#দ্বিরাগমন
#পর্ব_৯
মুনাকে দেখতে আসা মুনার হবু শাশুড়ি আমার শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলেন,
“একী শুনছি আমি? এগুলো কি সত্য?”
শাশুড়ি আমতা আমতা করলেন। কিছু বলে উঠার আগেই তারানা আপা বললো,
“হ্যাঁ হ্যাঁ সত্য। উনি আমাদের শাশুড়ি। সালমান আমাদের জামাই আর মুনা আমাদের একমাত্র ননদ।”
মুনার হবু শাশুড়ি অবাক হলেন। আমার শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনি কিছু বলছেন না যে! আপনি আমাদের থেকে এই খবরটা গোপন করতে চেয়েছিলেন? এই মেয়েটাকে আপনি ঘরের কাজের মেয়ে বললেন এইমাত্র! অথচ গাড়ির ড্রাইভার এসে ডাকলো, ভাবি বলে?”
শাশুড়ি এবারও নিশ্চুপ। কোনো জবাব দিলেন না। মুনার হবু নন্দাই সোফায় বসা ছিলো। সে উঠে মুনার আঙুল থেকে আংটিটা খুলে তার মাকে বললো,
“চলো। আর এখানে বিয়ে নয়। এই ঘরে ভাইটাকে বিয়ে দেওয়া চলবে না। এরা মানুষ কেমন সেটাতো আমরা আজই দেখে ফেললাম।”
তারা উঠে চলে গেলো। তারা চলে যেতেই শাশুড়ি এসে তারানা আপাকে একটা থাপ্পড় দিলেন। তাকে বললেন,
“এই শয়তান্নি আমি তোর কী ক্ষতি করেছি রে? তুই আমার মেয়ের সাথে এরকম করলি কেনো?”
তারানা আপা বললো,
“আপনি আমার সাথে কীরকম আচরণ করেন? আমিও তো কারে, কারো বোন।”
“তুই বাজা মেয়ে। তুই মেয়ে না। তোর বাঁচার অধিকার নাই।”
তারানা আপা বললো,
“অহ আচ্ছা। আমি কারোর বিয়ে করে নিয়ে আসা বউ। এই ঘরের ছেলের বউ। আপনার পুত্রবধূ। আপনি আজ আমার পরিচয় গোপন রাখতে চেয়েছিলেন? সুলতানা আপার পরিচয় কাজের মেয়ে হিসেবে দিয়েছিলেন? আপনার বিবেকে বাধলো না এইটা?”
শাশুড়ি চটাস করে থাপ্পড় বসালেন তারানা আপার গালে। মুজা পাশ থেকে তার জুতা ছুড়ে মারলো তারানা আপার দিকে। তারানা আপা কান্না করতে করতে বলে উঠলো,
“মারো আমাকে মারো। আজ আট বছর থেকে শুধুই মার খেয়ে আসছি। তারপর মুনার সামনে গিয়ে তারানা আপা তার জুতা খুলে হাতে নিলো। তারপর মুনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
“মার আমাকে। তুইতো আমার ছোট বোনের মতো তুই ও আজ জুতা ছুড়ে মারলি। তুই ও মেয়ে আমিও মেয়ে। তুই বিয়ে করে বিয়ের পর যদি তোর স্বামীর ঘরে তোর পরিচয় লুকানো হয় তখন তোর কেমন লাগবে? এই নে জুতা। মার আমাকে। ভালো করে মার।
শাশুড়ি সামনে এসে মুনার হাত থেকে জুতা নিয়ে তারানা আপাকে মারতে শুরু করলেন। আমি গিয়ে শাশুড়ির হাতে ধরলাম। তারানা আপা বললো,
“উনাকে আটকাবি না নুপুর। আমার দোহাই। আমাকে মেরে শেষ করে দিক। তবুও আমি অপমান অবহেলা আর বাজা মেয়ে বাজা মেয়ে শুনতে পারবো না। এই কষ্টের বোঝা বইতে বইতে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি।”
শাশুড়ি বললেন
“খানকির মেয়ে, তুই মর। আমার মেয়ের দিকে খারাপ নজর দিস। তুই চাস না আমার মেয়ের ভালো জায়গায় বিয়ে হোক।”
সুলতানা আপা বললো,
“ওকে মারা বন্ধ করেন আম্মা। দোহাই লাগে।”
শাশুড়ি তখন ব্যঙ্গ করে বললেন
“ওরে আল্লাহ রে, দেখো এক সতীন আরেক সতীনকে না মারার কথা বলে। এই মূর্খ, এই জায়গায় যদি আর কেউ হতো তাহলে এক সতীন আরেক সতীনকে বলতো,……. ”
আমি পাশ কাটিয়ে শাশুড়ির কথা শেষ হবার আগেই বললাম,
“আমরা সতীন না আমরা তিন বোন।”
“অহ বোন! নতুন আরেকজন আসছে। ন্যাকামো দেখে আর বাঁচি না।”
শাশুড়ি আমাকে বললেন,
“পেটে বাচ্চা ছেলে এসেছে,তাই বলে নিজের অবস্থান ভুলে আবা না। টাকা দিয়ে তোমাকে বিয়ে করিয়ে নিয়ে এসেছি। তবুও যে লোকের সামনের সম্মান তোমাকে দিচ্ছি, এইটাই অনেক। এইটা অনেকেই পায় না।শুকরিয়া থাকো।”
এমন সময় সালমান বাসায় এসে ঢুকলো। মুনা গিয়ে তার ভাইকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বললো,
“তোমার বউ আমার বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে।”
শাশুড়ি সব খুলে বললেন সালমানকে। সালমান এসব শুনেই তারানা আপার চুল ঝাপটে ধরলে। থাপ্পড় দিতে থাকলো একের পর এক। আমি কাছে এগিয়ে এসে হাত ধরতে চাইলে সালমান আমার দিকে তেড়ে আসলো। আমাকে বললো,
“তুই সামনে আসলে আজ তোকে শেষ করে দিবো।”
সুলতানা আপা সামনে আসার আগেই সালমান সুলতানা আপার দিকে ইশারা করে হাত উচিয়ে বললো,
“খবরদার এদিকে আগাবি না। আজ এই মেয়েটাকে শেষ করে দিবো আমি।”
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মুনা তার ভাইকে বলতে লাগলো,
“আরও মারো, বেশ করে মারো শয়তান্নিকে। ”
শাশুড়ি ছেলেকে শিখিয়ে দিলেন
“তারে তালাক দিয়ে দে”
সালমান রাগের মাথায় বলে বসলো,
এক তালাক
দুই তালাক
তিন তালাক
যাহ শেষ। তোর সাথে আমার সম্পর্ক শেষ। তুই চলে যা।
তারানা আপা চোখের সামনে উপরে উঠে আসলো। আমি আর সুলতানা আপা তারানা আপার পিছুপিছু গেলাম। শাশুড়ি নিচ থেকে চেচিয়ে বললেন,
“মুখপুড়া, তালাক খেয়েছিস, এখন ঘর থেকে বের হয়ে যা।”
উপরে উঠে এসে তারানা আপা তার ব্যাগ গুছাতে লাগলো। সুলতানা আপা হাত ধরে বললো
“পাগলামি করিস না তুই। এখানে কিচ্ছু হয়নি। আজ এক যুগ ধরে দেখছিস এসব। এগুলো নতুন কিছু?”
তারানা আপা বললো,
“নতুন না তবে এই ঘরে আর থাকা হচ্ছে না আমার।”
আমি আর সুলতানা আপা অনেক চেষ্টা করলাম তারানা আপাকে বুঝাতে। কিন্তু কোনোভাবেই বুঝাতে পারলাম না। তারানা আপাকে সুলতানা আপা জিজ্ঞেস করলেন,
“কোথায় যাবি তাহলে?”
তারানা আপা বললো,
“যাওয়ার জায়গা নেই। যেদিকে চোখ যায় সেদিকে যাবো। মরণে শান্তি হলে মরবো তবুও এই ঘরে আর আসবো না।”
নিচে নেমে আসলো তারানা আপা। আমাদের পেছন থেকে ডাক সে শুনলো না। ড্রইংরুমের সোফায় শাশুড়ি, মুনা আর সালমান বসে আছে। শাশুড়ি সোফা থেকে উঠে এসে তারানা আপাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“চলে যাবি?”
তারানা আপা জবাব দিলো না। শাশুড়ি তারানা আপার ব্যাগ হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলো। তারানা আপার গলায় চেইন, হাতে চুড়ি, আঙুলে আংটি আর কানে সোনার দুল পরে ছিলো। মুনা উঠে এসে শাশুড়িকে বললো,
“মা এগুলো আমাদের না? এগুলো সে নিয়ে যাবে কেনো?”
শাশুড়ি বললেন,
“হ্যাঁ হ্যাঁ। দেখেছো চোরের ঘরের চোর। এগুলো নিয়ে চলে যাচ্ছে!”
তারপর আমাদের সামনে শাশুড়ি তারানা আপার সব গহনা খুলে নিলেন। তারানা আপার ব্যাগ রেখে দিলেন। তারপর শাশুড়ি বললেন,
“যদি মেয়ে না হতি তাহলে পরনের ড্রেসটাও খুলে রেখে দিতাম। এইটাও আমার ছেলের টাকায় কেনা।”
তারানা আপা মুখ খুললো। মাটিতে থু ফেলে বললো
“চিহ আপনি না মেয়ে? আপনার না মেয়ে আছে? অভিশাপ দিচ্ছি আপনার মেয়ে ধুকে ধুকে জীবন পার করবে স্বামীর ঘরে। কষ্ট সইতে পারবে না, মরতেও পারবে না।”
শাশুড়ি বললেন,
” যা যা। আর এই, তোর নাকের ফুলটাও খুলে রেখে যা। বাজা মেয়ে, জীবন কেমন কাটে দেখ এবার।”
তারানা আপা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো শুধু পরনের কাপড় আর একটা জলজ্যান্ত শরীর ছাড়া এই ঘর থেকে সেদিন তারানা আপা কিচ্ছুই নেয়নি। পেছনে পেছনে চিৎকার করতে করতে অভিশাপ দিয়ে গেলো,
“মেয়ে আপনারও আছে, একদিন এর ফল হাড়ে হাড়ে টের পাবেন আপনারা।”
লেখা: Midhad Ahmed
(চলবে)