের প্রয়োজন হবে। তারানা আপাকে নিয়ে এসো। জানি আর কোনো অসুবিধা হবে না তোমাদের। বাসা দোকান সব লিখে দিয়েছি তোমাদের নামে। একটা অনুরোধ রেখো শুধু মুনার চিকিৎসা করিও। আমি আমার মেয়েকে বড় করে যখন ফিরে আসবো, তখন যেনো দেখতে পাই মুনার নতুন জীবন আর সাজানো গুছানো সংসার হয়েছে। আমি এইটা দাবী হিসেবে তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি।
আমার মাকে দেখে রেখো। আমার ছোট দুইটা ভাইয়ের বাপ নেই। তোমাদের উপর রেখে গেলাম তাদের। এখানে থাকলে আমার মেয়েটা বাঁচতে পারবে না। আমি গেলাম।”
ইতি
নুপুর
এভাগা মা একজন, যে পেটে ছেলে না মেয়ে ধরেছে। একদিন সেই মেয়েকে যোগ্য করতে পারলে, তবেই ফিরে আসবো।
আমি বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম অজানার গন্তব্যে। কোনো পথ নেই, মঞ্জিল নেই। একা একা পথ আর একটা বিশাল স্বপ্ন, আমার মেয়েকে আমার মানুষ করতেই হবে। হাতে শুধুমাত্র একটা হাজার টাকার নোট ছিলো আমার। এই হাজার টাকার নোটের কাছে আমি আজীবন নত হয়ে থাকবো। কারণ আমার মেয়ের বাবার হাজার টাকার নোট নিয়েই আমি আমার মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে এসেছি। একবার ইচ্ছা হল, মাকে দেখে আসি। কিন্তু গেলাম না সেদিকে। যদি মায়া বেড়ে যায়? গেইটের সামনে গিয়ে মাটি ধরে সালাম করলাম। এই বাসা থেকেই একদিন আমার বাবার লাশ বের হয়েছিলো।
আমি মেয়েকে নিয়ে চলে গেলাম। দূরে… অনেক দূরে…. কেউ আর জানবে না আমি কোথায় গিয়েছে, কীভাবে গিয়েছি। শুধু আমি আর আমার সত্য জানে, জীবন আমাকে অন্য একটা মোড়ে দাঁড় করিয়েছে। আমি আগে ছিলাম সালমানে ছোট বউ, সুলতানা আপা আর তারানা আপার ছোট সতীন। তবে সেই পরিচয় আজ থেকে মূল্যহীন। আমি আজ থেকে সত্যের মা। আমার মেয়ের নাম রাখলাম, “সত্য”
লেখা: Midhad Ahmed
(চলবে)