বিষাদের রঙ নীল : পর্ব-৬

বিষাদের রঙ নীল (পর্ব-৬)
অলিন্দ্রিয়া রুহি

চয়নকে পেছন থেকে ডেকে উঠল বহ্নি,
-এই চয়ন!
চয়ন থেমে গেল। ঘুরে তাকিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাল। বহ্নি হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে এলো।
-তোমার মতিগতি আমার ভালো ঠেকছে না। তুমি কী তূজাকে সব সত্যিটা বলতে যাচ্ছো?
চয়ন ফাঁকা ঢোক গিলে নিজের সাহস অটুট রাখল। মাথা দুলিয়ে বলে উঠল,
-হুম।

-বাহ! তুমি তো দেখছি নিজেও মরবে, আমাদেরকেও মারবে!

-আপনাদের কথা আমি বলব না। শুধু নিজের দোষ গুলো স্বীকার করে নেবো। আর ওকে চলে যেতে বলব।

-আর তাতেই ও চলে যাব ভাবছ?

চয়ন উত্তর দিল না।

-তোমার বউ যা… দেখা যাবে এর পেছনে কারা কারা যুক্ত আছে, তাদের সবাইকে চিরুনি অভিযান করে খুঁজে বের করবে। তারপর জেলের ভাত খাওয়াবে। দরকার নাই কোনো। আমি রিস্কে পড়তে চাই না। তুমি কিছুই বলবে না ওকে।

চয়ন প্রতিবাদের গলায় বলল,

-তাহলে তো ও ধুকে ধুকে মারা যাবে এভাবে। একদিনেই ওর অবস্থা দেখছেন? ও একেবারে সব সত্যিটা জানুক,বারেবারে জানার চেয়ে। আর নিজের জীবন বেছে নিক।

-তুমি না ওকে ভালোবাসো? ও চলে গেলে থাকতে পারবা?

চয়ন অল্প একটু হাসল, মলিন হাসি। জবাব দিতে পারল না কোনো। বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। তাই দেখে বহ্নি বলল,

-যা যেভাবে চলছে, চলতে দাও। কাজে মনোযোগ দাও। বউয়ে না… এই পৃথিবীতে একটা জিনিসরই মূল্য আছে, আর সেটা টাকা। ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই বুঝেছো? আর হ্যাঁ, ভুলেও ওকে কোনোকিছু বলতে যেয়ো না। এর ফল ভালো হবে না যদি বস জানতে পারে! সাবধান করে দিলাম।

বহ্নি ঠোঁট বাকিয়ে কথাগুলো বলে চলে গেল। চয়ন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। তার মাথা ঘুরছে। দ্বিধাদ্বন্দে দোদুল্যমান মন… এক মন বলছে তূজাকে সবটা জানিয়ে দিতে, অপর মন বলছে এতে তূজারও ক্ষতি হতে পারে। কী করবে চয়ন! ভেবে পেল না। হাতের আঙুল দিয়ে মাথার দুই পাশের রগ চেপে ধরে দপদপানি কমানোর চেষ্টা করল।

তূজা পাশ ফিরে শুয়ে আছে। চোখে ঘুম নেই তার। শুকনো জলেরা গাল দখল করেছে। চোখের সামনে বারবার কিছু সুমধুর স্মৃতি ভেসে উঠছে থেমে থেমে। তূজা স্মৃতির পাতায় বিচরণ করতে চাইছে না, তবুও তাকে করতে হচ্ছে।

জুম্মাবার ছিল, চয়ন গোসল শেষে বেরিয়ে আসে উন্মুক্ত শরীরে। তূজা ড্রেসিং টেবিল গোছাচ্ছিল, চয়নকে এভাবে দেখে কিছুটা থমকানো চাহনি নিয়ে আয়নার ভেতর দিয়ে তাকিয়ে রইল। ব্যাপারটা খেয়াল করে চয়ন। হেসে উঠে সে।

-এতগুলো দিন হলো বিয়ের! তাও আমাকে দেখার সাধ তোমার মিটলো না!

-আমি মরার পরও বোধহয় মিটবে না।

বলে উঠল তূজা, অনেকটা আদুরে গলায়। চয়ন থমকে গেল এবার। পরক্ষণেই মাথা ঝাকিয়ে মেকী ধমকের সুরে বলল,

-কীসব কথা!! এই তোমাকে না মানা করেছি এসব মরা-টরা ব্যাপার নিয়ে কথা বলবে না?

-কেন বলব না? মৃত্যুই তো আমাদের পার্মানেন্ট ভবিষ্যৎ আর মাটিই হলো আসল ঠিকানা। প্রতিদিনই মৃত্যুর কথা স্মরণ করা উচিত, তাহলে অন্তত খারাপ কাজগুলো থেকে নিজেকে বিরত রাখা যায়।

চয়ন পাল্টা কোনো উত্তর দিল না। চুপচাপ পাঞ্জাবি পর‍তে লাগল। তূজা হাতের কাজ থামিয়ে চয়নকে একদৃষ্টে দেখতে লাগল। অফ হোয়াইট পাঞ্জাবি, গলার একপাশে গোল্ডেনের হালকা সুতোর কাজ, হাতাতেও একই কাজ। কিছুদিন আগেই চয়ন পাঞ্জাবিটা কিনেছে। বেশ মানিয়েছে তাকে। সে কলার ঝাড়তে ঝাড়তে তূজার চোখে চোখ রাখল। তূজা হেসে বলল,
-তোমাকে দারুণ লাগছে। কেউ তুলে টুলে নিয়ে যাবে,সাবধানে যেয়ো।
প্রত্যুত্তরে চয়ন পাল্টা হাসি ছুঁড়ে দিয়েছে।
-কেউ নিলে কী? ভালোই তো হবে। তোমাতে বোরিং হয়ে গেছি। এবার একটু অন্য কিছুর স্বাদ নিতে চাই।

বলেই এক চোখ টিপেছিল তূজাকে উদ্দেশ্য করে। তূজা প্রতিবাদ করেনি, এগিয়ে এসে মেকী রাগ দেখায়নি, বরং অভিমানের পাহাড় খাঁড়া করেছে বুকের ভেতর। মৃদু ভাবে তপ্ত শ্বাস ফেলে হাতের কাজে মন দিয়েছে। চয়ন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ফাজলামো করতে গিয়ে বেশি বলে ফেলল না? চয়ন দ্রুত এগিয়ে এসে পেছন থেকে তূজার কোমড় আঁকড়ে ধরল।

-এই, সরি, সরি.. রাগ করো না সোনা। আ..আমি বুঝতে পারিনি। মজা করে বলেছি। তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি।

তূজা উত্তর দেইনি। হাতের কাজ থামায়নি। সে একমনে কাজ করে যাচ্ছে, যেন চয়নের কথা শুনতেই পেল না।

-কী হলো? কথা বলবে না? বাব্বাহ! এত রাগ? এত রাগ কই থাকে শুনি? এই খাঁড়া নাকটায়?

বলেই তূজার নাকটা জোরে টিপে ধরল চয়ন। তূজা মৃদু ধাক্কায় চয়নকে সরিয়ে দিয়ে চাপা চিৎকার করে উঠল।

-একদম ঢং করতে আসবে না!!
গরু একটা.. যাও, সরো। রাগটাও ভাঙাতে পারে না ঠিকঠাক!

-শিখিয়ে দাও।

-ইশ! ঠ্যাকা নাকি?

-হুম, ঠ্যাকায়।

চয়ন এগিয়ে এসে নিজের বাহুডোরে তূজাকে আঁটকে নিতে চাইলে তূজা চোখ পাঁকায়,
-কয়টা বাজে? নামাযে যাবেন না?

-এই রে! দেড়ি হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা আদর গুলো পেন্ডিং থাকুক, এসে করবোনি।

বলে এক ছুটে বেরিয়ে যায় চয়ন। আবার ফিরে আসে।টুপি নিয়ে যাওয়ার সময় তূজা ওর হাত ধরে থামাল। স্থির চোখে চেয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,
-আমার জন্য আল্লাহর রহমত নিয়ে এসো আসার পথে।

চয়ন মৃদু হেসে উত্তর দিল,
-আচ্ছা।

.

কারও উপস্থিতি টের পেয়ে তূজা স্মৃতির পাতা থেকে বের হয়ে আসে। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল, পরাজিত সৈনিকের মতো চয়ন দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ভীষণ ক্লান্ত, উদ্ভ্রান্তের ন্যায় দেখাচ্ছে। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল তূজার। এই মানুষটা তাকে প্রতিনিয়ত ঠকিয়েছে, ঠকাচ্ছে, তবুও এর উপর থেকে মায়া কেন সরে যায় না? মাঝে মাঝে মনে হয়, ভালোবাসার চাইতে মায়ার জোর অনেক বেশি! তূজা খুব সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস গোপন করল।চোখ সরিয়ে চয়নকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করল। একটু সুস্থ হলেই চয়নের সঙ্গে আলোচনায় বসবে সে। বহ্নি আর তার সম্পর্ক নিয়ে খোলামেলা কথা বলবে। যদি বহ্নির সঙ্গে চয়ন সংসার করতেই চায়, তাহলে তূজা আপোষে সরে যাবে। ঝামেলা তার কাছে একদম পছন্দ নয়। আর সবচেয়ে বড় কথা, ঝামেলা করেই বা লাভ কী? জোরজবরদস্তি করে চয়নকে বেঁধে রাখা যাবে? যাবে না। এতদিন ভালোবাসা দিয়েই যখন বাঁধতে পারল না নিজের আঁচলে, তখন জোর করেও সম্ভব না। নইলে তূজা একটা চেষ্টা করত। তার অবচেতন মন যে এখনো চয়ন চয়ন জপে মরে যায়!

-ত…তূজা!

ডাকতে গিয়ে কণ্ঠটা কেঁপে উঠল চয়নের। নিজেকে এতটা অপরাধী মনে হচ্ছে যে তূজার নামটা উচ্চারণ করার অধিকার তার নেই। তূজা ফিরেও তাকাল না। উত্তরও দিল না। নিশ্চুপ থেকে শ্বাস আঁটকে রাখল।

চয়ন একটু সাহস করে এগিয়ে গিয়ে বিছানায় বসল। তূজা আরও সরে গিয়ে শুলো। চয়নের শরীরের কোনো স্পর্শ সে গায়ে মাখাতে চায় না আর। চয়ন তার মনের মধ্যেই কবর হয়ে গেছে। চয়নের প্রতি ভালোবাসা টুকুন বুকের ভেতরই চাপা থাক।

-কিছু খাবে তূজা?

স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে চয়ন। প্রাণপণে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। তাকে শক্ত থাকতে হবে। যে পথ সে বেছে নিয়েছে, তাতে শক্ত না থাকলে চলবে না। আর এই পথ থেকেও সে চাইলেই বেরিয়ে আসতে পারবে না। অন্তত লিন্ডা তাকে বেরিয়ে আসতে দিবে না। চয়নের মাঝে কী এমন যাদু পেয়েছে, লিন্ডাই ভালো জানে!

চয়ন ভাবনা থামাল। তার সামনে অসহায় তূজা শুয়ে, আর সে কীনা এই মুহূর্তে এসেও লিন্ডার কথা ভাবছে? ছ্যাহঃ! বুকটা অপরাধবোধে ভরে উঠল আচমকাই। একটা সূক্ষ্ণ শ্বাসকষ্টের ন্যায় শুরু হলো।

-কী হলো? তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি তো নাকি? উত্তর কই?

-উত্তর নেই।

শান্ত অথচ দৃঢ় শোনালো তূজার কণ্ঠ। চয়নও নিজেকে শক্ত ভাবেই পেশ করার চেষ্টা করল।

-ইদানীং এর বেয়াদবি করছ কেন তূজা?

-বেয়াদবি? উমমম, চোরের চেয়ে বেয়াদবই বেশি ভালো, তাই না?

-তুমি কী আমাকে চোর বলার চেষ্টা করছ?

-চেষ্টা করছি না, বলছিই। তুমি চোর চয়ন…অনেক বড় মাপের চোর।

-আজব তো! তুমি কীসের সাথে কীসের লজিক দাও, আমি বুঝি না! আচ্ছা আমি চোর মানলাম, তা কী চুরি করেছি আমি? বলো।

-বলব? শুনতে পারবে তো সত্যবচন?

তূজা এবার উঠে খাটে হেলান দিয়ে বসল। ধারালো দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল চয়নের উদ্দেশ্যে।

-সত্যবচন না-কি তা শুনলেই বুঝতে পারব।

-আমি মিথ্যা বলি না চয়ন। তোমার মতো মিথ্যুক আমি নই। তুমি একটা মিথ্যুক, ডাহা মিথ্যুক। সাথে অভিনেতাও! কী ভালো অভিনয় যে তুমি করতে পারো! তা কোনোদিনই বিশ্বাস করতাম না,যদি না নিজের চোখে দেখতাম।

-তু..তুমি কী দেখেছো?

চয়নের কণ্ঠে বিভ্রান্তি। একটু ভয় ভয়ও লাগছে তার।

-দেখেছি, দিনের আলোয় যাকে ভাবি ভাবি ডেকে মুখে ফেণা তুলো, রাতের অন্ধকারে বউ ফেলে তার ঘরেই কী করে হানা দাও!!

তূজার চোখ জলে ছলছল করছে। চয়ন অতিশয় চমকালো। এর মানে সেদিন রাতে বহ্নির ঘরে ঢুকতে দেখেছিল তূজা আর সেই জন্যেই মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল? ওহ শিট! নিজেই নিজের হাতের তালুতে ঘুষি মেরে উঠল। হঠাৎ তূজা বাচ্চাদের মতো হামাগুড়ি দিয়ে চয়নের কাছাকাছি এলো। ভেজা কণ্ঠে একরাশ অসহায়ত্ব নিয়ে বলে উঠল,
-কেন এমনটা করলে তুমি? আমি তো তোমায় ভালোবাসায় কোনো কমতি রাখিনি! যদি ভাবিকেই তোমার পছন্দ,তাহলে আমাকে কেন মাঝে টানলে? কেন চয়ন? বড় ভাই মারা গেলে, ছোট ভাই ইজিলি ভাবিকে বিয়ে করতে পারে। এটা ইসলামেও জায়েয। তবু তুমি আমাকে বিয়ে করলে। তারপর বহ্নি ভাবির সাথে…! ছিঃ চয়ন, ছিঃ তোমাকে ধিক্কার জানাই। পৃথিবীতে অনেক বাজে মানুষ দেখেছি, কিন্তু তোমার মতো কাউকে দেখিনি। কোনোদিন দেখব বলে ভাবিও নি। আর তুমি, তুমিই আমার সাথে এমন করলে? তুমি তো জানতে আমার এই খানে…

তূজা কথা থামিয়ে চয়নের একটা হাত নিয়ে হৃদপিণ্ডের উপরে রাখল। বলল,
-ঠিক এইখানে তোমার বসবাস। তোমাকে আমি সবকিছুর উর্ধ্বে ভালোবাসি। তোমার থেকে একটা ধমক পেলে আমার মন ভার হয়। আর এতবড় একটা চমক পেলে মনটাই খান খান হয়ে ভেঙে যাবে। জেনেও কীভাবে পারলে আমাকে এতোটা কষ্ট দিতে? বলো? বাবা নেই আমার। মাথার উপর ছায়া বলতে তোমাকেই বুঝতাম। পৃথিবীতে বাঁচার কারণ বলতে তোমাকেই খুঁজতাম। সেই আজ আমার বাঁচার কারণ আমাকে মৃত্যুর ঠিকানা দেখিয়ে দিল! ভালো চয়ন, ভালো… আমি সরে যাব। তুমি তো আমাকে ভালোবাসা না তাই না? তাহলে আমার চলে যাওয়ায় কীই-বা আসে যায়?

তূজা শান্ত কণ্ঠে কথাগুলো বললেও তার দু’গাল বেয়ে ঝরঝর করে জলপ্রপাতের মতোন অশ্রবিন্দু গুলো ঝরছে। চয়ন থামাতে পারল না নিজেকে এবার। তূজার কষ্টের মাত্রা পরিমাপ করতে পেরে পাগল প্রায় হয়ে উঠল। দ্রুত তূজাকে নিজের আলিঙ্গনে চেঁপে ধরতেই দিকদিশা হারিয়ে ফেলল তূজা। নিজেকে ধরে রাখতে পারল না আর কিছুতেই। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। চিৎকার করে বলল,
-কেন এমন করলে চয়ন, কেন এমন করলে…

তারপর পরই চয়নের বুকের উপরেই নেতিয়ে পড়ল তূজা। ইতিমধ্যে তার চিৎকার শুনে মমতাজ বেগম,বহ্নি,কনক সবাই এসে দরজায় ভীড় জমিয়ে ফেলল। মমতাজ বেগম ঢুকতে ঢুকতে প্রশ্ন করলেন,
-কী হইছে, কী হইছে!
চয়ন উত্তর দিতে পারল না কোনো। সে একবার বহ্নির দিকে ঘৃণা ভরা চোখে তাকাল। বহ্নি অবাক হয়ে দেখল, চয়নের দুই চোখের কার্নিশ উপচে সমানে জল গড়াচ্ছে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here