বিষাদের রঙ নীল : পর্ব-১

তূজা চোখেমুখে অন্ধকার দেখছে। হাতে থাকা কাগজের টুকরোটি মাটিতে পড়ে গেল। শরীর এভাবে জোর ছেড়ে দিল কেন! আশ্চর্য… বেসিন এক হাতে আঁকড়ে ধরে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করল তূজা। চোখের পর্দায় লেখাগুলো ভাসছে।
‘তোমার মধ্যে কী আছে জানো? মাদকতা আছে, নেশা আছে.. তার স্বাদ আমি পেয়েছি, আর বারবার পেতে চাই চয়ন। আজ যদি তুমি আমার না হও, তাহলে বিষ হাতে তোমার অফিসে চলে যাব আমি। নিশ্চয়ই কোনো তামাশা চাও না তুমি?’
এইটুকুই লেখা আছে কাগজটায়। মেয়েটির নাম-ধাম, পরিচয় কিছু না থাকলেও চয়নের সাথে তার কী ধরনের সম্পর্ক হতে পারে তা অনুমান করা খুব কঠিন হচ্ছে না তূজার পক্ষে। সাত বছরের প্রেমের সম্পর্ক, অতঃপর বিয়ের দুটি বছর- প্রতিটি মুহূর্ত চোখের সামনে ভাসছে। গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ। মনে হচ্ছে, দীর্ঘ কতগুলো বছর যাবত পানি পড়েনি গলার ভেতর। কথাগুলো কাউকে বলা দরকার, নইলে বুকটা এক্ষুনি ফেটে যাবে ধড়াস করে…
বেসিন ধরে ধরে দুর্বল শরীরে উঠে দাঁড়াল তূজা। তেজহীন কম্পমান হাতে নিচ থেকে কাগজটি তুলে নিলো। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে চললো ছাদের দিকে।

সবসময় কাপড়চোপড় ধোঁয়ার আগে শার্ট-প্যান্টের পকেটগুলো চেক করে নেওয়া তূজার অভ্যাস। আজকেও অভ্যাসবশত সবগুলোর পকেট চেক করছিল, ঠিক তখনি প্যান্টের পকেট থেকে এই কাগজটি বেরিয়ে আসে। অল্প একটুকরো কাগজ, গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয় যে বুঝতে পেরে আগ্রহ জন্মে তূজার। দেখার জন্য পুরোটা খুলতেই গোটাগোটা অক্ষরের কয়টি লাইন চোখের সামনে পড়ল। সেগুলো পড়তেই মাথা ভনভন করে উঠল তার। অজান্তেই চোখ দুটোয় জল জমেছে।

বহ্নি কাপড় মেলছিল দড়িতে। তূজা ছাদের দরজায় দাঁড়িয়েই আক্রোশ ভরা গলায় বলে উঠল, ‘তোমার দেবর আমার সাথে এমনটা কেন করল আপা?’
বহ্নি অবাক নয়নে তূজার দিকে তাকাল, ‘কী বলছিস তুই? কী করেছে চয়ন?’
‘কী করেছে? এই দেখো.. এই কাগজেই প্রমাণ আছে।’
কাগজের টুকরোটি বাড়িয়ে ধরল তূজা। ভাঁজকৃত কপাল নিয়ে বহ্নি কাগজটি মেলল। পড়তে শুরু করল। পড়া শেষ হলে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে সেও তূজার দিকে তাকাল। নিরবে তূজার চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে। সে একটু এগিয়ে রেলিং ঘেঁষে আকাশপানে মুখ করে তাকাল।

বহ্নি সম্পর্কে তার ভাসুরের বউ, ভাবী হয়। যদিও তার ভাসুর আরও বছর তিনেক আগে মারা গিয়েছে, তবুও বহ্নি এখনো এই বাড়ি ছাড়েনি। একমাত্র মেয়ে কনককে নিয়ে রয়ে গেছে। তার বাসা থেকে অনেকবার তাকে নিয়ে যেতে চেয়েছে, অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার জন্য, বহ্নি যায়নি। সে চলে গেলে কনককে কে দেখবে? যতই চাচা,চাচী,দাদী থাকুক, মায়ের ভালোবাসার সমান কেউ ভালোবাসতে পারে না। অপরদিকে ওদের শ্বাশুড়ি মমতাজও বহ্নিকে নিজের মেয়ের মতো বুকে আগলে ধরেছেন, কোথাও যেতে দেননি। বহ্নির সাথে তূজার সম্পর্কটা অনেকদিনের… বিয়ের আগে থেকে। ওদের সম্পর্কের কথা সবার আগে বহ্নিই জানতো। এমনকি যখন চয়ন বেকার বলে তূজার বাবা তূজাকে গৃহবন্দী করে ফেলেন, কোনোভাবেই চয়নের সঙ্গে বিয়ে দিবেন না, তখন বহ্নিই আগ বাড়িয়ে কথা বলেছে। চয়নের জন্য সময় চেয়েছে। তূজার বাবাকে বুঝিয়েছে। মেয়ের কান্নাকাটি আর পাগলামির কাছে হার মেনে চয়নকে তিনি ছয়মাসের সময় দিয়েছিলেন। মাত্র তিনমাস যেতে না যেতেই চয়ন বেশ ভালো মানের একটি চাকরি পেয়ে যায়। তূজার বাবা তূজাকে চয়নের হাতে দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বহ্নিকে কখনো ভাবি বলে ডাকে না তূজা। তার কাছে বহ্নি বড়বোনের মতোন।

পিঠে কারও হাতের স্পর্শ পেয়ে দ্রুত চোখজোড়া মুছে নিলো তূজা। পেছন ফিরতেই বহ্নি বলল, ‘কান্নাকাটি করছিস কেন? এটা দিয়ে এমন কিছুই স্পষ্ট বোঝা যায় না!’
‘এখানে স্পষ্ট চয়নের নামটা লেখা আছে। আর ওর সাথে এটার যোগসূত্র না থাকলে এই কাগজটা কোথাথেকে এলো? উড়ে উড়ে তো আসেনি আর!’
‘তবুও.. আগে না বুঝেই চিল্লাফাল্লা করিস না তূজা। চয়ন এমনিতেই কত ব্যস্ত থাকে সারাদিন। বাসায় এসে যদি দুদন্ড শান্তি না পায়..’
‘ওর শান্তিটাই তোমার কাছে বড়? আর আমার দিকটা? আমি যে মনে মনে অশান্তিতে মরে যাচ্ছি!!’ গলার স্বর বাড়লো তূজার। বহ্নি মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক একটা শব্দ করে সরে গেল সামনে থেকে।
‘তাহলে যা মন চায় কর। মারামারি কর গিয়ে.. যা।’

চোখ দুটো জ্বলছে ভীষণ। বুকের ভেতরটা কেমন যে করছে! এই পরিস্থিতির সম্মুখীন যে না হয়েছে সে কোনোদিনই বুঝবে না কষ্টটা… বহ্নির হাত থেকে একপ্রকার ছো মেরে কাগজটা নিয়ে নিলো তূজা। তারপর গটগট আওয়াজ তুলে সিড়িঘরের দিকে পা বাড়ালো। পেছন থেকে বহ্নি ডেকে উঠল, ‘তূজা!’
‘কী?’ তূজা ঘুরে দাঁড়াল।
‘কোথায় যাচ্ছিস?’
‘জাহান্নামে।’
‘চয়ন আসলেই ওর সাথে ক্যাটক্যাট করতে যাস না.. আবারও বলছি..’
‘আমার প্রশ্নের জবাব ওকে দিতে হবে। জবাবটুকু না দেওয়া অবধি ওকে আমি ছাড়ছি না।’ তেজ নিয়ে বলল তূজা। তারপর নিচে নেমে গেল।

বেশ কয়েকবার রিং পড়ে পড়ে কেটে গেল, চয়ন ফোন ধরল না। তূজার ইচ্ছে করছে আছাড় মেরে ফোনটাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলতে, কিন্তু সম্ভব না। আবারও ফোন লাগাল সে। এইবার তিনবার রিং পড়ার পর চয়নের গলা ভেসে এলো ওপাশ থেকে, ‘তোমার মাথায় কী ঘিলু নাই? ফোনটা যখন ধরছি না, এর মানে আমি বিজি আছি। এইটুকু সেন্সটাও কী নাই?’
তূজা কঠিন কিছু বাক্য বলতে গিয়েও বলল না। গলার মাঝে কিছু একটা আঁটকে আছে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না, এই কণ্ঠের মালিক তাকে ধোঁকা দিতে পারে! কান্না লুকিয়ে ভাঙা গলায় তূজার প্রশ্নবাণ, ‘আজকে একটু তাড়াতাড়ি আসতে পারবে?’
‘কেন?’ যেন বিরক্তি ঝরে পড়ছে চয়নের কণ্ঠ চুঁইয়ে চুঁইয়ে।
‘এ..এমনি।’
‘এটা তো আমার অফিস, আমি যখন ইচ্ছা চলে আসব। আবার যখন ইচ্ছা অফিসে আসব। নাকি এটা তোমার বাপের অফিস?’ অফিস চলাকালীন চয়নকে বিরক্ত করলে এভাবেই রেগে রেগে কথা বলে সে। পরে অবশ্য বাসায় এসে রাগ ভাঙায়ও। এমনটাই নিয়ম হয়ে গেছে এতদিনে। তবুও আজ বুকে বিঁধছে এই আচরণ, পোড়া যন্ত্রণা হচ্ছে।

তূজা চুপ বিধায় চয়নের রাগটা যেন আরও বাড়লো। গলার আওয়াজ উঁচিয়ে বলল সে, ‘কানে ফোন ধরে রাখার জন্য টাকা দেওয়া হয় না আমাকে! তোমার মতো এত অবসর নই আমি বুঝেছো? আর শোনো, আজ রাতে আমি আসব না বাসায়।’
‘কেন!!’
‘চায়না থেকে ক্লায়েন্ট আসবে। ভোর রাতে মিটিং। সকাল হবে বাসায় পৌঁছুতে। খেয়ে নিও আর ঘুমিয়ে যেও। রাখছি, বায়।’
‘চয়ন, শো..’ বাকি কথাটুকু শেষ করার আগেই লাইন কেটে গেল। তূজা ফোনটাকে সজোরে ছুঁড়ে ফেলল। সামনের দেয়ালে বারি খেয়ে টুকরো আকারে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। মুখ ঢেকে শব্দ করে কেঁদে উঠল তূজা। ক্লায়েন্ট মিটিং নাকি কীসের মিটিং- তার মনই বলে দিচ্ছে।

ফোন রাখতেই বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো বড় একটি দীর্ঘশ্বাস। পেছন ঘুরতেই লিন্ডাকে বিছানায় আধশোয়া হয়ে তার দিকেই তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু হাসল চয়ন।
লিন্ডা নখ খুঁটতে খুঁটতে বলল, ‘তোমার বউ?’
‘হুম।’ দায়সারাভাবে উত্তর দিল চয়ন।
‘ফোনটা এরোপ্লেন মুড করে রাখো চয়ন।’ অনেকটা আদেশের স্বরে বলে উঠল লিন্ডা।
চয়ন করল না। ফোনটাকে বেড সাইড টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলল, ‘আর ফোন করবে না ও। আমি জানি।’
‘বাহ! নিজের বউকে বেশ ভালোভাবেই চিনো দেখছি।’
‘নিজের বউকে নিজে চিনবো না তো কে চিনবে বলো!’
এই কথার জবাব না দিয়ে ঠোঁট ঘুরিয়ে মৃদু হেসে উঠল লিন্ডা। নাইটির ফিতা খুলতে খুলতে বলল, ‘আমাকে কতটুক চেনো?’
চয়ন উত্তর দিল না। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল সে। কেন যেন চোখের সামনে তূজার মুখটা ভেসে উঠছে বারবার। তূজার থুতনিতে ছোটমোটো গর্ত টাইপ আছে। ভীষণ সুন্দর লাগে দেখতে। কেউ ওর সাথে কথা বলতে গেলে সবার প্রথমে ওই গর্তের দিকেই চোখ পড়বে। চয়নেরও পড়েছিল। সেখান থেকেই ভালোলাগার শুরু হয়েছিল।

সম্বিৎ ফিরলো লিন্ডার ডাকে, ‘চয়ন! চয়ন..’
চয়ন বাস্তবে ফিরতে ফিরতে উদাসীন গলায় জবাব দিল, ‘হুঁ..’
‘কী ভাবছ তুমি? আমার কাছে এসে কাকে ভাবছ তুমি? হ্যাঁ?’ আর্ত চিৎকারে চয়নের কপালে ভাঁজের সৃষ্টি হলো। লিন্ডা মেয়েটা একটু পাগলাটে ধরনের। চেঁচামেচি করে খুব। আবার রাগটাও একদম নাকের ডগায়। ওর মন মতো নিঃশ্বাসটাও ফেলতে হবে যেন! চয়ন জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি আবার ড্রাগস নিচ্ছো, রাইট?’
লিন্ডার চোখমুখ থেকে মুহূর্তেই কঠিন ভাবটা সরে গেল। একটু হাসল সে। জবাব না দিয়ে চয়নের দিকে এগিয়ে গেল। চয়নের গলা দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বুকে নাক ঘঁষতে লাগল। চয়ন বলল, ‘জবাব কই?’
‘তোমায় না পেলাম, একটু ড্রাগস তো পেতে পারি! পারি না?’ অদ্ভুত আবদারের স্বরে বলে উঠল লিন্ডা। চয়ন পাল্টা উত্তর দিতে গিয়েও থেমে গেল। এই মেয়েটা ভীষণ রহস্যময়ী!

(চলবে)
বিষাদের রঙ নীল (পর্ব-১)
অলিন্দ্রিয়া রুহি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here