বিষাদের রঙ নীল : পর্ব-৫

বিষাদের রঙ নীল (পর্ব-৫)
অলিন্দ্রিয়া রুহি

শ্বাস বন্ধ হয়ে উল্টে উপুড় হয়ে পড়ে রইল তূজা। মুখের এক পাশ দিয়ে লালার মতো পিচ্ছিল পদার্থ গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে।

মাঝরাত, সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন। কেউ নেই তূজার মাথার উপর একটা হাত রাখার জন্যে! যে মেয়েটা উড়ন্ত তেলাপোকা দেখে ভয় পেয়ে বাবার পেছনে গিয়ে লুকোতো, যার একটু জ্বরে বাবা-মায়ের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যেতো, সেই আদরের তূজা আজ অন্ধকারের মধ্যে একলা একাকী বাঁচার চেষ্টা করছে। কিন্তু মস্তিষ্কের কারণে পেরে উঠছে না। বোঝা চোখদুটো বেয়েও শীতল পানি গড়াচ্ছে।

কয়েক মিনিট কাটলো। চয়ন বহ্নির ঘর থেকে বেরোলো। ড্রয়িং রুমে হালকা হলুদ বাতি জ্বলছে। সেই আলোতেই কালো মতোন কিছু পড়ে থাকতে দেখে চয়ন একটু ভয় ভয় নিয়ে এগিয়ে আসতেই চমকে উঠল। তূজা বলে একটা চিৎকারই দিয়ে উঠল সে। দ্রুততার সঙ্গে তূজাকে ধরে নিজের কোলের উপর নিলো। বহ্নিও বেরিয়ে এসেছে ততক্ষণে। অবাক নয়নে এত রাত্রে এখানে তূজাকে এই অবস্থায় দেখে তারও চক্ষু চড়কগাছ! চয়নের বুক ধুকপুক ধুকপুক করছে। তূজার বুকের উপর কান পেতে নিঃশ্বাসের উঠানামা অনুভব করার পর একটু গিয়ে স্বস্তি পেল সে। দ্রুত তূজাকে পাজাকোলে করে নিজের ঘরে নিয়ে এলো। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চোখেমুখে পানির ছিঁটা দিল। লাভ হলো না কোনো। মাথা যেন আগুন! এত উত্তপ্ত! মাথায় পানি দিয়ে দিল। হাতে-পায়ে তেল ডলে ডলে মালিশ করে দিল। একটা হুলুস্থুল কাহিনী… তনয়, মমতাজ বেগম ও উঠে পড়ল। এমনকি ছোট্ট কনকও ঘুম ঘুম চোখে চাচীর করুণ অবস্থা এসে দেখে গেল। ভোরের আলো ফুঁটতে শুরু করল, কিন্তু তূজার অবস্থা ভালোর দিকে না গিয়ে খারাপের দিকে যেতে লাগল। গা কাঁপিয়ে ধুম জ্বর এসেছে। শেষে ভোর বেলাতেই তূজাকে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো।

ডক্টর বললেন, হুট করে মানসিক ভাবে প্রচন্ড শক খেয়েছে তূজা, যেটা মেনে নিতে না পারায় তার এই অবস্থা। চয়ন ভেবে নিলো, লিন্ডার কাহিনীর জন্যেই শক খেয়েছে তূজা, কিন্তু ও তো জানে না, বহ্নির ঘরেও ওকে যেতে দেখেছে বেচারী!
ছোট্ট মস্তিষ্ক একসাথে এতচাপ নিতে পারেনি। একদিকে বহ্নি, যাকে বোন সমান জানতো, অন্যদিকে মন নিংড়ে ভালোবাসা দেওয়ার স্বামী! দু’জনেই মুখোশধারী কালসাপের ন্যায় আচরণ করেছে তূজার সাথে। কী করে সইবে সে?
সকালের দিকে চয়ন তনয়কে বলল মা’কে নিয়ে বাসায় চলে যেতে। সে আর বহ্নি এখানে থাকবে। মমতাজ বেগম যেতে চাইলেন না, বহ্নিকে তনয়ের সঙ্গে জোরজার করে পাঠিয়ে দিলেন, নিজে রয়ে গেলেন। তার মন বলছে- কিছু একটা ঘাপলা অবশ্যই আছে এখানে। নইলে সুস্থ সবল মেয়েটার কী এমন হলো যে মানসিক ভাবে এত ভেঙে পড়ল!?

দুপুরের পর পর তূজার জ্ঞান ফিরলো। আগের চেয়ে খানিকটা ভালো বোধ করল সে। চোখ মেলে মাথার কাছটায় মমতাজ বেগমকে দেখতে পেয়ে বুকটা ভরে এলো প্রশান্তিতে। মমতাজ বেগম তার সঙ্গে টুকটাক কথা বলে কপালে চুমু এঁকে দিলেন।

-এখন কেমন লাগছেরে মা?

-ভালো।

-কী হইছে তোর? আমাকে খুলে বল সব।

তূজা প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল।

-আম্মা, আমার মা, মামা কে খবর দিছেন?

-না দেই নাই। আগে তোর পরিস্থিতি বুঝতে চাইছি। তারা টেনশন করতো জানাইলে।

-ভালো করছেন। জানানোর দরকার নাই। আমি এখন সুস্থ আছি। আমারে এখান থেকে নিয়ে চলেন দ্রুত। এখানে থাকলে বরং আরও অসুস্থ হয়ে পড়ব।

মমতাজ বেগম মৃদু হাসলেন।

-আচ্ছা। চয়ন আসুক। ডাক্তারের সাথে কথা বলি আগে।

ভাত শেষে ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল তূজা। চয়নকে ডক্টরের সাথে কথা বলতে বললেন মমতাজ বেগম। ডক্টর বললেন,
-উনাকে মানসিক ভাবে কোনোপ্রকার স্ট্রেস দিবেন না। ভাগ্য ভালো ব্রেইন স্ট্রোক হয়নি। নইলে এরকম কেসে প্রায়ই রোগী ব্রেইন স্ট্রোক করে কোমায় চলে যায়। যতটা পারবেন, চিন্তামুক্ত লাইফে রাখবেন উনাকে। মানসিক ভাবে সাপোর্ট করবেন।

চয়ন মনে মনে বলল,
-আমাদের জীবনে মানসিক সুখ বলতে আর কিছুই নেই ডক্টর। আমাকে ওকে ছাড়তে হবে, নইলে তূজা কোনোদিন মানসিক ভাবে শান্তি পাবে না।

মুখে বলল,
-ওকে।

সন্ধ্যের পর পর তূজাকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। মমতাজ বেগম কড়াভাবে বলে দিলেন,
-একদম রুম থেকে বের হবি না, রেস্ট নিবি শুধু।

তূজাও বাধ্য মেয়ের মতো মেনে নিলো সবটা। যে রহস্য তাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে সেটার সবটা জানতে হলে, আগে সুস্থ হতে হবে তাকে। মানসিক এবং শারীরিক- দুই ভাবেই।

চয়নকে নিয়ে রাতে বসলেন মমতাজ বেগম। আসরে বহ্নিও আছে। তনয় বাসায় নেই। কোথায় গিয়েছে, মমতাজ বেগম জানেন না। অবশ্য সেটা তার মাথা ব্যথা নয়। মূল চিন্তা চয়ন আর তূজাকে নিয়ে। এদের সম্পর্ক যে ভালো যাচ্ছে না, এটা তিনিও বুঝতে পেরেছেন।

-চয়ন!

-জি আম্মা।

-আমার বিবাহিত জীবন ৩৬ বছর। তোর আব্বা কোনোদিন আমার গায়ে হাত তোলেন নাই বেঁচে থাকতে। আমাকে কোনোদিন রাগের মাথায়ও গালি দেন নাই। তার সন্তান তুই, কথাটা মনে রাখিস!

-হুম।

-তূজার সাথে কী হইছে তোর? আমাকে সত্যটা বল। ও কালকে যেগুলো বলছে,সেসব কী সত্যি? যদি সত্যি না হয় তাহলে কী এমন কারণে ও এত অসুস্থ হয়ে পড়ল হঠাৎ?

বহ্নি মাঝদিয়ে বলে উঠল,
-আম্মা, আমি বলছিলাম না ওর মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। দেখলেন তো? আজকে অসুস্থ ও হয়ে পড়ছিল এই কারণে। ওরে ভালো ডাক্তার দেখানো উচিত। যারা মানসিক চিকিৎসা করে…

-তুমি চুপ থাকো বউমা। তোমাকে মাঝে কথা বলতে বলি নাই!! চয়ন উত্তর দে তুই। চুপ থাকবি না।

-আমি কিছু জানি না আম্মা। ওর কী হইছে ওই জানে। আমার তো মনে হয়, ও আর আমার সাথে সংসার করতে চায় না। এইজন্যে এসব ভুজুংভাজুং কাহিনী করতেছে, যাতে আমিই বাধ্য হয়ে ওকে ছেড়ে দেই!

-ও তোরে পাওয়ার জন্য আমার পা পর্যন্ত ধরছিল, মনে আছে তোর? আর সে কীনা এখন তোর সাথে সংসার করতে চাইছে না? তাও বিয়ের দুই বছর পর এসে?

-কাকে কখন ভালো লেগে যায়, সেটা কী বলা যায় আম্মা? ওর হয়তো কাউকে ভালো লাগছে এখন। ওর আচরণও আমার কাছে সন্দেহজনক লাগে।

-ওর কাউকে ভালো লাগছে নাকি তোর কাউকে ভালো লাগছে? আর সেইটা তূজা জানতে পারছে দেখে চিন্তায় চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়ছে, কোনটা?

চয়ন উত্তর দিল না। কাচুমাচু করল। অস্থির দৃষ্টিতে বারকয়েক বহ্নির দিকেও তাকাল। মমতাজ বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

-কোনো পুরুষ যদি কোনো নারীকে বিনা কারণে কাঁদায়, তবে সেই নারীর প্রতি ফোঁটা চোখের জলের জন্য ফেরেশতা সেই পুরুষের উপর লানত দেয়। কথাটা মনে রাখিস। মিথ্যা বলে কাউকে আঁটকে রাখার চেয়ে সত্য বলে তাকে মুক্ত করে দেওয়া অত্যধিক ভালো।

চয়ন মায়ের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে আসতে ভাবল, তূজার কাছে সব সত্যি স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নেবে সে। তূজা চলে যাক, তার জীবনে অন্য কেউ আসুক। তার জীবন পূর্ণতা এবং নিখাঁদ ভালোবাসায় ভরে উঠুক। চয়নের বুক জুড়ে তো খাঁদের মেলা বসেছে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here