বিষাদের রঙ নীল : পর্ব-২

বিষাদের রঙ নীল (পর্ব-২)
অলিন্দ্রিয়া রুহি

তূজার চোখ ইতিমধ্যেই ফুলে উঠেছে। মেয়েটা একদম কাঁদতে পারে না। বাবার সবচেয়ে প্রিয় মেয়েটি তূজা, একমাত্র মেয়ে বলে কথা! কখনো সামান্য আঁচড়টাও লাগতে দেননি তিনি। মা যদি বকতো, বাবা মা’কে ধুঁয়ে দিত একদম! এত আদরের মেয়ের চোখে কখনো জলটাও জমতে দেননি। বিয়ের পর চয়নও কখনো এতটা কষ্ট দেয়নি, যতটা আজ হচ্ছে… সবটা এখনো পরিষ্কার না তূজার কাছে। তবুও তার মন বারবার কু গাইছে। ভেতর থেকে কেউ একজন চিৎকার করে বলছে,
-তুই ঠকছিস তূজা.. ভীষণ খারাপ ভাবে ঠকেছিস।

ঝিম ধরা মাথা নিয়ে ধীর পায়ে উঠে দাঁড়াল তূজা। ঠিক তখনি দরজায় তনয়ের মুখটা উঁকি দিল,
-ভাবি, মা ডাকছে আপনাকে।

বলেই চলে গেল তনয়। এক সেকেন্ড ও দাঁড়াল না। চয়নের ছোট ভাই, সম্পর্কে তূজার দেবর। পড়াশোনা করছে এখনো। পাশাপাশি কীসের যেন বিজনেস করে বন্ধুরা মিলে, ভালো ইনকাম হয়। আর্থিক দিক দিয়ে খুব ভালো অবস্থানে আছে চয়নের পরিবার। অথচ এরাই আগে দুইবেলা ঠিকঠাক ভাত খেতে পারত না! কী এমন আলাদিনের চেরাগ পেয়েছে দু-ভাই, কে জানে!
ভাবনার গতিপথ বৃদ্ধি করে না তূজা। বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে মাথায়ও খানিক পানি ঢালল। শরীরটা একটু ঝরঝরে লাগছে এখন। গামছা দিয়ে হাতমুখ মুছে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এগোলো রান্নাঘরের দিকে।

ঘরে দুটো বউ থাকলেও রান্নাবান্নার দায়িত্ব এখনো মমতাজ বেগমেরই হাতে। তিনি বলে দিয়েছেন,
-যতদিন শরীরে জোর আছে, অতদিন আমিই করি। আমি দুর্বল হয়ে গেলে তারপর নাহয় তোমরা করো।

আজকে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। কারণ সকাল থেকেই আকাশে মেঘের ঘনঘটা। তূজা রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে আঁটসাঁট ভাবে দাঁড়াল। ভাঙা কণ্ঠে বলল,
-আম্মা!

মমতাজ বেগম খুন্তি ঘোরাতে ঘোরাতেই চোখ তুলে তাকালেন,
-কোথায় ছিলে বউমা? কতক্ষণ যাবত ডাকছিলাম!

-এইতো, ঘরেই ছিলাম।

-দেখো তো, খিচুড়িতে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কী-না।

একটা বাটিতে অল্প একটু খিচুড়ি তুলে তূজার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন তিনি। তূজা নিল। একটুখানি মুখে দিয়ে বলল,
-অনেক ভালো হয়েছে খেতে।

মমতাজ বেগম মৃদু হাসলেন। বহ্নি ঠিক তখনি রান্নাঘরে ঢুকল। মমতাজ বেগম বললেন,
-ভর্তার সবকিছু তৈরি করে ফেলেছ বড় বউমা?

বহ্নি একনজর তূজার দিকে তাকাল, তূজাও বহ্নির দিকে তাকাল। দু’জনের চোখাচোখি হতেই বহ্নি চোখ সরিয়ে নিল। ব্যস্ত গলায় বলল,
-ভর্তা নিয়ে আপনি চিন্তা কইরেন না আম্মা। আমি সব রেডি করতেছি।

-আচ্ছা।

বলে নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন মমতাজ বেগম।
তূজা ছোট্ট করে বলল,
-আমি কাপড়গুলো ধুঁয়ে দিয়ে আসি আম্মা।

-এখনো ধোওনি? এতক্ষণ কী করলে তাহলে?

যুতসই কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। বহ্নি তূজার অবস্থা বুঝতে পেরে বলল,
-আমার সঙ্গে ছাদে ছিল।

-ওহ!

তূজা দ্রুত পায়ে রান্নাঘর ছাড়ে।

বাহিরে আলো নিভে এসেছে। আর কিছুক্ষণ পরেই অন্ধকার তার ঝাপি থেকে আঁধার নামিয়ে মায়াজাল সৃষ্টি করবে আনাচে কানাচে। ঘুম ভাঙতেই আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে চয়ন। শরীরটা হালকা লাগছে খুব। জড়ানো চোখে হাত হাতড়ে পাশটা খালি পেয়ে পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল। ঠিক তখনি কফি মগ হাতে লিন্ডা রুমে প্রবেশ করল।

-শুভ বিকেল!

মিষ্টি কণ্ঠে বলে উঠল লিন্ডা।
প্রত্যুত্তরে চয়ন অল্প একটু হাসল।

-মুখ ধুঁয়ে নেবে আগে? নাকি কফি খাবে?

জানতে চায় লিন্ডা। চয়ন বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে জবাব দেয়,
-বাসী মুখে সকালের চা ভালো লাগে, বিকেলেরটা না। পাঁচ মিনিট দাও, ফ্রেশ হয়ে আসছি।

-ওকে!

চয়ন বাথরুমে ঢোকে। লিন্ডা গিয়ে বারান্দায় কফির আয়োজন করতে লাগল। ফ্রেশ হয়ে সোজা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল চয়ন। তার পরনে শ্যাওলা রঙের ট্রাউজার,উদোম পেটানো শরীর। লিন্ডা এক পলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। চয়ন ব্যাপারটা লক্ষ্য করে কটাক্ষ সুরে বলল,
-মনে হলো আমাকে খালি গায়ে দেখে লজ্জা পাচ্ছো!

লিন্ডা ভ্রু কুঁচকে ফেলল এহেন কথায়,
-তোমাকে দেখে লজ্জা পাব! আমি? সিরিয়াসলি!

-তাহলে ওভাবে চোখ সরালে কেন?

-সে তো তোমাকে এভাবে দেখলে আবার কী যেন হচ্ছে শরীরে। এখন আর গোসল করার ইচ্ছে নেই মিস্টার। তাই!

-আচ্ছা!

হাসল চয়ন। একটা বেতের চেয়ার টেনে বসে পড়ল লিন্ডার পাশে। লিন্ডা কফি মগ ঠেলে দিল, চয়ন নিরব মুখে চুমুকের পর চুমুক দিয়ে গেল।

কিছুক্ষণ কাটার পর আচমকা লিন্ডা বলে উঠল,
-আচ্ছা চয়ন, তোমার ওয়াইফের থেকে আমি নিশ্চয়ই অনেক সুন্দরী, তাই না?

-হুম।

ছোট্ট করে উত্তর দিল সে।

-আমার টাকাপয়সার ও অভাব নেই! আমাকে যে বিয়ে করবে সে পায়ের উপর পা তুলে আজীবন খেতে পারবে। তাই না?

-হ্যাঁ।

-তারপরেও তুমি কেন বিয়ে করো না আমাকে? কেন ছেড়ে দিচ্ছো না তূজাকে? আমার সবদিক থাকা সত্ত্বেও কেন তোমাকে নিজের করে পাই না, বলো!

লিন্ডার কণ্ঠ করুণ শোনালো। চয়ন চোখ সরিয়ে ধসূর অন্তরীক্ষে রাখল। কিছু একটা ভেবে বলল,
-কারণ তূজার কেউ নেই।

-মিথ্যে! ওর মা আছে। মামা আছে!

হৈহৈ করে উঠল লিন্ডা।

-বাবা তো নেই। বাবা যার থাকে না, তার মনে করো কিছুই থাকে না।

-ও এখনো যুবতী। আবার বিয়ে হয়ে যাবে। তখন ওর নিজের পরিবার হবে। তুমি তো ওর সঙ্গে সুখে নেই। তাহলে কেন শুধুশুধু এই সম্পর্ক টেনে টেনে আগাচ্ছো চয়ন?

-কে বলল, আমি ওর সাথে সুখে নেই?

-তুমি ওর সাথে সত্যিই সুখী?

-হ্যাঁ।

-তাহলে আমাকে কেন কাছে টানো চয়ন? কীসের জন্য তুমি…

লিন্ডার কথা শেষ না হতেই চয়ন বলে উঠল,
-আমি তোমাকে কাছে টানিনি। তুমি আমাকে কাছে টেনেছো লিন্ডা। এখনো টানছো।

-তুমি বলতে চাইছো আমি জোর করছি তোমাকে!

-উঁহু.. আমি বলতে চাইছি আমাদের সম্পর্কটা দেনাপাওনার। এর বাহিরে আর কিছু ভাবাও ঠিক না।

কথাটি ভীষণ ভাবে লিন্ডার গায়ে লাগল। তাকে পাওয়ার জন্য এত এত মানুষ অপেক্ষায়, আর সে চয়নকে জোরজবরদস্তি কাছে টানছে? এমনটা ধারণা চয়নের? সে কী ভাবে নিজেকে! অভিমানে ভার হয়ে যাওয়া কণ্ঠটাকে নাড়িয়ে লিন্ডা বলে উঠল,
-ঠিক আছে। আমি আর কিছু ভাবতে চাই না। আমি যেহেতু তোমাকে জোর করে কাছে টানছি, তাহলে তুমি এখন থেকে যা চাও তাই হবে।

-সত্যি?

-হুঁ। কী চাও বলো।

চয়ন সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিল,
-আজকের রাতটা আমি মুক্তি চাই। আমি বাসায় যেতে চাই।

লিন্ডা নিষ্পলক চেয়ে রইল চয়নের চোখে। চয়ন চোখ সরালো না। সে এতদিনে বুঝে গেছে,মেয়েটা বাহির থেকেই শক্ত, ভেতর থেকে নরম, ভঙ্গুর। লিন্ডাই চোখ সরিয়ে নিল। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
-ওকে ফাইন, ইউ আর ফ্রী নাও। গো..

প্রত্যুত্তরে একটি কথাও বলল না চয়ন। উঠে দাঁড়াল, বিছানার উপর থেকে নিজের শার্ট-প্যান্ট নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। বাসায় চলে যাওয়ার জন্য যে খুশিটুকু তার চোখেমুখে লিন্ডা দেখেছে, সেই খুশিটুকু সে তার সঙ্গে থাকাকালীন সময়েও দেখতে চায় চয়নের চোখে। কিন্তু আদৌ তা সম্ভব কীনা কে জানে!
কিছুক্ষণ পর চয়ন বাথরুম থেকে বের হলো এবং বেরিয়ে গেল। আকাশে বাতাসে আযানের মধুর ধ্বনি বাজছে তখন। লিন্ডা আলগোছে চোখে জমা জলটুকু মুছল।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here