নিঃশ্বাসে তুই পর্ব -০৮+৯

#নিঃশ্বাসে_তুই (৮)

ঘুম থেকে উঠতে আজ একটু বেশিই দেরি হয়ে গেল অহমির। গতরাতে প্রায় জেগেই কেটেছে তার। ভোর ভোর চোখ টা একটু লেগে এসেছিল। সেই ঘুমে এগারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। অবশেষে মায়ের ডাকে চৈতন্য ফেরে তার।

“অমু, অমু আর কত ঘুমবি? এখন তো ওঠ। আজকেই অহনা টা চলে যাবে। আর কতটুকু সময়ই বা আছে ওরা। আর তুই পড়ে পড়ে ঘুমিয়ে।”

মায়ের ডাকাডাকিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে অহমি। ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলে,

“প্লিজ আম্মা আর একটু ঘুমতে দাও না। একটু পরেই উঠে যাচ্ছি।”

তাহমিনা বেগম শুনতে নারাজ। তিনি একটানে মেয়ের গায়ের থেকে কম্বল টেনে নিলেন। শক্ত কন্ঠে আদেশ করে বললেন,

“আর একটি কথাও শুনতে চাই না অমু। এখুনি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে চলে এসো। দুপুর গড়িয়ে এলো এখনো তোমার সকালের নাস্তা খাওয়া হলো না।”

তাহমিনা বেগম চলে গেলেন। মায়ের আদেশ শিরোধার্য। উপায়ন্তর না পেয়ে বিছানা ছাড়তে বাধ্য হলো অহমি। দু হাত উপরে তুলে টান দিয়ে শরীরের আলস্য ছাড়িয়ে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।

ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরল অহমি। চিরুনি দিয়ে চুলগুলো পরিপাটি করতে মনোযোগী হলো। সহসা তার মস্তিষ্কে জেগে উঠল গতরাতের কিছু স্মৃতি। থেমে গেল চিরুনি। দৃষ্টি স্থির হলো আয়নাতে। মনের ভাবনাগুলোকে প্রশ্রয় দিয়ে স্মৃতিগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে লাগল। মনে মনে ভাবতে লাগল,

“আচ্ছা ধ্রুব চৌধুরীই কেন? কেন সেই আমার মস্তিষ্কে হানা দিল। কেন গতরাতে বদ্ধ দৃষ্টির অন্তরালে তার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল? কেন সেই থেকে আমার মনটা অস্থির হয়ে উঠেছে? কেন গতরাত আমার কাটল নির্ঘুম? কেন! কেন! কেন? এতো কেন-র উত্তর কী আদৌ আছে?

.

অহনা তিশাকে নিয়ে চলে গেছে বেলা তিনটে বাজতেই। এখন প্রায় চারটা বাজতে চলল। অহমি দ্রুত ব্যাগপত্র গুছিয়ে রওনা হলো কোচিং এর পথে। গেট থেকে বেড়ানোর আগেই অর্পার ডাক পরল। সে ফোন হাতে বিচলিত রুপে এগোতে এগোতে বলল,

“এই অমু গতকাল নাকি তুই আবার এ’ক্সি’ডে’ন্ট হতে যাচ্ছিলি? ধ্রুব না বললে তো জানতেই পারতাম না। আচ্ছা শোন ধ্রুব গাড়ি পাঠিয়েছে। নিচে ওয়েট করছে। চুপচাপ ওটাতে করে চলে যাবি। ঠিক আছে? যা এবার।”

অহমি অবাকান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

“এসব কী বলছ আপি? উনি কেন গাড়ি পাঠাতে গেলেন?ওনাকে বলে দাও এসব গাড়ি-টাড়ি আমার লাগবে না। অতটুকুনি রাস্তা হেঁটেই চলে যাব।”

অর্পা চোখ গরম দেখিয়ে বলল,”তুই যাবি নাকি আম্মাকে বলবো?”

অহমি চুপসে গেল। কাচুমাচু মুখ করে বলল,
“আচ্ছা, আচ্ছা যাচ্ছি।”

.

দিন চলতে লাগল এভাবেই। কেটে গেল একটি মাস। ধ্রুবর সঙ্গে অহমির এ পর্যন্ত আর দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু রোজ ধ্রুবর গাড়ি কোচিং, কলেজ যেখানেই যাক না কেন অহমির জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত থাকে। এমনটা অহমির বেশ আশ্চর্য লাগে কিন্তু অর্পার ভয়ে কিছু বলতে পারে না। অর্পা টাও যে কেন এতে সম্মতি দিচ্ছে তাও অহমির অজানা।

এমনি একটি বিকেল আজ আবার এসেছে। নভেম্বর মাস।প্রকৃতিতে শীতের তীব্রতা বেশ গাঢ় হয়েছে। অপরাহ্নে যেন সেই হিমময়তা দ্বিগুণ তীব্রতা ছড়ায়। এমন প্রকৃতিকে ঘুরে ঘুরে উপভোগ না করলেই যেন নয়। সেই ভাবনার সূত্র ধরে অহমি, পুষ্প এবং তাদের কোচিং এর আরও কিছু ফ্রেন্ডরা মিলে সিদ্ধান্ত নিল তারা আজ কোচিং শেষ করে ঘুরতে বের হবে। বেশি নয় দু ঘন্টার মতো ঘুরাঘুরি করে বাড়ি ফিরে যাবে সকলে। সামনেই তাদের ইয়ার ফাইনাল এক্সাম। সেই সুবাদে ঘুরাঘুরি করে মাইন্ড টা একটু ফ্রেশ করে নেওয়া যাবে। যেই কথা সেই কাজ। কোচিং শেষ করে সকলে ছুটল নিজেদের প্ল্যান মাফিক কার্যে। প্রত্যেকে বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিল। অহমিও অর্পার থেকে পারমিশন নিয়ে নিল। পুষ্পকে কিছু বলার মতো কেউ নেই তাই তার ফোন করার প্রয়োজন পড়ল না। অহমি, পুষ্পর সঙ্গে আছে ওদের ফ্রেন্ড প্রিয়া,লামিয়া, মামুন,রাফি, ফাহিম। সকলেই যখন পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে বাহিরে বেড়িয়েছে ঠিক তখনই ঘটল বিপত্তি। আজও ধ্রুবর পাঠানো গাড়ি দাড়িয়ে আছে কোচিং এর থেকে একটু দূরত্বে। গাড়িতে ড্রাইভার বসে। অহমি এক পল সেদিকে তাকিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে রওনা দিল। পুষ্প সেদিকে লক্ষ্য করে অহমির কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

“এই অমু গাড়িটা তো আজও দাড়িয়ে।”

অহমি অবজ্ঞা করে বলল,”ধুর বাদ দে। থাক তো দাড়িয়ে আমার কী। আমি আজ যাচ্ছি না।”

পুষ্প আর কিছু বলল না। সকলে মিলে হইহই করতে করতে চলে গেল। এদিকে ড্রাইভার অসীম অহমিকে চলে যেতে দেখে ততক্ষণাৎ ধ্রুবকে ইনফরমেশন জানিয়ে দিল। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো প্রতিত্তোর সে পেল না। ফোন রেখে সেও গাড়ি টান দিয়ে চলে গেল।

.

অর্পা ফোন কানে ধরে বসে আছে। ওপাশ থেকে তীক্ষ্ণ বাণী ভেসে ভেসে আসছে। অর্পা কোনো প্রকার দিরুক্তি করার সাহস পাচ্ছে না। চুপচাপ শুনে যাওয়া ছাড়া তার যে আর কোনো উপায় নেই। তার দোষ একটাই, সে কেন তাকে না জানিয়ে পারমিশন দিয়ে দিল? অর্পা তো ভুলেই বসেছিল যে, তার বোনটা এখন আর মুক্ত পাখির ন্যায় উন্মুক্ত নয় সে এখন বন্দী খাঁচার পাখির ন্যায় কারো তীক্ষ্ণ নজর দ্বারা বন্দী। কারো অতী স্নেহের বন্দিনী, কারো অতী যত্নের বন্দিনী, কারো অতী আদরের বন্দিনী, কারো অতী ভালবাসায় বন্দিনী।

ওপাশ থেকে শেষ কয়েকটি শক্ত বাক্যের সঙ্গে কল লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। অর্পা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে দু-হাতে মাথা চেপে ধরে বসে রইল।

.

আধঘন্টা হলো ওরা বেড়িয়েছে। হিমশীতল রজনী টাকে বেশ উপভোগ করছে অহমি। বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো মুহূর্ত গুলো তার কাছে বরাবরই অতি স্পেশাল। কিন্তু সেই স্পেশালিটি দ্বিগুণ করে তুলেছে এমন মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি। এই প্রকৃতিতে এসে ফুচকা বা চটপটি না হলেই যেন নয়। ওরা সকলে মিলে প্রবেশ করল একটি ফুচকা স্টলে। এখানে ফুচকা, চটপটি উভয়ই পাওয়া যায়। বোম্বাই মরিচের টুকরো এবং লেবুর রসের সংমিশ্রণে তৈরি হয় সেগুলো। অসাধারণ টেস্ট। অহমি বেশ কয়েকবার খেয়েছে এখানকার খাবার। প্রথম এসেছিল বিভোরের সঙ্গে। তারপর থেকে প্রায়শই আসা হয়। আজকেও তার আইডিয়াতে সকলের আসা হয়েছে।

ঝাল ঝাল এক প্লেট ফুচকা আর গরম ধোঁয়া ওঠা এক প্লেট চটপটি। ব্যস অপেক্ষা যেন আর সয় না। সকলের জন্য অর্ডার দিয়ে ফাহিম এসে বসল ওদের সঙ্গে চেয়ারে। নাক, মুখ কুঁচকে বলল,

“আমরা কিন্তু ফুচকা খাব না। তোরা মেয়েরা যে কী পাস
ওই ফুচকার মধ্যে আল্লাহ মালুম। আমাদের জন্য দু প্লেট চটপটি।”

ফাহিমের সঙ্গে সহমত পোষণ করল রাফি,মামুনও। এদিকে মেয়েরা বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল। পুষ্প বলল,

“যা ভাগ খেতে হবে না তোদের। ফুচকার মর্ম তোরা কী বুঝবি। তোদের তো কোথায় সিগারেট, পান, বিড়ি সবই মুখে রোচে। ওসব নিয়েই থাক তোরা।”

পুষ্পর কথায় বাকি মেয়েরা হেসে উঠে সম্মতি জানাল। ওদের কান্ডে রাফি ক্ষীপ্ত হয়ে বলল,

“শুরু হয়ে গেল তো তোদের এখানেও। আমাদের নিয়ে পিঞ্চ না করলে কী তোদের পেটের ভাত হজম হয় না।”

লামিয়া ব্যঙ্গাত্নক কন্ঠে বলল, “নাহহহ রে একদম নয়। তবে তোরা কেন লাগতে আসিস আমাদের সঙ্গে। আমরা কী শুরুতে কিছু বলেছিলাম নাকি?”

শেষোক্ত কথাটি লামিয়া বেশ রেগে বলল। অতঃপর সকলকে চুপ করাতে অহমি মৃদু চিৎকার দিয়ে বলল,

“এই তোরা থামবি। আর ছেলেরা তোরা আজকে একটা হলেও ফুচকা খাবি নয়তো খুব বাজে কিছু হবে আজ তোদের সঙ্গে। এমনিতেও আমরা কিন্তু দলে ভারি আছি।”

অহমির সঙ্গে সকলে সম্মতি দিল। ছেলে কয়টা চুপসে গেল। অহমি যখন বলেছে তখন খেতেই হবে। নয়তো সত্যি সত্যি কিছু করে ফেলবে এরা৷ এদের দিয়ে বিশ্বাস নেই। শেষে মান ইজ্জত নিয়ে বাড়ি ফেরা দায় হয়ে পড়বে। ততক্ষণে ওদের অর্ডারকৃত ফুচকা, চটপটি চলে এসেছে। খাবার আসতেই অহমি বলল, এবার শুরু হবে মিশন, ‘ছেলেদের ফুচকা খাওয়ানো।’

মেয়েরা বেশ এক্সাইটেড। শুরুতে লামিয়া এগিয়ে গিয়ে ঠেসে ধরে একটি ফুচকা রাফির মুখে পুড়ে দিল। তারপর প্রিয়া গিয়ে মামুনকে খায়িয়ে দিল৷ দুটোর অবস্থা একদম দেখার মতো। এমনিতেই ওরা ঝাল খেতে পারে কম। তার ওপর টকও খেতে পারে না। দুজনে একটা খেয়েই নাজেহাল। ফাহিম কাচুমাচু হয়ে আছে ওদের অবস্থা দেখে। তখনই অহমি নিজেই হাসতে হাসতে ওর দিকে একটি ফুচকা নিয়ে এগিয়ে যায়। অহমি ফাহিমের মুখ চেপে ধরে যখনই ওর মুখে ফুচকা টি দিতে যাবে তার আগেই কেউ ওর হাত খুব শক্ত করে চেপে ধরে। চোখ মুখ কুঁচকে বেশ বিরক্তির সহিত পাশ ফিরে, ‘কে রে ‘ বলে তাকাতেই চমকে ওঠে সে। পড়ে যায় ফুচকা নিচে। ফাহিমের মুখ থেকে আপনা হতেই হাত আলতো হয়ে পড়ে যায়। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে।

.#নিঃশ্বাসে_তুই (৯)
————————–
অহমির হাতটি খুব শক্ত করে চেপে ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল ধ্রুব। অহমি চেয়েও কিছু বলতে পারল না। ভয়ে তার আত্না শুকিয়ে। যেতে যেতে ধ্রুব পুষ্পের উদ্দেশ্যে বলল,

“পুষ্প ড্রাইভার ওয়েট করছে।”

পুষ্প থতমত কন্ঠে বলল,”হ হু হু ভাইয়া যাচ্ছি।”

পুষ্প মাথা নিচু করে গাড়িতে গিয়ে বসল। অহমিকে এক প্রকার ছুড়ে ফেলল গাড়ির মধ্যে ধ্রুব। কিঞ্চিৎ আহত হলো সে তবুও টু শব্দটি করল না। ধ্রুব যে ভীষণ রেগে আছে এটা এই মুহুর্তে যে কেউ ধরতে পারবে তার লালাভ দৃষ্টি আর প্রখর ব্যক্তিত্বের আদলে। পুষ্প, অহমিও বুঝল। তাই দুজনেই ভেতরে ভেতরে ভয় পাচ্ছে কিন্তু মুখ ফুটে বাক্য বের করছে না।

গাড়ি এসে থামল পুষ্পদের বাড়ির সামনে। পুষ্প ইশারায় অহমিকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল। অহমির মুখটা এবার পুরোপুরি চুপসে এলো। এতোদিন ড্রাইভারের সঙ্গে আসা যাওয়া করলেও কখনো ধ্রুব গাড়িতে থাকেনি। কিন্তু আজ পরিস্থিতি পুরোই ভিন্ন। দুরু দুরু বুকে কাঁধের ব্যাগটা কোলের ওপর নিয়ে দু-হাতে সেটাকে সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরে শক্ত ভঙ্গিতে বসে আছে অহমি। তার এই দুরু দুরু বুকের অস্থিরতা আরও দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেল যখন পুষ্প চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধ্রুব ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে ওঠে এসে পেছনে অর্থাৎ অহমির পাশের সিটটি দখল করল। অহমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে পড়ল ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব স্বাভাবিক ভাবেই বসে আছে। দৃষ্টি ফোনের ওপর। সে পেছনে আসতেই ড্রাইভার গাড়ি টান দিল। অহমি ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। ঘুনাক্ষরেও সে আর পাশ ফিরে চাহিবে না বলে পণ করে নিল।

.

প্রায় ত্রিশ মিনিট পরও যখন বাড়ির রাস্তায় গিয়ে পৌঁছল না গাড়ি তখনই অহমির হুঁশ ফিরল। জানালা থেকে উঁকি ঝুঁকি মে’রে বারকয়েক দেখে নিল। এটাতো তাদের বাড়ির রাস্তা নয়। অকস্মাৎ সে উত্তেজিত হয়ে উঠল। ভয়, শঙ্কা সাইডে রেখে এবার সে ধ্রুবর পানে চাহিল। তড়িঘড়ি করে উদ্বীগ্ন কন্ঠে বলল,

“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমায়? এটা তো আমাদের বাড়ির রাস্তা নয়? কোথায় যাচ্ছি আমি? আমি কোথাও যাব না আপনার সাথে। প্লিজ আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিন। আমি কিন্তু…….. ”

অহমিকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ধ্রুব চোখ, মুখ শক্ত করে কড়া গলায় বলল,

“একদম চুপচাপ বসে থাকো। একটা শব্দ করলে গাড়ি থেকে ধাক্কা মে’রে ফেলে দেব। তারপর এই নির্জন রাস্তায় তোমাকে একা ফেলেই চলে যাব।

ভালো হবে তাই না ব্যাপারটা?”

শেষোক্ত কথাটি ধ্রুব একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল। অতঃপর সে আবার ফোনে মনোযোগী হলো। অহমি ধ্রুবর কথা শুনে ভেতরে ভেতরে জ্বলে উঠল কিন্তু মুখে প্রকাশ করল না। থমথমে মুখ করে আগের ন্যায় বসে রইল। কিন্তু মনে তার হাজারো চিন্তা খেলা করছে। স্বস্তিতে বসা দায় হয়ে পড়েছে।

.

গাড়ি এসে থেমেছে সুবিশাল বড় এক বাংলোর সম্মুখে। গাড়ি থেকে নেমে ধ্রুব অহমির ডান হাত ধরে টেনে বাহিরে নিয়ে আসে তাকে। অহমি অবাকান্বিত নয়নে আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে দেখছে। এমন সৌন্দর্য সে স্বচক্ষে এই প্রথম দেখল। সিনেমাতেই এসব বাড়ি চোখে পড়েছে। বাস্তবে এই প্রথম দেখল। বেশিক্ষণ তার দেখার দৃষ্টি অব্যাহত রাখতে পারল না। তার আগেই ধ্রুব তাকে টেনে নিয়ে গেল বাংলোর ভেতরে।

ভেতরে প্রবেশ করতেই রহিম চাচা এসে অহমিকে সালাম দিল। বাবার বয়সী লোকের থেকে সালাম পেয়ে অহমি একটু অস্বস্তিবোধ করছে। কোনো রকমে সালামের জবাব দিয়ে চুপ করে রইল সে। রহিম চাচা পুনরায় জিজ্ঞেস করল,

“ভালো আছেন আম্মাজান। শরীর সুস্থ আছে তো?”

অহমি এক পল ধ্রুবর চোখে তাকাল। ধ্রুব এক দৃষ্টে তার। দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখ ফিরিয়ে নিল ততক্ষণাৎ সে। ছোট্ট করে উত্তর দিল,

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি?”

রহিম চাচা প্রস্বস্ত হেসে বললেন,

“আমিও ভালা আছি আম্মাজান। আপনেরা ভেতরে যান আমি গিয়া আপনেগো খাবারের ব্যবস্থা করি।”

রহিম চাচা ওদের দু’জনের দিকে একবার তাকিয়ে প্রসন্ন হাসতে হাসতে চলে গেলেন। মনে হচ্ছে তিনি বড্ড বেশি খুশি।

রহিম চাচা চলে যেতেই ধ্রব অহমির দিকে তাকিয়ে বলল,

“ইনি হলেন রহিম চাচা। আমাদের বাড়ির পুরনো, বিশ্বস্ত কাজের লোক।”

তারপর অহমিকে সঙ্গে করে বিশাল সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল ধ্রুব। একটি বদ্ধ দরজার সামনে এসে থামল তারা। দরজার লক খুলে ভেতরে প্রবেশ করল অহমিকে সঙ্গে করেই। অহমি একটু ইতস্তত করছে তাই দরজার বাহিরেই দাড়িয়ে রইল। ধ্রুব ভেতরে ঢুকে অহমিকে না দেখে পেছন ঘুরে দরজার কাছে এলো। দরজার ভেতর থেকেই হাত বাড়িয়ে দিয়ে অহমিকে এক টানে ভেতরে নিয়ে গেল। টাল সামলাতে না পেরে অহমি গিয়ে একেবারে ধ্রুবর বক্ষে জায়গা করে নিল। আকষ্মিক ঘটনায় লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে অহমি মাথা নিচু করে নিল। দুই হাত দ্বারা ধ্রুবর বক্ষে আলতো ধাক্কা দিল ছাড়া পাওয়ার চেষ্টায়। কিন্তু দেখা যায় তাতে করে কোনো লাভ হয় না। ধ্রুব তাকে আরও একটু নিবিড় পরশে নিজের সঙ্গে আটকে নেয়। তার পুরু, চওড়া, খয়েরী বর্ণ ওষ্ঠ জোড়া এগিয়ে নেয় অহমির কর্ণের নিকটে। গাম্ভীর্যপূর্ণ, প্রগাঢ় শীতল, নেশাক্ত কন্ঠ বলে,

“এটা ধ্রুব চৌধুরীর বেডরুম। এখানে ঢোকার পারমিশন সবাই পায় না। তুমি পেয়েছ তার মানে, ‘ইউ আর ভেরি স্পেশাল পারসন।’ অত্যন্ত অমূল্য রত্ন।”

ধ্রব অহমিকে ছেড়ে দিয়ে কাবার্ড থেকে প্রয়োজনীয় পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। অহমি সেখানেই বরফের ন্যায় জমে আছে। এই মানুষ টা কাছাকাছি থাকলে তার অস্বস্তি হয় আবার ভালোও লাগে। সেই মুহূর্তে সে যেন স্ট্যাচু হয়ে যায় তবুও মন সচল থাকে। মনের মধ্যে তীব্র অনূভুতি সৃষ্টি হয় তবু ভালো লাগে। মানুষ টার হঠাৎ করা কাজ গুলোতে শুরুতে ঘাবড়ে যায় পরক্ষণেই এক শীতল স্রোত বয়ে যায় অন্তঃকোণে। অদ্ভুদ সে! অদ্ভুত পায়ের চলন! অদ্ভুত তার কথার ধরণ! তবুও বারংবার সেই অদ্ভুত্তেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে অহমি। ক্ষণে ক্ষণে হচ্ছে মুগ্ধ আবার কখনো বা হচ্ছে ভীত। আশ্চর্য সে অনূভুতি!….

.

পনের মিনিটের মতো সময় নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো ধ্রুব। একটা এ্যাস কালার ট্রাউজার। গায়ে হাফ হাতা ব্ল্যাক কালার গেঞ্জি। গলায় ঝুলছে ভেজা টাওয়াল। সেই টাওয়ালের এক কোণ দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে এগিয়ে গেল ড্রেসিং টেবিলের সামনে। আয়নাতে দেখে দেখে খুব নিখুঁত ভাবে চুলের পানি মুছে নিল। তারপর চিরুনি, জেল দিয়ে সুনিপুণ ভাবে চুলগুলো গুছিয়ে নিল। সারা শরীর পারফিউম, লোশন,ক্রিম দিয়ে পরিপাটি করে নিল।

বিছানার এক কোণে চুপটি করে বসে থেকে পুরো কার্যক্রম খুব মনোযোগ সহকারে দেখল অহমি। তার দৃষ্টি এখনো ধ্রুবতে আবদ্ধ। সহসা পারফিউমের লাস্ট টাচ আপ করতে করতে ধ্রুবর কন্ঠ ভেসে এলো,

“ভালো ভাবে শিখে রাখো। বউ ঘরে এলে আমি কিন্তু নিজে হাতে আর কিচ্ছুটি করব না। আমার সকল কাজ, সেবা তাকেই করতে হবে।”

অহমি হকচকিয়ে উঠল। শকটের মধ্যেও তার মস্তিষ্কে একটি প্রশ্ন জাগ্রত হলো। সোজাসাপ্টাই জিজ্ঞেস করল,

“আমাকে শিখতে হবে কেন? আপনার বউকে গিয়ে শেখান।”

ধ্রুব ভেজা টাওয়ালটা হাতে নিয়ে বেলকনির দিকে এগোতে এগোতে বলল, “সেই চেষ্টাই করছি।”

অহমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। এই লোকটার কথার আগামাথা সে খুঁজে পায় না। মাঝে মধ্যে বদ্ধ উন্মাদ মনে হয় নয়তো বিশেষ জ্ঞানী। অর্থাৎ গভীর জলের মাছ।

.
চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here