নক্ষত্র বন্দনা পর্ব ২৭

#নক্ষত্র_বন্দনা

#পর্ব_২৭

#লেখায়_জারিন

১৫৪.

‘তুমি কিন্তু এবার বেশি বাড়াবাড়ি করছো, পুতুলের আম্মু!’
-রাগ চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে ভারী গলায় বললো নক্ষত্র।

‘আমি সত্যি হাঁপিয়ে উঠেছি। এভাবে আর কত?’ক্লান্তস্বরে জবাব দেয় ইরিন।

‘এ কথার মানে কি ইরিন? কি সমস্যা তোমার?’ শায়লা প্রশ্ন করলেন।

‘লোক দেখানো সম্পর্কটা থেকে মুক্তি চাইছি, আম্মু। যা আমার নয়, সেই মিথ্যার ভাগিদার কেন হবো আমি?’ শায়লার প্রশ্নের বিপরীতে বললো ইরিন।

‘কিসের মিথ্যা? তুমি আমার স্ত্রী। আমার সন্তানের মা। এটা তোমার লোক দেখানো মনে হয়?’ চেঁচিয়ে বললো নক্ষত্র।

‘স্ত্রী! হ্যাঁ, তবে সেটাও কেবল ধর্মের জোরে, পরিবার আর সমাজের দৃষ্টিতে। কিন্তু, পারতপক্ষে আমি তো শুধু আপনার সন্তানের মা, আপনার কাছে। এর বাইরে স্ত্রীর অধিকার মর্যাদা কই আমার?’ নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে কষ্ট-ক্লান্তি জড়ানো শান্ত স্বরে বললো ইরিন।

‘পুতুলের আম্মু, তুমি…

‘এসব কি বলছে ও নক্ষত্র? কি চলছে তোমাদের মাঝে? সত্যি করে বলো! ‘

অবাক হয়ে বিচলিত স্বরে নক্ষত্রকে প্রশ্ন করলেন শায়লা। নক্ষত্র তার দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল।চোখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে মুখ করে তাকালো। নক্ষত্রের এমন আচরণে ইরিন হতাশ হলো। শায়লার প্রশ্নের জবাব দিয়ে নক্ষত্রকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘আজ তিনটা বছর আপনি আমাকে নাম ধরে ডাকেন না,পুতুলের বাবাই। ভালোবাসার ডাকনামগুলো তো আমার অতীত গিলে খেয়েছে সেই কবেই! আপনার প্রতি অধিকার থেকে আমি বঞ্চিত আজ প্রায় ৪ বছর। পুতুল আমাদের সম্পর্কটায় এতটাই দূরত্ব এনে দিয়েছে যে আপনি আমাকে স্ত্রীর মত ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেন না। পুতুলের জন্ম যখন হয়েইছে…সেটাও আপনার সম্মতিতে তখন আমি নিজেকে এতটাও অযোগ্য ভাবতে পারিনা যে আপনি আপনার স্বামীর অধিকার ফলাবেন না আমার উপর।আমাকে স্ত্রীর কোন অধিকারই দিবেন না আপনি। এতদিন ধৈর্য্য ধরেছি, এখন আর কত?’

‘পুতুলের আম্মু…বেশি বলে ফেলতেছো কিন্তু তুমি… আম্মুর সামনে এসব…

‘তুমি থামো নক্ষত্র। ইরিনকে বলতে দাও। আমারও জানা দরকার…কেন হঠাৎ করেই এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার দরকার পড়লো ওর! ‘

নক্ষত্রকে বাঁধা দিয়ে বললেন শায়লা। ছেলে আর ছেলের বউয়ের মধ্যেকার এতকালের অজানা সত্য তাকে হতবাক করে দিয়েছে। চারদেয়ালের বাইরে একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক যে চারদেয়ালের ভেতরে এত অবহেলায়, টানাপোড়নে টিকে আছে এটা তার ভাবনাতীত ছিল। আজ যখন ইরিন সব গুছিয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানায় নক্ষত্র ও শায়লাকে তারা বাঁধা দেয়। নক্ষত্র রাগ করে ইরিনকে ঘরে নিয়ে এলে শায়লাও আসেন পিছু পিছু। অতঃপর, খোলামেলাভাবে কথাবার্তা বলতেই তাদের তিনজনের এই রুদ্ধদ্বার মিটিং।

শায়লার সম্মতি পেয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেললো ইরিন। নক্ষত্র রাগে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রয়েছে। তা দেখে নক্ষত্রকে উদ্দেশ্য করেই ইরিন বললো,

‘আজকে বলি প্লিজ?! চিন্তা করবেন না, অভিযোগ করছি না কোন। জাস্ট মনের কথাগুলো বলতে চাইছি যা এতগুলো বছর মনে মধ্যে চেপে রেখেছিলাম। এই আশায় যে এগুলো কখনো প্রকাশ করার প্রয়োজন পড়বে না। আপেক্ষায় ছিলাম একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। কি কিছু আর হলো কই! – নিজের জীবনের টানাপোড়নের উপহাস করে বললো ইরিন। কয়েকসেকেন্ড সময় নিয়ে নিজেকে তৈরী করে নিল বাকি কথাগুলোর জন্য। মাথা নিচু করে শান্ত স্বরে বললো,

‘এক ঘরে থাকি আমরা। এক বিছানায় ঘুমাই । কিন্তু, মাঝে পুতুল থাকে। বাবা মায়ের মাঝে সন্তান থাকবে, এটা অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু, সেটা কতদিন? আপনার পাশে ঘুমানোর যোগ্যতাও কি আমার নেই? মাফ করতে নাই পারলেন তাই বলে বছরের পর বছর শাস্তি দিয়ে যাবেন এভাবে?’

‘আমি তোমাকে কোন শাস্তি দেইনি। তুমি অযথা এসব..

‘আমি সত্যিই আর পারতেছিনা পুতুলের বাবাই। আমার ভীষণ হাঁসফাঁস লাগে এই জীবন। নিজে নিজে মরা তো সম্ভব না, আপনিও দায়িত্ব নিয়ে বাঁচায় রাখবেন বলেছেন।কিন্তু, এভাবে বাঁচতেও আর ভাল্লাগতেছে না আমার। ‘

‘কি চাও তাহলে তুমি?’ নক্ষত্র প্রশ্ন করে।

‘এই অর্ধসত্যি সম্পর্কটা থেকে মুক্তি!’ দৃঢ় গলায় বলে ইরিন।

‘আর আমি যদি মুক্তি না দেই?’ নক্ষত্র একরোখা স্বরে প্রশ্ন করে।

‘আমি আপনার অস্তিত্ব থেকে দূরে থাকতে চাই, পুতুলের বাবাই। আপনাকে পেয়েও না পাওয়ার যে শাস্তি আপনি আমাকে দিয়ে যাচ্ছে বিগত ৪ টা বছর যাবৎ, আমি সেটা থেকে মুক্তি চাই। পুতুল থাকবে আপনার কাছেই, সমস্যা নেই। শুধু আমি দূরে যেতে চাই। আর আমার জানা মতে আপনি এই স্বাধীনতা…অধিকারটুকু আমাকে দিয়েছেন।’

‘পুতুলের কথাও কি ভাববে না একবার?’ নক্ষত্র প্রশ্ন করলো।

‘ওর কথা ভেবেই ৩ টা বছর ধরে এই শাস্তি ভোগ করছি। কিন্তু, সন্তানের মা হলেও আমিও একজন নারী।একটা আলাদা মানুষ। আমারও কিছু ইচ্ছে, কিছু চাওয়া আছে। ‘

‘তাই বলে এভাবে একটা সম্পর্ক শেষ করা যায় না ইরিন। নক্ষত্র কিন্তু চাইলে ৪ বছর আগেই তোমাকে ডিভোর্স দিতে পারতো। কিন্তু, সে যখন এতদিনেও এমন কিছু করেনি তখন তুমি কেন এখন ডিভোর্সের কথা বলছো? তাও আবার পুতুলের জন্মের পর! তুমি এখন শুধু ওর স্ত্রী নও। ওর সন্তানের মা-ও তুমি।এতদূর আগানোর পর সম্পর্কটা কি ছেলেখেলা মনে হচ্ছে তোমার? ‘ ইরিনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে বললেন শায়লা।

‘আম্মু….আপনি আপনার ছেলের কথা..আপনার নাতনীর কথা ভাবছেন, কিন্তু আপনি একজন স্ত্রী হিসেবে ভেবে দেখুন তো প্লিজ! বাবার সাথে আপনার সম্পর্ক যেমনই হোক মনের দূরত্ব থাকলেও আপনারা নিজেদের প্রতি অধিকার…মর্যাদা কিন্তু ঠিকই দেন। কিন্তু, এই অধিকার যদি আপনাকে না দিত বাবা? শুধুমাত্র মা-কে ভালোবেসে বা আপনার কোন ভুলের কারণে আপনাকে এইসব থেকে বঞ্চিত করতো, কতদিন টিকে থাকতে পারতেন এসবের বিপরীতে?’

ইরিনের প্রশ্নে সহসা কিছু বলতে পারেন না শায়লা।স্বামীর সাথে তার সম্পর্কও যে একেবারে স্বাভাবিক তেমনও নয়। তবুও নিজেদের মাঝে সমোঝতার কারণে আজও তারা একসাথে সুখী না হলেও খুব একটা মন্দ নেই। তাই একজন স্ত্রী হিসেবে ইরিনের দিকটা সত্যিই ভাবিয়ে তুললো তাকে।

কিন্তু, এই মূহুর্তেই তিনি কোন সিদ্ধান্তে যেতে পারছেন না। নক্ষত্র যদি সত্যিই এমন কিছু করে থাকে তাহলে ইরিনের চাওয়াটা খুব একটা অনৈতিক নয়। কিন্তু, ছেলের সংসার ভাংবে, নাতনীটা মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যাবে। এটাও তিনি চাননা। দোটানায় পড়ে গেছেন তিনি।

১৫৫.

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন শায়লা। নক্ষত্র ও ইরিনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এভাবে সম্পর্ক ভাঙা যায় না। তোমরা বরং ঠান্ডা মাথায়, একসাথে বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলো একবার। তারপর, আমাকে জানাও। আমার যা বলার তখনই বলবো আমি।

তারপর, নক্ষত্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’ ইরিনের অভিযোগ কিন্তু এড়িয়ে যাওয়ার মত নয় নক্ষত্র। আমি কিংবা রেণু আপা কখনোই তোমাকে এমন অন্যায় আচরণের শিক্ষা দিয়েছি বলে মনে হয় না আমার। আমি চাই না পুতুলের জীবনে তোমার জীবনের গল্প রিপিট হোক কোনভাবে। মনে রেখো, তোমার জন্য আমি ছিলাম কিন্তু পুতুলের মা বেঁচে থাকতে ওর আর কোন মা হবে না। তুমি যদি তোমার ভুল সুধরে না নাও তাহলে আমিও ইরিনকে বাঁধা দিতে পারবো না। ‘

কথা শেষ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন শায়লা।নক্ষত্র ও ইরিনকে একসাথে বসে কথা বলে সব ঠিক করে নেওয়ার একটা সুযোগ করে দিলেন তিনি। কিন্তু, নক্ষত্র সেই সুযোগ নিল না। শায়লা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই সে রাঁগে ফুঁসে উঠলো ইরিনের উপর।

‘আমি তোমাকে ডিভোর্স দিবো না, পুতুলের আম্মু।’ জেদি গলায় বললো নক্ষত্র।

‘আমি অলরেডি ডিভোর্স ফাইল করে ফেলেছি। নোটিশ পৌঁছে যাবে আপনার কাছে দুই এক দিনের মধ্যেই।’

‘এতই সহজ? তুমি কি ভাবছো তুমি চাইলেই ডিভোর্স হবে? কিসের ভিত্তিতে ডিভোর্স চাইছো তুমি? ‘

‘আপনাকে দোষী করে কিছু অর্জনের ইচ্ছা আমার নেই। ভয় নেই, সত্যি বলিনি। আমার অপরাগতার কথা বলেই ডিভোর্সের আবেদন করেছি। আমি বলেছি আমি অন্য একজনের সাথে সম্পর্কে আছি।’

‘ভালো করেছো। কিন্তু, তুমি কোথাও যাবে না। যেভাবে সংসার করেছো এতদিন বাকি জীবনও এভাবেই সংসার করবা। পুতুলের মা হয়েই থাকবা এ বাড়িতে।’

‘আমি যে বাড়িতেই থাকি না কেন..একলা থাকি বা দোকলা…আমি পুতুলের মা-ই থাকবো আজীবন।’

‘আমি বললাম তো তুমি..

‘আদৃত রাওনাফ নক্ষত্র…এই মানুষটা কখনো নিজের কথার বরখেলাফ করে না।’ নক্ষত্রের রক্তচুক্ষুর বিপরীতে শান্ত চাহনী ছুঁড়ে দিয়ে বললো ইরিন।

ইরিনের এমন কথার পরে নক্ষত্র আর কিছুই বলতে পারলো না। ইরিন মুচকি হাসে নক্ষত্রের চুপ হয়ে যাওয়ায়। বিছানায় বসা ছিল নক্ষত্র। ইরিন সোফা ছেড়ে উঠে পড়লো। এগিয়ে গিয়ে তার বাহু ধরে তাকে টেনে দাঁড় করায়। নক্ষত্র কিছু বলার আগেই ইরিন বলে উঠে, ‘এটুকু স্পর্শ এলাউড কিন্তু আমাদের মাঝে।’

‘পুতুলের আম্মু, তোমার আরেকবার ভাবা উচিৎ। ‘রাগ ছেড়ে হতাশ হয়ে ক্লান্ত স্বরে বললো নক্ষত্র।

ইরিন নক্ষত্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার চোখে চোখ রাখে। শুকনো হেসে বলে, ‘জানি কথাটা আমার মুখে বড্ড বেমানান। নির্লজ্জ ভাববেন আপনি আমাকে। তবুও বলতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। ‘

‘ভালোবাসো…তাহলে ছেড়ে যাচ্ছো কেন?’ ইরিনের কিছু বলার আগেই তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো নক্ষত্র।

নক্ষত্রের এমন কথায় যন্ত্রণা ও একটা তীক্ষ সুখানুভূতি ছুঁয়ে যায় তাকে। মানুষটা তাহলে জানে…বুঝে নিজের প্রতি তার অনুভূতিটা। কিন্তু, সেটাকে গ্রহণ করে না। স্বীকৃতি দেয় না নিজের অনুভূতির শহরে। এসব ভেবেই যন্ত্রণার ঠিকরে পড়া নিঃশব্দ হাসি এসে জুড়ে বসে ইরিনের ঠোঁটের বাঁকে। নক্ষত্রের চোখে চোখ রেখেই বললো,

‘আত্মসম্মান নিংড়ে দিয়ে পড়ে থাকতে বিবেকে বাঁধছে তাই। চারদেয়ালের বাইরে স্বাভাবিক একজন স্ত্রী হওয়ার…স্বামী নিয়ে দোকালা জীবনের অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত আমি এখন। এবার একা থাকতে চাই।’

‘পুতুলকে ছেড়ে একা ভালো থাকতে পারবে তুমি?’

‘ভালো তো এমনিতেও নেই আমি।পুতুল আমার হাজার কষ্ট, ব্যাথার মাঝে একটা স্বস্তির মতো। একলা তো সেই ৪ বছর আগেই করে দিয়েছিলেন আপনি আমাকে। সব দিয়েও আমাকে কিছু না পাওয়ার মত করে রেখেছেন।

আর তাছাড়া,যার সাথে সম্পর্কের সুতো বেঁধে এত পরিবার…এই জীবনের সাথে জুড়েছিলাম, পুতুলকে জন্ম দিয়েছি…ওর মা হয়েছি, সেই তো নিজের থেকে আমার অংশ ছিড়ে দিয়ে আলাদা করে ফেলেছে আমাকে। তাহলে বাকি সব কিছুর সাথে কি করে জুড়ে থাকি বলুন তো?’

‘তাই বলে পুতুলকে তুমি…

‘পুতুলের সাথে সম্পর্কটা আমার একক সম্পর্ক। আপনি আমাকে স্বীকৃতি না দিলেও আমার সাথে ওর যা সম্পর্ক তাই থাকবে আজীবন। তবে, আমাকে এই ৪ বছরে টিকিয়ে রাখার যে লড়াই আপনি করেছেন তার কৃতজ্ঞতায় আমি আমার এই স্বস্তিটুকুও আপনাকে দিয়ে যেতে চাই। এমনিতেও, বেঁচে যে আছি এই তো অনেক। ভালো থাকাটা জরুরী নয় এখানে। ‘ মনঃকষ্টে জর্জরিত…ব্যাথায় কাতর হয়েও অতিশান্ত স্বরে নক্ষত্রের মুখপানে চেয়ে বললো ইরিন।

ইরিনের এমন কথায় অবাক চোখে তার চোখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো নক্ষত্র। ইরিনের চোখে জমা হচ্ছে অকথিত ব্যাথার জল থৈ থৈ নোনাপুকুর। সেই চোখে চোখ রেখেই ছোট একটা তপ্ত শ্বাস ফেললো নক্ষত্র। কিন্তু, হৃদয়ের অভ্যন্তরে যে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে তার উত্তাপ এই তপ্ত শ্বাসের বিপরীতে একেবারে তুচ্ছ। ইরিনের থেকে চোখ সরিয়ে নিল নক্ষত্র। একরোখা স্বরে বললো,

‘তবে যাও…….যেখানে তোমার শান্তি সেখানেই যাও। আমি পুতুলকে সামলে নিতে পারবো। ‘

‘হ্যাঁ, জানি আপনি পারবেন।আর স্বস্তিটুকুই যেখানে ছেড়ে যাচ্ছি, শান্তি সেখানে নিছকই বাহুল্য।’ আলতো হেসে বললো ইরিন।

‘হ্যাঁ, স্বস্তি রেখে বিপরীতে যন্ত্রণাটুকু থেকেও মুক্তি নিয়ে যাচ্ছো।’

অভিমানী স্বরে বললো নক্ষত্র। কিন্তু, ইরিন সেটা বুঝলো না। শুকনো হেসে বললো, ‘ মৃত্যু না আসা অবধি আমার কোন মুক্তি নেই। ‘

নক্ষত্রের অভিমান বাড়লো ইরিনের এমন কথায়। এতদিন যেমনই ছিল, দিন শেষে এই মুখটা তো দেখতে পেত খুব কাছ থেকে। ইরিনকে ভালোবেসেও তাকে স্পর্শের লোভ থেকে নিজেকে সংযত রাখলেও ইরিন জানে না কত কত রাত সে ইরিনের ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে নিজের জন্য একটু স্বস্তি খুঁজেছে। শান্তি অনুভব করেছে।

সে জানে না, কত কত সময় পুতুলের সাথে, রিতুর সাথে খেলতে গিয়ে হাসি মজায় লুটোপুটি খাওয়া প্রাণোচ্ছল কিশোরী মত হেসে উঠা ইরিনকে আড়াল থেকেই দু চোখ ভরে দেখেছে নক্ষত্র।
কত শত রাত হাত পা ছুঁড়ে ঘুমানো পুতুলকে নিজের বুকে আগলে নিয়ে ঘুমিয়েছে ইরিন যাতে নক্ষত্রের ঘুমাতে সমস্যা না হয়, এটাও নক্ষত্র খেয়াল করেছে। নক্ষত্রের নিষেধ করার পরেও লুকিয়ে চুপিয়ে তার প্রিয় খাবার রান্না করে খাইয়েছে ইরিন, অথচ প্রতিবার নক্ষত্র খাওয়ার সময় সে ভয়ে থাকতো নক্ষত্র বুঝে না ফেলে..তাকে বকাঝকা না করে। নক্ষত্র সেটা বুঝেও তৃপ্তি করে ইরিনের রান্না করা খাবারটাই বেশি খেয়েছে।

ইরিন কখনো টেরই পায়নি, নক্ষত্রের একটু যত্নে যতবার ইরিন খুশিতে কেঁদেছে সেটা নক্ষত্র ঠিকই দেখেছে। ইরিনের অসুখ হলে বাইরে বাইরে দায়িত্ব পালন হিসেবে যে সেবা করেছে,তাতে মিশে থাকতো কতখানি চিন্তা, কষ্ট আর ভালোবাসা।

ইরিন কখনো জানতেই পারেনি….যে ভালোবাসার পায়রা নক্ষত্রের মরুহৃদয়ে ডানা ঝাপটাতো,কিন্তু মুক্ত আকাশে উড়ার নিষেধাজ্ঞায় গুমড়ে গুমড়ে বেঁচে থাকতো.. তাদের শান্ত করতে ইরিনের উপস্থিতি কতটা জরুরি নক্ষত্রের জন্য। অনুভূতির দ্বন্দে দূরত্ব থাকলেও ভালোবাসার মানুষটা চোখের সামনে ছিল, অন্তত তাকে হারাবার ভয় তো হতো না।

কিন্তু, এখন! এখন কি করবে সে? ইরিনের অনুপস্থিতে যে শূন্যতা এসে জুড়ে বসবে এই বিশাল ঘরময়, হৃদয়জুড়ে সেসব নিয়ে কি করে থাকবে সে? কতদিনই বা টিকে থাকবে এভাবে? জানা নেই নক্ষত্রের। কেবল হৃদয়ের চাপা হাহাকার ছড়িয়ে পড়তে থাকে তার সমস্ত সত্তাজুড়ে।

আলগোছে চোখ মুছে নিল ইরিন। নক্ষত্রকে বললো, ‘ যাওয়ার আগে আরেকটু ভুল যদি করি…খুব বেশি কিছু ক্ষতি হবে কি?’

‘ভুলের বিষয়ে তো তুমি পিএইচডিধারিনী। তোমার কোন ভুলের কারণে ক্ষতি হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। যা হয় সবটাই একেবারে সর্বনাশ।’ বাঁকা হেসে বিদ্রুপের স্বরে বললো নক্ষত্র।

তার কথায় এত কষ্টের মাঝেও নিরবেই হেসে ফেললো ইরিন। হাসি মিলিয়ে যেতেই সে নক্ষত্রকে বললো, ‘আপনাকে একটু গভীরভাবে স্পর্শ করি, নক্ষত্র?খুব বেশি না…জাস্ট একটুখানি? ‘

ইরিনের এমন আবদারে চমকে উঠলো নক্ষত্র। মূহুর্তেই তার মনে পড়ে যায় তাদের প্রথম আলিঙ্গনের কথা। ঠিক এভাবেই ইরিনের কাছে আবদার করেছিল সে। কিন্তু, ইরিনের অনুমতির অপেক্ষা সে করেনি। পরম আদরে আলিঙ্গন করেছিল নিজের ভালোবাসাকে। অথচ, সেই ভালোবাসাই আজ তাকে গভীরভাবে একটুখানি স্পর্শ করার জন্যই চাতকের মত তার অনুমতির অপেক্ষা করছে।এ অনুমতি সে তাকে দেয় না আর…প্রায় ৪ বছর। আজও দিলো না। দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে কঠিন গলায় বললো, ‘না’।

ইরিন ভীষণভাবে আহত হলো নক্ষত্রের এমন আচরণে। না চাইতেও বাঁধভাঙা স্রোতের মতই টুপটুপ করে কয়েকফোঁটা কষ্ট নিরবে ঝরে পড়লো তার দু চোখেত কার্নিশ বেয়ে।

ইরিন আর দাঁড়ালো না। ঘরের কোণায় রাখা লাগেজটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। নক্ষত্র মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল। একবার পিছু অবধি ডাকেনি।

আহ..অভিমান! পিছু না ডাকার নাম।

১৫৬.

গাড়ির ব্রেক চাপায় হালকা ঝাঁকিতে ঝট করে চোখ মেলে তাকায় নক্ষত্র। সামনে থেকে ড্রাইভার আনিস বললো, ‘এসে পড়েছি, স্যার।’

এতক্ষণ গাড়িতেই ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসেছিল নক্ষত্র।রাফিদের সাথে কথা শেষ হওয়ার পর রাফিদ চলে গেলেও নক্ষত্র অনেকটা সময় ছাদেই দাঁড়িয়ে ছিল। অনেক খুঁটিনাটি দিক,অনেক অভাবনীয় বিষয় যা তার চোখের সামনে থেকেও ছিল দৃষ্টির অগোচরে এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই সন্ধ্যা শেষ প্রহরে পা রেখেছিল আজ তার।পুরো অফিস খালি হওয়ার অনেকটা সময় পর সে বেরিয়েছে ওখান থেকে। পথিমধ্যে শারিরীক আর মানসিক ক্লান্তির রেশ ধরে ঘুম ঘোর নেমে এসেছিল তার। অবচেতন মনের আয়নায় ভেসে উঠেছিল একখণ্ড অতীত।

ইরিনের বাড়ি ছেড়ে আসার দিনটা সত্যিই ভীষণ পীড়াদায়ক ছিল তার জন্য। কিন্তু, তার অভিমান নামক ক্ষত বিক্ষত অনুভূতির সামনে ইরিন এমনকি অন্যকেউ বুঝতেই পারেনি সেই অন্তর্নিহিত জ্বালাটুকুন। অথচ সে আজও কষ্ট পুষে বেড়ায় হৃদয়ের অন্তঃস্থলে। এসব ভেবেই বিষাদভরা এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো নক্ষত্র।

এরপর, মিনিট দুই সময় নিয়ে গাড়ির দরজা খুললো সে। বের হওয়ার জন্য এক পা ফেলে বাইরে উঁকি দিতেই ভড়কে গেল। একনজর চারপাশ ভালো করে তাকিয়ে দেখে নিল।কয়েকসেকেন্ড ভেতরেই পা গুটিয়ে ঝটপট আবার গাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। সামনে তাকিয়ে অবাক গলায় আনিসকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এটা তো পুতুলের আম্মুর বাসা। এখানে কেন এসেছো?’

আনিস বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেল নক্ষত্রের এমন প্রতিক্রিয়ায়। বিভ্রান্ত স্বরে বললো, ‘আপনিই তো এখানে আসতে বললেন,স্যার। ‘

‘আমি বলেছি? কখন?’ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে নক্ষত্র।

‘ ওই তো অফিস থেকে বেরোনোর পর আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম যে, স্যার..এখন কোথায় যাবো? আপনিই তো তখন বললেন, সাজিদ ভিলা। আমিও তো তাই এখানেই নিয়ে আসলাম। ‘

আনিসের কথার জের ধরে মস্তিষ্কে জোর দিতেই চট করেই মনে পড়ে গেল সবটা। নক্ষত্র ধপ করে আবারও গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করে ডান হাতের দু আঙুল দিয়ে কপাল চেপে ধরলো সে।

আনিস কোন ভুল করেনি। সে তো রোজকার অভ্যাস মতই জিজ্ঞেস করছিল, এরপর কোথায় যাবে। কারণ, প্রায় সময় নক্ষত্র অফিস শেষে মিটিং থাকলে বা অন্য কোথাও কোন কাজ থাকলে প্রায়শই সরাসরি বাড়ি না গিয়ে সেখানেই যায়। তাই আনিস নিজে থেকে জিজ্ঞেস করে নেয় কখন কোথায় যাবে। নক্ষত্রও বলে দেয়। বাড়ি যাওয়ার হলে কখনো সে বলে না যে বাড়ি চলো। সোজা ‘শেখ ভিলা’ বলে সম্বোধন করে। আর ইরিন যে বাড়িতে থাকে সেটার নাম সাজিদ ভিলা। আজ ইরিনের সাথে নিজের অতীত নিয়ে ঘাটতে ঘাটতে, ইরিনের কথা বেশি ভাবায়, আনিসের প্রশ্নে অবচেত মনেই ইরিনের বাড়ির ঠিকানা বলে ফেলেছে সে।

এটুকু মনে হতেই নিজের প্রতি নিজেই হতাশ হলো নক্ষত্র। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো। সামনেই ১৩ তালা বিল্ডিংটা। ইরিন থাকে ৯ তলায়। একই অফিসে কাজ করলেও কাজ না থাকলে খুব একটা মুখোমুখি হয় না দুজন। সেবার রাগ করে পুতুলকে নিয়ে চলে আসার পর আর দেখা হয়নি ইরিনের সাথে। পরের দিন সেই যে অফিসিয়াল ট্যুরে গেছিল, ১৭ দিন সেখানে কাটিয়ে দুদিন আগেই দেশে ফিরেছে সে। মাঝে একদিন ছুটি কাটিয়ে আজ অফিস জয়েন করেছিল। তাও পুরোটা দিন প্রায় রাফিদের সাথেই বিভিন্ন আলাপচারিতায় কেটে গেল। সব মিলিয়ে প্রায় ২০/২১ দিন যাবৎ ইরিনের সাথে দেখা হয়নি তার। অথচ একটা সময় ছিল যখন ইরিনের মুখটা না দেখলে তার দিন পুরো হতো না।

‘কোন ভুল হয়েছে স্যার? অন্য কোথাও যাবেন আপনি?’

আনিসের প্রশ্নে ভাবনার সুতো কাটে নক্ষত্রের। ছোট একটা শ্বাস ফেলে আনিসের দিকে তাকায়। সে পিছন ফিরে তাকিয়ে আছে নক্ষত্রের দিকে। তার উত্তরের আশায়।

নক্ষত্র সহসা কোন উত্তর দিতে পারলো না। দেশে ফিরেছে পর থেকেই ইরিনকে এক পলক দেখার সুপ্ত ইচ্ছেটা মনের মধ্যে খুঁচাখুঁচি করছিল বেশ। যাওয়ার আগে এমন রাগারাগি করে গেছে অথচ পরে ইরিনের দিকটা ভেবে রাগ পড়ে গেছিল তার। সেখানে জায়গা করে নিয়েছিল মন খারাপ।তাই তাকে একঝলক দেখার জন্য মনটাও অস্থির হয়ে উঠেছিল। আর আজ যখন ভুল করে এসেই পড়েছে…তাকে একনজর না দেখেই কি ফিরে যাবে? ইরিনই কি ভাববে এভাবে হুট করে তার বাসায় গেলে? যদি জিজ্ঞেস করে কেন এসেছে হঠাৎ এভাবে? কি দরকার? কি-ই বা বলবে তখন সে!

এসব ভেবে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেল নক্ষত্র। কি করবে ভাবতেই মস্তিষ্ক বললো, ‘কোন দরকার নেই এভাবে যাওয়ার। কাল অফিস গেলেই তো দেখা পাওয়া যাবে। এক নজর দেখারই তো ব্যাপার। দূর থেকে দেখলেই হবে। এখন গেলে অহেতুক বাহানা করতে হবে। যেটা তার সাথে একদমই যায় না। কি দরকার এভাবে নিজেকে ছোট করার?

কিন্তু, মন মস্তিষ্কে চুপ করাতে ধমকে বলে, এই কিসের ছোট করা? স্ত্রী সে তোমার! সে যেখানেই থাকুক, তার কাছে যাওয়ার পূর্ণ বৈধতা আছে তোমার। যখন ইচ্ছা যেতে পারো। এর জন্য কোন বাহানা কেন করতে হবে? এসেই যখন পড়েছো দেখা করে যাও। ইরিন কি ভাবলো সেটা দিয়ে তোমার কি? বি লাইক আ ম্যান, নক্ষত্র।

নক্ষত্র মন মস্তিষ্কের রেষারেষিতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে।কি করবে না করবে ভাবতে থাকে। মিনিট পাঁচ সময় সে গাড়িতেই বসে রইলো। আনিস আবার প্রশ্ন করে, ‘অন্য কোথাও যাবেন কি, স্যার? নাকি গাড়ি শেখ ভিলায় নিবো?’

নক্ষত্র অসহায় দৃষ্টিতে মেলে তাকায় আনিসের দিকে। আনিস বোকা বোকা চোখে চেয়ে থাকে। নক্ষত্রের এই আচরণ যে তাকেও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে দিয়েছে।

১৫৭.

টেবিলজুড়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ইরিন এক এক করে সেগুলো আলাদা করে গুছিয়ে নিচ্ছে। আপেলগুলো ফলের ঝুড়িতে তুলতে তুলতেই ভুল করেই তার চোখ এক পলক মুখোমুখি সদর দরজার দিকে পড়লো। সেকেন্ডেরও কম সময়ে চোখ ফিরিয়েও নিল সে। মূহুর্তেই আবার ঝট করে ফিরে তাকালো। আপেল হাতে নিয়ে ভূত দেখার মত চককে দাঁড়িয়ে রইলো নিজ জায়গাতেই।

নক্ষত্র বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো ইরিনের এমন প্রতিক্রিয়ায়। সে সদর দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল বেশ অনেকক্ষণ আগেই। ইরিন একগাদা বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বাসায় ঢুকেছিল। ঢুকার পর সেগুলো টেবিলে রেখে গিয়েছিল সোফায় গিয়ে ক্লান্তিতে গা এলিয়ে দিয়েছিল। চোখ বুজে মিনিট দশেক ওভাবেই ছিল ইরিন। এই করে দরজা লাগাতে ভুলে গেছিল সে ।

বাসায় এসে এভাবে দরজা খোলা রাখা দেখেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায় নক্ষত্রের। ইরিনকে এই নিয়ে কঠিন কিছু কথা শোনানোর প্রস্তুতি নেয় সে মনে মনে। কিন্তু, দরজা থেকে দৃশ্যমান ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকাতেই থমকে যায় সে। টেবিলজুড়ে একগাদা জিনিসপত্র। ইরিন ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হাতেও খুব মনোযোগ দিয়ে লিস্টের সাথে এক এক করে সব মিলাচ্ছে আর গুছিয়ে নিচ্ছে। ইরিনকে দেখেই তার খুব অযত্নেই দু একটা হার্টবিট মিস হলো যেন।

ময়ূরকণ্ঠী আর গাঢ় নীলের একটা সিল্ক শাড়ি পড়েছে সে আজ। ছড়ানো কাঁধ তবে অনেকটাই গলা পর্যন্ত তোলা কুনুই পর্যন্তও হাতা দিয়ে ডিজানই করা ব্লাউজ তার সাথে। ইরিনের চিকন চাকন হাতে বেশ মানিয়েছে। শাড়িটও তার গায়ের রঙ,শরীরের গড়নের সাথে ভীষণ যত্নেই মিশে গেছে যেন। শাড়ির ছড়ানো আঁচল তুলে চাপিয়ে দিয়েছে কাঁধের উপর। অফিসে সাধারণ আঁচল ছড়িয়ে রেখে একদম মার্জিতভাবেই শাড়ি পড়ে ইরিন। শরীরের গড়ন, বাঁক বোঝা মুশকিল তার এই পোশাকেও। কিন্তু, এখন তার শাড়ি পড়ার ধরণটা এক্কেবারে নতুন ঘরকন্না করা রমনীর মত। কেবল শাড়ির আঁচলখানা যদি কোমড়ে পেঁচিয়ে নিত তবে পাক্কা গিন্নি লাগতো তাকে দেখতে।

সাজ সজ্জা একেবারে সাধারণ হলেও অফিসের ফর্মাল সাজ হিসেবে মানিয়েছে খুব। ঝরঝরে চুলগুলো মাঝ বরাবর সিঁথি করে পেছনে পনিটাইল করা। এক হাতে ঘড়ি, অন্যহাতে নক্ষত্রের মায়ের চুড়ি দুটো। ইরিন সব ছেড়ে দিয়ে এলেও এগুলো নক্ষত্র তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুমতি দেয়নি। নক্ষত্রের মতে যতদিন ইরিন তার স্ত্রী হয়ে আছে, ততোদিন এই চুড়িজোড়া তার হাতেই থাকবে। ইরিনও এই নিয়ে আপত্তি করেনি। নক্ষত্রের ভালোবাসা ভেবেই পরম যত্নে নিজের হাতের কব্জিতে ঠাঁই দিয়েছে এদের। নাকে নক্ষত্রের দেয়া সোনা জড়ানো হীরের নাকফুল। গলায় ময়ূরকণ্ঠী রঙেরই ছোট্ট একটা স্টোনের পেন্ডেন্ট আর কানে ম্যাচিং টপ কানের দুল। বা হাতের আঙুলে বিয়ের আংটি। ঠোটে হালকা করে দেওয়া লাল রঙের লিপ্সটিক। এছাড়া নজরে পড়ার মত কোন প্রসাধনী নেই তার মুখে। তবুও, এই সাধারণ সাজেই তাকে একনজরে মুগ্ধ করার মতই অপরূপ লাগছে। নক্ষত্রের এতদিনের মন খারাপটা এক নিমিষেই উবে গেল ইরিনকে এভাবে দেখে। ঘরের দরজা খোলা রাখার ভুলকে ভুলে ইরিনকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে।

১৫৮.

ইরিনও আচমকা নক্ষত্রকে এভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে যায়। কারণ, এভাবে হুট করে নক্ষত্রকে সে কখনোই আশা করে না নিজের বাসায়। নক্ষত্রই আসে না খুব একটা। যদিও বা আসে তবে সেটা পুতুলকে নিয়ে। কিন্তু, আজ নক্ষত্রকে একা এভাবে নিজের বাসায় দেখে বেশ অবাক হলো সে। তারপর, পুতুলের কথা ভেবেই নক্ষত্রের আশেপাশে উঁকি দিল ইরিন। নক্ষত্র তার এ কার্যকলাপ দেখে নিজের আশে পাশে তাকালো। কিছু না বুঝতে পেরে ইরিনের দিকে তাকাতেই সে প্রশ্ন করলো, ‘ পুতুল কই? ‘

নক্ষত্র বুঝতে পারলো ইরিন তাকে এসময় মোটেও আশা করেনি। ভেবেছে হয় তো পুতুলকে নিয়ে এসেছে। কিন্তু, সে তো আজ পুতুলকে নিয়ে আসেনি। এসেছিলই তো ভুল করে। কিন্তু, ইরিনকে দেখার তৃষ্ণা যে তাকে ইরিনের ফ্ল্যাট পর্যন্ত টেনে এনেছে সেটা কি করে বলবে সে? মনে মনে ফাঁকা ঢোক গিললো নক্ষত্র। কিছুটা গলা খাকড়ানি দিয়ে বললো, ‘আসেনি।’

‘আসেনি…তাহলে আপনি হঠাৎ এসময় এখানে?’

ইরিনের কথায় নক্ষত্র হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিল। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজে। অফিস ছুটি হয়েছে বিকেল পাঁচটায়। এ সময় এখানে আসাটা সত্যিই একটা ফালতু কাজ হয়েছে। এখন কি বলবে সে ইরিনকে?মাত্র কয়েকসেকেন্ড সময় নিল নক্ষত্র। তারপর ঝটপট উত্তর করলো, ‘বুড়ির সাথে দেখা করতে এসেছি। কোন সমস্যা?’

নক্ষত্রের এমন রূক্ষ কন্ঠের জবাবে কিছুটা ভড়কে গেল ইরিন। অপ্রস্তুত স্বরে জবাব দিল, ‘না..সমস্যা হবে কেন! কিন্তু, বুড়ি তো এখানে নাই। আম্মার কাছে গেছে দুদিন আগে। ‘

‘হঠাৎ আম্মার ওখানে কেন? কই আমাকে তো বলেনি। আর তুমি দুদিন ধরে বাসায় একা?’ কিছুটা রেগে প্রশ্ন করলো নক্ষত্র। ইরিনের এভাবে একা বাসা থাকাটা ওর একটুও পছন্দ হয়নি।

‘হ্যাঁ, ভাবীর ছোট ভাইয়ের বিয়ে ছিল। আম্মা একা যেতে চাচ্ছিল না। আবার না গেলেও ভাবী অশান্তি করছিল। তাই বুড়িকে নিয়ে গেছে সাথে করে। কালকেই চলে আসবে ওরা। ‘

‘কই বুড়ি আমাকে তো কিছু বলেনি। ও তো আমাকে না জানিয়ে কখনো কোথাও যায় না এভাবে!’

‘দুনিয়া উল্টে গেলেও আপনাকে না জানিয়ে যাওয়ার মেয়ে কি সে? কল করেছিল বেশ কয়েকবার। না পেয়ে পরে ম্যাসেজ করেছিল। আপনি দেখেনি মে বি।’

ইরিনের কথায় কপালে দুখানা চিন্তার ভাজ ফেলে পকেট হাতড়ে ফোন বের করলো নক্ষত্র। রিতুর নাম্বারে সার্চ দিতেই দেখলো তিনদিন আগে ম্যাসেজ করেছিল সে। কিন্তু, নক্ষত্র ফ্লাইটে ছিল বিধায় ফোন অফ রেখেছি। পরে আর খেয়াল করেনি। নিজের কাজে নিজেই বিরক্ত হলো সে। ইরিন সেটা খেয়াল করে ব্যাপারটা সামলে নিতে প্রসঙ্গ পাল্টে প্রশ্ন করলো, ‘কবে ফিরেছেন আপনি?’

ইরিনের প্রশ্নে রীতিমতো চূড়ান্ত মেজাজ খারাপ হয়ে গেল নক্ষত্রের। কি ভাবে কি এই মেয়ে নিজেকে? দুপুরে নক্ষত্রের জন্য খাবার পাঠিয়ে এখন ভং করে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে কবে ফিরেছে! অবশ্য ইরিন তো আর জানে না..খাবার পাঠানোর ব্যাপারটা নক্ষত্র জানে, বুঝে। তাই তার এই মিছে ভংটুকু মেনে নিল সে। শান্ত গলায় জবাব দিল, ‘দুদিন আগে।’

‘ওহ’ ছোট্ট করে বললো ইরিন। তারপর, নক্ষত্রকে খেয়াল করে ব্যতিব্যস্ত স্বরে বললো, ‘এই আপনি ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে আসুন।’

নক্ষত্রও এবারে খেয়াল করলো যে, সে এতক্ষণ যাবৎ বাইরে দাঁড়িয়েই কথা বলছিল। আজ দিনটাই কেমন এলোমেলোভাবে কেটছে তার। একের পর এক স্বভাব বহির্ভুত কাজ করে যাচ্ছে সে। হতাশ হয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে ভেতরে ঢুকলো সে। দরজা লাগাতে লাগাতে ঝাঁঝালো গলায় বললো, ‘এভাবে হাট করে দরজা খুলে রাখো কেন? যত্তসব বাজে অভ্যাস।’

নক্ষত্রের এমন বকাঝকায় আবারও মুখ ফোলালো ইরিন। একরোখা স্বরে বললো, দরজা কই খুলে রাখি, আজ লাগাতে ভুলে গেছিলাম জাস্ট।’

‘হ্যাঁ, ভুল করায় তো তুমি পিএইচডিধারিণী এক্কেবারে।’ রেগে বিদ্রুপের স্বরে বললো নক্ষত্র।

‘এখন কিন্তু আপনি আমাকে ইনসাল্ট করতেছেন পুতুলের বাবাই।আমি মোটেও সবসময় এমন করিনা। আজকে টায়ার্ড ছিলাম তাই খেয়াল করিনি ভুলে। ‘ অভিমানী গলায় বললো ইরিন।

নক্ষত্র সেটা বুঝেও পাত্তা দিল না। কথা এড়িয়ে ইরিনকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি এখনো অফিসের গেটআপে? অফিস তো ছুটি হয়েছে অনেকক্ষণ। ‘

‘হ্যাঁ, ওই তো অফিস শেষ করে মাসকাবারির বাজার করতে গেছিলাম। মিনিট বিশেক আগেই ফিরেছি বাসায়। সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল তাই ভাবলাম যে একেবারে গুছিয়ে রেখেই ফ্রেশ হতে যাই।’

নক্ষত্র বেশ অবাক হলো ইরিনের কথায়। মিনিট বিশেক আগে এসেছে তাহলে সে কেন দেখলো না তাকে আসতে? নাকি খেয়াল করেনি…তার আগেই ইরিন বিল্ডিং এ ঢুকে গেছিল? এ ব্যাপারে আর বেশি জোর দিয়ে ভাবলো না নক্ষত্র। কেবল কিঞ্চিৎ আফসোস করলো এই ভেবে যে, নীচে দেখতে পেলে উপরে ফ্ল্যাট পর্যন্ত আসতে হতো না। দূর থেকে দেখেই শান্ত মনে ফিরে যাওয়া যেত। অহেতুক এসব মিথ্যা বাহানা…কথা কিছুই বলা লাগতো না। নিজের ভাগ্যের উপর এবারে চরম বিরক্ত হলো নক্ষত্র।

এক পলক ইরিনকে দেখলো চোখ তুলে। এগিয়ে এসে ইরিনের পাশে দাঁড়িয়ে হাত থেকে লিস্টটা টান দিয়ে নিয়ে নিল। ইরিন কিছু বলার আগেই নক্ষত্র বললো, আমি দেখে দিচ্ছি। তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।’

‘এই না…আপনি কেন করবেন। আপনি বসুন গিয়ে আমি ঝটপট গুছিয়ে নিচ্ছি সব। তারপর, চা করে দিচ্ছি আপনাকে। ‘

‘যেটুকু বললাম সেটুকু করো যাও। অফিস শেষ করে এতগুলো বাজার করতে যাওয়া লাগে কেন তোমার? ছুটির দিনে কি করো? ‘

‘অফিসের বাইরেও অনেক কাজ থাকে আমার যেগুলো ছুটির দিনে টাইম ম্যানেজ করে করতে হয় আমাকে।তাই..

‘ইউ মাস্ট বি টায়ার্ড। যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।’

‘ঠিক আছি আমি। ‘

‘ভালো।’ কথাটা বলে এক এক করে লিস্ট আর জিনিসগুলা চেক করতে ব্যস্ত হয়ে গেল নক্ষত্র। ইরিন আর দাঁড়ালো না ওখানে। ফোসঁ করে একটা শ্বাস ছেড়ে পা বাড়ালো ঘরের দিকে। কারণ সে জানেই, নক্ষত্রের সাথে তর্ক যুদ্ধে জয়ী হওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। অযথা ক্যাঁচক্যাঁচ করার কোন মানে নেই।এমনিতেই অনেক ক্লান্ত সে। মাথাটাও ভীষণ চাপ ধরে আছে। কড়া এককাপ চা খাওয়া জরুরি এখন। ফ্রেশ হয়ে এসে চা বানাতে হবে। সাথে নক্ষত্রের জন্য আর কিছু নাস্তা তৈরী করা যায় কিনা ভাবতে ভাবতেই ঘরে ঢুকে গেল সে। নক্ষত্র ইরিনের চলে যাওয়া আরচোখে তাকিয়ে দেখলো একবার। তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে গেল নিজ কাজে। টায়ার্ড লাগছে তারও। দ্রুত কাজ শেষ করা চাই।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here