—-” তো অনন্যা আজ তোমার সাথে তোমার ভাইয়া নেই। এখন যদি তোমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করি তাহলে কী হবে সুন্দরী? সেদিন তো খুব তোমার ভাইয়াকে দিয়ে আমাকে শাসিয়ে গিয়েছিলে এখন কী হবে?”
এইটুকু বলে ছেলেটা আর ছেলেটার বন্ধুরা জোরালো শব্দে হাসতে শুরু করে। অনন্যা বিরক্ত হয়ে ছেলেগুলোর দিকে তাকায়। পাশ থেকে অনন্যার বেস্ট ফ্রেন্ড টিয়া ছেলেগুলো কে উদ্দেশ্য করে বলল,
—-” মিরান ভাইয়া যদি জানতে পারে তুমি মিরু কে এসব কথা বলছো, তাহলে তোমার কী অবস্থা হবে তুমি তা বুঝতে পারছো?”
ছেলেটা ভয় পাবার অভিনয় করে বলল,
—-” মিরান ভাইয়া? আমিতো ভয় পেয়ে গেছি মিরান ভাইয়ার নাম শুনে।”
এটুকু বলে আবার হাসতে শুরু করে ছেলেটা। অনন্যা ওদের দিকে তাকিয়ে কঠোর গলায় বলল,
—-” রাসেল ভাইয়া আমার কী ফুপিকে বলতে হবে তুমি ভার্সিটিতে এসে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড টিয়া কে বিরক্ত করছো?”
একথা শুনে রাসেলের মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়। রাসেল ভীতু গলায় বলল,
—-” বোন আমার, তুমি এত বড় উপকার আমার করো না। চাচি মা যদি এ কথা জানতে পারে তাহলে আর আমার একটাও হাড়গোড় আস্ত থাকবে না।”
ভার্সিটিতে আজ কোন কারণবশত দুই ক্লাস পর বোর্ড মিটিং এর জন্য ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। অনন্যা আর টিয়া ভার্সিটি গেটের পাশে দাঁড়িয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল তখন রাসেল ওদের বন্ধুদের নিয়ে হাজির হয় অনন্যাদের সামনে। রাসেল অনন্যার ফুপির ভাসুরের ছেলে। রাসেল যে টিয়া কে ভালোবাসে তা অনন্যা আর টিয়া খুব ভালো করে বুঝতে পারে। কিন্তু রাসেল কখনো সাহস করে বলে উঠতে পারেনি তার মনের কথা। তাইতো ইনিয়ে-বিনিয়ে টিয়াকে বিরক্ত করে যায় সব সময়। অনন্যা রাসেলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
—-” তখনতো খুব বলছিলে আজ ভাইয়া আমার সাথে নেই বলে আমাকে তুলে নিয়ে বিয়ে করবে। কী করবে না আমাকে বিয়ে?”
রাসেল টিয়ার এর দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে বলল,
—-” আমিতো টিয়াকে শোনাবার জন্য কথাটা বলছিলাম। আমি যে টিয়া কে ভালোবাসি তা কবে থেকে বোঝানোর চেষ্টা করছি কিন্তু টিয়া তো বুঝতেছিনা। আর অনন্যা ও তো আমার আদরের ছোট শালী….
রাসেলকে বিড়বিড় করতে দেখে টিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
—-” বিড়বিড় করে কী বলছো? যা বলার জোরে বলো।”
রাসেল কিছু বলার আগেই ওদের সামনে একটা পুলিশের গাড়ি থামে। গাড়ি থেকে সুদর্শন এক যুবক নেমে এলে অনন্যা একগাল হেসে বলল,
—-” শান্ত ভাইয়া তুমি এখানে? তোমার তো এখন থানায় থাকার কথা!”
শান্ত সানগ্লাস খুলে পুলিশ ইউনিফর্ম ঠিক করতে করতে ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
—-” ছিল বৈকি কিন্তু আমার শত্রু আর তোর প্রাণপ্রিয় ভাই আমাকে অর্ডার করে গেছে আমি আজ তোদের যেনো সেলফি বাড়ি পৌঁছে দেই।”
টিয়া ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
—-” তুই তো কখনো আমাকে ভার্সিটি থেকে নিয়ে আসা দূর ঠিকমতো সময় দিস না অথচ দেখ মিরান ভাইয়া এত বড় একজন কার্ডিওলজিস্ট হয়েও তার সব ব্যস্ততার আগে মিরু।”
শান্ত অসহায় চোখে টিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
—-” তুই তো জানিস বোন আমি ঠিকমত খাওয়ার সময় পাইনা তাহলে তোকে সময় দেবো কী করে? সারাদিন তো চোর ডাকাতের পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে দিন পার হয়ে যায়। শুধু তোর কথা রাখতে পনের দিনের জন্য ছুটি নিয়েছে জুঁই আপুর বিয়ে উপলক্ষে। এরপর ও তুই মুখ গোমরা করে রাখবি?”
টিয়া গিয়ে শান্তর হাত জড়িয়ে ধরে বলল,
—-” সত্যি বলছিস ভাইয়া তুই পনের দিনের জন্য ছুটি নিয়েছিস?”
শান্ত উপর নীচ মাথা দুলিয়ে বলল,
—-” হ্যাঁ!”
টিয়া খুশিতে উত্তেজিত হয়ে বলল,
—-” তাহলে আজ বিকেলে আমি তুই আর মিরু রওনা দিবো চাচাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে!”
অনন্যা কপাল ভাঁজ করে বলল,
—-” ভাইয়া না আসা পর্যন্ত আমি যাব না। ভাইয়াকে ছাড়া আমি আজ পর্যন্ত কোথাও যাইনি। তোরা বরং বিকেলে রওনা দেয় আমি না হয় ভাইয়া এলে তার সাথে যাব।”
টিয়া মন খারাপ করে বলল,
—-” চল না মিরু খুব মজা হবে। আর ভাইয়া তো আজ সন্ধ্যার ফ্লাইটে চলে আসবে।”
শান্ত টিয়ার উপর থেকে নজর সরিয়ে অনন্যা দিকে তাকিয়ে বলল,
—-” মিরানের সাথে আমার ভোররাতের ফ্লাইটে ওঠার আগে কথা হয়েছে। মিরান বলেছিলাম যে অপারেশন করতে মুম্বাইতে যাচ্ছে তা বিকেলের মধ্যে কমপ্লিট করে সন্ধ্যার ফ্লাইটে ঢাকায় ব্যাক করবে। আর যদি তুই বা টিয়া জুঁই আপুর বাড়িতে আজ যেতে চাস তাহলে আমি যেন তোদের নিয়ে যাই। তাহলে মিরান সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে চাচাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবে।”
টিয়া অনন্যার দিকে তাকিয়ে বলল,
—-” এই দেখ মিরান ভাইয়াও তোকে যেতে বলেছে। এবার তো রাজি হয়ে যা যাওয়ার জন্য।”
অনন্যা কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
—-” বাড়ি গিয়ে মাম্মার সাথে কথা বলে তারপর তোকে জানাচ্ছি।”
শান্তর রাসেলের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
—-” আর রাসেল তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছে অথচ আমি খেয়ালই করিনি! তা কেমন আছো তুমি?”
রাসেল হালকা হেসে বলল,
—-” জ্বী ভাইয়া আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
শান্ত ঠোঁটে হাসি এনে বলল,
—-” আমি ভালো আছি। লেখাপড়া কেমন চলছে তোমার?”
রাসেল টিয়ার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
—” ভালো ভাইয়া!”
শান্ত সানগ্লাস পড়ে রাসেলের দিকে তাকিয়ে বলল,
—-” সময় করে এসো একদিন আমাদের বাড়িতে। আজ আসি একটু তাড়া আছে।”
রাসেল টিয়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা স্বরে বলল,
—-” আসবো! অবশ্যই আসবো! আসতে আমাকে হবেই আপনাদের বাড়িতে।”
টিয়া রাসেলের দিকে সরু চোখে তাকায়। শান্ত ওদের তাড়া দিয়ে বলল,
—-” টিয়া চল দেরি হয়ে যাচ্ছে আমাদের। তোদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আমাকে আবার একবার থানায় যেতে হবে।”
শান্তর কথা শুনে টিয়া আর অনন্যা দুজনে গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ি চলতে শুরু করলে টিয়া একনজর রাসেলের দিকে তাকায়। রাসেল টিয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিড় বিড় করে বলল,
—-” তোমাকে না দেখে আবারও অনেকগুলো দিন পার করতে হবে টিয়া পাখি। খুব কী দরকার ছিল বিয়েতে যাবার?”
______________________________
দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছে আর অনন্যা একটু একটু করে মন খারাপ করছে। বাড়ি ফিরেছে পর থেকেই ওর মাম্মা দেখা নেই। বাড়ি ফিরে দাদুর কাছ থেকে জানতে পেরেছে অফিসে কোনো ঝামেলার কারণে তড়িঘড়ি করে ওর মাম্মা বেরিয়ে গেছে। কিন্তু অনন্যার মন তো আর মানছে না। প্রতিদিন দুপুরে ওর মাম্মা ওকে নিয়ম করে ওকে নিজের হাতে খাইয়ে দেয়। আর রাতের বেলা? তখন তো ভাইয়া নিজের হাতে খাইয়ে দেয়। এই নিয়মের কোন হেরফের হলে অনন্যার মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। মিরান বাড়িতে যত রাতেই হোক না কেন আগে ওর বোনকে খাইনি তারপরে নিজে খাবে। আর মিরান যদি কোন কারনে রাত করে বাড়ি ফিরে তখনো অনন্যা না খেয়ে তার ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করে। কখন ওর ভাইয়া ফিরবে আর কখন ওকে খাইয়ে দেবে। অনন্যা মন খারাপ করে ওর বেলকুনির দোলনায় বসে ছিল। হঠাৎ কারো কথা শুনে ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে আসে অনন্যা।
—-” সরি মাম্মা। আজ বড্ড দেরি হয়ে গেছে অফিসে সব ঝামেলা মিটিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে।”
অনন্যা মাথা তুলে তাকায় উপরের দিকে। ওর মাম্মা হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনন্যা অভিমান করে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। অনন্যার মাম্মা মেয়ের এমন বাচ্চাদের মত আচরণ দেখে মৃদু হেসে ওর পাশে বসে বলল,
—-” আমার প্রিন্সেস কী আমার উপর রেগে আছে?”
অনন্যা মাথা দুলিয়ে বলল,
—-” উঁহু।”
অনন্যার মাম্মা অনন্যার আরেকটু পাশ ঘেষে বসে বলল,
—-” তাহলে?”
অনন্যা অভিমানী গলায় বলল,
—-” সেই কখন থেকে তোমার জন্য বসে আছি কিন্তু তোমার আসার তো কোন নামই নেই। তুমি জানোনা তুমি আর ভাইয়া আমাকে খাইয়ে না দিলে আমার খেতে ইচ্ছে করে না।”
অনন্যার মাম্মা বাঁ হাত দিয়ে মেয়ের মুখে পরা চুলগুলো যত্নসহকারে কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে আদুরে গলায় বলল,
—-” আমি জানি তো মাম্মা, কিন্তু আজ হঠাৎ করে অফিসে ঝামেলার কারণে একটু দেরী হয়ে গেছে। দুপুর গড়িয়ে গেছে দেখে কাজগুলো মাঝপথে রেখেই বাড়ি চলে এসেছি আমি। এখনো কী আমার উপর রাগ করে থাকবে আমার প্রিন্সেস?”
অনন্যার জন্য অনন্যার মাম্মা সব কাজ মাঝপথে ছেড়ে চলে এসেছে দেখে অভিমান ভেঙে যায়। অনন্যা ওর মাম্মা আমাকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে বলল,
—-” না মাম্মা তোমার প্রিন্সেস তোমার উপর রাগ করেনি। একটু অভিমান করেছিল এই যা। কিন্তু এখন তার অভিমানও ভেঙে গেছে। এখন আমাকে খাইয়ে দাও খুব খিদে পেয়েছে আমার।”
অনন্যার মাম্মা মুচকি হেসে মেয়েকে খাইয়ে দিতে শুরু করে। অনন্যা মুখে ভাত নিয়ে বলল,
—-” পাপা কোথায় মাম্মা?”
অনন্যার মাম্মা ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
—-” কোথায় আবার হসপিটালে একটু পরেই চলে আসবে। বাড়ি আসার পথে শান্ত ফোন করেছিল আমায়। তুই যাবি ওদের সাথে?”
অনন্যা মুখের খাবার শেষ করে বলল,
—-” ভাইয়াকে ছাড়া কখনো কোথাও যাইনি ভাইয়া আসুক তারপর নাহয় যাব।”
অনন্যার মাম্মা অনন্যার মুখে ভাত তুলে বলল,
—-” সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু এদিকে টিয়া যে মন খারাপ করে বসে আছে তার কী হবে? আর মিরান তো আজ সন্ধ্যার ফ্লাইটে চলে আসবে। আমি না হয় ওকে এয়ারপোর্ট থেকে একেবারে তোর কাছে যেতে বলবো। তাহলে কী যাবি শান্ত দের সাথে?”
অনন্যা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
—-” আমি অতশত বুঝিনা। রাতে খাবার সময় আমি যেনো তাকে আমার চোখের সামনে পাই।”
অনন্যার মাম্মা ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
—-” সেটা তোকে বলতে হবে না। সেদিকে আমার ছেলের খেয়াল আছে। নে এবার তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে ব্যাগ গুছিয়ে নে, আর তোর যাওয়ার কথা টিয়া কে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিস।”
______________________________
অনন্যা ব্যাগ গুছিয়ে রেডী হচ্ছিলো ঠিক তখন টিয়া রুমে ঢুকে কপট রাগ দেখিয়ে অনন্যা কে বলল,
—-” তুই এখনো রেডি হস নি কখন বেরোবো আমরা?”
অনন্যা এক নজর টিয়ার দিকে তাকিয়ে পরে চুল ঠিক করতে করতে বলল,
—-” আর বলিস না, কোন ড্রেসটা পড়বো তা চুজ করতে করতে দেরি হয়ে গেছে। তা শান্ত ভাইয়া কোথায়?”
টিয়া বিছানায় বসে বলল,
—-” নিচে হল রুমে বসে দাদুর সাথে কথা বলছে। তাড়াতাড়ি কর না-হলে কিন্তু দেরি হয়ে যাবে আমাদের।”
অনন্যা চুল গুলো ঠিক করে টিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
—-” তবে যাই বলিস না কেন তুই আজ দুপুরে রাসেল ভাইয়ার মুখটা দেখার মত ছিল। যখন শুনলো তুই তোর চাচাতো বোনের বিয়েতে যাচ্ছিস পনের দিনের জন্য তখন থেকে মুখটা কেমন গোমরা করে রেখেছিল।”
টিয়া কিছুটা অভিমানী হয়ে বলল,
—-” এই কথা আমাকে বলছিস কেন? কাউকে ভালোবাসলে তা বুক ফুলিয়ে প্রকাশ করতে হয় আর তোর ভাই…. ছাড় তো এসব কথা। আমি তার আসে পাশে থাকি বা না থাকি এতে তার কিছু যায় আসে না।”
অনন্যা মৃদু হেসে বলল,
—-” এর জন্য বুঝি সখীর অভিমান হয়েছে?”
টিয়া অনন্যার দিকে তাকিয়ে দেখে ওর চোখে মুখে দুষ্টুমির ছাপ। টিয়া কোমরে হাত দিয়ে অনন্যার দিকে তাকিয়ে বলল,
—-” আমার কথা ছাড়। তোর সেই ক্রেজি লাভারের কথা বল ক’দিন ধরে তো কোন খবরা-খবর নেই।”
অনন্যা উদাসীন গলায় বলল,
—-” তিন-চারদিন ধরে তার সাথে কোন যোগাযোগ নেই। কোন মিশনে আছে হয়তো।
টিয়া মুখ টিপে হাসে বলল,
—-” এর জন্য বুঝি সখীর এত উদাসীন?”
অনন্যা চোখ ছোট ছোট করে টিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
—-” তুই কী আমার সাথে মজা করছিস?”
টিয়া দাঁত কেলিয়ে বলল,
—-” আমি তোর সাথে মজা করবো কেন? আমিতো তোর খিল্লি উড়াছি!”
অনন্যা টিয়ার দিকে তেড়ে গিয়ে বলল,
—-” তবে রে দাঁড় তুই।”
এই বলে অনন্যা টিয়া কে তাড়া করতে শুরু করে। আর টিয়া অনন্যার হাত থেকে বাঁচার জন্য রুমের মধ্যে দৌড়াতে শুরু করে।
চলবে……
#না_চাইলেও_তুই_আমার
[ সিজান ৩ ]
#লেখিকা_সারজীন_ইসলাম
#পর্ব- ০২
—-” মিরু প্লিজ তুই কান্না থামা ভাইয়া কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে। ভাইয়া এসে দেখে যদি তুই কান্না করছিস তাহলে কী হবে তুই বুঝতে পারছিস?”
অনন্যা কান্না করতে করতে বারবার কেঁপে উঠে বলল,
—-” কটা বাজে দেখেছিস? এতক্ষণে তা ভাইয়ার এসে যাওয়ার কথা। সন্ধ্যার পর থেকে ভাইয়ার ফোন ও বন্ধ পাচ্ছি। কোন বিপদ আপদ হয়নি তো আবার?”
একটু পরে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে অনন্যা। হঠাৎ করে পরিচিত কারো কথা শুনে অনন্যা কান্না থামিয়ে দরজার দিকে তাকায়। কয়েক মুহুর্ত ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে দেখে ঝড়ের গতিতে গিয়ে ব্যক্তিটি কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলল,
—-” কোথায় ছিলি ভাইয়া এতক্ষণ? তোর তো সেই সন্ধ্যায় এসে যাওয়ার কথা ছিল! এত দেরি করলি কেন?”
মিরান অনন্যাকে ওর বুক থেকে তুলে চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল,
—-” কোথায় থাকবো আবার? আবহাওয়ার কারণে ফ্লাইট একটু পিছিয়ে গেছে এই যা। এরজন্য তুই কেঁদে কেঁদে সাগর বানিয়ে ফেলবি? তুই জানিস না তোর চোখের পানি আমি দেখতে পারিনা তারপরও ডাফার এর মত কান্না করছিলি কেন?”
অনন্যা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
—-” তুই আমাকে বকা দিচ্ছিস? আমি কিন্তু পাপার কাছে তোর নামে নালিশ করবো।”
মিরান হেসে দিয়ে কান ধরে বলল,
—-” সরি আর কখনো বকবো না তোকে। এবার একটু হাস!”
অনন্যা ঠোঁট ফুলিয়ে হেসে বলল,
—-” ঠিক আছে ঠিক আছে এবারের মত মাফ করে দিলাম। আমার খিদে পেয়েছে এখন খাইয়ে দে আমায়। না হলে কিন্তু তোর খবর আছে আমি বলে দিলাম।”
মিরান শুকনো গলায় ঢোক গিলে ভয় পাবার অভিনয় করে বলল,
—-” চাচী তাড়াতাড়ি করে খাবার নিয়ে এসো নাহলে এই গুন্ডি মেয়ে আর আমাকে আস্ত রাখবে না।”
মিরানের কথা শুনে সবাই মুখ টিপে হেসে দেয়। অনন্যা ছোট ছোট করে মিরানের দিকে তাকালে শান্ত মিরান কে তাড়া দিয়ে বলল,
—-” মিরান চল আগে ফ্রেশ হয়ে নিবি। মিরু কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে কিছু খাইনি।”
মিরান শান্তর দিকে তাকিয়ে বলল,
—-” হ্যাঁ, চল না হলে কথায় কথায় আরও দেরি হয়ে যাবে।”
মিরান শান্তর সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে যায়। টিয়া অনন্যার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
—-” এত করে আমি তোকে কান্না থামাতে বলছিলাম কিন্তু তুই তো তখন আমার কথা কানেই দিসনি। কেঁদে কেঁদে মুখের অবস্থা নাজেহাল করে দিয়েছিস। এখন যা হাত মুখ ধুয়ে আয়। তারপর ভাইয়া এসে তোকে খাইয়ে দেবে।”
অনন্যা ভেংচি কেটে বলল,
—-” যাচ্ছি! যাচ্ছি!”
অনন্যা চলে গেলে টিয়া অনন্যার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে দেয়।
মিরান আর শান্ত স্কুল লাইফের বন্ধু। টিয়া শান্তর বোন। মিরান যখন খেলাধুলা করার জন্য শান্ত দের বাড়ি যেতে তখন ও অনন্যা কে ওর সাথে নিয়ে যেত। সেখান থেকেই অনন্যা আর টিয়ার বন্ধুত্ব হয়। শান্ত লেখাপড়া শেষ করে পুলিশের চাকরিতে জয়েন করে আর মিরান তার পাপার মত একজন বড় ডাক্তার হয়। শান্তর চাচাতো বোনের বিয়ে উপলক্ষে মিরান আর অনন্যা কে ওদের গ্রামের বাড়িতে আসার জন্য রাজি করায়। ওরা অবশ্য আরও দুই একবার এখানে এসেছিল। শান্তর চাচা এই গ্রামের চেয়ারম্যান বিধায় বেশ নামডাক আছে তার। অবশ্য এই নিয়ে তার ভিতরে কোন হিংসা দেমাক নেই। এক কথায় বলতে গেলে মাটির মানুষ তিনি। স্ত্রী মেয়ে আর ছোট ছেলে আরাফাত কে নিয়ে সুখের সংসার তার।
মিরান ফ্রেশ হয়ে এসে শান্তর চাচির দিকে তাকিয়ে বলল,
—-” চাচি বাড়ির আর সব কোথায় কাউকে দেখছি না যে?”
শান্তর চাচি মিরানের দিকে তাকিয়ে রাগ দেখিয়ে বলল,
—-” রাত্রি এখন কত হলো সেদিকে খেয়াল আছে তোর? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখ রাত প্রায় দুটো বাজতে চলল আর তুই এখন বাড়ির সবার খোঁজ করছিস?”
মিরান মুখটা কাচুমাচু করে বলল,
—-” সরি চাচি রাগ করো না। আবহাওয়ার কারণে ফ্লাইট লেট না হলে আমি তো ঠিক সময়ে এসে পড়তাম।”
শান্তর চাচি হালকা হেসে বলল,
—-” ঠিক আছে আর সরি বলতে হবে না। বাড়ির সবাই খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু আমি শান্ত, টিয়া আর মিরু খায়নি।”
এরমধ্যে অনন্যা এসে ওর ভাইয়ের পাশে দাড়িয়ে বলল,
—-” নে ভাইয়া এবার খাইয়ে দেয় আমায় খুব খিদে পেয়েছে।”
মিরান অনন্যার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে খাইয়ে দিতে শুরু করে।
______________________________
মিরা কোন ভাবে জানতে পেরেছে মিহান আজ হসপিটালের একজন মহিলা ডাক্তারের সাথে হেসে হেসে কথা বলেছে। এতে মিরা রাগ করে ঘরের দরজায় খিল দিয়েছে। মিহান খেয়ে দেয়ে ধীরেসুস্থে রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। রুমের দরজা বন্ধ দেখে মিহান দরজায় টোকা দিয়ে মিরা কে বলল,
—-” মিরা জানপাখি দরজা বন্ধ করলে কেন?”
ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ না আসলে মিহান আরো জোরে দরজা ধাক্কা দিয়ে বলল,
—-” তুমি ঠিক আছো তো? কী হল কথা বলছ না কেন জানপাখি?”
ওপাশ থেকে মিরা চেঁচিয়ে বলল,
—-” খবরদার আমাকে জানপাখি বলে একদম ডাকবে না।”
মিহান ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,
—-” কী? কেন? তোমাকে জানপাখি বলে ডাকবো না তো কাকে ডাকবো?”
মিরা ওপাশ থেকে রাগ দেখিয়ে বলল,
—-” কেন তোমার হসপিটালের ডাক্তার আছে না যার সাথে হেসে হেসে গল্প করছে! কী যেন নাম ওই ডাক্তার টার…. ধুর ছাতা নামটা মাথায় আসছে না। যাই হোক তাকে গিয়ে জানপাখি ডাকো।”
মিহান মিরার রাগের কারণ বুঝতে পেরে হালকা হেসে বলল,
—-” ওহ তুমি ডক্টর জান্নাতের কথা বলছো? জানো মেয়েটা খুব ভালো। সবার সাথে মিষ্টি করে হেসে কথা বলে। ওর সাথে কথা বললে মনটা ভালো হয়ে যায়।”
মিহানের কথা শুনে মিরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল,
—-” ওহ এতদূর? তার সাথে কথা বললে মন ভালো হয়ে যায়? তো যাও না তার কাছে যাও আমার কাছে এসে জানপাখি জানপাখি করছ কেন?”
মিহান ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
—-” তুমি খুব ভালো কথা মনে করেছো। আমি বরং গিয়ে ডক্টর জান্নাতের সাথে একবার দেখা করে আসি।”
দরজার ওপাশ থেকে কোনও আওয়াজ না পেয়ে মিহান পা টিপে পা টিপে মিরানের রুমের দিকে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলল,
—-” না, না এই গুন্ডি মেয়ে আর এ জন্মে ভালো হবে না। না হলে কী বিয়ের এতবছর পরও আমাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোড়ায়? কী কপাল আমার কোথায় ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দেবো। ওদের সংসার গুছিয়ে দিয়ে কিছুদিন মিরার সাথে রিলাক্সে থাকবো তা না এখন আমাকে ছেলে রুমের বেলকনি থেকে আমার রুমের বেলকনিতে যেতে হবে।”
মিহান অতি সাবধানে ছেলের বেলকনি থেকে নিজের রুমের বেলকনিতে দাড়িয়ে আস্তে করে বলল,
—-” এই বয়সে কী এত দৌড়ঝাঁপ মানায়? যাই গিয়ে আগে মহারানীর রাগ ভাঙ্গাই না হলে আমার মাথার চুল একটাও আস্ত থাকবে না।”
মিহান রুমে ঢোকার আগে কারো হাসির শব্দে দাঁড়িয়ে যায়। অন্ধকারে মিহান ভালো করে দেখতে পায় না। পকেট থেকে ফোনে বের করে লাইট জ্বালিয়ে সামনে গিয়ে দেখে মিরা বসে আছে। মিরা আর মিহান বেলকনি রাখা যে বেডে বসে জ্যোৎস্নাবিলাস করে মিরা সেখানে বসে মিটমিট করে হাসছে। মিরা মিহানের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
—-” কী হলো গেলে না ডক্টর জান্নাতের কাছে?”
মিহান বেলকনির আলো জ্বালিয়ে দিয়ে বলল,
—-” আমি তার কাছে যাই আর আমার গুন্ডি বউ আমাকে শূলে চড়াক তাই না?”
মিরা তেতে উঠে বলল,
—-” কী বললে আমি গুন্ডি?”
মিহান ঢোক গিলে বিড়বিড় করে বলল,
—-” এই যা কী বলে ফেললাম!”
মিরা মিহানের দিকে সরু চোখে তাকায়। মিহান বোকা হেসে বলল,
—-” কই নাতো কিছু বলিনি। তুমি রুমে না থেকে এখানে বসে আছো কেন?”
মিরা মৃদু স্বরে বলল,
—-” তোমাকে শাস্তি দেওয়া জন্য এখানে বসে আছি আমি।”
মিহান অবাক কন্ঠে বলল,
—-” শাস্তি? কিসের শাস্তি?”
মিরা মিহানের দিকে ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে বলল,
—-” এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে? ঠিক আছে আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। তুমি আজ হসপিটালের কার সাথে হেসে হেসে কথা বলছিলে?”
মিহান হেঁটে এসে মিরার পাশে বসে মৃদু হেসে বলল,
—-” ওহ তুমি ডক্টর জান্নাতের কথা বলছো? তেমন কিছু না তার মেয়ের জন্মদিনে আমাদের পুরো পরিবার ইনভাইট করেছে। তারজন্য তার সাথে কিছু কথা বলছিলাম। কিন্তু তুমি একথা জানলে কী করে?”
মিরা মিহানের গাল টেনে দিয়ে বলল,
—-” মাই ডিয়ার হাসবেন্ড তুমি খুব ভালো করেই জানো, আমার কাছের মানুষগুলো কখন কী করছে আমি সব খবর রাখি।?”
মিহান মৃদু হেসে বলল,
—-” তা জানি বৈকি।”
মিরা মুখে একটু গাম্ভীর্য ভাবে এনে বলল,
—-” তো মিস্টার শাস্তি জন্য রেডি হয়ে যায়।”
মিহান ঢোক গিলে বলল,
—-” কী শাস্তি?”
মিরা মিহানের মুখের এক্সপ্রেশন দেখে মুচকি হেসে বলল,
—-” বেশি কিছু না, রাত শেষ হতে তো আর বেশি বাকি নেই। তাই বাকি রাত টুকু তুমি আর আমি এখানে বসে গল্প করে কাটিয়ে দেবো।”
মিহান লাফিয়ে উঠে বলল,
—-” আমি রাজি।”
মিরা চোখ গুলো ছোট ছোট করে বলল,
—-” আমার বলা এখনো শেষ হয়নি।”
মিহান মুখ গোমড়া করে বলল,
—-” বলো।”
মিরা মিহানের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
—-” প্রতিবার আমি তোমার কোলে মাথা রেখে গল্প করি কিন্তু এবার তুমি আমার কোলে মাথা রেখে গল্প করবে।”
মিহান খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল,
—-” সত্যি?”
মিরা মিহানের খুশি দেখে মুচকি হেসে মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সম্মতি জানায়।
#চলবে…..
#না_চাইলেও_তুই_আমার
[ সিজান ৩ ]
#লেখিকা_সারজীন_ইসলাম
#পর্ব- ০১