দ্বিরাগমন পর্ব ৩

#দ্বিরাগমন
#পর্ব_৩

মাস দুয়েকের মধ্যে আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলাম। আমার প্রতি শাশুড়ির খাতির যত্ন বেড়ে গেলো অদ্ভুতরকম ভাবে। শাশুড়ি সুলতানা আর তারানা ভাবীকে ডেকে বললেন,
“বাজা মেয়েরা দেখেছো? জাতের মেয়ে একটাই ভালো। জাতের মেয়েরা বছরে বছরে বাচ্চা জন্ম দেয়। এই ক্ষমতা তোমাদের হলো না। লজ্জা করে না আমার ছেলের ঘাড়ে চেপে চেপে, ছেলের স্ত্রীর মর্যাদা নিয়ে বাস করছো?”
আমার কথাগুলো শুনে খারাপ লাগলো। শাশুড়ির কথার উপর আমি কখনো কথা বলি না। গতকাল সন্ধ্যায় অবধি আমাকে শাশুড়ির পায়ের লাথি খেতে হয়েছে। আর আজ যখন আমি মা হতে চলেছি এই খবরটা আমার শাশুড়ি শুনতে পেলেন, তখন তার মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন চলে আসলো। শাশুড়ি তারানা ভাবীকে বললেন,
“রোজ রোজ নুপুরের জন্য সকাল বিকাল দুধ এনে দিবি।”
তারানা ভাবী জবাব দিলেন,
“কেনো না আম্মা? আমাদের বাচ্চা আসতে চলেছে। আমরা মা হতে চলেছি। নুপুরের দায়িত্ব এখন আমাদের।”
তারানা ভাবীর মুখে এই কথা শুনে আমার মন খুশিতে ভরে উঠলো। নিজের পেটে হাত রেখে আমার অনাগত সন্তানকে মনে মনে বললাম,
“দেখ বাবা তোর জন্য তোর তিন তিনটা মা অপেক্ষা করছে।”
তবে সেই চিন্তায় বাধ সাধলেন আমার শাশুড়ি। তারানা ভাবীকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোর বাচ্চা আসতে চলেছে মানে?”
তারানা ভাবী উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো,
“আমাদের বাচ্চা। তারানার বাচ্চা, সুলতানা ভাবীর বাচ্চা,নুপুরের বাচ্চা। এইটা আমাদের বাচ্চা।”
শাশুড়ি আমার খিলখিল করে হাসলেন। হেসে হেসে বললেন,
“বেহায়া মেয়ে। লজ্জা করে না? নিজের পেটে বাচ্চা আসে না অন্য মেয়ের বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা বলিস?”
তারানা ভাবীকে দেখলাম শাশুড়ির কথায় একদম জানি চুপসে গিয়েছেন।
শাশুড়ি তারপর তারানা ভাবীকে বললেন,
“দুধ ঠাণ্ডা করে দিস। গরম করে দিস না কিন্তু! বলা তো যায় না নিজে মা হতে পারিস নাই বলে অন্যের বাচ্চাকে মেরেও ফেলতে পারিস।”
আমি কথাটা শুনে আর নিজেকে চুপ রাখতে পারলাম না। একদিন দিয়ে আমার ভয় হচ্ছে কিছু বলতে আর অন্যদিক দিয়ে নিজেকে চুপ রাখাটা নিজের বিবেকের কাছে অপমান হওয়া মনে হলো। আমি শাশুড়িকে বললাম,
“ইশ মা! আমার বাচ্চা আর ভাবীদের বাচ্চা এক ই তো। আমার বাচ্চা তিন তিনটা মা পাবে।”
শাশুড়ি আমাকে বললেন,
“হয়েছে হয়েছে। আর কথা বলতে হবে না। বিশ্রাম করো। আর তারানা, সুলতানা কাজে লেগে যাও। বিকালে আমার ছোটবোন তার পরিবার নিয়ে আসবে। রাতে খেয়ে যাবে তারা।”
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে আমার মাথায় হাতে রেখে বললেন,
“বিশ্রাম করো নুপুর। কোন দরকার হলে আমাকে ডাক দিও। কেমন?”
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম।
অবাক হলাম আমি। অন্যকোন দিন হলে যদি আমি তারানা ভাবী আর সুলতানা ভাবীর পক্ষে কথা বলতাম, তাহলে নিশ্চিত শাশুড়িত থাপ্পড়, গালি দুইটাই শুনতে পেতাম। রহস্যময় ভাবে আজকে আমি বেঁচে গেলাম। শাশুড়ি আমার রুম থেকে চলে গেলেন। পেছন পেছন সুলতানা ভাবী আর তারানা ভাবিও রুম থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলেন। আমি পেছন থেকে ডাক দিলান সুলতানা ভাবী আর তারানা ভাবীকে। সুলতানা ভাবীকে বললাম,
“মনে কষ্ট নিও না। আমি না তোমার ছোট বোন?”
সুলতানা ভাবীর চোখের কোনে পানি চলে আসলো।
আমি তারপর সুলতানা ভাবীর হাত নিজের পেটের কাছে লাগিয়ে বললাম,
“এই দেখো আমাদের বাচ্চা। তার মায়েরা এভাবে কাঁদলে সে কষ্ট পাবে না?”
তারানা ভাবী আর সুলতানা ভাবী আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলো। সুলতানা ভাবী বললো,
“কখনো বাচ্চা পেটে ধরিনি। তবে মা ডাকটা শুনার সাধ ছিলো। নিজের জামাইয়ে বিয়ে করিয়ে নিয়ে আসলাম নতুন করে। আমার ঘরেই আমার সাজানো সংসারে এলো তারানা।”
তারানা বললো,
“একটা বাচ্চা পেটে ধরেছিলাম। মেয়েটা জন্মমরা হয়ে আসলো। আর মা হতে পারলাম না। তারপর এই একই বাচ্চার জন্য আমার বোনের সাথে সুলতানের বিয়ে হয়। বোনটার জীবন নষ্ট হলো। তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। বাপের বাড়ি যাওয়া আমার চিরতরে নিষিদ্ধ।”
আমি সুলতানা ভাবী আর তারানা ভাবীকে বললাম,
“কান্না বন্ধ করো। আমাদের বাচ্চা আসতে চলেছে। তাকে যে দেখে রাখতে হবে। এই দেখে রাখার দায়িত্ব যে আমাদের। ”

শাশুড়ি আবার রুমে এসে হুংকার দিলেন সুলতানা ভাবী আর তারানা ভাবীকে। বললেন,
“এখানে কী হচ্ছে শুনি? আমি না বললাম আজ বাসায় মেহমান আসবে?”
মুনা এসে বললো,
“তিন সতীনে মারামারি লাগে না কেনো? তোমাদের কীসের এতো বনাবনি? সতীন সতীনে মাইর হয় জানতাম, তোমরা মারামারি করো না কেনো?”
শাশুড়ি মুনাকে চুপ করতে বললেন। মুনাকে বললেন,
“বাচ্চা হয়ে যাক তখন দেখবি এমনিতেই অধিকার খাটাবে। বাজা মেয়েরা এঘরে আর বেশিদিন থাকবে না রে মুনা।”
আমার কথাটা শুনে খারাপ লাগলো। আমি শাশুড়িকে বললাম,
“আম্মা আপনি এরকম বলেন কেনো? আমাদের কষ্ট লাগে না?”
কথাটা বলা শেষে দেখলাম সুলতানা ভাবী আর তারানা ভাবী আমার দিকে তাকাতাকি করছেন। শাশুড়ি দাতে দাত চেপে আমাকে বললেন,
“কথা বেশি শিখে ফেলতেছো নুপুর। বেশি বাড়াবাড়ি ভালো না কিন্তু।”
মুনা আর শাশুড়ি রুম থেকে চলে গেলেন। তারানা ভাবী আর সুলতানা ভাবী আমাকে বললো,
“তোর সাহস হয়ে গিয়েছি দেখছি। আমরা ভেবেছিলাম আম্মা এসে তোকে মারধর শুরু করবেন।”
আমি হাসলাম। সুলতানা ভাবী বললো,
“সাহস বেশি দেখানো ভালো না। এই মহিলার মেজাজ আজকে ভালো তাই কিছু বলেনি। নাহলে তোকে ঠিক মারতো।”
আমি বললাম,
“আচ্ছা আচ্ছা। ঠিক আছে। এবার শান্ত হও তোমরা। এতো অস্থির হইও না। আমার বাচ্চার মায়েরা এতো অস্থির হলে চলবে?”
তারানা ভাবী আমার মাথায় হাত রেখে বললো,
“দোয়া করি রে বোন, আমাদের একটা বাচ্চা ভালোয় ভালোয় দুনিয়ায় আসুক। আল্লাহ তাকে ভালো রাখুক। তুই ই আমাদের শেষ ভরসা। তোর মাধ্যমেই আমরা মা শুনার বাসনা পূর্ণ করবো রে।”

সেদিন বিকালেই শাশুড়ির খালাতো বোনেরা আমাদের বাসায় এলেন। শাশুড়ির বোন আমাকে দেখে বললেন,
“এই মেয়েটা উর্বশী। বছরে বছরে ফুল ফুটাবে দেখে নিস।”
শাশুড়ি তারানা আর সুলতানা ভাবীকে ডেকে আনলেন ড্রইংরুমে। তারপর তার খালাতো বোনকে বললেন,
“আর এদের কিছু বলবা?”
তিনি বললেন,
“এদের চেহারায় দেখো, রুক্ষতা আর আর্যতা পূর্ণ। এরা সংসারে অসহায়ত্ব, দূর্বলতা নিয়ে আসে। শান্তি না।”
সুলতানা ভাবী আর তারানা ভাবীর মুখ দেখলাম মলিন হয়ে গিয়েছে। পাশ থেকে মুনা বললো,
“হয়েছে হয়েছে, যাও এখন রান্নাঘরে।”
ভাবীদের সাথে আমিও চলে যেতে চালে পেছন থেকে শাশুড়ি আমাকে ডেকে এখানে বসতে বলেন। শাশুড়ির খালাতো বোন আমাকে বললেন,
“নাতি দিতে হবে। নাতি চাই। বুঝছো মাইয়?”
আমি কোন উত্তর দিলাম না। নাজুক হয়ে বসা রইলাম বেশ কিছুক্ষণ।
এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো। তারানা ভাবী এসে দরজা খুললো। সালমান এসেছে। এমন সময় সালমানের বাসায় আসার কথা নয়। সালমান দরজার সামনেই তারানা ভাবীকে দেখে বললো,
“ইশ! ঢুকতেই অলক্ষ্মীর মুখ দেখে ফেললাম। আমার নুপুর কই? নুপুর, নুপুর….”
শাশুড়ি সালমানকে ডাক দিলেন। বললেন,
“নুপুর এখানে আছে।”
শাশুড়ির খালাতো বোন সালমানকে বললেন
“আহারে বাবা এখন শান্ত হয়ে বস। বউ পোয়াতি হয়েছে এর খুশি তো লাগবেই।”
সালমান আমার দিকে চেয়ে চেয়ে বললো,
“বউটা আমার লক্ষ্মী। এতোদিনে আমার ঘরে আলো আসা শুরু করেছে।”
তারপর শাশুড়ি আমাকে ভেতরে যেতে বললেন। সালমানও আমার সাথে ভেতরে আসলো। রুমে এসে সালমান আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমাকে বললো,
“ভালোবাসি।”
এই কথাটা আমি এই প্রথম কারো মুখ থেকে শুনলাম। এই কথাটা শুনার জন্য আমি মোটেও আশায় ছিলাম না। যেই সালমান গতকাল রাতে অবধি আমাকে বেল্ট দিয়ে পিটিয়েছে, সেই সালমান আজ আমাকে বলছে, “ভালোবাসি”
সালমান আবার বললো,
“আমাকে তুমি খুশি করেছো। আর তোমার কোন কষ্ট নেই। বলো তুমি কী চাও?”
আমি কী বলবো বুঝতে পারলাম না। পরক্ষণেই বলে বসলাম,
“অধিকার চাই”
“এইতো অধিকার দিলাম”
“না এই অধিকার না।”
“অহ তাইলে দোকান তোমার নামে করে দেই নুপুর?”
“না।”
“সোনার গহনা বানাবে? আসো যাই।”
“না”
“তাহলে কী চাও তুমি?”

নুপুর আর সালমানের কথা রান্নাঘর থেকে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলো সুলতানা আর তারানা। মনে মনে দুজন কষ্ট পাচ্ছিলো। তারানা সুলতানাকে বললো,
“এই দেখো, আমাদের আর কিছুই রইলো না। দিনশেষে নুপুর এই ঘরের কর্তৃ।”
সুলতানা বললো,
“আমারও তাই মনে হয়।”
“কী চাইবে সে সালমানের কাছে?”
“এইতো অধিকার চাইবে।”
“কীসের অধিকার?”
“টাকা পয়সা, যা ইচ্ছা তাই।”
তারানা সুলতানাকে বললো,
“একটা নিয়তি জানো ভাবী?
“কী নিয়তি?”
“আমাদের এখানে ঠাই হবে না। নুপুর যখন মা হবে তখন আর আমাদের তোয়াক্কা করবে না। আমাদের আর মর্যাদা থাকবে না। এখনই শাশুড়ি যেভাবে আমাদের অপদস্থ করছেন, নুপুরের বাচ্চা হওয়ার পর যদি ঠিক এভাবেইইকরতে থাকেন?”
“করবেন। এটা মেনে নিতে হবে।”
“নুপুরও কি বদলে যাবে?”
“হ্যাঁ যাবে। এইতো এখন দেখ, আজই অধিকার চেয়ে বসলো সালমানের কাছে। আমাদের আর তার মনে থাকবে না। দেখে নিস আমার কথাটা মিলিয়ে।”

এদিকে সালমান নুপুরকে বললো,
“তুমি যা চাইবা আমার কাছে আমি তাই দিবো আজকে। আমি খুব খুশি হয়েছি তোমার উপর।”
নুপুর বললো,
“আমার নামে বাসার জায়গার দলিল করে দিতে হবে।”

লেখা: Midhad Ahmed

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here