প্রীতিকাহন পর্ব ১৭+১৮

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_১৭

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

কালো হিজাবের ফাঁকে দৃশ্যমান নয়নে বিস্ময় ভাসিয়ে কপাল কুঁচকালো মিষ্টি, “প্রীতিকাহন? এটা আবার কী?” নবাব ওর উপর ঝুঁকে আছে বিষয়টা এখন ভালো করে চোখে লাগতে, মিষ্টির কপালের ভাঁজ এবার দ্বিগুণ হলো,”তার আগে সোজা হয়ে বসো।”

ভ্রু নাচিয়ে নবাব জানতে চাইলো, “কেন?” এই বলে আরও ঝুঁকে আসতে মিষ্টি পিছিয়ে গেল। কিন্তু বেশি পেছানোর আগে নবাবের বুকে দু’হাতে ধাক্কা দিয়ে রেগেমেগে বললো, “আশ্চর্য! এভাবে কি কথা বলা যায়? আর তুমি ওখান থেকে আমার পাশে এসে কেন বসলে?”

ধাক্কা খেয়ে কিঞ্চিৎ সরে বসলেও নবাব মিটিমিটি হাসছে৷ ওকে হাসতে দেখে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো, “তোমাকে আমি বুঝতে পারি না কেন?”

চোখে বিস্ময় আর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে নবাব বললো, “বুঝতে যেও না। নবাবের ভালোবাসায় পড়লে আর রক্ষে থাকবে না।” এমন কথা নবাব আগেও বলতো কিন্তু মিষ্টি হেসে উড়িয়ে দিতো। আজকে মিষ্টির হাসি এবং রাগ কোনওটাই প্রকাশ পাচ্ছে না। নবাবকে ঝুঁকে আসতে দেখে রাগটা যেমন এসেছিল, আচম্বিতে তেমনই মিলিয়ে গেল।

“বললে না তো প্রীতিকাহন কী?” মায়া জড়ানো কন্ঠ শুনে নবাব অবাক হলো, “এসব তুমি শুনবে?”

মাথা নুইয়ে মিষ্টি বলতে শুরু করলো, “জানি না। আমার না নিজেকেও কেন যেন ভীষণ অপরিচিত লাগে। এতসব হয়ে যাওয়ার পরও কত নিশ্চুপ আমি। তোমার অন্য একটা রূপ দেখেও শব্দহীন আমি। আমার তো উচিত ছিল তোমাকে গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা। তোমাকে প্রচন্ড রকমের ঘৃণা করা। সবকিছু বুঝেও যেন অবুঝ সেজে বসে আছি।”

ইঞ্জিনের শব্দে কানে তালা লাগার মতো অবস্থা। কিন্তু তীব্র শব্দ উপেক্ষা করেও মিষ্টির কথাগুলো একে একে ঠিকই পৌঁছে যাচ্ছে নবাবের কানে। মায়া জড়ানো মিষ্টির কথাতে নবাবও ওর প্রতি অন্য এক মায়া অনুভব করলো। তাই একটু এগিয়ে এসে আদুরে গলায় বললো, “তোমার যা ইচ্ছে হয় করতে পারো। আমি কখনও আপত্তি করবো না কিন্তু তিক্ত রাগে আমার হৃদয় দগ্ধ করো না। তোমার রাগ ব্যতীত আমি সব গ্রহণ করতে রাজি। যদি আমার হৃদয় চাও তবে সেটাও তোমার হাতে তুলে দিবো।”

ফিকে হেসে মিষ্টি তাকালো নবাবের দিকে, “সাহিত্য গুরু, আপনার সাহিত্য সমাচার অন্যদিন না হয় শুনবো। এখন প্রীতিকাহন নিয়ে বলো। এই নিয়ে তিনবার জানতে চাইলাম। এবার না বললে কিন্তু…” মিষ্টির কথার মাঝেই নবাব বললো, “আজকে থাক অন্য কোনওদিন বলবো।”

“কেন?” অবাক হলো মিষ্টি।

“এটার বিশ্লেষণ করলে তোমার মনে হবে আমি সত্যিই সাহিত্যিক হয়ে গিয়েছি। তাই অন্য কোনওদিন বলবো।”

“তবে এখন কি নিরবতা পালন করবে?”

“নাহ, তা কেন করবো? এসব ছাড়াও তো কতকিছু করার আছে। এই যেমন ধরো, নৌকায় আমি তুমি ছাড়া কেউ নেই। মাঝি আছে কিন্তু আমাদের আশেপাশে বিরক্ত করতে আসবে না।”

“তো?” আঁড়চোখে তাকাতেই নবাব ঘাবড়ে গিয়ে হালকা হাসবার চেষ্টা করলো।

“না মানে…” নবাব আমতা-আমতা করতে শুরু করলে মিষ্টি বললো, “পানিতে ডুবে মরতে চাও?” প্রশ্ন করে স্থির দৃষ্টিতে তাকালো মিষ্টি। ওর চেহারায় হালকা রাগ ভাসছে। নবাব বুঝতে পারছে মিষ্টি তার ইশারা বুঝেছে বলে রাগ প্রকাশ করছে। সব বুঝেও নবাব পাত্তা না দিয়ে বললো, “আশ্চর্য! আমি কি অন্যায় কিছু বলেছি?”

“নাহ, আপনি অনেক ন্যায় কিছু বলে ফেলেছেন কিন্তু ভবিষ্যতে এমন ন্যায় কিছু বলতে শুনলে খুব খারাপ হবে।” এই বলে মিষ্টি মুখ ঘুরিয়ে সোজা হয়ে বসলো। আর এতেই নবাব ওর কানের কাছে এসে ফিসফিস করলো, “ভালোবাসি বলাটা যদি অন্যায় হয়। তবে এই অন্যায় করতে আমি হাজারবার রাজি। আমার তোমাকেই চাই মিষ্টি, তোমাকেই চাই। এই তোমার জন্যই তো আমি নিজের জীবন রেখেছি বাজি।”

.

বিছানাকান্দি না গিয়েও হোটেলে ফিরতে রাত হয়ে গেল মিষ্টি আর নবাবের। দুপুরে খাবারে তেমন কিছু খাওয়া হয়নি বলে শরীরও বেশ দূর্বল লাগছে। আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে যখন নবাব সিএনজি ভাড়া করেছিল, তার আগে কিছু শুকনো খাবার কিনে নিয়েছিল। সেগুলো দিয়েই মধ্যাহ্নভোজ শেষ করেছিল।

রুমের দরজা বন্ধ করে পরিশ্রান্ত মুখে নবাব বললো, “আমি আগে ফ্রেশ হয়ে আসি।”

“ঠিক আছে।” মিষ্টি জবাব দিলো।

নবাব তোয়ালে এবং কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। এদিকে মিষ্টি বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে পড়লো। ক্লান্ত হাতে ধীরে ধীরে হিজাব এবং বোরকা খুলে পাখার হাওয়ায় গা জুড়োতে লাগলো। হঠাৎ ওর পাশে থাকা নবাবের ফোনে দৃষ্টি পড়তে চমকে উঠলো। শব্দ বিহীন ফোনে আলো জ্বলছে। মিষ্টি কৌতূহল বশত ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো অর্ষা নামের একটা মেয়ে কল করেছে।

সাত-পাঁচ না ভেবে মিষ্টি কল রিসিভ করলো কিন্তু হ্যালো বলার আগেই শুনতে পেল, “থ্যাঙ্ক গড। আমি তোমাকে এই যে কল করি তুমি রিসিভ করো না কেন নবাব?… যাক, এখন কল রিসিভ করেছো আই অ্যাম সো হ্যাপি।” এতোসব কথা শুনে মিষ্টি অবাক হওয়ার পাশাপাশি ক্ষুব্ধ হলো। থমথমে গলায় সে বললো, “হ্যালো।”

মেয়েলি কন্ঠের হ্যালো শব্দ কানে পৌঁছানো মাত্র অর্ষার হাসিখুশি কন্ঠে বিষন্নতা ভিড় করলো, “কে আপনি?”

“সেটা হয়ত আপনার না জানলেও চলবে।” কাটকাট করে জবাব দিলো মিষ্টি।

“আপনি নবাবকে ফোন দিন।”

“আপনার পরিচয়?” দাঁতে দাঁত চেপে মিষ্টি প্রশ্ন করলো।

বেশ ভাব নিয়ে অর্ষা জবাব দিলো, “আমি ওর এক্স।” মূহুর্তেই মিষ্টির চোয়ালের পেশী টানটান হলো। রাগের তীব্রতায় চোখ বুজে এলো কিন্তু হঠাৎ ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হলো। চোখ মেলে মিষ্টি সেদিকে তাকিয়ে দেখলো নবাব দাঁড়িয়ে আছে।

তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে বের হতে গিয়ে থমকে গেল নবাব। নিজের ফোন মিষ্টির হাতে দেখে সে থতমত খেল। তবে সবচেয়ে বেশি অবাক হলো মিষ্টির রাগী মুখ দেখে।

নবাবকে দেখে মিষ্টি তড়াক করে দাঁড়িয়ে পড়লো। নবাবের চোখে চোখ রেখে যথেষ্ট রাগ নিয়ে অর্ষাকে জবাব দিলো, “যেখানে সম্পর্কের ছিটেফোঁটা নেই, সেখানে নির্লজ্জের মতো এমন শব্দ উচ্চারণ করতে মুখে বাঁধেনি?” এই বলে ফোনটা বিছানায় ঠাশ করে রেখে দিলো মিষ্টি। এরপর কাপড়চোপড় নিলো ফ্রেশ হওয়ার জন্য। নবাবকে পাশ কাটিয়ে যখন ওয়াশরুমে ঢুকলো, তখন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অনেক কিছু বুঝিয়েছিল সে নবাবকে। কিন্তু নবাব বুঝতে পারেনি এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল।

শব্দ করে যখন মিষ্টি ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করলো, তখন দরজার দিকে লক্ষ্য করে নবাব বলে উঠলো, “বাব্বা! রেগেমেগে তো ফায়ার দেখছি। কিন্তু ফোন ধরার জন্য তো আমার রাগ হওয়ার কথা।… কার সাথে কথা বলছিল মিষ্টি?”

বিছানার ওপর তোয়ালে রেখে ফোন হাতে নিলো নবাব। স্ক্রিন ওপেন হতে দেখলো অর্ষার নাম ভাসছে এবং এখনও কলে আছে। একটা চাপা বিরক্তিতে ভ্রুকুঞ্চন হলো নবাবের। সেই সাথে নবাবের মুখ বিকৃত হয়ে নিসৃত হলো ছোট্ট একটা ইংরেজি শব্দ, “Bitch.”
#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_১৮

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

প্রচন্ড রাগে নবাব নিজের ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে দিলো। মিনিট পাঁচেক বিছানায় ঝিম মেরে বসে থেকে আবার উঠে দাঁড়ালো। ওয়াশরুমের দরজার দিকে আঁড়চোখে তাকালো। ওয়াশরুমের ভেতর থেকে পানির শব্দ খুব জোরে ভেসে আসছে। হঠাৎ নবাবের মনে হলো মিষ্টিকে একবার ডাকা প্রয়োজন। ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়িয়েও থেমে গিয়ে ভাবলো, “নাহ, বাইরে থেকে ওর প্রতিক্রিয়া আন্দাজ করতে পারবো না। যা হওয়ার হবে আমি বরং রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে আসি।”

বিছানা থেকে ফোন নিয়ে নবাব রুমের বাইরে চলে এলো৷ দরজা তালাবন্ধ করে পা বাড়ালো খাবারের সন্ধানে। প্রায় আধঘন্টা পর খাবারের ব্যবস্থা করে রুমে প্রবেশ করলো। খাবার রেখে চারপাশে মিষ্টিকে খুঁজতে গিয়ে দেখলো ওয়াশরুম থেকে এখনও পানির শব্দ আসছে। এতে নবাবের হৃদয় আঁতকে উঠলো অজানা একটা ভয়ে। এক প্রকার ছুটে এসে নবাব দরজা ধাক্কাতে শুরু করলো, “মিষ্টি?”

পানির শব্দ ব্যতীত অন্য কোনও শব্দ শুনতে না পেয়ে নবাব আরও অস্থির হলো। দরজায় ধাক্কা দেওয়ার তীব্রতা বাড়ার সাথে কন্ঠস্বরও দ্বিগুণ হারে বাড়লো, “মিষ্টি… মিষ্টি…মিষ্টি…?”

ভারী কন্ঠে অস্ফুট প্রশ্ন এসে নবাবের কানে ধরা হলো, “কী হয়েছে?”

কিঞ্চিৎ স্বস্তি পেলেও নবাবের অস্থিরতা কমলো না, “সেই কখন ওয়াশরুমে ঢুকেছো। এখনও হয়নি?” মিষ্টি জবাব দিলো না কিন্তু নবাব কান পেতে দাঁড়িয়ে রইলো জবাবের আশায়। হঠাৎ পানির শব্দটা শোনা গেল না।

প্রায় পাঁচ মিনিট পর ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হতে নবাব এক কদম পিছিয়ে গেল। কিন্তু মিষ্টিকে দেখে নবাব হতভম্ব হয়ে গেল। মুখ-চোখ লাল হওয়ার পাশাপশি ফুলে ফেঁপে উঠেছে। চোখ নামানো এবং মুখমণ্ডল ভেজা তবুও স্পষ্টত ঐ চেহারা বুঝিয়ে দিচ্ছে মিষ্টি এতক্ষণ কাঁদছিল।

“মিষ্টি?” নামটা উচ্চারণ করতে গিয়ে নবাবের কন্ঠস্বর কেঁপে উঠলো। মিষ্টি নবাবের সাথে থেকেও এমন লুকিয়ে কেঁদেছে বলে তার ভেতরটা যেন তীব্র অনলে জ্বলছে।

মিষ্টির দৃষ্টি চঞ্চল হলেও সে নবাবের দিকে তাকালো না। নবাবকে এড়িয়ে যাবার জন্য সে পা বাড়ালো কিন্তু নবাব হাত ছড়িয়ে অবিশ্বাসের চোখে জানতে চাইলো, “এমন করলে কেন? আর করছোই বা কেন?”

মুখের চারপাশে থাকা খুচরো চুল থেকে চুইয়ে পানি পড়ছে৷ ভেজা গাল বেয়ে যখন সেটা গড়িয়ে পড়ছে, তখন শিরশিরানি অনুভূতি হচ্ছে। তাই ভেজা মুখ ওড়না দিয়ে মুছে চোয়াল শক্ত করলো মিষ্টি। ওর এমন মুখপানে তাকিয়ে নবাব জিজ্ঞেস করলো, “চুপ করে কেন আছো? এভাবে কেঁদে কাকে কষ্ট দিতে চাইছো তুমি?… আমাকে?” এবার চোখ তুলে তাকালো মিষ্টি। ওর চোখ লাল হয়ে আছে। অতিরিক্ত কান্নায় চেহারায় একটা লাবন্যতা ভাসছে। অতি অল্প সময়ের এই চেহারা দেখে নবাবের মনে হয়েছিল, মিষ্টিকে অন্যরকম লাগছে।

“সরে দাঁড়াও আমার সামনে থেকে।” মিষ্টির কন্ঠে জোর নেই। কান্না মিশ্রিত কন্ঠ হলেও রাগের তীব্রতা কান্নার চেয়ে বেশি।

“আমি আমার প্রশ্নের উত্তর চাই।”

“উত্তর আমার অজানা।” দাঁতে দাঁত চাপলো মিষ্টি।

“সারাদিন জার্নি করে এসব নিতে পারছি না মিষ্টি।” নবাবের কন্ঠেও স্পষ্ট রাগ দেখা গেল।

“আমি তো কাউকে কিছু নিতে বলেনি।”

নবাব নিজেকে শান্ত করবার চেষ্টায় বললো, “ঠিক আছে, তাহলে খেয়ে নাও।”

“মরে গেছে আমার ক্ষুধা। এবার আমিও মরতে চাই।” হঠাৎ করে চিৎকার করে উঠলো মিষ্টি আর পরক্ষণেই কাঁদতে শুরু করে বেলকনির দিকে ছুটতে শুরু করলো।

“মিষ্…” নবাব পুরো নামটা উচ্চারণ করতে গিয়েও থেমে গেল। প্রচন্ড রাগে এবং কষ্টে তার মাথা যেন ঘুরছে৷ একহাত কপালে আর অন্য হাত কোমড়ে রেখে সে মনে মনে কারোর উপর ফুঁসে উঠলো, “অর্ষা, এখন যদি সামনে পেতাম। তবে ক্রসফায়ারে শেষ করে দিতাম।” নবাব বুঝতে পারছে মিষ্টির মাঝে হঠাৎ করে আসা পরিবর্তনের কারণ অর্ষা। নিশ্চিত হওয়ার জন্য নবাব মিষ্টির কাছে ইনিয়ে-বিনিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু মিষ্টি অর্ষার ব্যাপারে কোনো কথাই তুললো না অথচ কেঁদে-কেটে একসা করে ফেলেছে।

বেলকনির মেঝেতে হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে মিষ্টি। হাঁটুর উপর দুইহাত রেখে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। এমন দৃশ্য দেখামাত্র নবাবের হৃদয় আত্মচিৎকার করে উঠলো অতি গোপনে। মিষ্টির চোখ থেকে আগেও অজস্র অশ্রু ঝরেছে। সে নিজেও মিষ্টিকে বহুবার কাঁদিয়েছে। কিন্তু এই মূহুর্তে ওর কান্নায় নবাবের সহ্য ক্ষমতাকে ভঙ্গুর করছে।

হাঁটু ভেঙে মেঝেতে বসে মিষ্টি মাথায় হাত রাখলো নবাব তৎক্ষনাৎ মিষ্টি ওর হাত সরে দিলো। পুনরায় নবাব হাত রাখতে গেল আর মিষ্টি আবারও হাত সরিয়ে দিলো। মিষ্টি সোজা হয়ে বসছে না এমনকি নবাবকে না দেখেই বার-বার হাত সরিয়ে দিচ্ছে। নবাবের বোধগম্য হচ্ছে মিষ্টির রাগ কিন্তু সে নিজের মাঝে থাকা রাগটা মিষ্টিকে দেখাতে চাইছে না। তাই আবারও মিষ্টির মাথায় হাত রাখলো কিন্তু মিষ্টি ওর হাত সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে নবাব এবার মিষ্টির ডান হাত দুই হাতে চেপে বললো, “এই মিষ্টি, কেন এমন করছো? আমার কি এসব খুব ভালো লাগছে?” নবাব যখন হাত ধরেছে, তখনই মিষ্টি মাথা তুলে তাকিয়ে ছিল। এখন নবাব এমন প্রশ্ন করতে চোখ সরিয়ে সোজা হয়ে বসেছে। কান্না থামিয়ে অনবরত নাক টানছে। নবাবের হাতের মুঠোয় বন্দি হওয়া নিজের হাত ছাড়াতে মিষ্টি কোনও চেষ্টা করেনি।

পরম যত্নে মিষ্টির হাত নিজের বুকে আগলে নবাব জানতে চাইলো, “এই মিষ্টি, আমার অপরাধ কী বলো? আজকে তো সব ঠিকঠাক ছিল৷ পান্থুমাই গেলাম, দু’জনে কত আড্ডা দিলাম। তবে এরাতে কেন এমন রাগের পসরা সাজিয়ে আমায় কষ্ট দিচ্ছো?”

“আমার আর কী কী সহ্য করতে হবে বলতে পারো?” কান্নায় ভারী হওয়া কন্ঠে প্রশ্ন করে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মিষ্টি। নবাব স্পষ্ট দেখতে পেল মিষ্টি কাঁপছে রাগ এবং চাপা কান্নায়।

“শুধু আমার ভালোবাসাটা সহ্য করো মিষ্টি, অন্যকিছু সহ্য করতে হবে না।” সহানুভূতির সুরে নবাব বললো।

“ভালোবাসা? কীসের ভালোবাসা? তুমি… তুমি এখনও অর্ষার সাথে…” প্রচন্ড ঘৃণায় মিষ্টি মুখ ফিরিয়ে নিলো বাক্য অসম্পূর্ণ রেখে। এবার নিজের হাতের অস্তিত্ব নবাবের হাতে অনুভব করে সেটা ছাড়াতে চেষ্টা করলো। মিষ্টি যত হাত টানছে, তত নবাব শক্ত হাতে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরছে।

হাত ছাড়াতে ব্যর্থ হয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মিষ্টি। এরপর ফুঁসে উঠলো, “হাত ছাড়ো আমার।”

“সব জেনেও কেন তুমি অর্ষাকে টানছো? তুমি কি জানো না ওর আর আমার মাঝে কী ছিল?”

“না, আমি জানি না। তুমি আমার হাত ছাড়ো নয়ত চিৎকার করবো আমি।”

“করো চিৎকার। আমিও চিৎকার করেই বলবো, আমি তোমাকে ভালোবাসি আর ভালোবাসার অধিকারে হাত ধরেছি।”

মিষ্টি অন্য হাতে নবাবের হাত সরিয়ে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টায় করছে। আর নিজের হাতের দিকে লক্ষ্য করে নবাবকে বলছে, “যাকে অন্য মেয়ে হাজারবার কল করে খোঁজে, যাকে অন্য মেয়ে বড় গলায় প্রাক্তন দাবী করে; তাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।”

মিষ্টি যেই হাত নবাবের হাত থেকে ওর হাত সরাতে ব্যস্ত ছিল, সেই হাত শূন্যে চেপে নবাব ধীর গলায় বললো, “ভালো তো বাসো না আমায়, তাই না? তবে অর্ষার ফোনকলে এতো রি-অ্যাক্ট কেন করছো? কাউকে ভালো না বাসলে তো হিংসে হওয়ার কথা নয়, কাউকে ভালো না বাসলে তো এত কষ্ট পাওয়ার কথা নয়।” নবাবের কথা শুনে মিষ্টি থমকে গেল। নবাবের হাতে নিজের দুই হাত বন্দি রেখে ধীরে ধীরে মাথা নুইয়ে নিলো। আচমকা শান্ত হয়ে যাওয়া মিষ্টির কাছে নবাব জানতে চাইলো, “এই মিষ্টি, তবে কি তুমি আমায় ভালোবাসো?”

চকিতে মিষ্টি তাকালো নবাবের দিকে, “এড়িয়ে যেতে চাইছো বিষয়টা? নিজের কথার মারপেঁচে আমাকে ভুলাতে চাইছো?”

“কী বলছো তুমি এসব? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“তোমাকে বুঝতে হবে না। তুমি আমার হাত ছাড়ো। এক কথা আমি বারবার বলতে পারবো না।” মিষ্টি যতটা রাগ নিয়ে কথাগুলো বললো, নবাব ততটাই শান্ত গলায় বললো, “ছাড়ার জন্য কি হাত ধরেছি?” নবাব এবার মিষ্টির দুই হাত এক করে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মিষ্টির দিকে। মিষ্টি মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে বিধায় সে নিজেই বললো, “অর্ষার সাথে প্রথম দেখা, ওর প্রপোজ করা, ওর সাথে কথা বলা; কোন বিষয়টা তুমি জানো না মিষ্টি? এমন কি ওর সাথে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার বিষয়টাও তুমি জানো। আমি তোমাকে সবকিছুই বলেছি তবুও এমন কেন করছো?”

“যোগাযোগ বন্ধ হলে তোমাকে হাজারবার কেন কল দেবে? আমাকে সব কথা জানাও বলেই আমি নিজেরও চেয়ে বেশি তোমাকে বিশ্বাস করি। কিন্তু সেই বিশ্বাস কি তুমি নষ্ট করতে চাও প্রাক্তনকে দিয়ে?”

একগাল হেসে, “মিষ্টি, আমার না অসম্ভব রাগ উঠছে কিন্তু রাগটা প্রকাশ না করে শান্ত আছি৷ কেন জানো? তোমাকে আমি না চাইতেও অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। তাই এখন আর কষ্ট দিয়ে ব্যথিত করতে চাই না। সবারই একটা অতীত থাকে মিষ্টি, আমারও ছিল। কিন্তু সেই অতীতেও আমার সঙ্গী হিসেবে তুমি ছিলে। আর বর্তমান এবং ভবিষ্যতে কেবল তুমিই থাকবে।” নবাবের কথা শুনে মিষ্টির রাগ উবে যেত দেখলো সে। নবাব ভাবলো মিষ্টি এবার কিছু বলবে। কিন্তু নবাবের ভাবনার বাইরে গিয়ে মিষ্টি বলে উঠলো, “হাত ছাড়ো আমার।”

একই কথা আবার শুনে দাঁত কিড়মিড় করলো নবাব, “তুমি কি এলার্ম টিউন? হ্যাঁ? রাগে যেই কথা একবার বলো, সেটা শুধু বলতেই থাকো।”

“হাত ছাড়ো আমার।” বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিষ্টি আবারও এই কথা বললো। এতে নবাব রাগ হওয়ার পরিবর্তে শরীর দুলিয়ে হেসে উঠলো আর মিষ্টির হাত ছেড়ে দিলো। নবাবকে হাসতে দেখে চোখ নামিয়ে মিষ্টিও মুচকি হাসলো এবং ভেজা চোখে হাত বোলালো।

বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নবাব বললো, “এলার্ম টিউন একটা।” এরপর দরজার কাছে এসে ফিরে তাকিয়ে বললো, “এই যে মিস টিউন, খেতে এসো। বাকি ঝগড়াটা কালকের জন্য তুলে রাখো।” প্রতুত্তরে মিষ্টি চোখ নামিয়ে নিলো আর একটু লজ্জা মাখা হাসি নবাবকে ছুঁড়ে দিলো।

.

“এই আপু, আজকে স্কুলে কী হয়েছে জানো?”

কলেজ থেকে ফিরে নাওয়া-খাওয়া সেরে ঘুম দিয়েছিল মিষ্টি। এখন ঘুম থেকে জেগে উঠে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হলো। এক গ্লাস পানি পান করে ফোন হাতে নিতে দেখলো নবাব ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। বিছানায় পা তুলে বসে মিষ্টি জানতে চাইলো, “কী হয়েছে?”

প্রায় সাথে সাথেই জবাব দিলো নবাব, “আমাদের স্কুলে নতুন একটা মেয়ে এসেছে।”

“তাতে কী হয়েছে?”

“কী হয়নি সেটা জানতে চাও।”

চোখ উল্টে মিষ্টি ছোট্ট নিশ্বাস ফেললো। এরপর জবাব দিলো, “ভাই, ফোনে টাকা অতি স্বল্প। তাই অল্প কথায় পুরো কাহিনি বলো।”

“আরে হ্যাঁ, তোমাকে তো কেবল কোচিং-এর ফোন দেওয়া হয়েছে। এতে আবার টাকাও দেওয়া হয় না তেমন। আমার তো চিন্তা নেই। আমি মায়ের ফোন দিয়ে কাজ চালাই। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো মা বুঝতেও পারে না টাকা কোথায় গায়েব হয়।”

মিষ্টি উত্তর দিলো, “বুঝলাম ভাই কিন্তু মেয়েটা কে? নাম কী?”

“অর্ষা।”

…চলবে

)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here