না চাইলেও তুই আমার পর্ব ২৩+২৪

#না_চাইলেও_তুই_আমার_02
#লেখিকা_সারজীন_ইসলাম
#পর্বঃ ২৩
মিরা মিহানের বুকের সাথে লেপ্টে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মিহান মিরাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলে,

—” শান্ত হও। পানি খাবে?”

মিরা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললে, মিহান কিছু করে উঠার আগেই প্রিয়া ওর ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে মিরার হাতে দেয়। মিরা পানি খেয়ে নিজেকে শান্ত করে আশেপাশে তাকায়। ওদের ঘিরে একটা বড়সড় ভীর হয়ে আছে। রিসাবের দলের ছেলেরা রিসাবকে ধরে দাঁড় করিয়ে হাত পা চেক করছে। রিসাবকে ধরে রাখা ছেলেটা রেগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,

—” রিসাবের যদি কিছু হয় না তাহলে তোমার কী হাল করবো তুমি ভাবতেও পারছো না।”

—” ইউ….

মিরা বলার আগে মিহান হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে নিজের মুখের রুমাল টা খুলে ফেলে। সবাই ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে থাকে মিহানের দিকে। কেউ কেউ মিহানকে দেখে দুই পা পিছিয়ে গেছে। মিহান পকেটে হাত ঢুকিয়ে অ্যাটিটিউড নিয়ে রিসাবদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

—” তোমাদের না আগে একবার সাবধান করা হয়েছিলো মেয়েদের উত্যক্ত করা নিয়ে?”

রিসাবরা সবাই কাঁপা কাঁপি শুরু করে দিয়েছে মিহানের কথায়। ওরা কিছু না বললে মিহান ধমকের সুরে বলে,

—” কী হলো কথা বলছো না কেনো?”

রিসাব ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলে,

—” আমি কাউকে উত্যক্ত করিনি। আমি মিরাকে ভালোবাসি। সত্যি বলছি আমি মিরাকে ভালোবাসি।”

মিহান চোখ লাল করে রিসাবের দিকে তাকায়। আবার কিছু ভেবে মুচকি হেসে দিয়ে মিরার কাছে গিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরে বলে,

—” Listen everyone. Mira is my life partner. আমাদের বিয়ে খুব তাড়াতাড়ি হতে যাচ্ছে। আমার ভালোবাসা, আমার মিরা জানপাখির দিকে যে চোখ তুলে তাকাবে তার কী অবস্থা করবো তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না?”

মিহান একটু বলে থেকে রিসাবদের দিকে তাকিয়ে আবার বলে,

—” জানো তো আমি কে? মিহান চৌধুরী আমি। অন্য সব মেয়েদের বিরক্ত করলে আমি কী করি তা তো কম বেশি সবাই জানো? আর আমার ভালোবাসার মানুষটাকে কেউ যদি কিছু বলে তাহলে আমি তার কী হল করবো তা নিশ্চয়ই কাউকে বলে দিতে হবে না!”

মিরা মিহানের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। মিহান ওদের এভাবে থ্রেট দিচ্ছে কেনো মিরা বুঝতে পারছে না। আর ওরাই বা ওর কথা শুনছে কেনো? ওদের চেহারা বলে দিচ্ছি ওরা খুব ভয় পেয়ে আছে। মিহান মিরার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “কী হলো!” মিরা ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে বলে,

—” না কিছু না। আমার ভালো লাগছে না, চল বাড়ি যাই ভীতুরাম।”

মিহান মিরার মাথায় হাত দিয়ে বলে,

—” শরীর খারাপ লাগছে তোমার?”

—” আরে না তেমন কিছু না। এমনি ভালো লাগছে না।”

—” ঠিক আছে চলো বাড়িতে যাই। এই যে আমার শালা শালিকারা তোমার কী যাবে আমাদের সাথে?”

প্রেম খুব দ্রুত উত্তর দেয়,

—” হ্যা ভাইয়া আমরাও যাবো।”

—” চলো তাহলে।”

মিহান মিরার হাত ধরে ধীর পায়ে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে যায়। অনেকে ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রেমরাও মিরাদের পিছন পিছন বেরিয়ে যায় ভার্সিটি থেকে।

————————————

মিরা Airport এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে, সাথে প্রিয়া, নীলা আর নিঝুম আছে। প্রেম অফিসের কাজে আটকে গেছে তাই ওদের সাথে আসতে পারেনি। মিনিট দুয়েক আগে মিরার পাপা মাম্মা চলে গেছে ভিতরের দিকে, আর কিছু পর ওদের ফ্লাইট ছেড়ে দিবে। মিরা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,

—” চল বাড়ি যাই এখন।”

নীলা মিরার দিকে তাকিয়ে বলে,

—” হ্যা, চল বাড়ি চল। সন্ধ্যা হয়ে এলো বলে।”

নিঝুম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,

—” এখনো এক ঘন্টার পর সন্ধ্যা হবে।”

মিরা ওদের থামিয়ে বলে,

—” গাড়িতে বসে যত খুশি কথা বলিস চল এখন।”

সবাই গাড়িতে উঠে বসলে নিঝুম মিরার পাশে বসে। মিরা ড্রাইভিং সিটে, প্রিয়া আর নীলা পিছনে সিটে। মিরা গাড়ি চালানো শুরু করলে নিঝুম বলে,

—” আপু FM ছাড়ি বসে থাকতে ভালো লাগছে না।”

মিরা নিঝুমের দিকে না তাকিয়ে বলে,

—” তোরা এই FM এ কী পেয়েছিস আল্লাহ ই জানে? আচ্ছা ছাড় আমিও শুনি রোমান্টিক রোমান্টিক কথা।”

মিরা মুখের এক্সপ্রেশন দেখে প্রিয়া আর নীলা খিটখিটিয়ে হেসে দেয়। নিঝুম ওদের দিকে না তাকিয়ে FM ছেড়ে শুনতে শুরু করে।

কোনো মিষ্টি মেয়ের কন্ঠস্বর শুনে সবাই চুপ করে শুনতে শুরু করে।

—” যদি বলো তোমার কথা মনে পড়ে কতবার? আমি বলবো চোখের পাতা নড়ে যত বার। যদি বলো তোমায় ভালোবাসি কত? আমি বলব আকাশে তারা আছে যত! আমি তোমাকে চাই কল্পনাতে নয় বাস্তবে আমি তোমাকে চাই ছলনাতে নয় ভালোবাসায়। আমি তোমাকে চাই তোমার মত করে নয় আমার মত করে আমি তোমাকে চাই খনিকের জন্য নয় চিরদিনের জন্য।”

মিরা নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বলে,

—” মেয়েটার নাম জানিস?”

—” কেনো আপু?”

—” খুব মিষ্টি কন্ঠটা তাই জানতে চাইছিলাম।”

হঠাৎ নীলা উত্তেজিত হয়ে বলে,

—” মিরা সামনে তাকা।”

মিরা তাড়াতাড়ি করে সামনে তাকিয়ে দেখে একটা বাচ্চা ওদের গাড়ির দিকে ছুটে আসছে। তার পিছন পিছন আরো দুজন মহিলা ছুটে আসছে। মিরা আর কিছু না ভেবে দ্রুত ব্রেক কষে।

————————————

মিহান সন্ধ্যার পর ঘুম থেকে উঠে নিচে আসে। অনু পাশের সোফায় বসে দুষ্টুমিতে মেতে উঠে দুজনে। মিহানের মম ওদের কফি দিয়ে যাওয়ার সময় ওদের বকে যায় দুষ্টুমি করার জন্য। কিন্তু কে শুনে কার কথা? দুজনে আবার মেতে উঠে। কফি খেতে খেতে দুজনে দুজনকে খোঁচা দিয়ে কথা বলতে থাকে। মিহান কফি শেষ করে উঠতে গেলে ফোন বেজে উঠে। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে প্রিয়া ফোন করছে। মিহান ফোন রিসিভ করে বলে,

—” হ্যা প্রিয়া বলো!”

—” জিজু আপনি একটু Airport এর পাশের হসপিটালে আসতে পারবেন?”

মিহান উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে,

—” মিরা কিছু হয়েছে? মিরা ঠিক আছে তো? কারো কিছু হয়নি তো?”

—” জিজু ফোনে এতো কিছু বলার সময় নেই। আপনি আগে আসুন।”

এই বলে প্রিয়া দ্রুত ফোন কেটে দেয়। মিহান বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে যাবার সময় পিছন থেকে অনু জিজ্ঞাসা করে,

—” কী রে এখন আবার কোথায় যাচ্ছিস? কে ফোন করেছিলো?”

মিহান কোনো কিছুর উত্তর না দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে। অনু মিহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একা একা বলে,

—” এর আবার কী হলো?”

————————————

মিহান হসপিটালের সামনে দাঁড়িয়ে প্রিয়াকে ফোন করে, প্রিয়া ফোন রিসিভ করলে মিহান আশেপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে বলে,

—” আমি হসপিটালের সামনে। কোথায় তোমরা?”

প্রিয়া নিঃশ্বাস নিয়ে ছোট করে বলে,

—” সেকেন্ড ফ্লোর ১০২ নাম্বার রুমে।”

মিহান ফোন রেখে পা বাড়ায় হসপিটালের দিকে। খুঁজে খুঁজে মিহান ১০২ নাম্বার রুমে হাজির হয়। ভালো করে রুমে চোখ বুলিয় মিহান। মিরা বেডে আধশোয়া অবস্থায় চোখ বন্ধ করে আছে আর বুকের সাথে একটা বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে আছে। কপালে ছোটো ব্যান্ডেজ করা। মিহানের বুক মোচড় দিয়ে উঠে মিরার এই অবস্থা দেখে। পাশের সোফায় দুজন মহিলা বসে আছে, নীলা, নিঝুম আর প্রিয়া বেডের এক কোনে বসে আছে। মিহানকে দেখে প্রিয়া আর নীলা এগিয়ে আসে। মিহান ওদের পাশ কাটিয়ে মিরার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। মিহান মিরার ব্যান্ডেজের জায়গায় ঠোঁট ছোঁয়ায়। মিরা পিটপিট করে মিহানের দিকে তাকায়।
#না_চাইলেও_তুই_আমার_02
#লেখিকা_সারজীন_ইসলাম
#পর্বঃ ২৪
মিহান ব্যতিব্যস্ত হয়ে মিরার হাত পা চেক করছে আর কোথায় ব্যথা পেয়েছে কী না? মিরা ছোট ছোট চোখে মিহানের দিকে তাকিয়ে আছে অদ্ভুত দৃষ্টিতে। মিহান চোখ মুখ শক্ত করে জিজ্ঞাসা করে।

—” কীভাবে এক্সিডেন্ট হলো?”

মিরা কিছু না বলে মিহানের দিকে তাকিয়ে আছে। মিহানকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত সে। মিহান ধমক দিয়ে বলে,

—” কী হলো কথা বলছো না কেনো? কীভাবে এক্সিডেন্ট করেছো?”

মিরা হালকা কেঁপে ওঠে মিহানের ধমকে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে সবাই ওদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মিরা বুকে ঘুমিয়ে থাকা বাচ্চাটাকে ভালো ভাবে জড়িয়ে ধরে বলতে শুরু করে।

—” এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফিরছিলাম তখন….

মিরাকে বলতে না দিয়ে মিহান ভ্রু কুঁচকে বলে,

—” এক মিনিট এক মিনিট এয়ারপোর্টে গেছিলে কেনো?”

মিরা বিরক্ত হয়ে বলে,

—” আমাকে কথা সম্পূর্ণ বলতে দিবি না কী?”

—” আচ্ছা বলো।”

মিরা জোরে শ্বাস নিয়ে বলে,

—” পাপার এমার্জেন্সি কাজ পড়ে যাওয়া আজ বিকালে মাম্মা আর পাপা লন্ডন চলে গেছে। তাদের পৌঁছে দিতে এয়ারপোর্টে গেছিলাম। বাড়ি ফেরার সময় আমি গাড়ি ড্রাইভ করছিলাম, হঠাৎ করে এই বাচ্চাটা গাড়ির সামনে চলে আসে ওকে বাঁচাতে গাড়ি দ্রুত ব্রেক করি। তাই সামান্য কপালটা কেটে গেছে গেছে।”

মিরা থামলে মিহান একবার বাচ্চাটার দিকে তাকায় পরে মিরার দিকে তাকিয়ে বলে,

—-” তারপর কী হলো?”

মাঝে নীলা মিহানের দিকে এগিয়েছে বলে,

—” ভাইয়া এর পরের ঘটনা আমি বলছি।”

মিহান নীলার দিকে তাকালেন নীলা বলতে শুরু করে।

———————————–

মিরা নিজের দিকে খেয়াল না করে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে বাচ্চাটার কোথায় লেগেছে কী না তা দেখতে থাকে। বাচ্চাটা কিছু না বুঝে মিরাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। এরমধ্যে মহিলা দুইজন দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আসে। মিরা বাচ্চার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মহিলাদের দিকে তাকিয়ে বলে,

—” এইভাবে বাচ্চাটা দৌড়ে আসছিলো কেনো? আর আপনারাই বা কেনো ওর পিছু দৌড়ে দৌড়ে আসছিলেন?”

মহিলা দুইজনের মধ্যে একজন জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলে,

—” মা আমরা সামনে যে এতিমখানা টা আছে না? আমরা সেখানে চাকরি করি। আর বাচ্চাটাও সেখানকার।”

নীলা শান্ত গলায় বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলে,

—” তাহলে ও এতিমখানা ছেড়ে এখানে আসলো কীভাবে?”

অন্য মহিলা আহত কন্ঠে বলে,

—” বাবুর মা বাবা কে বা কারা আমরা কেউ জানিনা। হাসপাতাল থেকে ওকে আমাদের এতিমখানায় রেখেছে যায় তিন বছরের বেশি হতে চললো। বাবু যখন একটু একটু কথা বলতে শুরু করে তখন থেকেই ও মা পাগল। ছেলেরা মা পাগল হয় তা সবাই জানে কিন্তু সেই তুলনায় বাবু একটু বেশি পাগলামি করে ওর মায়ের জন্য। সব কথায় মা। মা ছাড়া কিছু বুঝেনা। এইটুকু বয়সে কতবার এতিমখানা থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে ওর মাকে খুঁজতে। কিন্তু আজ দারোয়ানের চোখে বালু দিয়ে এতিমখানা থেকে বেরিয়ে এসেছে। দারোয়ানের চিৎকার শুনে আমরা এতিমখানা থেকে বেরিয়ে এসে দেখি বাবু এতিমখানা থেকে বেরিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। তারপর আমি আর মিনা ওর পিছন পিছন দৌড়ে এতদূর এসেছি।”

মিরা সবশুনে বাচ্চাটাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে ভালোভাবে দেখতে থাকে। দুধে আলতা গায়ের রং, চুলগুলো বিদেশীদের মত, চোখ দেখে মনে হল লেন্স লাগানো। মিরা বাচ্চাটাকে দেখে কেমন বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে। এইটুকু বাচ্চা কী না মা ছাড়া থাকে ভাবতেই মিরার কেমন লাগছে। মিরা বাচ্চাটার কপালে চুমু দিয়ে আবার জড়িয়ে ধরে। নিঝুম বলে,

—” আপু তোমার মাথা থেকে রক্ত বেরোচ্ছে চলো হসপিটালে যাবে। পাশেই একটা হসপিটাল আছে।”

প্রিয়াও নিঝুমের কথায় সায় দিয়ে বলে,

—” হ্যা, মিরা চল না হলে ইনফেকশন হয়ে যাবে।”

মিরা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

—” আমার কিছু হয়নি তোরা চিন্তা করিস না আমি ঠিক আছি।”

নীলা রাগ দেখিয়ে মিরাকে বলে,

—” মিরা জেদ করিস না চল। মামা মামী জানতে পারলে চিন্তা করবে চল।”

মিরা আর কিছু না বলে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ওদের সাথে হসপিটালে দিকে রওনা দেয়।

———————————–

মিহান সব শুনে একবার বাচ্চাটাকে দেখে। মিহান চিন্তা করে কি সুন্দর ছেলেটা অথচ আমায় বাবা-মা হয়তো থেকেও নেই। মিহানো ওর মমকে খুব ভালোবাসে। ছোটবেলায় মিহান ওর মমকে ‌ ছাড়া কিছু বুঝতো না। তাহলে এটুকু বাচ্চারা কি দোষ দিবে মিহান। এই ভেবে মিহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু ঝুঁকে বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। পাশের সোফায় বসে থাকা মহিলাদের মধ্যে বেলি নামের মহিলা উঠে এসে ইতস্তত বোধ করে মিহানকে বলে,

—” বাবা আমাদের জন্য তোমরা অনেক কষ্ট করেছ। আর কষ্ট দেবো না। এখন আমাদের যেতে হবে। রাত তো অনেক হলো। এতিমখানায় ফিরতে হবে আমাদের। মা বাবুকে দেও আমাদের কাছে। ঘুমিয়ে আছে এখনই নিয়ে যেতে হবে না হলে আবার শুরু করবে কান্না।”

মিরা ওর বুকে ঘুমিয়ে থাকা বাচ্চাটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মিহানের দিকে তাকিয়ে বলে,

—” ভীতুরাম।”

—” হুম, বলো।”

—” I want to adopt him.”

একথা শুনে রুমে উপস্থিত সবাই মিরার দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। হতবাক হওয়ারই কথা। এইটুকু মেয়ে সে কী না আবার বাচ্চা দত্তক নেবে। মিরা সবাইকে এক নজর দেখে আবার বলতে শুরু করে।

—” তুই পারবি ব্যবস্থা করতে? না আমি ডেনি ভাইয়া কে বলবো।”

ওদের কথার মাঝে নীলা বলে,

—” মিরা মামা মামী?”

—” মাম্মা পাপা কখনো আমার কাজে বাধা দেয়নি আর দেবেও না। তাছাড়া আমি যতদূর জানি এবং চিনি মাম্মা পাপা কখনো এই কাজে আপত্তি করবে না।”

মিহান এক দৃষ্টিতে মিরার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। না ও ভুল মানুষকে ভালোবাসি নি। ঠিক মানুষকেই নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে।নিজের কথা না ভেবে অন্যের কথা ভাবে। অন্যের জন্য মন কাঁদে। অন্যের কষ্টে নিজেও কষ্ট পায়। যতই গুন্ডামি করুক না কেনো ওর মনটা এখনো বাচ্চাদের মতো। এসব ভেবে মিহানের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠে। মিহান পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলে,

—” চিন্তা করো না আমি সব ব্যবস্তা করে ফেলবো।”

মিহান পিছন ফিরে মহিলাদের দিকে তাকিয়ে দেখে তাদের চোখে পানি। মিহান না বুঝে তাদের জিজ্ঞাসা করে,

—” কী হলো আন্টি? আপনারা কান্না করছেন কেনো?”

বেলি আন্টি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

—” না বাবা খুশিতে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। এবার বোধ হয় সত্যিই ছেলেটা মা পাবে।”

মিরা বেলি আন্টির দিকে তাকিয়ে বলে,

—” আন্টি আজ আমি ওকে আমার সাথে নিয়ে যেতে চাই।”

মিনা আন্টি চিন্তিত সরে বলে,

—” কিন্তু?”

মিহান বলে,

—” চিন্তা করবেন না আন্টি। আমি আমাদের বাড়ির ঠিকানা আর ফোন নাম্বার দিয়ে যাচ্ছি যোগাযোগ করার জন্য। যদি কোনো সমস্যা হয় তা আমি দেখে নেবো। আপনারা চিন্তা করবেন না। ও ভালো থাকবে মিরার কাছে। কাল সকালে আমি আসবো এতিমখানায়। এখন আসুন আপনাদের দেওয়ার ব্যবস্থা করা দিচ্ছি।”

বেলি আন্টি আর মিনা আন্টি কিছুক্ষণ মিরার সাথে কথা বলে চলে যায়। মিহান ওদের যাওয়ার জন্য গাড়ি ঠিক করে দেয়।

———————————–

চৌধুরী বাড়ির ডিনার টেবিলে বসে তিনজনে ডিনার করছে মিহান ছাড়া। মিহান ফোন করে বলে দিয়েছে ওর ফিরতে দেরি হবে। ওর জন্য কেউ যেন অপেক্ষা না করে। মিহানের পাপা মিহানের মমের দিকে তাকিয়ে বলে,

—” আজ নিলয় ভাই লন্ডন চলে গেছে জানো কিছু?”

মিহানের মম অবাক হয়ে বলে,

—” সে কী আমি তো কিছু জানিনা। তুমি কি কীভাবে জানলে?”

মিহানের পাপা মুখে থাকা খাবার শেষ করে বলে,

—” কাল দুপুরের দিকে নিলয় ভাই ফোন করে বলেছিল তাদের লন্ডনে অফিসে কী নিয়ে যেনো ঝামেলা হয়েছে। তাই নিলয় ভাই আর ভাবি আজ বিকেলের ফ্লাইটে চলে গেছে লন্ডন।‌”

মিহানের মম চিন্তিত হয়ে বলে,

—” ওহ। তা নিলয় ভাইয়ারা কবে দেশে ফিরবে তা কিছু বলেছে?”

—” না সেসব কিছু বলেনি। শুধু বলেছে খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরবে।”

অনু এতক্ষণ ওদের কথা শুনছিলো, ওদের কথার মাঝে বলে,

—” ভাবি তাহলে একা একা থাকছে?”

মিহানের মম বলে,

—” ধুর বোকা। ওর ফুপা, ফুপি, দাদা, দাদি আর কাজিনরা আছে না। তাহলে একা একা থাকবে কেনো!”

মমের কথা শুনে অনু মুখ গোমড়া করে ফেলে। অনুর মুখের এক্সপ্রেশন দেখে ওর হালকা হেসে মিহানের মমের দিকে তাকিয়ে বলে,

—” শোনো যে কথা বলতে যাচ্ছিলাম। রায়হান ফোন করেছিলো। তনু নাকি তোমাকে ফোন করেছিলো তোমাকে ফোনে পাইনি তার জন্য রায়হান আমাকে ফোন করেছে।”

—” তোমাকে বলবো বলবো করে আর বলা হয়ে ওঠেনি ফোনটায় ইদানীং খুব সমস্যা দেখা দিয়েছে। কেউ ফোন করলে ফোন বন্ধ বলে। মিহানো আমাকে বলেছে একথা দুইদিন। এর মধ্যে আর বের হয়নি তাই আর নতুন ফোন কেনা হয়নি। যাইহোক ছাড়ো ওসব কথা কী জন্য ফোন দিয়েছিল সেটা বলো?”

—” কেনো আবার। তনুর দাদা শ্বশুর শাশুড়ির মৃত্যু বার্ষিকীতে প্রতিবছর যে মিলাদের আয়োজন করা হয় তার জন্য ফোন করেছিলো।”

অনু উত্তেজিত হয় বলে,

—” পাপা আমরা যাবো?”

—” হ্যা, যাবো আমরা। প্রতিবছরই তো যাই। তাহলে বছরে যাবে না কেনো? তাছাড়া আমরা না গেলে না গেলে তনুর শ্বশুর-শাশুড়ি মানে আঙ্কেল-আন্টি খুব কষ্ট পাবে। তারা দুইজন আমাকে তোমার মমকে ভিশন ভালোবাসেন।”

মিহানের মম বলে,

—” কবে মিলাদ? আর কখন যাবো আমরা?”

—” আজকে তো রবিবার! তারিখ অনুযায়ী বুধবার দিন মিলাদ। দেখি কাল বিকালে দিকে রওনা দিতে পারি কী না। আমাদেরকে আঙ্কেল আন্টি একটু তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে। অনেকদিন নাকি জমিয়ে আড্ডা দেয় না। তাই কিছুদিন মন খুলে কথা বলব সবার সাথে। মিহানের হবু বউ কে দেখতে চেয়েছেন তারা।”

অনু ঠোঁটের কোনে হাসি এনে বলে,

—” ভাবির যাবে আমাদের সাথে?”

মিহানের পাপা খাওয়া শেষ করে টেবিল থেকে উঠেন অনুর মাথায় হাত দিয়ে বলে,

—” শুধু তোমায় ভাবী ই নয় সাথে নীলা আর নিঝুমও যাবে।”

অনু খুশিতে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে।

—” ইয়েয়য়য়য়য়!

মিহানের মম অনুকে ধমক দিয়ে বলে,

—” এই আস্তে এতো চিৎকার করছিস কেনো?”

অনু মুখ গোমড়া করে ওর পাপার দিকে তাকায়। ওর পাপা ওর দিকে তাকিয়ে হেসে দিলে অনুও সাথে সাথে হেসে দেয়। মিহানের মম ওর পাপার দিকে তাকিয়ে আবারো বলে,

—” শোনো মিরার দুজন বন্ধু এসেছে লন্ডন থেকে ওদেরও তো বলতে হয় না কী?”

মিহানের পাপা উপরে যেতে যেতে বলে,

—” তোমার যা ভালো মনে হয় করো। আমি যাই ঘুমতে।”

মিহানের মম মিহানের পাপার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,

—” সব দায়িত্ব আমার উপরে চাপিয়ে দিয়ে চললেন উনি ঘুমতে।”

———————————–

সকাল আটটার টার বেশি বাজে। মিরা ঘুম থেকে উঠেছে অনেকক্ষণ। মিরা বাচ্চাটার বিষয়ে ওর মাম্মা পাপার সাথে কথা বলে নিয়েছে। তারা ভিশন খুশি মিরার এই সিদ্ধান্তে। কাল হসপিটালে যে বাচ্চাটা ঘুমিয়েছে আর এখনো ঘুম থেকে উঠো নি। বাড়ির সবাই বাচ্চাটাকে খুব ভালো লেগেছে। এইটুকু বাচ্চা ভালো না লেগে উপায় আছে? মিরা বাচ্চাটার মাথার কাছে বসে মুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। নীলা বাচ্চাটার পায়ের দিকে দিয়ে বসা। নীলা কৌশলী হয়ে মিরা কে জিজ্ঞাসা করে,

—” আচ্ছা, মিরা ওর নাম কী দিবি ঠিক করলি। শুনলাম এতিমখানার সবাই ওকে বাবু বলে ডাকতো।”

—” ঠিক বলেছো। কী নাম দেওয়া যায় ওর।”

—” তুই ভাব তুই ওর মা।”

—” ভীতুরাম আসুক তারপর ঠিক করবো কী নাম দেওয়া যায়।”

ওদের কথা শুনে বাচ্চাটা ঘুম থেকে উঠে যায়। আস্তে আস্তে চোখ খুলে চারদিকে তাকায়। মিরা কে দেখে মুখ ভরা হাসি ফুটে ওঠে। মিরাও ওকে দেখে মিষ্টি করে হাসে। আবার বাচ্চাটার কিছু মনে পরে গেলে মন খারাপ করে মিরার দিকে তাকিয়ে বলে,

—” থরি অনতি।”

মিরা বাচ্চাদের গালে চুমু খেয়ে বলে,

—” সরি কেনো বাবা?”

বাচ্চাটা মিরার কপালের দিকে তাকিয়ে বলে,

—” তাল আমাল দন্য তোমাল ব্যথু নেগেছে।”

—” এতে তোমার কোনো দোষ নেই বাবা। তাই সরি বলতে হবে না।”

বাচ্চাটা হেসে বলে,

—” আতথা অনতি।”

মিরা ওকে শোয়া থেকে কোলে নিয়ে বলে,

—” আমি তোমার আন্টি না বাবা।”

—” তাইলে তে তুমি?”

মিরা ওর চুলগুলো ঠিক করতে করতে বলে,

—” আমি তোমার মাম্মা।”

বাচ্চাটা “মাম্মা” শব্দ টা শোনার পর অনেকক্ষণ মিরার দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ করে মিরাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দেয়। মিরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে ওর এমন কান্না দেখে।

—” বাবা কী হয়েছে কাঁদছো কেনো?”

বাচ্চাটা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

—” মাম্মা? তুমি আমাল মাম্মা?”

মিরা মিষ্টি হেসে মাথা নেড়ে হ্যা বলে। বলতে দেরি কিন্তু বাচ্চাটা মিরাকে জড়িয়ে ধরে সারা মুখে চুমু দিয়ে ভরিয়ে দেরি নেই। কিন্তু ফুটানোর জন্য ঠিক মতো দিতে পারছে না। এরমধ্যে মিহান রুমে এসে এই দৃশ্য দেখে। পাশে নীলা হাসি মুখে এই সবকিছু ভিডিও করছে। মিহান রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে,

—” বাহ! বাহ! মা ছেলের কত ভালোবাসা। আর কারো কথা তো মনেই নেই তাদের।”

মিরা মিহানের কথা শুনে ভেংচি কেটে।

চলবে….💙

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here