নানান রঙের মেলা পর্ব -০৫ ও শেষ

‘নানান রঙের মেলা’ পর্ব ৫
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

কামিনী জ্ঞান হারাতেই আবইয়াজ দিশেহারা হয়ে উঠল। উপস্থিত সকলকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কামিনীকে দুই হাতে পাঁজাকোলা করে নিয়ে উপরের দিকে চলে গেল। শোরগোল শুনে ক্যামেলিয়া কি হয়েছে দেখার জন্য নিজের রুম থেকে বেরিয়েছিল। আবইয়াজকে কামিনীকে কোলে করে আনতে দেখে সে বুঝে গেল গড়বড় হয়েই গেছে। সবসময়ের মতো ক্যামেলিয়ার করা কাজের ব’কা গুলো কামিনীকেই খেতে হয়েছে। সে তাৎক্ষণিক নিজেকে কামিনী প্রমাণ করার জন্যে সোজা কামিনীর রুমে গিয়ে বসে রইল। আবইয়াজ কামিনীকে নিয়ে রুমে এসে তাকে যেন দেখেও দেখল না। সে বিছানায় আলতো ভাবে কামিনীকে শুইয়ে দিলো। ক্যামেলিয়া ভেবেছিল তার ম্যাম চলে গেছে। তাই সবার সামনে নির্বিকার বসে থাকে। তবে মাজেদা হককে রুমে প্রবেশ করতে দেখেই সে তব্দা খেয়ে যায়। তিনিও বিস্মিত চোখ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আজমাইন বলল,

-‘ও কামিনী। ক্যামেলিয়া আর কামিনী দুজনেই যমজ।’

ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মাজেদা হক স্বাভাবিক হলেন। মৃদু হেসে এগিয়ে এসে ক্যামেলিয়ার গালে হাত রেখে বললেন,

-‘বাহ্! কি সৌভাগ্য আমার। এখন তবে ছোট ছেলের বিয়েটাও ঠিক করে ফেলতে হবে দেখছি!’

ক্যামেলিয়ার জাওয়াদের ছোট ভাই সাদাবের কথা মনে পড়ল। সাদাব ভাই তো প্রেম করছেন। আহারে! ম্যামের স্বপ্নটা পূরণ হবে না।

কামিনীর জ্ঞান ফিরতেই সে সবাইকে দেখে আগের থেকেও বেশি ঘাবড়ে গেল। ঝরঝর করে কেঁদে দিলো তখনই। কোনো কথাই বলতে পারল না। আবইয়াজকে দেখেই তার যত ভ’য়। আবইয়াজের ওই চোখ দুটো তো চোখ নয় যেন আস্ত আ’গ্নে’য়গি’রি! আবইয়াজকে ফুসতে দেখে কামিনীর গায়ের পোষমে কাঁ’টা দিয়ে উঠছে। ছোট বেলায় একবার ক্যামেলিয়ার কারণে আবইয়াজের হাতে তাকে মা’ই’র খেতে হয়েছিল। যেন তেন মা’ই’র নয়! একেবারে বিছানায় পড়ে থাকার মতো মা’ই’র খেতে হয়েছে। সেটা মনে পড়লে এখনও তার অবস্থা খা’রা’প হয়ে যায়। আবারও তেমন কিছু হবে কিনা এই শঙ্কাতেই সে কান্নায় ভেঙে পড়ছে বারবার।

টুইঙ্কেল মাগরিবের নামাযের পর একটু ঘুমিয়েছিল। হট্টগোলের আওয়াজে তার ঘুমটা ছুটে যায়। তার পাশের রুমটাই কামিনীর। বিছানা ছেড়ে তাড়াতাড়ি সে কামিনীর রুমে ঢুকতেই দেখল কামিনী কাঁদছে আর তাকে বাকি সবাই ঘিরে রেখেছে। টুইঙ্কেল তড়িগড়ি করে তার কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে কাতর স্বরে বলল,

-‘আপা কাঁদছ কেন? দাদু কি মা’রা গেছে?’

আলফাজ ধ’ম’কে উঠল টুইঙ্কেলকে। বলল,

-‘শাট আপ টুনি! কেউ কাঁদলেই কি শুধু দাদু ম’রে তোর কাছে?’

টুইঙ্কেল চুপ হয়ে গেল। আবইয়াজ আর অপেক্ষা করতে পারল না সবটা জানার জন্য। তাই গলার আওয়াজ বাড়িয়ে কামিনীকে বলল,

-‘তুমি কাকে বিয়ে করছ?’

কামিনী ফোপাতে ফোপাতে জবাব দিলো,

-‘কাউকেই না।’

-‘উনি একটু আগে নিচে কি বলেছিলেন আমি শুনতে পেয়েছি। নাটক করছ তুমি?’

-‘না সত্যি বলছি।’

-‘বিয়ে করবে না বলছ আবার ভালোবাসো শুনছি। আমাকে বোকা পেয়েছ তুমি?’

-‘আমি তো আপনাকেই ভালোবাসি।’

কামিনীর কথা শুনে তার বাবা-মা দুজনেই বিব্রতবোধ করলেন। এটা তারা কি শুনছেন! উপস্থিত সবার মুখ এতবড় হা হয়ে গেছে। কামিনীও বুঝে উঠতে পারল না যে সে কি বলতে কি বলে ফেলেছে! আবইয়াজ একটু নরম হলো। হালকা কেঁশে বলল,

-‘তাহলে উনি কেন এসব বলছেন?’

-‘আমি জানব কি করে, আমি তো চিনি না ওনাকে।’

মাজেদা হক থতমত খেয়ে গেলেন এমন কথা শুনে। বললেন,
-‘কি বলছ ক্যামেলিয়া? আমাকে তুমি চিনতে পারছ না!’

আবইয়াজ আর কামিনী দুজনেই চমকে উঠল এই কথা শুনে। এবং একইসাথে বলে উঠল,

-‘আমি ক্যামেলিয়া না!’

-‘ও ক্যামেলিয়া না!’

ক্যামেলিয়া এক কোণায় দাঁড়িয়ে ছিল চুপচাপ। সবার নজর নিজের দিকে পড়তেই ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। মাজেদা হককে বলল,

-‘স্যরি ম্যাম! আমি ভ’য় পেয়ে গিয়েছিলাম তাই এভাবে লুকিয়ে পড়েছিলাম।’

সালাম খান কামিনীর দিকেই তাকালেন। বললেন,

-‘তুমি আবইয়াজকে পছন্দ করো?’

কামিনী ঝটফট দুই দিকে মাথা নাড়ল। যার অর্থ না। সে পছন্দ করে না। আবইয়াজ এমন অস্বীকৃতি সইতে পারল না। ধ’ম’কে উঠে বলল,

-‘এই মেয়ে! থা’প্প’ড় চিনো?’

কামিনী দুই গালে হাত রেখে বলল,

-‘মাফ করেন। আপনি আমার ভাই লাগেন। শুধু ভাই। বড় ভাই। আর কোনো দিন বলব না ভাইয়া। আর কোনো দিন এসব মাথাতেও আনব না। মাফ করে দেন ভাইয়া!’

কামিনী পা ধরতে গেল আবইয়াজের। আবইয়াজ দু পা পিছিয়ে গিয়ে বলল,

-‘দূরে থাকো! কাছে এসো না।’

তারপর শাফকাত খানের দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘চাচা! আমি কামিনীকে বিয়ে করতে চাই। আমার এই সিদ্ধান্তে আপনাদের মত থাকবে আশা করছি।’

কথাটা বলেই এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না সে। হনহনিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। তার মনের মাঝে হুট করেই কেন যেন কামিনীকে বউ করে ঘরে তোলার ইচ্ছে জাগছে।

শাফকাত খান তার তিন ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন আবইয়াজ কখনো মুখ ফুটে কিছু চায়নি। অন্যসময় হলে কিংবা তাদের অন্য কোনো ছেলে হলে ব্যাপারটা তারা মেনে নিতেন না। কিন্তু আবইয়াজ দেখেই তারা এটা মেনে নিচ্ছেন। কামিনীর মা একবার বললেন,

-‘ওরা তো ভাই বোন!’

রহমত খান সেটা শুনে বলেন,

-‘যদিও শুনতে খা’রা’প লাগবে তারপরেও তো এটাই সত্যি যে আবইয়াজ কামিনীর আপন জেঠাতো ভাই নয়। আবইয়াজের বাবা আবতিশাম ভাই আমাদের সৎ ভাই ছিলেন। আমাদের বাবা এক হলেও মা তো ভিন্ন! আহামরি সমস্যা কোথায় তাহলে? অনেকে তো আপন চাচাতো ভাইকেও বিয়ে করে। এই কথার জবাবে আর কেউ কিছু বলার সা’হ’স পায় না।’

তারপর সব হুট করেই হয়ে গেল। ঠিক করা হলো প্রথমে অরোরার বিয়ে হবে। তারপর মেহনাজ আর যাবিরের। তারপরই আবইয়াজের আর কামিনীর বিয়ে দেওয়া হবে। খান বাড়ির কেউই চাইছে না সব বিয়ে এক আসরে দিতে। তারা খানদানি বংশের মানুষ। প্রত্যেকটা মেয়ের বিয়ে আলাদা ভাবে ভিন্ন ভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে সম্পন্ন করবেন।

রাতে মাজেদা হককে জোর করে আটকে রাখলেন বাড়ির বউয়েরা। রান্না চড়িয়েছেন না খাইয়ে ছাড়ছেন না। মাজেদা হক বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন সকলের এমন আচরণে। তারপরেও মনে মনে সন্তুষ্ট হলেন। ছেলে যে ভালো ঘরের মেয়ে পাচ্ছে এটাই তার জন্য অনেক।

আলফাজ মাজেদা হকের সাথে আসা মেয়েটির দিকে একটু পর পরই সুযোগ পেলেই আড়চোখে তাকাচ্ছে। মেয়েটি মাজেদা হকের ভাইয়ের মেয়ে। নাম হলো তনয়া। ঢাকা মেডিকেলে ফিফথ্ ইয়ারে পড়ছে বর্তমানে। সন্ধ্যার দিকে ফুফু কল করে তাকে তাড়াতাড়ি হল থেকে বের হতে বললেন। এমন ভাবে ডেকেছিল সে ভেবেছে কোনো বড় ধরনের বি’প’দ হয়ে গেছে। কোনো রকমে তৈরি হয়ে বের হয়ে এসে জানতে পারে জাওয়াদের জন্য মেয়ে দেখতে যাচ্ছে। শুনে তার প্রচন্ড রা’গ হয় কিন্তু ফুফুকে কিছু বলতেও পারে না। চুপচাপ তার সঙ্গে আসে। আর এখানে আসার পরই একের পর এক শক পাচ্ছে সে। এখন নতুন যেটা যোগ হলো সেটা হলো আলফাজের চো’রা দৃষ্টি। লোকটা দেখতে শুনতে ভালোই, ভদ্র গোছের বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে কেন তাকাচ্ছে তার দিকে! ওহ! সে তো ভুলেই গেছে, শ’য়’তা’ন গুলো ভদ্র বেশেই থাকে। আলফাজকে এড়ানোর জন্যই সে ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু বেশিক্ষণ ফোন হাতে রাখতে পারেনি। টুইঙ্কেল তাকে অরোরার রুমে ডেকে নিয়ে যায়। সাত বোন সেখানেই উপস্থিত ছিল। সবার সাথে আড্ডা দিয়ে তার সময়টা বেশ ভালোই কে’টে যায়।

খেতে বসার সময় টেবিলে তনয়ার বিপরীতে বসে আলফাজ। আর সে পুরোটা সময় এটা সেটা এগিয়ে দিতে থাকে তনয়াকে। এত মানুষজনের মধ্যে, নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ আলাপে ব্যস্ত থাকায় কেউই তাদের লক্ষ্য করেনি। তনয়া খুব ক’ষ্টে রা’গ সংবরণ করে অল্প খেয়েই উঠে পড়ে। রাত বেশি বাড়ছে দেখে মাজেদা হকরা খাওয়ার পর পরই রওনা দেন। তবে ফেরার আগে খান পরিবারের সবাই তাদের বেশ অনুরোধ করলেন অরোরার বায়নাতে যেন তারা সপরিবারে আসে খান বাড়িতে। সবাই তাদের অপেক্ষায় থাকবে। মাজেদা সক আশ্বস্ত করলেন তারা আসবেন।

——————————
পরদিন ভোর ছয়টায় মেহনাজ ছাদে যোগব্যয়াম করছিল। অরোরা চা করে নিয়ে সুজানাকে ডেকে ছাদে আসে। এসে মেহনাজকে নিজ কাজে ব্যস্ত দেখে হেসে টেবিল সাজিয়ে বসে। তার হাতে হুমায়ূন আহমেদের রূপা বইটি। অগণিতবার বইটি তার পড়া হয়েছে। তারপরও পুনরায় পড়তে বি’র’ক্তবোধ করে না সে। এত টানে তাকে বইটা!

সুজানা আর এরিনা একসাথে ছাদে আসে। এসে চেয়ার টেনে বসে। চা খায়, গল্প করে টুকটাক। খানিকপর টুইঙ্কেল আসে ছাদে। মেহনাজকে প্রোটিন শেক দিয়ে সে ধপ করে বসে পড়ে চেয়ারে। সুজানা জিজ্ঞেস করে,

-‘টুকুন, টাকুন আসবে না?’

-‘না। ঘুমাচ্ছে।’

টুকুন টাকুন হলো ক্যামেলিয়া আর কামিনী। তাদেরকে সবাই আদর করে এই নামে ডাকে। গতরাতে কামিনীর ভ’য়ের চোটে জ্বর আসে। আর যমজ হওয়ার জন্য ছোট থেকেই দুজনের অনেক কিছুর মিল আছে। এরমধ্যে একটি হলো একজনের জ্বর আসলে অপরজনেরও অটোমেটিক এসে যায়। কামিনীর জ্বর আসার তিন ঘন্টা পরই ক্যামেলিয়ারও জ্বর আসে। এখন দু বোনই শয্যায় পড়ে গেছে। প্রতিদিন এই সময় সাত বোন ছাদে এসে গল্প করে আর চা খায়। আজ আর তেমনটা হয়নি। আড্ডাও তেমন জমলো না।

চা খাওয়া যখন প্রায় শেষের দিকে, তখন যাবির আসে ছাদে। তাকে দেখে সবাই কোনো কথা বলে না। আসলে বলতে নেয় কিন্তু যাবির ইশারায় চুপ থাকতে বলে তাদের। সবাই মৃদু হেসে চুপিচুপি ছাদ ছাড়ে। মেহনাজ তখন চোখ বন্ধ করে গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিল। তাই সবাই যে ছাদ ছেড়েছে তা সে টের পায় না। তবে একটু পর যাবির তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই সে বুঝতে পারে। যাবিরের ব্যবহার করা পারফিউমের ঘ্রাণটা মেহনাজের চেনা। চোখ খুলতেই সামনে যাবিরকে দেখে সে বি’র’ক্ত হলো। যাবির ভ্রু উঁচিয়ে হেসে বলল,

-‘কিরে! ইয়োগা করছিস!’

মেহনাজ থমথমে গলায় বলল,

-‘এখান থেকে যাও যাবির ভাইয়া।’

-‘তুমি করে বলছিস তবে! আমি তো ভেবেই বসেছিলাম এখন থেকে তুই সম্বোধনই শুনতে হবে।’

-‘ডিস্টার্ব করো না। যাও!’

-‘যাব না।’

মেহনাজ আসন ছেড়ে উঠল। গায়ে ওড়না পেঁচিয়ে নিয়ে বলল,

-‘তুমি একটা অ’স’হ্য’কর মানুষ!’

-‘স’হ্য করার অভ্যেস করে নে।’

-‘পারব না। আর এত সকাল সকাল তোমার এবাড়িতে কি? শুনেছি ভোর রাতে ফিরেছ। তা চার ঘন্টাও তো হলো না। এখনই নানাবাড়ি চলে এলে! একটু শরম করো।’

-‘নানাবাড়ি আসতে শরম কীসের! হ্যাঁ, তুই চাইলে এটা বলতে পারিস যে হবু শ্বশুর বাড়িতে এত সকালে আসা ঠিক না। তাই বলে নানাবাড়ির খোঁ’টা দিবি? এই আমার মামা তোকে আসলে কি খাইয়ে এমন পা’ষা’ণ বানালো?’

-‘মামাকেই জিজ্ঞেস করো।’

-‘তুই বল, তুই কি খাস সেটা তো তোর জানার কথা।’

-‘ধ্যাত!’

মেহনাজ নিচে নামার জন্য পা বাড়ায়। তাকে প্রস্থান নিতে দেখে যাবির জোর জোরে গাইতে থাকে,

“তোমার বাড়ির রাস্তাটার
মায়ায় পড়েছি,
তোমার বাড়ির ফুল গাছটার
মায়ায় পড়েছি,
তোমার বাড়ির গেটের আমি
মায়ায় পড়েছি,
তোমার বাড়ির জানালার
মায়ায় পড়েছি,

এই ভেবো না তোমার বাবার
ধনের লো’ভে পড়েছি,

হায় হায় হায়!
হায় হায় হায় হায়রে হায়
তোমায় ভালোবেসেছি!”

এমন এক গান শুনে মেহনাজ তাজ্জব বনে গেল। পেছন ফিরে কিছুসময় অবাক চোখে যাবিরের দিকে তাকিয়ে থেকে সে চলে যায়।

যাবির তিন তলায় এসে দেখে আবইয়াজ কামিনীর রুমের দিকে যাচ্ছে। যাবির তার কাছে গিয়ে বলে,

-‘কি ভায়া! শুনছি আমার শালিকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছ। তা আমাকে তো কখনো জানালে না যে ভেতরে ভেতরে এসব চলছে!’

আবইয়াজ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল,

-‘কি সব চলছে?’

-‘বোঝো না তাই না? অলওয়েজ এমন অবুঝ সেজেই তো চলেছ। আমি জানতাম লাস্ট বলে তুমিই ছক্কা মা’রবে। আর দ্যাখো! প্রেডিকশন মিলে গেলো।’

আবইয়াজ অ’গ্নিদৃষ্টিতে তাকালো যাবিরের দিকে। দশ নাম্বার বি’প’দ সংচেত আঁচ করতে পেরে যাবির দ্রুত সেই জায়গা ত্যাগ করে। যাবির চলে যাওয়ার পর আবইয়াজ আরো কিছুক্ষণ কামিনীর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু ভেতরে ঢোকার সা’হ’স পায় না। তাই নিজের ঘরে ফিরে যায়।

ক্যামেলিয়া ঘুমের ঘোরে ফোনের রিংটোনের শব্দ পেয়ে পাশ থেকে ফোনটা হাতে তুলে নেয়। চোখ মেলে দেখে আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে শুনতে পেলো,

-‘ভালোবাসি ক্যামেলিয়া। খুব বেশিই ভালোবাসি।’

এই এত অবসাদের মধ্যেও ক্যামেলিয়ার মনে হলো, আহা! এটাই বুঝি সুখ!

পরিশিষ্ট:

আজ অরোরার বায়না। সকাল থেকে খান বাড়ি হৈ চৈ এ মেতে আছে। গোটা বাড়ি সুন্দর, সুসজ্জিত ভাবে সাজানো। বাড়ির সবাই খুবই ব্যস্ত ভঙ্গিতে এদিক ওদিক ঘুরঘুর করছে। তবে এত ব্যস্ত মানুষের মধ্যে একজন খুবই আরামে হল রুমের নতুন সোফায় বসে আছে। সেই মানুষটি হলো বুয়া। নিউমার্কেট থেকে কিনে আনা চুমকি চুমকি লাল রঙের কাপড় পরে, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক দিয়ে, চোখের উপর সানগ্লাস লাগিয়ে, হাতে একটা কটকটে লাল রঙের পার্স নিয়ে বসে আছে। গতকাল রাতেই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন আজ কোনো কাজ করবেন না। অবশ্য তিনি কোনো কাজই করে না। বুয়া এই বাড়িতে আছে আঠাশ বছর হতে চলেছে। হোসনে আরা বেগমের গ্রামের তিনি। অকালে স্বামী সন্তান হারিয়ে যখন বাপের ভিটায় ভাইয়ের বউয়ের লাঠি ঝাটা খায় তখন গ্রামের মহাজনের দয়া হয়। পাঠিয়ে দেন তাকে ঢাকায় হোসনে আরার কাছে। এসেছিলেন তো মূলত কাজ করার জন্যে। কিন্তু যে বছর তিনি এই বাড়িতে আসেন সেই বছর আলফাজের জন্ম হয়। আর তখন তার উপর আলফাজের দেখা শোনা করার দায়িত্ব পড়ে। আলফাজের দেখাশোনা করাই তখন তার কাজ হয়ে যায়। এরপর অরোরা হলো তারও দেখাশোনার ভার পড়ল বুয়ার উপর। এরপর মেহনাজ, এরিনা, সুজানা, ক্যামেলিয়া, কামিনী, নিয়ন , টুইঙ্কেল, রিজভী এদের সবার দেখোশোনাই তিনি করেন। এই এতগুলো বাচ্চার দেখাশোনা করাতে কখনোই বাড়ির অন্যান্য কাজ তিনি করেননি। বুয়া শুধু তিনি নামেই ছিলেন তবে তার কাজ ছিল কেবল বাচ্চাদের সাথে থাকা, তাদের খাওয়ানো, গার্ডেনে তাদের সাথে খেলা করা ব্যাস! বাচ্চাদের কাপড় ধোয়ার কাজও করেননি তিনি কখনো। সেটার জন্য আলাদা লোক ছিল। যেহেতু বুয়া বলেই সবাই তাকে প্রথমে ডেকেছিল তাই তার নাম বুয়াই হয়ে গেল। তবে তিনে নিজেকে ন্যানি ভাবে। অবশ্য উচ্চারণে বলে উল্টোটা। এই যেমন একটু আগে তিনি যখন বসেছিলেন তখন তার কাছে দুইজন মহিলা আসেন। জিজ্ঞেস করেন,

-‘আপনি মেয়ের কি হন?’

বুয়া গম্ভীর স্বরে জবাব দেয়,

-‘আমি অরোরা মায়ের নানি।’

মহিলা চরম অবাক হলেন। চোখ কপালে তুলে তিনি বলেন,

-‘কি! আপনি নানি?’

-‘হ।’

-‘সত্যি?’

-‘তয় আমি মিছা কতা কমু?’

-‘এত ইয়াং নানি! মানে অরোরার মাকে একটু আগে দেখলাম। বয়স তো একই হবে আপনাদের।’

-‘তাও আমি নানি।’

মহিলা যিনি প্রশ্ন করছিলেন তিনি হলেন শাহরিয়ারের মামি। তিনি বুয়ার কনফিডেন্স দেখে সত্যিই তাকে নানি ভেবে বসল। শাহরিয়ারের নানিকেও আজ আনা হয়েছে। তিনি বসে আছেন ওই পাশের সোফায়। তিনি বুয়াকে নিয়ে গিয়ে শাহরিয়ারের নানির পাশে বসিয়ে দিলেন। এর একটু পরই সেখানে টুইঙ্কেল আসে। এসে জিজ্ঞেস করে,

-‘বুয়া! আপনি এখানে? দাদু কোথায়?’

বুয়ার বলার সাথে সাথেই মহিলা গুলোর মুখের রঙ বদলে গেল। টুইঙ্কেল ব্যস্ত ভঙ্গিতে নিজের দাদুকে খুঁজতে লাগল। পেয়েও গেল। একটু সামনেই টেবিলের পাশে একটা পিঁড়িতে কপালে হাত দিয়ে উদাস হয়ে বসে আছেন। টুইঙ্কেল তাড়াতাড়ি নিজের দাদুকে সেখান থেকে উঠিয়ে অন্য সোফায় নিয়ে গিয়ে বসালো। তারপর বুয়াকে মৃদু রা’গ দেখিয়ে বলল,

-‘বুয়া! আপনাকে বলেছি দাদুর খেয়াল রাখতে। আর আপনি কিনা তাকে এভাবে নিচে পিঁড়িতে বসিয়ে রেখেছন!’

বুয়া আ’সা’মীর মতো মুখ করে বললেন,

-‘আমি ভুইলা গেছিলাম মা টঙ্কেল।’

-‘উফ বুয়া! কতদিন বলেছি আমাকে টঙ্কেল ডাকবেন না! তারপরেও কেন ডাকেন? বাকিদের মতো টুনি ডাকলেও তো পারেন। টঙ্কেল খুবই অদ্ভুত ডাক।’

টুইঙ্কেল রা’গে গজগজ করতে করতে চলে যাওয়ার পরই বুয়ার পাশ থেকে শাহরিয়ারের মামি তার শ্বাশুড়িকে উঠিয়ে নিয়ে আবার হোসনে আরার পাশে নিয়ে বসালো। এরপরই বুয়া সেদিকে তাকিয়ে মুখে ভেঙচি কেঁটে অন্যত্র এসে বসে রইল।

তাজওয়ার এসেছে থেকেই এরিনার দেখা পায়নি। তাই উপরে উঠে সুজানাকে দেখতে পেয়ে এরিনার খোঁজ নিতে চাইলে সুজানা সোজা তাকে এরিনার রুমেই পাঠিয়ে দেয়। সেখানে গিয়েই তাজওয়ার দেখে শাড়ি পরে আছে এরিনা। কানের দুল পরছে। তাজওয়ারকে দেখে অবাক হলো। বলল,

-‘আপনি কখন এলেন?’

-‘এই তো একটু আগেই।’

এরিনা পুনরায় সাজতে ব্যস্ত হয়ে গেল। কিন্তু হুট করেই কিছু মনে পড়ে তার। তাই তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলে,

-‘সেদিন ওইরকম করেছেন কেন? আপনাকে কে ওই ভুয়া সংবাদ দিয়েছিল?’

তাজওয়ার ইতস্তত গলায় জবাব দিলো,

-‘শান্ত রিজভীর থেকে শুনেছিল। আর তারপর আমাকে বলে। আমরা তো জানতাম তুমিই শুধু ওর বোন। মানে অরোরা আপু যে আছেন তার খবর তো আর জানতাম না। তাই ওইরকম হয়ে গেছিল। আর তাছাড়া পরে যখন কল দিলাম তখন তো তুমি ক্লিয়ার করতে পারতে!’

-‘আমিও বুঝতে পারিনি।’

এরিনা হেসে ফেলে। হাসল তাজওয়ার ও। ভুল বোঝাবুঝিটা হয়ে খুব ভালো হয়েছে। যদি না হতো তবে আজ এসময় তাজওয়ার কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারত?

যাবির মেহনাজের রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খোলা কিন্তু ভেতরে ঢোকার অনুমতি তাকে মেহনাজ দেয়নি। যাবির বলে,

-‘স্যরি আর কখনো ওইরকম রাফলি বিহেইভ করব না।’

-‘যাবির ভাইয়া যাও এখান থেকে! তোমাকে কতবার বলব তুমি আমার কাছে কেবল ভাই।’

-‘আমি হতে চাই না ভাইয়া। আমি তো হতে চাই সাইয়া।’

-‘যাবে তুমি?’

-উহু!’

-‘ধুর। এই তোমাকে কোন পাগল এই নিউজ দিয়েছিল? বিদেশ ছিলে আমি ভালোই ছিলাম। যেই পাগল দিয়েছে খবর তাকে না চড়িয়ে দিলে আমার শান্তি হবে না।’

-‘রাফিদ ভাইকে চ’ড় দিবি?’

মেহনাজ অবাক হলো। রাফিদ তাদের পাশের বাড়ির। আবইয়াজ, আলফাজ, আজমাইন, যাবির এদের সবার সাথে তার বন্ধুর মতো সম্পর্ক। তবে যতই বন্ধু হোক, তার তো এত ভেতরের কথা জানার কথা না। তাই সে বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইল,

-‘ওনাকে কে বলেছে আবার!’

-‘তোদের বাড়ির ছুটা বুয়া মর্জিনা গিয়ে রাফিদ ভাইয়ের বউকে বলেছে তোর বিয়ে। আর ভাই তো জানে আমি তোকে পছন্দ করি। তাই আমাকে জানিয়ে দিয়েছে কল করে।’

-‘আজ মর্জিনার খবর করে ছাড়ব আমি!’

মেহনাজের অনুমতির অপেক্ষা আর করে না যাবির। সোজা রুমে ঢুকে মেহনাজের হাত চেপে ধরে বলল,

-‘তুই এমন কেন করিস বল না! ভালোবাসি তো তোকে!’

মেহনাজ কিছু বলল না। কিছুক্ষণ চুপ করে চেয়ে রইল যাবিরের মুখের দিকে। তারপর এমন একটা কথা বলল যা শোনার জন্য যাবির প্রস্তুত ছিল না।

কামিনী আর ক্যামেলিয়া দুজনেই একটু সুস্থ হয়েছে। ক্যামেলিয়া হবু শ্বাশুড়ির কাছে আছে। আর কামিনী আবইয়াজের সাথে। আবইয়াজ ই তাকে জোর করে নিজের পাশে পাশে রাখছে। একটু পর পরই এটা সেটা এনে দিচ্ছে খাওয়ার জন্য। সে যে পেটুক, এটা তো আবইয়াজ ভালোই জানে। তবে জ্বরের মুখে পেটুকটা খেতে পারছে না। আবইয়াজের খুব ক’ষ্ট হচ্ছে তাই পেটুকের জন্য। কামিনী অবশ্য ল’জ্জ পাচ্ছে। বাড়ির সবাই সামনে থাকাতে তার ল’জ্জায়, অস্বস্তিতে মাথা নত হয়ে যাচ্ছে।

নিবরাস এসেছে থেকেই টুইঙ্কেলের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। টুইঙ্কেল অবশ্য এত কিছু বুঝল না। সে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই আলাপ সাড়ে নিবরাসের সাথে। এই স্বল্প আলাপে নিবরাসের মন ভরে না। সে ঘুরঘুর করতেই থাকে। সালাম সাহেব ড্রয়িং রুমে আসেন তখন সবেমাত্র। এসে নিবরাসকে দেখে তার হাহাকার টা আবারও জেগে ওঠে। কামিনী আর ক্যামেলিয়ার সাথেও তার বিয়ে দিতে পারবেন না। ছেলেটাকে এ বাড়ির জামাই করা আর হবে না। হঠাৎ করেই তার নজর পড়ল টুইঙ্কেলের উপর। শাড়ি পরে বড় মেয়ে সেজে আছে সে। নিবরাসের দিকে আরেকবার তাকাতেই তিনি দেখলেন নিবরাসের নজর টুইঙ্কেলের দিকেই। মনে মনে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন। টুইঙ্কেলকেই বিয়ে দিইয়ে দিবেন নিবরাসের সাথে। দরকার পড়লে জোর করে দিবে। ছোট ভাইয়ের সাথে কথা বলতে হবে এ ব্যাপারে! তিনি ইমরোজ খানকে খুঁজতে লাগলেন।

আংটি পরানোর সময় শাহরিয়ার আর অরোরা এক সাথে দাঁড়ায়। আংটি পরাতে নিবে যখন তখন শাহরিয়ারের কল আসে। জরুরী ভিত্তিতে হসপিটাল যেতে হবে। এমার্জেন্সী!

শাহরিয়ার চলে যেতেই সেদিকে ছলছল চোখে অরোরা তাকিয়ে রইল। এই হসপিটাল কি এখন তার শ’ত্রু হতে চাইছে? নাকি শাহরিয়ারের পেশাটা! সে অভিমান করে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে রইল।

শাহরিয়ার যখন ফিরল ততক্ষণে সবাই খাওয়া দাওয়া সেড়ে ফেলেছে। রাতও হয়ে যায় অনেক। তাকে দেখে প্রথমেই তার মা এক দফা বকলেন। তারপর তার খালা বকলেন। বকাবকি শেষ হওয়ার পর আংটি বদলের অনুষ্ঠান শুরু হলো পুনরায়। অরোরা কেঁদেছিল তাই তার চোখ মুখ লাল ছিল একেবারে প্রথম দিনের মতো। শাহরিয়ার প্রথমে নিজের কাজে অনুতপ্ত হলেও এবার খুশিই হলো। ভালোই হয়েছে সে চলে গিয়েছিল। নয়তো এমন কান্না করে লাল করে ফেলা সুন্দর মুখটার দেখা পেত কী?

সবশেষে গ্রুপ ফটো তোলা হলো। সবাই যার যার মতো পজিশন নিয়েছিল। আলফাজ দাঁড়ালো তনয়ার পাশে। তনয়া তা দেখে বি’র’ক্ততি মুখ কুঁচকে ফেলল।
যাবির আজমাইনের পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল। মূলত তাকে একটা কথা বলার জন্যই সে মেহনাজকে ছেড়ে এখানে দাঁড়িয়েছে। আজমাইন বলল,

-‘তোর সে তো ওইখানে। তুই এখানে কি করছিস?’

-‘দরকার আছে ভাই।’

-‘কি হয়েছে?’

-‘তোমার বোন বলছে আমার মেডিকেল টেস্ট করাতে হবে। আত্মীয়ে আত্মীয়ে বিয়েতে নাকি সমস্যা হয়। এখন কি করি বলো তো! টেস্ট করালে লোকে আমাকে কি বলবে?’

-‘কি বলবে? কিছুই বলবে না। এক কাজ করিস, শাহরিয়ার ভাইয়ার সাথে আমি কথা বলে নিব। তার হসপিটালেই গিয়ে টেস্টটা করিয়ে নিস।’

যাবির অসহায় মুখ করে মেহনাজের দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘আচ্ছা। তাই হবে!’

ক্যামেরা ম্যান সবাইকে হেসে ছবি তুলতে বলল। কেউই হাসছে না। তাই দেখে রিজভী বলল,

-‘সবাই বলো চিজ!’

সবাই চিজ বলতে নিলেই বুয়ার হাঁচি এসে যায়। তিনি বাড়ি কাঁপিয়ে হাঁচি দিলেন,

‘হাচ্চু’

সবাই ওমনি হাসা শুরু করল। ক্যামেরা ম্যান এসেছে থেকেই আজিব সব কাজকর্ম দেখছে। শেষ স্ন্যাপটা নেওয়ার সময় সে বিড়বিড় করে বলতে লাগল,

-‘নানান রঙের মেলা!’

(সমাপ্ত)

(প্রিয় পাঠকগণ, কেমন লেগেছে এই পুরো গল্পটা জানাতে ভুলবেন না।)

টাইপো করেছেন Ifrat Akther Popy আপু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here