নিখোঁজ প্রেমের শহরে, পর্ব:১৭

#শেষ_পর্ব
#আতিয়া_আদিবা
শিহাবের সারারাত ঘুম হলো না। সে আজ গভীর চিন্তায় মগ্ন। মগ্ন তার অতীতের কথা মনে করতে। সে তার শিশুকাল পেরিয়েছে। পেরিয়েছে কৈশোরকাল। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত তার মায়ের কথার অবাধ্য সে কখনো হয় নি। তার মাকে সে সবসময় তার আইডল হিসেবে মানে। মা কখনোই তার খারাপ চায় না, মনে প্রাণে বিশ্বাস করে।
কিন্তু এখনো কি নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মত বয়স তার হয়নি? মায়ের একটি কথার অবাধ্য হলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে?
শিহাব ভাবতে লাগলো। তার মাথায় অজস্র প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এই মুহূর্তে। প্রতিটি প্রশ্নের গভীরতা অনেক। হয়তো এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর খুঁজতে খুঁজতে রাত পেরিয়ে যাবে। ঝিঁঝিঁ পোকাগুলোর ডাক থেমে যাবে। পূর্বে দেখা যাবে রঙিন আলোর ছটা। পাখিরা জেগে যাবে। কিন্তু শিহাবের যে প্রশ্নগুলোর উত্তর আজই দরকার! ঠিক এই মুহূর্তে দরকার।
______________________________________

নিয়াজ করিম করুন দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে বর্ষার দিকে। ক্ষণিককাল আগেও তার মনে হয়েছিলো মেয়েটা মজা করছে। কিন্তু যখন ব্যাগ গোছানো শুরু করলো তখন তার সন্দেহ মন খারাপে রূপ নিলো। বর্ষা সত্যি আজ ফিরে যাচ্ছে।
নিয়াজ করিম শান্ত স্বরে বললেন,
আর কটা দিন থেকে যেতি।
বর্ষা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলো। দাদার কথা শুনে সে থমকে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বলল,
না দাদু। অনেকদিন তো হলো এখানে আছি। মা নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তা করে করে চোখের নিচে কালি ফেলে দিয়েছে।
নিয়াজ বললেন,
তোর মার কাছে খবর পাঠিয়ে দে। ঝামেলা চুকে যায়।

না। আমি ফিরে যাবো।

নিয়াজ করিম আর কোনো কথা বললেন না। তিনি বিছানায় বসে ছিলেন। উঠে বারান্দায় চলে গেলেন। বর্ষা জানে নিয়াজ করিম চোখের পানি লুকাতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। বর্ষার এতে সুবিধা হলো। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে চোখের পাতাজোড়া এক করলো। মুহুর্তেই টপ টপ করে কয়েক ফোটা পানি মেঝেতে পড়লো।

বর্ষা প্রাইভেট কারে উঠলো। তার সাথে ফারুককে পাঠানো হয়েছে। বর্ষাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসবে। নিয়াজ করিম বর্ষার মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন,
তোর জন্য সবসময় আমার দোয়া আছে, বর্ষা। দেখবি খুব শীঘ্রই তোর কষ্টগুলো কোথায় হারিয়ে যাবে!
বর্ষা হেসে বলল,
দাদাজান, এখন আর কষ্ট পাই না। বরং কষ্টের অভাব বোধ করি।
নিয়াজ করিম কোনো উত্তর দিলেন না।
বর্ষা আবারো বলল,
দাদাজান, মন খারাপ হলে আবারো চলে আসবো কোনো একদিন।
নিয়াজ করিম হাসলেন। বললেন,
এই ফার্ম হাউজটা তোর। যখন ইচ্ছে এসে পরবি। কেউ মানা করবে না।
আসি দাদাজান।
সাবধানে যাস।

বর্ষা গাড়ির গ্লাস উঠিয়ে দিলো। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে। বর্ষা দেখলো, লণ্ঠল ঝুলানো সাড়ি সাড়ি গাছগুলো পেছোনে ফেলে সে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। একসময় ফার্ম হাউজের মেইন গেটের বাহিরে এসে গেলো গাড়িটি। বর্ষা গাড়ির পেছোনের গ্লাস দিয়ে তাঁকিয়ে রইলো। এবার সে ফার্মহাউজ থেকে তার সাথে করে কিছু মধুর স্মৃতি নিয়ে যাচ্ছে। শিহাবের সাথে কাটানো সময়গুলো বর্ষার কাছে মধুর বলেই মনে হচ্ছে।

রুমানার গত দুদিন ধরে প্রচন্ড জ্বর। ঈর্ষা তার পাশে বসে মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে। মেয়ের শোকে রুমানা পাগলপ্রায়! চোখের নিচে কালি। চুল উস্কখুস্ক। হেফাজত করিম ইলেক্ট্রিক সিগারেট ফুঁকছেন। রুমানা ঘুমের ঘোরে বর্ষাকে ডেকে যাচ্ছে অবিরাম। ঈর্ষা উদ্বিগ্ন। সে হেফাজত করিমকে বলল,
বাবা, ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসো। মায়ের অবস্থা ভালো না।
হেফাজত করিম ছোট মেয়ের কথা গায়ে লাগালেন না। ধোঁয়া ছেড়ে বললেন,
তোর বড় বোন বাড়িতে পা ফেলা না অব্দি তোর মা সুস্থ হবে না। খামোখা টাকা নষ্ট!

বাবা, আমি বুঝতে পারছি না। তুমি এমন বদলে গেলে কিভাবে। মা অসুস্থ আর তুমি টাকার চিন্তা করছো?

তোদের পেছোনে এতগুলো টাকা খরচ করে পেলাম কি? বড় বোন বংশের সুনামে লাত্থি মারলো। আর তোর মা আজীবন তোর বোনের সাফাই গাইলো! মা মেয়ে দুজনেই আমার কপালটা খেলো। আমি আর একটা টাকাও খরচ করতে পারবো না।

ঈর্ষা অবাক চোখে বাবার দিকে তাঁকিয়ে রইলো। তার হাত পা থরথর করে কাঁপছে। একবার ভাবলো সে দৌঁড়ে নিজের ঘরে চলে যাবে। দরজা লাগিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদবে। পরক্ষণেই মত পাল্টালো। সে নিজের ঘরে গেলে তার মাকে কে দেখবে?
ঈর্ষা ছলছল চোখে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো।
ইয়া আল্লাহ! আমার বোনটাকে ফিরিয়ে আনো।

দুপুর আড়াই টায় বর্ষা নিজের বাড়ি পৌঁছালো। হেফাজত করিম গামছা নিতে তখন বারান্দায় গিয়েছে। সে বর্ষাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখলো। গাড়িটাও সে চিনে ফেললো। তার বড় চাচার গাড়ি। নিয়াজ করিমের।
বর্ষা কলিং বেল চাপলো। এতদিন পর বাড়ি ফিরে তার অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে। ঈর্ষা এসে দরজা খুলে দিলো। ওপারে বর্ষাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঈর্ষা ক্ষণিককাল পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর ‘আপা’ বলে চিৎকার দিয়ে বর্ষাকে জড়িয়ে ধরলো। বর্ষাও নিজের বোনকে দুই বাহু প্রসার করে বুকে জায়গা করে দিলো।
ঈর্ষা কেঁদে ফেললো। ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল,
আপা, কই চলে গিয়েছিলে তুমি?

গিয়েছিলাম কোনো এক জায়গায়। ফিরে এসেছি তো। কাঁদছিস কেনো? বোকা মেয়ে!

আপা, মা অনেক অসুস্থ। তুমি ভেতোরে চলো। মার পাশে গিয়ে বসবে চলো।

আরে বোকা! আমাকে ছাড়লো তো আমি ভিতরে যাব।

ঈর্ষা তার বোনকে ছেড়ে দিল। বর্ষা ভেতরে ঢুকে সোজা মায়ের ঘরে চলে গেলো। মায়ের পাশে বসলো। মাথায় হাত রেখে চমকে উঠলো। ঈর্ষাকে বলল,
কিরে মায়ের তো অনেক জ্বর। ডাক্তার ডাকিসনি?
ঈর্ষা তার বোনকে বাবার ব্যবহারের কথা খুলে বলল। বর্ষা সাথে সাথে নিজের ঘরে গেলো। আলমারি খুলে, কাগজের নিচ থেকে কিছু জমানো টাকা বের করলো। ঈর্ষার হাতে দিয়ে বলল,
জলদি পাশের ডাক্তারখানায় যা। বলবি রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। এক্ষুণি যেতে হবে।

ঈর্ষা আর সময় নষ্ট করলো না। দ্রুত ডাক্তার আনতে গেলো।

ঈর্ষা বেরিয়ে যেতেই হেফাজত করিম ঘরে ঢুকলেন। বর্ষাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
তুই কোথায় গিয়েছিলি।

বর্ষা মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
কোথায় গিয়েছিলাম তুমি জানো বাবা। বারান্দা থেকে তুমি আমাকে দেখেছো।

হেফাজত করিম কিছুটা ভড়কে গেলেন। বললেন,
তুই কিভাবে জানলি।

বারান্দায় ঝুলানো দড়িটা নড়ছিলো। একটা অবয়ব সড়ে যেতে দেখেছি। ওটা ঈর্ষা হলে দরজা খুলেই আমায় বলতো, বারান্দা থেকে দেখেছে। যেহেতু বলে নি। তার মানে তুমি ছিলে।

তোকে না করি নি? নিয়াজের কাছে যাবি না।

বলেছো।

তাও কেনো যাস?

না বলার পেছোনে কোনো যুক্তি দেখাতে পারো নি। তাই যাই।

তুই জানিস? শালা আমার জায়গা খেয়ে বসে আছে?

বাবা উনি তোমার গুরুজন। সম্মান দিয়ে কথা বলো।

আমার সম্পত্তি খেয়ে বসে আছে। চোর। তাকে আবার কিসের সম্মান দিবো।

দাদাজান তোমার সম্পত্তি খায়নি। বরং তুমি সেটা আত্মসাৎ করার পায়তারা করছো।

কি বললি?

সত্যি কথা বলেছি। দাদাজানের বাবা ফার্মহাউজের প্রোপার্টি টুকু দুই ভাইকে গিফট করেছিলো। তোমার বাবা অর্থাৎ দাদাভাই সেটা নেন নি। তার বড় ভাইকেই পুরো জায়গাটুকু ভোগ দখল করতে দিয়েছেন। তাহলে কিভাবে সে চুরি করলো। আর ওই সম্পত্তি তোমার হলো?

এগুলো নিয়াজ তোকে বলেছে?

বাবা, নাম ধরে ডাকবে না।

নাম ধরে ডাকলে কি হবে।

বর্ষা চোখমুখ শক্ত করে বলল, তোমার মেয়ে হয়ে আমি আমার অতীতে যা করেছি তা নিয়ে গর্ববোধ হচ্ছে। যে মানুষ গুরুজনকে সম্মান দিতে জানে না তার জাত ধূলোয় মিশে যাওয়াই উচিত।

হেফাজত করিম দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে মেয়ের গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলেন এবং ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
বর্ষা চোখে পানি নিয়ে মায়ের পাশে গিয়ে বসলো।
নরম কণ্ঠে ডাকলো,
মা, ও মা! দেখো আমি ফিরে এসেছি।
রুমানা কোনো উত্তর দিলো না। সে অচেতনের মত শুয়ে আছে।

ঈর্ষা ডাক্তার নিয়ে ফিরে এসেছে। প্রচন্ড জ্বরে রুমানা জ্ঞান হারিয়েছিলো। ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের পর রুমানা চোখ মেললো। বড় মেয়েকে দেখে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন। সকল অভিমান অভিযোগের ডালা সাজিয়ে ফেললেন।
ডাক্তার কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে চলে গেলো।
_____________________________________

পরিস্থিতি শান্ত হলো বিকালের দিকে। রুমানা ওষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে। হেফাজত করিম টিভি দেখছেন। ঈর্ষা মায়ের পাশে শুয়ে বই পড়ছিলো।
বর্ষা ভাবলো একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসবে। সে রান্নাঘরে গিয়ে কড়া করে চা বানালো। তারপর ছাদে চলে গেলো।
সূর্য পশ্চিমে অগ্রসর হচ্ছে। পৃথিবীর বুকে রাত নেমে আসবে অচিরেই। হঠাৎ তার পাশে শিহাব এসে দাঁড়ালো। বর্ষা ভাবলো তার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে।
শিহাব বলল,
একা একা সানসেট দেখছেন?
বর্ষা হেসে বলল,
হুঁ। আমার সাথে সূর্যাস্ত দেখার মত কেউ নেই। তাই একা একা দেখছি।

আমি যদি আপনার সাথে সানসেট দেখি আপনার কোনো আপত্তি আছে?

না।

যদি সারাজীবন দেখতে চাই?

বর্ষা বলল,
হ্যালুসিনেশন এ প্রতিদিন আসবেন? আমার সাথে সূর্যাস্ত দেখবেন?

শিহাব অবাক হয়ে বলল,
হ্যালুসিনেশন কেনো হবে। আমি সত্যি এসেছি।

বর্ষা এবার ভালোমতো শিহাবের দিকে তাঁকালো। নিজেকে চিমটি কেটে বুঝলো শিহাব আসলেই এসেছে!

আপনি এখানে কি করছেন?

একটা প্রোপোজাল নিয়ে এসেছি।

কি প্রপোজাল?

আপনি কি আমাকে সারাজীবনের জন্য বিয়ে করবেন?

বর্ষা চুপ হয়ে গেলো। মাথা নিচু করে ফেলল।

শিহাব বলল,
আমার আপনার পাস্ট নিয়ে কোনো হেডেক নেই। তবে আপনার প্রেজেন্ট আর ফিউচার নিয়ে বেশ হেডেক আছে বলতে পারেন।

কেমন হেডেক?

আপনাকে আমি আর একটা দিনও কাঁদতে দেখতে চাই না।

বর্ষার গাল গড়িয়ে পানি পরতে শুরু করলো।
শিহাব এগিয়ে এসে বর্ষার হাত ধরলো। বলল,
প্লিজ না করবেন না। অনেক কষ্ট করে পরিবারকে রাজি করিয়ে ছুটে এসেছি। Say, yes!

বর্ষা হেসে জিজ্ঞেস করলো,
প্রেম না করেই বিয়ে করবেন?

শিহাব বলল,
এবার প্রেমটা না হয় বিয়ের পরেই হোক?

বর্ষা আচমকা শিহাবকে জড়িয়ে ধরলো। তার মনে হতে লাগলো শিহাবকে জড়িয়ে ধরার এই অনুভূতিটুকুই হয়তো প্রকৃত সুখের সংজ্ঞা!

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here