বিষাদের রঙ নীল : পর্ব-৭

বিষাদের রঙ নীল (শেষ পর্ব)
অলিন্দ্রিয়া রুহি

পিটপিট করে চোখ মেলতেই নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করে তূজা। মাথার কাছে মমতাজ বেগমের প্রতিচ্ছবি। তূজাকে চোখ মেলতে দেখে উনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন।

-বউমা! বউমা শুনতে পাচ্ছো আমাকে?

তূজা ধীর ভাবে মাথা নাড়ালো। উঠে বসার চেষ্টা করলে শরীরটা অত্যধিক দুর্বল লাগায় আবার শুয়ে পড়ার তাগিদ জানালো। মমতাজ বেগম বললেন,
-উঠার দরকার নাই। শুয়ে থাক মা।

-আম্মা, উনি কই?

-বাসায়।

-আমাকে নিতে আসবেন না?

মমতাজ বেগম খানিকটা রাগ নিয়ে বললেন,
-ওর কথা তুলিস না তুই। তোকে এত কষ্ট দিল আর তুই কী-না এখনো ওকে ভেবেই মরছিস।

তূজা ক্ষণকাল সময় চুপ করে থেকে বলল,
-আপনি সব জানেন আম্মা?

-জানি। তোকে হাসপাতালে আনার আগে শুনছি। আমার পা ধরে মাফ চাইছে ও। কী কী করছে তার সবটাই স্বীকার করছে।

তূজার চেহারায় রক্তিম আভা ফুঁটে উঠল। ক্ষীণ স্বরে বলল,
-আপনি অনেক কষ্ট পাইছেন, না আম্মা?

-কষ্ট পাইলেও বা কী? এগুলা তো সমাধান হইয়া যাবে না। ও মরুক, ও মরলেই শান্তি পাই আমি।

তূজা আঁতকে উঠে বলল,
-এসব কী বলছেন আম্মা! ছিঃ ছিঃ এমন বলবেন না।

মমতাজ বেগম নিরব রইলেন। কথা বাড়ালেন না। তূজাও চুপ করে রইল। রাতের দিকে বহ্নির ফোন আসলো। মমতাজ বেগম ফোন কানে নিয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে শুনলেন। তারপর তার হাত থেকে আপনা আপনি ফোন পড়ে গেল বিছানায়। ব্যাপারটা লক্ষ করল তূজা। সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসল সে। তার মন কু গাইছে। তার উপর বহ্নিও বা ফোন করে কী এমন বলল! যার কারণে মমতাজ বেগমের হাত থেকেই ফোনটা পড়ে গেল? বুঝে উঠতে পারল না তূজা।

তূজা উৎকণ্ঠা নিয়ে ডাকল,
-আম্মা!

মমতাজ বেগম বিমূঢ় হয়ে রইলেন। তূজা শ্বাশুড়ির বাহু খপ করে টেনে ধরলেন,
-ও মা.. কী হয়েছে? বলুন আমাকে!

মমতাজ বেগমের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। সে তূজাকে বুকে টেনে শক্ত হাতে ধরে চয়নের মৃত্যুর খবরটা দিলেন।

তূজা অজ্ঞান হওয়ার পর মমতাজ বেগম হামলে পড়েন চয়নের উপর। কী চলছে দুজনের ভেতর, কেন তূজা এমন করছে- এর জবাব তাকে দিতেই হবে। চয়ন আর মিথ্যে বলতে পারেনি তখন। নিজের করা সকল পাপকর্মের কথা অবলীলায় বলে দেয় মা’কে। তূজার বাবা যখন ওর বিয়ে দিতে চাচ্ছিল, চয়ন তখন সদ্য মাস্টার্স পাশ করা এক বেকার যুবক। হন্যে হয়ে ঘুরেও কোথাও ভালো চাকরি পাচ্ছিল না। ঠিক তখনই বহ্নি তাকে মিজানের কথা বলল। আপাদমস্তক মিজান একজন বিজনেস ম্যান হলেও, গোপনে সে মেইল স্কর্টদের লিডার। বিবাহিত, অবিবাহিত, ডিভোর্সি বিভিন্ন বয়সের নারীরা টাকার বিনিময়ে ফূর্তি করতে চাইলে মিজানকে জানাত। বিনিময়ে মিজান তাদের সামনে দাঁড়া করাতো সব ক’টি টগবগে যুবককে। তাদের মধ্যে থেকে যাকে পছন্দ হতো, তারা বেছে নিত। এর বিনিময়ে বেশ চড়া মূল্য পেতো মিজান। তা থেকে অর্ধেক দিয়ে দিত যুবক দের। এভাবেই সে দিনে দিনে টাকার পাহাড় গড়ে তুলছিল। চয়নকে প্রথমে একটা ভালো চাকরির অফার করে মিজান। ওই অফিসে যোগদানের কয়েকদিনের মধ্যেই চয়ন সবকিছু জেনে যায়। প্রথম প্রথম সে আগ্রহ প্রকাশ করেনি এই পেশায় আসার জন্য। কিন্তু টাকার পরিমাণ দেখে লোভ ধরে রাখতে পারেনি নিজের। তূজাকে আরও ভালো সচ্ছল জীবন যাপন করানোর জন্য মিজানের দ্বিতীয় অফারটিও সানন্দে গ্রহণ করে। দুইজন ডিভোর্সি মহিলার পর তৃতীয় বারে লিন্ডার সাথে দেখা হয় চয়নের। এরপর থেকে আর কারও সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ চয়নের হয়নি। একমাত্র লিন্ডাই তাকে ব্যবহার করত এবং চড়ার চেয়েও চড়া মূল্য দিত। কতবার যে চয়নকে ভালোবাসার কথা বলেছে! চয়ন বিবাহিত জানার পরেও। চয়নকে রাজী করাতে পারেনি। তবুও হাল ছাড়েনি লিন্ডা। কয়েকদিন বাদে বাদে দু-একদিনের জন্য চয়নকে ডেকে নেওয়া হতো। তখন অফিসের কাজের চাপ অথবা বিজনেস ট্রিপের কথা বলে এদিকটা সামলাতো চয়ন। আর মাথার উপর মিজান তো আছেই সব সামলে নেওয়ার জন্য!

বহ্নিও মিজানকে নতুন নতুন নারী এনে দিত। বিনিময়ে সেও কিছু টাকা পেত। এইজন্যেই দ্বিতীয় বিয়ে করেনি বহ্নি। কারণ আরেকবার বিয়ে করলে সংসারের মায়াজালে এমনভাবে আঁটকা পড়বে সে যে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কাজ করতে পারত না তখন। অথচ সবাই ভেবেছে, কনকের জন্য বহ্নি বিয়ে করতে আগ্রহী হয়নি! আসলেই মানুষ শুধু উপরের দিকটাই দেখে। ক’জন ভেতরের রূপ দেখতে পায়?

সেদিন রাতে বহ্নিই তার রুমে চয়নকে ডেকেছিল। চয়ন কেন ভুল করে তার পকেটে লিন্ডার কাগজ রেখেছিল, তা জানতে। চয়নকে সাবধান করেছিল, নইলে তারা সবাই-ই বিপদে পড়ে যেত। অথচ বেচারি তূজা ভেবেছে, চয়নের সঙ্গে বহ্নির অবৈধ সম্পর্ক আছে?
আচ্ছা, তূজাও কী সত্যিই বেচারি? নাকি তারও অন্য কোনো রূপ আছে?

দেখা যাক!

চয়নের লাশটা দেখার সৌভাগ্য তূজার হয়েছে। তার সামনে নিথর দেহটা শুয়ে আছে। জিভটা ঝুলে ছিল, কয়েকজন মিলে সেটাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে নইলে ভয়ংকর দেখাচ্ছিল। ঠোঁট দুটো হালকা নীল বর্ণ ধারণ করেছে। চোখেমুখে বিষন্নতার ছাপ, খুব কষ্ট পেয়ে যে মারা গেছে- তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মমতাজ বেগম উদ্ভ্রান্তের ন্যায় বিছানায় শুয়ে আছেন। তার দুই চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরছে। তার মনে পড়ছে, চয়নকে বলা শেষ কথাগুলো।

তূজাকে দ্বিতীয়বার হাসপাতালে নেওয়ার জন্য চয়ন খুব তোরজোর লাগালে মমতাজ বেগম তাকে থামিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমার ফুলের মতো বউয়ের শরীরে তোর স্পর্শ আর একটাও আমি লাগতে দিবো না। তুই একটা অপবিত্র, নোংরা কীট, তোকে আমি পেটে ধরেছি, ভাবলেই ঘৃণা হচ্ছে! মরে যা তুই… বেঁচে থেকে আমার জ্বালা যন্ত্রণা আর বাড়াস না।

চয়ন স্তব্ধের ন্যায় মায়ের কথাগুলো শুনে অন্য রুমে চলে গিয়েছিল। তারপর তনয়কে বলে তূজাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। বহ্নিকে ঘরেই রেখে গিয়েছিল কনককে দেখার জন্য। আর চয়ন, সে সেই তখনি ঘরের দরজা আঁটকে দিয়ে ঝুলন্ত ফ্যানের সঙ্গে গলায় দড়ি দিয়েছিল। তূজাকে যখন হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বের করা হচ্ছে ঘর থেকে, সে তখন এই পৃথিবী ছেড়েই চলে গিয়েছিল। তার হাতে মুঠো পাকানো ছিল তূজার ওড়না… তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়াতে গড়াতে একসময় তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল!

অনেকক্ষণ চয়নের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজায় বারংবার নক করে বহ্নি। তার আশংকা জন্মে মনের ভেতর। তাই শেষে লোক ডাকিয়ে দরজা ভাঙালে চয়নকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

হাটুতে মুখ গুঁজে ‘দ’ ভঙ্গিতে বসে আছে তূজা। তার মা আর মামা খবর পেয়ে তূজাকে নিতে এসেছিল সেদিনই। যেখানে স্বামীই নেই, সে সংসারে থেকে আর লাভ কী? একটু শোক সামলে উঠলে অন্যথায় বিয়ে দেওয়ার কথা ভেবে দেখা যাবে। কিন্তু তূজা যায়নি। বহ্নিও তাকে আঁটকে ফেলেছে, যেতে দেয়নি। চয়নের মৃত্যুর পর প্রায় ৪ মাস অতিবাহিত হয়েছে। তূজা এখনো সেই আগের ন্যায়, মন মরা… মাঝে মাঝে কেঁদে ওঠে একাকী। তার মনে হয়, চয়ন ওর আশেপাশেই আছে। তখন ভড্ড ভয় লাগে তূজার। মাঝরাতে চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে উঠে সে। এই নিয়ে মমতাজ বেগম পেরেশানিতে আছেন। বহ্নিকে নিয়ে একদিন আলাপে বসলেন তিনি।

-বড় বউমা, ছোট বউমার বয়সটা একদম অল্প। আর ওর ইদ্দতকালীন সময়টাও তো পার হয়ে গেছে। এখন ওকে ওর মায়ের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়ায় ভালো হয়। ওর মা, মামা ভালো পাত্র দেখে ওকে বিয়ে দিক। ওর জীবনের একটা গতি হলো। নইলে কী সারাজীবন এখানে থেকে জীবন টা শেষ করে দিবে?

বহ্নি ভ্রু কুঁচকালো।

-ওকে তো জোর করে আঁটকে রাখিনি আম্মা। ও নিজেই তো ও বাড়ি গেল না। এখানে ওর প্রথম স্বামীর সমস্ত স্মৃতি। শত হোক, প্রথম স্বামীকে কোনো মেয়েই মন থেকে মুছতে পারে না।

-তাহলে কী এভাবেই জীবন টা পার করবে ও?

-না, তা করবে কেন। আবার বিয়ে হবে, আর বিয়েটা দিবেন আপনি।

মমতাজ বেগম নড়েচড়ে বসলেন,

-আমি?

-হ্যাঁ, আম্মা। আপনাকে এবার আসল কথাটা পাড়ি। ছেলে তো আমাদের ঘরেই আছে।

-তুমি কার কথা বলছ বড় বউমা?

-কেন, তনয়ের কথা? তনয় যে তূজার জন্য কতকিছু করছে, সেসব কী আপনি চোখে দেখেন না আম্মা? তূজার পছন্দের খাবার দাবার নিয়ে আসে, তূজাকে সবসময় হাসাতে চেষ্টা করে, তূজার দিকে খেয়াল রাখে, এসব কীসের ঈঙ্গিত বুঝেন না?

মমতাজ বেগম বিমূঢ় হয়ে রইলেন। কোনো জবাব দিলেন না।

-আমি তো প্রথমেই বুঝছি যা বুঝার৷ তারপর একদিন তনয়কে ধরলাম। জিজ্ঞেস করতেই সব বলে দিল, সে নাকি তূজাকে খুবই পছন্দ করে। আর ভাই মারা গেলে বিধবা ভাবীকে তো বিয়ে করাই যায়। যদি সেই ভাবীর অনুমতি থাকে আর পিতামাতার ও অনুমতি থাকে। দেখুন আম্মা, তনয় একটা আবদার করেছে, ও সহজে কারো কাছে কিছু চায় না। ওর আবদারটা মেনে নিন। আর তূজা তো খারাপ মেয়ে না৷ উল্টো চয়ন ওকে বিয়ের পর থেকেই ঠকিয়েছে, কষ্ট দিয়েছে। এবার অন্তত তনয় ওকে ভালো রাখুক। ওর জীবনে সুখ, আনন্দ আসুক। প্রথম স্বামীর স্মৃতিও কাছে থাকল৷ আবার সুখেও থাকতে পারল দ্বিতীয় বিয়ে করে। ভেবে দেইখেন৷

মমতাজ বেগম চিন্তায় পড়ে গেলেন৷ তলে তলে এত কিছু ঘটে গেল, অথচ তিনি একদমই টের পেলেন না! তার মন ছিল কোথায়? বুক ফুঁড়ে নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসলো উনার। বহ্নির কথাগুলো পারতপক্ষে ঠিকই লাগছে। তূজা খুব ভালো মেয়ে, সংসারী মেয়ে। তার সাথে তনয়ের কিছু একটা হলে, মন্দ হয় না। তনয় না হয় রাজী, কিন্তু তূজা? ও রাজী হবে?

এক বিকেলে তূজা ছাদে উদাসীন হয়ে বসেছিল, মমতাজ বেগম তার কাছে গিয়ে পাশে বসলেন। তূজা শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে অল্প একটু হাসল।

-কীরে মা, এখানে একলা একলা বসে আছিস কেন?

-এমনিই আম্মা! ভালো লাগে না তাই৷

-ইয়ে মানে…তোকে একটা কথা বলতাম, তুই কিছু মনে করিস না।

-বলুন আম্মা।

-তোর বয়সটা আর কতই বা? অনেক কম! অনেকের এই বয়সেও বিয়ে হয় না, আর তুই তো বিধবার তকমা গায়ে লাগিয়ে ফেলেছিস। যাক গে, আসল কথাটা বলি। আমি ভাবতেছি, তোকে আবার বিয়ে দেওয়ার কথা। আমি যদি পাত্র ঠিক করি, তুই করবি বিয়ে?

মমতাজ বেগম আগেই তনয়ের কথা বললেন না। তূজার হাবভাব আগে বুঝতে হবে।

তূজা একটু চমকালো যেন। পরমুহূর্তেই কপালের ভাঁজ গুলো মসৃণ হয়ে উঠল।

-আম্মা, আমি লজ্জা পাচ্ছিলাম বলতে কিন্তু আমিও এটাই চাই। যতদিন একলা থাকব, চয়নের স্মৃতি আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে। ওকে নিয়ে বাজে স্বপ্ন দেখব, যা আমার রাতের ঘুম হারাম করে দেবে। তাই আমিও লাইফে আগাতে চাই আম্মা। কিন্তু আপনি কী না কী মনে করবেন ভেবে আর বলি নাই।

মমতাজ বেগম মনে মনে শান্ত হলেন।

-যাক, আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে তো হয়েই গেল। পাত্র কে জানতে চাইবি না?

-পাত্রও দেখে ফেলেছেন আপনি? বলেন আম্মা, কে সে?

-আমাদের তনয়। তোকে আমার কাছ ছাড়া করব না আমি।

বলে তূজাকে একহাতে পেঁচিয়ে ধরলেন তিনি৷ তূজা লজ্জায় লাল হয়ে অস্ফুটস্বরে বলল,

-তনয় ভাই!

মমতাজ বেগম মৃদু ধমকের স্বরে বললেন,
-আজ থেকে এসব ভাই-টাই বাদ৷ আল্লাহ চাইলে আগামীকাল আমি তোদের বিয়ে পড়িয়ে দিব একদম ঘরোয়া ভাবে৷ তোর মাকেও বলছি। সেও রাজী। সে শুধু চায়, তোর একটা গতি হোক।

পরদিন, রাত্র বেলা। কিছুক্ষণ আগেই তনয় আর তূজার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। তূজাকে একটা লাল জামদানি পড়িয়ে তনয়ের রুমে নিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। বহ্নি চলে যেতে চাইলে তূজা তার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
-ধন্যবাদ।

বহ্নি হাসল, কিছু বলল না৷ এরই মধ্যে তনয় রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালে বহ্নি চলে গেল। তনয় রুমে ঢুকে দরজা আঁটকে ফেলল। তূজা ঘোমটা সরিয়ে নিচে নামল। তনয়ের দু’হাত নিজের দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
-অবশেষে আমরা এক হলাম!
প্রত্যুত্তরে তনয় মুচকি হেসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তূজাও তার পাশে গিয়ে বসতেই তনয় তূজার শরীরকে নিজের দিকে টেনে নিলো।
তূজা একদম ঘাবড়ালো না, বরং সাড়া প্রদান করল।
এমনটাই তো হবার কথা ছিল! চয়নকে বিয়ে করে এই বাড়িতে আসার পাঁচ মাসের মাথায় তূজা জানতে পারে, চয়ন খারাপ কাজে লিপ্ত হয়েছে অতিরিক্ত টাকা কামানোর নেশায়। খবরটা তাকে তনয়ই দিয়েছিল। সেইদিনের পর থেকে তনয়ের সঙ্গে ভাবটা বেশি হয়ে গেল তূজার। অপরদিকে চয়নের কারণে ভেঙে পড়ল মনে মনে।তখন তনয় তূজাকে সময় দেওয়া শুরু করল। তূজার মন ভালো করার খোরাক হলো। এভাবেই পার হচ্ছিল প্রতিটি দিবস-রজনী! একসময় তূজা টের পেল তার ভেতরে ভালোবাসা নামক যে সত্ত্বাটা এতদিন চয়ন চয়ন করত, এখন সেটা তনয় তনয় করে। তনয়কে জানিয়েও দিল তূজা, ভেবেছিল তনয় তাকে খারাপ মেয়ে ভাববে। উল্টো তনয়ের থেকেও গ্রীন সিগন্যাল পায় সে। তারপর থেকেই সবার আড়ালে তনয়-তূজার রামলীলা চলতে থাকে। ধরাও খায় একদিন, তবে সেটা বহ্নির কাছে। চয়নের খাবারে ঘুমের ওষুধ মিক্সড করে দিত তূজা। চয়ন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলে সে পা টিপে টিপে চলে যেত তনয়ের কাছে নিজেকে মেলে ধরতে। এভাবেই একদিন মুখোমুখি হয় বহ্নির। তূজা অত্যধিক ভয় পেয়ে গেলেও বহ্নি তাদের উল্টো সাপোর্ট করল। বহ্নিরই প্ল্যান ছিল, মানসিক ভাবে একদম গুড়িয়ে দিয়ে চয়নকে পথের মাঝ থেকে সরিয়ে ফেলার জন্য। তূজাও তাই করল এবং ফলাফল চয়ন নিজেই তাকে পাপীষ্ট ভেবে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করল। অথচ বেচারা যদি জানত, সব কিছুই তূজার অভিনয় ছিল! ড্রামা ছিল!

কেটে গেছে তিন তিনটে বছর। বহ্নির মনে হচ্ছে মৃত্যু ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই তার। মিজানের সঙ্গে কখন যে সে নিজেও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল, বলতে পারল না। আজ চার মাস যাবত মিজানের সন্তান বহ্নি তার পেটে নিয়ে ঘুরছে। শ্বাশুড়ি মাও ইদানীং অন্যরকম চোখে তাকান তার দিকে, কিন্তু কিছু বলেন না। আর ক’দিন গেলেই পেট ফুলে ঢোল হবে৷ তখন কীভাবে লুকোবে বহ্নি? ওদিকে মিজান তাকে আর তার সন্তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য স্রেফ মানা করে দিয়েছে। বহ্নি গিয়েওছিল এবোরশন করাতে, কোন যাদুবলে যে বাচ্চাটা রয়ে গেল! কত ওষুধ খেল , গেল না। বাচ্চার হাত-পা এখন গজাচ্ছে। ডক্টররাও বলে দিল, এবোরশন সম্ভব না। বহ্নির ইচ্ছে করছে ছাদ থেকে ঝাপ দিয়ে পড়ে যেতে। জীবন তাকে কোন মোড়ে নিয়ে দাঁড় করালো!

তনয় বারবার তাগাদা দিচ্ছে তৈরি হওয়ার জন্য। তূজা দুর্বল মনটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

-ডক্টর তো কম দেখালাম না তনয়৷ লাভ তো হয়নি কিছু! তোমার আমার কপালে সন্তানের ভালোবাসা নেই।এটা মেনে নাও।

তনয় খেঁকিয়ে উঠল।

-ঘরে যদি আরেকটা সতীন আনতে না চাও তাহলে দ্রুত রেডি হও,যাও।

অগত্যা তূজা রেডি হতে লাগল। তার চোখে জল টলমল করছে। এতদিন হয়ে গেল! কম চেষ্টা তো করল না৷ একটা বাচ্চার অস্তিত্বই কোনোভাবে ধারণ করতে পারছে না সে! এসব কী চয়নের অভিশাপ? নাকি কর্মের ফল? তূজার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে রিকশা নিল ওরা। দু’জনের মুখই অন্ধকারাচ্ছন্ন। ডক্টর সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, দুজনের মধ্যেই সমস্যা আছে। কোনো উপায়েই বাচ্চা কনসিভ হবে না তূজার আর তনয়ের বীর্যতেও সমস্যা রয়েছে৷ একটি বাচ্চা দত্তক নেওয়া ছাড়া উপায় নেই তাদের।
তূজা ভাবল, বলবে, চলো একটা এতিম বাচ্চা দত্তক নেই, কিন্তু তার আগেই একটা ঘটনা ঘটে গেল। রিকশাওয়ালা ছিটকে লাফ দিয়ে সরে গেল, আর পুরো রিকশার উপর একটা ট্রাক উঠে চলে এলো। তনয় বা তূজা কিছু বুঝে ওঠার আগেই যমদূত কে দেখতে পেল। তূজা দেখল, যমদতের ঠিক পেছনে চয়ন দাঁড়িয়ে আছে। তার ঠোঁটে মুচকি মুচকি হাসি৷ সে হাতছানি দিয়ে তূজাকে ডাকছে!

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here